অনাথাশ্রম থেকে শ্রীজিতাকে সম্বর্ধনা দিয়েছে ওর লাস্ট বিশাল অংকের ডোনেশনটার জন্য।
“মা হওয়া কি মুখের কথা?” গদগদস্বরে বলেছিল চিত্রণ, “আর এতগুলো বাচ্চার…মানে, আমি তো ভাবতেই পারি না—!”
শ্রীজিতা হেসেছিল একটু শুধু কথার জবাবে।
চিত্রণ ওর আন্ডারে কাজ করে। বেশ ভালই ছেলেটা।
পাশের টেবিলে বসে চোখের চশমাটা ঠিক করে নাকের উপর চেপে বসাতে বসাতে মধু নামের স্বল্পভাষী মেয়েটা তখন কী মনে করে মুখ খুলেছিল কে জানে? “কথায় বলে না, ‘কুপুত্র যদ্যপি হয়, কুমাতা কদাপি নয়?’ অত্যন্ত ভুল কথা একটা। আমাদের ইগো আর ইনসিকিওরিটিতে ধোঁয়া লাগাতে শুধু কথা সাজানো।”
“সেকিরে? কী বলিস?” অত্যন্ত অবাক হয়ে বলেছিল চিত্রণ। তারপরে রাশিরাশি উদাহরণ সাজিয়েছিল কবে কোন সন্তান মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল, কে মাকে মারধর করত, কে কবে— আর কথা শেষ করেছিল এভাবে, “বদ সব বদ! কুসন্তান! এমনকি পয়সাওলারাও…বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাচ্ছে মাকে, ভাবা যায়?”
মধু কম কথা বলে, কিন্তু যা বলে তাতে ও একরোখা।
“কুপুত্র কুমাতারই তৈরী।” বলেছিল মধু।
কেন মধু এই প্রসঙ্গ তুলেছিল কে জানে? শ্রীজিতার মেজাজ বিগড়ে গেছিল হঠাৎ ওর অনাথাশ্রমে যাতায়াত, দানধ্যানের সম্পর্কে কথাবার্তার মধ্যিখানে এই সব বেকার আলোচনা এসে পড়ায়।
মাথার ভিতর ঘুরছিলও কথাগুলো।
কোলের উপর পেপারটাতে প্রথম পৃষ্ঠাতেই বড়বড় করে লেখা ছিল খবরটা। মা হত্যা করেছে কন্যাসন্তানকে।
দেখেই মুখটা বিতৃষ্ণায় বিকৃত করে শ্রীজিতা তাকিয়েছিল গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে। খবরের কাগজ আর পড়া যায় না আজকাল!
এসি গাড়িতে চড়তে একসময়ে অত্যন্ত খারাপ লাগত শ্রীজিতার। এখন গাড়ির নরম সিটে হেলান দিয়ে বসে বাইরের রাস্তার ধুলো, হাওয়ার দৃশ্যমান দমবন্ধ করা ধূসর ধোঁয়ার দিকে ফাঁকা চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ব্যাপারটা খেয়াল করে একটা মুখভঙ্গি করল ও।
গাড়িটা জ্যামে আটকে পড়েছে, সামনে পিছনে গাড়ির সারি। আকাশে মেঘ জমছে। রোজই আজকাল সন্ধের সময় মেঘ জমছে আকাশ কালো করে, অথচ বৃষ্টি তেমন কিছু হচ্ছে না। কয়েক ফোঁটা হয়তো। গুমোট ভাবটাই তাতে বাড়ে যা, আরাম কিছু পাওয়া যায় না।
এসিতে আরাম করে হেলান দিয়ে বসে একটু চোখ বুজবে কিনা ভাবছিল শ্রীজিতা। অন্যমনস্কভাবে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বছর দেড়-দুয়েকের বাচ্চাটার দিকে চোখটা পড়ে গেল। ছোট্ট একটা লাল রঙের গেঞ্জি পরনে। শুধু ওইটুকুই। একহাতে একটা মাটির ভাঁড়, অন্যহাতে একটা ছেঁড়া হাওয়াই চপ্পল নিয়ে রাস্তার পাশে বসে নিজের মনে...খেলাই করছে মনে হয়।
এই রাস্তাতেই ও জন্মেছে, ওর সারা শরীরে সে ছাপ স্পষ্ট। এই গাড়িঘোড়ার শব্দ, এই নোংরা দূষিত আবহাওয়ার মধ্যে ওর অবিচলিত মুখভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে এই রাস্তাতেই বড় হয়ে উঠে এই রাস্তাতেই জীবন কাটিয়ে দেবে ও, সে প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই।
আজ শ্রীজিতা অন্যদিনের থেকে একটু বেশি ইমোশনাল ফিল করছে কোনও অজ্ঞাত কারণবশত। রোজ এরকম কত ছোট্ট গেঞ্জি পরা ন্যাংটো শিশুকে রাস্তার পাশে বসে থাকতে দেখে, কখনো কিছু মনে হয় না। আজ মেজাজটা হঠাৎ বিলকুল খারাপ হয়ে গেল।
কে ওর মা কে জানে? আছে নিশ্চয়ই আশেপাশেই। রাস্তার পাশের বটগাছটার তলায় বসে ওই হলুদ নীল ছোপা ছোপা নাইটি পরা যে মেয়েটা বাসন মাজছে, সেই কি? নাকি, ওই ওষুধের দোকানের সামনে ছেঁড়া শাড়ি পরে শুয়ে থাকা মহিলা?
যেই হোক না কেন, কী আসে যায় তাতে?
ওরকম মা থাকার সঙ্গে না থাকার কী পার্থক্য? সন্তানকে সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ দিতে পারবে না, কেন পৃথিবীতে আনা?
জিষ্ণুর মুখটা মনে পড়ল শ্রীজিতার। এখুনি বাড়ি যেতে পারলে বাঁচে ও। আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়েছিল এই ভেবে যে ছেলেটার সঙ্গে একটু সময় কাটাবে বেশি করে। অথচ এই জ্যাম! এতক্ষণ আটকে আছে এখানে, ব্যাপারটা যেহেতু গা সওয়া, খেয়ালই করেনি। কিন্তু এই তাড়াতাড়ি ছুটি নেওয়া কিসের জন্য, যদি না সন্তানের কাছে যাওয়া যায় একটু দ্রুত? যা কিছু শ্রীজিতার নিজের, সবই তো জিষ্ণুর জন্য! কীই না করেছে ও জিষ্ণুর জন্য? সেই ছোটবেলা থেকে যত পড়া মুখস্থ করা, সেই কেরিয়ার তৈরীর উদ্দেশ্যে দৌড়, সেই ছোট ছোট সব ত্যাগস্বীকার...এমনকি প্রথম প্রেম ওর, নীলাঞ্জন, তার সঙ্গে ব্রেক আপ, সব সবই...হ্যাঁ, তখন বোঝেনি বটে শ্রীজিতা, কিন্তু এই সবই ছিল জিষ্ণুর জন্য। জিষ্ণু আসবে এই পৃথিবীতে, তাকে একটা সমৃদ্ধ, বাসযোগ্য জীবন দিতে হবে, এই না ছিল শ্রীজিতার সাধনার একমাত্র লক্ষ্য? নইলে কার জন্য এখনও লড়াই করে যাচ্ছে ও? ভোগ কি করছে নিজে? না। করছে না।
হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে গলার কাছে কান্না জমে উঠতে চাইছিল শ্রীজিতার।
গাড়িটা কিন্তু চলছে না। এখনও লাল সিগনাল ওঠেনি। এখনও জ্যামে জ্যাম। এবারে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। অল্প অল্প। বেশি হবে না, কিন্তু এই জ্যামের অবস্থা আরও খারাপ হবে তাতে।
ভুরু কুঁচকে আবার বাইরে তাকিয়েছিল শ্রীজিতা।
ওই বাচ্চাটার মা কোথায় আছে কে জানে? ভিজবে হয়তো বাচ্চাটা। হয়তোই বা কেন, ভিজবেই! আশেপাশে তো কোনও মাথা গোঁজার ঠাঁইও নেই। আর ওইটুকুন তো বয়স ওর। কীই বা বুঝবে ও?
সিটের পাশে পড়ে থাকা পেপারে চোখ পড়ে গিয়েছিল শ্রীজিতার আবার, কী ধরনের মা! এইসব নোংরা, অমানুষ মায়েদের—
ভাবতে ভাবতেই প্রায় বৃষ্টি এসে গেল। বড় বড় ফোঁটা নয়। খুব অল্প ইলশেগুঁড়ি। শ্রীজিতার গাড়ির দরজার কাঁচে এসে পড়ল প্রথমে একটা বিন্দু জল, তারপরে বেশ খানিকক্ষণ পরে আরেক ফোঁটা—
হঠাৎ কী মনে হল কে জানে, এসি গাড়ির মধ্যের আরামে বসে নিজের সন্তানের জন্য অপেক্ষা আর বেওয়ারিশ শিশুটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ কী মনে হল শ্রীজিতার—গাড়ির দরজা খুলে ফেলল ও।
বাচ্চাটার কাছে যাবে। বাচ্চাটা ভিজবে এইরকম জায়গায় একা একা বিশ্রীভাবে, এ চোখে দেখা যায় না—
ড্রাইভারকাকু ওকে গাড়ি ছেড়ে বেরোতে দেখে কিছু একটা বললেন হয়তো, শ্রীজিতার বাবার আমলের লোক তিনি, বলতেই পারেন।
শ্রীজিতা শুনলই না সেসব। গিয়ে দাঁড়াল বাচ্চাটার সামনে। ফোকলা দাঁতে হাসি হেসে বাচ্চাটা তাকাল শ্রীজিতার মুখের দিকে। নাকে সিকনি, মুখের-ঠোঁটের পাশে সন্দেহজনক কালো কালো দাগ। হাসিটা দেবশিশুর। কোলে নেবে বাচ্চাটাকে? না, ছিঃ! এর সারাশরীরে যে অসংখ্য জীবাণু!
কিন্তু, কোলে না নিলে এই এসে পড়া বৃষ্টির হাত থেকে ওকে রক্ষাই বা করবে কী করে? বোকার মত রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে না কি শ্রীজিতা? নির্বোধ একটা মেয়েমানুষের মত। আশেপাশের লোকেরা এসি গাড়ি থেকে দামী ক্যাজুয়াল শার্ট প্যান্ট পরিহিতা এক মহিলাকে বেরিয়ে রাস্তার বাচ্চার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে না কি?
বাচ্চাটা কিন্তু নোংরা মেখে দেবশিশু হয়ে বসে আছেই তো আছেই।
হাসছেই তো হাসছেই। ওর চোখে সম্ভ্রম নেই। যেটা ওই অনাথাশ্রমের শিশুদের চোখে দেখে শ্রীজিতা অভ্যস্ত। তাই ওদের বুকে তুলে নেওয়াটাও সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু এই শিশু—
নিজের একহাতে ধরে থাকা হাওয়াই চপ্পলটাকেই সে বড়োসড়ো একটা উপহার মনে করেছে, আর শ্রীজিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে সেই চপ্পলসুদ্ধু হাতটাকে।
আকাশের বুক চিরে ঝলক মেরে গেল বিদ্যুৎ। কড়াৎ করে বিকট শব্দটা হল তারপরেই।
আর, বাচ্চাটা হাতের চপ্পল ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল তড়িৎগতিতে। চিৎকার করে ভয়ার্ত গলায় ডাকল “মা!”
ওষুধের দোকানের সামনে শুয়ে থাকা মহিলা ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন তাতে।
শিশুটা দৌড়ে চলে গেল মায়ের কাছে। শ্রীজিতার দিকে ফিরেও তাকালো না আর।
শ্রীজিতাও—ছুট্টে গাড়িতে এসে ঢুকল ও। “চলো, কাকু, চলো!” বলল শ্রীজিতা। হাঁপাচ্ছে।