• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৬ | সেপ্টেম্বর ২০১৯ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • তিন রকমের “আউরা” : অংকুর সাহা


    আউরা — কার্লোস ফুয়েন্তেস; প্রকাশক: বিবলিওতেকা এরা, মেহিকো সিটি; প্রথম সংস্করণ ১৯৬২; ৪৯তম সংস্করণ ২০০৭; প্রচ্ছদের ছবি: রোগেলিও কুয়েয়ার; পৃষ্ঠা ৬২; ISBN : 968 411 1819


    || ১ ||

    এসপানিওল

    কার্লোস ফুয়েন্তেস (১৯২৮-২০১২)-এর প্রথম উপন্যাস “লা রেহিওন মাস ত্রান্‌সপারেন্‌তে” (“যে অঞ্চলে আকাশ পরিষ্কার”) প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে, তখনও তাঁর বয়েস ৩০ ছোঁয়নি। তিনি চাকরি করতেন মেহিকোনগরীতে রাষ্ট্রসংঘ পরিচালিত তথ্যকেন্দ্রে। ৩৭৬ পৃষ্ঠার এই গভীর ও জটিল উপন্যাসটি তাঁকে জনপ্রিয়তা, সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা এবং খানিকটা হলেও অর্থনৈতিক সফলতা দেয়--তিনি পুরো সময় লেখার কাজে মনোনিবেশ করতে সমর্থ হন। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ--১৫০ পৃষ্ঠার প্রথাসিদ্ধ মার্কসবাদী উপন্যাস “লাস বুয়েনাস কনসিয়েনসিয়াস” (“উত্তম বিবেক”)। “আউরা” তাঁর তৃতীয় উপন্যাস--৫০ পৃষ্ঠার একটি নভেলা--রচনাকাল ১৯৬১, প্রকাশ ১৯৬২--এতে কোনও রাজনৈতিক, সামাজিক বা ঐতিহাসিক বক্তব্য নেই--রয়েছে ভূতের গল্প, ফ্যানটাসি, রূপকথা, থকথকে যৌনতা আর স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে সহজ চলাফেরা। একই সময়ে তিনি লিখে চলেছিলেন লাতিন আমেরিকার বুম সাহিত্যের প্রধান মাইলফলক, “লা মুয়েরতে দে আর্তেমিও ক্রুস” (“আর্তেমিও ক্রুসের মৃত্যু”)--সেটিও প্রকাশিত হবে আউরার কয়েক মাস পরে। অর্থাৎ একটি নির্মম, সিরিয়াস, কঠোর, রুক্ষ, কর্কশ, দীর্ঘ উপন্যাসের পাশাপাশি এর একটি ছোটো এবং আতংক আর সৌন্দর্যের সংরাগ বিজড়িত রচনা লিখতে চেয়েছিলেন তিনি।

    মূল গ্রন্থে ছিল একটি উৎসর্গপত্র, যেটি পরে ইংরেজি/এসপানিওল দ্বিভাষিক সংস্করণে বাদ পড়ে যায়। ফুয়েন্তেস গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন মানুয়েল এবং তেরে বারবাকানো দম্পতিকে; মানুয়েল বারবাকানো পন্‌স (১৯২৫-১৯৮৬)-এর “পেদ্রো পারামো” উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপায়িত হবে (মুক্তি ১৯৬৭ সালে), তখন দুজনে মিলে রচনা করবেন চিত্রনাট্য।

    আউরা উপন্যাসটির সূচনা হয়েছে ফরাসি ঐতিহাসিক জুল মিশেলে (১৭৯৮-১৮৭৪)-এর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। মূল গ্রন্থে উদ্ধৃতিটি গদ্যের আকারে একটি অনুচ্ছেদ; দ্বিভাষিক সংস্করণে লিসেন্দার কেম্প উদ্ধৃতিটির পংক্তি ভেঙে ভেঙে তাকে একটি কবিতার রূপ দিয়েছেন এবং ইংরেজি অনুবাদের ক্ষেত্রেও বজায় রেখেছেন সেই আকার। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা অনুবাদ সেটি বিশুদ্ধ কবিতা--পুরোটাই উদ্ধৃত হ’ল এখানে—

    “পুরুষ শিকার করে, মৃগয়ায় যায়, যুদ্ধ করে, যোঝে--
    গোপন চক্রান্ত, ছল, এইসব করে নারী, স্বপ্ন দ্যাখে শুধু:
    সেই হ’লো উদ্ভট কল্পনাশক্তির জননী,
    দেবতাদের মা-জননী।
    তার আছে দ্বিতীয় দৃষ্টি, পরাদৃষ্টি,
    সেই পাখা যা তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে
                     বাসনা ও কল্পনার অসীমে...
    দেবতারা পুরুষদেরই মতো;
    তারা জন্ম নেয় তারা মরে
    কোনো মেয়ের বুকেই...”
    উদ্ধৃতিটি জুল মিশেলের ১৮৬২ সালে প্রকাশিত ডাকিনীবিদ্যার ইতিহাস “লা সোরসিয়ের” থেকে নেওয়া। লেখকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী ইয়োরোপের মধ্যযুগের ডাকিনীবিদ্যা একটি প্রতিবাদের অস্ত্র; অত্যাচারী রাজা-জমিদার এবং রোমান ক্যাথলিক গির্জার শোষণের বিরুদ্ধে।

    আউরার কাহিনি মূলত: এইরকম--তরুণ ইতিহাসবিদ ফেলিপে মোন্তেরো একদিন শস্তা কাফেতে বসে চা খেতে খেতে একটা বিজ্ঞাপন দ্যাখে--তরুণ ঐতিহাসিকের জনো চাকরি--প্রার্থীকে জানতে হবে ফরাসি ভাষা--মাসমাইনে ভালো, থাকা-খাওয়া সমেত এবং বাড়ির বিশাল লাইব্রেরি ব্যবহারেও অসুবিধে নেই; বাড়ির মালকিন কনসুয়েলো ইয়োরেন্তে নামে এক বৃদ্ধা--কাজটা হল বৃদ্ধার প্রয়াত স্বামী হেনারাল ইয়োরেন্তের স্মৃতিকথা রচনা। বিজ্ঞাপনের সঙ্গে কোনও ফোন নম্বর নেই, ঠিকানা “দোনসেলেস ৮১৫”--নতুন আর পুরনো বাড়ি মিশিয়ে সেই রাস্তা। কয়েকদিন অপেক্ষার পরে ফেলিপে সেই বাড়িতে গিয়ে হাজির।

    বাড়ি অন্ধকার, দরজা খোলা--যেন তার জন্যেই অপেক্ষা করছিল বাসিন্দারা। এক বৃদ্ধার কন্ঠস্বর তাকে বলে দেয় কোনদিকে যেতে হবে, কতগুলো ধাপ সিঁড়ি ভাঙতে হবে, ইত্যাদি; বৃদ্ধার ঘরে পৌঁছে প্রথম আলাপ পরিচয় সেরে সে কাজ বুঝে নেয়--বৃদ্ধার স্বামীর স্মৃতিকথাটি সমাপ্ত এবং প্রকাশের জন্যে তৈরি করতে হবে। এমন সময়ে ঘরে ঢোকে বৃদ্ধার অপরূপা সুন্দরী ভাগনি আউরা--তাঁর সবুজ চোখের মায়ায় অভিভূত ফেলিপে। এইটুকুই গল্প--বাকিটা গা-ছমছমে রূপকথা, অথবা ভৌতিক কাহিনি, অথবা আধিভৌতিক প্রতিবেদন। ধীরে ধীরে আউরা হয়ে ওঠে কনসুয়েলো আর ফেলিপে হয়ে ওঠে হেনারাল ইয়োরেন্তে--পুরো রচনাটি ফুয়েন্তেস লিখেছেন “সেকেন্‌ড পার্সন ন্যারেটিভ” অর্থাৎ মধ্যম পুরুষের জবানীতে। যখন কনসুয়েলো কথা বলেন, আউরারও ঠোঁট কেঁপে ওঠে; শয্যায় ফেলিপের আলিঙ্গনে ও আশ্লেষে যুবতী আউরা পরিণত হয় বৃদ্ধা কনসুয়েলোতে। অন্তহীন সে কাহিনি....


    || ২ ||

    ইংরেজি

    কবি, প্রাবন্ধিক এবং এসপানিওল ভাষার ইংরেজি অনুবাদক লিসেন্দার কেম্প-এর জন্ম ১৯২০ সালে আমেরিকার ভারমন্ট রাজ্যের র‍্যানডলফ শহরে, নভেম্বর ১৩। মেইন রাজ্যের বেটস কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভের পর ১৯৪২ সালে তিনি সেবাবাহিনীতে যোগ দেন--তিন বছর কাটে পানামা, ইকুয়েদর এবং পুয়ের্তো রিকোতে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে দেশে ফিরে এসে আবার লেখাপড়া শুরু করেন। সেনাবাহিনীতে কাজ করার সময়ে তিনি বেশ কিছু কবিতা লিখেছিলেন--তার থেকে ১৬টি কবিতা তিনি বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে দাখিল করেন তাঁর এমএ ডিগ্রির গবেষণাপত্র হিসেবে; সেটি গৃহীত হয় এবং তিনি তাঁর ডিগ্রির জন্যে আংশিক ক্রেডিট পান। কবিতাগুলি র‍্যান্‌ডম হাউস প্রকাশনালয় থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় “উত্তরের আগন্তুক” নামে। সাহিত্যচর্চা ছাড়াও তিনি জ্যাজ সঙ্গীতের অনুরাগী ছিলেন এবং আলটো স্যাকসোফোন বাজাতেন।

    বাফেলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু। তবে ১৯৫৩ সালে তিনি মেহিকোতে যান এবং সেখানে চাপালা হ্রদের পশ্চিম তীরে ইয়োকোতেপেক অঞ্চলে বাস করেন ১২ বছর। এই সময়ে তাঁর লেখা মেহিকো বিষয়ক কবিতা, ফিচার এবং প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় আমেরিকার বিভিন্ন সাময়িকপত্রে। তিনি লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদের কাজেও মনোনিবেশ করেন। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অনুবাদ--

    হুয়ান রুলফোর “পেদ্রো পারামো” (প্রকাশ ১৯৫৯)
    রুবেন দারিওর “নির্বাচিত কবিতা” (প্রকাশ ১৯৬৫)
    দখল এবং স্প্যানিশ আমেরিকার অন্যান্য কবিতা (প্রকাশ ১৯৭০)
    মেহিকোর তিন জন কবি (প্রকাশ ১৯৬৫)
    তাঁর অনুবাদক জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ ওক্তাবিও পাসের কবিতা ও প্রবন্ধের অনুবাদ। মেহিকো থেকে ফিরে আসার পরে এক দশক (১৯৬৫-১৯৭৫) তিনি ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস প্রেসের প্রধান সম্পাদকের কাজ নেন এবং সেই সময় পাসের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রথমে “নি:সঙ্গতার গোলকধাঁধায়-- মেহিকোর জীবন ও চিন্তাভাবনা” নামক পাসের বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থটির তিনি ইংরেজি অনুবাদ করেন। তারপরে আরো অনেকগুলি গদ্য ও পদ্যের গ্রন্থ।

    প্রথম জীবনে তিনি কিছু কল্পবিজ্ঞানের কাহিনিও লিখেছিলেন। ১৯৯২ সালে তাঁর মৃত্যু।

    “আউরা” গ্রন্থটি তাঁর অনুবাদে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। নিউজউইক সাপ্তাহিক পত্রিকায় গ্রন্থটির বিষয়ে মন্তব্য--“When you finish, you have gone through a total experience, a beautiful horror story, a horrifying story of beauty, a combination of Poe, Baudelaire and Isak Dinesen, translated so agilely by Lysander Kemp that it seems to have been written in English.”

    ফুয়েন্তেসের ফরাসি ভাষাপ্রীতি তাঁর অনুরাগীমহলে সুবিদিত--আর এই নভেলায় তো চরিত্রেরা সকলেই ফরাসি ভাষা জানে; লাতিন আমেরিকার অভিজাত মানুষেরা ফরাসি ভাষার (এবং পানীয়ের) চর্চা নিয়মিতই করে থাকেন। আউরার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংলাপই ফরাসি ভাষায়--কেম্প সেগুলির ইংরেজি অনুবাদ করে দেন নি, সেটাই ইয়োরোপীয় ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদের সময় প্রচলিত আচরণবিধি (যেমন, যদি কোনও হিন্দি ভাষার উপন্যাসে সংস্কৃত ভাষার উদ্ধৃতি থাকে, বাংলা অনুবাদে সেই সংস্কৃত উদ্ধৃতিগুলি রেখে দিলে অসুবিধে নেই), কিন্তু আমার মত পাঠকের খটকা লাগে পড়তে। সুখের বিষয় যে বাংলা অনুবাদে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ফরাসি বাক্যবন্ধগুলিও বাংলায় রূপান্তরিত করে দিয়েছেন।


    || ৩ ||

    প্রকাশের অব্যবহিত পরেই আলোচকরা আউরাকে গথিক সাহিত্যের আখ্যা (১৮ আর ১৯ শতকের ভয়াবহ আর অতিলৌকিক সাহিত্য) দিয়েছিলেন, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটা অনেকটাই পাল্টেছে। মার্কিন গথিক সাহিত্যের মুকুটহীন রাজা হাওয়ার্ড ফিলিপস লাভক্র্যাফট (১৮৯০-১৯৩৭)-এর মতে, “A story is fantastic simply if the reader experiences a deep feeling of fear and terror, the presence of unusual worlds and powers.” ফরাসি প্রাবন্ধিক ও ভাবুক রজার কাইয়োয়া (১৯১৩-১৯৭৮) এই ধরনের আখ্যানকে “পাঠকের ভয় নিয়ে খেলা” অভিধা দিয়েছেন--বিজ্ঞানের তুমুল অগ্রগতির কারণে পৃথিবীতে আর রহস্য অথবা অজানা বলে কিছু নেই, কিন্তু গথিক আখ্যানগুলির উদ্দেশ্য মানব অবচেতনের কোনও অচেনা জানালা খুলে দেওয়া, যার মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে শীতলতম আতংক। ফরাসি দার্শনিক লুই ভ্যাকস (১৯২৪- )-এর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী--“Fantastic art should introduce imaginary terror into the bosom of the real world.” আউরাতে বেশ কিছু গা-ছমছমে মুহূর্ত রয়েছে, কিন্তু সেখানে নারীশরীরের রহস্য খুঁজতে গিয়ে উঠে আসে আধিভৌতিক রহস্য। অবশ্য এমন কাহিনি যে এর আগেও লেখা হয়নি, তা নয়-- ফুয়েন্তেসের পূর্বসূরির সংখ্যা অনেক; হেনরি জেমস (১৮৪৩-১৯১৬)-এর “অ্যাসপার্নের কাগজপত্র”, রবার্ট লুই স্টিভেনসন (১৮৫০-১৮৯৪)-এর “ডক্টর জেকিল ও মি হাইড”, পুশকিনের (১৭৯৯-১৮৩৭) “চিড়িতনের রাণী”, ফকনারের (১৮৯৭-১৯৬২) “এমিলির জন্যে গোলাপ”, আলফোনসে রেইস-এর (১৮৮৯-১৯৫৯) “নৈশভোজন”, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড (১৮৫৬-১৯২৫)-এর “নারী”--এরকম আরো নানান গ্রন্থ ফুয়েন্তেসের অনুপ্রেরণা। আর সবার ওপরে জুল মিশেলে তো আছেনই, যাঁকে স্মরণ করে লেখকের নান্দীমুখ। মিশেলে লিখেছেন, “Woman is born a fairy, through love she changes into a sorceress, thanks to her cunning and maliciousness she becomes a witch, she rules destiny and numbs pain….Alone she conceives and gives birth. To whom? To a being identical to herself who has all appearance of reality. It has been seen, it has been heard. Everyone could describe it.” যে কোনও রাম-শ্যাম না পারলেও ফুয়েন্তেস অবশ্যই পারেন। “আউরা” নামটিও পাওয়া যায় মিশেলের রচনায়, যার অর্থ, “A spirit that penetrates and lives in the woman possessed by a satanic force.” দোনসেলসের বারান্দার যে সব গাছগাছড়ার টব রয়েছে, তাদের অনেকগুলোই ব্যবহার হয় ডাকিনীবিদ্যায় এবং মিশেলের গ্রন্থে তাদের বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু সব মিলিয়ে আমার কাছে “আউরা” এক অভিনব প্রেমের গল্প--আর যে কোনো ভাষার প্রেমের গল্পেই ম্যাজিক এক প্রধান উপাদান। তবে ফ্রয়েড যাকে বলেছেন “অলৌকিক” (“Uncanny”), তেমন অনেক উপাদানই প্রবলভাবে উপস্থিত রয়েছে আউরাতে। কিন্তু তাদের কাজ পাঠককে অভিভূত করা, ভয় দেখানো নয়। আউরাতে অতিপ্রাকৃতের অস্তিত্ব রয়েছে, ঠিক যেমন থাকে কবিতায়। তবে তা ভয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ নয়, কেবল বাড়িয়ে দেয় কাহিনির কাব্যময়তা ও ম্যাজিক। গ্রন্থটির বিষয়ে ওক্তাবিও পাস লিখেছেন, “The eroticism is inseparable from the horror, and Fuentes outdoes even himself in the horror, both erotic and grotesque. Fierce joy. If it is not sacred, it is something no less violent: desecration.” কবিতা মানেই তো দৈনন্দিনের খাড়া দেয়াল পেরিয়ে অন্য বাস্তবের দিকে কয়েক মুহূর্তের জন্যে হলেও উঁকি দেওয়া। হারিয়ে যাওয়া বিদ্যুতের খোঁজ করতে মরিয়া কবিরা একা একা পথ হাঁটেন প্রতিদিন নতুন শব্দ, চিত্রকল্প আর বেঁচে থাকার আগুনের সন্ধানে। যে আগুন পোড়ায় আবার দানও করে নতুন জীবন।


    || ৪ || বাংলা

    [“আউরা”- কার্লোস ফুয়েন্তেস; বাংলা অনুবাদ: মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়; লাতিন আমেরিকার উপন্যাস সংগ্রহ--দে’জ পাবলিশিং প্রকাশিত; পৃষ্ঠা: ৩৯১-৪৩২]

    বাংলা অনুবাদের সূচনা সংক্ষিপ্ত একটি ভূমিকা দিয়ে--“আউরা পড়বার আগে”; তার তৃতীয় অনুচ্ছেদে এসেই হোঁচট খেতে হয়, যখন পড়ি--“কার্লোস ফুয়েন্তেস জন্মেছিলেন মেহিকোনগরীতেই, ১৯২৮-এ”--তথ্যটি ভুল। লেখকের জন্ম পানামানগরীতে, মেহিকোনগরীর ১৫০০ মাইল দক্ষিণপূর্বে। রাফায়েল ফুয়েন্তেস ছিলেন মেহিকো সরকারের এক উচ্চপদস্থ ডিপ্লোম্যাট--কর্মসূত্রে তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রী বের্তা মাসিয়াস ফুয়েন্তেসকে বসবাস করতে হ’ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজধানী শহরে। ১১ই নভেম্বর ১৯২৮ যখন তাঁর পুত্র কার্লোসের জন্ম হ’ল তখন তাঁরা বাস করতেন পানামার রাজধানী পানামাশহরে। আরও একটি স্থানে হোঁচট লাগে--কনসুয়েলো ফেলিপের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন আউরার সঙ্গে--“আউরা। আমার সঙ্গিনী। আমার ভাগনি।” মূল গ্রন্থে “আউরা। মি কম্পানিয়েরা। মি সব্রিনা।” কিন্তু কয়েক পাতা পরেই তিনি হয়ে যান “পিসি”। আরও কয়েক পাতা পরে “মামি” (দুবার)। কোনও লেখক বা অনুবাদকের পক্ষেই কাহিনির প্রতিটি ডিটেল মনে রাখা সম্ভব নয়। বিদেশের অভিজাত প্রকাশকরা ভালো মাইনে দিয়ে ‘বুক এডিটর’ পোষেন--আমাদের দেশে তার বালাই নেই।

    “আউরা” নভেলটি “লাতিন আমেরিকার উপন্যাস সংগ্রহ” নামে একটি বৃহৎ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত--বইটি আমার কাছে নেই--অনুজপ্রতিম শৈবাল নন্দ আমাকে বইটির ৪২টি পাতা পরম মমতায় কপি ও স্ক্যান করে ইমেলে পাঠিয়েছেন; তাঁর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বইটি বাঙালি পাঠকের সামনে খুলে দিতে পারে লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যের সিংহদরোজা। কিন্তু সেই পথের বাধা হল অসংখ্য ছাপার ভুল আর বানান ভুল। নভেলার ভূমিকাতেই (পৃষ্ঠা ৩৯১) ঘটেছে প্রমাদ--

    “মারিও ভার্গাস য়োসা” হয়েছে “মারিও ভর্গোস রোসা”
    “আর্তেমিয়ো ক্রুসের মৃত্যু” হয়েছে “আর্তেমিয়ো ক্রুসোর মৃত্যু”
    “সান্তিয়াগো দে চিলে” হয়েছে “সান্তিয়াগো দে টিলে”
    বোঝা যায় যিনি প্রুফ দেখেছিলেন, বিদেশি নামের সম্বন্ধে তাঁর কোনও ধারণাই ছিল না। “আউরা” পড়তে পড়তে চোখে জল এসে যায়--মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ভাষার এক শীর্ষস্থানীয় কবি ও প্রাবন্ধিক, অনুবাদক--তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হয় এমন সাবলীল অবহেলায়!

    আমি যে দেশে বাস করি সে দেশে নামী অনুবাদকেরা নামী লেখকদের সমানই সম্মানীয়। গ্রেগোরি রাবাসার মৃত্যু ঘটেছে ২০১৬ সালে ৯৪ বছর বয়েসে--অনুবাদ করেছেন মার্কেস, কোর্তাসার, লিসপেকতর, লেসামা লিমা, বার্গাস য়োসা ও অন্যান্য লেখকদের রচনা--তাঁর অনেকগুলি অনুবাদগ্রন্থই বেস্ট সেলারের তালিকায়। পাঠক সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতেন সেগুলির জন্যে। তাঁর বুকসেলফ সাজানো অসংখ্য সাহিত্য পুরস্কারে।

    এলিয়ট ওয়েনবার্গার ৭০ বছরের যুবক--ওক্তাবিও পাসের গ্রন্থ অনুবাদ ও সম্পাদনা করে তাঁর খ্যাতি; আরও অনুবাদ করেছেন উইদোব্রো, বর্হেস, ভিকুনিয়া, বেইদাও, বিয়াউররুতিয়া ও অন্যান্য। তিনি আমেরিকার ১৫০ জন প্রধান চিন্তকের তালিকায় সসম্মানে উপস্থিত। তিনি বিভিন্ন শহরে অনুবাদ কবিতা পড়তে এলে তিলধারণের জায়গা থাকে না। বাঙালি অনুবাদকেরা সেই তুলনায় অজ্ঞাত ও অবহেলিত, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে। বাংলাদেশে সরকারী ও বেসরকারী প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয় প্রচুর, বিভিন্ন স্বাদের অনুবাদগ্রন্থ--পাঠক সেগুলি পড়েনও--অনুবাদকেরা পান সম্মান ও অর্থানুকুল্য।

    চিনদেশে কোটি কোটি ডলার খরচা করে বিশ্বসাহিত্যের মণিমুক্তাগুলির অনুবাদ চলেছে চিনে ভাষায়; সেই সঙ্গে চিনে সাহিত্যের অনুবাদ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়। কেবল ঘুমিয়ে থাকে পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।


    || ৫ ||

    লাতিন আমেরিকার বেশির ভাগ মানুষই রোমান ক্যাথলিক; কিন্তু হিন্দুদের মতন দেবদেবীর পুজো করতে তাঁদের কোনও বাধা নেই। বৃদ্ধা কনসুয়েলো ইয়োরেন্তের ঘরে রয়েছে দেবতাদের পূজাবেদী--তাতে মোমবাতি জ্বলে সারা রাত; দেবদেবীদের মধ্যে রয়েছেন হেসুস ক্রিস্তো (যিশু), মারিয়া (মা মেরি), সান সেবাস্তিয়ান, সান্তা লুসিয়া, দেবদূত মিশেল ও অন্যান্য সন্তেরা। বাঙালি মা-মাসিদের ঠাকুরঘরের সঙ্গে তার খুব একটা তফাৎ নেই। সেনিওরা ইয়োরেন্তে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেন তাঁদের সামনে আর গল্প করে যান সন্তদের সঙ্গে

    কেম্প এবং মানবেন্দ্র দুজনই কবি--তাঁদের গদ্য অনুবাদেও ছড়িয়ে থাকে কাব্যিকতা--একটা উদাহরণ দিই:

    “Then you fall on Aura’s naked body, you fall on her naked arm, which are stretched out from one side of the bed to the other like the arms of the crucifix hanging on the wall, the black Chirst with the scarlet silk. Wrapped around his thighs, his spread knees, his wounded side, his crown of thorns set on a tangled black wig with silver spangles. Aura opens up like an altar.”
    ফুয়েন্তেসের এই অংশটুকু মানবেন্দ্রর অনুবাদে, “তারপর তুমি উপুড় হয়ে পড়ো আউরার নগ্ন দেহবল্লরীর ওপর, পড়ো তার প্রসারিত দুই নগ্ন বাহুর মধ্যে, বাহুদুটি ছড়িয়ে আছে বিছানার এপাশ থেকে ওপাশ অব্দি ঠিক যেন দেয়ালে টাঙানো ওই ক্রুশের মতো, ঠিক ওই কৃষ্ণকায় হেসুস ক্রিস্তোর মতো যার উরু-দেশে জড়িয়ে রাখা উজ্জ্বল লাল রেশমি কাপড়, তাঁর প্রসারিত দুই হাঁটু তাঁর জখম পার্শ্বদেশ, ক্ষতবিক্ষত, তাঁর কাঁটার মুকুট যেটা জটপাকানো এক কালো পরচুলার ওপর বসানো, যাতে বসানো ঝলমলে সব চুমকি। আউরা কোনো বেদির মতোই খুলে যায়।”

    ধর্ম এবং যৌনতা--লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের দুই প্রধান অবলম্বনই এখানে প্রবলভাবে উপস্থিত।


    || ৬ ||

    এক চরিত্রের ওপরে অন্য চরিত্রের আরোপণ অথবা “সুপারইমপোজিশান” সাহিত্য কোনও নতুন ঘটনা নয়-- ‘প্রতিরূপ’ অথবা জার্মান ‘ডপলগ্যাংগার’ কথাসাহিত্যে অথবা উপকথায় বেশ কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন। অগ্রজ সাহিত্যিক হুলিও কোর্তাসার (১৯১৪-১৯৮৪) দুই চরিত্রের আরোপণ এবং অতীত এবং বর্তমানের আরোপণ করেছিলেন তাঁর “দূরত্ব” (“লেহানা”) গল্পে, আউরার এক দশক আগে--বুয়েনোস আইরেস শহরে তরুণী আলিনা রেইস আর হাংগেরির বুদাপেস্ট শহরের এক বৃদ্ধা ভিখারিণীর মধ্যে। কিন্তু ফুয়েন্তেসের আখ্যানে রয়েছে দ্বৈত আরোপণ--কনসুয়েলো এবং আউরা একে অন্যের ওপরে আরোপিত; “আউরা” (ইংরেজিতে “অরা” (Aura)) শব্দটির অর্থ পরিমণ্ডল, বাতাবরণ, অলৌকিক সুরভির হিল্লোল অথবা দিব্য আভা--আউরা হতে পারেন কনসুয়েলোর সুরভিততরঙ্গ অথবা সূক্ষ্ম বিকিরণ। তার প্রেমে পড়ে ফেলিপে আরোপিত হন হেনারেল ইয়োরেন্তের অস্তিস্ত্বে। ফেলিপের খেয়াল থাকে না তিনি কার সঙ্গে নিবিড় যৌনতায় লিপ্ত, তিনি তরুণী অথবা বৃদ্ধা, তাঁর বয়েস ২০ অথবা ১০৯--পাঠকও একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে ভেসে যান ফুয়েন্তেসের বহমান ভাষার স্রোতে--সেখানেই তাঁর সার্থকতা।

    কোর্তাসার বেশ কয়েকবার খেলার ছলেই বলেছেন যে অনুজ ফুয়েন্তেসের প্রতি তাঁর রয়েছে তীব্র ঈর্ষা, যা তাঁর পক্ষে সংবরণ করা অসম্ভব। ১৯৭৫ সালে তাঁকে এই বিষয়ে বিশদ প্রশ্ন করেন ইভলিন পিকোন গারফিল্ড--কোর্তাসার আড্ডাবাজ মানুষ, গল্প করতে ভালবাসেন--কিন্তু তিনি উত্তর দিয়েছিলেন সংক্ষেপে--‘আহা, যদি আউরার মতন একটা কাহিনি আমি লিখতে পারতাম’--‘রেউয়েলা’র রচয়িতার কাছ থেকে এমন উক্তি এই কৃশকায় আলেখ্যটিকে এক নতুন উচ্চ স্তরে পৌঁছে দেয়। সেখানে অতীত-ভবিষ্যৎ, স্বপ্ন-বাস্তব, আলো-ছায়া, এসপানিওল-ফরাসি ভাষা নিবিড় আসঙ্গে লিপ্ত--সেই কাব্যিক বাস্তবতা পাঠককে পৌঁছে দেয় এক অভিনব জগতে--ওক্তাবিও পাস যাকে বলেছেন-- ‘সেই দেশের ভূগোল এখনও রচিত হয়নি।’ কিন্তু তিনি হয়ত যা বলতে চেয়েছিলেন--‘আউরা’ এক মহতী দীর্ঘ কবিতা!


    তথ্যসূত্র:


    --The Archetypes of Carlos Fuentes: From witch to Androgyne; by Gloria B Duran; Archon Books; 1980

    --Carlos Fuesntes: A critical view; Edited by Robert Brody and Charles Rossman; University of Texas Press; Austin; 1982

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments