“এই যে ভাই, মদ খেয়ে খালি বোতলটা সমুদ্রের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিলে, এটা কি ঠিক হল? পরিবেশের ব্যাপারটাও তো একটু ভেবে দেখবে?”
“আজ্ঞে, দেখি তো। ভেবে দেখারও দরকার পড়ে না, অর্ধেক বোতল খালি হতে না হতেই খালি চোখে লাল পরি, নীল পরি... বেশ দেখতে পাই। তারা রঙ্গিন প্রজাপতির মতো আমার মাথার চারদিকে উড়ে উড়ে বেড়ায়। আহা, কী তাদের রূপ! ওরা হাসলে পান্না ঝরে, কান্নায় মুক্তো।”
“পাও তবে দেখতে, পরিরা কাঁদছে? বললে না, কান্নায় মুক্তো ঝরে... চোখ চেয়ে দেখো ওই পরিদের চোখের মুক্তো বুকে ধরে হাজার হাজার শামুখ সমুদ্রের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। ওরা আসলে সমুদ্রের রাজার চর, ওরা শুশুকদের কানে কানে ফিসফিস করে খবর দেবে মানুষের চেয়ে বড় ঘাতক পৃথিবীতে আর কেউ নেই। শুশুকরা বলবে কাছিমদের, কাছিমরা তিমিদের, তিমিরা নিচু কম্পাঙ্কে মেসেজ পাঠাবে সমুদ্রের রাজার কাছে। সমুদ্রের রাজার রাগ বড় ভয়ঙ্কর, মাথা নাড়া দিয়ে অক্ষৌহিণী ঢেউ — সৈনিক নিয়ে একবার যদি সে ডাঙায় উঠে আসে পালাবার পথ পাবে না।”
“আরে, আরে রাগ করছেন কেন, স্যার? আমি ওই বোতলটার মধ্যে জাস্ট একটা চিঠি ভরে, ছিপি এঁটে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলাম।”
“কাকে লিখলে চিঠি?”
“পৃথিবীর অন্যদিকে আটলান্টিক সমুদ্রের তীরে আমার প্রেমিকা থাকে, তাকেই...। হলুদ বেলাভূমিতে সবুজ নারকোল গাছের ছায়ায় সে রোদ পোহায়, আমায় ছবি পাঠিয়েছিল। ঢেউয়ের ধাক্কায় বোতলটা যদি ঠক করে তার পদপল্লবে গিয়ে আছড়ে পড়ে ভেঙে খান খান হয়ে যায়, তখন নিতান্ত কৌতূহলে চিঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে যদি সে একবার পড়ে দেখে, জানবে আমি আজও তার জন্যে অপেক্ষা করে বসে আছি!”
“আচ্ছা, আচ্ছা, ‘থাকো সিন্ধু পারে’ কেস... তা এদেশে কি প্রেমিকা খুঁজে পেলে না? কোথায় আলাপ হল? ফেসবুকে? বিদেশিনীর জন্যে দেবদাস হওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না হে?”
“না না দাদা, সে সত্যি সত্যি বিদেশিনী নয়, আমায় ত্যাগ দিয়ে এন আর আই বিয়ে করে বিদেশ গিয়ে ঘর বেঁধেছে।”
“সে নাহয় বুঝলাম। কিন্তু রাস্তা তো কম নয়! যেতে যেতে বোতলের চিঠিটা যদি ভোল পালটে আরব্য রজনীর দৈত্য হয়ে যায়? তোমার প্রেমিকার সামনে দাঁড়িয়ে গোঁফে চাড়া দিয়ে বলে, হুকুম আকা...”
“তাতে কী?”
“ধর তোমার প্রেমিকা বলল, এই নরাধম প্রেমপত্র লেখকটাকে পৃথিবীর সবথেকে উঁচু পাহাড়ের চুড়োয় নিক্ষেপ করে এসো।”
“ভালোই তো, নিখরচায় এভারেস্ট জয় করে আসা যাবে।”
“অত আনন্দিত হবার কিছু নেই। সে জায়গাও নাকি এখন আবর্জনার আখড়া। জানো, ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের চেনাজানা এই পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাবে। শুধু অবিনশ্বর প্লাস্টিক পড়ে থাকবে।”
“অমন করে ভয় দেখাবেন না স্যর। দমবন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় পিছন থেকে কেউ মাথায় প্লাস্টিকের থলি পরিয়ে টান দিচ্ছে। কোনও একটা সিনেমায় দেখেছিলাম... মার্ডার সিন...”
“স্বাভাবিক। কত ধার্মিক মানুষকেই দেখি প্লাস্টিকের থলিতে পুজোর ফুল বেলপাতা জলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। ভাবখানা যেন সেগুলো সাদা হাঁস হয়ে জলকেলি করবে।”
“হাঁস শুনে কেমন হাঁসফাঁস লাগছে স্যার...”
“মরা হাঁসের পেট কাটলে আকছার প্লাস্টিক আর কাচের টুকরো পাওয়া যাচ্ছে। বেচারারা খাদ্যের সন্ধানে উষ্ণতর এলাকায় উড়ে আসে, কাচ আর প্লাস্টিকের টুকরো ঠুকরে ঠুকরে খায়, তারপর ছেঁড়া পাকস্থলী নিয়ে পাথরের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে।”
“দু-চারটে হাঁস মরলে কী এমন ক্ষতি?”
“হায় মানুষ, খাদ্য পিরামিডটাকে উলটে না দিতে পারলে তোমার শান্তি নেই।”
“ইয়ে, শান্তির কথা আপনি জানলেন কেমন করে, স্যর? তার জন্যেই তো এত অশান্তি। দেখুন না, দু-বছর প্রেম করে কেমন অনায়াসে ফেলে চলে গেল।”
“আহারে! খুব কষ্ট পাও?”
“তা আর বলতে!”
“এক কাজ করো, রোজকার কষ্টগুলোকে মাথা থেকে বার করে মাটিতে পুঁতে দাও। রিলিফ পাবে। তাছাড়া যখন কষ্টর বীজ থেকে চারাগাছ বেরোবে দেখবে কত আনন্দ হয়।”
“আইডিয়াটা মন্দ নয়। তবে একটা সমস্যা। কোন কষ্ট থেকে কোন চারাটা বেরোল বুঝব কী করে?”
“কেন, যখন ফুল ধরবে, তখন ঠিক বুঝতে পারবে। সাধারণত ব্যথার ফুলের রং নীল হয়, অস্থিরতার কমলা।”
“আর যদি সাদা ফুল ফোটে?”
“জানবে, তুমি তাকে ভুলে গেছ।”
“সত্যি, তাকে একেবারে ভুলে যেতে পারব?”
“একদম, মানুষের স্মৃতির পরিধি সীমিত। একটা বৃষ্টির মরশুম পেরোলেই তুমি তাকে ভুলে যাবে। এমন কত দেখলাম।”
“কে জানে? আর সে যদি আমায় না ভুলতে পারে?”
“ওই নিয়ে তুমি মাথা খারাপ কোরো না। তোমার কথা মনে পড়লে অন্যমনস্ক হয়ে রান্নায় দু-বার নুন দিয়ে ফেলবে, তার বেশি কিছু নয়। সেদিন সন্ধেবেলা তার স্বামী খাবার মুখে দিয়ে থুথু করে ফেলে দেবে... তার অভিমান হবে। তখন তোমার প্রেমিকার স্বামী তার স্ত্রীর মানভঞ্জনের জন্যে তাকে রেস্তোরাঁয় খেতে নিয়ে যাবে। উজ্জ্বল আলোর মধ্যে কোণের টেবিলে বসে তারা ডিনার খাবে। ব্যাকগ্রাউন্ডে সফট মিউজিক বাজবে। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তখন চেষ্টা করেও তোমার প্রেমিকা তোমার মুখ মনে করতে পারবে না।”
“যাক, নিশ্চিন্ত হলাম স্যর। মাথা থেকে ভার নেমে গেল। এতদিন লাল পরি নীল পরিদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারতাম না। এবার পারব।”
“সে তুমি বল। একবার কেন বারবার বল। আমি আপত্তি করতে যাব না। কেবল কোনও ডানাকাটা পরির সঙ্গে বিয়েথা করে বসলে পরিবার পরিকল্পনার কথাটা মাথায় রেখো।”
“কী যে বলেন স্যর!”
“আহা লজ্জা পাও কেন? তোমরাই তো পৃথিবীতে নতুন সকাল আনবে। অপরাজিতা ফুলের মতো গাঢ় নীল দূষণমুক্ত আকাশের ছায়া পড়বে নদীর জলে। সেই জলে কেমিক্যাল থাকবে না, হাজার রোগের বীজানু থাকবে না। চইচই হাঁসেদের দল পাড়ে উঠে ডানা ঝাড়বে। নির্ভয়ে দানা খুঁটে খাবে। তোমাদের সন্ততি সুখে থাকবে। বাপদাদার ভালবাসার গল্প করবে, পৃথিবীকে ভালবাসার, মানুষকে ভালবাসার। মঙ্গল হোক তোমাদের। শুভ হোক।”
সমুদ্র নিজের কাছে কিছুই রাখে না। একটা দামাল ঢেউ খালি বোতলটা ফেরত দিয়ে গেল। মাতাল লোকটা এক হাতে চটি অন্য হাতে বোতলটা নিয়ে টলোমলো পায়ে এগোল। বোধহয় সেটার সদ্গতির ব্যবস্থা খুঁজতে। মাতালের কাণ্ডজ্ঞান জাগ্রত হলে তাকে আটকানো দায়। তারও পর যদি সে পরিদের পিছু ধাওয়া করে। লোকটা চলে যাবার পরও ভিজে বালিতে তার পায়ের ছাপ রয়ে গেল বেশ কিছুক্ষণ।