• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৭ | জানুয়ারি ২০২০ | প্রবন্ধ
    Share
  • নবনীতা দেব সেন এর ভালোবাসার কবিতা: “তুমি মনস্থির করো” : অনিতা অগ্নিহোত্রী


    ই নভেম্বর, ২০১৯। নবনীতা দেব সেন চলে যাবার ঠিক পরেই সোশ্যাল মিডিয়া মুখরিত হয়ে উঠেছিল তাঁর নানা কবিতার উচ্চারণে। স্মরণসভার আমন্ত্রণে, ছবির নীচে, পত্র পত্রিকার মলাটে দৃশ্যমান হয়ে উঠল নবনীতা দেব সেনের কবিতার নানা পংক্তি। আরও আশ্চর্যের, ‘কবি নবনীতা দেব সেন’ এই সম্বোধনে তাঁকে ডাকা হ’ল নানা স্মরণের অনুষ্ঠানে। কল্পনা করার মধ্যেই আছে নিরর্থক অসঙ্গতি, তবু আমার মনে হচ্ছিল, নবনীতা দেব সেন থাকলে কত আনন্দিত হতেন। অপ্রতিদ্বন্দ্বী গদ্যকার হিসেবে যতই শীর্ষের দিকে এগিয়েছেন নবনীতা, ততই জনপ্রিয়তা ও সম্পাদকীয় দাবী তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে আরও আরও গদ্য।

    নবনীতার লেখক জীবনের আরম্ভ কবি হিসেবে। কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম প্রত্যয়’ যখন বেরিয়েছিল, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২০। গদ্যের পাশাপাশি কবিতা তিনি নিরন্তর লিখেছেন, পরিমাণে অল্প হলেও। কিন্তু কবি যখন সফল গদ্যকারে পরিণত হ’ল, তখন তাঁর কাছ থেকে আগ্রহ সহকারে কবিতা চান না সম্পাদকরা। যদি অতি ব্যস্ততার কারণে গদ্য না দিতে পারেন, তখন অনিচ্ছুক সম্পাদক বলেন, ঠিক আছে, তা হলে না হয় একটা কবিতাই দিন। এভাবে পছন্দের কবিতাটি লেখা যায়না, মনের গহনে শৈবালের মত ভেসে বেড়ানো কবিতা চিন্তা সুদূরে লুকিয়ে বসে থাকে। নবনীতার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্য, কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের পিছনে তাঁর নিজস্ব অন্যমনস্কতার কারণে, ১৯৭১ এর পর নতুন গ্রন্থ প্রকাশের আগে কেটে গেছে বেশ কয়েকটি বছর। যতদূর জানি, ‘লায়নটেমারকে’-র কবিতাগুলিও স্বতন্ত্র বই হিসেবে প্রকাশিত হয়নি। অনূদিত কবিতা, মৌলিক কবিতার অনেকগুলি অগ্রন্থিত অবস্থায় রয়ে গেছে। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সংকলনেও তাই বেশ কিছু অগ্রন্থিত কবিতার সমাবেশ — যা কোনও বিশিষ্ট বাঙালী কবির ক্ষেত্রে কিছু বিস্ময়ের।

    নবনীতা দেব সেনের প্রেমের কবিতা নিয়ে কিছু লিখব বলে এই ভূমিকা। নবনীতা দেব সেন, তাঁর ব্যক্তিজীবনে যেমন, কবিতা জীবনেও তেমন, আদ্যোপান্ত বেঁচে থাকার, জীবনকে প্রতি পলে অনুভব করার অভ্যাসে নিবিড় হয়ে থাকেন। একই সঙ্গে থাকে নিজেকে প্রশ্ন করার দুরন্ত বাসনা। কিন্তু মানবসম্পর্ক-উদ্‌গত প্রেমও তাঁর লেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। নানা অবসরে নবনীতা দেব সেনের কবিতা পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে, প্রথম প্রত্যয়ের কবিতাগুলির মধ্যে যে প্রেমের অনুভূতি সুপ্ত অথবা অনুক্ত ছিল, উক্ত হলেও অনেকটাই পরোক্ষ, তা বিকশিত হয়েছে, একটি নিবিড় গুচ্ছের মতন, ‘তুমি মনস্থির করো’ বইটিতে। ছোট বই, ছেচল্লিশটি ছোট কবিতা। ২০০৭ - ২০০৯-এর মধ্যে লেখা কবিতাগুলি পুস্তক আকারে যখন প্রকাশিত হয়, নবনীতা দেব সেনের বয়স তখন সত্তর ছাড়িয়েছে। নিজের ছোট সংসারটির দায়িত্বভার কমে এসেছে, সন্তানেরা বড় হয়েছে। অথচ প্রেমের, প্রেমের আকিঞ্চনের সমস্ত স্মৃতিই গলন্ত লাভার মত সময়ের ভাঁজে বন্দী হয়ে আছে। এই বইয়ের জানালা পথে বাইরের আকাশে উড়ে আসছে তারা। মনে হয়, সময়ে ত্রিশ চল্লিশ বছর পিছিয়ে গেছেন নবনীতা; অস্তিত্বের ভিতর থেকে তুলে এনেছেন ফেলে আসা একটি জীবনকাল, যা তাঁর বর্তমানেরই মতন সজীব ও উষ্ণ।

    একটি কবিতা পড়ি —

    চুপ!
    চুপ চুপ হৃৎপিণ্ড
    চুপ করে থাকো
    প্রচণ্ড আওয়াজে তোর
    ত্রিলোকের ঘুম ভেঙে যাবে
    থাম্‌ থাম্‌ ধমনির স্রোত
    এত রক্ত
    ব্রহ্মাণ্ড ভাসাবে।।
    প্রেম নিয়ে কিছুই উক্ত হয়নি এই কবিতায়। অথচ এক অগ্নুৎপাতের ছবি আঁকা হ’ল। “হৃদয়ের এ কূল ও কূল দুকূল ভেসে যায়” সংগীত প্রবাহের সম্পূর্ণ বৈপরীত্যে এই ত্রিমাত্রিক উদ্‌গীরণ।

    অনেকটা এই রকমই আর এক কবিতা —

    হাউই

    তীব্র অপমান
    বুকের বোতল থেকে হুশ্‌ করে
                শূন্যে উঠে যায়
    অন্ধকার থেকে ঝরে পড়ে
                 বহুবর্ণ নক্ষত্র যন্ত্রণা

    কিছুই ভোলা যায় না। ভালোবাসিবার সাধ। ভালোবেসে ব্যর্থ হবার স্মৃতি। তজ্জনিত রক্তপাত। কিন্তু মানুষটি কি বদলে যায়?
    স্মারক

    ভুলে যেতে দিও না নিজেকে
    সেই সব সঙ্গীনের খোঁচা
    রক্ত ঝরতে দিও
    একদিন অস্ত্র ধরতে
    শিখে যাবে হয়তো তুমিও

    যদি মানুষটি বদলে গিয়ে না থাকে, তবে তাকে সহবাস করতে হয় মিথ্যের সঙ্গে। যেমন, এই কবিতাটি:
    অস্তি

    ছোটো ছোটো মিথ্যা জুড়ে জুড়ে
    মস্ত এক সত্য গড়ে ওঠে
    সেই সত্য আর সব সত্যকে গুঁড়িয়ে
    মিথ্যা করে দেয়।
    সেই মিথ্যা এখন জীবন।

    মিথ্যা আসলে সত্যই। কিন্তু সে সত্য লিখিত হয়েছে তার হাতে, যে জয়ী। পরাজিতের কাছে কোনও বিকল্প নেই, জয়ীর লেখা সেই ইতিহাসে দ্বিমাত্রিক ছবি হয়ে থাকা ছাড়া।

    কোথাও কোথাও কবিতা ও ভালোবাসা এক হয়ে গেছে। কবিতা অথবা ভালোবাসা হয়ে উঠেছে জীবনযাপনের শর্ত। এমন একটি কবিতা:

    যতকাল কবিতায়

    বেঁচে থাকো, ফুটে থাকো
    অমোঘ পাসপোর্ট ছবি হয়ে
    প্রত্যেক লাইনে তুমি জেগে থাকো
    আকন্ঠ তেষ্টার মতো
    ছাতিকাটা যন্ত্রণা আমার
    ফুটে থাকো
    লুকিয়ে থেকো না
    যতকাল কবিতায় বাঁচি।

    এর সঙ্গে তুলনীয় আরও একটি কবিতা আছে সঙ্কলনটির আরম্ভে: কবিতাটির নাম, ঘর।
    ঘর

    বারবার প্রণয় সম্ভবা
    বারবার বিরহে সুন্দর
    কবিতার জন্যে বুঝি তুমি
    বারবার দুঃখ খুঁজে নাও?

    কবিতার জন্যে ভাঙো ঘর?

    কবিতাগুলি পড়ি এবং একই সঙ্গে বিষাদে ও আনন্দে আচ্ছন্ন হই। তাঁর নিজের লেখালিখির সুবাদেই নবনীতা দেব সেনের জীবন এক খোলা বই। কে না জানে, লেখিকাদের লেখার মধ্যেও কোনও নিভৃতি নেই। তাঁদের যে কোনও উচ্চারণই আত্মজীবনীমূলক, এমন ধরে নেওয়ার জন্মগত অধিকার পাঠকদের আছে। কবিতাগুলি পড়া শেষ হ’লে বসে ভাবি: যার ভালোবাসার ক্ষমতা ছিল অপরিসীম, তাঁকে কি বিদায় নিতে হ’ল হৃদয়ে ভালোবাসার আকিঞ্চন নিয়ে?

    আমার মতে ‘দুঃখরঙের বাড়ি’ কবিতাটি যার মধ্যে আছে দশটি ছোট কবিতা, এই সংকলনের শেষ কবিতা হওয়া উচিত ছিল। কারণ এগুলির পর আর কোনও কথা অবশিষ্ট থাকে না।

    দুই এবং তিন শীর্ষক দুটি কবিতা উদ্ধৃত করি —

    দুই

    সকলেই একটু একটু বদলে যায়
    সবখানি বদলায় না
    শুধু একটু খানি —
    তাতেই পালটে যায় দিন, রাত্রি, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত।


    তিন

    জানাজানি হয়ে গেল
    সে কখনো ছিল না ওখানে
    শুধু ছায়াটুকু ছিল।।

    একি অপ্রেমের লজ্জা? দাহ?

    চার ও পাঁচ দুটি কবিতাও একইরকম বিষাদ-মাখা,

    চার

    লজ্জার কী আছে, যদি
    বসও বারবার ভুল বলে?
    লজ্জার কী আছে, অশ্রুজলে ?


    পাঁচ

    এখন প্রশ্ন হবে, ফিরি, কি না-ফিরি?
    না-ফেরা ফেরার চেয়ে অনেক কঠিন
    অন্তরাত্মা যদিও বাহিরি।।

    রবীন্দ্রনাথের গান যেমন তাঁর সৃষ্টিক্ষমতার শুদ্ধতম প্রকাশ, নবনীতা দেব সেনের কবিতাও তাই — সংখ্যায় তারা যেমনই কম হোক; সাহিত্যিকের অন্তর্চেতনার নির্যাস তাদেরই মধ্যে।

    ৮ই নভেম্বর সকালে যখন চিরযাত্রার আগে তাঁকে শেষবারের মত দেখতে গিয়েছিলাম, এই দুটি কবিতা, দুঃখরঙের বাড়ি সিরিজের, মনের মধ্যে ফিরে ফিরে আসছিল, বিদায় বেলার গানের মত:

    নয়

    বলবো না ছুঁয়ে থাকো
    বলবো না, তুলসী চন্দন দিও চোখের পাতায়
    শেষ দৃষ্টি নগ্ন চেয়ে থাক্‌ —
    বলে যাক্‌, ফিরিস না কখনো।।

    দশ

    এই মুখ, এ-মুখ অচেনা।
    এই জিব, এ জিহ্বা অচেনা।
    আমাকে এখন আর আমার শরীরে ধরছে না।।

    মৃত্যু কি সদ্য আঁকা ছবির মতন এসে দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল কবির, ডুবিয়ে দিয়েছিল কি তাঁর অতলান্তিক অভিমান?


    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ জয়দীপ মুখোপাধ্যায়
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)