• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৬ | সেপ্টেম্বর ২০১৯ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • বহুমাত্রিক উপন্যাস—‘বন্দুক-দ্বীপ’ : নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়


    Gun Island;—Amitav Ghosh; First Published: 2019; Penguin Random House India; Page: 289; ISBN: 9780670089161

    মিতাভ ঘোষ-এর উপন্যাস—‘বন্দুক দ্বীপ’ (Gun Island) খুবই সাম্প্রতিক রচনা,—২০১৯ সালে প্রকাশিত। বাঙালি পাঠকের কাছে লেখক কি খুবই পরিচিত এবং পঠিত? হয়তো তাঁর নাম অনেকেই জানেন। কিন্তু যেহেতু তিনি ইংরেজিতে লিখে থাকেন; আপামর বাঙালি পাঠক সম্ভবত তাঁর রচনাগুলি সম্বন্ধে যথেষ্টভাবে অবহিত নন। সে কারণেই তাঁর সামান্য লেখক-পরিচয় পাঠকদের জানানো উচিত বলে মনে হয়। (*)

    অমিতাভ ঘোষ-এর জন্ম কলকাতায়—১৯৫৬ সালে। যদিও তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়েছে মূলত—বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং ভারতের অন্যান্য জায়গায়। পড়াশোনা—দিল্লিতে এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখনও পর্যন্ত, তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা—আট। প্রথম উপন্যাস—‘The Circle of Reason’—প্রকাশিত হয়েছিল - ১৯৮৬-তে। প্রথম উপন্যাসেই তিনি বিদগ্ধ পাঠকদের চিত্ত জয় করে নেন। তারপর তাঁর নিরলস কলম থেমে থাকেনি। তাঁর বহু-পঠিত উপন্যাস—‘সী অব পপিজ’ এবং সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে তাঁর গবেষণা-আখ্যান—‘হাংরি টাইড’ পাঠকমহলে প্রভূত সমাদর পায়। ভারতীয় লেখক হিসেবে তিনি ‘জ্ঞানপীঠ’ পুরস্কারে ভূষিত হন ২০১৮ সালে।

    লেখকের সব উপন্যাসেরই আখ্যান-রূপ বিস্তৃত গবেষণার ওপর নির্ভরশীল। উপন্যাসে তিনি শুধুমাত্র আখ্যান-রচনায় আগ্রহী নন; বিশ্বজুড়ে সাম্প্রতিক ঘাত-প্রতিঘাত, নানা সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক সমস্যা তাঁর প্রায় প্রতি আখ্যানেরই অবিচ্ছেদ্য বিষয়।

    আলোচ্য উপন্যাসটির পটভূমি বহুধা-বিস্তৃত;—কলকাতা, সুন্দরবন, লস-অ্যাঞ্জেলস এবং শেষমেশ - ভেনিস। দেশি ও বিদেশি চরিত্রের প্রাসঙ্গিক উপস্থাপন। বাস্তবিক, এই রচনায় লেখক তিনটি আন্তর্জাতিক জ্বলন্ত-সমস্যাকে গভীর মনোযোগে রেখায়িত করতে চেয়েছেন। সেগুলো হল—(১) বন্দুক-দ্বীপ, বন্দুকি-সওদাগর এবং মনসামঙ্গল কাব্যের প্রাচীন এবং অতীন্দ্রিয় (mystic) মিথ্‌ বা পুরাণ-কল্পকে আধুনিক মননে বিশ্লেষণ, (২) বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়ন এবং দাবানল কাণ্ড, (৩) তৃতীয় পৃথিবীর হাজার-হাজার স্থানচ্যুত এবং উদ্বাস্তু মানুষদের ইওরোপের নানা দেশে আশ্রয় গ্রহণের অসহায় প্রচেষ্টা এবং দুরূহ অভিবাসন সমস্যা।

    পিরামিডসম অনন্য স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত বিচিত্র কথনের মূল কথক হলেন কলকাতার এক বাঙালি—দীননাথ বোস; সংক্ষেপে দিনু; বিদেশিদের উচ্চারণে শুধুই ‘দীন’। দিনু কলকাতা ছেড়ে ব্রুকলিনে প্রতিষ্ঠিত। তিনি সেখানে দুর্লভ বইপত্রের ব্যবসায়ী (rarebooks dealer)।

    উপন্যাসের শুরু কলকাতায়;—এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। যেখানে দীননাথের সঙ্গে বহুদিন পর হঠাৎই দেখা হয় দূর-সম্পর্কের এক আত্মীয়, দিল্লীবাসী কানাই দত্তর সঙ্গে। সংবাদমাধ্যমে চাকরির সূত্রে কানাই যেন বিচিত্র সব সংবাদের ভাঁড়ার। কথাপ্রসঙ্গে কানাই দীননাথকে জিগ্যেস করেন—‘তুমি কি বন্দুকি-সদাগরের সম্বন্ধে জান?’ ‘বন্দুকি-সদাগর’--এই নামটার সঙ্গে এক লোককথা, হয়তো-বা এক প্রাচীন মিথ্‌ জড়িয়ে আছে। দীননাথ যেহেতু দুর্লভ সব প্রাচীন গ্রন্থের ব্যাপারী, তাই কানাইয়ের তাঁর কাছে এই প্রসঙ্গের উত্থাপন। ... নাহ্‌, দীননাথ শোনেননি সেই নাম। তখন কানাই তাঁকে জানান যে, বাংলা পুরাণ-কাহিনিতে বাবা দক্ষিণ রায় বা চাঁদ সদাগর যেমন এক বহুশ্রুত চরিত্র; বন্দুকি-সদাগরও সেরকমই একজন। বাস্তবিক, চাঁদ-সদাগরের পুরাণের সঙ্গে বন্দুকি-সদাগরের পুরাণের ভাষ্যমিল লক্ষিত হয়। চাঁদ-সদাগরের মতো বন্দুকিও ছিলেন এক শৈব। দেবী মনসার পুজো বা বন্দনা তিনি কখনও করেননি। ফলে চাঁদ-এর মতো বন্দুকিকেও ভীষণভাবে মনসার দ্বারা লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত হতে হয়। শেষমেশ বন্দুকি-সদাগর মনসার কোপ-দৃষ্টি থেকে নাকি রক্ষা পান—সুন্দরবনের গভীরে, এক প্রত্যন্ত গ্রামে, নদীর ধারে এক ধাম বা মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। যে মন্দিরে এখনও মনসার পুজো হয়। দীননাথের প্রশ্ন ছিল—‘কেউ নিজের চোখে দেখেছে সেই ‘ধাম’? কানাই বলেন—তার কাকিমা, এক সমাজসেবী, নীলিমা বোস নিজের চোখে দেখেছেন সেই ‘ধাম’।

    প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহী দীননাথ দেখা করতে যান নীলিমা বোস-এর সঙ্গে। এই বৃদ্ধা মহিলা এখন কলকাতায় থাকেন। কিন্তু ১৯৫০ সাল থেকে প্রায় বছর তিরিশ নীলিমা ও তাঁর স্বামী কলকাতায় স্থায়ী বাস ছেড়ে থাকতে শুরু করেন সুন্দরবনের ‘gateway’ লুসিবাড়ি গ্রামে। সেই গ্রামের অনুন্নত মহিলাদের সংগঠিত করে অচিরেই তাঁরা গড়ে তোলেন ‘বাদাবন ট্রাস্ট’। এই ট্রাস্ট হল ভারতের অন্যতম এক ‘charitable organization’। এখন এই সংগঠনের কাজকর্ম সুন্দরবনের বিশাল এলাকা জুড়ে পরিচালিত হয়। গড়ে তোলা হয়েছে গরিবদের জন্যে দাতব্য-হাসপাতাল, শিক্ষাকেন্দ্র, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং প্রশিক্ষণ-কেন্দ্র।

    ‘ধাম’ বা মন্দিরের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে নীলিমা শোনান দীননাথকে সুন্দরবন অঞ্চলে ১৯৭০ সালে ভয়াবহ সাইক্লোনের কথা। সেই সাইক্লোন ধ্বংস করেছিল গ্রামের পর গ্রাম, মৃত্যু হয়েছিল অসংখ্য মানুষের। রায়মংগল নদীতে নীলিমা ভাসতে দেখেছেন লাশের পর লাশ।

    নৌকো নিয়ে ট্রাস্ট-এর একজন বিশ্বাসী কর্মী হরেন নস্করের সঙ্গে তিনি নৌকোয় বেরিয়েছিলেন নিজের চোখে ক্ষয়ক্ষতি দেখতে। নদীর ধারে চোখে পড়ে এক প্রাচীন মন্দির। কাছাকাছি এক গ্রামের মানুষজন ভয়ংকর ঝড়ের তাণ্ডবের হাত থেকে বাঁচতে নিজেদের গ্রাম ছেড়ে সবাই আশ্রয় নেয় সেই মন্দিরে। তারা সবাই বেঁচে যায়। মন্দিরে আশ্রিত গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে নীলিমা জানতে পারেন যে সেই মন্দির মনসাদেবীর পুজোর জন্যে নির্মিত হয়েছিল প্রায় চারশ বছর আগে। নির্মাণ যিনি করেছিলেন তাঁর নাম—বন্দুকি-সদাগর। এটা সত্যিই অত্যাশ্চর্য যে, ঝড়ের তাণ্ডব এই প্রাচীন মন্দিরের একটা ইটও খসাতে পারেনি। আশ্রিত গ্রামবাসীদের মধ্যে হিন্দু যেমন ছিলেন, মুসলমানও ছিলেন। প্রাচীন মন্দিরকে ঘিরে দু-প্রকারের অলৌকিক কাহিনি চালু দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের মনে। '… Hindus believed that it was Manasa Devi, who guarded the shrine; while Muslims believed that it was a place of Jinns protected, by a Muslim Pir or Saint, by the name of Ilyas--’

    নীলিমার মতে, চাঁদ-সদাগর ও বন্দুকি-সদাগর পুরাণ, প্রকৃতপ্রস্তাবে একই পুরাণ। মনসাকে অবজ্ঞা করার কারণে বন্দুকি সদাগর (gun-merchant) অকথ্য লাঞ্ছনার শিকার হন। তাঁর স্ত্রী ও পুত্র-কন্যা সাপের কামড়ে মারা যান। অতঃপর-- ‘... to escape the Goddess’s wrath,’ সদাগর সমুদ্রে পাড়ি দেন। কিন্তু সেখানেও তো তিনি ভয়ানকভাবে লাঞ্ছিত হন; জলদস্যুদের আক্রমণে তাঁর বাণিজ্য-পোত ধ্বংস হয়; জলদস্যুদের হাতে তিনি বন্দি হন; জলদস্যুরা তাঁকে বিক্রি করে দেয় ইলিয়াস (Ilyas) নামে এক জাহাজ-মালিকের কাছে।

    ইলিয়াসের ক্রীতদাস হিসেবে, তাঁর জাহাজে সদাগর ভ্রমণ করেন অনেক দেশ। লোকমুখে প্রচলিত ও প্রচারিত সেই পুরাণ-কাহিনিতে কিছু কিছু দেশ-এর উল্লেখ আছে। সদাগর গিয়েছিলেন ‘তাল-মিছরির দেশ’-এ, (Land of Sugar); ‘রুমালি-দেশে’ - (Land of Kerchieves)। লোককথায় উল্লিখিত এই পুরাণ-কাহিনির ও সেইসব দেশের কোনো বাস্তব-ভিত্তি আছে কিনা;—দীননাথের সেই নিরন্তর সন্ধানই এই উপন্যাসের মূল আখ্যান-পর্ব।


    পুরাণ-কাহিনির বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণ:

    আলোচ্য উপন্যাসের অভিনবত্ব এখানেই যে, কৌতূহলোদ্দীপক পুরাণ-কাহিনির উপর ভিত্তি করে লেখক কল্পলোকের গল্প বা তথাকথিত জাদু-বাস্তবতার রমণীয় কাহিনি পাঠকের কাছে উপস্থাপন করতে চাননি। তিনি লোকমুখে প্রচারিত পুরাণ-কল্পের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন। অর্থাৎ নির্মাণ থেকে তাঁর সচেতন প্রয়াস বিনির্মাণ অর্জনে। দেরিদা-কথিত এই বিনির্মাণ (deconstruction) এই সময়ে উপন্যাসের বা কথনের উত্তর-আধুনিক প্রবণতা।

    সিন্‌তা (Cinta) একজন ইতালিয়ান মহিলা, উপন্যাসের এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। তিনি দীননাথের থেকে দশ বছরের বড়। আন্তর্জাতিক মানের স্কলার। তিনি কলকাতাতেও এসেছিলেন। দীননাথ তাঁর থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। এই শহরের নানা দ্রষ্টব্য দেখিয়েছিলেন। ভেনিস-এর প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে তিনি জ্ঞানগর্ভ গবেষণা করছেন। অনেক ভাষা জানেন। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে সিন্‌তা আমন্ত্রণ পান সেমিনারে বক্তব্য রাখার।

    পটভূমি—ভেনিস। সিন্‌তার আমন্ত্রণে দীননাথ যান ভেনিস। সিন্‌তা তাঁর গবেষণা-লব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করে বন্দুক-দ্বীপ, বন্দুকি-সদাগর—এসব terminology-র বাস্তব-ভিত্তিক ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেন। সিন্‌তার দৃঢ় ধারণা যে, ‘বন্দুকি সদাগর’ বা ‘Gun-merchant’, বাস্তবিক ভেনিসে এসেছিলেন। কীভাবে তা প্রমাণ করেন তিনি? সিন্‌তার মতে এখানে Arabic ভাষার বড় ভূমিকা আছে। আরব ভাষায়, ‘Bandiq’ শব্দ, কালক্রমে অপভ্রংশের আকারে ‘Venedig’ রূপ নেয়, যা আরব দেশের মানুষের কাছে প্রতীয়মান - ‘ভেনিস’ হিসেবে। সিন্‌তার পর্যবেক্ষণ—“And through Arabic the name of Venice has travelled far afield, to Persia and parts of India, where to this day guns are known as ‘bundook’, which is of course none other than ‘Venice’ or ‘Venetian’….” সুতরাং ‘Bonduki Sadagar’ বলতে সুদূর অর্থে বোঝায়—“the gun merchant who went to Venice….”

    মনিব ইলিয়াস-এর সঙ্গে ক্রীতদাস সদাগর গিয়েছিলেন ‘তাল-মিছরির দেশ’- এ। দীননাথ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন—‘the name that I translated as the “Land of Palm Sugar Candy” was Taal- misrir-desh. Desh is “Country” is Bengali, and taal is a kind of palm tree that produces a sugar syrup which is used to make all kinds of sweets including a crystallized candy. I translated the phrase as “palm sugar candy” because the Bengali word for “sugar candy” is misri …’ এই অনুবাদ শুনেই সিন্‌তার চোখ খুলে যায়—‘“Misri” is but the Arabic word for Egypt? Misri or masri means Egptian” - perhaps crystallized sugar is known as misri because the process had come to Bengal by way of Egypt?’

