ওদেশের বিকেল সাড়ে চারটেয় আমরা প্লেন থেকে যখন নামলাম, বাইরের তাপমাত্রা ৬° সেন্টিগ্রেড। কেফ্লাভিক (Keflavik) অ্যারপোর্ট থেকে রেকেভিক-এ পৌঁছতে ৫০কিমি পথ পাড়ি দিতে হবে। বাসের জানলা থেকে দেখছি দিগন্তে সোনা রঙের সূর্য কাঁসার থালার মতো চকচক করছে আর সেই অস্তায়মান সূর্যের প্রভা মেঘলা আকাশে ছড়িয়ে পড়ে চমৎকার এক নৈসর্গিক চিত্র তৈরি হয়েছে।
মসৃণ পথে বাস চলেছে আর তার টিভিতে দেশটি সম্বন্ধে নানা তথ্য দেখাচ্ছে। যেমন, পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের এই দ্বীপটির অবস্থান নর্থ অ্যাটল্যান্টিক ও আর্কটিক সাগরের সংযোগস্থলে ৬৩° থেকে ৬৮° উত্তর অক্ষাংশে। সেখানে তাই শীতকালে সূর্যদেব সারাদিন দিগন্তের কাছাকাছি থাকেন। আবার, উষ্ণ গালফ্ স্ট্রীম-এর কল্যাণে এই একই অক্ষাংশে থাকা অন্যান্য দেশের থেকে এই দেশটি উষ্ণ। তার আয়তনের তুলনায় আইসল্যান্ড (১০৩,০০ বর্গ কিমি)-এর জনসংখ্যা (মাত্র সাড়ে তিনলাখ) খুব কম আর তাদের অধিকাংশের বাস সমুদ্রের ধারের এই শহর রেকেভিক-এ। দেশটির আয়তনের ২০% হিমবাহ, ৪%-এ আছে লেক, ৭০%-এ আছে পাহাড় আর ২% মাত্র জমি যার অর্ধেক চাষের কাজে ব্যবহৃত হয়। এইসব হিমবাহ ও তাদের থেকে উৎপন্ন নদী ও ঝর্ণার প্রাচুর্য আইসল্যান্ডের এক মস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। অন্যদিকে, দেশটিতে রয়েছে বেশ কিছু জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। ফলে, সমস্ত দেশে হাইড্রো-ইলেক্ট্রিক ও জিও-থার্মাল পাওয়ার উৎপাদন করে সস্তায় সকল দেশবাসীকে গরম জল, হীটিং ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। বুঝলাম যে আগ্নেয়গিরির লাভাতে তৈরি বলেই রাস্তার পাশের ধু-ধু জমি অমন কালো রঙের! অবশ্য, কোথাও কোথাও তাতে রয়েছে হলুদ হয়ে যাওয়া ঘাস।
বাস থেকে কখনো দেখছি দিগন্তবিস্তৃত প্রান্তরের মধ্যে বরফ-মাথায় নিচু পাহাড়, কোথাও বা রয়েছে ছোট-বড় বাড়িঘর। আস্তে-আস্তে সন্ধে নামল। শহরের কাছে আসতেই গাড়ির সংখ্যা বাড়ল ও বাসের গতি কমে গেল। একজায়গায় সার দিয়ে রয়েছে অনেকগুলো কৃশকায় নিষ্পত্র গাছ আর কিছু ঝাউ গাছ। চেনা নামের ফাস্টফুড-এর দোকান দেখে বুঝলাম যে শহরে পৌঁছে গিয়েছি। ততোক্ষণে, রাস্তার পাশে এসেছে প্রচুর বহুতল বাড়ি যার অনেকগুলো মহাজাতিক সংস্থার অফিস ও বড়বড় হোটেল। তবে, পরে দেখেছি যে শহরটিতে আবাসিক অঞ্চলের ঘর-বাড়ি তিনতলার বেশি নেই বললেই চলে। লেখা বাহুল্য, আর যে কোনো ইওরোপীয় শহরের মতো রাস্তাঘাট পরিষ্কার। গাড়ি ছাড়া সাধারণের চলাচলের জন্য শহরে বাস ও ট্যাক্সি চলছে।
হোটেলের রিসেপশনেই দুঃসংবাদ পেলাম যে খারাপ আবহাওয়ার জন্য সেদিন রাত্রের ‘নর্দার্ন লাইট্স্’ বা সুমেরুপ্রভা দেখতে যাবার ব্যবস্থাটি বাতিল হয়ে গিয়েছে। এই খবরে একদিকে নিরাশ হ’লাম ঠিকই কিন্তু অন্যদিকে ক্লান্ত শরীর তখন একটু বিশ্রাম পাবে ভেবে যেন একটু স্বস্তিও পেলাম। সুখের কথা এই যে আমরা অন্য একদিন এই বাতিল ট্রিপটি নিতে পারব। আমাদের মোট তিনটি ‘অরোরা শিকারে’ (ওদেশের ভাষায় ‘Aurora hunting’) যাবার ব্যবস্থা করা আছে যার দু’টি হবে ডাঙ্গায় ও একটি সমুদ্রের বুকে। ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে রাত্রে বেরিয়ে বীয়ার সহযোগে কুচোনো বীফ ভাজা ও আলুমরিচ খেয়ে এলাম।
সেসময় ওদেশে সূর্য ওঠে সকাল সাড়ে আটটায় ও অস্ত যায় ছ’টায়। তাই সমুদ্রে ‘তিমিদর্শন’-এর উদ্দেশ্যে সকাল সোয়া আটটাতে যখন ‘জেটি’র দিকে রওনা হলাম, তখনো আকাশ অন্ধকার। বাইরে টিপটিপে বৃষ্টি পড়ছে ও হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা (৫°C)। একথা জানতাম যে জোরালো হাওয়ার দেশ হিসেবে আইসল্যান্ড-এর স্থান পৃথিবীতে দ্বিতীয় ও সেই হাওয়ার কল্যাণে তাপমাত্রা যা তার থেকে বোধহয় অনেকটা কম। ফলে, প্রচুর পরিমান গরম জামায় আবৃত হয়েও সেই ঠান্ডার কাছে পরাস্ত হ’চ্ছিলাম। যাহোক, প্রথমে লঞ্চ-এর ওয়েটিং এরিয়া আরেকটি লঞ্চ-এ গিয়ে উঠলাম। সেখানে বিশাল এক তিমির কঙ্কাল ওপর থেকে ঝুলছে ও দোকানে বিক্রি হ’চ্ছে নানারকম স্যুভেনির। আমাদের চারপাশে নানাদেশের মানুষের মধ্যে দু’টি ভারতীয় দম্পতিও রয়েছেন। আসল লঞ্চ-এ উঠে ঠান্ডার ভয়ে আমি খোলা ডেক-এ না গিয়ে নিচেই বসলাম।
ন’টায় যখন লঞ্চ ছাড়ল, সবে দিনের আলো ফুটছে। গাইড আশ্বাস দিলেন যে আজ সমুদ্র যেরকম শান্ত, তাতে তিমি দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশী। তিনি আমাদের সেফটি-টিপস জানালেন, দেখালেন লাইফ জ্যাকেট-এর অবস্থান। জমির থেকে তরতর করে দূরে চলেছি, মাঝেমাঝে সমুদ্রের মধ্যে দ্বীপের মতো বরফ-মাথায় পাহাড় দেখতে পাচ্ছি। অন্যদের দেখাদেখি আমি একবার সাহস করে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা অগ্রাহ্য করে বেশ অনেকক্ষণ ডেক-এ রইলাম। গাইড মহাশয়ের উৎসাহের অন্ত নেই। তিনি সেইসময় আশ্বাস দিচ্ছিলেন যে তিমি ছাড়া ডলফিন ও নানারকম মাছও দেখতে পাওয়া যাবে। কোথায় কী! খানিকপরে সমুদ্রের অনেকটা ভেতরে যখন, বেশ কাছ থেকে সেই বিখ্যাত আগ্নেয়গিরি দেখলাম যার থেকে বেরোনো ছাই-এর কারণে ২০১০ সালে ইওরোপ-সহ পৃথিবীর প্রায় কুড়িটি দেশের বিমান চলাচল বেশ কিছুদিনের জন্য ব্যাহত হয়েছিল। তার কাছাকাছি আরো কয়েকটি আগ্নেয়গিরি রয়েছে। একটু পরে হাওয়া বাড়ল, ঢেউএর ধাক্কায় লঞ্চ দুলতে লাগল ও আমাদের তিমি দেখবার আশা সুদূরে মিলিয়ে গেল। ঐ তিনঘণ্টার লঞ্চ-ভ্রমণে, তিমি দূরে থাক, একটা পুঁটি মাছ অবধি দেখতে পেলাম না!
