• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৬ | সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • অপরূপ সেই আলোকধারা : চম্পাকলি আইয়ুব


    হলগ্রিমুর চার্চ থেকে শহরের একাংশ
    ইসল্যান্ড-এ বেড়াতে যাবার প্রস্তুতি-পর্বে আমার আনন্দ একটু নিভু-নিভু ছিল কারণ শীতকে আমার বড় ভয়। ওদিকে, ওদেশের দর্শনীয়দের মধ্যে যে সুপার-স্টার সেই ‘নর্দার্ন লাইট্‌স্‌’ বা ‘অরোরা বোরিয়ালিস’ তো বড় খেয়ালি। তাই, তাকে দেখতে পাওয়ার অনিশ্চয়তাকে কম করতে শীতকালই হ’ল উৎকৃষ্ট সময় যখন আইসল্যান্ড-এ রাত হয় দীর্ঘ। অতএব, ‘অরোরা’ দেখবার আশা নিয়েও প্রচুর গরম জামার ওপর ভরসা করে নভেম্বরের এক কৃষ্ণপক্ষে আমাদের অভিযান শুরু হ’ল আইসল্যান্ডের রাজধানী রেকেভিক (Reykjavik)-এর উদ্দেশ্যে।

    ওদেশের বিকেল সাড়ে চারটেয় আমরা প্লেন থেকে যখন নামলাম, বাইরের তাপমাত্রা ৬° সেন্টিগ্রেড। কেফ্লাভিক (Keflavik) অ্যারপোর্ট থেকে রেকেভিক-এ পৌঁছতে ৫০কিমি পথ পাড়ি দিতে হবে। বাসের জানলা থেকে দেখছি দিগন্তে সোনা রঙের সূর্য কাঁসার থালার মতো চকচক করছে আর সেই অস্তায়মান সূর্যের প্রভা মেঘলা আকাশে ছড়িয়ে পড়ে চমৎকার এক নৈসর্গিক চিত্র তৈরি হয়েছে।

    মসৃণ পথে বাস চলেছে আর তার টিভিতে দেশটি সম্বন্ধে নানা তথ্য দেখাচ্ছে। যেমন, পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের এই দ্বীপটির অবস্থান নর্থ অ্যাটল্যান্টিক ও আর্কটিক সাগরের সংযোগস্থলে ৬৩° থেকে ৬৮° উত্তর অক্ষাংশে। সেখানে তাই শীতকালে সূর্যদেব সারাদিন দিগন্তের কাছাকাছি থাকেন। আবার, উষ্ণ গালফ্‌ স্ট্রীম-এর কল্যাণে এই একই অক্ষাংশে থাকা অন্যান্য দেশের থেকে এই দেশটি উষ্ণ। তার আয়তনের তুলনায় আইসল্যান্ড (১০৩,০০ বর্গ কিমি)-এর জনসংখ্যা (মাত্র সাড়ে তিনলাখ) খুব কম আর তাদের অধিকাংশের বাস সমুদ্রের ধারের এই শহর রেকেভিক-এ। দেশটির আয়তনের ২০% হিমবাহ, ৪%-এ আছে লেক, ৭০%-এ আছে পাহাড় আর ২% মাত্র জমি যার অর্ধেক চাষের কাজে ব্যবহৃত হয়। এইসব হিমবাহ ও তাদের থেকে উৎপন্ন নদী ও ঝর্ণার প্রাচুর্য আইসল্যান্ডের এক মস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। অন্যদিকে, দেশটিতে রয়েছে বেশ কিছু জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। ফলে, সমস্ত দেশে হাইড্রো-ইলেক্ট্রিক ও জিও-থার্মাল পাওয়ার উৎপাদন করে সস্তায় সকল দেশবাসীকে গরম জল, হীটিং ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। বুঝলাম যে আগ্নেয়গিরির লাভাতে তৈরি বলেই রাস্তার পাশের ধু-ধু জমি অমন কালো রঙের! অবশ্য, কোথাও কোথাও তাতে রয়েছে হলুদ হয়ে যাওয়া ঘাস।

    বাস থেকে কখনো দেখছি দিগন্তবিস্তৃত প্রান্তরের মধ্যে বরফ-মাথায় নিচু পাহাড়, কোথাও বা রয়েছে ছোট-বড় বাড়িঘর। আস্তে-আস্তে সন্ধে নামল। শহরের কাছে আসতেই গাড়ির সংখ্যা বাড়ল ও বাসের গতি কমে গেল। একজায়গায় সার দিয়ে রয়েছে অনেকগুলো কৃশকায় নিষ্পত্র গাছ আর কিছু ঝাউ গাছ। চেনা নামের ফাস্টফুড-এর দোকান দেখে বুঝলাম যে শহরে পৌঁছে গিয়েছি। ততোক্ষণে, রাস্তার পাশে এসেছে প্রচুর বহুতল বাড়ি যার অনেকগুলো মহাজাতিক সংস্থার অফিস ও বড়বড় হোটেল। তবে, পরে দেখেছি যে শহরটিতে আবাসিক অঞ্চলের ঘর-বাড়ি তিনতলার বেশি নেই বললেই চলে। লেখা বাহুল্য, আর যে কোনো ইওরোপীয় শহরের মতো রাস্তাঘাট পরিষ্কার। গাড়ি ছাড়া সাধারণের চলাচলের জন্য শহরে বাস ও ট্যাক্সি চলছে।

    হোটেলের রিসেপশনেই দুঃসংবাদ পেলাম যে খারাপ আবহাওয়ার জন্য সেদিন রাত্রের ‘নর্দার্ন লাইট্‌স্‌’ বা সুমেরুপ্রভা দেখতে যাবার ব্যবস্থাটি বাতিল হয়ে গিয়েছে। এই খবরে একদিকে নিরাশ হ’লাম ঠিকই কিন্তু অন্যদিকে ক্লান্ত শরীর তখন একটু বিশ্রাম পাবে ভেবে যেন একটু স্বস্তিও পেলাম। সুখের কথা এই যে আমরা অন্য একদিন এই বাতিল ট্রিপটি নিতে পারব। আমাদের মোট তিনটি ‘অরোরা শিকারে’ (ওদেশের ভাষায় ‘Aurora hunting’) যাবার ব্যবস্থা করা আছে যার দু’টি হবে ডাঙ্গায় ও একটি সমুদ্রের বুকে। ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে রাত্রে বেরিয়ে বীয়ার সহযোগে কুচোনো বীফ ভাজা ও আলুমরিচ খেয়ে এলাম।

    সেসময় ওদেশে সূর্য ওঠে সকাল সাড়ে আটটায় ও অস্ত যায় ছ’টায়। তাই সমুদ্রে ‘তিমিদর্শন’-এর উদ্দেশ্যে সকাল সোয়া আটটাতে যখন ‘জেটি’র দিকে রওনা হলাম, তখনো আকাশ অন্ধকার। বাইরে টিপটিপে বৃষ্টি পড়ছে ও হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা (৫°C)। একথা জানতাম যে জোরালো হাওয়ার দেশ হিসেবে আইসল্যান্ড-এর স্থান পৃথিবীতে দ্বিতীয় ও সেই হাওয়ার কল্যাণে তাপমাত্রা যা তার থেকে বোধহয় অনেকটা কম। ফলে, প্রচুর পরিমান গরম জামায় আবৃত হয়েও সেই ঠান্ডার কাছে পরাস্ত হ’চ্ছিলাম। যাহোক, প্রথমে লঞ্চ-এর ওয়েটিং এরিয়া আরেকটি লঞ্চ-এ গিয়ে উঠলাম। সেখানে বিশাল এক তিমির কঙ্কাল ওপর থেকে ঝুলছে ও দোকানে বিক্রি হ’চ্ছে নানারকম স্যুভেনির। আমাদের চারপাশে নানাদেশের মানুষের মধ্যে দু’টি ভারতীয় দম্পতিও রয়েছেন। আসল লঞ্চ-এ উঠে ঠান্ডার ভয়ে আমি খোলা ডেক-এ না গিয়ে নিচেই বসলাম।

    ন’টায় যখন লঞ্চ ছাড়ল, সবে দিনের আলো ফুটছে। গাইড আশ্বাস দিলেন যে আজ সমুদ্র যেরকম শান্ত, তাতে তিমি দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশী। তিনি আমাদের সেফটি-টিপস জানালেন, দেখালেন লাইফ জ্যাকেট-এর অবস্থান। জমির থেকে তরতর করে দূরে চলেছি, মাঝেমাঝে সমুদ্রের মধ্যে দ্বীপের মতো বরফ-মাথায় পাহাড় দেখতে পাচ্ছি। অন্যদের দেখাদেখি আমি একবার সাহস করে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা অগ্রাহ্য করে বেশ অনেকক্ষণ ডেক-এ রইলাম। গাইড মহাশয়ের উৎসাহের অন্ত নেই। তিনি সেইসময় আশ্বাস দিচ্ছিলেন যে তিমি ছাড়া ডলফিন ও নানারকম মাছও দেখতে পাওয়া যাবে। কোথায় কী! খানিকপরে সমুদ্রের অনেকটা ভেতরে যখন, বেশ কাছ থেকে সেই বিখ্যাত আগ্নেয়গিরি দেখলাম যার থেকে বেরোনো ছাই-এর কারণে ২০১০ সালে ইওরোপ-সহ পৃথিবীর প্রায় কুড়িটি দেশের বিমান চলাচল বেশ কিছুদিনের জন্য ব্যাহত হয়েছিল। তার কাছাকাছি আরো কয়েকটি আগ্নেয়গিরি রয়েছে। একটু পরে হাওয়া বাড়ল, ঢেউএর ধাক্কায় লঞ্চ দুলতে লাগল ও আমাদের তিমি দেখবার আশা সুদূরে মিলিয়ে গেল। ঐ তিনঘণ্টার লঞ্চ-ভ্রমণে, তিমি দূরে থাক, একটা পুঁটি মাছ অবধি দেখতে পেলাম না!

    আমাদের হোটেলটি বেশ আরামের। সেখানকার ঘরের হীটিং-এর সঙ্গে মেঝে গরম রাখার ব্যবস্থাটি আমার বেশ অভিনব লাগল। আরেকটি স্বস্তির ব্যাপার হ’ল যে ওখানে খাবারজল কিনতে হয় না—নিশ্চিন্তে কলের জল খাওয়া যায়। অন্যদিকে, বাথরুমের গরমজল যেহেতু প্রাকৃতিক গীজার থেকে আসছে, তাই জলে বেশ সালফারের গন্ধ। কন্যার অনুযোগ, ‘স্নান করে বেরিয়ে মনে হচ্ছে গায়ে যেন চাটমশলা লাগিয়েছি’!

    সেদিন রাত্রে আমাদের ‘নর্দার্ন লাইট্‌স্‌’ দেখতে যাবার কথা। সারাদিন আমাদের সবার মনে একটা ‘কী হয়, কী হয়’ ভাব। তার আগে আমাদের ডিনার-এর ব্যবস্থা রয়েছে এক ‘পাব’-এ। বিরাট ‘পাব’টি প্রচুর লোকজনের উপস্থিতিতে সরগরম। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট টেবিলে গিয়ে বসলাম। হাসিখুশী এক অ্যামেরিকান তরুণ আমাদের আপ্যায়নের দায়িত্বে ছিলেন। প্রত্যেকের জন্য একটু বেঁটে কিন্তু ছড়ানো গ্লাস-এ প্রথমে তিনরকম বীয়ার এল যার প্রত্যেকটির সঙ্গে চমৎকার কাচের পাত্রে সুন্দর করে সাজানো তিনরকম খাবার--যেমন চিংড়ি, স্যামন ও mussels। পানীয়ের প্রথম পর্ব শেষ হওয়ার মুখে আমাদের টেবিলের বাকি দুই অতিথি এসে পৌঁছলেন। সেই অ্যামেরিকান প্রৌঢ়া ও তরুণী-জুটি খুব মজা করে আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়লেন। তারপর এলো পরের পর্বের অন্য আরো তিনরকম বীয়ার ও তাদের সঙ্গতকারী খাবার। রূপ-গন্ধ-স্বাদে বীয়ার-এর যে এতো বৈচিত্র্য আছে তা ঐ সন্ধের আগে আমি জানতাম না! খাবারের স্বাদও ছিল অপূর্ব; বিশেষত, রোস্টেড ল্যাম্ব-এর স্বাদ যেন আজও ভুলতে পারি না!


    রেকেভিক-এর ‘পাব’-এ খাদ্য ও পানীয়

    ‘পাব’ থেকেই আমাদের নিয়ে বাস চলল ‘নর্দার্ন লাইট্‌স্‌’ দেখাতে। ঘন্টাখানেক পর শহর থেকে দূরে নিকষ কালো অন্ধকার এক মাঠের মধ্যে গিয়ে থামলাম। কনকনে ঠান্ডায় বাস থেকে নেমে আমরা প্রকৃতির করুণার আশায় আকাশের দিকে চেয়ে রইলাম। আকাশে হালকা মেঘ ছিল। মেঘ সরে তারা ফুটল। আমাদের আশা এবার বুঝি তাকে দেখা যাবে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে আবারও আকাশ মেঘে ঢেকে গেল। এখানেও গাইড অনেকরকম আশার কথা বললেন কিন্তু দূরে, দিগন্তে শহরের আলো ছাড়া আকাশে কোনো আলোর দেখা পেলাম না। ঠান্ডা থেকে বাঁচতে আমি মাঝেমাঝে বাসে উঠে বসছিলাম। কম-উৎসাহী পর্যটক যাঁরা বাসের ওম্ ছাড়তে চান না তাঁদের সঙ্গে বাস-চালক হান্স বেশ সরস ভঙ্গীতে আইসল্যান্ড-এর ভূগোল-ইতিহাস নিয়ে গল্প করছিলেন। জানলাম যে আইসল্যান্ড-বাসীর পূর্বপুরুষ হল নরওয়ের বাসিন্দা ভাইকিংরা। তারা ৮৫২ সালে এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। শুনে মজা লাগল যে নরওয়েতে তাদের ভাষা অন্য ভাষার প্রভাবে অনেক পালটে গিয়েছে কিন্তু আইসল্যান্ড যেহেতু একটি দ্বীপ, তাই তার বিচ্ছিন্নতার জন্য ভাষার সেই পুরনো রূপ এখানে এখনো অবিকৃত আছে।

    যাহোক, ঘন্টাদেড়েক এভাবে আকাশ দেখে ও ঠান্ডার সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। আসলে, ‘অরোরা’-র মতো ‘প্রাকৃতিক বিস্ময়ের’ সৃষ্টির পেছনে এতোগুলো প্রাকৃতিক ঘটনার সমাপতন দরকার যে তার দেখা পেতে একটু ধৈর্য ধরতেই হয়! দু’কথায় বলি এই ‘অরোরা’ বা মেরু-প্রভার উৎসের কথা। এর উৎস হল সূর্য ও তার মধ্যে প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা নানা বিক্রিয়া। বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট আহিত কণারা (charged particles) পৃথিবীতে ছুটে আসে ও তারপর তারা পৃথিবীর দুই চৌম্বকীয় মেরুর দিকে অধিক পরিমাণে আকৃষ্ট হয়। সেই সময়, আহিত কণাদের সঙ্গে পৃথিবীর পরিমণ্ডলে থাকা নানা গ্যাসের অণু ও পরমাণুর সংঘাতে এই অলৌকিক আলোকপ্রভার সৃষ্টি হয়। সাধারণত অক্সিজেনের সঙ্গে সংঘর্ষে তৈরি হয় হলুদ ও সবুজ আলো আর নাইট্রোজেনের সঙ্গে সংঘাতে তৈরি হয় লাল, বেগুনি ও কখনো নীল আলো। স্পষ্টতই, এই পদ্ধতির মূলে আছে যে সৌর-বিক্রিয়া তার কমা-বাড়ার সঙ্গে মেরু-প্রভার ঔজ্জল্য ও আকার নির্ভর করে। সাধারণত, তার যে চওড়া পটি বা ব্যান্ডের মত আকার দেখা যায়, সৌর-বিক্রিয়া বাড়লে তার আকার হয় এক নৃত্যশীল পর্দার মতো যাতে রংবদলের পালা চলতে দেখা যায়! এই অপার্থিব দৃশ্য দেখবার জন্য আদর্শ পরিবেশ হ’ল মেঘমুক্ত আকাশ ও নিকষ কালো অন্ধকার। আজকাল আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো কোনো এক বিশেষ জায়গায় ‘অরোরা’ দেখতে পাওয়ার পূর্বাভাস জানবার ব্যবস্থাও আছে।

    ‘নর্দার্ন লাইটস’ ছাড়াও আইসল্যান্ড-এর প্রসিদ্ধি আগ্নেয়গিরি, হিমবাহ ও গীজারের দেশ ব’লে। আমরা এবার সেই সব দ্রষ্টব্য দেখতে সারাদিনের জন্য বেরোলাম ‘গোল্ডেন সার্কেল ট্যুর’-এ। সকালের তাপমাত্রা ৭°C তাই যথারীতি পাতলা-মোটা মিলিয়ে কয়েক প্রস্থ গরমজামা পরতে হ’ল। প্রথমে যাবো শহর থেকে চল্লিশ কিমি দূরে Thingvellir (উচ্চারণ ‘থিঙ্কভেল্লির’) National Park. বাসে উঠতেই গাইড আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে ‘ট্যাবলেট’ ধরিয়ে দিলেন যার কল্যাণে আমরা ‘ইয়ার ফোন’ লাগিয়ে যখন যেখান দিয়ে বাস যাচ্ছে সেখানকার বিশিষ্টতার বর্ণনা শুনতে পাচ্ছিলাম।

    মস্ত পাহাড় ও পরপর হলুদ আলো-দেওয়া গ্রীন-হাউস পার হয়ে এগোচ্ছি। ডানদিকে এলো ক্যাথলিক চার্চ। পাকদণ্ডী পথে পাহাড়ের ওপরে উঠছি। ওদেশের বেশিরভাগ পাহাড় অগ্ন্যুৎপাতের ফলে তৈরি বলে তাদের কালো গায়ে কোনো গাছপালা নেই। তবে তাদের অধিকাংশের মাথায় রয়েছে বরফ। একতলা বা দোতলা ‘ফার্ম হাউস’ দেখছি যার কোনো কোনোটিতে ঘোড়া চরছে। আইসল্যান্ড-এর এই ঘোড়াগুলো আকারে ছোট আর তাদের ঘাড়ে ও লেজে প্রচুর লোম। সাধারণত ঘোড়ার চাররকম ‘চলন’ থাকলেও এদের নাকি একটি বাড়তি ‘চলন’ আছে। এই কষ্টসহিষ্ণু প্রাণীটি পাহাড়ি পথে সহজে চলতে পারে ও পৃথিবীর নানাদেশে, প্রধানত ঘোড়দৌড়ের জন্য, এদের খুব চাহিদা। আইসল্যান্ড-এ ঘোড়া আমদানী নিষিদ্ধ ও রপ্তানী করা ঘোড়াও দেশে ফেরানো যায়না। ধীরে ধীরে আমাদের পথ এতোটা ওপরে উঠে এসেছে যে বরফ-ঢাকা পাহাড়গুলোর চূড়া আমাদের পাশে এসে যাচ্ছে।

    বিরাট এক লেক-এর পাশ দিয়ে যাচ্ছি যার নাম Thingvallavatn ও সেটি ওদেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক হ্রদ। তার ধারে ধারে রয়েছে তিনটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। ওদেশের ত্রিশটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মধ্যে তিনটিকে একসঙ্গে দেখে ফেললাম ভেবে মজা লাগল। একটু পরেই পৌঁছে গেলাম ন্যাশনাল পার্ক-এ। সেখানে অনেক বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে ও চারদিকে প্রচুর লোকজন।


    রিফ্ট্ ভ্যালি’, থিঙ্কভেল্লির ন্যাশনাল পার্ক
    এই ৯৩ বর্গ কিমি বিস্তৃত ন্যাশনাল পার্কটির প্রসিদ্ধি নানা কারণে। প্রথমে বলি ঐতিহাসিক কারণটি যার জন্য এটি ২০০৪ সাল থেকে UNESCO World Heritage Site হিসেবে স্বীকৃত। নরওয়ে থেকে এসে দেশের বিভিন্নভাগে বসতি গড়ে থাকা অধিবাসীদের নিয়ে এখানে ৯৩০ সালে প্রথম ‘ন্যাশনাল পার্লামেন্ট অফ আইসল্যান্ড’ বা ‘অ্যালথিং’ স্থাপিত হয়। এটি পৃথিবীর সবথেকে পুরনো পার্লামেন্ট। সেখানে প্রতিবছর ২-৩ সপ্তাহ ধরে খোলা আকাশের নিচে যে অধিবেশন হতো তাতে আইন-প্রণয়ন, বিচার ও প্রয়োজনে শাস্তিদানের ব্যবস্থা ছিল। ১২৬২ সাল থেকে আইসল্যান্ড প্রথমে নরওয়ে ও তারপর ইওরোপের এক বা একাধিক দেশের শাসনাধীন থাকলেও ১৭৯৮ সাল অবধি পার্লামেন্ট-এর অধিবেশন হ’তো এই একই জায়গায়। পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার ১০০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৩০ সালে এই ন্যাশনাল পার্ক এর স্থাপনা হয়। এই জায়গাতেই ১০০০ খ্রীষ্টাব্দে লৌকিক ধর্মের পরিবর্তে আইসল্যান্ড-এ খ্রীষ্টধর্মকে সরকারী ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সর্বোপরি, এখানেই ১৯৪৪ সালের ১৭ই জুন ডেনমার্কের শাসন থেকে আইসল্যান্ড-এর স্বাধীনতা প্রাপ্তির ঘোষণা হয়।


    থিঙ্কভেল্লির ন্যাশনাল পার্ক-এর পথ
    এবার বলি পার্কটির ভৌগোলিক অবস্থানের বৈশিষ্ট্যের কথা। অ্যাটল্যান্টিক মহাসাগরের নিচে নিমজ্জিত ‘মিড-অ্যাটল্যান্টিক রিজ়’ হ’ল উত্তর অ্যামেরিকা ও ইউরেশিয়ান টেক্টনিক প্লেট-এর সংযোগস্থলে অবস্থিত পৃথিবীর উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রসারিত এক পর্বতমালা। আইসল্যান্ডে এই মিড অ্যাটল্যান্টিক রিজ় জলের থেকে মাথা তুলেছে ও তার ফলে এই দেশের পূর্ব ও পশ্চিম ভাগ রয়েছে দু’টি ভিন্ন ‘কন্টিনেন্টাল প্লেট’-এ। ‘মিড-অ্যাটল্যান্টিক রিজ়’-এর উপরিতলে থাকা ‘রিফট ভ্যালি’তে রয়েছে এই ন্যাশনাল পার্কটি যার ফলে দু’টি টেক্টনিক প্লেট এখানে দেখা যায়। এই প্লেট দু’টি বছরে ২ সেমি করে পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলে আইসল্যান্ডে নিয়মিত ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত হয়। এই সব ভূতাত্ত্বিক অস্থিরতায় তৈরি হয়েছে এই পার্কের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া দীর্ঘ ফাটলগুলি (cracks or faults)। বাস থেকে যেখানে নামলাম সেটি উত্তর অ্যামেরিকা টেক্টনিক প্লেট-এর ওপরে অবস্থিত। মেঘলা দিন, চারদিকের দৃশ্য অপরূপ, পাথুরে জমিতে জল জমে আছে, অনেকদূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে কিন্তু ঠান্ডা হাওয়ার দাপটে দু’দণ্ড দাঁড়ানো কষ্টকর! কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি ঢালু পথ ধরে নামতে লাগলাম ‘রিফট ভ্যালি’র দিকে। সেখানে, প্রথমে সরু এক গিরিকন্দর বা ‘Gorge’-এর মধ্যে দিয়ে কিছুটা চললাম। তার দু’পাশে দাঁড়ানো খাড়া লাভা-জমা পাথরের দেওয়াল আসলে উত্তর অ্যামেরিকা টেক্টনিক প্লেট-এর অমনি এক fault. অর্থাৎ, আমরা উত্তর অ্যামেরিকার টেক্টনিক প্লেট-এর সবথেকে পূর্ব দিকের ধার দেখতে পাচ্ছি। সেই পাথরের দেওয়ালের গায়ে ‘আইস্ল্যান্ডিক মস’ হয়ে রয়েছে। তারপর, পথটি প্রশস্ত হ’ল ও ডানদিকের পাথরের দেওয়ালটি অদৃশ্য হওয়ায় দেখতে পেলাম আমাদের ডানদিকে থাকা বিস্তীর্ণ ‘রিফট ভ্যালি’-টি। এই ‘রিফট ভ্যালি’-র অন্য প্রান্তে রয়েছে ‘ইউরেশিয়ান টেক্টনিক প্লেট’। ‘ভ্যালি’-তে প্রথমেই চোখে পড়ল একটি সাদা রঙের মামুলি চার্চ ও তার সঙ্গে এক ফার্ম হাউস। এছাড়া সেখানে রয়েছে অমনি দু’চারটে সাধারণ বাড়ি ও কয়েকটি ঝাউ গাছ। কালো পাথুরে জমির ওপর দিয়ে এক সরু নদী এঁকে-বেঁকে বয়ে চলেছে আর মাঝে মাঝে পাথরের ওপর রয়েছে জমা জল। দূরে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট পাহাড়। আরেকটু এগোতে দেখলাম যে আমাদের রাস্তা থেকে ডানদিকে এক সরু পথ বেরিয়ে গিয়েছে। সেই পথ ধরে একটু গিয়েই নদীর ওপর ছোট ব্রিজ। সেটি পার হয়ে গিয়ে ‘রিফট ভ্যালি’-তে পা দিলাম। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি!

    থিঙ্কভেল্লির ন্যাশনাল পার্ক-এ ‘ফাটল’ ও ‘রিফ্ট্ ভ্যালি’

    ফিরে এসে পুরনো রাস্তায় আরেকটু এগিয়ে পেলাম এক ঝর্ণা। ওপর থেকে গমগম করে আওয়াজ তুলে কয়েকটি ধারায় জল এসে পড়ে পথের পাশে একটি জলাশয় তৈরী হয়েছে। বুঝতে পারলাম যে একটু আগে দেখা নদীটির উৎস এই জলাশয়টি। জলাশয়ের পাশে এক বোর্ডে লেখা তার নাম ‘ড্রাউনিং পুল’ যেখানে মধ্যযুগের মহিলাদের ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে ডুবিয়ে মারা হ’তো! শুধু কি তাই! ১৮০০ সাল অবধিও দেশে অপরাধের শাস্তি বলতে ছিল শিরশ্ছেদ, ফাঁসি, বেত্রাঘাত বা অঙ্গচ্ছেদ।


    থিঙ্কভেল্লির ন্যাশনাল পার্ক-এর ঝর্ণা ও নদী

    আকাশ মেঘলা তাই ভর দুপুরেও ঝিমনো আলোয় ধুধু প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে আবারও বাস চলল। পাশে আসছে বরফ-মাথায় পাহাড়। রাস্তার পাশেও ছোট ছোট বরফের স্তূপ। এবার বাঁদিকে এক পাহাড় এলো যাতে বেশ কয়েকটি গুহা রয়েছে এবং জানলাম যে দারিদ্র্যের কারণে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত এখানে মানুষজন বাস করতো। বাঁদিকে সার দিয়ে পাহাড় চলেছে আর ডানদিকে এলো লগারভাটন লেক। এই অগভীর লেকটির তলদেশে উষ্ণ প্রস্রবণ থাকায় সারা বছর এখানে স্নান করা যায়। সেই কারণে, আগে এখানে ‘ব্যাপ্টিজম’-এর জন্য লোকেরা আসতো। লেকের পাশে যে গ্রাম আছে তাতে শ’তিনেক লোকের বাস। ওদেশের মানুষের কাছে হাইকিং, ট্রেকিং, মাছ ধরা ইত্যাদির জন্য এই জায়গাটি খুব জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। সাধারণভাবে, জলে-ডাঙ্গায়-পাহাড়ে-পর্বতে নানারকম খেলাধূলায় এই দেশটি মহা উৎসাহী। এই ছোট দেশের ২০১৮ তে FIFA World Cup-এর যোগদানের কথা আমাদের অনেকেরই মনে আছে। অনেক খেতে ঘাসের গাঁঠরি রাখা আছে যা শীতকালে গৃহপালিত পশুর খাদ্য। খানিক পরে আকাশে খানিকটা জায়গা একটু পরিষ্কার হয়ে সোনালি রঙ ধরল কিন্তু সূর্যের দেখা নেই। মনে মনে ভাবছি রাত্রে যেন মেঘ কেটে যায়!

    যাহোক, এরপর এক অঞ্চল এলো যেখানে শুয়োর, মুর্গী, ছাগল ও গরু প্রতিপালন করা হয়। ওদেশে উপনিবেশের শুরু থেকেই ভেড়া প্রতিপালন করা হয় এবং এই প্রাণীটি দেশবাসীর কাছে এতো মূল্যবান যে তাদের ভাষায় নাকি ‘ভেড়া’ ও ‘অর্থ’ একই শব্দে বোঝানো হয়। সাধারণ ভাবে দুগ্ধজাত দ্রব্য এদেশে এক গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। আইসল্যান্ডের মাখন বিশেষ প্রসিদ্ধ ও স্কির (Skyr) নামে প্রায় দই-এর মতো ঘন একরকম নরম চীজ খুব জনপ্রিয়।

    বন্যজন্তুর মধ্যে আইসল্যান্ডে ‘আর্কটিক ফক্স’ ছাড়া আছে ‘রেইন ডিয়ার’। তাদের সংখ্যা-বৃদ্ধি হ’লে নিয়ম করে শিকার করা হয়। এক সময় যে ‘মিঙ্ক ফার্মিং’-এর এখানে রমরমা ছিল তা এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শীতকাল বলে এক শালিকের মতো পাখি ছাড়া ওখানে আর কোনো পাখি দেখতে পাইনি।


    স্ট্রোক্‌কুর গীজার-এর চারধারে জমায়েত দর্শকবৃন্দ
    অবশেষে সূর্যের দেখা পেলাম। তিনি বেশ নিচে থাকলেও বাসের জানলা দিয়ে রোদ গায়ে এসে পড়তে তাঁর তেজ টের পাচ্ছিলাম। বাইরের তাপমাত্রা অবশ্য তখনো ৮° সেন্টিগ্রেড! আবারও সেই ধুধু প্রান্তরে চলে আমরা আইসল্যান্ডের বিখ্যাত স্ট্রোক্‌কুর (Stokkur) গীজার দেখতে নামলাম। আগ্নেয়গিরি-বহুল এই জায়গাটিতে বেশ কয়েকটি গীর্জা আছে। এখানেও অনেক পর্যটকের ভীড়। চারপাশে পাহাড়ের মাঝে বিরাট এক পাথুরে উপত্যকা যাতে অল্পস্বল্প ঘাস আছে আর আছে কিছু ঝাউ গাছ। তার মধ্যে বিরাট এক চত্বর ছোটছোট লাঠিতে দড়ি বেঁধে ঘিরে রাখা রয়েছে। চত্বরের পাশের পাথরে বাঁধানো রাস্তা ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে এক জায়গায় এসে অন্যান্যদের সঙ্গে আমরাও সেই সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে গেলাম। ঘেরা জায়গার মাঝখানে অনেকটা জমা জল যার উপরিতলে সামান্য একটা আলোড়ন চলছে ও বগবগ আওয়াজ হচ্ছে। হঠাৎ, সেই ছোট জলাশয় থেকে তীব্র গতিতে মাটির তলার ফুটন্ত জল বিশাল উঁচু (১৫-২০ মিটার) এক স্তম্ভের আকারে উৎক্ষিপ্ত হ’ল। উপস্থিত সকলে হৈ হৈ ক’রে উঠল। পরের ৫-৭ মিনিট জলের উপরিতলের আলোড়ন চলল আর তারপরই হঠাৎ আবার সেই একইভাবে জলস্তম্ভের আবির্ভাব। আবার প্রায় একই সময়ের বিরতি ও তারপরই সেই জলোচ্ছ্বাস। এই কখন হয়--কখন হয় ভাবনা নিয়ে অপেক্ষা করে ঐ দৃশ্য দেখতে আমার অদ্ভুত মজা লাগছিল আর ব্যাপারটা যে এতোটা নাটকীয় তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ঘেরা প্রান্তরের মধ্যে গীজার-এর আশেপাশে ইতস্তত জমা জল ছাড়াও সেই উৎক্ষিপ্ত গরম জল সরু ধারায় বয়ে যাচ্ছে। গীর্জার থেকে খানিক দূরে বয়ে-যাওয়া জলে হাত দিয়ে ভারী আনন্দ হ’ল। নানাসময় সমুদ্র-নদী-ঝর্ণার জল ছুঁয়েছি কিন্তু এই জলের মতো এমন উৎস তো আগে দেখিনি।

    স্ট্রোক্‌কুর গীজার-এর জলস্তম্ভ

    স্ট্রোক্‌কুর-এর খুব কাছাকাছি রয়েছে গীজির (Geysir)। ইওরোপীয়দের জানা এটি ছিল প্রথম গীজার ও ১২৯৪ সালে লিখিত বিবরণে এই গীজির-এর কথা আছে। এই নাম থেকেই সামান্য পরিবর্তিত হয়ে ‘পর্যায়ক্রমে উৎক্ষিপ্ত উষ্ণ প্রস্রবণ’ বলতে ইংরিজিতে গীজার শব্দটি এসেছে। গীজির থেকে এখন আর জল বেরোয় না বললেও চলে কিন্তু সেখানেও অনেকটা জল জমে রয়েছে। তার ওপরটা বেশ ধোঁয়ায় ভরা ও হাওয়া দিতেই সালফার-এর গন্ধ নাকে এল।


    গুলফস্‌ জলপ্রপাত
    পরের গন্তব্য আইসল্যান্ডে আসা পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় গুল্‌ফস্‌ (Gulfoss) নামে এক জলপ্রপাত। বিরাট এক গ্লেসিয়ারের পাশ দিয়ে বাস চলল। কয়েক মিনিটেই গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। গুল্‌ফস্‌-কে বর্ণনা করা যায় একই জায়গায় থাকা দু’টি জলপ্রপাত হিসেবে। গ্লেসিয়ারের বরফ-গলা জলে সৃষ্ট এক নদী তার বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে প্রবল বেগে এসে পাহাড়ের গায়ে সমকোণে থাকা দু’টি খাড়া ধাপে (১১ ও ২১ মিটার) লাফিয়ে নেমে নিচের এক গিরি-কন্দরে ঝাঁপ দিচ্ছে। সে যে কী ভয়ঙ্কর-সুন্দর দৃশ্য! সুর্য সেসময় লুকোচুরি খেলছিল বটে কিন্তু আমাদের ভাগ্য ভাল যে তার আলো জলপ্রপাতের ওপর বাতাসে ভেসে থাকা জলকণিকায় পড়ে সুন্দর এক রামধনু তৈরী করেছিল। ভীষণ-দর্শন এই জলপ্রপাতটিকে তো নীচ থেকে দেখবার উপায় নেই কিন্তু ওপরে ভিন্ন তল থেকে দেখবার জন্য ব্যবস্থা করা রয়েছে। পাহাড়ের গা বেয়ে পীচ-ঢালা রাস্তা ধরে অনেকটা হেঁটে প্রথমে ওপরের তলে গেলাম যেখান থেকে নদী প্রথম ধাপ নামছে ও তারপর নিচে নেমে দেখলাম মাঝের ধাপ বরাবর। সেখানে সুন্দর কাঠের প্লাটফর্ম করা যাতে অনেক পর্যটক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে সেই জলপ্রপাতের রূপ দেখছে ও তার জলদগম্ভীর গান শুনছে। আমিও তাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে এই অপরূপ দৃশ্য দেখলাম।

    গুলফস্‌ জলপ্রপাতের ওপর রামধনু। দূরে হিমবাহ।

    রেকেভিক-এ ফেরার পথে ছোটখাটো আরো কয়েকটি গীজ়ার দেখতে পেলাম ও বেশ কিছু জায়গায় মাটি থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখলাম। আরেকটু এগোতেই এলো গত ৪০০০ বছর ধরে সুপ্ত এক আগ্নেয়গিরি। সেটি হ’ল পৃথিবীর একমাত্র আগ্নেয়গিরি যেখানে খোলা লিফট-এ দর্শকরা মাটির তলার ‘ম্যাগমা চেম্বার’ দেখতে যেতে পারেন এবং তাই তার কাছে অনেক পর্যটক রয়েছেন। আগ্নেয়গিরিটির কাছে প্রচুর ঝাউ জাতীয় গাছ লাগানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলি যে আইসল্যান্ড-এ এসে ঔপনিবেশিকরা নির্বিচারে সব গাছপালা কেটে ফেলে কিন্তু লাভায় ভরা পাথুরে জমিতে গাছ তো সহজে হয়না। ইদানীং, উষ্ণায়নের ফলে হিমবাহ গলে যাওয়া ইত্যাদি যেসব বিপত্তি দেখা দিচ্ছে তাদের সামাল দিতে সারা দেশে গাছ লাগানোর এক বিরাট উদ্যোগ চলেছে। আসা-যাওয়ার পথে যে নার্সারি দেখেছি সেখানে নানারকম চারাগাছ পালন করে উপযুক্ত জমিতে লাগানো হয়। যাহোক, বরফ-মাথায় পাহাড়, নদী, ঝর্ণা ইত্যাদি দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে রেকেভিক-এ ফিরলাম।

    সেই রাত্রে ছিল আমাদের লঞ্চ-এ ক’রে সমুদ্র থেকে ‘অরোরা শিকারে’ যাবার পালা। পূর্বাভাস অনুযায়ী সেদিন অরোরা দেখতে পাবার সম্ভাবনা যেহেতু খুব বেশী, আমাদের ধারণা ছিল কম-বেশি যাহোক ‘অরোরা’ অবশ্যই দেখতে পাব। সহযাত্রীদের মধ্যে এক ভারতীয় পরিবার বললেন তাঁরা নাকি তিনদিন আগে শহর থেকে পরিষ্কার ‘অরোরা’ দেখেছেন। এহেন ভাগ্যবানদের দেখেও শান্তি! যাহোক, অনেক আশা নিয়ে ডেক-এর ওপর উঠেছি, আকাশের এদিক থেকে ওদিকে চেয়ে থেকেছি কিন্তু তারপর প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়ার দাপট আর যখন সহ্য করতে পারিনি, নেমে এসেছি। সমুদ্রের ওপরের সে হাওয়ার এমন তেজ যে মনে হ’চ্ছিল তার ধাক্কায় পড়ে যাবো। এমন কয়েকবার ওঠা-নামা করাই সার হ’ল — সেদিনের অভিযানেও মেরুপ্রভা অধরা রয়ে গেল।

    শেষের দিনটির সকালে আমরা একটু আরাম করে প্রাতরাশ করলাম। হোটেলের চমৎকার ‘কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্ট’-এ একেকদিন একেকরকম pickled fish ও টাটকা ছানা এই পদ দু’টি আমার বেশ অভিনব লাগে। সেদিন ডাইনিং হল-এর মেঝে মুছছিল যে তরুণীটি তাকে দেখে আমি ভারতীয় ভেবেছিলাম। আলাপ করে জানলাম যে ঐ মিষ্টি মেয়ে ‘দিল্কি’ তার বাবা ও দিদির সঙ্গে শ্রীলঙ্কা থেকে এসে ওদেশে ‘রাজনৈতিক আশ্রয়’ নিয়েছে।

    সেদিন আমরা যখন পায়ে হেঁটে শহর দেখতে বেরোলাম, ঊষাদেবী সদ্য আবির্ভূতা হয়েছেন। অল্প দূরেই ‘রেকেভিক চার্চ’ কিন্তু চড়াই পথে সেখানে যেতে বেশ গরম লাগতে লাগল। প্রথমে চোখে পড়ল মস্ত এক পাথরের বাহারী বেদীর ওপর লাইফ এরিক্‌সন (৯৭০-১০২০)-এর দৃপ্ত ভঙ্গীমায় দাঁড়ানো বিশাল মূর্তি। আইসল্যান্ড-বাসী এই নরওয়ের মানুষটি ছিলেন প্রথম ইওরোপীয় যিনি ৯৯৯ সালে, অর্থাৎ কলাম্বাসের ৫০০ বছর আগে, সঙ্গীসাথী-সহ উত্তর অ্যামেরিকায় পদার্পণ করেন। তাঁর স্থাপিত সেই উপনিবেশটির নাম ছিল ‘ভিনল্যান্ড’ ও সেটি বর্তমান ক্যানাডার অন্তর্গত। নানাকারণে বছর দশেকের বেশী সেই উপনিবেশ সেখানে স্থায়ী হয়নি। ১৯৩০ সালে আইসল্যান্ডের পার্লামেন্ট-এর হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এই মূর্তিটি ছিল আইসল্যান্ডবাসীকে দেওয়া অ্যামেরিকার উপহার।


    হলগ্রিমুর চার্চ, রেকেভিক
    এরই ঠিক পেছনে রয়েছে ১৯৮৬ সালে তৈরি দেশের সবথেকে উঁচু চার্চ (৭৪.৫ মিটার) যার সম্মুখ ভাগের গঠন শৈলী একটি ঢেউকে মনে পড়ায়। শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ও আর সব বাড়ির থেকে উঁচু এই চার্চ-টিকে নানা জায়গা থেকে দেখতে পাওয়া যায়। চার্চ-এর অভ্যন্তর মাপে বিশাল হলেও সাজসজ্জায় খুব সাধারণ। সেখানে রয়েছে কাঠের পালপিট, বিশাল পাইপ অর্গ্যান ও বেশ ছোট মাপের ‘স্টেইন্ড গ্লাসে’ মাদার মেরীর ছবি। চার্চের ভেতরে অনেক লোক থাকলেও সকলে আশ্চর্য রকম নিঃশব্দ। আমরা লিফট-এ করে চার্চ-এর সবচেয়ে ওপর তলায় উঠে চারদিকের চারটি জানলা থেকে রেকেভিক শহর এর সুন্দর ‘প্যানোরামিক ভিউ’ পেলাম। সুবিন্যস্ত সোজা সোজা রাস্তার ধারে দোতলা বা তিনতলা বাড়ির সারি যাদের বেশির ভাগের রঙ্গীন ছাদ, আবার কারো বা দেওয়ালে উজ্জ্বল রঙ। আরো দূরে দেখা যাচ্ছিল সমুদ্র ও ছোট ছোট পাহাড়। দৃশ্যগুলি এতো সুন্দর যে মনে হ’চ্ছিল যেন জানলার ফ্রেমে আঁটা একেকটি ছবি!

    সকাল থেকে মেঘলা আকাশ দেখে মনের মধ্যে বারবার উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল যে কথাটি তা হ’ল সেদিন রাতে আমাদের ‘নর্দার্ন লাইটস্‌’ দেখার শেষ সুযোগ। ছবিতে দেখা প্রকৃতির সেই অবিশ্বাস্য সুন্দর রূপটি নিজের চোখে দেখতে পাবো কি না কে জানে! যাহোক, চার্চের কাছেই পেলাম sculpture garden যা মাপে ছোট কিন্তু সেখানে বেশ কিছু সুন্দর ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য রয়েছে। তাদের স্রষ্টা আইনার জন্সন (১৮৭৪-১৯৫৪) ছিলেন ওদেশের প্রথম ভাস্কর।

    তারপর সুন্দর এক লেক ও তার পাশের পার্ক পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ন্যাশনাল ‘ম্যুজিয়াম অফ আইসল্যান্ড’-এ। ততক্ষণে, সূর্যদেব দর্শন দিয়েছেন ও আকাশ হয়েছে মেঘমুক্ত। এই ম্যুজিয়াম-টিতে নরওয়ে থেকে আইসল্যান্ডে আসা মানুষদের যে জীবনযাত্রার বিবর্তনের ইতিহাস প্রদর্শিত রয়েছে তা অনেকটা সময় দিয়ে দেখলাম।

    শহরের Flea Market-এর প্রশংসা শুনেছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম নিত্যদিনের নানা প্রয়োজনীয় পসরা নিয়ে রয়েছে দোকানের সারি। কন্যার উৎসাহে আমিও কয়েকটি দোকানের গয়না, উলের পোষাক, নানারকম ব্যাগ, খাদ্য-সামগ্রী ইত্যাদি দেখলাম। ঐ ক’দিনে স্থানীয়দের দেখাদেখি আমরাও চানাচুরের মতো শুধু শুধু hardfiskur বা শুঁটকিমাছ খেতে শিখেছিলাম। তাই, স্যুভেনির হিসেবে দু’ধরনের শুঁটকি মাছ কিনলাম আর কিনলাম Licorice Chocolate. মাছ-বিক্রেতা ভদ্রলোক বেশ গম্ভীর কিন্তু তা পুষিয়ে দিলেন হাসিখুশী সুন্দরী Chocolate-বিক্রেতা মহিলা। গল্প করতে করতে তিনি বুদ্ধি দিলেন মাখন লাগিয়ে শুঁটকি মাছ খেতে। পরে খেয়ে দেখেছি যে ব্যাপারটা সত্যি অতি সুস্বাদু হয়।

    ‘অরোরা’ নিয়ে আমাদের সারাদিনের উদ্বেগ তো ছিলই। তাই, বিকেল থেকে এই বুঝি ট্রিপ বাতিলের খবর এলো ভেবে বারবার ফোন-এর পর্দায় চোখ রাখছিলাম। যাহোক, রাত সাড়ে আটটায় বাস এসে আমাদের শহরের বাইরে নিয়ে চলল ‘অরোরা’ দেখাতে। আমাদের সাথী সেবার খুব প্রাণোচ্ছল এক গাইড ও তরুণী বাস-চালক মণিকা। গাইডের সঙ্গে তার আলাপচারিতায় শুনতে পেলাম যে তিন বছর অন্য কম্পানিতে চাকরি করে আসা মণিকার সেদিন এই কম্পানিতে দ্বিতীয় রাত। যথারীতি, কৃত্রিম আলোর প্রভাব ছাড়িয়ে শহরের বাইরে অনেক দূরে যেতে প্রায় ঘন্টাখানেক চলা। বাস থেকে নেমে দেখলাম আবারও কোনো এক বিশাল প্রান্তরে এসেছি। সেখানে ৭-৮° সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ও হাড় হিম-করা জোরালো ঠান্ডা হাওয়ায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকাও কঠিন ব’লে বোধ হ’চ্ছে! গাইডের সহায়তায় অল্পক্ষণের মধ্যে উত্তর আকাশে ফিকে সবুজ চওড়া যে এক আলো দেখতে পেলাম সেটি যেন আকাশের গায়ে বয়ে যাওয়া এক আলোর নদী। বুঝলাম এই হ’ল সেই মেরুপ্রভা মূলত যার আকর্ষণে এই দূরদেশে আসা! খানিক বাদে তার একধারের খানিক অংশ বেঁকে নিচের দিকে গিয়ে ইংরিজি এস-এর মতো হ’ল। মেরুপ্রভার ঔজ্জল্য সেদিন খুব যে বেশি তা নয় আর তার মধ্যেও তার কমা-বাড়া ছিল। কিন্তু অধরা যে অবশেষে ধরা দিয়েছে তাতেই আমরা খুব খুশী–-খুশী আমাদের গাইড মহাশয়, খুশী মণিকাও! সেখানে অনেক বাস, প্রচুর লোকজন কিন্তু কোনো হৈচৈ নেই। সকলে বিভোর হয়ে প্রকৃতির সেই মোহিনী রূপ দেখছে। চারপাশে নানারকম ক্যামেরায় আকাশের ছবি উঠছে। আমার সেই দায় নেই। আমি শুধু আশ মিটিয়ে আকাশের গায়ের সেই আলোক ধারাকে দেখছি, দেখছি তার রূপ-বদল। এমন সময় অন্ধকারের এক কোণ থেকে স্পষ্ট বাংলায় এক পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো, ‘এই গাধার বাচ্চা, ওদিকে না — এদিকে তাকা’!

    বাসের ভেতরটা যেহেতু গরম, তাই আমরা মাঝেমাঝে বাসে উঠে গা গরম করে আবার নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছিলাম। এই ওঠানামা সবই অন্ধকারে যাতে আমাদের দেখবার ক্ষমতা হ্রাস না পায়। ঘন্টাখানেক এই দৃশ্য দেখবার পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হ’ল আরেকটি জায়গায়।


    ‘অরোরা’ ও সপ্তর্ষিমণ্ডল-সহ অন্যান্য নক্ষত্র
    এই দ্বিতীয় জায়গায় গাইড প্রথমে নেমে কয়েক মিনিট আকাশ দেখে নিয়ে আমাদের নামতে বললেন। একটু পরে, অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতেই, উনি আমাদের ছায়াপথ ও মাথার ওপরে থাকা ধ্রুবতারা দেখালেন। তারপর, আকাশে ধূসর থেকে হালকা সবুজ রঙের চওড়া মেরুপ্রভা দেখতে পেলাম। বাতাস বইলে শস্য খেতে যেমন ঢেউ খেলে যায়, সেই আলোক ধারার ওপর দিয়ে হঠাৎ এক লীলায়িত তরঙ্গ আকাশের একধার থেকে আরেক ধারে চলে গেল। একটু পরে, আগেরবার যেমন দেখেছিলাম তেমনি, তার বাঁকা ধনুকের মতো আকার হ’ল। এক সময় দিগন্তের কাছাকাছি একই জায়গা থেকে ভিন্ন ব্যাপ্তির কয়েকটি সবুজ আলোকধারা আকাশের অনেকটা ছেয়ে ফেলল। সেই আলোর গায়ে ও আশপাশে সপ্তর্ষি মণ্ডল-সহ বেশ কিছু তারা জ্বলজ্বল করছিল। তারপর, অল্প সময়ের জন্য, সেই সবুজের কোলে এক জায়গায় আমি খানিকটা লাল রঙ দেখতে পেলাম যা সত্যি না কল্পনা তখন তা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। পরে, আমার স্বামীর তোলা ছবিতে সবুজ আলোক ধারার বুকে পরিষ্কার সেই লাল ছোপ দেখে বুঝেছিলাম যে সে রঙ আমার কল্পনাজাত ছিলনা। এই জায়গায় সমবেত দর্শকরা নানারকম আওয়াজ করে বেশ উত্তেজনা প্রকাশ করছিলেন। ঠান্ডায় কাঁপতে থাকা কন্যাকে জড়িয়ে ধরে আমি রীতিমতো মোহাবিষ্টের মতো প্রকৃতির সেই আলোর খেলা দেখছিলাম ও রোমাঞ্চিত হ’চ্ছিলাম। সেখানে মাত্র পনেরো মিনিট থাকবার পরে গাইড মহাশয়ের ডাকে আমরা ফিরে চললাম। ঘোর অমাবস্যার গভীর রাতে জনমানবহীন পথ। আমার চিন্তায় তখন শুধু সদ্য দেখা অবিশ্বাস্য সেই আলোক ধারার আসা-যাওয়া। ঐ মহাজাগতিক আনন্দসন্ধ্যার অংশীদার করে নেবার জন্য একসময় আমি নীরবে প্রকৃতিকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। শহরের আলো তখন আর বেশি দূরে নেই।



    অলংকরণ (Artwork) : ছবি : পূষণ আইয়ুব
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)