ক’দিন আগে ব্যাঙ্গালোর গেছলুম। সেখানে বড়ো নাতি হঠাৎ বলে বসলো—দাদু কি হলো তুমি তো তোমার সেই আয়না ভূতের গল্পটা তোমার বইতে দাও নি? সেটাও তো তোমার সেই মধুপুরেরই ঘটনা?
আমি বললুম—ওরে, ওটা সত্যি নয়, ওখানে গিয়ে তো কিছু দেখতে পাই নি আমি। তাই আর ওটাকে লিখি নি। শুধু মুখেই তোকে বলেছি। আর আয়না ভূত কিনা তাও তো জানি না, তোকে অমনি করে বলেছিলাম তুই যখন ছোট ছিলি।
চুপ করে গেলো, কিন্তু ওর মুখের ভাব দেখে আবার বললাম আরে সে তো আরও কত মধুপুরের গল্প তুই শুনেছিস, সব কি আর ওই বইতে আছে? ওটায় শুধু ইংরিজিতে লেখা যেগুলো, সেগুলো আছে।
নাতির বয়স এখন বারো। ছ’সাত বছর আগে শোনা গল্প মনে রেখে আমাকে মনে করিয়ে দিলো, তাই ভাবলুম বাংলায় লিখেই রাখি। ছোট্ট গল্প, অন্যের মুখে শোনা গুজব, পরে নিজে যাচাই করতে গিয়ে হতাশ হয়েছিলাম।
মধুপুরে আমাদের বাড়ি থেকে সোজা দক্ষিণে একটা কাঁচা রাস্তা কয়েক মাইল গিয়ে জয়ন্তী নদীর বড়ো নালাটার কাছে ফুরিয়ে যেত। তারপর দক্ষিণে যেতে হলে পায়ে হাঁটা সুঁড়িপথ বা পাকদণ্ডী ছিল। ওই জায়গাটার থেকে মাইল খানেক পুবে জয়ন্তীর বড়ো নালাটা জয়ন্তীতে পড়তো। আমরা সাইকেল ঘাড়ে করে নালাটা পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে বেড়াতে যেতাম।
ওই এলাকায় একটা খুব পুরোনো নবাবী আমলের কবরখানা ছিল। মুসলমানদের। স্বাভাবিক ভাবেই নানারকম অতিপ্রাকৃত গল্প শোনা যেত জায়গাটা সম্বন্ধে। আমি কখনো কিছু দেখিনি। সেই কাহিনীই শোনাই এবার।
আমাদের কুন্ডু বাংলো এলাকার সব আমবাগানের ইজারাদার ছিল মেওয়ালাল। বুড়োর ছিল গুটিকতক বউ, আর তাদের ছিল গুটিকতক করে ছেলেপিলে। সব মিলিয়ে ডজনখানেকেরও বেশি। ওদের মধ্যে এক ছোকরা, আমার চেয়ে একটু বড় বয়সে, তাকে ডাকা হতো লালা বলে—ঠিক নাম জানুতম না। যাই হোক, লালা নিজেদেরই ইজারা নেওয়া বাগানের ফল নিজেই চুরি করে ধরা পড়ে বাড়িতে দাদাদের হাতে ঠ্যাঙানি খেয়ে শার্ট পরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো পিঠে দাগ আছে কি না। আমি দেখলুম দাগ আছে, কিন্তু এমন কিছু না। বললুম, কিন্তু লালা ঠিক মানলে না। বললে চল আয়নাঝাড়ে দেখে আসি—বাড়ির আয়না তো আর ছুঁতে পাবো না। আমার “কাজ” ছিল, গেলুম না, আসলে বেশ অস্বস্তি ছিল।
বুঝিয়ে বলছি, দাঁড়ান।
ওই যে নদীর কাছে নালাপাড়ে কবরখানাটার কথা বলছিলাম, ওটার সম্বন্ধে একটা অদ্ভুত ধারণা ছিল স্থানীয় লোকেদের। ওখানে নাকি দিনে-রাতে যে কোনো সময়েই গেলে দেখা যেত অনেক লোকজন ঘোরাফেরা করছে। সে তো ঠিক। হতেই পারে। গোলমালটা ছিল যে ওই সব লোক প্রত্যেকেই নাকি যে ওখানে তখন গিয়েছে ঠিক তার মতন দেখতে, এক-ই ধরনের জামা-কাপড় পরা পর্যন্ত। হুবহু। তাদের-ই একজন হয়তো এদিক থেকে ওদিকে চলে গেলো, আরেকজন এসে মাটিতে বসে পড়লো, আরেকজন নালায় নেমে পা ধুতে লাগলো, একজনের বিড়ি আরেকজন চেয়ে নিয়ে ফুঁকতে লাগলো, এই সব উদ্ভুট্টি কাণ্ড যত।
আরও আছে। ধরো একলা ওখানে গিয়ে তুমি জামাটা খুলে ফেললে। অন্যরা সবাই অমনি জামা খুলে ফেলবে। তুমি একটা বিড়ি ধরলে। অমনি সবাই ফুক ফুক করে বিড়ি ধরিয়ে খাবে, কেউ তোমার দিকে ফিরে, কেউ বা অন্য কোনো দিকে। সে এক জগাখিচুড়ি ব্যাপার।
একবার শুনেছিলাম একজন মুন্ডা জেলে ওপার থেকে জয়ন্তীর বাটা মাছ নিয়ে আসছিলো বাঁকে করে দুটো ভারা ঝুলিয়ে। এমন কিছু ভারী নয়, তবে ব্যালেন্স করার জন্যে দুদিকে দুটো। সে অতি সুস্বাদু মাছ জয়ন্তীর, কিন্তু প্রচুর কাঁটা। যাই হোক নালা পেরিয়ে মধুপুরের দিকে ভারা নামিয়ে বসে একটা বিড়ি ধরিয়েছে, “অন্যরাও” বিড়ি ধরালো। তাদের-ও এদিকে ওদিকে ছড়ানো মাছের ভারা। জেলেটার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। সে হাত বাড়িয়ে অন্যদের ভারা থেকে কয়েকটা মাছ তুলে নিয়ে নিজের ভারায় রাখলো। বিড়িতে শেষ টানটা দিয়ে যেই উঠে বাঁক তুলতে যাবে, দেখে বাঁক ভীষণ ভারী, তোলাই যাচ্ছে না। বুদ্ধিমান জেলে তক্ষুনি “অন্যদের” সেই মাছগুলো ফেরত রাখলো, তবে নিষ্কৃতি!
আরেকবার শুনেছিলাম একজন মুন্ডা মাঝি দক্ষিণ পাড়ে মাল পত্তর নামিয়ে উত্তর পাড়ে এসে তার “অন্যদের” অনুরোধ করে তাকে একটু মাল নিয়ে নালা পেরোতে সাহায্য করতে, আর তারা নাকি মুখ চাওয়া চাওয়ি করে জনাদুয়েক তার বোঁচকা-টোচকা পার করে দেয়!
একটা ডিসেন্টিং ওপিনিয়ন-ও শোনা যেত অবশ্য। সে এক হো বুড়ির গল্প। সে শহর থেকে নিজের গাঁয়ে ফেরবার পথে নালার ধারে পা মচকায়। বসে পড়ে। আর তক্ষুনি নাকি কয়েকজন বুড়ি এসে কি সব পাতা পত্তর ছেঁচে তার পায়ে লাগিয়ে একটা ন্যাকড়া দিয়ে বেঁধে দেয়—তফাৎটা শুধু এই যে সেই হো বুড়ি নাকি পরে বলেছিলো যে সেই তারা মোটেই তার নিজের মতো দেখতে নয়, তারা সবাই নাকি বুড়ি, তাদের চুলটুল সব পেকে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি! বুঝুন ব্যাপারটা!
তবে কখনো কোনো মানুষের কোনো ক্ষতি করে নি ওই সব “অন্য” জনেরা। আর, কয়েকজন মিলে যদি যাওয়া হতো, তো এসব কিসসু চোখে পড়তো না। সেই ব্যাপারটা কি করে আবিষ্কার করলুম, সেটাই এই গপ্পো, বুঝলেন!
যাক এই সব উৎকট গৌজবিক কারণে জায়গাটাকে অনেকে আয়নাঝাড় নাম দিয়েছিলো, যদিও আয়নাকে আমাদের দিকে এমনিতে শীশা বলা হতো। লালার ইচ্ছে সেখানে গিয়ে নিজের পিঠের অবস্থা দেখবে। পাগল না পেট খারাপ! আমার “কাজের” কথা মনে পড়ে গেলো। তাই আমি আর গেলাম না লালার সঙ্গে। ব্যাটা একাই গেলো।
ঘুরে এসে পরের দিন লালা বললে আমি যা বলেছিলাম তাই ঠিক, পিঠে বেশি দাগ পড়ে নি, খালি গায়ে বেরোতে কোনো অসুবিধে ওর হবে না। ছ’জন লালাকে ও দেখেছে, একজন দূরে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো, তার পিঠটা ও ভালো করে দেখে নিয়েছে। আমার মুখটা একটু শুকিয়ে গেলো, ছয় প্লাস এক ইজিকালটু সাত জন লালার মধ্যে কোনটা ফিরে এলো রে বাবা! কে জানে!
লালার কথা শুনে সামান্যতম বিচলিত দেখলাম না আমাদের দলের সদস্যদের মধ্যে একজনকে। ওই বদমাইস ডাকাবুকো বিজলী—যার ডাক নাম ছিল বিজুরিয়া। তক্ষুনি পাজিটা আমাকে পটাতে শুরু করলো ওই জায়গাটায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে। “নিয়ে যাওয়া” মানে আমার সাইকেলে ডবল ক্যারি করে দুজনে যাওয়া। আসল কথা হাঁটতে উনি চান না, কাজে কাজেই আমাকে সাইকেল নিয়ে যেতে হবে। একটু ভয় ভয় করছিলো, তাই নানারকম ওজর দেখলাম—মালকোঁচা পাল্টে হাফ পেন্টুল পরতে হবে, খালি পায়ের ধুলো ঝেড়ে চটি পরতে হবে ইত্যাদি। কে শোনে।
ওই বোধ হয় একবার-ই অমন বিচ্ছিরি রাস্তায় ডবল-ক্যারি করেছি। যা হোক, গিয়ে পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে থেকেও কিছু দেখতে পাওয়া গেলো না। কয়েকটা বিড়ি দু’জনে ভাগাভাগি করে খেলাম। একবার দুজনের-ই মনে হলো লোকের গলা শুনতে পেলাম। এদিক ওদিক অনেক খুঁজেও কিছু দেখতে পেলাম না।
ধুত্তোর বলে উঠে পড়ে আরও আধঘণ্টা একটু বদমাইশি করে সোজা বাড়ি ফিরে এলাম। নদীর ধার থেকে ফিরতে পুরোটাই চড়াই। নো ডবল-ক্যারি। মহারাণীকে বহুদূর হাঁটতে হলো।
পরদিন বিজুরিয়া হতভাগী আড্ডায় এসে বললে যে একলা না গেলে নাকি কিছুই দেখা যায় না—ও কার কাছে শুনেছে। কে জানে।
কোনো কারণে ওর পর আমরা দু’জন বেশ কিছুদিন পরস্পরের সঙ্গে কথা বলিনি, কিন্তু সে গল্প আপনাদের জন্য নয়।
লালাকে ঠিক আসল লালা বলে মেনে নিতেও আমার কিছুদিন সময় লেগেছিলো।
আরেকটা কথা বলে থামি। কিছুদিন পরে আমি একবার একলা গিয়েছিলাম—ততদিনে সাহস বেড়েছে। কিচ্ছু দেখতে পাই নি। কয়েকজন সাঁওতাল মাঝি উল্টো পার থেকে মধুপুরে আসছিলো, তাদের সঙ্গেই হেঁটে শহরে ফিরি।