আমাদের হোটেলটি বেশ আরামের। সেখানকার ঘরের হীটিং-এর সঙ্গে মেঝে গরম রাখার ব্যবস্থাটি আমার বেশ অভিনব লাগল। আরেকটি স্বস্তির ব্যাপার হ’ল যে ওখানে খাবারজল কিনতে হয় না—নিশ্চিন্তে কলের জল খাওয়া যায়। অন্যদিকে, বাথরুমের গরমজল যেহেতু প্রাকৃতিক গীজার থেকে আসছে, তাই জলে বেশ সালফারের গন্ধ। কন্যার অনুযোগ, ‘স্নান করে বেরিয়ে মনে হচ্ছে গায়ে যেন চাটমশলা লাগিয়েছি’!
সেদিন রাত্রে আমাদের ‘নর্দার্ন লাইট্স্’ দেখতে যাবার কথা। সারাদিন আমাদের সবার মনে একটা ‘কী হয়, কী হয়’ ভাব। তার আগে আমাদের ডিনার-এর ব্যবস্থা রয়েছে এক ‘পাব’-এ। বিরাট ‘পাব’টি প্রচুর লোকজনের উপস্থিতিতে সরগরম। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট টেবিলে গিয়ে বসলাম। হাসিখুশী এক অ্যামেরিকান তরুণ আমাদের আপ্যায়নের দায়িত্বে ছিলেন। প্রত্যেকের জন্য একটু বেঁটে কিন্তু ছড়ানো গ্লাস-এ প্রথমে তিনরকম বীয়ার এল যার প্রত্যেকটির সঙ্গে চমৎকার কাচের পাত্রে সুন্দর করে সাজানো তিনরকম খাবার--যেমন চিংড়ি, স্যামন ও mussels। পানীয়ের প্রথম পর্ব শেষ হওয়ার মুখে আমাদের টেবিলের বাকি দুই অতিথি এসে পৌঁছলেন। সেই অ্যামেরিকান প্রৌঢ়া ও তরুণী-জুটি খুব মজা করে আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়লেন। তারপর এলো পরের পর্বের অন্য আরো তিনরকম বীয়ার ও তাদের সঙ্গতকারী খাবার। রূপ-গন্ধ-স্বাদে বীয়ার-এর যে এতো বৈচিত্র্য আছে তা ঐ সন্ধের আগে আমি জানতাম না! খাবারের স্বাদও ছিল অপূর্ব; বিশেষত, রোস্টেড ল্যাম্ব-এর স্বাদ যেন আজও ভুলতে পারি না!
‘পাব’ থেকেই আমাদের নিয়ে বাস চলল ‘নর্দার্ন লাইট্স্’ দেখাতে। ঘন্টাখানেক পর শহর থেকে দূরে নিকষ কালো অন্ধকার এক মাঠের মধ্যে গিয়ে থামলাম। কনকনে ঠান্ডায় বাস থেকে নেমে আমরা প্রকৃতির করুণার আশায় আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম। আকাশে হালকা মেঘ ছিল। মেঘ সরে তারা ফুটল। আমাদের আশা এবার বুঝি তাকে দেখা যাবে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে আবারও আকাশ মেঘে ঢেকে গেল। এখানেও গাইড অনেকরকম আশার কথা বললেন কিন্তু দূরে, দিগন্তে শহরের আলো ছাড়া আকাশে কোনো আলোর দেখা পেলাম না। ঠান্ডা থেকে বাঁচতে আমি মাঝেমাঝে বাসে উঠে বসছিলাম। কম-উৎসাহী পর্যটক যাঁরা বাসের ওম্ ছাড়তে চান না তাঁদের সঙ্গে বাস-চালক হান্স বেশ সরস ভঙ্গীতে আইসল্যান্ড-এর ভূগোল-ইতিহাস নিয়ে গল্প করছিলেন। জানলাম যে আইসল্যান্ড-বাসীর পূর্বপুরুষ হল নরওয়ের বাসিন্দা ভাইকিংরা। তারা ৮৫২ সালে এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। শুনে মজা লাগল যে নরওয়েতে তাদের ভাষা অন্য ভাষার প্রভাবে অনেক পালটে গিয়েছে কিন্তু আইসল্যান্ড যেহেতু একটি দ্বীপ, তাই তার বিচ্ছিন্নতার জন্য ভাষার সেই পুরনো রূপ এখানে এখনো অবিকৃত আছে।
যাহোক, ঘন্টাদেড়েক এভাবে আকাশ দেখে ও ঠান্ডার সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। আসলে, ‘অরোরা’-র মতো ‘প্রাকৃতিক বিস্ময়ের’ সৃষ্টির পেছনে এতোগুলো প্রাকৃতিক ঘটনার সমাপতন দরকার যে তার দেখা পেতে একটু ধৈর্য ধরতেই হয়! দু’কথায় বলি এই ‘অরোরা’ বা মেরু-প্রভার উৎসের কথা। এর উৎস হল সূর্য ও তার মধ্যে প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা নানা বিক্রিয়া। বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট আহিত কণারা (charged particles) পৃথিবীতে ছুটে আসে ও তারপর তারা পৃথিবীর দুই চৌম্বকীয় মেরুর দিকে অধিক পরিমাণে আকৃষ্ট হয়। সেই সময়, আহিত কণাদের সঙ্গে পৃথিবীর পরিমণ্ডলে থাকা নানা গ্যাসের অণু ও পরমাণুর সংঘাতে এই অলৌকিক আলোকপ্রভার সৃষ্টি হয়। সাধারণত অক্সিজেনের সঙ্গে সংঘর্ষে তৈরি হয় হলুদ ও সবুজ আলো আর নাইট্রোজেনের সঙ্গে সংঘাতে তৈরি হয় লাল, বেগুনি ও কখনো নীল আলো। স্পষ্টতই, এই পদ্ধতির মূলে আছে যে সৌর-বিক্রিয়া তার কমা-বাড়ার সঙ্গে মেরু-প্রভার ঔজ্জল্য ও আকার নির্ভর করে। সাধারণত, তার যে চওড়া পটি বা ব্যান্ডের মত আকার দেখা যায়, সৌর-বিক্রিয়া বাড়লে তার আকার হয় এক নৃত্যশীল পর্দার মতো যাতে রংবদলের পালা চলতে দেখা যায়! এই অপার্থিব দৃশ্য দেখবার জন্য আদর্শ পরিবেশ হ’ল মেঘমুক্ত আকাশ ও নিকষ কালো অন্ধকার। আজকাল আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো কোনো এক বিশেষ জায়গায় ‘অরোরা’ দেখতে পাওয়ার পূর্বাভাস জানবার ব্যবস্থাও আছে।
‘নর্দার্ন লাইটস’ ছাড়াও আইসল্যান্ড-এর প্রসিদ্ধি আগ্নেয়গিরি, হিমবাহ ও গীজারের দেশ ব’লে। আমরা এবার সেই সব দ্রষ্টব্য দেখতে সারাদিনের জন্য বেরোলাম ‘গোল্ডেন সার্কেল ট্যুর’-এ। সকালের তাপমাত্রা ৭°C তাই যথারীতি পাতলা-মোটা মিলিয়ে কয়েক প্রস্থ গরমজামা পরতে হ’ল। প্রথমে যাবো শহর থেকে চল্লিশ কিমি দূরে Thingvellir (উচ্চারণ ‘থিঙ্কভেল্লির’) National Park. বাসে উঠতেই গাইড আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে ‘ট্যাবলেট’ ধরিয়ে দিলেন যার কল্যাণে আমরা ‘ইয়ার ফোন’ লাগিয়ে যখন যেখান দিয়ে বাস যাচ্ছে সেখানকার বিশিষ্টতার বর্ণনা শুনতে পাচ্ছিলাম।
মস্ত পাহাড় ও পরপর হলুদ আলো-দেওয়া গ্রীন-হাউস পার হয়ে এগোচ্ছি। ডানদিকে এলো ক্যাথলিক চার্চ। পাকদণ্ডী পথে পাহাড়ের ওপরে উঠছি। ওদেশের বেশিরভাগ পাহাড় অগ্ন্যুৎপাতের ফলে তৈরি বলে তাদের কালো গায়ে কোনো গাছপালা নেই। তবে তাদের অধিকাংশের মাথায় রয়েছে বরফ। একতলা বা দোতলা ‘ফার্ম হাউস’ দেখছি যার কোনো কোনোটিতে ঘোড়া চরছে। আইসল্যান্ড-এর এই ঘোড়াগুলো আকারে ছোট আর তাদের ঘাড়ে ও লেজে প্রচুর লোম। সাধারণত ঘোড়ার চাররকম ‘চলন’ থাকলেও এদের নাকি একটি বাড়তি ‘চলন’ আছে। এই কষ্টসহিষ্ণু প্রাণীটি পাহাড়ি পথে সহজে চলতে পারে ও পৃথিবীর নানাদেশে, প্রধানত ঘোড়দৌড়ের জন্য, এদের খুব চাহিদা। আইসল্যান্ড-এ ঘোড়া আমদানী নিষিদ্ধ ও রপ্তানী করা ঘোড়াও দেশে ফেরানো যায়না। ধীরে ধীরে আমাদের পথ এতোটা ওপরে উঠে এসেছে যে বরফ-ঢাকা পাহাড়গুলোর চূড়া আমাদের পাশে এসে যাচ্ছে।
বিরাট এক লেক-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছি যার নাম Thingvallavatn ও সেটি ওদেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক হ্রদ। তার ধারে ধারে রয়েছে তিনটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। ওদেশের ত্রিশটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মধ্যে তিনটিকে একসঙ্গে দেখে ফেললাম ভেবে মজা লাগল। একটু পরেই পৌঁছে গেলাম ন্যাশনাল পার্ক-এ। সেখানে অনেক বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে ও চারদিকে প্রচুর লোকজন।
ফিরে এসে পুরনো রাস্তায় আরেকটু এগিয়ে পেলাম এক ঝর্ণা। ওপর থেকে গমগম করে আওয়াজ তুলে কয়েকটি ধারায় জল এসে পড়ে পথের পাশে একটি জলাশয় তৈরী হয়েছে। বুঝতে পারলাম যে একটু আগে দেখা নদীটির উৎস এই জলাশয়টি। জলাশয়ের পাশে এক বোর্ডে লেখা তার নাম ‘ড্রাউনিং পুল’ যেখানে মধ্যযুগের মহিলাদের ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে ডুবিয়ে মারা হ’তো! শুধু কি তাই! ১৮০০ সাল অবধিও দেশে অপরাধের শাস্তি বলতে ছিল শিরশ্ছেদ, ফাঁসি, বেত্রাঘাত বা অঙ্গচ্ছেদ।
আকাশ মেঘলা তাই ভর দুপুরেও ঝিমনো আলোয় ধুধু প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে আবারও বাস চলল। পাশে আসছে বরফ-মাথায় পাহাড়। রাস্তার পাশেও ছোট ছোট বরফের স্তূপ। এবার বাঁদিকে এক পাহাড় এলো যাতে বেশ কয়েকটি গুহা রয়েছে এবং জানলাম যে দারিদ্র্যের কারণে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এখানে মানুষজন বাস করতো। বাঁদিকে সার দিয়ে পাহাড় চলেছে আর ডানদিকে এলো লগারভাটন লেক। এই অগভীর লেকটির তলদেশে উষ্ণ প্রস্রবণ থাকায় সারা বছর এখানে স্নান করা যায়। সেই কারণে, আগে এখানে ‘ব্যাপ্টিজম’-এর জন্য লোকেরা আসতো। লেকের পাশে যে গ্রাম আছে তাতে শ’তিনেক লোকের বাস। ওদেশের মানুষের কাছে হাইকিং, ট্রেকিং, মাছ ধরা ইত্যাদির জন্য এই জায়গাটি খুব জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। সাধারণভাবে, জলে-ডাঙ্গায়-পাহাড়ে-পর্বতে নানারকম খেলাধূলায় এই দেশটি মহা উৎসাহী। এই ছোট দেশের ২০১৮ তে FIFA World Cup-এর যোগদানের কথা আমাদের অনেকেরই মনে আছে। অনেক খেতে ঘাসের গাঁঠরি রাখা আছে যা শীতকালে গৃহপালিত পশুর খাদ্য। খানিক পরে আকাশে খানিকটা জায়গা একটু পরিষ্কার হয়ে সোনালি রঙ ধরল কিন্তু সূর্যের দেখা নেই। মনে মনে ভাবছি রাত্রে যেন মেঘ কেটে যায়!
যাহোক, এরপর এক অঞ্চল এলো যেখানে শুয়োর, মুর্গী, ছাগল ও গরু প্রতিপালন করা হয়। ওদেশে উপনিবেশের শুরু থেকেই ভেড়া প্রতিপালন করা হয় এবং এই প্রাণীটি দেশবাসীর কাছে এতো মূল্যবান যে তাদের ভাষায় নাকি ‘ভেড়া’ ও ‘অর্থ’ একই শব্দে বোঝানো হয়। সাধারণ ভাবে দুগ্ধজাত দ্রব্য এদেশে এক গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। আইসল্যান্ডের মাখন বিশেষ প্রসিদ্ধ ও স্কির (Skyr) নামে প্রায় দই-এর মতো ঘন একরকম নরম চীজ খুব জনপ্রিয়।
বন্যজন্তুর মধ্যে আইসল্যান্ডে ‘আর্কটিক ফক্স’ ছাড়া আছে ‘রেইন ডিয়ার’। তাদের সংখ্যা-বৃদ্ধি হ’লে নিয়ম করে শিকার করা হয়। এক সময় যে ‘মিঙ্ক ফার্মিং’-এর এখানে রমরমা ছিল তা এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শীতকাল বলে এক শালিকের মতো পাখি ছাড়া ওখানে আর কোনো পাখি দেখতে পাইনি।
স্ট্রোক্কুর-এর খুব কাছাকাছি রয়েছে গীজির (Geysir)। ইওরোপীয়দের জানা এটি ছিল প্রথম গীজার ও ১২৯৪ সালে লিখিত বিবরণে এই গীজির-এর কথা আছে। এই নাম থেকেই সামান্য পরিবর্তিত হয়ে ‘পর্যায়ক্রমে উৎক্ষিপ্ত উষ্ণ প্রস্রবণ’ বলতে ইংরিজিতে গীজার শব্দটি এসেছে। গীজির থেকে এখন আর জল বেরোয় না বললেও চলে কিন্তু সেখানেও অনেকটা জল জমে রয়েছে। তার ওপরটা বেশ ধোঁয়ায় ভরা ও হাওয়া দিতেই সালফার-এর গন্ধ নাকে এল।
রেকেভিক-এ ফেরার পথে ছোটখাটো আরো কয়েকটি গীজ়ার দেখতে পেলাম ও বেশ কিছু জায়গায় মাটি থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখলাম। আরেকটু এগোতেই এলো গত ৪০০০ বছর ধরে সুপ্ত এক আগ্নেয়গিরি। সেটি হ’ল পৃথিবীর একমাত্র আগ্নেয়গিরি যেখানে খোলা লিফট-এ দর্শকরা মাটির তলার ‘ম্যাগমা চেম্বার’ দেখতে যেতে পারেন এবং তাই তার কাছে অনেক পর্যটক রয়েছেন। আগ্নেয়গিরিটির কাছে প্রচুর ঝাউ জাতীয় গাছ লাগানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলি যে আইসল্যান্ড-এ এসে ঔপনিবেশিকরা নির্বিচারে সব গাছপালা কেটে ফেলে কিন্তু লাভায় ভরা পাথুরে জমিতে গাছ তো সহজে হয়না। ইদানীং, উষ্ণায়নের ফলে হিমবাহ গলে যাওয়া ইত্যাদি যেসব বিপত্তি দেখা দিচ্ছে তাদের সামাল দিতে সারা দেশে গাছ লাগানোর এক বিরাট উদ্যোগ চলেছে। আসা-যাওয়ার পথে যে নার্সারি দেখেছি সেখানে নানারকম চারাগাছ পালন করে উপযুক্ত জমিতে লাগানো হয়। যাহোক, বরফ-মাথায় পাহাড়, নদী, ঝর্ণা ইত্যাদি দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে রেকেভিক-এ ফিরলাম।
সেই রাত্রে ছিল আমাদের লঞ্চ-এ ক’রে সমুদ্র থেকে ‘অরোরা শিকারে’ যাবার পালা। পূর্বাভাস অনুযায়ী সেদিন অরোরা দেখতে পাবার সম্ভাবনা যেহেতু খুব বেশী, আমাদের ধারণা ছিল কম-বেশি যাহোক ‘অরোরা’ অবশ্যই দেখতে পাব। সহযাত্রীদের মধ্যে এক ভারতীয় পরিবার বললেন তাঁরা নাকি তিনদিন আগে শহর থেকে পরিষ্কার ‘অরোরা’ দেখেছেন। এহেন ভাগ্যবানদের দেখেও শান্তি! যাহোক, অনেক আশা নিয়ে ডেক-এর ওপর উঠেছি, আকাশের এদিক থেকে ওদিকে চেয়ে থেকেছি কিন্তু তারপর প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়ার দাপট আর যখন সহ্য করতে পারিনি, নেমে এসেছি। সমুদ্রের ওপরের সে হাওয়ার এমন তেজ যে মনে হ’চ্ছিল তার ধাক্কায় পড়ে যাবো। এমন কয়েকবার ওঠা-নামা করাই সার হ’ল — সেদিনের অভিযানেও মেরুপ্রভা অধরা রয়ে গেল।
শেষের দিনটির সকালে আমরা একটু আরাম করে প্রাতরাশ করলাম। হোটেলের চমৎকার ‘কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্ট’-এ একেকদিন একেকরকম pickled fish ও টাটকা ছানা এই পদ দু’টি আমার বেশ অভিনব লাগে। সেদিন ডাইনিং হল-এর মেঝে মুছছিল যে তরুণীটি তাকে দেখে আমি ভারতীয় ভেবেছিলাম। আলাপ করে জানলাম যে ঐ মিষ্টি মেয়ে ‘দিল্কি’ তার বাবা ও দিদির সঙ্গে শ্রীলঙ্কা থেকে এসে ওদেশে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ নিয়েছে।
সেদিন আমরা যখন পায়ে হেঁটে শহর দেখতে বেরোলাম, ঊষাদেবী সদ্য আবির্ভূতা হয়েছেন। অল্প দূরেই ‘রেকেভিক চার্চ’ কিন্তু চড়াই পথে সেখানে যেতে বেশ গরম লাগতে লাগল। প্রথমে চোখে পড়ল মস্ত এক পাথরের বাহারী বেদীর ওপর লাইফ এরিক্সন (৯৭০-১০২০)-এর দৃপ্ত ভঙ্গীমায় দাঁড়ানো বিশাল মূর্তি। আইসল্যান্ড-বাসী এই নরওয়ের মানুষটি ছিলেন প্রথম ইওরোপীয় যিনি ৯৯৯ সালে, অর্থাৎ কলাম্বাসের ৫০০ বছর আগে, সঙ্গীসাথী-সহ উত্তর অ্যামেরিকায় পদার্পণ করেন। তাঁর স্থাপিত সেই উপনিবেশটির নাম ছিল ‘ভিনল্যান্ড’ ও সেটি বর্তমান ক্যানাডার অন্তর্গত। নানাকারণে বছর দশেকের বেশী সেই উপনিবেশ সেখানে স্থায়ী হয়নি। ১৯৩০ সালে আইসল্যান্ডের পার্লামেন্ট-এর হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এই মূর্তিটি ছিল আইসল্যান্ডবাসীকে দেওয়া অ্যামেরিকার উপহার।
সকাল থেকে মেঘলা আকাশ দেখে মনের মধ্যে বারবার উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল যে কথাটি তা হ’ল সেদিন রাতে আমাদের ‘নর্দার্ন লাইটস্’ দেখার শেষ সুযোগ। ছবিতে দেখা প্রকৃতির সেই অবিশ্বাস্য সুন্দর রূপটি নিজের চোখে দেখতে পাবো কি না কে জানে! যাহোক, চার্চের কাছেই পেলাম sculpture garden যা মাপে ছোট কিন্তু সেখানে বেশ কিছু সুন্দর ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য রয়েছে। তাদের স্রষ্টা আইনার জন্সন (১৮৭৪-১৯৫৪) ছিলেন ওদেশের প্রথম ভাস্কর।
তারপর সুন্দর এক লেক ও তার পাশের পার্ক পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ন্যাশনাল ‘ম্যুজিয়াম অফ আইসল্যান্ড’-এ। ততক্ষণে, সূর্যদেব দর্শন দিয়েছেন ও আকাশ হয়েছে মেঘমুক্ত। এই ম্যুজিয়াম-টিতে নরওয়ে থেকে আইসল্যান্ডে আসা মানুষদের যে জীবনযাত্রার বিবর্তনের ইতিহাস প্রদর্শিত রয়েছে তা অনেকটা সময় দিয়ে দেখলাম।
শহরের Flea Market-এর প্রশংসা শুনেছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম নিত্যদিনের নানা প্রয়োজনীয় পসরা নিয়ে রয়েছে দোকানের সারি। কন্যার উৎসাহে আমিও কয়েকটি দোকানের গয়না, উলের পোষাক, নানারকম ব্যাগ, খাদ্য-সামগ্রী ইত্যাদি দেখলাম। ঐ ক’দিনে স্থানীয়দের দেখাদেখি আমরাও চানাচুরের মতো শুধু শুধু hardfiskur বা শুঁটকিমাছ খেতে শিখেছিলাম। তাই, স্যুভেনির হিসেবে দু’ধরনের শুঁটকি মাছ কিনলাম আর কিনলাম Licorice Chocolate. মাছ-বিক্রেতা ভদ্রলোক বেশ গম্ভীর কিন্তু তা পুষিয়ে দিলেন হাসিখুশী সুন্দরী Chocolate-বিক্রেতা মহিলা। গল্প করতে করতে তিনি বুদ্ধি দিলেন মাখন লাগিয়ে শুঁটকি মাছ খেতে। পরে খেয়ে দেখেছি যে ব্যাপারটা সত্যি অতি সুস্বাদু হয়।
‘অরোরা’ নিয়ে আমাদের সারাদিনের উদ্বেগ তো ছিলই। তাই, বিকেল থেকে এই বুঝি ট্রিপ বাতিলের খবর এলো ভেবে বারবার ফোন-এর পর্দায় চোখ রাখছিলাম। যাহোক, রাত সাড়ে আটটায় বাস এসে আমাদের শহরের বাইরে নিয়ে চলল ‘অরোরা’ দেখাতে। আমাদের সাথী সেবার খুব প্রাণোচ্ছল এক গাইড ও তরুণী বাস-চালক মণিকা। গাইডের সঙ্গে তার আলাপচারিতায় শুনতে পেলাম যে তিন বছর অন্য কম্পানিতে চাকরি করে আসা মণিকার সেদিন এই কম্পানিতে দ্বিতীয় রাত। যথারীতি, কৃত্রিম আলোর প্রভাব ছাড়িয়ে শহরের বাইরে অনেক দূরে যেতে প্রায় ঘন্টাখানেক চলা। বাস থেকে নেমে দেখলাম আবারও কোনো এক বিশাল প্রান্তরে এসেছি। সেখানে ৭-৮° সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ও হাড় হিম-করা জোরালো ঠান্ডা হাওয়ায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকাও কঠিন ব’লে বোধ হ’চ্ছে! গাইডের সহায়তায় অল্পক্ষণের মধ্যে উত্তর আকাশে ফিকে সবুজ চওড়া যে এক আলো দেখতে পেলাম সেটি যেন আকাশের গায়ে বয়ে যাওয়া এক আলোর নদী। বুঝলাম এই হ’ল সেই মেরুপ্রভা মূলত যার আকর্ষণে এই দূরদেশে আসা! খানিক বাদে তার একধারের খানিক অংশ বেঁকে নিচের দিকে গিয়ে ইংরিজি এস-এর মতো হ’ল। মেরুপ্রভার ঔজ্জল্য সেদিন খুব যে বেশি তা নয় আর তার মধ্যেও তার কমা-বাড়া ছিল। কিন্তু অধরা যে অবশেষে ধরা দিয়েছে তাতেই আমরা খুব খুশী–-খুশী আমাদের গাইড মহাশয়, খুশী মণিকাও! সেখানে অনেক বাস, প্রচুর লোকজন কিন্তু কোনো হৈচৈ নেই। সকলে বিভোর হয়ে প্রকৃতির সেই মোহিনী রূপ দেখছে। চারপাশে নানারকম ক্যামেরায় আকাশের ছবি উঠছে। আমার সেই দায় নেই। আমি শুধু আশ মিটিয়ে আকাশের গায়ের সেই আলোক ধারাকে দেখছি, দেখছি তার রূপ-বদল। এমন সময় অন্ধকারের এক কোণ থেকে স্পষ্ট বাংলায় এক পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো, ‘এই গাধার বাচ্চা, ওদিকে না — এদিকে তাকা’!
বাসের ভেতরটা যেহেতু গরম, তাই আমরা মাঝেমাঝে বাসে উঠে গা গরম করে আবার নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম। এই ওঠানামা সবই অন্ধকারে যাতে আমাদের দেখবার ক্ষমতা হ্রাস না পায়। ঘন্টাখানেক এই দৃশ্য দেখবার পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হ’ল আরেকটি জায়গায়।