• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৪ | অক্টোবর ২০২১ | গল্প
    Share
  • মাতৃরূপেণ : সৌমি জানা


    য়ার্ডের পাশেই একটা বড় ওক গাছ। জেমির ঘরের জানলা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যায়। জেমির ঘরটা তিনতলায়। এমনকি ওর বেডে শুয়ে বাইরে তাকালেও জানলা জুড়ে ওই বড় ওক গাছ। ঋতু বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে সাজায় গাছটা। এইতো কদিন আগে হলুদ, কমলা, বাদামি পাতায় ঢেকে ফেলেছিল নিজেকে। কি যে সুন্দর লাগছিল দেখতে! জেমির মনে পড়ল ওর মায়েরও একটা একইরকম দেখতে ফল কালারের ড্রেস ছিল। ড্রেসটা পরলে মাকে লাগত ভীষণ প্রাণবন্ত, উচ্ছল। থ্যাঙ্কসগিভিং-এ ওই পোশাক পরে একমুখ হাসি নিয়ে টেবিল-ভর্তি খাবার সাজিয়ে ফেলত মা। তারপর যে কি আনন্দ! মায়ের হাসি যেন থামতই না, সঙ্গে ওরা তিন ভাই-বোনও সেদিন রঙিন স্বপ্নে ভাসত। পেট ভরা খাবার আর বুক ভরা খুশি নিয়ে ওরা ঘুমিয়ে পড়ত ডিনারের শেষে। তবে ঘুমের মধ্যেই জেমি শুনতে পেত ৱাতে মায়ের কান্না, চাপা আর্তনাদ। নিশ্চই ওই লোকটা এসেছে, বুঝত জেমি। লোকটা এলেই মা অমন করে কাঁদে!

    শীতের মুখে সব পাতা ঝরে যায় গাছটার। নগ্ন শাখাপ্রশাখা, এবড়োখেবড়ো বাকল, গুঁড়ির কাষ্ঠতা নিয়ে তখন দাঁড়িয়ে থাকে ওকগাছ। মাকেও ওইরকম দেখেছে জেমি। ক্ষতবিক্ষত, বিধ্বস্ত, চোখের কাজল ধেবড়ে গেছে গোটা মুখে, লিপস্টিকের গাঢ় লাল ঠোঁট ছাড়িয়ে থুতনিতে, গলায়, ফরসা সাদা হাতদুটোয় দগদগে হয়ে লেপ্টে। ওইগুলো ঢেকে রাখতে পারে অমন জামা আর নেই মায়ের। এমনই বুঝি হয়। পাতা ঝরে গেলে মায়ের মত এমন করেই বুঝি রিক্ত, নগ্ন, অবসন্ন, ব্যথার ভার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গাছটা। বরফের শৈত্য গায়ে মেখেও নিশ্চুপ, নিরাভরণ। হিমশীতল কাঠিন্য সম্বল করে অস্তিত্ব বাঁচানোর সংগ্রাম।

    শীতটা বড্ড লম্বা। ঠান্ডা বরফের আস্তরণ সব যন্ত্রণার অনুভূতিগুলোকে অসাড় করে রাখে, পাকাপাকি না হলেও অস্থায়ী। জেমি নিজেও দেখেছে, ওর কপালের দুপাশের রগের দপদপানিটা যখন খুব বাড়ে, তখন চোখ বন্ধ করে মাথায় আইস-ব্যাগ চেপে ধরে রাখলে খুব আরাম পায়। ঠান্ডার কামড়ে যাবতীয় অনুভূতির অবসান! তবে বরফ একদিন গলবেই। তখন একটা দুটো করে কুঁড়ি ধরে গাছটায়, ছেয়ে যায় মুকুলে। বসন্তের বাতাসে সুবাস ছড়ায় ওর শাখা জুড়ে প্রস্ফুটিত গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। গ্রীষ্মের রোদেলা উষ্ণতায় গাছ ভরে যায় নতুন গজানো সবুজ পাতায়। তখন সে অপরূপা!

    জেমি ভাবে ওর মায়ের মতোই সুন্দরী ওই ওক গাছ। ঠিক ওই গাছটার মতো শরীরের সব যন্ত্রণা, মনখারাপের সব আস্তরণ ঝেড়ে ফেলে মুক্তোর মতো ঝরঝরে হাসিমুখে উঠে দাঁড়ায় মা। মায়ের রূপে, বর্ণে, গন্ধে, আদরে উদ্বেল হয়ে যায় ওরা তিন ভাইবোন। সারাদিন যে কত কাজ মায়ের! পাখির পালকের মতো হালকা নরম পায়ে বাড়িতে বাইরে অবিশ্রান্ত ছোটাছুটি। জেমি আর ওর ছোট ছোট দুই ভাইবোনের জীবনে সবসময় হাসি আর আলো ছড়ায় মা, ওদের ঘিরে বোনে সুরক্ষার জাল।

    কিন্তু গ্রীষ্মের ওই উষ্ণ দিনগুলোতেই হঠাৎ হঠাৎ আকাশ কালো করে আসে ঘূর্ণিঝড়, রুদ্র মূর্তি, বিধ্বংসী। কয়েক ঘন্টার বন্যতায় তছনছ হয়ে যায় সাজানো বাগান। ফুল ছিঁড়ে, পাতা ঝরে, ডাল ভেঙে, শিকড় উপড়ে নিথর হয়ে যায় গাছগুলো। ঝড়ের রাতে ঘুমোতে পারেনা জেমি। সারারাত কাঁচের জানলা দিয়ে ওক গাছটাকে দেখে। আহত বাঘিনীর মতো প্রচণ্ড তেজে ঝড়ের সাথে লড়ে যায় গাছটা। যেন এক অশরীরী শক্তি গ্রাস করে ওকে, শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে ঝড়টাকে গিলে খেতে চায় তখন গাছটা!

    জেমির চোখে ভেসে ওঠে অগুনতি খণ্ডচিত্র। ঝড়ের মতো আসত ওই লোকটা ওদের সুখের দিনে। লোকটা এলেই মা কেমন অস্থির হয়ে পড়ত। জেমিকে বলত দুই ভাইবোনকে নিয়ে কোণের দিকে ওর ঘরটায় দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে থাকতে। ঘরের ভিতর থেকে ওরা শুনতে পেত বাইরের চেঁচামেচি, মায়ের আর্তনাদ, প্রতিরোধ। ভাই-বোন দুটো একসময় ঘুমিয়ে পড়লেও সারারাত ঘুমোতে পারত না জেমি। দরজা খুলে সন্তর্পণে বাইরে এসে লুকিয়ে দেখত মায়ের ঘরের দিকে, কখন লোকটার হাত থেকে ছাড়া পাবে মা? অবশেষে ভোররাতে যখন লাথি মেরে দরজা ঠেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত লোকটা তখন বিছানায় এলিয়ে পড়ত জেমির মা। ভীষণ শান্ত, আহত, চলত্শক্তিহীন, নির্জীব। ঝড়ের সঙ্গে লড়াইয়ের শেষে ওক গাছটা যেমন নিষ্প্রাণ দাঁড়িয়ে থাকে ঠিক তেমন।

    এমনই চলছিল বেশ কয়েক বছর। হঠাৎ এক অভিশপ্ত ঝড়ের রাতে বাজ পড়ে আগুন ধরে গেল গাছটায়। দাউদাউ করে জ্বলছে গাছটা! জেমি চাইছিল ছুটে বেরিয়ে গাছটাকে বাঁচাতে। চিৎকার করে ডাকছিল, “বাঁচাও বাঁচাও, কেউ বাঁচাও ওকে… কে আছো বাঁচাও!” তিনতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নামতে যাচ্ছিল ও। কিন্তু কি যে হলো, হঠাৎ সব ঝাপসা হয়ে গেল ওর চোখের সামনে, জড়িয়ে গেল পা দুটো, ঘনিয়ে এল গাঢ় অন্ধকার!

    পরের দিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল দেখল নিজের বিছানাতেই শুয়ে আছে ও। সব শান্ত, কোথাও কোন শব্দ নেই। জানলার পর্দাটা কে যেন টেনে দিয়েছে। তবে কি সারারাত স্বপ্ন দেখল ও, একটা ভীষণ দুঃস্বপ্ন! কিন্তু না, সেদিন তো সত্যিই আগুন লেগেছিল, দাউদাউ করে জ্বলছিল মা। সেইদিন রাতেও এসেছিল ওই লোকটা। ওর সাথে লড়তে লড়তে কিচেনে চলে এসেছিল মা। পিছন পিছন ঘাতকের মতো ধেয়ে আসছিল লোকটা। ধাক্কাধাক্কিতে মনে হয় গ্যাস স্টোভের নব ঘুরে গেছিল কোনভাবে। মুহূর্তে আগুনের শিখা গ্রাস করেছিল মায়ের গায়ের গোলাপি রোবটাকে। ছড়িয়ে পড়ছিল লেলিহান অগ্নিশিখা। মা যন্ত্রণায় চিৎকার করে সাহায্য চাইছিল, কিন্তু পালিয়ে গেল লোকটা। জেমি ছুটে আসছিল মাকে ধরতে। মা ককিয়ে উঠল, “না না এসোনা সোনা, কাছে এসোনা আমার আর …”

    কথাটা শেষ হলনা মায়ের, ভীষণ ধোঁয়ায় দম আটকে এল জেমির। চারদিকে ঘনিয়ে এল অন্ধকার, ঠিক আগের রাতের মতো!

    হঠাৎ বাইরে একটা ঘড়ঘড়ে যান্ত্রিক আওয়াজ শুনতে পেল জেমি। কোনোরকমে টলতে টলতে বিছানা থেকে নেমে ছুটে এসে এক ঝটকায় সরিয়ে দিল জানলার পর্দা। একি! ওরা ওক গাছটাকে কেটে ফেলছে! গাছটা পুড়ে কালো হয়ে গেছে। আর সোজা দাঁড়িয়ে নেই, ঝুঁকে পড়েছে একদিকে। কয়েকটা লোক, সঙ্গে ভারী ভারী যন্ত্রপাতি, গাছটাকে মোটা দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে একটা ভীষণ শব্দ করা যান্ত্রিক করাত লাগিয়ে ওর গোড়া থেকে কাটতে শুরু করেছে।

    চিৎকার করে ওঠে জেমি, “এই কি করছো! ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও গাছটাকে তোমরা। ছুঁয়োনা একদম। না হয় একটু পুড়ে গেছে, না হয় আর নড়ছে না পাতাগুলো আগের মতো, তবু তো আছে। ওকে কেটে ফেলোনা তোমরা…..দোহাই তোমাদের!”

    ডুকরে কেঁদে উঠল জেমি। “আমার মাকেও ছাড়োনি তোমরা। মা ওঠো। মুখটা কালো হয়ে গেছে তোমার, সোনালি চুলগুলো ঝরে গেছে সব, তবু তোমায় কি শান্ত স্নিগ্ধ লাগছে। ওঠো মা, তুমি আবার সুন্দর হয়ে যাবে, হাসবে আগের মতো। এখন চোখ খোলো। খুব খিদে পেয়েছে মা, খেতে দাও আমাদের ….দ্যাখো জেসমিন কাঁদছে, ওকে কোলে নাও …ওঠো মা। একি! কি করছ তোমরা! আমার মাকে তুলে ওই কালো বাক্সে ভরছো কেন? ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও বলছি ….”

    প্রাণপণে হাত পা ছুড়ছে জেমি। চিৎকার করছে, মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে ওর, চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। আবার সেই সাদা পোশাক পরা লোকগুলো এসে চেপে ধরছে ওকে। ওরা বারবার আসে। যতবার জেমি ওর মাকে ধরতে যায়, ওরা এসে হাত পা চেপে ধরে ওর! আবার ওরা চেঁচিয়ে বলছে,

    “হেল্প হেল্প….এমার্জেন্সি ইন রুম ৩০১ ….পেশেন্ট গট ভায়োলেন্ট …..কল দ্য ডক্টর …”



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments