উপন্যাস হ’ল বন্দর থেকে বন্দরে ঘোরা দূরপাল্লার যাত্রীবাহী জাহাজ। ছোটোগল্প হ’ল উপকূলে ঘোরাফেরা করার পালতোলা ডিঙিনৌকো। উপন্যাস লেখার জন্যে প্রয়োজন অলিম্পিক মানের একদল খেলোয়াড়। যদিও ঔপন্যাসিক শেষ পর্যন্ত লিখবেন একা একাই, তিনি আসলে এক দেহে বহু মানুষ--তাঁর মধ্যে মিশে আছেন একদল চিত্রশিল্পী, নগর-পরিকল্পক, গসিপকলমের লেখক, ফ্যাশনের বিশেষজ্ঞ, স্থপতি, মঞ্চসজ্জা বিশারদ; দেওয়ানি আদালতের বিচারক, জমিবাড়ির দালাল, ধাইমা, মুদ্দাফরাস; এক ডাকিনী; এক উচ্চপদের পুরোহিত; সব মিলিয়ে একটাই অস্তিত্ব।
এর উল্টোপিঠে গল্পকার হলেন সেই ডিঙিনৌকার এক মাঝি। একাকীত্বের প্রতি কেন তাঁর এত আগ্রহ? কেনই বা সব সময় উপকূলের কাছাকাছি থেকে যাওয়ার প্রয়োজন? হয়ত: গল্পকার জানেন, যদি তিনি আজ রাতের মধ্যেই পুরো গল্পটা বলে ফেলতে না পারেন, উপকূলের কাছাকাছি--তিনি না পারবেন সমুদ্র পার হতে, রাতও আর সকাল হবে না গল্পটা সমাপ্ত করার কাজে। সব গল্পকারই শেহেরজাদের সন্তান, মনের মধ্যে ঘুমন্ত থাকা গল্পটাকে বলে ফেলতে ব্যস্ত, যাতে নিজের অমোঘ মৃত্যুকে বিলম্বিত করা যায় খানিকটা।
আরব্য রজনীতে যেমন, যে-কোনো ছোটোগল্পেই রয়েছে ক্ষণিকতার সনির্বন্ধ আলিঙ্গন। কিন্তু ক্ষণিক মানে এই নয় যে তার মধ্যে রয়েছে গভীরতার অভাব অথবা আরোপিত মাপকাঠির স্বল্পতা। ছোটোগল্প মানে কিন্তু বামন উপন্যাস নয়। সে এমনই একটা জিনিশ যার রয়েছে নিজস্ব সম্পূর্ণতা, নৈতিক সততা আর সৌন্দর্য। তার মধ্যে রয়েছে অন্তরঙ্গ শতজলঝর্নার ধ্বনি, তবে থাকবে না নিবিড় উন্মোচনের মুহূর্ত, যেমন পাওয়া যায় প্রুস্ত (১৮৭১-১৯২২) অথবা জয়েসের (১৮৮২-১৯৪১) অসাধারণ দৃষ্টান্তে। ছোটোগল্পকে মুহূর্তের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে তার মাধুর্য, তার অর্থসুষমা, তার গাঢ় আবেগ; তাকে দেখতে পাওয়া যাবে (আয়ারল্যান্ডের গল্পকার) শন ও'ফাওলেন (১৯০০-১৯৯১) যাকে বলেন, আকাশে ওড়া বালকের ঘুড়ির মতন, “এক ক্ষুদ্র বিস্ময়, এক সংক্ষিপ্ত ঊজ্জ্বল মুহূর্ত”-এর জন্যে।
যদিও মেনে নেওয়া যায় যে ছোটোগল্প বিলম্বিত করতে সক্ষম আসন্ন মৃত্যুকে, তার প্রতিক্রিয়া হতে পারে বিচিত্র ও বিভিন্ন; যেমন গোগোল (১৮০৯-১৮৫২)-এর বিনীত ওভারকোটের পকেট থেকে নির্গত হয়েছিল রুশ উপন্যাসগুলির এক নিযুত আর এক পৃষ্ঠা; অথবা পো (১৮০৯-১৮৪৯), যার রচনাপদ্ধতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মেশানো ছিল “পরিণাম” অথবা “কলাকৌশল” বিষয়ে পূর্বপরিকল্পিত ধারণা; অথবা চেকফ (১৮৬০-১৯০৪), যাঁর ছোটোগল্পে গ্রহ-উপগ্রহের মতন একরাশ চরিত্র দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়, তারপরে উপস্থিত হয় প্রধান চরিত্র, গল্পটির “সূর্য”।
লাতিন আমেরিকার ছোটোগল্পও এইসব পূর্বপরিকল্পনার সঙ্গে অপরিচিত নয়। লাতিন আমেরিকার উপন্যাসের বিভিন্ন তরঙ্গগুলি হয় প্রতিফলিত হয়েছে ছোটোগল্পে, অথবা তাদের পূর্বাভাস প্রথম দেখা গিয়েছে ছোটোগল্পে। বিশ্বজনীনতা, পরাবাস্তববাদ, স্বভাববাদ, আঞ্চলিক মনোভাব, ভূমিজ মানুষ, কৃষক এবং শহুরে নাগরিক--সবাইকে দেখতে পাওয়া যাবে আমাদের ছোটোগল্পে। কিন্তু তার মানে তাদের রচনাশৈলী কিন্তু লোকচক্ষুর আড়ালে কোনও বায়ুনিধোরক কক্ষে গড়ে ওঠেনি। এতে অনুপ্রবেশ করেছে নিয়মিতভাবে অন্যের জগৎ। লাতিন আমেরিকার আধুনিক ছোটোগল্পের অন্যতম পথিকৃৎ উরুগুয়াইএর হোরেসিও কিরোগা (১৮৭৮-১৯৩৭); তাঁর লেখা কাহিনীগুলির পটভূমি মিসিওনেস প্রদেশের অরণ্যভূমি, কিন্তু তাদের চরিত্রগুলো অমানবিক উচ্ছ্বাস অথবা আবেগের শিকার হয় না, যেমন হয় কলম্বিয়ার হোসে ইউস্তাসিও রিভেরার (১৮৮৯-১৯২৮) অথবা বেনেসুয়েলার রোমুলো গাইয়োগোসের (১৮৮৪-১৯৬৯) বাস্তবভিত্তিক উপন্যাসে; বরং তাদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় আধুনিক এবং নাগরিক উপাদান ও অসুখ: ভীতি, বিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব, আত্মহনন, মানসিক বিশৃংখলা... অন্যদিকে পুরোপুরি শহুরে লেখক আর্হেন্তিনার রোবের্তো আর্লট (১৯০০-১৯৪২) বুয়োনোস আইরেস শহরের এক বিশ্বাসজনক বর্ণনা উপস্থাপিত করেন, সেখানকার মানুষগুলো ময়াল সাপ, চিতাবাঘ অথবা পিরানহা মাছের মতই নৃশংস।
এই নতুন লাতিন আমেরিকার যে সমাজব্যবস্থার বিবরণ প্রতিবিম্বিত হয়েছে আজকের ছোটোগল্পের সংকলনে তা মৃতপ্রায় অথবা জায়মান, অথচ সর্বদাই যথার্থ, যূথবদ্ধ এবং সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় আমাদের কথাসাহিত্যের পরিপূরক অথচ বিরোধী, প্রাচীন ঐতিহ্যকে। তার কারণটাও ভেবে দেখবার মতন; আগে যেরকম দূরত্ব ছিল শহর আর গ্রামের মধ্যে, শহুরে ইঁদুরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হত না গ্রামের ইঁদুরের--ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছে সেই দূরত্বের ব্যবধান, কারণ বেশিরভাগ লাতিন আমেরিকার মানুষ এখন বাস করেন বিশাল মহানগরে অথবা তার শহরতলীতে। রিও দে জেনেরো, মেহিকোনগরী, লিমা, কারাকাস, বোগোতা--শহরগুলো এখন ছড়ানো রাজধানী, প্রতিদিন সেখানে এসে উপস্থিত হন হাজার হাজার চাষাভুষো মানুষ; তাঁরা বিভিন্ন কারণে তাঁদের গ্রাম থেকে ছিন্নমূল--গৃহযুদ্ধ, নাশকতামূলক কর্ম, খিদে, অনুর্বর জমি অথবা শহুরে সুখের ভঙ্গুর স্বপ্ন। কিন্তু শহরে এসে তাঁদের বাকি জীবন কাটে জঞ্জালময় ধাপার মাঠে, নালানর্দমায় অথবা বিশাল বসতি এলাকায় খুদে ঝুপড়িতে; বিচিত্র তাদের নামকরণ--ব্রাসিলের “ফাভেলা”, চিলের “কায়াম্দা”, বেনেসুয়েলার “র্যান্চো” এবং মেহিকোতে, আকরিক অর্থেই “হারিয়ে যাওয়া শহর” অর্থাৎ “সিউদাদেস পারদিদাস”।
একদিকে সামাজিক সমস্যাগুলির দুর্বহ বোঝা আর অন্যদিকে দ্রুত পরিবর্তন আমাদের রচনাকে পূর্বেই প্রভাবিত করেছে এবং এখনও চলেছে তার প্রভাব; কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা আমাদের সমাজকে নতুন আকার, নতুন রূপ, নতুন শব্দভাণ্ডার এবং নতুন কল্পনাশক্তি দেবার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি পেয়েছি। লাতিন আমেরিকার অনেক লেখনই রাজনৈতিক প্রণোদনা প্রকাশ করেন তাঁদের রচনায় এবং সেটার ব্যাখ্যাও খুবই সহজঃ আমরা নিজের নিজের দেশের নাগরিক এবং আমাদের আইনসঙ্গত অধিকার এটা। কিন্তু লেখক হিসেবে সমাজের প্রতি আমাদের অবদান যতোটা না রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি অথবা রাজনৈতিক নির্ভুলতার পালনে; তার থেকে অনেক বেশি দুটো সামাজিক প্রয়োজন মেটানোয়--এই ব্যাপারে লেখকদের প্রস্তুত থাকতে হয়ই--ভাষা এবং কল্পনাশক্তি। একটা সমাজকে যদি তার শব্দভাণ্ডার অথবা স্মৃতি, ভাষা অথবা কামনার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়, তারা খুব সহজেই লাতিন আমেরিকার সুসংবদ্ধ রাষ্ট্রের অভিশাপগুলির শিকার হয়ে পড়ে--মিথ্যা মরীচিকা, বিধিনির্দিষ্ট নেতার দল ও অন্যান্য।
লাতিন আমেরিকার মতন একটা অঞ্চলে ঠিক এই কারণেই সাহিত্যের রচনা, প্রকাশ ও নিয়মিত পাঠ ভীষণভাবে প্রয়োজনীয়। আমাদের সমাজগুলোর রাজনৈতিক উত্থানপতনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমাদের চার নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, জয়েসের সাহিত্যে যেরকম সাধারণ বাক্য এবং ভঙ্গিমা থেকেই হঠাৎ জন্ম নেয় আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তি; আমাদের লেড়ে বিস্কুট খাওয়ার একমাত্র উপায় আমাদের চায়ের ভাঁড়েই ডুবিয়ে ডুবিয়ে। কিন্তু জয়েস অথবা প্রুস্তের রচনায় যে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ--অকৃত্রিম আত্মজ্ঞানের স্বল্পস্থায়ী মুহূর্ত--দেখা দেয় হঠাৎ এবং অস্বাভাবিকরূপে, যেন ডুবে রয়েছে কাহিনীকথনের বিশাল গভীর সমুদ্রে, ছোটোগল্পে সেটা ঘটিয়ে ফেলা চাই অল্পকথায় গল্পকথনের মুহূর্তে; অর্থাৎ তা ঘটবে গল্পের ঘটনাবলীর সঙ্গে সঙ্গে পাশাপাশি।
মেহিকোর হুয়ান রুলফো (১৯১৭-১৯৮৬), কলম্বিয়ার গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস (১৯২৭-২০১৪) অথবা ব্রাসিলের ক্লারিস লিসপেকতর (১৯২০-১৯৭৭)-এর মতন লেখকদের রচিত ছোটোগল্পগুলিতে এমন নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ; অনন্যসাধারণ আধ্যাত্মিক অথবা ছোটোখাটো আকর্ষণীয় মুহূর্ত ঘটে চলে মূল কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে।
একটি লাতিন আমেরিকার গল্পে, অথবা, সেই অর্থে উত্তর আমেরিকার, ইয়োরোপের, এশিয়ার অথবা প্রাচ্যের যে কোনো গল্পেও--প্রতিফলন ঘটে মানবাত্মার অথবা সমাজের; একক অথবা সমষ্টির উভয়েরই প্রয়োজন একটা আকার, একটা স্বীকৃত নান্দনিক পদ্ধতি, কোনো ঐতিহ্যের প্রতি প্রবল আনুগত্য, যার থেকে লাফ দিতে উদ্যত গল্পের কাহিনী, এর মধ্যে সে ফিরিয়ে দেবে তার প্রতিদান — যেমন একটা নৌকো, যার মধ্যে বাহিত হবে তার আকার এবং পাল তুলে রওনা হবে উপকূলের গা ঘেঁষে এবং স্থগিত রাখতে সক্ষম হবে খলিফার দেওয়া মৃত্যুদণ্ড।
আসন্ন মৃত্যুকে পিছিয়ে দেবার অবলম্বন হিসেবে ছোটোগল্পের প্রতিক্রিয়া সত্যি সত্যিই গোগোল অথবা পো অথবা চেকফের মতনই বিচিত্র এবং বিস্তৃত। কিন্তু যদি কেবল লাতিন আমেরিকার কথাই বলতে হয়, আমি মনে করিয়ে দিতে চাই দুই মহান শিল্পীর কথা, দুজনেই আর্হেন্তিনার, হুলিও কোর্তাসার (১৯১৪-১৯৮৪) এবং হর্হে লুইস বর্হেস।
কোর্তাসার পো-এর রচনাসমগ্র অনুবাদ করেছিলেন এসপানিওল ভাষায় এবং সেই মার্কিন লেখকের গল্পের তাৎক্ষণিক অভিঘাত বিষয়েও অবগত ছিলেন পুরোপুরি। প্রতিটি গল্পে এক তাৎক্ষণিক উন্মাদনার সৃষ্টি করার অতুলনীয় দক্ষতা ছিল কোর্তাসারের। অ্যাকোয়িরামে বেড়াতে এসে একজন লোক দেখলো অ্যাক্সোল্টল প্রজাতির এক শ্যামবর্ণ স্যালাম্যান্ডার--যে চিরকাল লার্ভা অবস্থাতেই থেকে যায় আর মানুষের সুখের সঙ্গে যার সুখের গা-ছমছমে মিল--তার সুখ দেখে মনে হ’ল যেন যে তার নিজের মুখই দেখছে। পিরামিডের চূড়ায় বলিপ্রদত্ত এক আসতেক স্বপ্ন দ্যাখে আধুনিক এক হাসপাতালে চলছে তার শল্যচিকিৎসা; অন্যদিকে তার শল্যচিকিৎসার সময় এক আধুনিক মানুষ স্বপ্ন দ্যাখে পিরামিডের চূড়ায় চলছে তার বলিদানের অনুষ্ঠান। আর ইঞ্চির পর ইঞ্চি একটি গৃহ পুরোপুরি অধিকৃত হয় অদৃশ্য শক্তির দ্বারা।
কোর্তাসারের এক একটি গল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ, নিজের নিজের মধ্যে সমাপ্তি ঘটে তাদের।
এর ঠিক বিপরীত হলেন বর্হেস--তিনি এমন গল্পের সৃষ্টি করেন, যাদের অনুপ্রবেশ ঘটে অন্য গল্পের ভিতর এবং পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এক কাহিনীসমাবেশের প্রতিষ্ঠা ঘটে। এক কথায় তাঁর রচনাসমগ্রের নাম দেওয়া যায় তাঁর নিজের লেখা প্রতীকস্বরূপ একটি আলেখ্যর নামে “এল আর্দিন দে সেনদেরোস কে সে বাইফুরকান” অথবা “শাখাপ্রশাখায় পথ সমেত বাগান”। অনেক অনেক বিষয়বস্তু মিলে সৃষ্টি হয়েছে বর্হেস-এর সাহিত্য--তারা লুকিয়ে থাকে একে অন্যের আড়ালে ঠিক যেমন “টল্ন, উকবার এবং অর্বিস টের্টিয়াস” গল্পের [“টল্ন” এক নতুন পৃথিবী; “উকবার” তার অন্তর্গত একটি দেশ; “আর্বিস টের্টিয়াস” সেই দেশের বিষয়ে চল্লিশ খণ্ডের বিশাল এনসাইক্লোপিডিয়া]। কাল্পনিক শহরগুলি, যারা লুকনো সময়ের অন্তরালে; যাদের পুষ্টি স্মৃতির মাধ্যমে এবং যাদের জন্ম ভাষার গর্ভে। এই শিল্পের এক উজ্জ্বল উদাহরণ তাঁর লেখা “পিয়ের মেনার্দ, দন কিহোতের লেখক” নামে গল্পটি যেখানে গোপনতার মাধ্যমে দীর্ঘায়ত করা হয় শিল্পকে।
মেনার্দ, ফ্রান্সের মফস্বলের কনিষ্ঠ আমলা, সিদ্ধান্ত নেন তিনি সেরভানতেসের “দন কিহোতে” উপন্যাসটি নতুন করে লিখবেন। কিন্ত তা না করে হুবহু নকল করে যান মূল উপন্যাসটি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর রচনাটি নতুন সাহিত্যকর্ম, কারণ “দন কিহোতে”-র পুনর্লিখনের মাধ্যমে মেনার্দ আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে উপন্যাসটিকে নতুন করে পড়তে হবে; ১৬০৫ সালে উপন্যাসটি প্রকাশের পর থেকে যা কিছু নতুন ঘটনা ঘটছে, সেই সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টিকাহিনীর নানান অভিনব অনুষঙ্গ। বর্হেস, তাঁর প্রদর্শিত নতুন পদ্ধতিতে পাঠকের কাছে জানান দেন যে অতীতের রয়েছে নিজস্ব অনন্যতা এবং “দন কিহোতে”-র পরবর্তী পাঠক হবেন তার সাম্প্রতিকতম পাঠক।
যদিও মেনে নিতেই হয় যে এই সংকলনের ছোটোগল্পগুলিতে রয়েছে শৈলীগত এবং বিষয়বস্তুগত বৈচিত্র্য, আমি মনে করি যে লাতিন আমেরিকার ছোটোগল্প লিখতে গিয়ে বর্হেস অথবা কোর্তাসারের নজর এড়ানো শক্ত হবে। একজন লেখক লিখবেন, হয় কোর্তাসারের মতন সংযত ও বিবেচক, প্রতিটি গল্প তাঁর স্বয়ংসম্পূর্ণ অস্তিত্ব সমেত; অথবা সংযত ও অবিবেচক, প্রতিটি গল্প ফিরিয়ে ফিরিয়ে আনবে অন্য গল্পের অনুষঙ্গ--সেগুলি হতে পারে লেখা অথবা না-লেখা কাহিনী। কিন্তু আপনি বর্হেস অথবা কোর্তাসার, যাঁর সঙ্গেই একাত্ম বোধ করুন না কেন, যদি সফল ছোটোগল্প লিখে ফেলতে চান, আপনার সামনে থাকবে দুটি পথ: বাস্তবের অথবা স্বপ্নসম্ভবের। আমি নিজে মনে রেখেছি বালজাকের (১৭৯৯-১৮৫০), বিশেষ করে তাঁর “বুনো গাধার চামড়া” গল্পটি; যাতে দুটি পথের কোনো একটিতে পুরোপুরি পা না রেখেও ছোটোগল্প লেখা চলে। সে ঔপন্যাসিক ফরাসি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মুখপাত্র হতে ইচ্ছুক, যিনি মাথার মধ্যে ‘পুরো একটা সমাজ’কে বয়ে নিয়ে যান, কিন্তু তার সঙ্গী হিসেবে থাকে ভূতপ্রেত, উপকথা, ভয়ভীতি, ব্যাখ্যার অতীত ঘটনাবলী এবং এক বুনো গাধার চামড়া, যেটা পূর্ণ করতে পারে আপনার মনের বাসনা, কিন্তু প্রতিটি দানের পরে পরেই তার আকার সংকুচিত হয় খানিকটা এবং শেষ পর্যন্ত, কাহিনীর সমাপ্তিতে দিশেহারা মালিকের জীবন শুষে নিয়ে তা অদৃশ্য হয়ে যায়। প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে সব গল্পেরই একটা অবাস্তব দিক রয়েছে। তারা দখল করে অথবা পুনরাবৃত্তি করে অথবা ভবিষ্যদ্বাণী করে সমসময়ের। সবশেষে তারা, ওয়ালটার বেনজামিন (১৮৯২-১৯৪০) যেমন বলেছেন, মৃত্যুর হাত থেকে ধার নেয় তাদের আইনসম্মত অধিকার। সামাজিক আচরণের পরিধিকে বিস্তৃত করে তারা যোগ করে নতুন কামনাবাসনা এবং দাবীদাওয়া ব্যক্তি এবং সমষ্টি, উভয়ের। মানবচরিত্রকে অনুধাবন করে তারা দুভাবে--স্বচ্ছ এবং রহস্যময়। তারা নতুন করে রূপ দেয় আমাদের--তার কারণ আমাদের জয়, আমাদের জোরজুলুম, আমাদের প্রণয়, এবং আমাদের মৃত্যু--অপরিহার্য এবং অনন্য বস্তুগুলি। আমাদের সাহিত্যে এক অসন্তোষ আর ক্রোধের একটা বড় কারণ হ’ল এই। এবং একই কারণে আমাদের সাহিত্য কোমল আর দয়ালু।
সব মিলিয়ে, কোমল, ক্রুদ্ধ অথবা দয়ালু, বাস্তব অথবা স্বপ্নসম্ভব, সব গল্পের শেষেই ঝুলে থাকে একটা প্রশ্ন, রেশ রয়ে যায় তার সুগন্ধের, যার ফলে একটা গল্প এগোতে পারে সমাপ্তির দিকে, কিন্তু তার সঙ্গেই তা থেকে যায় উন্মুক্ত। তার কারণ ছোটোগল্প হ’ল মৃত্যুর বিরুদ্ধে লেখকের ঘোষণা, লেখক তো আর কিছুই নন কেবল চিরকালের আরোগ্যকামী।
অনুবাদকের কথাঃ
বাংলা ছোটোগল্পের প্রাণপুরুষ যেমন রবীন্দ্রনাথ, ঠিক তেমনই লাতিন আমেরিকার ছোটোগল্পের পুরোধা হর্হে লুইস বর্হেস (১৮৯৯ - ১৯৮৬)। ১৯৯৮ সালে বর্হেসের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের প্রাক্কালে লাতিন আমেরিকার ছোটোগল্পের একটি প্রামাণ্য অ্যান্থোলজি সম্পাদনার ভার দেওয়া হয় মেহিকোর কথাসাহিত্যিক কার্লোস ফুয়েন্তস (১৯২৮ - ২০১২) এবং ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্পাহানীবিদ্যার অধ্যাপক হুলিও ওরতেগার (১৯৪২-) হাতে। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে — মার্কিন প্রকাশক ভিনটেজ পেপারব্যাক আর ব্রিটেনের প্রকাশক পিকাডর পেপারব্যাক। চোদ্দ ডলার মূল্যের চারশো পৃষ্ঠার বইটি বহুপঠনের পরে জীর্ণ।
সংকলিত প্রবন্ধটি সেই গ্রন্থের ভূমিকা--ছোটোগল্পের যে-কোনো সংকলনের পুরোভাগে স্থান পাবার যোগ্য। ফুয়েন্তস প্রবন্ধটি লিখেছিলেন ইংরেজিতে, তাঁর মাতৃভাষা এসপানিওলে নয়। আক্ষেপ হয় যে তিনি ইংরেজি ভাষায় আরও বেশি করে লিখলেন না কেন!