• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৭ | জানুয়ারি ২০২০ | প্রবন্ধ
    Share
  • নবনীতা দেবসেন, এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব : ঊর্মিলা চক্রবর্তী


    বিদ্যাদিগ্‌গজ কাকে বলে? যাঁদের পেটে বইয়ের পাতা গজগজ করে, তাঁরাই বিদ্যাদিগ্‌গজ। এঁদের গোটা পৃথিবী সমীহ করে। মানুষজন তাঁদের কাছ থেকে বেশ একটু দূরে দূরেই থাকে। এঁদের মধ্যে কেউ যদি আবার কেবল বিদগ্ধ না হয়ে সৃষ্টিশীল ও অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত হন, দেশে বিদেশে সম্মানিত হন, একদিকে পদ্মশ্রী অন্যদিকে সাহিত্য আকাদেমি সম্মানের সঙ্গে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে চেয়ার অলঙ্কৃত করার সম্মান অর্জন করেন, তবে তাঁর কাছে যেতে ভয় পাবেন না তেমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। সবারই মনে হয়, এত জ্ঞান, এত সৃজনশীলতা, এত সম্মান, এমন মানুষের কাছে কীভাবে পৌঁছোনো সম্ভব? নিজেকে এত সামান্য মনে হয় যে পা কাঁপে।

    এটাই স্বাভাবিক, আর এই স্বাভাবিক কম্পন আমার মধ্যেও ছিল একথা অস্বীকার করি কীভাবে? আমি যখন তাঁর কাছে গেছি ততদিনে তো নবনীতা দেবসেন পৃথিবীবিখ্যাত, আমাদের দেশে একজন কিংবদন্তির মানুষ বললেও চলে কারণ যাদবপুরে বি.এ., এম.এ., পড়িনি বলে তাঁকে আমি তো খুব একটা অল্পবয়সে দেখিনি।

    সেটা ১৯৮৪ সাল। কলেজে কাজ করতে করতে অন্য এক বিদগ্ধ নারীর কাছে পি.এইচ.ডি. করা শুরু করেছি। তিনি স্বনামধন্য অধ্যাপক যশোধরা বাগচী। কোনো অজ্ঞাত কারণে তখনই আমার কবিতা লেখার শুরু। যশোধরাদি আমাকে একদিন প্রায় ঠেলেই পাঠিয়ে দিলেন তাঁর নার্সারি স্কুল থেকে একসাথে পড়া প্রাণের বন্ধু নবনীতা দেবসেনের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে আমার কবিতা দেখাতে। উনি বলেছেন, আমি যাব না বলার সাহস পাইনি বলেই হয়তো শেষ পর্যন্ত ‘ভালো-বাসা’ বাড়িতে বেল বাজানোর সাহস পেয়েছিলাম। আমি তখন সবে কবিতা লিখছি, সেইসব কবিতা এমন একজন মানুষের কাছে নিয়ে গিয়ে তাঁর মতামত নেব, ভাবতেই ঘেমে উঠছিলাম।

    নবনীতা দেবসেন এলেন একমুখ হাসি নিয়ে। দেখে তো মনেই হল না যে তিনি এমন কিছু ভয়ের বস্তু। সঙ্কোচ করবার কোনো সুযোগ না দিয়ে আমার সঙ্গে মাটিতে পাতা একটা ম্যাট্রেস-এ বসে পড়লেন। মন দিয়ে আমার মতো নতুন কবির লেখা পড়লেন। কি বলেছিলেন সে কথা বলবার প্রয়োজন নেই, শুধু এইটুকু বলব যে মনে অনেকখানি বলভরসা, অনেকখানি এগিয়ে যাবার সাহস সঞ্চয় করে সেদিন আমি ফিরেছিলাম।

    এই ছিলেন নবনীতাদি। একজন সামান্য কলেজের অধ্যাপক, সবেমাত্র কবিতা লেখা শুরু করেছে, তাকে মনে উৎসাহ জোগাতে কোনো কার্পণ্য করেননি। আজ ভাবি, কতটা মন বড় হলে নতুন কবির অপরিণত প্রচেষ্টাকে তাঁর মতো এতবড় মাপের একজন মানুষ এতটা উৎসাহ দিতে পারেন। অনেক পরে লিখে যখন সামান্য পরিচিতি পাওয়া শুরু করেছি তখন ‘সই’-তে যোগ দেবার জন্য ওনার বাড়িতে গেলাম। সেও যশোধরাদি সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলেন। সহজেই সবার সঙ্গে মিশে এই বিশাল মাপের মানুষটিকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়ে গেলাম। একটা কথাই বলব, যত দেখেছি ততই অবাক হয়েছি।

    একটু বলে নিই। তাঁর বৈদগ্ধ্যের কথা দিয়েই শুরু করেছিলাম, কিন্তু কিছু খবর হয়তো অনেকের অজানা। তাঁর বাবা মা নরেন দেব এবং রাধারানী দেবী দুজনেই কবি ছিলেন এবং এক সাহিত্যিক বাতাবরণেই তাঁর বেড়ে ওঠা। তাঁর নাম রেখেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছোট্টবেলা থেকেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন, আর তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় মাত্র বারো বছর বয়সে। অসীম মেধা নিয়ে তিনি স্কুল পেরিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করার পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী হিসাবে এম.এ. পাশ করেন। এরপর বিদেশ। হার্ভার্ড থেকে তুলনামূলক সাহিত্যেই আবার একবার এম.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি. করেন। এরপর অমর্ত্য সেনকে বিয়ে করা এবং দুই কন্যা অন্তরা ও নন্দনার জন্ম তাঁর জীবনের বিশেষ ঘটনা। কিন্তু পড়াশুনা থেমে থাকেনি। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও কেম্ব্রিজের নিউনহ্যাম কলেজ থেকে তিনি এর পর পোস্ট-ডক্টর‍্যাল গবেষণা করেন। তবে এরই সঙ্গে একটি অবাক হবার মতো কথা এই যে তিনি মোট দশটি ভাষা জানতেন — বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, ওড়িয়া, অসমীয়া, ফরাসী, জার্মান, গ্রীক, সংস্কৃত আর হিব্রু!

    বাদবাকি কথা তাঁর সম্মানপ্রাপ্তি। সাহিত্য একাডেমি, পদ্মশ্রীর সঙ্গে আরও অজস্র সম্মান পেয়েছেন তিনি, দেশে এবং বিদেশে। দেশে বিদেশে নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো লেকচার দেওয়া, কখনো সৃষ্টিশীল রচনার পাঠ দেওয়া, কখনো অতিথি অধ্যাপক হিসাবে তুলনামূলক সাহিত্য পড়ানো ছিল নিয়মিত কাজ। তবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি স্থায়ীভাবে পড়িয়েছেন, দেশে থেকেছেন, এবং বাংলা ভাষাতেই অজস্র বই লিখেছেন। এসব কথা সবাই জানে।

    এসব কথা একটু মনে করিয়ে দিতে হল এইজন্য যে তাঁকে যখন কাছ থেকে ভালো করে দেখার সুযোগ হল তখন দেখা গেল যে মানুষটা এসবের চেয়ে অনেক বড়, এগুলো তাঁর বাইরের ব্যাপার, গভীরভাবে তাঁকে স্পর্শ করেনি। সই তাঁর প্রাণের সংগঠন, সব সই তাঁর প্রাণের সখী। আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন প্রাণ খুলে, মনের আনন্দ বেদনা ভাগ করে নিতেন সবার সঙ্গে। সামান্য কারণে হঠাৎ ক্ষুব্ধ হয়ে অভিমানে ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে চলে যেতেও দেখেছি। মনে প্রশ্ন জাগত, এত বড় মানুষটা, কখনো কি মনে হয় না যে আমরা ওঁর কাছে কিছুই না? এমন সমানে সমানে ব্যবহার করতেন যে বিশ্বাস হতে চাইত না। কেউ একটু ভালো লিখলে, ভালো গান গাইলে, কী খুশি! ওনার মুখ থেকেই শুনেছি, আমরা সবাই সই, আমরা বন্ধু, আমরা মেয়েরা সব সই, সয়ে যাই, আর আমরা আমাদের সই রেখে যাব পৃথিবীতে, নারীর অভিজ্ঞান। সই কথাটির কথা এমন করে কবেই বা ভেবেছিলাম? অমর্ত্য সেন যখন ছেড়ে গেলেন, তখন যে ভয়ঙ্কর অবস্থায় পড়েছিলেন, দুই শিশুকন্যাকে নিয়ে সেই যে কঠিন সংগ্রাম, সে কথাও নিঃসংকোচে বন্ধুর মতো বলতে শুনেছি। উনি একথা না বলতে কখনো চাননি, বলতেন যে অন্য মেয়েরাও তো এমন অবস্থায় পড়ে, তারা মনে জোর পাবে তাঁর যুদ্ধের কাহিনি শুনে। তিনি যে অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা এমন কথা তাঁর বোধহয় কখনো মনেই হয়নি।

    সই-তে নবনীতাদির সঙ্গে দুটি অভিজ্ঞতার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সেই দিনগুলো কখনো ভুলব না। একটু খেয়ালি মানুষ ছিলেন নিঃসন্দেহে। হঠাৎ একবার খেয়াল হল আমাদের সব সইদের জন্মদিন উনি নিজে পালন করবেন। সবার জন্য তো আর আলাদা আলাদা করে উৎসব করা সম্ভব নয়, তাই একই মাসে যাদের জন্ম তাদের সবার এক দিনে হবে ঠিক করলেন। ভাগ্যক্রমে সেটা আগস্ট মাস, আমি প্রথম দলে পড়ে গেলাম! সেকি দারুণ অভিজ্ঞতা! আটজন সইয়ের একদিনে জন্মোৎসব! বিশাল রূপোর থালায় আটটা রূপোর বাটিতে পায়েস, রূপোর চামচ এল। অন্য সইদের জন্যও পায়েস ছিল, তাদের কেবল রূপোর বাটি চামচ বাদ! এল সব বার্থ-ডে গার্লের জন্য গোলাপফুল আর মিষ্টি। সবচেয়ে বড় কথা, দিদি নিজে হাতে আমাদের সবার মুখে পায়েস তুলে দিলেন চামচ দিয়ে, মুখে মিষ্টি দিলেন, হাতে গোলাপ তুলে দিলেন। এ কি ভোলা যায় কখনো? আর তারপর তো সবার জন্য খাবার বিশাল পাট ছিলই। এই আমাদের নবনীতাদি।

    আর একটি ঘটনাও বলি। সেদিনটাও তাঁর জন্মদিন। সেই শেষ সবাইকে নিয়ে জন্মদিন পালন। তার পরের জন্মদিনে তিনি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেবার ভাগে ভাগে অনেকজনকে ডেকেছিলেন সেই উপলক্ষ্যে, বিভিন্ন দিনে। এর ঠিক আগেই আমেরিকা গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য, জেনে এসেছিলেন যে খুব সম্ভব সেটিই তাঁর শেষ জন্মদিন পালন। তার আগে একদিন আমি ফোন করে তাঁকে বলতে শুনেছিলাম, “কই, আমার তো কিছু হয়নি।” সে যাই হোক, সব সইকে যেদিন জন্মদিনের ডিনারে ডাকলেন সেদিন গিয়ে দেখি সদ্য নিদানপ্রাপ্ত তিনি দারুণ একটা শাড়ি পরে আছেন, কপালে তাঁর সেই খুব চেনা বিশাল লাল টিপ। দারুন সেজেগুজে হাসিমুখে বসে আছেন। ক্লান্তি যদি ভেতরে কোথাও থেকেও থাকে তার কোনো বহিঃপ্রকাশ ছিল না। সেই চিরপরিচিত ভঙ্গীতে সবার কুশলসংবাদ নিলেন, কারও গান, আবৃত্তি ভালো লাগলে প্রশংসা করলেন, মন একটুও বিক্ষিপ্ত বলেও মনে হল না। ডাক্তার বলেছিলেন বাইরের কোনো কিছুর সংস্পর্শে না আসতে, কিন্তু একটি অল্প বয়সী মেয়ে এসে তাঁকে একটা ঝুটো গয়নার সেট দিলে তিনি ডাক্তারের নির্দেশ না মেনে সেটি খুশি হয়ে পরে নিলেন। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ সাবধান করতে গেলে বলেছিলেন, আশি বছর বেঁচেছি, অনেক কিছুই তো করেছি, এখন আর চলে যাবার ভয় কি?

    এই ছিলেন নবনীতাদি। জীবনটাকে যেন খেলা ভেবে নিয়েছিলেন। হেসেই জীবন কাটিয়ে দিলেন, হাসিমুখেই চলে গেলেন। ভিতরে চিরদিন একটা শিশুকে লালন করে গেছেন। তাঁর হঠাৎ রাগ, হঠাৎ অভিমান, আবার পরমুহূর্তেই কাছে টেনে নেওয়া তাঁর অন্তরের শিশুসত্ত্বারই প্রকাশ বলে মনে হতো সবসময়। তাঁকে যাঁরা চিনতেন, সকলেই তাঁর আন্তরিক ব্যবহার আর প্রাণময় হাসিতে মুগ্ধ ছিলেন। আমরা এমন মানুষকে কাছ থেকে দেখতে পেয়েছি বলে নিজেদের ধন্য মনে করি।



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ রাজীব চক্রবর্তী
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments