• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৭ | জানুয়ারি ২০২০ | প্রবন্ধ
    Share
  • গলছে বরফ, গলছে না দায়ী দেশগুলোর মন : হাসান জাহিদ


    রাশক্তিধর দেশগুলোর শক্তিধর নেতাগণ, এমনকি সারাবিশ্বের পাতি নেতৃবৃন্দ যখন বৈশ্বিক কূটচাল নিয়ে ব্যস্ত, এবং যুদ্ধংদেহী মনোভাব প্রদর্শন করছেন, অস্ত্রের ঝনঝন শব্দ তুলছেন, যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছেন, তখন এক কিশোরী জলবায়ু পরিবর্তনের কুফলের কথা জানিয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠল।

    নাড়া দিল বিশ্ব বিবেককে। তখন দেয়া হলো পরিবেশকর্মী সুইডিশ ষোড়শী গ্রেটা থুনবার্গকে বিকল্প নোবেল ‘রাইট লাইভলিহুড’ পুরস্কার। হয়তো বিশ্ব নেতৃবৃন্দ নতুনভাবে উপলব্ধি করেছেন জলবায়ু পরিবর্তনের কুফলকে। কিন্তু নেতৃবৃন্দ কি জলবায়ু পরিবর্তন রোধে আশু কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন? যে ফাঁদ তাঁরা নিজেরা তৈরি করেছেন, সেই ফাঁদে নিজেরাই আটকে যাবেন অচিরে — এই উপলব্ধিটুকু তাঁদের মধ্যে জাগিয়ে দেয়া কি একটা ছোট্ট মেয়ের কাজ?

    যখন ফলদায়ক কিছু হচ্ছে না তখন খুদে একটা মেয়ে সরব হয়ে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিল যে, এটি ‘বড়দের বিরুদ্ধে ছোটোদের যুদ্ধ,’ আর সেটা হাতেনাতে প্রমাণ করে দিয়ে গ্রেটা রুদ্রমূর্তি ধারণ করল অনিশ্চিত এক ভবিতব্যের কথা ভেবে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে খোঁচা মেরে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, আগামী পৃথিবী বর্তমান প্রজন্মের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং অ-বসবাসযোগ্য। ক্যানেডীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে গ্রেটা সাফ জানিয়ে দিল: ‘আপনি জলবায়ু পরিবর্তনরোধে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।’শুধু জাস্টিন ট্রুডো নন; অনেক রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান গ্রেটা-র তোপের মুখে পড়েছেন।

    গ্রেটা-র কাছ থেকে আমরা একটা নতুন শিক্ষা লাভ করেছি। সেটা হলো — রবিঠাকুরের ভাষায় — ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’

    শেষ পর্যন্ত দায় এসে বর্তাল ছোটোদের স্কন্ধে, বড়রা সেই কবে থেকেই জলবায়ু নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে মুখে ফেনা তুলে বেলাশেষে প্রমাণ করলেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কুপ্রভাব প্রতিরোধের প্রয়াস যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। বরং পৃথিবীর স্বাস্থ্যের আরও ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

    গ্রেটা’র আগমন যেন অনেকটা ঐশ্বরিক; যে-সময় বিশ্ব নেতারা যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছেন, তেল ট্যাংকার পোড়ানোর অজুহাতে যুদ্ধের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছেন, তখন গ্রেটা থুনবার্গ যেন দেবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বিশ্ববাসীর মনোযোগ ঘুরিয়ে দিল যুগ যুগ ধরে লালিত একটা বৈশ্বিক সমস্যার দিকে; যা কার্যকর পদক্ষেপে সমাধানযোগ্য, অথচ একে লালন করা হয়েছে অনেক দেশের রাষ্ট্রীয় স্বার্থরক্ষায়।

    গ্রেটা-র আহ্বানে ১৫০টি দেশের কয়েক লক্ষ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় বিশ্বনেতাদের ব্যর্থতার (কিম্বা কূটচালের) প্রতিবাদে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে।

    এখন প্রশ্ন দাঁড়াল: বিশ্বনেতৃবৃন্দ কি গ্রেটা-র আহ্বানে যথাযথ সাড়া দেবেন, নাকি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য, শক্তি প্রদর্শনের জন্য আরও মারমুখী হয়ে উঠবেন? কিংবা তাঁদের ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব স্বীকার করে ছোটোদের সাথে হাত মিলিয়ে একযোগে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন কুপ্রভাবের বিরুদ্ধে কাজ করে যাবেন?

    এইসব প্রশ্নের উত্তর, জলবায়ু পরিবর্তন ও তার কুপ্রভাব, ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য কেন তা হুমকি হয়ে উঠল, কীভাবে হলো, আগামী পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য রাখতে কী করে যেতে হবে বর্তমান পৃথিবীকে — এসব এখন বিপন্ন বিশ্ববাসীর সামনে ক্রসওয়ার্ড পাজল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    অনস্বীকার্য যে, শিল্পবিপ্লবের পর থেকে সাম্রাজ্যবাদী ও পরাশক্তির দেশগুলো নিজেরা বিলাসিতায় ও আরাম-আয়েসে থেকে, পৃথিবীর সিংহভাগ ভূখণ্ডকে চরম বিপদের মুখে ফেলেছে জলবায়ু পরিবর্তন নামের দানবের জন্ম দিয়ে।

    তারা জেগে থেকেও ঘুমের ভান করে পড়ে ছিল। তারা জানত, এই পৃথিবীটা আমাদের নয়; আমরা শুধুমাত্র একে ধার নিয়েছি আগামী প্রজন্মের কাছ থেকে:

    “We do not inherit the Earth form our ancestors; we borrow it from our children.”Cree Indian prophecy

    জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণা, ক্রম-উদ্ভব ও সম্ভাব্য পরিণতি

    কোনো জায়গার গড় জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদী ও অর্থপূর্ণ পরিবর্তন, যার ব্যাপ্তি কয়েক যুগ থেকে কয়েক লক্ষ বছর পর্যন্ত হতে পারে, তাকে জলবায়ুর পরিবর্তন (Climate Change) বলা হয়। জলবায়ু পরিবর্তন বিভিন্ন নিয়ামকের ওপর নির্ভরশীল, যেমন, প্রক্রিয়া, পৃথিবীর আহরণকৃত সৌর বিকিরণের পরিবর্তন, ভূত্বক গঠনের পাততত্ত্ব (plate tectonics),আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, ইত্যাদি। তবে বর্তমানকালে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন বললে সারা পৃথিবীর সাম্প্রতিক সময়ের মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন বোঝায় যা ভূমণ্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধিরই রূপান্তর।

    জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, বাতাস, প্রভৃতির ধরন বদলে যাচ্ছে। যদিও এখানে জলবায়ু পরিবর্তন বলা হয়েছে, প্রকৃত অর্থে বহু লক্ষ বছরের হিসাবে এটা শুধুই জলবায়ু ছিল। ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ কথাটির উদ্ভব খুব সাম্প্রতিককালে, বিশেষত নব্বই দশক থেকে জলবায়ু নিয়ে তোলপাড় হয়, এবং জলবায়ুর সাথে পরিবর্তন কথাটি যোগ হয়ে ভিন্নমাত্রিকতা লাভ করে।

    জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলো কয়েকটি প্রাকৃতিক-প্রক্রিয়া নির্ভরশীল — এমনটিই যুগ যুগ ধরে লালিত ধারণা ও বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ। এইসব প্রক্রিয়ার মধ্যে যেমন আছে পৃথিবীর বিভিন্ন গতিশীল প্রক্রিয়া, তেমন আছে সৌরমণ্ডলীয় প্রভাব। শেষোক্ত কারণটির মধ্যে থাকতে পারে সৌর বিকিরণের মাত্রা, পৃথিবীর অক্ষরেখার দিক পরিবর্তন কিংবা সূর্য ও পৃথিবীর অবস্থানগত দিক। বর্তমান সময়ে মনুষ্য কর্মকাণ্ড হতে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাসের ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিকে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম কারণ ধরা হয়। জলবায়ুর বৈজ্ঞানিক মডেলে এই সমস্ত সূচককে ইংরেজিতে অনেকসময় Climate Forcing বলা হয়। বায়ুমণ্ডলে নির্গত গ্যাসসমূহকে গ্রিনহাউস গ্যাস বলা হয় এজন্য যে, শীতপ্রধান দেশে কাচের ঘরে রোদ প্রবেশ করিয়ে তাপ আটকে রেখে তাতে সব্জি বা ফুলগাছ চাষ করা হয়। তেমনি বায়ুমণ্ডলে বর্ধিত তাপমাত্রা আটকে পড়ে ভূমণ্ডল উত্তপ্ত করছে, আর তাতে ইন্ধন যোগাচ্ছে ‘মানবসভ্যতা’র অতিরঞ্জিত কাজকর্ম।

    ভূপৃষ্ঠ হতে ২০-৫০ কিলোমিটার ওপরে ওজোন নামের একটা গ্যাসের পাতলা স্তর রয়েছে। এই স্তর সূর্যরশ্মি থেকে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর ও তীব্র তেজস্ক্রিয় রশ্মি শোষণ করে পৃথিবীকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে চলেছে। কলকারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্য, জেট বিমানের গ্যাসীয় জঞ্জাল, বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত ক্লোরিন এবং সার হিসেবে ব্যবহৃত নাইট্রোজেন সাধারণ বিক্রিয়ায় ওজোন নামের গ্যাসের স্তরকে প্রতিনিয়ত হালকা করছে। পরিণামে ওজোনের এই পাতলা গ্যাসের স্তর পেরিয়ে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পরিবেশ-প্রতিবেশকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে বলে বিজ্ঞানী/ চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, এবং পরবর্তীতে সেটা ফলে গেছে।

    এই অতিবেগুনি রশ্মি মানুষের ত্বকের ক্ষতি ও দেহে ক্যান্সারসহ মারাত্মক ব্যাধির সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া পশুপাখি গাছপালাতেও এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে এবং পড়বে। সেজন্য ওজোনস্তর বিপন্ন হলে পৃথিবীর ক্ষতির আশঙ্কা বেড়ে যাবে বহুগুণ। ওজোনস্তর অতিবেগুনি রশ্মিকে ফিল্টারের মতো সযত্নে ছেঁকে নিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রেখে আসছিল অনাদিকাল ধরে।

    পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের (Atmosphere) বিভিন্ন গ্যাস, জলীয় বাষ্প ও অপরাপর উপাদানের মধ্যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় ছিল। এখন সেই ভারসাম্য ভঙ্গুর। যেমন ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বায়ুমণ্ডলে অতিমাত্রায় ওজোন গ্যাস তথাসিএফসি (ক্লোরোফ্লুরোকার্বন) যোগ হওয়ায় বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে অবস্থিত ওজোনস্তর ফুটো হয়ে গেছে। এই স্তর পৃথিবীকে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে পৃথিবীর উদ্ভিদ ও প্রাণীকে রক্ষা করে আসছিল। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে অতিমাত্রায় ওজোন ক্ষয়কারী গ্যাস, বিশেষতসিএফসি নির্গত হবার ফলে এই স্তর ক্ষয়িত হয়ে গেছে। মানুষই এই কাজটি করেছে, আর সভ্যসমাজ এর কুফল বুঝতে পেরে সিএফসি ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে; তাতে অবশ্য এই ফুটো বন্ধ হবে না, তবে মন্দের ভালো যে, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে মানবসৃষ্ট সিএফসি কম যোগ হবে। উত্তর গোলার্ধে এই ওজোনস্তরের ফুটো দৃশ্যমান হয় বেশি, আর সেখানেই ক্ষতির কারণও অধিক। ক্যানেডা এর অন্যতম শিকার। এখনও ওজোনস্তরের ফুটোজনিত কারণে সেইদেশে মানব-পশুপাখি ও উদ্ভিদের নানান রোগ হয়। ওজোন ক্ষয়কারী পদার্থ নির্গমন রোধ সংক্রান্ত ভিয়েনা কনভেনশনের পথ ধরেই ক্যানেডার মন্ট্রিয়্যাল শহরে ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭ সালে জন্ম হয় মন্ট্রিয়ল প্রটোকলের।

    তাপ কেমন করে আটকে থাকছে? ধরুন, শীতকাল। রাতে ঘুমোনোর সময় ইলেক্ট্রিক হিটার চালু করে দিয়ে ব্ল্যাংকেট মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। প্রথমে আরামের ঘুম, তারপর হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। গরম লাগছে আপনার। দরজা-জানলা বন্ধ থাকায় তাপ আটকে গেছে ঘরে। পৃথিবীর অবস্থাটা ঠিক আপনার ঘরটার মতো: তাপআটকে আছে। এই তাপ এলো কোথা থেকে? মানুষই যোগ করেছে, আর করছে। বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন গ্যাসীয় উপাদান তথা অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, আর্গন, কার্বন ডাইঅক্সাইড ও স্বল্প পরিমাণে জলীয় বাষ্প থাকে। এই প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে মানব কর্মকাণ্ড থেকে যোগ হওয়া গ্যাসসমূহর জন্যে, ফলে পৃথিবী উষ্ণ হয়ে উঠছে।

    উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে কী হবে? পৃথিবীর তিনভাগই পানি, এর একটা বড় অংশ হলো বরফ এবং হিমবাহ। উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের বরফ, দক্ষিণ মেরুর তুষার আস্তরণ প্রাকৃতিক নিয়মেই চলছিল। কিন্তু তথাকথিত মানবসভ্যতার উন্মেষে, বিলাসী জীবনযাত্রার প্রাকৃতিক সাইকেলে যে দ্রুত কুপ্রভাব ফেলল, তারই জেরে বাড়ছে উষ্ণতা। এই উষ্ণতায় বরফের স্তর গলছে, আর মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে দ্রুত। এই বরফগলা পানি নামছে এবং নামতে থাকবে (উষ্ণ) সাগরে। ফলে সমুদ্রস্ফীতি দেখা দেবে। সমুদ্র স্ফীত হলে অনেক প্রকারের পরিবেশওপ্রতিবেশগত বিপর্যয় নামবে, যার অন্যতম হলো দ্বীপদেশ, উপকূলীয় ও নিম্নাঞ্চলের দেশ সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে সমুদ্রতলে তলিয়ে যাবে। সর্বোচ্চ বিপন্নতার তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ ও ভানোয়াতু। বাংলাদেশ একটা বদ্বীপ এবং ভৌগোলিকভাবে খুবই নাজুক। মানবসংখ্যা বেশি, সম্পদ সীমাবদ্ধ এবং জলবায়ু দানবের আক্রোশের জবাব দেয়ার মতো হাতিয়ার নেই বা নিরাপদ অবকাঠামোগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা থেকে এখনও অনেক দূরে এই দেশটি।

    পরিবেশদূষণ, প্রাতিবেশিক ভারসাম্যহীনতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, স্থানীয়, আঞ্চলিক ও মহাদেশীয় কলেবরে আজ যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে, তা শুধু কোনো নির্দিষ্ট একটি দেশের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনবে না, সেটা কমবেশি সব দেশেই বিরূপ প্রভাব ফেলবে। সেখানে যেসব দেশের সামর্থ্য-অবকাঠামো-প্রযুক্তি বেশি, সেই দেশগুলোই টিকে থাকবে বা বিপর্যয় সামলে নেয়ার মতো অবস্থায় থাকবে। সেইসব সমর্থ দেশগুলোর কারণেই কিন্তু আজকের এই বিপন্নতা। সারা পৃথিবী ভুগবে। বেশি ভুগবে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, দ্বীপদেশ ভানোয়াতু প্রভৃতি।

    জলবায়ু পরির্তনের কারণ শুধুমাত্র অতিরিক্ত কার্বন নির্গমনই নয়, কার্বন শোষণে মূল্যবান সম্পদ বনাঞ্চল তথা রেইনফরেস্ট উৎপাটিত হয়েছে নির্মমভাবে। কলকারখানা স্থাপন, বনজঙ্গল ও জলাভূমি উজাড় করে মানববসতি স্থাপন, নদীনালায় তীব্র দূষণ, কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, নানা ইকোসিস্টেমের নাশ, তীব্র বায়ুদূষণ প্রভৃতি পরিবেশগত দূষণ স্থানিক, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পৃথিবীর স্বাস্থ্য আজ মারাত্মক হুমকির মুখে। পরিবেশের দূষণ, প্রাতিবেশিক ধ্বংসলীলা প্রভৃতি একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ও সেসব অঞ্চলবিশেষ পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে।

    সভ্যতা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে নগরায়ন ও শিল্পায়নের বাহুল্য। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নজিরবিহীন চাপ পড়ছে যাতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে মানুষের লোভী মনোবৃত্তির কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ নবায়নের ক্ষমতা ক্ষয়িত হয়ে গেছে।

    শিল্পায়নের ফলে প্রতিবছর কলকারখানার কোটি কোটি টন বিষাক্ত গন্ধকের ধোঁয়া বাতাসে মিশে আসছে। এই গন্ধকের ধোঁয়া (সালফার ডাইঅক্সাইড ও সালফার ট্রাইঅক্সাইড) বাতাসে জলীয় অংশের সাথে মিশে তৈরি হয় সালফিউরিক এসিড, যা কিনা এসিড রেইন বা অম্লবৃষ্টি নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাংশে বৃষ্টির পানির অম্লত্ব বেড়েছে বহুগুণ। এর প্রভাবে অনেক হ্রদের ৯০% মাছ ধ্বংস হয়ে গেছে। ব্রিটেন ও জার্মানির শিল্পাঞ্চল থেকে উড়ে যাওয়া ধোঁয়া নরওয়ে-সুইডেন-এ অম্লবৃষ্টিজনিত সমস্যার সৃষ্টি করেছে। আমরা জানি, সূর্যের আলো জীবনীশক্তির আধার। বৃষ্টিতে যে পরিমাণ সূর্যের আলো পৌঁছয় যদি তার মাত্র শতকরা দেড় কি দুইভাগ কমে যায় তাহলে সমস্ত বিশ্বে নেমে আসবে প্রবল শীতের পরশ−মেরু অঞ্চলের চিরস্থায়ী বরফ ছড়িয়ে পড়বে বিষুব অঞ্চল পর্যন্ত। আবার বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে যদি উত্তর গোলার্ধে তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে তাহলে উত্তর মেরু অঞ্চলের ভূভাগের হিমবাহ, যা বিশাল আইস শীট এবং সারাবছর বিদ্যমান থাকে, সেই বরফ সম্পূর্ণ গলে যাবে, ফেঁপে উঠবে সাগরের জল (একমাত্র অস্ট্রেলিয়া বাদে অন্য সব মহাদেশে, বিশেষত গ্রিনল্যান্ড এবং অ্যান্টার্টিকার পর্বতমালায় এসব বরফ জমে থাকে)। এছাড়াও পোলার আইসক্যাপ (সাগর-মহাসাগরে জমে থাকা পাহাড়সম বরফ) গলেও সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি করবে – এগুলো বহুবছর যাবত সাগরপৃষ্ঠে বরফের পাহাড়রূপেই বিরাজমান ছিল। উষ্ণতা বেড়ে এসব ক্যাপ গলছে, এবং তা উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য বিপজ্জনক।

    যেমন, গলে যাওয়া পোলার আইস ক্যাপ ক্যানেডার উপকূলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ (সাম্প্রতিক সময়ে ইয়াহুনিউজে প্রকাশিত স্কট সাদারল্যান্ডের প্রতিবেদন ‘Polar ice melting, sea levels rising point to major risks for Canada’s coasts’-এ সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়নজনিত কারণে বরফ গলা এবং ফলশ্রুতিতে সমুদ্রস্ফীতি ও সে কারণে উপকূলে বিরূপ প্রভাব )।

    পোলার আইস ক্যাপ অতি দ্রুত গলছে এবং তা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়াচ্ছে। এ তথ্য জানিয়েছে পোলার আইস ক্যপের বিভিন্ন পরিমাপ নির্ধারণে বিশ বছরেরও অধিক সময়কাল ধরে পরিচালিত স্যাটেলাইট উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী টিম।

    ‘আমাদের নতুন উপাত্ত পোলার আইস শীট ক্ষয়ের নির্ভরযোগ্য ও সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরেছে’, সমীক্ষার দলনেতা ড. অ্যান্ড্রু শেফার্ড, (যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লীডস-এর আর্থ অবজার্ভেশনের অধ্যাপক) ক্যানেডার সিবিসি নিউজকে জানিয়েছেন।

    ড. শেফার্ড আরও বলেন, ‘বর্তমান উপাত্ত গ্রীনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকার আইস শীটের পরিবর্তনসংক্রান্ত গত বিশবছরের অনিশ্চয়তা দূর করেছে। এই তথ্যগুলো এখন থেকে জলবায়ু বিজ্ঞানীদের জন্য বেঞ্চমার্ক হয়ে থাকবে।’

    আইস শীট ম্যাস ব্যালান্স ইন্টার-কমপেয়ারিজন এক্সারসাইজ (IMBIE) নামে পরিচিত এই প্রজেক্টটি নাসা ও ইয়োরোপীয় স্পেস এজেন্সির যৌথ প্রয়াস, যা ২৬টি পৃথক প্রতিষ্ঠান থেকে ৪৭ জন জলবায়ু গবেষক নিয়ে গঠিত। ইউনিভার্সিটি অব অটাওয়ার আর্থ সিস্টেম ডাইনামিক গ্রুপ-এর ভূপদার্থবিদ গ্লেন মিল্ন রয়েছেন এই প্রজেক্টে। প্রজেক্টের উদ্দেশ্য আইস শীটের মাত্রা ও পরিমাপ পদ্ধতির মধ্যে বিদ্যমান অনেক বছরের মতভেদ দূর করা।

    ক্যানেডার অনেক অঞ্চল আছে যেগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত কারণে বিরূপ প্রভাব পড়বে। আটলান্টিক ক্যানেডায় অবস্থিত নোভা স্কোশিয়ার পুরো পূর্ব উপকূল — ইয়ারমাউথ থেকে লুইসবুর্গ, নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের ফরচুন বে ও স্টিভেনভিল, প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ড দ্বীপের পুরোটা এবং নিউ ব্রান্সউইকের উত্তর উপকূলের — বিশেষত মংকটন এলাকা। সেন্ট লরেন্স সীওয়ে জুড়ে যে এলাকা, তা-ও হুমকির মুখে, বিশেষভাবে কুইবেকের কিছু এলাকা। ক্যানেডার ওয়েস্ট কোস্টের হাইডা গোয়েই দ্বীপসমূহ বিশেষভাবে বিপন্ন, যেমনটি বিপন্ন ভ্যাঙ্কুভার আইল্যান্ড উপকূল আর পুরো ভ্যাঙ্কুভার সিটি। বর্ণিত এসব এলাকা ধ্বংসাত্মক জলোচ্ছাসের হুমকির মুখে রয়েছে। এই ঝুঁকি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লেই কেবল বাড়বে। (প্রাবন্ধিকের অনুবাদ: টরোন্টোর একটি বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত)

    আবহাওয়া পরিবর্তন ও ভূমণ্ডলীয় তাপ বৃদ্ধির ফলে অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। ওজোনস্তর ক্ষয়জনিত অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়ে প্রাণী-উদ্ভিদের নির্মূলের কারণ হয়ে হয়েছে এবং আরও হতে পারে। Ecology এবং Ethology-এ দুয়ের মধ্যে কোথায় যেন একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের আচরণবিদ্যা Ethology যে আজ Ecology-কে ধ্বংসাত্মক রূপ দিচ্ছে তা প্রেতাত্মার রূপ ধরে একদিন মানবজাতির কাছেই ফিরে আসবে−সে দিন বুঝি আর দূরে নয়।

    দ্রুততম সময়ে উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তন কেন মানবসৃষ্ট? কেন তা প্রাকৃতিক নয়? পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা সব যুগে একরকম ও একই মাত্রায় ছিল না। কখনও শীতলতায় পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকা বরফে ঢেকে গেছে। সেসব ঘটেছে প্রাকৃতিকভাবে। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর থেকে খুব দ্রুত বদলে গেছে ভূচিত্রাবলি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অনেকস্থানে জলবায়ু হবে চরমভাবাপন্ন ও খেয়ালি।তার নজির দেখতে পাই সাহারা মরুভূমিতে। পৃথিবীর বৃহত্তম মরুভূমি সাহারা। এই মরুভূমির তাপমাত্রা সব সময় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে থাকে। সেখানে পড়েছে বরফের আস্তরণ (২০১৮)।

    উত্তর দিকের হাওয়ার প্রভাবে রুক্ষ, শুষ্ক, তপ্ত মরুভূমি এখন হিম শীতল বরফাচ্ছাদিত। তুষারপাতে যখন চরম বিপর্যয়ের মুখে উপনীত অন্যসব দেশ, তখন সাহারার এই তুষারপাতেই আনন্দিত সেখানকার অধিবাসীরা।

    এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো ওই মরু অঞ্চলে তুষারপাত হয়েছে।

    প্রথমবার তুষারপাত হয়েছিল ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। সেদিন মরু অঞ্চলের অধিবাসীরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না তাদের হাতে, গায়ে এসে পড়ছে নরম তুলোর মতো বরফ। সেই তুষারপাত দেখে তাদের আনন্দের সীমা ছিল না।

    প্রায় ৩৭ বছর পর ২০১৬ সালে ফের বরফের আস্তরণে ঢেকে গিয়েছিল সাহারা। পরের বছরও এই একই আবহাওয়া দেখেছিলেন এই মরুদেশের বাসিন্দারা। ২০১৭ সালের পর আবার ২০১৮ সালে নিয়মের বাইরেও যে ঘটনা ঘটে এবার তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন।

    জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হলো পৃথিবীর তাপমাত্রার পরিমাণ বৃদ্ধি বা হ্রাস — একটি নির্দিষ্ট হারে ও কলেবরে। এই তাপমাত্রা হ্রাস-বৃদ্ধির অন্যতম প্রাকৃতিক কারণ পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে দূরত্বের হ্রাস-বৃদ্ধির সংঘটন। যখন পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যিখানের দূরত্ব কমে যায় তখন পৃথিবী বেশি তাপ শোষণ করে। আবার পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যকার দূরত্ব বেড়ে গেলে পৃথিবী কম তাপ শোষণ করে। এভাবে Glacial ও Interglacial যুগের অবতারণা ঘটে। অন্যদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণন পথে এর অক্ষ সূর্যের দিকে হেলে যাবার কারণে তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধি হয়। যখন অক্ষ সূর্যের দিকে হেলে যায় তখন পৃথিবীর বেশির ভাগ অংশ সূর্যের আলো পায় এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এই তত্ত্ব প্রথম প্রকাশ করেন রাশিয়ার বিজ্ঞানী মিলাঙ্কোভিচ, যা Milankovitch Cycles নামে পরিচিত।

    বিজ্ঞানী মিলাঙ্কোভিচের তত্ত্বানুসারে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা হ্রাস পেতে কয়েক হাজার থেকে কয়েক লক্ষ বছর লাগে। কিন্তু আমাদের পৃথিবীর তাপমাত্রা শিল্পবিপ্লবের পর থেকে দ্রুততম সময়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৃদ্ধি প্রাকৃতিক কারণে যে নয় তা নিশ্চিত। তবে এই দ্রুত বৃদ্ধির কারণ কী?

    এই বিষয়ে প্রথম আলোকপাত করেন সুইডিশ বিজ্ঞানী আর্হেনিয়াস ১৮৯৬ সালে। তিনি প্রমাণ করেন যে, জীবাশ্ম জ্বালানিপোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। আর এই কার্বন এমন একটি মৌল যার তাপধারণ ক্ষমতা রয়েছে। ফলে সূর্য থেকে আগত তাপ ও পৃথিবী থেকে বিকিরিত তাপ কার্বন শোষণ করে এবং পৃথিবীর মোট তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি বাড়াতে পারে। এই ধারণাটি প্রথম স্বীকৃতি লাভ করে ১৯৮৮ সালে। ওই বছরটি ১৮৮০ সাল হতে ওই পর্যন্ত সময়ে সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হিসেবে প্রমাণিত হয়। পৃথিবীর ষাটটিরও বেশি দেশের ২৫০০ বিজ্ঞানী অসংখ্য তথ্য-প্রমাণাদি ও প্রকাশনা ঘেঁটে মত দেন যে, মানবসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধির কারণেই পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুততম সময়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

    বরফ গলার পরিণতি কী? বরফগলা পানি গিয়ে পড়ছে সাগরে। ফলে, আগামী দশকগুলোতে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েই চলবে। আইপিসিসি’র (Intergovernmental Panel on Climate Change, IPCC)নতুন রিপোর্টে বলা হয়েছে ২১০০ সাল নাগাদ সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা ১.১ মিটার পর্যন্ত বাড়বে।

    সংক্ষেপে বলতে গেলে বলা যায় — সাগরপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে, বরফ গলছে দ্রুতহারে, এবং এর প্রভাব পড়ছে পুরো বিশ্বের প্রাণীজগৎ ও ইকোসিস্টেমের ওপর।

    ‘ব্লু-প্ল্যানেট (পৃথিবী) এখন মহাসঙ্কটে নিপতিত। বিভিন্ন দিক থেকে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, এবং এর জন্যই আমরাই দায়ী,’ বলছেন ড. জ্যঁ পিয়েরে গাত্তুসো (Dr. Jean-Pierre Gattuso,ফরাসি সমুদ্রবিজ্ঞানী), যিনি সাম্প্রতিক এই রিপোর্টের প্রধান প্রণেতা।

    বিজ্ঞানীদের এখন কোনো সন্দেহ নেই যে সাগর-মহাসাগরে উষ্ণতা ১৯৭০ সাল থেকে অব্যাহতভাবে বাড়ছে।

    ড. গাত্তুসো বলেছেন, ‘নিচু জায়গাগুলোতে সাগরের উচ্চতা বাড়ার পরিণতি হবে ব্যাপক। বিশ্বের ৭০ কোটি মানুষ এরকম নিচু উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করে। বিষয়টি খুব উদ্বেগের।’

    এর প্রভাব কী হবে? কার্বন নির্গমন এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাত্রা যদি বেশি হয় তাহলে নিউইয়র্ক বা সাংহাইয়ের মতো বিত্তশালী নগরগুলোও সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে ঝুঁকিতে পড়বে।

    রিপোর্টে সাবধান করা হয়েছে — সাগরের তাপ বাড়ার ফলে আবহাওয়া দিনকে দিন বিপজ্জনক আচরণ করবে। সামুদ্রিক ঝড় আরও বাড়বে, সেইসাথে বাড়বে জলোচ্ছ্বাস।

    বিধ্বংসী জলোচ্ছ্বাসের নজির ইতিহাসে খুব কম। শত বছরে গড়ে একটি করে এরকম দুর্যোগ হয়। কিন্তু নতুন এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের বেশ কিছু জায়গায় খুব বড়মাপের জলোচ্ছ্বাস হতে পারে।

    ‘আমরা নজিরবিহীন কিছু আলামত দেখতে পাচ্ছি,’বলেছেন আইপিসিসি প্যানেলের অধ্যাপক ডেরা রবার্টস। ‘আপনি যদি স্থলভাগের খুব ভেতরেও বসবাস করেন, তাহলেও সাগর এবং পরিবেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিরাপদে থাকতে পারবেন না।’

    যেভাবে আপনার জীবনযাপন প্রভাবিত হতে পারে এমন বন্যার ক্ষতির মাত্রা দুই থেকে তিনগুণ বেড়ে যেতে পারে। সাগরের তাপমাত্রা বাড়ার ফলে ৯০ শতাংশ প্রবালপ্রাচীর বিলীন হয়ে যেতে পারে।

    সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে মাছ এবং জলজ উদ্ভিদের ওপর। মাছের শরীরে ভেতর পারদের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।

    সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়ায় জলজ প্রাণী আবাসস্থল বদলাবে। রিপোর্টে অবশ্যি কিছু আশাবাদও রয়েছে। বলা হয়েছে যে, সাগরের ভবিষ্যত এখন আমাদের হাতে রয়েছে। কিন্তু তার জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে এখনকার তুলনায় কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমপক্ষে ৮৫শতাংশ কমাতে হবে।

    আইপিসিসি প্যানেলের চেয়ারম্যান হোসুং লি বলেছেন, “কার্বন নির্গমনের মাত্রা অনেক কমালেও চরম ঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করাটা চ্যালেঞ্জিং হবে।

    বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এর জন্য রাজনীতিক ও রাষ্ট্রনায়কদের ওপর জনগণের চাপ বাড়ানো খুব জরুরি।

    কে বাড়াবে? যারা উঁচু গলায় কথা বলছে, তারাই তো নিজেদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে বড় বড় বুলি আওড়ে কম কার্বন নিঃসরণকারীকে বলছে কার্বন কমাতে, কার্বন শোষণকারী সিঙ্ক(Sink) বাড়াতে। তারা তাদের শিল্পায়ন ও পারমাণবিক কার্যক্রম সচল রাখতে ঐতিহাসিক কিয়োটা প্রটোকল গুঁড়িয়ে দিল। ১৯৯৭ সালে জাপানের ঐতিহাসিক নগরী কিয়োটাতে জন্ম নিয়েছিল উন্নত বিশ্বের সম্মেলন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল কার্বন লেভেল ১৯৯০-এর পর্যায়ে নামিয়ে আনার। তারপর কী ঘটল? অনেক আলোচনা-মিটিং-কনফারেন্স অব পার্টিজ (COP)−আরও কতো কি। শেষে কিয়োটা প্রটোকলের র‍্যাটিফাই বা অনুসমর্থন প্রশ্নে পেছাল অ্যামেরিকা। তাদের আর্থিক ও শিল্প উৎকর্ষতা নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্যানেডা বাধ্যবাধকতা মানতে পারবে না বলে বেরিয়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্রও বেরিয়ে গেল। শেষে হোস্ট কান্ট্রি জাপানও পগার পার।

    বাংলাদেশ বা দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর নিজস্ব পরিবেশ দেখভাল করা ছাড়া তেমন কিছু করার নেই। কারণ তারা মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ করছে না। কিন্তু এসব দেশ সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবে নিম্নাঞ্চল হওয়াতে ও ভৌগোলিকভাবে নাজুক অবস্থানে থাকার ফলে। ব্যাপক শিল্পায়নের পেছনে ছুটন্ত চীন, ব্রাজিল, মেক্সিকো, ভারত প্রভৃতি দেশগুলোকে লাগাম টেনে ধরার দায়িত্ব নিতে হবে। তারা শিল্পায়িত হচ্ছে দ্রুত হারে। কার্বন ছুড়ছে, ফসিল ফুয়েল পোড়াচ্ছে। তাদের ওপর অনেক দায়িত্ব বর্তায়। আর পরাশক্তি দেশগুলোর বোধোদয় হলে এবারের মতো পৃথিবীর স্বাস্থ্যের খানিকটা উন্নতি হলেও হতে পারে। ভবিষ্যত প্রজন্ম একটি সুন্দর পৃথিবী পেলে পেতেও পারে।

    তা না হলে প্রকৃতি ও আগামী প্রজন্মের অভিশাপে পৃথিবীতে লংকাকাণ্ড বেঁধে যাবে।

    *কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও সংগীতশিল্পী। সার্টিফায়েড মেম্বার, ইকো-ক্যানেডা, ক্যালগ্যারি, আলবার্তা, ক্যানেডা




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণ -- আন্তর্জাল থেকে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments