• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৭ | জানুয়ারি ২০২০ | গল্প
    Share
  • ফোঁস : দেবাশিস দাস


    সন্ধেবেলা ঘরে ঢুকে আলো জ্বালাতে গিয়েই হোল বিপত্তি। ফটাস্ করে একটা জোর শব্দ হয়ে উজ্জ্বল ভাবে জ্বলে উঠেই নিভে গেল ২০০ ওয়াটের বাল্বটা। চোখের ওপর লাফিয়ে নামল নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। অন্ধকারে ঘরে ঢুকতে অস্বস্তি হচ্ছিল ঈশানবাবুর। আজ দিন সাতেক হোল এই আস্তানাতে এসেছেন। এর আগের থাকার জায়গাটা একেবারেই বাসোপযোগী ছিল না। সেটা ছিল প্রায় বস্তির ঘর, তার ওপর কমন বাথরুম টয়লেট। ভীষণ অসুবিধার মধ্যে ছিলেন। এক অফিস কলিগ এটা জোগাড় করে দিলেন। ছোট হলেও তার একার জন্য ঠিকই আছে। এখানে একটা শোবার ঘর, রান্নাঘর আর বাথরুম। ঘরের কোথায় কি আছে এখনও ভাল করে সড়গড় হয় নি। তবু মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে সাহস করে এক পা ভেতরে ঢুকতেই ‘ফোঁস’ করে একটা আওয়াজ শুনতে পেলেন যেন। সঙ্গে সঙ্গে হিম হয়ে গেল রক্ত। প্রচণ্ড বেগে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। কোথা থেকে এলো এই আওয়াজ? তবে কি ঘরের ভেতরে সাপ এসেছে আবার?

    ঈশানবাবুর জীবনটা একটু নুয়ে পড়া মতন। যাকে বলে চুপচাপ পড়ে থাকা জীবন। তিনি কারো সাথেও নেই পাছেও নেই। যে যা বলে করে দেন। অফিসেও তার ইমেজটা ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ টাইপের। এইজন্য অনেকেই ওকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নেয়। আর অফিসের বসেরা তো অনেক সময় নিজেদের সংসারের কাজও করিয়ে নেন। তার দুএকজন শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু তাকে সবসময় বলেন যে ‘ঈশানবাবু, আপনার বিষাণটা একটু বাজাতে তো পারেন মাঝে মাঝে। একেবারে নেতিয়ে থাকলে চলবে? সময়মত প্রতিবাদ করতে বা “না” বলতে শিখুন। নতুবা পরে বিপদে পড়ে যাবেন। আপনাকে দিয়ে এরা তো নিজেদের পারিবারিক কাজ পর্যন্ত করিয়ে নিচ্ছে।’ ঈশানবাবুর মাঝে মাঝে মনে হয় যে এভাবে চলবে না, একটা কিছু করতেই হবে। কিন্তু কি করবেন আর কবেই বা করবেন, এসব নিয়ে তিনি কখনই কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না। যাই হোক এ পর্যন্ত ব্যাপারটা মোটামুটি ঠিকই চলছিল।

    কিন্তু ব্যাপারটা গুরুতর হোল যখন তাকে কোলকাতা থেকে অনেক দূরের একটা নতুন হওয়া মফ:স্বল অফিসে বদলি করা হোল। দূর মানে ট্রেনে রাত-পোহানো পথ। তারপর ঘন্টাখানেকের কোমরভাঙা বাসরাস্তা পার হয়ে প্রায় পাণ্ডববর্জিত একটা জায়গায় তাদের নতুন অফিস তৈরি হচ্ছে। ওখানে কেউ যেতে চায় না। কাজেই ঈশানবাবুকেই যেতে হবে। ‘আরে বাবা, তিনি কেন? এই অফিসে তো তার থেকে জুনিয়ার বেশ কিছু স্টাফ আছে, আর তারা অনেক বেশি দিন ধরে একনাগাড়ে এখানে আছে, তারা নয় কেন?’ এসব ভাবনা মাথায় আসলেও কাউকে বলতে পারলেন না। বদলির অর্ডার আসার পর অনেক দুঃখ পেলেন তিনি। সবাই বলল ‘ঈশানদা এই-ই সময়, প্রতিবাদ করুন।’ কিন্তু সেসব তো ওর ধাতে নেই। কারো সাথে কোনো বাকবিতণ্ডায় যেতে চান না তিনি। বউ-এর কথায় সাহস সঞ্চয় করে একবার বড়সাহেবকে মিন মিন করে কিছু বলেও ছিলেন। কিন্তু বড়সাহেব একটু কড়া চাহনি দিতেই সুড় সুড় করে চলে এসেছেন সেখান থেকে। চলে আসার সময় সাহেব অবশ্য বলেছিলেন—‘ঈশানবাবু চলেই যান ওখানে, আপনার উন্নতি হবে।’ কিন্তু কিসের উন্নতি, কিভাবেই বা হবে সেসব খুব অস্পষ্ট রইল। আর তাই আজ তিনি এই আধা-মফ:স্বল আধা-পাড়াগাঁয়ে ভীষণ পারিবারিক অসুবিধার মধ্যেও ঘর সংসার ছেড়ে চলে এসেছেন একা একা।

    তার কপালটাই খারাপ। এখানকার অফিসের বস আরও কড়া এবং অসভ্য ব্যবহারের জন্য তার ভীষণ দুর্নাম। এখানে অনেক জায়গা থেকে অনেকের বদলির আদেশ হওয়া সত্ত্বেও বেশিরভাগই লোকই ম্যানেজ করে নিয়ে এখানে আসেন নি। কাজেই স্টাফ বেশ কম। আর তাই এক-একজনকে অনেকের কাজ করতে হয়। এর ওপর মুখ বুজে কাজ করার জন্য ঈশানবাবুর ওপর চাপ আরও বেশি। এখানে অফিসটাও অন্যরকম। একতলা একটা বাড়ি, ঢুকেই একটা বড় স্পেস। সেখানে গাদাগাদি করে রাখা টেবিল চেয়ারে প্রায় জনা পনেরো লোকের বসার জায়গা। এরই মধ্যে একটা কোণের দিকে ঈশানবাবু বসেন। চারদিকে গাছগাছালি থাকাতে আলো বেশ কম। ছাদ থেকে ঝোলানো বাল্বগুলোর আলোই যা ভরসা। একপাশে পুরোনো আমলের সুইংডোর লাগানো একটা ঘর। সেটা বসের। বস একটু জোরে কথা বললে অনেকটাই বাইরে থেকে শোনা যায়। নতুন অফিস তৈরি হচ্ছে। যতদিন না সেটা রেডি হচ্ছে ততদিন এখানেই কাজ করতে হবে। মোটামুটি চলছিল। কিন্তু কদিনের মধ্যেই নতুন অফিসের জন্য ফার্নিচার কেনার ব্যাপারে একটা ফাইল নিয়ে বিরাট বিপদে পড়ে গেলেন তিনি। এখানে তার কাজ স্টোর এন্ড পারচেজে। তাকে তো এইসব প্রকিওরমেন্টের কাজই করতে হবে। কিন্তু নিরীহ মানুষের বিপদ তো পদে পদেই। অফিসের বস তাকে বললেন যে ‘এই প্রকিওরমেন্টের ব্যাপারে টেন্ডার যারা দিয়েছেন তাদের একটা কম্পারেটিভ স্টেটমেন্ট তৈরি করে টেন্ডার ইভ্যালুয়েশন করুন।’ এর পরেই বললেন আসল ব্যাপারটা। সেটা হোল, যে কোম্পানি সবচেয়ে কম দাম হেঁকেছে তাদেরকে টেকনিক্যালি নাকচ করে দিতে হবে, যাতে এদের চেয়ে বেশি দাম হেঁকে অন্য একটা কোম্পানি এই অর্ডারটা পেয়ে যায়। এটা ভীষণ অন্যায় এবং বিরাট ঝুঁকির কাজ। অনেক টাকারও ব্যাপার। অডিট হলে তিনি যদি ধরা পড়েন তবে চাকরি চলে যাবে। বউ বাচ্চা নিয়ে পথে বসবেন। বস বলেছেন দু-চারদিনের মধ্যে ফাইলটা পাঠাতে হবে। আর রোজই ব্যাপারটা ওনার কথামত করার জন্য প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছেন তিনি। ঈশান বাবু ‘না’ বলতে পারছেন না, আবার কাজটা করতেও পারছেন না। জীবন বিষিয়ে উঠেছে একেবারে। রাতে ঘুম হচ্ছে না, খাওয়াদাওয়াও অনিয়মিত হয়ে গেছে। বুঝতে পারছেন যে এরকম বেশিদিন চললে অসুস্থ হয়ে পড়বেন তিনি। বস অবশ্য অভয় দিচ্ছেন যে অডিটের ব্যাপারটা তিনি সামলে নেবেন। তা হলেও, এই অন্যায় করবেন কি করে তিনি। আর ঈশানবাবু এও জানেন যে যদি কোনোভাবে তিনি অডিট বা ভিজিলেন্সে ফেঁসে যান, তখন সাহায্য করা তো দূর, বস তাকে চিনতেই পারবেন না। কিন্তু যদি কাজটা না করেন তবে বস তাকে অন্য জায়গায় ফাঁসাতে পারেন। এমন কি চাকরিও যেতে পারে তাতে। বস নিজে যা করাপ্ট লোক। যা খুশি করতে পারেন। তিনি লড়বেন কি নিয়ে? এই অফিসে তার পূর্ব-পরিচিত কেউ না থাকাতে কথা বলে মন হাল্কা করার লোকও নেই।

    কয়েকদিন আগে বাড়ি ফেরার পথে একটা নির্জন জায়গায় জনাচারেক অচেনা লোক এক সন্ধেবেলা তার পথ আটকাল। অন্যমনস্কভাবে বাড়ি ফিরছিলেন, ছেলের স্কুলের বারো ক্লাসের টেষ্ট পরীক্ষা চলছে। আজ অঙ্ক ছিল। পরীক্ষা খুব জুতের হয় নি। কে জানে কেমন নম্বর আসবে। এরই মাঝে লোকগুলো কখন তাকে ঘিরে ফেলেছে খেয়াল করেন নি। রাস্তার লাইট-পোস্টটা একটু দূরে থাকাতে এই জায়গাটা বেশ অন্ধকার। ওদেরই একজন কথা শুরু করল।

    ‘কি ঈশানবাবু, ছেলের পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?’ বেশ অবাক হলেন তিনি। এরা কি করে জানল, পরীক্ষার কথা? তিনি তো এখানে কাউকে বলেন নি। অবাক হয়ে তাকাতেই পাশের লোকটির অতি বিনয়ী গলা দিয়ে যেন মধু ঝরে পড়ল।

    ‘দাদা কিছু মনে করবেন না এসব ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলছি বলে, তবে আপনার মেয়েটিকে পাত্রপক্ষ আগামী শনিবারে দেখতে আসবে। পাকা কথা, দেনা-পাওনা এসব ব্যাপার হবে, আর আপনি এখানে বসে থাকবেন? বাড়ি যাবেন না? এসব কাজ কি আপনাকে ছাড়া হবে? আপনি কালই ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যান। অফিসের ফরমালিটিস সব আপনার বসকে বলে ম্যানেজ করে দেব।’

    এবারে ভয়ানক চমকালেন তিনি। এরা কারা তা জানেন না, কিন্তু এরা এত কথা জানলই বা কি করে? এমন কি তিনি যে এখন ছুটি পাচ্ছেন না, তাও এরা জানে। থাকতে না পেরে প্রশ্ন বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে, ‘আপনারা কারা? ঠিক চিনতে পারলাম না তো? এত কথা জানলেনই বা কি করে?’

    ‘ওসব কথা বাদ দিন, কিন্তু এখন বাড়ি না গেলে আপনার সংসার যে ভেসে যাবে সেটা তো সত্যি।’ এবারের আওয়াজ তৃতীয় এক ব্যক্তির। গলাটা একটু ভাঙা। ‘তাছাড়া বৌদিও তো শয্যাশায়ী। তার পক্ষে একা সব সামলানো কি সম্ভব অসুস্থ শরীর নিয়ে?’

    এবারে যেন একটু রাগই হোল ঈশানবাবুর, এত গুলো অযাচিত উপদেশ শুনে। তিনি বললেন—‘আমার সংসার আমি বুঝবো, আপনাদের মাথাব্যথার কি দরকার?’

    ‘তা বললে কি হয়? আমাদের তো সবকিছুই দেখতে হবে। তাছাড়া মেয়ের বিয়ের পণের টাকাও তো আমাদেরই জোগাড় করে দিতে হবে। আপনার অবস্থা তো জানি। আপনার নিজের শহরে বদলি চাই, টাকাপয়সা চাই। সবকিছু সময়মতো পেয়ে যাবেন, বুঝলেন।’ চতুর্থ লোকটির গলার আওয়াজ বেশ কঠিন। মনে হোল হাতে কি যেন একটা জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করছে সে। ওটা কি জিনিস তা এত কম আলোয় বুঝতে পারলেন না তিনি।

    যেন আর কথা না বাড়িয়ে আলোচনা শেষ করতে চাইছে ওরা, এই ঢঙেই প্রথমজন আবার বলল,

    ‘ঠিক আছে, দুদিনের মধ্যে আপনি ফার্নিচারের ফাইলটা ভালভাবে ক্লিয়ার করে বড়সাহেবকে দিয়ে দিন, তারপর ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যান, বাকি ব্যাপার আমরা দেখে নেব। আর যদি কাজটা না হয়, তাহলে কি হবে তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না?’

    চতুর্থ লোকটার হাতের চকচকে জিনিসটা যে একটা ধারালো চাকু তাতে আর কোন সংশয় রইলো না তার। এবারে পুরো ঘটনা পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে। লোকগুলো হঠাৎই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এমন কি, কিছু ঘটেছিল কিনা তাই নিয়েই সংশয় হতে লাগল। ভীষণ ভয় পেলেন। এত লোক থাকতে তার সাথেই কেন এসব হয়। ভাবতে ভাবতে একরাশ চিন্তা নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরলেন তিনি।

    প্রথমদিকে এক কামরার ভাড়ার ঘরটাতে ভালোই ছিলেন। ওনার চাহিদা বিশেষ নেই। আর তার পরিবারের কারোর এখানে আপাতত আসার সম্ভাবনাও নেই। কিন্তু এখানেও একটা কাণ্ড হল। দিন দু-এক আগেই রবিবারের বিকেলে শোবার ঘরের কোনায় রাখা জলের কুঁজোটা ধোবার জন্য সরাতে যেতেই শরীরের সমস্ত রক্ত হিম হয়ে গেল তার। কুঁজোর পেছনের ঠান্ডা জায়গাটাতে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে একটা মিশকালো সাপ। কোন শব্দ না করে এবং আর কাছে না গিয়ে নি:শব্দে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। ভয়ে প্রাণ প্রায় গলার কাছে এসে আটকে গেছে। কবে থেকে সাপটা রয়েছে এখানে কে জানে? একে নিয়েই কি ঘর করছেন তিনি? কোনও রকমে বেঁচে গেছেন। যদি রাতের দিকে লেজে পা পড়ে যেত, বা ওটা বিছানায় উঠে আসত তবে কি হত? এইসব ভেবে কুল কুল করে ঘাম হচ্ছিল। রাস্তার উল্টোদিকের বাড়িটাতে দুজন মিস্ত্রি গোছের লোক কাজ করছিল। তাদেরই ডেকে আনলেন। তাঁরা লাঠি নিয়ে তৈরি হয়ে এসে কুঁজোটা সরাতেই সাপটা নড়েচড়ে উঠে চলতে শুরু করল। প্রায় হাত তিনেক লম্বা। বেশ কালো। ওরা বলল—‘বোধহয় কালাচ সাপ। বিষধরই মনে হচ্ছে। তবে ছোট সাপ’। দুজনেই লাঠি চালাতে লাগল। কিন্তু সাপের গায়ে লাগল না একটাও। সে এঁকেবেঁকে বাথরুমের দিকে চলে গেল। প্রায় নালার ছিদ্রের কাছে পৌঁছে গেছে সেই সময় একটা লাঠির আঘাত বোধ হয় ওর লেজে পড়ল। মুহূর্তের জন্য থেমে গেল সেই সাপ। লেজটা গুটিয়ে নিল সে। মিস্ত্রিরা উদ্যত, লাঠির আঘাত করার জন্য। হঠাৎ সাপটা তাদের দুজনের দিকে এক লহমায় লেজে ভর দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফণা বিস্তার করল। কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য। ফণা তোলা একটা সাপ। চেরা জিভটা বেরিয়ে আসছে আবার ঢুকে যাচ্ছে। আওয়াজ হচ্ছে ফোঁস ফোঁস। ঘটনার আকস্মিকতায় মুহূর্তে পিছিয়ে এল মানুষ দুজন। ফণার সম্মোহনে লাঠি হাতে নিথর দাঁড়িয়ে রইল তারা। তাদের চোখে খেলা করছে ভয়। এই আকস্মিকতার সুযোগে বাথরুমের নালা দিয়ে বেরিয়ে গেল সাপটি। শুধু ফোঁস ফোঁস আওয়াজটা যেন ঘরের মধ্যে রেখে গেল সে। মানুষদুটি ঘরে আর কিছু আছে কিনা তন্ন তন্ন করে খুঁজে সবকটা নালা ইঁট চাপা দিয়ে বন্ধ করে বেড়িয়ে গেল। বলে গেল, ‘সাবধানে থাকবেন। চারদিকে ফিনাইল ছিটিয়ে দিন। ও আর আসবে না। তবে নালাগুলো বন্ধ রাখবেন। বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন।’

    বাড়ির পেছন দিকেই একটা আগাছার জঙ্গল। সেখানেই হয়ত সাপটার বাসা। আহত সাপ নাকি ভয়ঙ্কর হয় এবং বার বার ফিরে আসে। একদিকে সাপের চিন্তা, অন্যদিকে বসের ফাইলের জন্য অন্যায় তাগাদা, জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। স্ত্রী অসুস্থ, তাই তাকেও কিছু জানাতে পারছেন না। অনাবশ্যক চিন্তা করবে।

    এরপর আর বিশেষ কিছু ঘটে নি, তবে আজ বাল্ব কেটে ঘর অন্ধকার হবার পরে মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে একটা ফোঁস ফোঁস আওয়াজ হোল। হয়ত মনের ভুল। যাই হোক, মোড়ের দোকান থেকে একটা ২০০ ওয়াটের বাল্ব কিনে আরও দুজন পাড়ার লোককে ডেকে আনলেন তিনি। তারা এসে বাল্ব লাগিয়ে ঈশানবাবুর বলা ‘ফোঁস ফোঁস’ আওয়াজ-এর উৎস খুঁজল। কিন্তু কিছু পেল না। নালাগুলো বন্ধই আছে। ওরা যাবার সময় অভয় দিয়ে গেল, ‘নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ুন, কিছুই নেই ঘরের মধ্যে।’

    রাতে খাওয়াদাওয়া করে মশারির ভেতরে ঢুকে বেড-সুইচ দিয়ে আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন। হঠাৎই খেয়াল হল, আরে কালকেই তো ফাইলটা করে দিতে হবে বসকে। বসের দেওয়া সময়সীমা কালই শেষ। কিন্তু কি করবেন তিনি? পুরোটাই তো অন্যায়। মনে পড়ল, ছোটবেলায় তার স্কুলশিক্ষক বাবা বলতেন ‘মানুষের মূল্যবোধটাই আসল। সেটা চলে গেলে একজন মানুষের আর কিছুই থাকে না’। কিন্তু এই মূল্যবোধ ধরে রাখার মতো মনের জোর বা সাহস কোনটাই তো তার নেই। আবার ধরা পড়ে চাকরি গেলে ছেলেমেয়ে নিয়ে পথে বসতে হবে। কি যে করবেন তিনি ঠিক করতে পারলেন না। সাপের চক্করেও বেশ দিশেহারা অবস্থা হয়েছে তার। যা হবার হবে ভেবে চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করলেন।

    কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলেন কে জানে? ‘ফোঁস ফোঁস’ শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। লাইট জ্বালিয়ে সন্তর্পণে বিছানা থেকে নেমে চারদিক দেখলেন। কোথাও কিছু নেই। তবু বেশ ভয় পেলেন। এবারে আলো জ্বালিয়েই ঘুমোলেন। ভোরের দিকে একটা স্বপ্ন দেখে আবার ভেঙ্গে গেল ঘুমটা। দেখলেন কয়েকটা লোক লাঠি হাতে আক্রমণ করতে উদ্যত আর তাদের সামনে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটা কালো মাঝারি মাপের সাপ।

    একটু দেরি করেই পৌঁছলেন অফিসে। রাতে ভাল ঘুম হয় নি। চোখদুটো জ্বালা করছে আর মাথা দপদপ করছে। কে জানে প্রেশারটা বাড়ল কিনা? অফিসে ঢুকতেই পিওন বলল বড়সাহেব ডাকছেন। দুরু দুরু বুকে বসের ঘরে ঢুকতেই বস আছড়ে পড়লেন তার ওপরে।

    ‘কি করছেন ঈশানবাবু? অ্যাঁ? এখনও ফাইলটা ক্লিয়ার করলেন না। আপনার অকর্মণ্যতার জন্য অফিসের একটা পুরো প্রসেস আটকে আছে। এত দায়িত্বজ্ঞানহীন হন কি করে আপনি?’ বসের গলার আওয়াজ এক এক পর্দা করে চড়ছে। ‘একেবারে ওয়ার্থলেস, কোন কাজ পারেন না। এর পরেও ভাবেন আপনার কাজ থাকবে? দেখুন আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যদি যেভাবে বলেছি সে ভাবে ফাইল ক্লিয়ার না করেন তবে কাল থেকে আপনাকে আর আসতে হবে না। কেন যে এই আকাঠ লোকগুলোকে এরা আমার ঘাড়ে ঠেলে দেয় কে জানে?.. দাঁড়িয়ে দেখছেন কি? আউট। গেট আউট। ফাইলটা না করে আনলে বুঝতে পারছেন তো কি হবে?’

    এতগুলো কথা বলে বস হাঁপাতে লাগলেন আর তিনি অপমানে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলেন। তিনি যথেষ্ট সিনিয়র, রিটায়ারমেন্টের আর বছর পাঁচেক আছে। তাও তাকে এভাবে অপমান করলেন বস। দেখলেন অফিসের সবাই তার দিকে করুণার দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। দুচোখ জলে ভরে এল তার। শরীরে একটা প্রবল অস্বস্তি নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন তিনি। অনেক কান্না জমা হয়ে আছে।

    ঘণ্টাখানেক পরে নিজেই ফাইল নিয়ে বসের ঘরে ঢুকলেন ঈশানবাবু। ফাইল দেখামাত্র বস চিৎকার করে উঠলেন, ‘একি কিছুই তো করেন নি। ব্যাপার কি আপনার? এত কথার পরেও আপনি—-’

    ‘পরের পাতায় দেখুন।’ বসকে থামিয়ে দিয়ে বরফ-ঠান্ডা গলায় কথা বললেন ঈশানবাবু।

    বস একটু থতমত খেয়ে পরের পাতায় দেখতে লাগলেন। খানিক পরেই ভুরু কুঁচকে মুখ লাল হয়ে উঠল তার। রাগে কাঁপতে কাঁপতে তিনি বললেন—

    ‘আরে, আপনি ওই কোম্পানিটাকেই লোয়েস্ট কোটেশন রেখে পাশ করিয়েছেন। আপনাকে যে আমি বললাম এদেরকে টেকনিক্যালি ফেল করিয়ে দিতে, সেটা শুনলেন না? দুই নম্বর কোম্পানিটাকে অর্ডার পাওয়াতে বলেছিলাম, সেটা করলেন না?’

    ‘ওদের টেন্ডার ডকুমেন্টে, টেকনিকাল স্পেসিফিকেশনে, কোথাও কোন গণ্ডগোল ছিল না স্যার।’

    ‘আরে সেইজন্যই তো আপনাকে ফাইলটা দেওয়া হয়েছে। বু্র্বক কোথাকার। আপনি কোনভাবে কিছু ম্যানুপুলেট করে, বা ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি বা অন্য কোন টেকনিক্যাল সার্টিফিকেট মিসিং দেখিয়ে ওদেরকে ডিসকোয়ালিফাই করে দেবেন, এসব কথা তো আপনাকে বার বার বলা হয়েছে।’ বসের আওয়াজ মাঝে মাঝে উত্তেজনার বশে বেশ জোরেই হচ্ছে। ‘এসব করে দিলে আপনি যে কতটা লাভবান হবেন, তা সেদিন সন্ধ্যাবেলা রাস্তায় আপনাকে তো আমার লোকজন বলেও দিয়েছিল।‘

    ‘আমাকে মাপ করবেন। আমি এসব অন্যায় করতে পারব না। আমাকে নিয়মমতো কাজ করতে দিন স্যার।’

    ‘সততা? সততা দেখাচ্ছেন? আপনি বেঁচে থাকবেন তো এভাবে? আপনার সংসার বাঁচবে? যাকগে, কাল থেকে আপনার মত উজবুককে আমার আর দরকার নেই।’

    ‘দেখুন স্যার, অফিসটা আপনার নয়। আপনিও কাজ করেন, আমিও কাজ করি। দুর্ভাগ্যবশত: আপনি আমার বস। আর আপনি একটা করাপশন করার জন্য আমাকে ইনসিস্ট করছেন। এটা অন্যায় বুঝতে পারছেন তো?’

    ‘অন্যায় দেখেছেন কতটুকু? রাস্তায় চলাফেরা করতে হবে না আপনাকে? আপনাকে রাস্তায় পেলে ওরা ছেড়ে দেবে ভাবছেন?... কে বাঁচাবে তোকে? নিজের ভাল নিজে বুঝিস না? মূর্খ? তোকে ফাঁসাতে আমার একদিনও সময় লাগবে না।’ উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলেন বস। আপনি থেকে একবারে তুইতে নেমে এলেন।

    ‘সে দেখা যাবে কে ফাঁসবে। আপাতত আপনার কথাগুলো সবই আমার মোবাইলে রেকর্ড হয়ে গেছে, সাথে কিছু ডকুমেন্টও জোগাড় করে রাখা আছে।’ একদম অচেনা একটা হিসহিসে আওয়াজ বেরিয়ে এল ঈশানবাবুর গলা দিয়ে। নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিলেন না। ভীষণ অবাক হলেন তিনি। কার গলা এটা? তিনি তো এসেছিলেন কাজটা না করতে পারার জন্য ক্ষমা চাইতে। তবে এটা কি হচ্ছে? কোন কিছুই যে তার নিয়ন্ত্রণে নেই। সেই রাগি-রাগি ঠান্ডা আওয়াজটা আবার বেরিয়ে এল। তবে এবার যেন আরো উচু পর্দায়।

    ‘দুর্বল দেখলে পেয়ে বসেন আপনারা। চাপ দিতে থাকেন। আমি যা ভাল বুঝেছি, করে দিয়েছি। এবার আপনার যা করার করুন ফাইলে। আমি একটা শব্দও বদলাবো না। আর...আর.. আপনি নিজেও সাবধানে থাকবেন। নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা আমার আছে। যদি কোন বেগড়বাঁই দেখি তাহলে আপনি জানেন না আমি কতদূর যেতে পারি।’ শেষের কথাগুলো বেশ জোরেই বলে ফেলেছিলেন তিনি। সুইং দরজার পেছনে মনে হোল ভিড় জমে গেছে। আর বসের মাথাটা ঘাড়ের থেকে ঝুলে পড়েছে সামনের দিকে। তিনি জ্বলন্ত চোখে চেয়ে রয়েছেন বসের দিকে আর বস সে চোখে চোখ রাখতে না পেরে নিজের চোখ নামিয়ে নিলেন। তিনি টের পেলেন দরজার পেছনের ভীত চোখগুলো তাকে দেখছে। এই দৃশ্যে কি একটা খুন হওয়ার কথা ছিল?

    হঠাৎই মনে পড়ল রেকর্ড করা তো দূরের কথা, পকেটে তো মোবাইলই নেই। সেটা তো এখন পড়ে আছে বসার টেবিলের ড্রয়ারে। জিহ্বাতে তীব্র জ্বালা আর নোনতা স্বাদ পেলেন। রক্ত বের হচ্ছে কি? তবে কি কঠিন কথাগুলো বলতে বলতে জিহ্বা চিরে গেল? একি পরিবর্তন হল তার? সুইং দরজা ঠেলে সকলের মাঝখান দিয়ে বের হবার সময় টের পেলেন একটা শব্দ অনেক গভীর থেকে তার শরীর ছেনে বুদ্বুদের মত উঠে আসছে—‘ফোঁস।’ প্রায় দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন তিনি।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments