শিল্পের জন্য শিল্প নয়, স্বামী বিবেকানন্দের রচনা জীবনের জন্য। যে জীবনের লক্ষ্য মানুষের কল্যাণসাধন এবং অন্তর্নিহিত দেবত্বের বিকাশ। আমরা জানি বাণী এবং রচনায় নরেন্দ্রনাথ দত্তর উপর কর্তৃত্ব করেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামীজীর উদ্দেশ্যমূলক রচনা আজকের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার যুগে কীভাবে পড়া যেতে পারে? এক্ষেত্রে আমরা স্বামীজীর বাংলা রচনাগুলিকেই প্রধানত অবলম্বন করব। তাঁর জীবন এবং রচনা মিলে জন্ম দিতে পারে নতুন কোনো পাঠ। বিশ্বজিৎ রায় ‘স্বামী বিবেকানন্দ বাংলা রচনা সংকলন’ গ্রন্থে ‘প্রবেশক’ অংশে বিস্তৃতভাবে স্বামীজীর বাংলা লেখালেখির বিষয়-প্রকরণ, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, ভাষা ব্যবহার প্রভৃতি নিয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন। খুব সুন্দরভাবেই তিনি উনিশ শতকের বাক্ সংস্কৃতির সূত্র ধরে বাণীময় বিবেকানন্দের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। তাঁর বক্তৃতাগুলি অন্যেরা লিখে নিতেন এবং সেখান থেকেই মুদ্রণের উপযুক্ত লেখা তৈরি হত। জীবনের শেষ চার বছর স্বামীজী ‘বাংলা ভাষার লেখক হিসেবে প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ’ করেন। তাঁর ‘বাংলা লেখা’ নিয়ে বিশ্বজিৎ রায়ের অভিমত উদ্ধৃত করছি--“চিঠিপত্র বাদ দিলে বিবেকানন্দের মৌলিক বাংলা রচনা বলতে মূলত তিনটি গ্রন্থকে বোঝায়। ‘বর্তমান ভারত’, ‘পরিব্রাজক’ এবং ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’। ‘ভাব্বার কথা’ নামে বিবেকানন্দের অন্য যে বইটি প্রচলিত সেটি নিতান্তই রচনাসংকলন। তাঁর প্রয়াণের পর গড়ে তোলা।... বাংলা লেখাগুলি উদ্বোধন পত্রিকায় ১৮৯৯ থেকে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত। পরিব্রাজক নামে যে বইটি চালু, সেটিকে বিলাতযাত্রীর পত্র বলাই উচিত।...বাগ্মী বিবেকানন্দ যেমন তাঁর বক্তৃতায় জাতীয়জীবনে উদ্দীপনার সঞ্চার করতে চান তেমনই তাঁর লেখাতেও উদ্দীপনাসঞ্চারই উদ্দেশ্য।” ১ ‘বলার নান্দনিকতা আর লেখার নান্দনিকতা’ তাঁর কাছে অভিন্ন ছিল বলেই সংযোগের এক নতুন সূত্র তৈরি হয়ে যায় আমাদের কাছে। লেখার মাধ্যমে তিনি আদতে কথা বলতে চেয়েছেন। এবারে দেখা যাক আজকের প্রেক্ষিতে এই কথাগুলো কীভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
“জ্ঞান মানে কি না বহুর মধ্যে এক দেখা। যে গুলো আলাদা, তফাৎ বলে আপাততঃ বোধ হচ্ছে, তাদের মধ্যে ঐক্য দেখা। যে সম্বন্ধে এই ঐক্য মানুষ দেখ্তে পায়, সেই সম্বন্ধটাকে “নিয়ম” বলে; এরি নাম প্রাকৃতিক নিয়ম।”২ ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ গ্রন্থটির প্রথমেই বলেছিলেন আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই ‘একটা ভাব’ আছে তেমনি প্রত্যেক জাতের রয়েছে ‘জাতীয় ভাব’। এই ভাবকে ধরতে গিয়েই এসেছে ইউরোপীয়দের সঙ্গে আমাদের গুণগত ফারাকের প্রসঙ্গ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভাবসমন্বয়ের জন্য উনিশ শতকের যে পরিচয়, বিবেকানন্দের লেখায় তা উঠে এসেছে। অবশ্য স্বামীজীর দেখার চোখ স্বতন্ত্র। শুধু দেখা নয়, দেখানোও বটে— “আমি যা শিখেছি, যা বুঝেছি, তাই তোমাদের বল্ছি; আমি ত আর বিদেশ থেকে তোমাদের হিতের জন্য আমদানী হইনি যে, তোমাদের আহাম্মকি গুলিকে পর্য্যন্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে হবে?”৩ এই কথার মধ্যেই উপনিবেশের প্রভুদের প্রাচ্যচর্চা এবং বিবেকানন্দের স্বাজাত্যবোধের নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে। আমরা জানি পরাধীন দেশের মানসিকভাবে পঙ্গু মানুষদের নব উদ্যমে জাগাতে চেয়েছিলেন বিবেকানন্দ। রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মত তাঁর রচনাও উদ্দেশ্যমূলক। উদ্দেশ্যমূলকতার সঙ্গে শিল্পের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের কথা বহুল আলোচিত। এটাও ঠিক, উদ্দেশ্যমূলক রচনা শিল্পগুণে দুর্বল হলেও সাহিত্যের ইতিহাসে বারেবারেই বিপুল প্রভাব রেখে যেতে সক্ষম হয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দের বাংলা রচনা পড়ার ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি মনে রাখা যেতে পারে। বীর সন্ন্যাসী ধর্মের লক্ষণ হিসেবে ‘কার্য্যশীলতা’কে নির্দেশ করেছিলেন। ফলে ধর্মের প্রায়োগিক রূপ তৈরি হল। এবং তা সমাজ সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে জীবসেবার। প্রত্যেক জীবকে ‘শক্তি প্রকাশের এক একটি কেন্দ্র’ হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন— “মানুষ হও, রামচন্দ্র! অমনি দেখবে, ওসব বাকি আপনা আপনি গড়গড়িয়ে আসছে। ও পরস্পরের নেড়িকুত্তোর খেয়োখেয়ী ছেড়ে, সদুদ্দেশ্য, সদুপায়, সৎসাহস, সদ্বীর্য্য অবলম্বন কর। যদি জন্মেছ, ত একটা দাগ রেখে যাও।”৪ বলা বাহুল্য বই-এর পৃষ্ঠা থেকে কথাগুলি মনের ভেতর ঝড় তোলে। প্রবাদে পরিণত হওয়া এই বাক্যের শক্তি আজও প্রাসঙ্গিক। তেমনি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার বিষয়টি। সাম্প্রতিক কালে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত এমন সব ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি আমরা, যাতে মানুষ সম্বন্ধেই প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। জন্মালেই যে কেউ মানুষ হয় না, মানুষ হয়ে ওঠা যে একটি প্রক্রিয়া, আজকের প্রেক্ষিতে এটি সবচেয়ে জরুরি বলে বোধ হচ্ছে।
পাশ্চাত্যকে বুঝতে চেয়ে বিবেকানন্দ শুরু করেন ‘পাশ্চাত্য ধর্মের আকর ফ্রান্স’ থেকে। গ্রীক শিল্পের প্রতি তাঁর অনুরাগের মূলে ক্লাসিক মেজাজ ক্রিয়াশীল ছিল। প্রাচীন ইতালির রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে জেগে ওঠার কথা উল্লেখ করে পরিণামবাদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আমাদের আলোচনার শুরুতেই আমরা ঐক্যবোধের কথা বলেছিলাম। বর্তমান সময় টুকরো টুকরো ভাবে দেখতে অভ্যস্ত করছে আমাদের, সেখানে ‘সমস্তই সেই একের বিকাশ’ হিসেবে ভাবা যেতে পারে কি? আলাদা আলাদা মনে হওয়াটা ‘মায়া’, ‘অবিদ্যা’। আর এক হলেন ব্রহ্ম। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মূলগত প্রভেদের সঙ্গে বাহ্যিক আচার, চালচলন, খাদ্য প্রভৃতির আলোচনায় লেখকের যুক্তিশীল সত্তা ক্রিয়াশীল থাকে সবসময়— “যাঁর উদ্দেশ্য কেবল মাত্র ধর্ম্মজীবন, তাঁর পক্ষে নিরামিষ; আর যাকে খেটে খুটে এই সংসারের দিবারাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে জীবনতরি চালাতে হবে, তাকে মাংস খেতে হবে বৈ কি।”৫ ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ গ্রন্থের শেষ অংশে রামায়ণ নিয়ে কথা বলছেন স্বামীজী। উড়িয়ে দিচ্ছেন রামায়ণকে আর্যদের বিজয়গাথা হিসেবে পড়ার প্রকল্পকে। সাংস্কৃতিক রাজনীতির চালচিত্র তাঁর কাছে পরিষ্কার। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এটাই স্বাধীনতার এতদিন পরেও আমাদের উপনিবেশের চেতনা দূরীভূত হল না। বিবেকানন্দ বলছেন— “সে রাবণ, রামায়ণ পড়ে দেখ, ছিলেন রামচন্দ্রের দেশের চেয়ে সভ্যতায় বড় বই কম নয়। লঙ্কার সভ্যতা অযোধ্যার চেয়ে বেশী ছিল বরং, কম ত নয়ই। তার পর বানরাদি দক্ষিণি লোক বিজিত হলো কোথায়? তারা হলো সব শ্রীরামচন্দ্রের বন্ধু, মিত্র।”৬ আজকের প্রেক্ষিতে এই রামায়ণ পাঠ নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন স্বামীজীর অন্যতম প্রিয় বই মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, যার সমান কাব্য বিশ্বসাহিত্যে দুর্লভ।
“মানুষ যে জিনিসটি তৈরি করে, তাতে কোন একটা idea express (মনোভাব প্রকাশ) করার নামই art (শিল্প)। যাতে idea-র expression (ভাবের প্রকাশ) নেই, রং-বেরঙের চাকচিক্য পরিপাটি থাকলেও তাকে প্রকৃত art (শিল্প) বলা যায় না।”৭ ‘স্বামি- শিষ্য সংবাদ’-এ এমনটাই শুনি স্বামীজীর মুখে। এই idea-র সূত্রেই এসেছে ‘Kali the Mother’ কবিতার কথা। মহাপ্রলয়ের সংহারমূর্তির ভাবকে ছবিতে দেখার ইচ্ছে তিনি ব্যক্ত করেছিলেন। একটি শিল্প থেকে আরেকটি শিল্প মাধ্যমে রূপান্তরের ইচ্ছের মাধ্যমে বিবেকানন্দের শিল্পী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘বর্ত্তমান ভারত’ রচনায় পাই— “সমষ্টির জীবনে ব্যষ্টির জীবন, সমষ্টির সুখে ব্যষ্টির সুখ, সমষ্টি ছাড়িয়া ব্যষ্টির অস্তিত্বই অসম্ভব, এ অনন্ত সত্য জগতের মূল ভিত্তি।”৮ সাম্প্রতিক আত্মকেন্দ্রিক জীবনের প্রেক্ষিতে এই ভাবনা আমাদের মনে রাখতেই হয়। বিশ্বায়নের যুগে পাশ্চাত্য অনুকরণ প্রবণতা আমাদের সংস্কৃতিকে যখন গ্রাস করছে, সেই সময় প্রায় সাবধান করে দেন বিবেকানন্দ— “পাশ্চাত্য অনুকরণে গঠিত সম্প্রদায়মাত্রই এদেশে নিষ্ফল হইবে।”৯ শব্দ যদি ঝংকার তুলতে পারে, রক্তে আনতে পারে হিন্দোল, তবে ‘বর্ত্তমান ভারত’ রচনার শেষ অনুচ্ছেদ সার্থকতম কাব্যের নিদর্শন। যা কিছু শ্রেষ্ঠ তার সারাৎসার যদি কবিতা হয়, তবে বিবেকানন্দের গদ্য রচনা ছুঁয়ে থাকে কবিতাকে— “হে ভারত, এই পরানুবাদ, পরানুকরণ, পরমুখাপেক্ষা, এই দাসসুলভ দুর্ব্বলতা, এই ঘৃণিত জঘন্য নিষ্ঠুরতা — এইমাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করিবে?... হে বীর, সাহস অবলম্বন কর, সদর্পে বল, আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই। বল, মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই…”১০ সারা ভারতবর্ষ জুড়ে যখন নিম্নবর্গের মানুষের ওপর সামাজিক অত্যাচার নেমে আসছে, সেই সময় সমস্ত ভারতবাসীকে ভাই হিসেবে মনে করাটাই আমাদের আশু কর্তব্য। আর এভাবেই সমসময়ের নিরিখে বিবেকানন্দের রচনার একরকম পাঠ প্রস্তাবনা তৈরি হতে থাকে। তাঁর রচনা হয়ে ওঠে আমাদের অস্তিত্বের আয়না।
“আমাদের দেশে বলে, পায়ে চক্কর থাক্লে সে লোক ভবঘুরে হয়। আমার পায়ে বোধ হয় সমস্তই চক্কর।”১১ ‘পরিব্রাজক’ রচনার শুরুতে বলেছিলেন স্বামীজী। তাঁর রচনার থেকে পেতে পারি তাঁর পরিব্রাজক মনের হদিশ। ‘বিলাতযাত্রীর পত্র’ রচনাটিতে ভ্রমণলব্ধ অভিজ্ঞতা ব্যক্ত হয়েছে। শুধু পুঁথি পড়া বিদ্যা নয়, জীবনের ঘাত প্রতিঘাত থেকে অভিজ্ঞতালব্ধ সত্যের জন্য বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা পেয়েছে এক অনন্য মাত্রা। সেইসঙ্গে তাঁর ব্যাপক অধ্যয়নের কথাটি স্মরণীয়। বিভিন্ন বই থেকে তুলনামূলক আলোচনা করে সিদ্ধান্তের কথা বলেছেন তিনি বারবার। নির্বিবাদে মেনে নেওয়া নয়, সন্দেহ, পরীক্ষা, যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত সত্য তিনি তুলে ধরছেন তাঁর লেখায়। গ্রন্থতত্ত্ব নিয়ে তিনি যেসময় চিন্তাভাবনা করছেন, তা আমাদের সমীহ আদায় করতে বাধ্য— “সময়ে সময়ে সকল ভাষারই পরিবর্ত্তন হচ্ছে, আবার এক এক লেখকের এক একটা ঢঙ্ থাকে। যদি একটা পুস্তকে খামকা একটা অপ্রাসঙ্গিক বর্ণনা লেখকের ঢঙ্গে থাকে, তাহলেই সেটা প্রক্ষিপ্ত বলে সন্দেহ হবে। এই প্রকার নানা প্রকারে সন্দেহ সংশয় প্রমাণ প্রয়োগ করে গ্রন্থতত্ত্ব নির্ণয়ের এক বিদ্যা বেরিয়ে পড়্লো।”১২ বিবেকানন্দের ‘পত্রাবলী’তে বিভিন্ন প্রসঙ্গে তাঁর নিজস্ব বই বিষয়ক সচেতনতার প্রকাশ ঘটেছে। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে এক পত্রে লিখছেন প্রিয় আলাসিঙ্গাকে যিনি মাদ্রাজ থেকে ‘ব্রহ্মবাদিন্’ পত্রিকার সম্পাদনা করতেন-- “... সাঙ্কেতিক প্রণালীতে আমার বক্তৃতাগুলি লিখে নেবার ফলে অনেকটা সাহিত্য গড়ে উঠছে দেখে আমি খুশি। ... যা হোক, লোককল্যাণের জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি—এই মনে করেই আমি সন্তুষ্ট...”১৩ এই প্রসঙ্গে আমাদের বঙ্কিমচন্দ্রের কথা মনে পড়তেই পারে। সাহিত্যের সঙ্গে জনকল্যাণের উদ্দেশ্যের ফলে কী লিখব-র সঙ্গে কীভাবে লিখব হয়ে উঠেছে তাঁর ভাববার বিষয়। এই পত্রেই বিবেকানন্দ লিখছেন— “আমার যে সাফল্য হচ্ছে, তার কারণ আমার সহজ ভাষা। আচার্যের মহত্ত্ব হচ্ছে তাঁর ভাষার সরলতা।”১৪ ‘বর্ত্তমান ভারত’ থেকে ‘পরিব্রাজক’—সমাসবহুল সাধু ভাষা থেকে চলিত ভাষায় লেখালেখির মূলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ইচ্ছে ক্রিয়াশীল থেকেছে। এপ্রসঙ্গে ‘বাঙ্গালা ভাষা’ লেখাটির কথা উল্লেখ করতেই হয়। যেখানে তিনি চলিত ভাষার সপক্ষে কথা বলছেন। বাংলা ভাষায় বিবিধ বিদ্যাচর্চার গুরুত্ব বারেবারে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই এসেছে অনুবাদের প্রসঙ্গ। ‘পরিব্রাজক’ গ্রন্থে তিনি লিখছেন— “এ সব দেশে নিজের ভাষায় অসংখ্য পুস্তক; তার উপর যখন যে ভাষায় নূতন কিছু বেরুচ্ছে, তৎক্ষণাৎ তার অনুবাদ করে সাধারণের সমক্ষে উপস্থিত করছে।”১৫ আবার ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে এক পত্রে লিখছেন— “হিন্দুভাবগুলি ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করা, আবার শুষ্ক দর্শন, জটিল পুরাণ ও অদ্ভুত মনোবিজ্ঞানের মধ্য থেকে এমন এক ধর্ম বের করা, যা একদিকে সহজ সরল ও সাধারণের হৃদয়গ্রাহী হবে আবার অন্যদিকে বড় বড় মনীষিগণের উপযোগী হবে! এ যারা চেষ্টা করেছে, তারাই বলতে পারে—কি কঠিন ব্যাপার!”১৬ সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্য যখন পাঠকের আনুকূল্য হারাচ্ছে, কিংবা হারিয়ে ফেলছে তার আন্তর্জাতিকতাবোধ ও বিশ্ববীক্ষাকে, সে সময় বিকেকানন্দের অনুভব সাহিত্যের মূলগত ভাবনাগুলিকে নতুনভাবে উসকে দেয়। লেখক-পাঠক সম্পর্ক নিয়ে তাঁর চিন্তাচেতনা এক বৃহত্তর সংযোগের কথা বলে। যে কোনো বিচ্ছিন্নতার বিপরীতে হৃদয়স্পর্শী ভাব সাহিত্যের মধ্য দিয়ে সঞ্চারিত করবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা বিবেকানন্দের বাণী ও রচনাকে করে তোলে অবশ্যপাঠ্য।
স্মরণযোগ্যতা যদি কবিতার অন্যতম মাপকাঠি তবে তিনি সার্থক শিল্পী। ‘সখার প্রতি’ কবিতার শেষ পঙ্ক্তিদ্বয়ের মধ্যেই নিহিত আছে তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার ভাবনির্যাস— “বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?/ জীবে প্রেম করে যেইজন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”১৭ বিবেকানন্দের বেশিরভাগ কবিতাই ইংরেজি থেকে অনুবাদ করা হয়েছে। ‘নাচুক তাহাতে শ্যামা’ কবিতাটি এককথায় অসামান্য। উজ্জ্বলকুমার মজুমদার ‘বিবেকানন্দের কবিতা’ শীর্ষক লেখায় মৃত্যুরূপা কালীকে কীভাবে দেখছেন বিবেকানন্দ, তা স্পষ্ট করেছেন— “দেখা মানে মায়ের চোখে দেখা; জীবন-মরণ একাকার করে দেখা, তাঁরই চোখে সর্বত্র তাঁকে দেখা। ‘তুমি আঁখি মম, তব রূপ সর্ব ঘটে।’ এই দেখায় তুমি আমি ভেদ থাকে না। এই দেখাই যোগের দৃষ্টি, মিস্টিকের অনুভূতি।”১৮ মেধা ও আবেগ মিলে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে দৃষ্টান্তবিশেষ।
স্বামী বিবেকানন্দের বাংলা রচনা আমাদের যেকোনো সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে শেখায়। শেখায় মানুষ হতে। বাংলা গদ্য সাহিত্যে তাঁর বৈপ্লবিক উপস্থিতি আজও প্রাসঙ্গিক। তাঁর লেখা পড়ে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে সাহিত্য হতে পারে সমাজবদলের চাবিকাঠি। শঙ্করীপ্রসাদ বসু বলেছিলেন একটি লেখায়— “বিবেকানন্দ তাঁর চিন্তা ও সৃষ্টিতে আধুনিক এবং শাশ্বত আধুনিক। তাঁর মধ্যে ঘটেছে ঐতিহ্য ও আধুনিকতায় সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক সম্মেলন।”১৯ বিবেকানন্দ শুধু আজকের প্রেক্ষিতে নয়, সব সময় প্রাসঙ্গিক। তিনি একইসঙ্গে সমকালীন ও চিরন্তন।
তথ্যসূত্রঃ-
১। স্বামী বিবেকানন্দ, ‘স্বামী বিবেকানন্দ: বাংলা রচনা সংকলন’, বিশ্বজিৎ রায় (সম্পাদনা), কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, প্রথম প্রকাশ—মার্চ ২০১৩, পৃঃ ৩২-৩৩।
২। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৯৬।
৩। তদেব, পৃঃ ১৬৫।
৪। তদেব, ১৬৭।
৫। তদেব, ১৭৭।
৬। তদেব, ২০৩।
৭। শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী, স্বামি-শিষ্য সংবাদ, ‘স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা’, নবম খণ্ড, কলকাতা, উদ্বোধন কার্যালয়, তৃতীয় সংস্করণ ভাদ্র ১৩৮০, পৃঃ ১১৮।
৮। বর্ত্তমান ভারত, ‘স্বামী বিবেকানন্দ: বাংলা রচনা সংকলন’ পূর্বোক্ত, পৃঃ ৯১।
৯। তদেব, পৃঃ ৯৮।
১০। তদেব, পৃঃ ৯৯।
১১। পরিব্রাজক, ‘স্বামী বিবেকানন্দ: বাংলা রচনা সংকলন’, পূর্বোক্ত, পৃঃ ২০৭।
১২। বিলাতযাত্রীর পত্র, তদেব, পৃঃ ১৪৫।
১৩। পত্রাবলী, ‘স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা’, সপ্তম খন্ড, পৃঃ ১৮৯।
১৪। তদেব।
১৫। পরিব্রাজক, ‘স্বামী বিবেকানন্দ: বাংলা রচনা সংকলন’,পূর্বোক্ত, পৃঃ ২০৯।
১৬। পত্রাবলী, ‘স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা’, সপ্তম খন্ড, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৮৪।
১৭। সখার প্রতি, ‘স্বামী বিবেকানন্দ: বাংলা রচনা সংকলন’, পৃঃ ৬৪।
১৮। ‘বিবেকানন্দের কবিতা’, উজ্জলকুমার মজুমদার, শাশ্বত বিবেকানন্দ, নিমাইসাধন বসু (সম্পাদনা), কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট, লিমিটেড, প্রথম সংস্করণ—সেপ্টেম্বর ১৯৯২, পৃঃ ১৮৫।
১৯। ‘স্বামী বিবেকানন্দ: সাহিত্যে ঐতিহ্য ও আধুনিকতা’, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৫৬।