পাখি দেখার একটা মজার ব্যাপার, যেকোনো নতুন জায়গায় গেলে সেখানকার সাধারণ, ঘরোয়া পাখিগুলোকেও (যাকে অনেকেই trash bird বলেন) ‘অ-সাধারণ’ বলে মনে হয়। যখনি কোন নতুন দেশে যাই আমি ওই পাখিগুলি দেখার জন্য উৎসুক হয়ে থাকি। কিন্তু ২০০৭-এ ইন্দোনেশিয়া বেড়াতে গিয়ে আমায় নিরাশ হতে হল। তার এক যুগ পরে কি অবস্থা তা আমার জানা নেই!
ইন্দোনেশিয়া একটা বিরাট দেশ, ১৮,০০০-এরও বেশি দ্বীপ ও হাজার হাজার মাইলের তীরভূমি বিষুবরেখার দুইদিকে ছড়িয়ে। এখানে আছে বিরাট রেন ফরেস্ট—আমাজন-এর পরেই যার নাম। দেশটাকে পূর্ব ও পশ্চিমে দুভাগ করেছে বিখ্যাত ‘ওয়ালেস লাইন’ যার পুবদিকে এশিয়ার পশুপাখি ও গাছপালা আর পশ্চিমদিকে অস্ট্রেলিয়ার।
আমার ট্রিপটা ডাক্তারি কনফারেন্স, পাখি দেখার ট্রিপ নয়। তবুও মিটিং, শপিং ইত্যাদির ফাঁকে আমি সর্বক্ষণ পাখি খুঁজি। আমার ব্যাগে সবসময় বাইনকুলার ও ইন্দোনেশিয়ার ৮০০ জাতির পাখির গাইড বই মজুত। আশা ৮০০-র মধ্যে অন্তত কয়েকটাও যদি দেখি।
আমাদের প্রথম দ্বীপ জাভা। যোগ্যাকারতা শহর ও একটু দূরে বোরাবুদুর বৌদ্ধ স্তূপটি দেখলাম। কিন্তু কোথাও পাখির নামগন্ধও নেই। শহরের পার্কে, বাগানে, শহরতলীর মাঠেঘাটে কোথাও একটা পাখিও নেই। সকালবেলা বাগানে পাখির ডাক শোনা যায় না। সুন্দর সবুজ বাগান, প্রজাপতি ও অন্যান্য পোকামাকড়ে ভর্তি, রাস্তার ধারে আবর্জনার ঢিপি, শুধু পাখিই নেই। কখনোসখনো দুএকটা সোয়ালো জাতীয় পাখি দেখা যায়, ব্যাস। কাক, চিল, চড়ুই, ময়না, বুলবুল, পায়রা নৈব নৈব চ।
শহরের বাইরেও একই অবস্থা। মাইলের পর মাইল টেলিগ্রাফের তারে কেউ লেজ ঝুলিয়ে বসে নেই। সজল সবুজ ধানক্ষেত, ডোবা, পুকুরেও কোন বক, মাছরাঙা বা পানকৌড়ি নেই। সবথেকে অদ্ভুত সমুদ্রের তীরে এতো মেছুয়া বাজার, গ্রাম—একটাও সী গাল চোখে পড়ল না।
আমি সঙ্গী গাইড ও স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞাসা করলাম কিন্তু কেউই এ'নিয়ে মাথা ঘামায় বলে মনে হল না। চিড়িয়াখানা, রেন ফরেস্ট ও সংরক্ষিত পার্কে ওরাংউটাং বা কোমোডো ড্রাগনের মতই পাখিরাও আছে জেনে তাঁরা সন্তুষ্ট। এর থেকে বেশি তাঁরা আশাও করেন না। যখন আমি আমার বাড়ির বাগানের পাখির কথা বলি তাঁরা ভদ্রভাবে একটু হাসেন, আমার একটি কথাও বিশ্বাস না করে।
ছবির মত সুন্দর দ্বীপ বালি—পাখির অবস্থা জাভার থেকে একটু ভালো। উবুদ শহরে বালি বার্ডিং ক্লাব আছে। কিন্তু কারো দেখা পেলাম না। পার্কে বাগানে কয়েকটা পাখি দেখলাম—spotted dove, Eurasian tree sparrow, black headed bulbul. হোটেলের বাগানে একটা olive backed sunbird-ও চোখে পড়লো। শহরের বাইরে দুএকটা শাদা বক আর উলুওয়াতু পাহাড়ের ওপর বেশ কয়েকটা ফ্রিগেট পাখি দেখলাম। নুসা দুয়া-র বিখ্যাত বীচে আমার মন ভরে গেল একজোড়া ব্ল্যাক-নেপড টার্ন দেখতে পেয়ে। অবশ্যই জাভার মতো সোয়ালো আর সুইফট সব জায়গায় আছে—অন্য পাখিদের শূন্যস্থান ভরাবার জন্য।
এরপর আমরা চললাম আসল রেন ফরেস্ট বোর্নিও (সম্প্রতি নাম বদলেছে কালিমানটান)। আমার খুব আশা এবার চুটিয়ে পাখি দেখবো। সে গুড়েও বালি। ঘন জঙ্গলের মধ্যে পাখি শোনা যায় কিন্তু দেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। দক্ষিণ বোর্নিওর বিখ্যাত ন্যাশনাল পার্ক তানজুন পুতিন-এ আমরা প্রচুর ওরাংউটাং, বাঁদর, বুনো শুয়োর ও জলে কুমীর দেখলাম কিন্তু পাখিরা অত সহজে দর্শন দেন না। শুধু নদীর পাড়ে খোলা জায়গায় দেখতে পেলাম হিল-ময়না, ডলার-বার্ড ধনেশ পাখি, মাছরাঙা, কুক্যাল, ব্রাহ্মিণী চিল, সাদা-পেট কাঠঠোকরা ইত্যাদি।
আমাদের শেষ গন্তব্য দ্বীপ কোমোডো। বিখ্যাত কোমোডো ড্রাগনের বাসস্থান। এদিকে বেশি টুরিস্ট আসেন না। এই দ্বীপটা শুকনো পাথুরে আর জঙ্গলও শুকনো। ডাঙায় অবশ্যই ড্রাগন ও তাদের খাবার—হরিণ ও বুনো শুয়োর। কাঁচের মত স্বচ্ছ পরিষ্কার সমুদ্রে নানা রঙের কোরাল রীফ দেখা যায়। লোকজন কম বলে এখানে অনেকগুলো পাখির দেখা পেলাম। Dusky scrub-fowls (megapods), long billed crows, Wallacean drongos, spotted doves, barred cuckoo doves, green imperial pigeons, yellow crested cockattoos, white bellied sea eagles, purple herons, striated heron, black-naped terns ইত্যাদি ইত্যাদি। এই দ্বীপেই সবথেকে ভালো পাখিদেখা করেছি। কিন্তু এখানেও একটিও গাল দেখলাম না।
ইন্দোনেশিয়ায় পাখি অবশ্যই আছে কিন্তু বেশিরভাগই নির্জন দ্বীপে বা গভীর জঙ্গলে। শহরে গ্রামে লোকালয়ে পাখি নেই। আমি এরকম দেখেছি চীনে, ব্যাংকক-এ এমনকি ম্যাডাগাস্কারেও (এই দেশটি আচারে ব্যবহারে ইন্দোনেশিয়ার মত, আফ্রিকার মত নয়)। শহরের পাখিগুলোর কি হল, কোথায় গেল কেউ জানে না। ক্ষেতখামারে, বাগানে খুব বেশি কীটনাশকের ব্যবহার, গুলতি দিয়ে পাখি মারা, পাখি ধরে বাইরে পাচার করা,পাখি শিকার ও পাখির মাংস খাওয়া, পাখি ধরে খাঁচায় পোষা এইসবই এদেশে খুব চলে। এরকম শতাব্দীভর চলতে থাকলে পাখির সংখ্যা কমে যেতে বাধ্য। এদেশে ঘরে ঘরে, দোকানে, রেস্তরাঁতে খাঁচায় ঝোলানো বুলবুল বা ময়না দেখা যায়। অথচ ঘরের বাইরে স্বাধীন পাখির অভাব এদের স্পর্শও করে না। এরা জানেই না এরা কি মিস করছে।
এসবই পালটানো যায়। একসময় জাভার মত বালিও পক্ষীহীন ছিল কিন্তু স্থানীয় লোকেরা পাখির যত্ন নেওয়ায় পাখির সংখ্যা বেড়েছে। অন্য দ্বীপগুলিও বালির অনুকরণ করতে পারে। নইলে পুরো দেশটাই একদিন পক্ষীশূন্য হয়ে যাবে।
পুঃ
গত পাঁচ দশকে উত্তর আমেরিকায় তিন বিলিয়ন পাখি কমে গেছে। ভারতের শহরে শকুনি থেকে চড়ুই পাখি সব গায়েব। মনে হয় সারা পৃথিবীতেই পাখিরা নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
(ভ্রমণকাল—অক্টোবর, ২০০৭)