• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৭ | জানুয়ারি ২০২০ | প্রবন্ধ
    Share
  • ‘অশনি সংকেত’ — সত্যজিতের ‘অন্য’ বিভূতিভূষণ : ভাস্কর বসু

    বাংলা মন্বন্তর, বাংলার শিল্পজগৎ ও ‘অশনি সংকেত’ রচনা-

    লকাতা দূরদর্শনে সলিল চৌধুরীর একটি বিখ্যাত সাক্ষাৎকার আমরা অনেকেই দেখেছি। প্রসঙ্গ উঠেছিল তাঁর সেই বিতর্কিত গানটি নিয়ে – যা পরিচিত ‘সেই মেয়ে’ নামে। সেখানে তিনি বোঝাচ্ছিলেন এই গানটি ছিল একই সঙ্গে প্রতিবাদের গান ও আশার গান। আরো জানাচ্ছিলেন এই মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, যা প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ, তা কিভাবে বাংলার শিল্পী সাহিত্যিকদের প্রভাবিত করেছিল। এরই ফলস্বরূপ গড়ে উঠেছিল গণনাট্য সংঘ।

    রবীন্দ্রনাথ সেই মেয়েটিকে দেখেছিলেন এক মেঘলা দিনে, ময়নাপাড়ায় আর সলিল তাকে দেখলেন, দুপুরের খররৌদ্রে, কলকাতার রাস্তায়। সে ভিক্ষে করছে, তার শীর্ণ বাহু তুলে। সলিলের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘সেই মেয়ে’র গানের শেষ পর্বে এসে সলিল আশা রেখেছিলেন যে এই অনাচার বেশীদিন স্থায়ী হবে না। আবার ‘সেই মেয়ে’ ফিরে যাবে তার গ্রামে, গিয়ে সে দেখবে নতুন গ্রাম তৈরী হয়ে গেছে। সেই যুগকে তিনি বাংলা শিল্প-সাহিত্যের এক ‘রেনেসাঁ’ বলে অভিহিত করেছেন।

    বিভূতিভূষণের বয়স তখন তখন প্রায় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই। তখন তিনি পথের পাঁচালী, অপরাজিত এবং আরণ্যকের প্রথিতযশা সাহিত্যিক। আবার সেই দুর্ভিক্ষের প্রত্যক্ষ সাক্ষী তিনি। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি লিখে ফেলেন একটি উপন্যাস – ‘অশনি সঙ্কেত’।

    উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘মাতৃভূমি’ পত্রিকায়। প্রকাশকাল ১৯৪৩ – ১৯৪৫। বিভূতিভূষণ উপন্যাসটি অসমাপ্ত রাখেন। কারণ কি? বিভূতিভূষণ রচনাবলীর ভূমিকায় সাহিত্য সমালোচক ডঃ রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের মতে এই অসমাপ্তির কারণ বিভূতিভূষণ সম্ভবত বুঝতে পারেন এই উপন্যাসে হাত দিয়ে তিনি ভুল করেছেন। এবং তাঁর মতে এটি বিভূতিভূষণের খুব দুর্বল সৃষ্টি। লিখছেন –

    “আজ বিভূতিভূষণের রচনা বলিয়া ইহার ঐতিহাসিক মূল্য থাকিলেও সাহিত্যমূল্য নাই বলিলেই চলে। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় গ্রাম-দেশের মানুষের চরম দুর্দশাই এই উপন্যাসের কথাবস্তু। কিন্তু ইহার কাহিনী, সংলাপ, যেন একমুখী হইয়া এক অখণ্ড জগৎ সৃষ্টি করিতে পারি নাই।”

    এমনকী বিভূতিভূষণ গবেষক রুশতী সেনের ধারণাও কিছুটা একই রকম। জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়’ (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, প্রথম প্রকাশ, ১৯৯৫) গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা আছে ৩৪ – ৩৬ পৃষ্ঠাতে। সেখানেও দেখছি বিভূতিভূষণের এই উপন্যাস শুরু হয়েছে কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থাতেই। ‘মাতৃভূমি’ পত্রিকাতে লেখা দিতেই হবে এই অন্বেষণ থেকেই কি শুরু হয় ‘অশনি সংকেত’? তিনিও অনেকটা ওপরের ডঃ দাশগুপ্তের বক্তব্যের সঙ্গেই একমত। উপন্যাস শেষ না হওয়ার মূল কারণ সম্ভবতঃ এই উপন্যাসকে শেষ করতে গেলে যে পরিমাণ টানাপোড়েন বা টালমাটালের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে বিভূতিভূষণ তার জন্য সেরকম তাগিদ অনুভব করেননি।

    অথচ এই সময় তৈরি হয়ে গেছে বাংলা গণনাট্য সংঘ, ‘নবান্ন’ নাটক অভিনীত হচ্ছে। তার দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন রুশতী সেন। সলিল চৌধুরীর উপরোক্ত সাক্ষাৎকারেও আমরা সেকথা জেনেছি। বিভূতিভূষণ সম্ভবত এই আন্দোলনের সঙ্গে সেভাবে যুক্ত ছিলেন না। ডঃ দাশগুপ্ত এবং রুশতী সেন দুজনেরই মনে হয়েছে উপন্যাসটি বেশ প্রক্ষিপ্ত। এই উপন্যাস লেখার জন্য দুর্ভিক্ষকে যেভাবে অন্তরে অনুভব করার প্রয়োজন ছিল তা একেবারেই নেই। তুলনাতে প্রায় একই সময়ে রচিত ‘দেবযান’ উপন্যাস অনেক প্রাণবন্ত। সম্ভবত কারণ একটাই – ‘দেবযান’ উপন্যাসে লেখক অনেক বেশিমাত্রায় নিজেকে ঢেলে দিয়েছেন।

    তবে আধুনিক যুগে এই উপন্যাসের কদর হয়নি, তা কিন্তু ঠিক নয়। ‘Goodreads’-এ নয় নয় করে ২৩৬টি রেটিং আছে, ১৪টি রিভিউ। সকলেই কম বেশি উচ্ছ্বসিত। গড় রেটিং ৪.৩। কিছু পাঠকের ক্ষোভ আছে বইটি এত ছোট কেন?

    তবে সব মিলিয়ে ডঃ রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের মন্তব্যঃ ‘ঐতিহাসিক মূল্য থাকিলেও সাহিত্যমূল্য নাই বলিলেই চলে’, বা রুশতী সেনের আলোচনা একটু বেশি রূঢ় বলে মনে হয়। আমরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে লক্ষ করি যে বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপন্যাসটিকে এক মহৎ সৃষ্টি বলে উল্লেখ করেছেন। অনেক এগিয়ে গিয়ে বলেছেন,

    “দুর্ভিক্ষের সেই এগিয়ে আসা, ঘনিয়ে ধরা, তার শ্বাসরোধকরা চাপ এবং তার প্রাণান্তক ছোবল স্তরে স্তরে গঙ্গাচরণের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে ত্রিমাত্রিক হয়ে উঠেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তারাশঙ্কর, যাঁরা পৃথক পৃথক অর্থে বাস্তবধর্মিতার জন্য সুখ্যাত, তাঁদের সকলেরই হার হয়েছে বিভূতিভূষণের এই তথাকথিত ‘অসমাপ্ত’ উপন্যাসের কাছে।”
    আমাদের পরবর্তী আলোচনা উপন্যাসটি নিয়েই।

    প্রকৃতি প্রেমিকের চোখে দুর্ভিক্ষের কাহিনি

    আদ্যন্ত প্রকৃতিপ্রেমিক হলেও সামাজিক কাহিনিতেও আমাদের মন জয় করেছেন বিভূতিভূষণ। তাঁর চরিত্রগুলি আমাদের কাছের মানুষ হয়ে গেছে। প্রকৃতিকে তিনি আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন, আবার নিয়ে এসেছেন যুগলকিশোরের মত নিষ্ঠাবান প্রকৃতির পূজারীকেও। তাঁর স্কুল জীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখিত অনুবর্তনও আমাদের কাছে এক অন্য স্বাদের উপন্যাস। আদর্শ হিন্দু হোটেলের হাজারী ঠাকুরের সংস্পর্শে আমাদের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে। অজস্র ছোট গল্পের চরিত্ররাও আমাদের মনে ভিড় জমায়।

    তবে ‘অশনি সংকেত’ একটু আলাদা। আমরা জানি না এই দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা তাঁকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর দিনপঞ্জিতে খুব কম উল্লেখ আছে। উপন্যাসটির পরিসমাপ্তি নিয়েও কি তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন? ডঃ দাশগুপ্ত কি ঠিকই বলেছেন যে ‘(বিভূতিভূষণ) বোধহয় ভাবিয়াছিলেন এখানি আরম্ভ করাই তাঁহার ভুল হইয়াছিল?’

    আমার কাছে এই উপন্যাস বিভূতিভূষণের একেবারে অন্যধারার সৃষ্টি। শুধু দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ নয়, এখানে ব্রাহ্মণতন্ত্রের বিরুদ্ধেও তাঁকে বেশ সরব দেখি। তাঁর নায়ক গঙ্গাচরণ সেই প্রকৃতির মানুষ যারা নিজের উঁচু জাতে জন্মানোর সুযোগ নিয়ে অন্যদের শোষণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত নয়। সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় ‘পরজীবী ব্রাহ্মণ’। তুলনাতে তার স্ত্রী অনঙ্গ একেবারেই অন্যধাঁচের মানুষ। সহজে সে সকলের সঙ্গে মিশতে পারে, তার ব্রাহ্মণত্বের অহঙ্কার নেই। প্রয়োজনে কায়িক পরিশ্রম করে স্বামীকে অর্থসাহায্য করতেও সে দ্বিধা করে না। এই দুটি কেন্দ্রীয় চরিত্রের জোরে উপন্যাস বেশ শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়েছে। গঙ্গাচরণ সমগ্র উপন্যাসে সেই সময়কার প্রচলিত ব্রাহ্মণতান্ত্রিকতার প্রতীক, অনঙ্গ-বৌ শাশ্বত মানবিকতার। গঙ্গাচরণ মনে করে যে নিছক জন্মের জোরেই তার অনেক কিছু প্রাপ্য, অনঙ্গ মনে করে নিজের হাতে কাজ করা অসম্মানজনক নয়।

    পারিপার্শ্বিক চরিত্রগুলিও বেশ আকর্ষণীয়। বিভিন্ন জাতের মানুষের সংমিশ্রণের যে ছবি বিভূতিভূষণ এঁকেছেন তা বেশ মনোগ্রাহী। গঙ্গাচরণকে দিয়েই আলোচনা শুরু হতে পারে।

    গঙ্গাচরণ বেশ লেখাপড়া জানা, বুদ্ধিমান ব্রাহ্মণ, কিন্তু বেশ ধুরন্ধর ও মতলববাজ। নিজের শক্তি দিয়ে সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। শিক্ষাদানও তার পেশা, শরৎচন্দ্রের পণ্ডিতমশাইয়ের ‘বৃন্দাবন’ তার আদর্শ নয়। এই চরিত্রের আঁচ দিয়েছেন বিভূতিভূষণ প্রথমেই। সে নিজের জাতের গর্বে গর্বিত। ছেলেকে হাতের কাজ করতে দেখে সে রেগে যায় —

    ব্রাহ্মণের ছেলে হয়ে কী কাপালীর ছেলের মত দা-কুড়োল হাতে থাকবি দিনরাত?
    অনঙ্গ বললে--কেন ছেলেটার পেছনে অমন করে লাগছো গা? বেড়া বাঁধছে বাঁধুক না? ছুটির দিন তো। গঙ্গাচরণ চক্কোত্তি বললে--না, ওসব শিক্ষে ভাল না। ব্রাহ্মণের ছেলে, ও রকম কি ভালো?”
    অর্থাৎ ছোটবেলা থেকেই সে তার ছেলের মনেও দর্পিত ব্রাহ্মণত্বের বিষ বপন করতে চায়। অনঙ্গ কিন্তু চায় তার ছেলে স্বাভাবিক মানুষ হোক, কায়িক পরিশ্রম তার বেড়ে ওঠার অঙ্গ। সে সহজভাবে গ্রামের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে। সেই সময়কার নারী ও পুরুষের এই বিপরীতধর্মিতা এই উপন্যাসের একটি মূল দিক।

    আরেকটি সংলাপেও তা সুস্পষ্ট —

    (গঙ্গাচরণ)-রও, সব দিক থেকে বেঁধে ফেলতে হবে ব্যাটাদের। চাষা গাঁ, জিনিস বলে পত্তর বলো, ডাল বলো, মুলো বেগুন বলো — কোনো জিনিসের অভাব হবে না। এ গাঁয়ে পুরুত নেই। ওরা বলচে, চক্কোত্তি মশাই, আমাদের লক্ষ্মীপুজো, মনসা পুজোটাও কেন আপনি করুন না?

    — (অনঙ্গ) সে বাপু আমার মত নেই।

    —কেন—কেন?

    — কাপালীদের পুরুতগিরি করবে? শুদ্দুর-যাজক বামুন হোলে লোকে বলবে কি?

    — কে টের পাচ্ছে বলে? এ অজ পাড়াগাঁয়ে কে দেখতে আসচে – তুমিও যেমন?

    — কিন্তু ঠাকুরপুজো জানো? না জেনে পুজো-আচ্চা করা— ওসব কাঁচা-খেকো দেবতা, বড় ভয় হয়। ছেলেপিলে নিয়ে ঘর করা--

    — অত ভয় করলে সংসার করা চলে না। পাঁজিতে আজকাল ষষ্টি পুজো মাকাল পুজো সব লেখা থাকে—দেখে নিলেই হবে।-

    ওপরের সংলাপ থেকে গঙ্গাচরণের এবং অনঙ্গের চরিত্র পরিষ্কার করে বুঝিয়েছেন বিভূতিভূষণ। অনঙ্গ যতই ভয় পাক না কেন চালাকির দ্বারা কার্য সিদ্ধ করতে গঙ্গাচরণ বদ্ধপরিকর।

    আরেকটি চরিত্র গ্রামের বিশ্বাসমশাই। তিনি গ্রামের মুরুব্বি। গঙ্গাচরণকে ভরসা দিয়েছেন যে গ্রামের একমাত্র ব্রাহ্মণ গঙ্গাচরণকে তিনি পাঠশালা করে ভালো করে থাকার বন্দোবস্ত করে দেবেন। সেই বিশ্বাসমশাই যখন বিপদে পড়েন, তাঁর কাছ থেকে শান্তি-স্বস্ত্যয়নের জন্য মোটা সওদা করতেও গঙ্গাচরণ দ্বিধাগ্রস্ত হয় না।

    আগের গ্রাম, ভাতছালাতে অনঙ্গের খুব কাছের মানুষ ছিল মতি মুচিনী। তাদের সম্পর্ক প্রায় বন্ধুত্বের। অনঙ্গের অন্তরের স্বাভাবিক ঔদার্য ব্রাহ্মণ-মুচির জাতের তফাৎকে মান্য করেনি। মতি তার কাছে এসে থেকেছে, আম কুড়িয়ে এনে খাইয়েছে। পরে আবার যখন তারা ভাতছালাতে ফেরে মতি ও অন্যান্যরা তাদের আদর যত্ন করে।

    দুর্ভিক্ষের আগমনের আগের সময়টি সত্যিই চমৎকার ফুটিয়েছেন বিভূতিভূষণ। গ্রামে ধীরে ধীরে গঙ্গাচরণের প্রতিপত্তি বাড়ছে, তাদের সংসারে মোটামুটি সাচ্ছল্য এসেছে, খুব সহজ বিবরণে সব ঘটনা এসে গেছে কাহিনিতে। সলিল চৌধুরীর বিখ্যাত গানের মতই ‘একটু খানি শ্যামল ঘেরা কুটীরে তার স্বপ্ন শত শত’-র গল্প শুনতে শুনতেই আমরা মন্বন্তরের আভাস পাই।

    মাঝে মধ্যে যুদ্ধের কথা শোনা যাচ্ছে। এক বৃদ্ধ পুরোহিত দীনু ভটচায গঙ্গাচরণের কাছে সাহায্য চায়। চালের দাম নাকি ভীষণ বাড়ছে।

    প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও আস্তে আস্তে গঙ্গাচরণও বুঝতে পারে বাজার খারাপ হচ্ছে। অবস্থা সঙ্গিন হয় যখন একদিন সে বাজারে চাল লুটের মধ্যে গিয়ে পড়ে। তার ব্রাহ্মণত্বকে অস্বীকার করে তাকে চোর অপবাদ দিতেও লোকের বাধে না।

    অনঙ্গের সাথী কাপালীদের ছোট বৌ। যখন অনঙ্গ ঘরে আর চালের ব্যবস্থা করতে পারে না, তখন তার সঙ্গে গিয়ে কচুর শাক, কলমী শাক, তুলে খাওয়ার ব্যবস্থা করে। কিন্তু একদিন অনাহারের জ্বালা সহ্য না করতে পেরে ছোট বৌ পরপুরুষের কাছ থেকে নিজের শরীরের বিনিময়ে খাবার জোগাড় করে। ক্রমশ মন্বন্তর তার করাল ছায়া ফেলছে।

    গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থ বিশ্বাস মশাইয়ের উপর আক্রমণ হয়, তিনি গ্রাম ছাড়ার প্রস্তুতি নেন। এই ধীরে ধীরে মন্বন্তরের চেহারাটা ফুটে ওঠার ছবি খুব বিস্তারিত ভাবে সুন্দর করে এঁকেছেন বিভূতিভূষণ। উপন্যাসের শেষ পর্বে আমরা দেখি অনাহারে ঘটে যাওয়া প্রথম মৃত্যু। অনঙ্গর ভালোবাসার জন মতি, যে এসেছিল অনঙ্গের কাছে ক্ষুধার জ্বালায়, তার মৃত্যুই অশনির সংকেত।

    মতির মৃতদেহ আমতলাতেই পড়ে আছে। কত লোক দেখতে আসচে। দূর থেকে দেখে ভয়ে ভয়ে চলে যাচ্চে। আজ যা ওর হয়েচে, তা তো সকলেরই হতে পারে! ও যেন গ্রামের লোকের চোখ ফুটিয়ে দিয়ে গেল। একটি মূর্তিমান বিপদের সংকেত স্বরূপ ওর মৃতদেহটা পড়ে রয়েচে আমগাছটার তলায়। অনাহারে প্রথম মৃত্যুর অশনি সংকেত।
    কিন্তু মৃত্যু থেকেই এক নবজন্মের শুরু হয়। এই আখ্যান সেই কালের যে কালে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে নীচু জাতের তফাৎ ছিল খুব বেশি। কিন্তু এই দুর্ভিক্ষের মৃত্যু যেন সেই তফাৎকে ঘুচিয়ে দিল। অনঙ্গর অনুনয়কে ফেলতে পারেনা গঙ্গাচরণ, ব্রাহ্মণ ভটচাযও যোগ দেয়। সঙ্গে কাপালীদের ছোট বৌ। দুর্ভিক্ষের মৃত্যু এক নতুন সমাজের জন্ম দিল, জাতপাতের ঊর্ধে মানুষ মনুষ্যত্বকে স্থান দিতে পারলো। অনঙ্গ-বৌ এর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কাছে হার মানতে হয়েছে গঙ্গাচরণের ব্রাহ্মণত্বের অহমিকাকে।

    এরপরে লোকজনের গ্রাম ছেড়ে পালানোর খবর দিয়েই কাহিনিটি মোটামুটি শেষ হয়। কাপালীদের ছোট বৌ অনঙ্গর কথা শুনে তাদের সঙ্গে থাকতে রাজি হয়। গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে গেলে হয়তো সে অনাহারের থেকে বাঁচত, কিন্তু তাও অনঙ্গের ভালোবাসার বাঁধনে সে আটকে যায়। কিছুটা খাপছাড়া হলেও এটাই কাহিনির পরিসমাপ্তি।


    পরিসমাপ্তি নেই বলেই সম্ভবত উপরোক্ত সমালোচকরা উপন্যাসটিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। পাঠক হিসেবে আমার রায় কিন্তু অন্যান্য সাধারণ পাঠকের মতই, যাঁদের অনেকেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। কেউ লিখেছেন —

    দুর্ভিক্ষ যে কতটা শক্তিশালী, কতটা অনভিপ্রেত তা এই উপন্যাসে বড় দুঃখ অথচ কঠোর বাস্তব ও একইসঙ্গে মায়ামাখানো গ্রামবাংলার জীবনের রূপের মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন বিভূতিভূষণ। দুর্ভিক্ষ সব শেষ করে দিয়ে যায়। হয়তো মনুষ্যত্বকেও। বা হয়তো নয়। পাঠকের মনে এই ভাবনাটুকুর উদ্রেক হওয়াই হলো এই বইটির মর্ম।
    একদমই তাই। আমারও তাই মতামত। আমি কখনোই মনে করি না যে ‘ইহার কাহিনী, সংলাপ, যেন একমুখী হইয়া এক অখণ্ড জগৎ সৃষ্টি করিতে পারি নাই।’ বরং নতুন ধরনের উপন্যাসের যে পরীক্ষা তিনি করতে চেয়েছিলেন, তাতে তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। শেষ অংশটুকু হয়তো তিনি আবার একটু যত্ন করে লিখলে তা পূর্ণ উপন্যাসের মর্যাদা পেত।

    কিন্তু তা সত্ত্বেও বেশ ধীর লয়ে, অতর্কিতে, সুস্থ, সুন্দর গ্রামজীবনের উপর যে মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ছায়া পড়ছে, তাঁর চিত্রিত এই ছবি আমাদের মুগ্ধ করে। এখানে মহামারী, জলপ্লাবন, ভূমিকম্প বা খরার প্রকোপ না থাকাতে গ্রামবাসীরা বিশ্বাসই করতে পারেনি যে অবস্থা এমন ভয়াবহ হবে। আর প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক যখন লেখেন এই উপন্যাসের বাস্তবতার বয়ানে তিনি তারাশঙ্কর-মানিককে ছাড়িয়ে গেছেন, তা নিঃসন্দেহে উঁচু মানের শংসাপত্র।


    চলচ্চিত্রে অশনি সংকেত


    অশনি সংকেত নিয়ে ছবি করার ইচ্ছে কিন্তু সত্যজিতের বহুদিনের। ১৯৪৩ – ৪৫, কাহিনিটি যখন ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছিল, তখন তিনি সম্ভবত পড়েননি। কারণ ১৯৪৪ সালে দিলীপকুমার গুপ্তের কাছেই তাঁর বিভূতিভূষণে হাতেখড়ি। ‘আম আঁটির ভেঁপু’র রেখাঙ্কন ও প্রচ্ছদ করার সময়ই তাঁর প্রথম পথের পাঁচালীর পাঠ। কিন্তু তিনি কি ঐ দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন? সেভাবে ঠিক জানা যায় না। এমনকি বিজয়া রায়ের ‘আমাদের কথা’-তে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কথা (১৯৪১) থাকলেও এই ঘটনার সেরকম উল্লেখ নেই।

    সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে জানা যায় যে ‘অপুর সংসার’ ছবির সময় থেকেই তিনি এই ছবির কথা ভেবে আসছিলেন। বলছিলেন – উপন্যাসটি এত সুন্দর যেন চিত্রনাট্য করাই আছে। কীভাবে দুর্ভিক্ষ আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে তার চমৎকার ছবি তুলে ধরা হয়েছে এবং না খেতে পেয়ে মৃত্যুতে কাহিনি শেষ। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন – ‘তাছাড়া গঙ্গাচরণ তো আমাদের হাতেই রয়েছে, খাঁটি ব্রাহ্মণ সন্তান।’ বোঝা যাচ্ছে, সত্যজিৎও মনে করেছিলেন –

    দুর্ভিক্ষের সেই এগিয়ে আসা, ঘনিয়ে ধরা, তার শ্বাসরোধকরা চাপ এবং তার প্রাণান্তক ছোবল স্তরে স্তরে গঙ্গাচরণের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে ত্রিমাত্রিক হয়ে উঠেছে।
    অর্থাৎ ‘চিত্রনাট্য করাই আছে’ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এই কথাই তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন।

    ১৯৭২ সালে ছবিটি যখন শুরু হল, তখন সৌমিত্র সত্যজিতের সঙ্গে পূর্ণ প্রস্তুতির সুযোগ পেয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে গঙ্গাচরণের ধূর্তামির কথা মনে করে সৌমিত্র মুখে একটু ধূর্ত হাসি রেখেছিলেন। সত্যজিৎ তাঁকে বলেন সেটা না রাখতে কারণ হাসি ছাড়াই গঙ্গাচরণের ধূর্ততা বেশি প্রকাশ পায়।১০

      
    ‘তাছাড়া গঙ্গাচরণ তো আমাদের হাতেই রয়েছে, খাঁটি ব্রাহ্মণ সন্তান।’

    সত্যজিতের বিভূতিভূষণ প্রীতি সর্বজনবিদিত। সংলাপ প্রসঙ্গেও তিনি লিখেছেন বিভূতিভূষণের কথা। বাঙালি চিত্রনাট্যকারদের বলেছেন তাঁর সংলাপ থেকে শিক্ষা নিতে।

    বিভূতিভূষণের সংলাপ পড়লে মনে হয় যেন সরাসরি লোকের মুখ থেকে কথা তুলে এনে কাগজে বসিয়ে দিয়েছেন। এ সংলাপ এতই চরিত্রোপোযোগী, এতই revealing যে, লেখক নিজে চরিত্রের আকৃতির কোন বর্ণনা না দিলেও কেবলমাত্র সংলাপের গুণেই চরিত্রের চেহারাটি যেন আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও স্মরণশক্তি না থাকলে এ ধরনের সংলাপ সম্ভবপর নয়। ১১
    এই জোরালো সংলাপের সঙ্গে আমরা যেন আরো বেশী করে পরিচিত হই এই উপন্যাসে। গঙ্গাচরণ এবং অনঙ্গ বৌএর সংলাপ তো বটেই, অন্যান্য পার্শ্বচরিত্রগুলি, — দিনু ভটচায, বিশ্বাসমশাই, মতি বাগদি, কাপালীদের ছোট বৌ-এর সংলাপগুলিও তাদের প্রকৃতি চিনিয়ে দেয়। সেজন্য লেখককে কোনরকম বিস্তারনার সাহায্য নিতে হয়নি।

    সুতরাং বোঝা যায়, এই উপন্যাস সত্যজিতের কাছে কেন এত আকর্ষক ছিল। অশনি সংকেতের আগেই তিনি বিশ্বখ্যাত পরিচালক, দেশে বিদেশে অনেক সম্মানপ্রাপ্তি ঘটেছে। এর আগে তিনি রবীন্দ্রনাথের কাহিনিকে চিত্রায়িত করার জন্যও কিছু পরিবর্তন করে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। এই উপন্যাসে যে তিনি একেবারে বিভূতিভূষণের আখ্যানকেই পুরোমাত্রায় অনুসরণ করলেন, তার কারণ আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি।

    কয়েকটি বড়োসড়ো পরিবর্তন তিনি করেছেন। যেমন, উপন্যাসে গঙ্গাচরণ ও অনঙ্গের দুটি সন্তান ছিল। এখানে সত্যজিৎ এই দম্পতিকে কমবয়সী ও নিঃসন্তান দেখিয়েছেন। কাহিনির শেষভাগে এই দম্পতির সন্তানসম্ভাবনার একটি আভাস দিয়েছেন পরিচালক। অন্য পরিবর্তনগুলিও যথাসময়ে আলোচিত হবে।

    চলচ্চিত্রটি রঙ্গিন হওয়ার ফলে প্রকৃতির ছবি খুব সজীব। শস্য শ্যামলা বাংলা-- না আছে খরা, না আছে বন্যা। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই এরকম মন্বন্তর সম্ভব? ছবির শুরুতেই দেখি বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর, জলভর্তি পুকুর, আর প্রসারিত ধানক্ষেত! “এমন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে” — ক্যামেরা ধীরগতিতে প্রকৃতির রূপকে প্রত্যক্ষ করে। যে দেশে এত প্রাকৃতিক প্রাচুর্য, সেখানে কেন আসবে সর্বনাশ?

    ঠিক এই কারণেই গঙ্গাচরণ, অনঙ্গ বৌ, গ্রামের মুরুব্বি বিশ্বাসমশাই বা অন্যান্যরা বিশ্বাসই করতে পারছিল না যে বিপর্যয় সমাগত। খুব ধীরে ধীরে, সন্তর্পণে, যেন তার পদক্ষেপ শোনা যাচ্ছিল। তা সত্ত্বেও যথেষ্ট গতিসম্পন্নভাবেই আমাদের চোখের সামনে সব কিছু পাল্টে যেতে থাকে।

    প্রত্যেকটি চরিত্রকেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার মত জায়গা দিয়েছেন পরিচালক। তার ফলে দুর্ভিক্ষের প্রভাব যে সমাজের ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ধরা পড়েছে, তা আমাদের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব। বড় চরিত্রগুলির আলোচনার আগে তিনটি চরিত্রের কথা ধরা যেতে পারে — বিশ্বাসমশাই, ভটচায ও মতি। তাদের চেহারা, হাঁটাচলা, কথাবার্তায় সেই গ্রামের তিনটি শ্রেণীর মানুষের ছাপ নির্ভুলভাবে ধরা পড়েছে।

    বিশ্বাসমশাই গ্রামের মুরুব্বি। ছবির শুরুতেই তিনি ব্রাহ্মণ গঙ্গাচরণের প্রতি নিষ্ঠাবান। গ্রামে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেখানোর জন্য তিনি উদ্যোগী স্কুল খোলার ব্যাপারে। এমনকি যুদ্ধের খবর আসার পরও কিন্তু তিনি নিরুদ্বিগ্ন ভাবে গ্রামের মানুষকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেন। তাঁর গোলার সঞ্চিত ধানে গ্রামবাসীদের চলে যাবে। কিন্তু শেষে তিনিও গ্রামবাসীদের অবিশ্বাসের পাত্র হয়ে প্রহৃত হয়ে গ্রামত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।


    দুর্ভিক্ষের আগে – গঙ্গাচরণের সঙ্গে সদালাপী বিশ্বাসমশাই পরে – পীড়িত, অপারগ

    দীনু ভটচায এক দূরবর্তী গ্রামের ব্রাহ্মণ, তিনি গঙ্গাচরণের চেয়েও ‘পরজীবী’। চোখের অসুখের জন্য কাজ না করতে পারার অজুহাত দিয়ে ভিক্ষের দ্বারাই সংসার চালাতে চান। গঙ্গাচরণের রোজগারে ভাগ বসাতে, তাদের বাড়ি উপযাচক হয়ে খেতে তার কোন আপত্তি নেই। তার স্বাভাবিক দুর্বলতা বশত অনঙ্গ তাকে সাধ্যমত আপ্যায়ন করে। কিন্তু দুর্ভিক্ষের মাত্রা যখন চরমে তখন গঙ্গাচরণ তার উপর বিরক্ত হয়। এভাবেই দুঃসময় পালটে দেয় মানুষের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলিকে। কিন্তু তার মধ্যেও অনঙ্গ যেন দাঁড়িয়ে থাকে মূর্ত মানবতার শাশ্বত প্রতীক হয়ে। গঙ্গাচরণকে অনুনয় বিনয় করে সে যথাসম্ভব আতিথ্যের আয়োজন করে।

        
    ভটচায ব্রাহ্মণ - দুর্ভিক্ষের আগে – গঙ্গাচরণের কাছে ভিক্ষারত পরে – গঙ্গাচরণের আপত্তি সত্ত্বেও অনঙ্গের ঔদার্যের আতিথ্য

    এই চরিত্রগুলিতে অভিনয়ও অত্যন্ত উঁচুমানের। বিশেষ করে বলতে হয় ভটচাযের ভূমিকাতে গোবিন্দ চক্রবর্তীর কথা। সেই পরজীবী ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্বের গর্ব, কাজ না করার অজুহাত, গঙ্গাচরণের প্রতি লুকনো ঈর্ষা, অনঙ্গ বৌ-এর আতিথেয়তার সুযোগ নেওয়া--সবকিছু অনবদ্য ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর নিখুঁত অভিনয়ে।

    গঙ্গাচরণের ভূমিকাতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় নিশ্চয়ই তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ রূপে গণ্য হবে। তাঁর সেই সময়কার কলকাতার যুব সমাজের প্রতীক ইমেজকে এই ছবিতে তিনি ভেঙেচুরে ফেলেছেন। আমরা জানি এর জন্য তিনি প্রস্তুতিও নিয়েছেন প্রচুর। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে হয়তো উপন্যাসটি তাঁর আগেই পড়া ছিল। চরিত্র নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন সত্যজিতের সঙ্গে, ছবি শুরুর আগেই ঘটনাস্থলে গিয়ে নিজের চোখে দেখেও এসেছেন। ‘পরজীবী’ ব্রাহ্মণোচিত চাতুর্যে, ছলাকলায় দক্ষ, গঙ্গাচরণকে তিনি আমাদের চোখের সামনে হাজির করাতে পেরেছেন। নিজে ব্রাহ্মণ হয়ে ভটচাযের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা পরিস্ফুট। ছবির শেষে ব্রাহ্মণত্বের অহংকার যখন আক্ষরিক অর্থেই ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়, সেই মুহূর্তগুলিতেও তাঁর অভিব্যক্তি চমকপ্রদ। সুন্দরী স্ত্রীর প্রতি তার প্রেমপূর্ণ চাহনিও ভারী মনোগ্রাহী।

    ছুটকির চরিত্রে সন্ধ্যা রায় অত্যন্ত সাবলীল। এই ধরনের চরিত্র তিনি আগে পরে অনেকবার করেছেন। কাজেই বোঝা যায় তিনি একেবারে চরিত্রের গভীরে ডুবে সাঁতার দিয়েছেন। মনে হতে পারে, তিনি কি ‘অনঙ্গ বৌ’ চরিত্রে অভিনয় করতে পারতেন না? কেন সত্যজিৎকে অন্যদেশের অভিনেত্রীর ওপর নির্ভর করতে হল? উত্তরে বলা যেতে পারে, সত্যজিতের কল্পনাতে অনঙ্গ বৌ-এর মধ্যে যে গ্রামীণ সারল্য ছিল, তা হয়তো সেই সময় সন্ধ্যা রায়ের মধ্যে ছিল না। তুলনাতে ছুটকি চরিত্রটি একেবারে যেন তাঁর জন্যই তৈরি ছিল।

    আমার মতে, সবকিছুর উপরে থেকে যাবে এই ছবিতে সত্যজিতের নতুন আবিষ্কার অভিনেত্রী ববিতার উজ্জ্বল উপস্থিতি। সত্যজিতের পরিচালনাতে তাঁর অসাধারণ অভিনয় আবার প্রমাণ করে চরিত্রোপযোগী শিল্পী নির্বাচনে সত্যজিতের অসীম দক্ষতার কথা। আমরা নিঃসন্দেহে মানি যে এই ছবিতে সকলেই যোগ্য অভিনেতা, সুযোগ অনুযায়ী তাঁরা সকলেই উজাড় করে দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলবো ববিতা যেন সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন। বিভূতিভূষণের অনঙ্গ বৌ যেন মূর্ত হয়েছে পর্দায়। প্রত্যেকটি দৃশ্যে তিনি অনন্যভাবে উজ্জ্বল--কর্তব্যে, ভালোবাসায়, লজ্জায়, ব্যথা-বেদনায়--তাঁর অভিব্যক্তি পূর্ণমাত্রায় আমাদের মুগ্ধ করেছে।


    আতিথ্যে, লজ্জায়, ব্যথা-বেদনায়, ভালোবাসায়, কর্তব্যে, – অনন্য অভিব্যক্তি – অনঙ্গ বৌ

    নিঃসন্দেহে এই ছবি সত্যজিতের এক অসাধারণ সৃষ্টি বলেই থেকে যাবে। তা ছাড়া এর ঐতিহাসিক মূল্যও তো অনস্বীকার্য। ব্রিটিশ রাজশক্তির এই অন্যায় অবিচারের কথা, পরাধীন ভারতবাসীর উপর এই নিষ্ঠুর অত্যাচারের কথা সেভাবে তো কেউ তুলেই ধরেননি। আগেও না, পরেও না। সত্যজিতের এই ছবিই কিন্তু বিশ্ববাসীর কাছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আপাতসুপ্ত এই নিষ্ঠুর দিকটিকে তুলে ধরে।

    তবে এইখানে আমি একটু হলেও আশাহত হয়েছি। এতবড় ট্র্যাজেডির পিছনে যে ব্রিটিশ রাজশক্তির চক্রান্ত ছিল, তা সেভাবে বিধৃত হয়নি। অস্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও সাধারণ দর্শকের কাছে তা ধরা না পড়তেও পারে। এটা ঠিক, এই বিষয় নিয়ে বিভূতিভূষণ কিছু আলোকপাত করতে পারেননি। তবে সেটা ছিল ১৯৪২ - ৪৩ সাল। তখন ঠিক বোঝাও হয়তো যায়নি। কিন্তু ১৯৭১ -৭২ সালে সত্যজিৎ যখন ছবি করছেন তখন কিন্তু অনেক গবেষণা হয়েছে। অমর্ত্য সেনের গবেষণার ফল কিছুদিন পরেই (১৯৮১) বিশ্ব জুড়ে প্রকাশিত হবে। ১২

    তৎকালীন যুদ্ধের কিছু ছবি, বিভিন্ন রণাঙ্গনের চেহারা, বর্মার পতন, ব্রিটিশ রাজশক্তির অবক্ষয় — এগুলিকে কি কিছু জায়গা দেওয়া যেত না? আমার ব্যক্তিগত মত তাতে ছবিটি আরো প্রাণবন্ত হত। সুজলা সুফলা দেশের মানুষ কিভাবে তাদের শাসকের দ্বারা নিপীড়িত হল তার এক জাজ্বল্যমান উদাহরণ হয়ে থেকে যেতে ছবিটি। দুটি ভিন্ন পরিস্থিতির, গ্রামের অবস্থা এবং রণাঙ্গনের অবস্থার তুলনামূলক একটা সংঘর্ষ কি ছবিটিকে আরো চিত্তাকর্ষক করতো না? শেষে অবশ্য বলা হয়েছে দুর্ভিক্ষটি ছিল মানুষের সৃষ্টি, কিন্তু সেই মানুষ যে ব্রিটিশ রাজ, তা আরো স্পষ্ট করে বলা যেত। এছাড়া সেই সময়কার স্বাধীনতা আন্দোলনের (ভারত ছাড়ো – ১৯৪২) কিছু ছবি এলে সময়ের ছাপও থেকে যেত। হয়তো বাজেটের সমস্যাও হতে পারে। পরবর্তীকালে হিন্দিতে নির্মিত ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ী' সিনেমার মতো সংস্থান থাকলে হয়তো সম্ভব হত।

    অশনি সংকেতকে ব্যঙ্গ করে অশনি সঙ্কট বলেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। তুষার তালুকদারের সঙ্গে সাক্ষাতে বলেছিলেন —

    আমার খুব কৌতূহল ছিল ছবিটি কেমন করে শেষ হয়েছে সে ব্যাপারটায়। সেখানে তো মানিকবাবু চূড়ান্ত ধেড়িয়েছেন। তুমি দেখেছো তো। শেষদৃশ্যটা মনে কর, সেখানে মন্বন্তরের কোপে পড়া হাজার হাজার ভুখা মানুষের মিছিল দিয়ে ছবি শেষ হয়েছে, তাই তো?

    হ্যাঁ। আর কেমনভাবে শেষ হতে পারতো?

    ঠিক বিভূতিবাবু তাঁর বইয়ে লিখেছেন, মনে আছে? সেখানে ছিল সেই পণ্ডিতের স্ত্রী পাগলের মত জমিয়ে রাখা বীজধান একেবারে পাথরের মত শুকনো খটখটে জমিতে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অর্থাৎ মৃত্যুর মিছিল নয়, নতুন জীবনের সৃষ্টি। এটাই শেষ কথা।

    -১৩
    এর সঙ্গে আমি একেবারেই একমত নই। আগেই বলেছি, কাহিনিটি অসমাপ্ত। হ্যাঁ, পণ্ডিতের স্ত্রীর একবার বীজধান ছড়িয়ে দেবার কথা আছে। কিন্তু সেটা এই কাহিনির মূল উপজীব্য নয়। অনঙ্গ বৌ বরাবরই চরম আশাবাদী, একেবারে উচ্চ মানবতার প্রতীক। তবে ‘অশনি সংকেত’ সিনেমার মূল উপজীব্য শেষের সেই কথাগুলি — ‘১৯৪৩ সালে বাংলাদেশে মানুষের সৃষ্টি এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে প্রায় ৫০ লক্ষ নরনারীর মৃত্যু হয়।’

    এই কাহিনি সেই নির্মম বঞ্চনার, দুর্ভাগ্যপীড়িত জনগণের অসহায় আত্মসমর্পণের। আমার মতে একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এর সমাপ্তি যথাযথ। সেটি এই — উপন্যাসের শেষে ছুটকি যদুপোড়ার আহ্বানকে উপেক্ষা করে অনঙ্গ বৌ-এর ভালোবাসার টানেই গ্রামে ফিরে আসে, তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য। ছুটকি, গঙ্গাচরণ, ভটচায, সকলে মিলে অন্ত্যজ মতির শেষকর্মে ব্রতী হয়। এই ক্ষয়িষ্ণু সময়ে এই ঘটনা খুব মর্মস্পর্শী। দুর্ভিক্ষ, অনাহার, মৃত্যু –তা যেন অলৌকিকভাবে মানুষের মধ্যে সৃষ্ট ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে। সম্ভবত এই পরিসমাপ্তি আরও বেশি তৃপ্তিদায়ক হতে পারতো।

    আবার এও হতে পারে সত্যজিৎ ভেবেছেন, সিনেমাতে যা দেখানো হয়েছে, ছুটকির পক্ষে এই অবস্থায় অনঙ্গ বৌ-এর আশীর্বাদ সম্বল করে অজানা ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ানোই বাস্তবসম্মত। আর ঐ মর্মস্পর্শী উপসংহার দেখালে এই নির্মম বাস্তবের অভিঘাত কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে যেত। তাই তাঁর বিখ্যাত গানের সারাংশ দিয়েই হয়তো সিনেমার পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন — "রাজায় রাজায় যুদ্ধে কেবল দেশে অমঙ্গল, তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল?”


    তথ্যসূত্র :


    ১) https://www.youtube.com/watch?v=XZrnATbtDsQ (১১.৪৪ মিনিট – ১৫.১৮ মিনিট)

    ২) বিভূতি রচনাবলী – পঞ্চম খণ্ড - মিত্র ও ঘোষ প্রথম প্রকাশ, ১৩৬১

    ৩) বিভূতিভূষণ – রুশতী সেন - পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, প্রথম প্রকাশ, ১৯৯৫, পৃঃ ৩৪ – ৩৬

    ৪) https://www.goodreads.com/book/show/15721603—

    ৫) ‘নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে’ – সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেশ, ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪, পৃঃ – ৪৪

    ৬) বিভূতি রচনাবলী – পঞ্চম খণ্ড - মিত্র ও ঘোষ প্রথম প্রকাশ, ১৩৬১, পৃঃ ১৯৯

    ৭) বিভূতি রচনাবলী – পঞ্চম খণ্ড - মিত্র ও ঘোষ প্রথম প্রকাশ, ১৩৬১, পৃঃ ২০০

    ৮) বিভূতি রচনাবলী – পঞ্চম খণ্ড - মিত্র ও ঘোষ প্রথম প্রকাশ, ১৩৬১, পৃঃ ২৯৯

    ৯) https://www.goodreads.com/book/show/15721603--?rating=2

    ১০) মানিকদার সঙ্গে – সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আজকাল প্রকাশনী সপ্তম মুদ্রণ জানুয়ারি ২০১১ পৃঃ – ৪৫ – ৪৬

    ১১) বিষয় চলচ্চিত্র, সত্যজিৎ রায়; অষ্টম মুদ্রণ; আনন্দ; সেপ্টেম্বর ২০০৯; পৃঃ ৬৪

    ১২) https://en.wikipedia.org/wiki/Amartya_Sen

    ১৩) ঋত্বিকদা সলিলদা – তুষার তালুকদার – আজকাল পাবলিশার্স লিমিটেড, প্রথম প্রকাশ, বইমেলা ২০০৩, পৃঃ – ৪৪ – ৪৫




    অলংকরণ (Artwork) : ছবিগুলি--আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)