    সুতরাং Sugar Candy Land is just a reference to Egypt…’ তারপর সদাগর গিয়েছিলেন, রুমালি-দেশে (Rummali-desh)। দীননাথকে সিন্‌তা জিগ্যেস করেন - তিনি কি ‘Rumelia’ দেশের নাম শুনেছেন? সিন্‌তার মতে প্রাচীনকালে যে দেশকে বলা হত, ‘রুমেলিয়া’, আধুনিক যুগে সেই দেশকেই বলা হয় টার্কি - Turkey. সুতরাং লোককথায় চালু পুরাণ বাস্তবিক ব্যাখ্যাত হয় এভাবে—‘.... the Gun Merchant and captain Ilyas would have gone from Egypt to Turkey…’

    সুতরাং শেষমেশ সিন্‌তার ব্যাখ্যায় লোককথার রূপ এরকম—‘The outlines of the story are historically quite plausible. The protagonist is a merchant, whose homeland in eastern India, is struck by drought and floods brought on by the climatic disturbances ….’


    দাবানল ও উষ্ণায়ন:

    ‘এ সপ্তাহে জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ফ্রান্সে এসেছেন বিভিন্ন রাষ্ট্রনেতারা। শীর্ষ বৈঠকে দাবানল নিয়ে বিশেষ আলোচনার ডাক দিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাকরঁ। শীর্ষ সম্মেলনের প্রথম দিনেই তিনি টুইট করেন, “আমাদের ঘর পুড়ছে। এটা একটা আন্তর্জাতিক সঙ্কট। এখনই কিছু করা দরকার।”'
                                                            (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪ অগস্ট ২০১৯)

    সারা বিশ্বজুড়ে, বিশেষত ইউরোপ ও ল্যাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে হঠাৎ- দাবানলে অরণ্যের পর অরণ্য পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের মতে এর প্রধান কারণঃ উষ্ণায়ন (global warming)। সম্প্রতি আমরা জেনেছি, আমাজন বৃষ্টি-বনানীর ব্যাপক অঞ্চল দিনের পর দিন অপ্রতিরোধ্য দাবানলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। আগুনের অস্বাভাবিক তাপে মারা যাচ্ছে হাজার হাজার বন্য প্রাণী। সাও-পাওলো-ব্রাজিলে এবং বলিভিয়ার কিছুটা অঞ্চল এই দাবানলের কবলে। সুপার-ট্যাঙ্কার বোয়িং-বিমান থেকে জল ছড়িয়ে দাবানল নেভানোর চেষ্টা চলছে।

    এই দাবানল-সমস্যা এবং উষ্ণায়ন-সমস্যা আলোচ্য উপন্যাসের আখ্যানে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। দীননাথ তাঁর স্মার্টফোনের মনিটরের দিকে তাকিয়ে দেখেন—‘... massive wildfires had been raging around Los Angeles for several days. Thousands of acres of land had been incinerated and tens of thousands of people had been moved to safety.’

    দীননাথ যাচ্ছেন, লস অ্যাঞ্জেলস্‌-এ এক সম্মেলনে যোগ দিতে। বিমানের জানলা দিয়ে তিনি কিছুটা প্রত্যক্ষ করেন দাবানলের লেলিহান শিখা কীভাবে ধ্বংস করছে বিশাল বনাঞ্চল। তার বর্ণনায় মূর্ত হয়ে ওঠে প্রকৃতির সেই ভয়ঙ্কর রোষ—‘It wasn’t long before dank smudges appeared in the distance. They quickly grew into dense masses of smoke. Then leading waves of flame came into view too, leaving the horizon with flickering tints of yellow and orange.’

    তারপর নির্দিষ্ট হোটেলে পৌঁছে দীননাথ প্রত্যক্ষ করেন লণ্ডভণ্ড অবস্থা। হোটেলের অতিথিরা সবাই আতঙ্কে ও বিস্ময়ে দেখছেন দাবানল দুর্দম গতিতে এগিয়ে আসছে নগরীর দিকে—‘...every eyes were drawn in the same direction, towards the northeast, where a dark cloud had reared up above the horizon, taking the shape of an immense wave, complete with a frothing white top. From where we stood it looked as though a gigantic tsunami were advancing upon the distant outskirts of the city’।

    শুধু তাই নয়। লস অ্যাঞ্জেলস্‌ নগরীর পাশে যে সমুদ্র, সেখানে সৈকতে ছুটোছুটি করা এবং সমুদ্রস্নান অধিবাসী এবং ট্যুরিস্টদের কাছে এক নির্ভার, বিপদহীন আনন্দ। কিন্তু দীননাথ সেখানে গিয়ে জানতে পারেন যে সৈকতের বেলাভূমিতে এবং সমুদ্রে নামার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আছে; কারণ সৈকতে আছড়ে পড়ছে যে নয়নাভিরাম তরঙ্গ; ভেঙে পড়ছে চূর্ণ-বিচূর্ণ ফেনিল বুদবুদে তার মধ্যে কিলবিল করছে হলদে-পেট ও সোনালি ছোট ছোট সাপ। ভীষণ বিষাক্ত নাকি সেই সাপ! চোখের সামনে এক পোষা কুকুরকে সেই সাপের দংশনে মরতে দেখেন দীননাথ। নিরাপত্তারক্ষীকে জিগ্যেস করে দীননাথ জানতে পারেন যে, গত কয়েক মাস এই বিষাক্ত সাপেদের আবির্ভাব হয়েছে সমুদ্র-সৈকতে। উষ্ণায়নই এই ভিনদেশি সাপেদের আবির্ভাবের কারণ। প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতি—‘...these snakes generally lived in warmer waters to the south .… their distribution was changing with the warming of the oceans and they were migrating northwards. This was bad news for southern California because yellow-bellies were indeed extremely venomous.’


    উদ্‌বাস্তুদের অমানুষিক শোষণ ও তাদের জটিল অভিবাসন-সমস্যা:

    গিসা (Gisa)—সিন্‌তার ভাইঝি, দীননাথকে জানায় যে, সে একটা তথ্যচিত্র বানাচ্ছে। বিষয়—লিবিয়া, ইজিপ্ট, এমনকি বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার উদ্‌বাস্তুর সামান্য ছোট ছোট নৌকোয় বিপদসংকুল, উত্তাল সমুদ্র পার হয়ে ভেনিসে বিতর্কিত পুনর্বাসন। দীননাথের সাহায্যপ্রার্থী গিসা। দীননাথ যেটা পারেন, সেটা হ’ল বাংলাদেশ থেকে গোপনে চলে আসা এরকম কোনো কোনো উদ্বাস্তুকে চিহ্নিত করে তাদের সঙ্গে গিসা-র সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা।

    এরকম উদ্বাস্তুদের থাকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা; ইতালিয়ান পরিভাষায় সেই জায়গাকে বলে ‘ঘেটো’ (ghetto); যেখানে সামান্য বস্তিতে অসহায় মানুষগুলো থাকেন। সন্ধানী দীননাথ কালক্রমে জানতে পারেন যে, ভেনিসে প্রচুর বাংলাদেশি থাকেন এবং অনেকরকম কাজ করে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করেন। কেউ হোটেলে ‘বয়’-এর কাজ করেন, কেউ রাস্তায় বাদাম বিক্রি করেন, কেউ নির্মাণকাজে জোগাড়ের কাজ করেন আবার কেউ বা আইসক্রীমের গাড়ি ঠেলে নিয়ে যান রাস্তায়। গিসার তথ্যচিত্র নির্মাণের কারণ আছে। কারণ সে জানে—‘Across Europe the question of immigration is now the single most important issue in politics...’ এরকমই একজন উদ্বাস্তু হ’ল বিলাল (Bilal), যে তার বন্ধু কবীরের সঙ্গে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলা থেকে পালিয়ে এসেছে ভেনিসে। বিলাল দীননাথকে জানান, তাঁর পালিয়ে আসার কাহিনি যা আমি, লেখক, সাধ্যমতো অনুবাদ করে পাঠককে জানানোর চেষ্টা করছি—‘... বেকার-জীবনের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আমি ও কবীর ঠিক করলুম ইওরোপের কোনো দেশে পুনর্বাসন নেব। সেখানে চাকরি করে বা পরিশ্রমের সাহায্যে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করতে হবে। একজন দালালের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। সে জানায় যে, ৩,৫০,০০০ টাকার বিনিময়ে আমাদের এমিরেটস-এ (আরবশাহীর কোনো দেশে) পৌঁছে দেবে। অনেক কষ্টে আমরা সেই টাকাই জোগাড় করি। দালালকে দিই। সে আমাদের (....??)(....??) একটা করে কাগজ দিয়েছিল এবং বলেছিল সেই কাগজ হল—“airport visa"। আমাদের চিট্টাগাঙ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে আমরা শারজার প্লেনে চেপে বসি। পরের দিন শারজা থেকে বিমানে খারত্যুম (Khartoum)। সেখানে আরো অনেক বাংলাদেশিদের আমরা দেখতে পাই যাদের বলা হয়েছে লিবিয়া বা সুদানে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু সেখান থেকে সকলকে বিমানে উড়িয়ে আনা হয় ত্রিপোলি (Tripoli)। কিন্তু ত্রিপোলিতে নেমে আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের অপহরণ করা হয়েছে। প্রায় দেড় বছর আমাদের ত্রিপোলিতে থাকতে হয়। আমাদের ওপর প্রতিদিন অকথ্য অত্যাচার ও যৌন-নির্যাতন চলত। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আমাদের কুলির কাজ করতে হত। বিনিময়ে দেওয়া হত সকালে দুটো রুটি, দিনের শেষে দুটো রুটি। ক্রমশ আমরা চুরিতে ও পকেটমারিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। এভাবে দু-বছর ধরে পয়সা জমিয়ে দালালকে প্রচুর টাকা দিয়ে সমুদ্র পেরিয়ে ভেনিসে এসে পৌঁছই। এখানে আমি নির্মাণকাজে পাথর ভাঙার কাজ করি।’

    ভেনিসে আশ্রয় নিয়েছেন এমন বাংলাদেশিদের সংগঠন তৈরি হয়েছে। যখনই শোনা যায় নীল নৌকোয় (স্বাধীনতার প্রতীক) বাংলাদেশিরা ভেনিসে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করছেন, তখনই তাঁরা সমুদ্রের উপকূলে এসে হাজির হন, যাতে বাংলাদেশিরা নির্বিঘ্নে ভেনিসের মাটিতে পা রাখতে পারেন। এরকমই এক উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে দীননাথও এসে পৌঁছন সমুদ্রের উপকূলে এবং তাঁর অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা হয়।

    ভেনিসেও - ‘right-wing, anti-immigrant’ সংগঠন আছে যাদের সমর্থকেরা প্রাণপণে বাধা দিতে থাকে যাতে উদ্বাস্তুদের নীল-নৌকো ভেনিস-উপকূলে না পৌঁছতে পারে।

    ‘On the evidence of the flags that were flutturing above their decks it seemed that some of their supporters had come a long way to support their cause - from Germany, Hungary, Russia, Singapore and Australia.’
    যারা ভেনিসে আশ্রয় চাইছেন, শয়ে শয়ে মানুষ নীল-নৌকোয় এগিয়ে আসছেন উপকূলের দিকে, তাদের বিরুদ্ধে সাদা মানুষেরা জাহাজে চড়ে শ্লোগান দিতে থাকেন—‘...close borders now! Italy is for the Italians.’ এমনকী ইটালিয়ান যুদ্ধজাহাজ নামিয়ে দেওয়া হয় সমুদ্রে, যাতে অন্য দেশের পলায়নকারী মানুষেরা (immigrants) ভেনিসে ঢুকতে না পারেন। দীননাথ তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলেন:
    ‘It was late afternoon when we sighted the warships. There were four of them, arrayed in a line, looking watchfully eastwards: it was as though they were waiting to ambush an enemy armada.’
    ক্রমাগত আকাশ বিদীর্ণ করে সাদা মানুষদের শ্লোগান:
    ‘Go back where you come from …!’
    ‘Not needed here!’
    ‘Europe for Europeans!’
    যখন অসহায় উদ্বাস্তুরা নীল-নৌকোয় শুধুই এলোমেলো ভাসছেন সমুদ্রে; কারণ তাদের পথ রোধ করে প্রস্তুত যুদ্ধজাহাজ; হয়তো কিছুক্ষণ বাদেই শুরু হবে কামান থেকে গোলাবর্ষণ;—ঠিক সেই মুহূর্তেই দীননাথ দেখেন যুদ্ধজাহাজগুলি পিছু হঠছে আর নীল-নৌকোগুলো এগিয়ে আসছে উপকূলের দিকে।

    এখনও মানুষ মানুষেরই জন্য ....। ভারপ্রাপ্ত ইটালিয়ান অ্যাডমিরাল হঠাৎ আদেশে জানিয়ে দেন সমস্ত যুদ্ধ-জাহাজগুলোর ক্যাপ্টেনদের। বাধা দেবার দরকার নেই। অসহায় মানুষগুলোকে আমরা আবাহন করে নিই ভেনিসের উপকূলে। সেই মহৎ-হৃদয় অ্যাডমিরালের সঙ্গে ইতালিয়ান সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকারটি খুবই প্রণিধানযোগ্য।

    ‘সাংবাদিক: অ্যাডমিরাল - মাইগ্র্যান্টসদের রেসকিউ করার জন্যে আদেশ কি আপনি নিজের ক্ষমতাবলে দিয়েছেন?

    'অ্যাডমিরাল: হ্যাঁ। যা আদেশ দিয়েছি আমরা নিজের দায়িত্বে।

    'সাংবাদিক: কিন্তু, অ্যাডমিরাল কর্তৃপক্ষ আপনাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যথাযথ ব্যবস্থা নিতে যাতে উদ্বাস্তুরা ইতালির মাটিতে পা রাখতে না পারেন? তাহলে আপনি যা কাজ করেছেন তা কি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধাচার নয়?

    'অ্যাডমিরাল: আমি মনে করিনা আমি আদেশ পালনে ব্যর্থ হয়েছি...

    'সাংবাদিক: কিন্তু আপনি তো জানতেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী চান না উদ্বাস্তুরা ইতালির মাটিতে পা রাখুন?

    'অ্যাডমিরাল: আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। মন্ত্রী এটাও বলেছেন যে মানুষ, সে যে কোনো দেশেরই হোক, যদি সত্যিই বিপন্ন বোধ করে; পায়ের নীচে মাটি না পেয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাহলে তাদের বাঁচাতে হবে এবং আমাদের দেশেই আশ্রয় দিতে হবে।

    উদ্বাস্তুদের তুমুল হর্ষধ্বনিতে আকাশ-বাতাস উত্তাল!'

    বহুমাত্রিক এই উপন্যাসটি বিষয়ে যে কথা বলা হয়েছে তা অনস্বীকার্য: ‘….this is a story about a world in which creatures and beings of every kind have been torn loose from their accustomed homes by the catastrophic processes of displacement that are now unfolding across the Earth, at an even-increasing pace…’


    (*) অমিতাভ ঘোষের উপরে পরবাসে পূর্ব-প্রকাশিত অংকুর সাহার লেখা দ্রষ্টব্যঃ অমিতাভ ঘোষ: ইতিহাস ও সাহিত্যের যুগলবন্দী, নিবিড় পাঠঃ কলকাতার ক্রোমোজোম

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments