“‘ডিভিয়েন্ট’- কথাটার মানে কি গো দাদাই?”— বারো বছরের নাতি সৌজন্যের কথায় তার দাদু সুধীন রায়ের চোখ কপালে ওঠার উপক্রম। সুধীন্দ্রনাথ রায় অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। কলকাতার একটি বিখ্যাত কলেজে দীর্ঘকাল ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন। লিখেছেন বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের বই ইংরেজি ও বাংলায়। এই সত্তরের কোঠায় এসেও দিনের বেশিরভাগ সময়ই তার পড়ার ঘরেই কাটে। আর সেই ঘরে দিনের শেষে তার অতিপ্রিয় এই একমাত্র নাতিটির আসা চাইই চাই। সারাদিনের কোনো না কোনো ঘটনা চোখ গোল গোল করে পিকাই অর্থাৎ সৌজন্য রায়কে তার দাদাইয়ের কাছে বলতেই হবে।
“এ কথাটা আবার কোত্থেকে শুনলে পিকাইভাই?” — নাতির কাঁধে হাত দিয়ে বললেন সুধীন রায়।
পিকাই খুব গম্ভীর মুখে বললো— “দেবাংশু একটা ডিভিয়েন্ট।”
“সে আবার কি? কে বলেছে?” — রীতিমতো চমকে গিয়ে বললেন সুধীন রায়। কারণ তিনি এই দেবাংশুর অনেক গল্প শুনেছেন তার নাতি পিকাইয়ের কাছ থেকে। ছেলেটি পিকাইয়ের সহপাঠী। পড়াশুনোয় খুব ভালো। খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারে। কিন্তু ইদানীং তার নামে তার বন্ধুদেরই অনেক অভিযোগ। কয়েকদিন আগেই নাকি তার মা-বাবাকে স্কুল থেকে ডেকে পাঠিয়েছিল।
“প্রীতি মিস বলছেন ওর বাবাকে — “আপনার ছেলে ডিভিয়েন্ট। আপনি ওকে অন্য কোথাও নিয়ে যান” —একইরকমভাবে বলল পিকাই।
“কী করে জানলে তুমি?” — এবার একটু গম্ভীরভাবেই বললেন সুধীন রায়।
“ওর বাবাই তো এই কথাটার জন্য আমাদের প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করেছেন — সেই নিয়ে স্কুলে এখন অনেক হইচই হচ্ছে,”— চোখ গোলগোল করে বলল পিকাই। তারপর বলল — “ডিভিয়েন্ট মানে কি গো? খুব খারাপ?”
সুধীন রায় একদৃষ্টে তাকালেন তার নাতির মুখের দিকে। তারপর তার মাথায় হাত দিয়ে তার এক ঝাঁকড়া চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বললেন— “নাহ্। তা ঠিক নয়। ব্যাপারটা তোমায় একটু বুঝিয়ে বলতে হবে। আজ রাতে পারলে শোয়ার আগে একটু সময় করে আমার কাছে এসো তো।” সুধীন রায় তার দীর্ঘজীবনের অভিজ্ঞতায় সমস্ত ব্যাপারটার একটা আভাস পেলেন তখনই। আর সেই সঙ্গেই মনে হল বিষয়টি নিয়ে আজই তার নাতির সঙ্গে কথা বলা উচিত।
পিকাই মাথা নেড়ে বলল — “হ্যাঁ হ্যাঁ--কাল তো দোলের ছুটি। আজ রাতে অনেক সময় পাওয়া যাবে।”
সুধীন রায়ের পড়ার ঘরের দেওয়াল ঘড়িটায় ঢং ঢং করে নটা বাজার সাথেসাথেই পিকাই এসে হাজির। সুধীন রায় তার সামনে রাখা বিরাট মোটা একটা বই থেকে চোখ তুলে বললেন — “এসো- এসো- একেবারে ঠিক সময়ে এসেছো।” পিকাই এসে বসলো তার নির্দিষ্ট জায়গায়। অর্থাৎ তার দাদাইয়ের বিছানায় রাখা তাকিয়াটিতে ঠেসান দিয়ে। খাটের পাশে পড়ার টেবিলটার সামনে। তার দাদাইয়ের মুখোমুখি।
সুধীন বসে রয়েছেন একটা প্রকাণ্ড রিভলভিং চেয়ারে। সামনের টেবিলে বইয়ের স্তূপ। পাশে রাখা লম্বা স্ট্যান্ডল্যাম্পের আলো এসে পড়েছে টেবিলে রাখা বইয়ের পাতায়। সুধীন বইটা বন্ধ করলেন। তারপর পিকাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন — “একটা গল্প শোনো খুব মন দিয়ে। যেখানেই বুঝতে পারবে না- আমায় বলবে।” পিকাই দেখলো তক্ষুণি বন্ধ করে রাখা বইটার গায়ে লেখা- মহাভারত- শ্রী কালীপ্রসন্ন সিংহ বিরচিত। পিকাই তার দাদাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল — “মহাভারতের গল্প?” সুধীন বললেন — “হ্যাঁ। কিন্তু এ গল্পটা নানাভাবে আরো অনেক লেখায় আছে। সেগুলো বড়ো হয়ে তুমি ইচ্ছে হলে পড়ে নিও। আমরা কিন্তু এখন মহাভারতের মতো করেই বলবো।”
“বহুকাল আগে রাজাদের বিখ্যাত এক বংশ ছিল যার নাম ইক্ষ্বাকু বংশ। এই বংশের রাজারা ছিলেন বিরাট মাপের। রামচন্দ্র এই বংশেই জন্মেছিলেন। এর অনেক কাল পরে কল্মাষপাদ নামে এক রাজা জন্মান এই বংশেই।” — মৌরি মুখে ফেলে বলতে শুরু করলেন সুধীন।
পিকাই ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল — “কি নাম বললে?”
সুধীন একটু হেসে সামনের খাতাটা টেনে নিয়ে তার মুক্তোর মতো হাতের লেখায় বড়ো বড়ো করে লিখলেন- ‘কল্মাষপাদ’। “নাও এবার ভালো করে দেখে উচ্চারণ করে পড়ো।” — বললেন তিনি।
পিকাই ভুরু কুঁচকে খাতাটার দিকে তাকিয়ে বলল — “কল্মাষপাদ- কি বিচ্ছিরি নাম।”
সুধীন রায় হেসে বললেন — “বিচ্ছিরি নাম? তা হলে শোনো- ওনার কিন্তু আরেকটা অন্য নামও ছিল- ‘সৌদাস’। আসলে কি জানো- এইসব নামের মধ্যে দারুণ সব মানে লুকিয়ে থাকে। যার নাম তার জীবনের কোনো বিশেষ কাজ বা ঘটনার কথা কিংবা বংশপরিচয় বলা থাকে এই নামের মধ্যে। এই যে নামটা কল্মাষপাদ - এর মানে যার পায়ে কালো দাগ--”
“পায়ে কালো দাগ? সে কি? কেন?” —সুধীনের কথার মাঝেই চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞেস করলো পিকাই। সুধীন বললেন — “সে এক অন্য গল্প - পরে বলবো সে কথা - এখন আমরা আমাদের গল্পে চলে আসি।” বলে তার রিভলভিং চেয়ারটিতে পিঠটা টানটান করে ঠেকিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করলেন—
“তা সেই রাজা গেছেন শিকার করতে গভীর বনে। সেখানে সারাদিন ধরে ছুটে বেড়িয়েছেন জন্তু জানোয়ারদের পিছনে। দিন শেষে শিকার-টিকার সেরে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসছিলেন ওই গভীর বনের একটা সরু রাস্তা ধরে। খিদেয় তেষ্টায় তখন তিনি কাহিল। কোনোক্রমে রাজপুরীতে ফিরে আসতে পারলে বাঁচেন। এমন সময় দেখতে পেলেন ওই পথেই উল্টোদিক থেকে কে যেন আসছে তার দিকে। রাজা তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন — “আমি রাজা কল্মাষপাদ - আমার যাওয়ার পথটা ছেড়ে দাঁড়ান।”
রাজার কথায় লোকটি তো সরলেনই না উল্টে বললেন — “আমি ব্রাহ্মণ। আর ব্রাহ্মণকে পথ ছেড়ে দেওয়া রাজার অবশ্যকর্তব্য।” কল্মাষপাদ বললেন — “আমি রাজা কল্মাষপাদ - আপনি এখুনি আমার রাস্তা ছাড়ুন।” লোকটি বলল — “আমি ঋষি শক্তি। আপনি নিজের রাজধর্মই জানেন না। আপনাকে রাস্তা ছাড়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।”
এইভাবে এদের ঝগড়া ক্রমশ বাড়তেই লাগল। শক্তি কিছুতেই সরে যাচ্ছেন না দেখে রাজা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তাকে কশাঘাত করে বসলেন। আর এই চাবুকের আঘাতের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে শক্তি রাজা কল্মাষপাদকে অভিশাপ দিয়ে বললেন — “তুই রাক্ষস হ - নরমাংস ভোজী রাক্ষস হ!”
পিকাই তার দাদাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ গোলগোল করে বলল — “সঙ্গে সঙ্গে সেই রাজা রাক্ষস হয়ে গেল?”
“প্রায় তাই ব্যাপার - কিন্তু পুরোপুরি তাই নয়,” — বললেন সুধীন। তারপর একটু থেমেই বললেন — “একটা মানুষ হঠাৎ রাক্ষস হয়ে গেল - ব্যাপারটার পিছনে অনেক ঘটনা থাকে পিকাইভাই। আর সেই জন্যে এই ঘটনার বেশ কিছুকাল আগেকার একটি জটিল ব্যাপারের কথা শোনো। যদিও এটা একটা একেবারেই আলাদা গল্প, কিন্তু ওই যে বললাম - একটা সাংঘাতিক ঘটনার পিছনে অনেক সময়েই পুরোনো কোনো ঘটনা থাকে - সেই হিসেবে এই গল্পটা বলতেই হচ্ছে। খুব মন দিয়ে শোনো।”
পিকাই জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো তার দাদাইয়ের মুখের দিকে। সুধীন বলতে শুরু করলেন — “মহামুনি বশিষ্ঠ ছিলেন ব্রহ্মার এক পুত্র। আর বিশ্বামিত্র ছিলেন এক বিরাট শক্তিশালী রাজা গাধির পুত্র। বিশ্বামিত্র রাজা হয়ে একবার মৃগয়ায় গেছেন তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে। মাঝপথে খিদে তেষ্টায় রীতিমতো বিপদে পড়ে এসে হাজির হলেন বশিষ্ঠমুনির আশ্রমে। কিন্তু একজন আশ্রমবাসী মুনি এতজনের খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করবেন কি করে? বশিষ্ঠমুনি কিন্তু তা পারলেন। কারণ তার কাছে ছিল এক আশ্চর্য গাভী নাম নন্দিনী। যার অসামান্য অলৌকিক ক্ষমতা। যার কাছে চাইলে সবকিছুই পাওয়া যায়। একে বলে কামধেনু। এর সাহায্যে রাজা ও তার সমস্ত সৈন্যসামন্তকে পেটপুরে খাওয়ালেন বশিষ্ঠমুনি।
রাজা বিশ্বামিত্র তো এই কামধেনুর ক্ষমতা দেখে তাজ্জব। উনি ওই কামধেনু নন্দিনীকে চেয়ে বসলেন। বশিষ্ঠমুনি আপত্তি করলে রাজা বিশ্বামিত্র জোর করে ওই নন্দিনীকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। তখন বশিষ্ঠ তার অতি প্রিয় নন্দিনীকে বললেন — “তুমি নিজের ক্ষমতায় নিজেকে রক্ষা করো।” এরপর হল এক সাংঘাতিক ব্যাপার। ওই কামধেনুর নিঃশ্বাস থেকে সৃষ্টি হতে লাগল হাজারে হাজারে সৈন্য। যাদের সঙ্গে তুমুল লড়াই হল বিশ্বামিত্রের সৈন্যবাহিনীর। শেষপর্যন্ত—” এই পর্যন্ত বলে সুধীন রায় তাকালেন তার ক্ষুদে শ্রোতাটির দিকে। এটা সুধীনের বলার একটা নিজস্ব কায়দা। কলেজে ক্লাস নেওয়ার সময়েও অনেক সময় তিনি ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে মাঝপথে থেমে যেতেন — তারা কতটা মন দিয়ে শুনছে বোঝার জন্য। সেই অভ্যেসটা এখনো রয়ে গেছে।
সুধীন রায়ের নাতি সৌজন্য রায় বারো বছরের ছোট্ট শ্রোতা হলে কি হয় - সে কিন্তু যথেষ্ট মনোযোগী - তাই সঙ্গে সে বলে উঠলো — “শেষ পর্যন্ত রাজা বিশ্বামিত্র যুদ্ধে জিতে ওই কামধেনুকে নিয়ে চলে গেলেন তার রাজ্যে।” সুধীন বললেন – “আদৌ না - বরং যুদ্ধে হেরে পালিয়ে বাঁচলেন। প্রচুর সৈন্যসামন্ত এমনকি তার ছেলেরাও ওই যুদ্ধে নিহত হল।” পিকাই আবার বলে উঠলো — “এটা কীরকম হল? একটা গোরুর কাছে হেরে গেল?” সুধীন হেসে বললেন — “একেই বোধহয় বলে গোহারান হারা।”
তারপর একটু থেমে বললেন — “এর পরের ব্যাপারটাই কিন্তু আসল। হেরে গিয়ে বিশ্বামিত্রের মনে হল - আমি এত বড়ো একজন ক্ষত্রিয় রাজা। কিন্তু আমার থেকে অনেক বেশি ক্ষমতা রাখে ওই জপতপ করা ব্রাহ্মণঋষি। এই ক্ষত্রিয় পরিচয় আমি ছুঁড়ে ফেলে ব্রাহ্মণ হওয়ার জন্য এখুনি তপস্যায় বসব। যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। শেষ পর্যন্ত অতি ঘোর তপস্যায় তিনি ব্রহ্মার বরে ব্রাহ্মণত্ব পেলেন।” এই পর্যন্ত বলে সুধীন একটু থামলেন।
“এইভাবে বিশ্বামিত্রও একজন বিরাট ঋষি হয়ে গেলেন। অথচ দ্যাখো এতবড় ঋষি হয়েও তার বশিষ্ঠের উপর সেই যে রেষারেষি জমেছিল তা এতটুকু কমল না। বশিষ্ঠ ছিলেন ইক্ষ্বাকু বংশের কুলোপুরোহিত। সেই হিসেবে রাজা কল্মাষপাদ তার যজমান।”
“যজমান মানে কি দাদাই?” — সুধীনের কথার মাঝেই জিজ্ঞেস করে বসল পিকাই।
“ঠিক প্রশ্ন করেছো পিকাইভাই। যাদের ঘরে গিয়ে তাদের বাড়ির পুরোহিতরা নিয়মিত যাজন, মানে পুজো-আচ্চা করেন, তারা হলেন ওই পুরোহিতের যজমান। আমাদের গল্পে বশিষ্ঠমুনি ইক্ষ্বাকু বংশের রাজাদের পুজো-আচ্চা যাগ-যজ্ঞে পুরোহিত হিসেবে থাকেন, তাই ওই বংশের রাজা কল্মাষপাদ তার যজমান।” এবার যা বলছিলাম শোনো — এই রাজা কল্মাষপাদকে যজমান হিসেবে পেতে বিশ্বামিত্রেরও ইচ্ছে ছিল। কল্মাষপাদ আর শক্তি যখন পরস্পর ঝগড়া করছিলেন সেখানে লুকিয়েছিলেন বিশ্বামিত্র। উনি এই পুরো ব্যাপারটার শেষ মুহূর্তটিকে নিজের স্বার্থে একেবারে লুফে নিলেন। কারণ বশিষ্ঠের সঙ্গে সেই পুরোনো বিরোধের জ্বালাটা তখনও তার মনে ধিকধিক করে জ্বলছিল।
এইবার তিনি রাজা কল্মাষপাদকে দিয়ে একটা সুযোগ পেয়ে গেলেন বশিষ্ঠের ক্ষতি করবার। তিনি জানতেন শক্তি বশিষ্ঠের পুত্র। তিনি শক্তির সঙ্গে কল্মাষপাদের এই ঝগড়ার মধ্যে খুব কৌশলে ঢুকে পড়লেন। যেই না কল্মাষপাদকে অভিশাপ দিয়েছেন — “তুই রাক্ষস হ!” অমনি বিশ্বামিত্র এই কথাটাকে নিজের কাজে লাগালেন। তার বিশেষ যোগবলে কিংকর নামে এক রাক্ষস রাজা কল্মাষপাদের ভিতর তখুনি প্রবেশ করল। আর তারই প্রভাবে কল্মাষপাদের অন্তরটি সঙ্গে সঙ্গে একেবারে বদলে গেল। কল্মাষপাদের সমস্ত চেতনা ওই রাক্ষসের বশে এসে গেছে তা নিশ্চিত হয়েই বিশ্বামিত্র সবার অলক্ষ্যে যেমন এসেছিলেন তেমনিভাবেই চলে গেলেন।
এবার ঘটল পরপর কয়েকটি ঘটনা। সেগুলো যেন সাজিয়ে রাখা ছিল কল্মাষপাদের ভবিতব্যের জন্য। এর প্রথমটা হল এই - ফেরার সময় তিনি ওই বনের মধ্যে এক ব্রাহ্মণের দেখা পেলেন। ব্রাহ্মণটি খিদেয় কাতর। রাজা কল্মাষপাদের কাছে একটু ভাত-মাংসের ভিক্ষা করলেন। কল্মাষপাদ বললেন — “এখানেই অপেক্ষা করুন। আমি আপনার খাবারের বন্দোবস্ত করে আনছি।”
এরপর দ্বিতীয় ঘটনা — রাজবাড়িতে এসে তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন ব্যাপারটা। মাঝরাতে যখন মনে পড়ল তখন রাজবাড়ির রাঁধুনিকে ডেকে বললেন — “ওই বনের মধ্যে এক ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণ খাবারের জন্য অপেক্ষা করছেন। এখুনি গিয়ে তাকে ভাতমাংস দিয়ে এসো।” রাঁধুনিটি ওই মাঝরাতে মাংসভাত কোথায় পাবে? সে এসে হাতজোড় করে জানালো সে কথা।
এইবার তৃতীয় এবং সবথেকে মারাত্মক ঘটনা — “তাহলে নরমাংস নিয়ে যাও যেখান থেকে পারো” — উন্মাদের মতো বলে উঠলেন রাজা কল্মাষপাদ। কারণ ভালোমন্দের বোধটা তার অন্তরের রাক্ষসের প্রভাবে আস্তে আস্তে উবে যাচ্ছে। রাজবাড়ির পাচক তখন বাধ্য হয়ে বধ্যভূমি থেকে মাংস নিয়ে তাই রেঁধে গিয়ে ব্রাহ্মণকে দিল।
এবার শেষ এবং চূড়ান্ত ঘটনা — ব্রাহ্মণ সেটি দেখামাত্রই রাগে আগুন হয়ে বলে উঠলেন — “আমায় নরমাংস পাঠানো? এতবড়ো স্পর্ধা! রাজা তুই নিজে নরমাংস খা!”
একে শক্তির অভিশাপ তার উপর এই ব্রাহ্মণের কথা একসাথে এসে কল্মাষপাদের চরম পরিণতি এনে দিল। এইবার কল্মাষপাদ তার ভিতরের রাক্ষসের বশে পুরোপুরিভাবে চলতে লাগল। সে শক্তির কাছে গিয়ে বলল — “আয় আগে তোকে শেষ করি।” বলেই কল্মাষপাদ নৃশংসভাবে হত্যা করল শক্তিকে। তারপর ভক্ষণ করল তাকে। শুধু শক্তি নয়, একে একে বশিষ্ঠের সবকটি পুত্রকেই নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল কল্মাষপাদ। কারণ সে তখন আর রাজা নেই, একটা নরমাংসভোজী পিশাচ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সর্বত্র।” — এতটা একটানা বলে একটু হাঁফিয়ে পড়লেন সুধীন। শরীরটাকে পিছনে একটু এলিয়ে দিয়ে বললেন — “কি বুঝলে পিকাইভাই?”
“কল্মাষপাদ যেই রাক্ষস হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে বশিষ্ঠমুনির ওকে বধ করা উচিত ছিল।” — খুব গম্ভীরভাবে বলল পিকাই। আজকাল সে মাঝে মাঝে বেশ ভারিক্কি চালে নিজের মতামত দেয়।
“শত্রুকে তিনি বধ করবেন? অসম্ভব। কারণ তিনি যে ‘বশিষ্ঠ’। অর্থাৎ যিনি বশ করেছেন এইসব হিংসা রাগ - তাই তো তার নাম বশিষ্ঠ।” — মৃদু হেসে উত্তর দিলেন সুধীন।
“তাহলে?”— চোখ বড়ো বড়ো করে তার দাদাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল পিকাই।
সুধীন রায় তার ডানহাতটি তার নাতি সৌজন্যের মাথায় আদর করে বুলিয়ে বললেন — “এইজন্যেই তো গল্পটা বলছি তোমায়। মন দিয়ে শোনো।”
“এই কল্মাষপাদের কি পরিচয়? ইনি এক অতি বিখ্যাত বংশের সন্তান। সেই বংশের নাম ইক্ষ্বাকু বংশ। এই বংশেই রামচন্দ্রের জন্ম। এই বংশের রাজাদের সূর্যবংশীয়ও বলা হত। অর্থাৎ এক অভিজাত পরিবারের রক্ত বইছে কল্মাষপাদের শরীরে। রাজা হিসেবে ইনিও যথেষ্ট নামজাদা ছিলেন। কিন্তু এত বড়ো মাপের মানুষ হয়েও তার মধ্যে একটা অশুভ শক্তির বীজ ছিল। যার জন্যেই তিনি এত সামান্য কারণে শক্তির গায়ে হাত তুলতে পেরেছিলেন।” — নাতির চোখে চোখ রেখে ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন সুধীন রায়।
“আর শক্তি কে? না মহামুনি বশিষ্ঠের পুত্র। নিজেও কত বড়ো জ্ঞানী। কিন্তু কি তুচ্ছ কারণে এমন অশান্তিতে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন। কারণ তার অহংবোধ। জ্ঞানী হয়েও এটিকে উনি ত্যাগ করতে পারেন নি। নিজের রাগের আগুনটাকে সামলাতে না পেরে নিজেই নিজের চরমতর সর্বনাশের কারণ হলেন।” —একইভাবে ধীরে ধীরে বলতে থাকলেন তিনি।
“আর এদের দুজনের অহংয়ের লড়াইয়ের মধ্যে কৌশলে ঢুকে পড়লেন বিশ্বামিত্র। কল্মাষপাদের ভিতর যে অশুভ শক্তির জায়গাটা ছিল সেখানে সহজেই ঢুকিয়ে দিলেন এক রাক্ষসকে যে তাকে রাতারাতি বদলে দিয়ে একটা মানুষের চেহারায় পিশাচ করে ফেলল। অর্থাৎ রাজা কল্মাষপাদ নিজের চরিত্র থেকে একেবারে সরে গিয়ে পুরোপুরি অন্য প্রকৃতির মানুষ হয়ে সর্বত্র ভয়ঙ্কর রূপে দাপিয়ে বেড়াতে লাগলেন। এইভাবে বিশ্বামিত্র নিজেকে পিছনে রেখে অন্যের মাধ্যমে চিরশত্রু বশিষ্ঠের সর্বনাশটি করালেন। অতএব কল্মাষপাদের রাক্ষস হওয়ার ব্যাপারে কত জটিল হিসেব রয়েছে বুঝতে পারলে তো?” — আবার একটানা বলে একটু থামলেন ওই সত্তরোর্ধ বৃদ্ধটি। তখন তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল তার বারো বছরের নাতিটি। তার দাদাইয়ের প্রতিটি কথা সে যেন চোখ বড়ো বড়ো করে গিলছিল।
এইবার বশিষ্ঠমুনির কি অবস্থা হল ভাবো তো! তিনি যখন জানলেন যে তার প্রতিটি পুত্রকেই বিশ্বামিত্র এমন সূক্ষ্ম কৌশলে আর এত নিষ্ঠুরভাবে রাক্ষস দিয়ে হত্যা করিয়েছেন তখন তিনি শোকে যেন পাথর হয়ে গেলেন। এত সত্ত্বেও তিনি কিন্তু বিশ্বামিত্রকে ধ্বংস করার কথা ভাবলেন না। বরং নিজেই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার জন্যে পাগলের মতো একের পর এক কাজ করে যেতে লাগলেন। কিন্তু প্রতিবারই কোনো না কোনো আলৌকিক কারণে তিনি বেঁচে যেতে লাগলেন। সুমেরু পর্বতের উপর থেকে ঝাঁপ দিলেন কিন্তু তাঁর শরীর যেন তুলোর স্তূপের উপর আছড়ে পড়লো। এরপর জ্বলন্ত আগুনে লাফিয়ে পড়লেন। সে আগুন তাঁকে স্পর্শ করল না। তিনি গভীর সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন। সমুদ্রের ঢেউ তাঁকে তীরে ঠেলে দিল। সারা শরীরে আষ্টেপৃষ্ঠে লতাপাতা বেঁধে একটি নদীর তীব্র স্রোতে নিজেকে ফেলে দিলেন। সেই নদী তখুনি তার স্রোতের ধাক্কায় বশিষ্ঠের শরীরে জড়ানো সমস্ত লতাপাতাগুলো খুলে কূলে উঠিয়ে দিল। এইভাবে বশিষ্ঠকে পাশমুক্ত করার জন্য নদীটির নাম হল ‘বিপাশা’। এর পরেও বশিষ্ঠ একটি কুমীর আর সাপে ভরা ভয়ঙ্কর নদীতে ঝাঁপ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে নদীটি শতগুণে তার বেগ বাড়িয়ে বশিষ্ঠকে তীরের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। সেই জন্য এই নদীর নাম হল শতদ্রু।
“উরিব্বাস! – এই সব নদীর নাম এইভাবে হয়েছিলো!” নিজেই চোখ বড়ো বড়ো করে বলল পিকাই।
সুধীন হাসিমুখে তার নাতির ওই অবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন নিজেই, “শুধু নদী নয়, আমাদের পুরাণে আর মহাভারতে যত রাজ্যের পাহাড়-পর্বত-বন-জঙ্গল-রাজা-রাজড়া সব্বার নামের পিছনে এরকম কোনো না কোনো গল্প জুড়ে আছে নিজেই সে বিষয়ে তোমায় অন্য একদিন বলবো’খন।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ - তুমি বশিষ্ঠের কি হোলো তাই বলো।” — বলল পিকাই।
“এইভাবে বশিষ্ঠ বারবার ব্যর্থ হয়ে যখন নিজের আশ্রমে ফিরে চলেছেন, তখন তার অজ্ঞাতে একটি মেয়ে তার পিছু পিছু চলতে লাগল। নির্জন বনের মধ্যে বশিষ্ঠ হঠাৎ শুনতে পেলেন কে যেন বেদগান গাইছে — সে গানের যেমন সুরেলা গলা তেমন নিখুঁত উচ্চারণ। বশিষ্ঠ অবাক হয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেলেন সেই মেয়েটিকে “কে মা এতো সুন্দর করে বেদগান গাইছে - কাউকে তো আশেপাশে দেখছি না--” নিজের মনেই বললেন তিনি।
মেয়েটি মাথা নীচু করে বলল — “এত বড়ো আঘাত পেয়েছেন আপনি যে জগতের অনেক কিছু ভুলে গেছেন। তাই আমি যে আপনার পুত্র শক্তির বিধবা স্ত্রী অদৃশ্যন্তী তাই চিনতে পারলেন না।”
বশিষ্ঠ অবাক হয়ে তাকালেন সেই মেয়েটির দিকে। তারপর বললেন — “তাহলে বেদ পাঠ করছে কে?”
মেয়েটি আগের মতোই মাথা নীচু করে বলল — “আমার সন্তান - যে এখনো আমার শরীরের মধ্যেই রয়েছে - এখনো পৃথিবীর আলো দেখে নি - সেই বেদপাঠ করছে।”
“বশিষ্ঠ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন ওই অদৃশ্যন্তী নামের মেয়েটির দিকে। তারপর বললেন — “মা! তুমি আমার সঙ্গে এসো,” — বলে ধীর পায়ে চলতে শুরু করলেন তার আশ্রমের দিকে। ততক্ষণে তার মনের মধ্যে বিরাট তোলপাড় হয়ে গেছে। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ভাবনা ছুড়ে ফেলে তখন তিনি ঠিক করে নিয়েছেন তার ভবিষ্যতের পথটা।” ...বিশ্বসংসার থেকে পালিয়ে না যাওয়ার চেষ্টা করে বরং এই যে শিশুটি জন্মাতে চলেছে তাকে নিয়েই তার মৃতপুত্র শক্তির অভাব মেটাবেন... অতএব এবার থেকে একেবারে নতুন উদ্দেশ্যে বাঁচতে হবে...” — এইসব ভাবতে ভাবতে বশিষ্ঠ ঘন বনের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তার আশ্রমের দিকে। হঠাৎ চমকে উঠলেন অদৃশ্যন্তীর চিৎকারে — “দেখুন! সামনে দেখুন! সেই ভয়ঙ্কর রাক্ষসটা!”
বশিষ্ঠ সামনে তাকিয়ে দেখতে পেলেন উলটো দিক থেকে তাদের কাছে ধীরে ধীরে পা ফেলতে ফেলতে এগিয়ে আসছে সেই রাক্ষস-হয়ে যাওয়া কল্মাষপাদ! মুখে তার হিংস্র হাসি! চোখদুটিতে বীভৎস আক্রোশ! অদৃশ্যন্তী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলো — “ওই তো সেই রাক্ষস! যে আমার স্বামীকে মেরে পিশাচের মতো খেয়ে ফেলেছে! এবার কি হবে? ও তো আমাদের সবাইকে মেরে খেয়ে নেবে এখুনি! কিভাবে পালাবো এবার?” বশিষ্ঠ একবার অদৃশ্যন্তীর দিকে আরেকবার সেই ভয়ঙ্কর মূর্তির দিকে তাকিয়ে বললেন — কোথায় রাক্ষস? আমি তো কোনো রাক্ষস দেখছি না।” বলেই সোজা এগিয়ে গেলেন সেই রাক্ষুসে কল্মাষপাদের দিকে। সেই দেখে কল্মাষপাদ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। আর তখনই বশিষ্ঠমুনি--” — বলে নাতি পিকাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন সুধীন রায়।
পিকাই জানে তার দাদাই মাঝে মাঝে গল্পের এইরকম চূড়ান্ত মুহূর্তে এসে থেমে গিয়ে তার দিকে তাকিয়ে যেন চোখের চাউনিতে জিজ্ঞেস করে — “এরপর বলো তো?”
“বশিষ্ঠমুনি বললেন, 'থামো - একবারে থেমে যাও।' — আর তখনই কল্মাষপাদ পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।” — চোখ বড়ো বড়ো করে হাত-পা নেড়ে বলল সুধীন রায়ের বারো বছরের নাতি সৌজন্য।
সুধীন হৈ হৈ করে বলে উঠলেন — “অপূর্ব! অপূর্ব বলেছো পিকাইভাই!” এটাও সুধীন রায়ের আরেকটি কায়দা। নাতিকে গল্প বলতে বলতে একটা মোক্ষম জায়গায় এসে ইচ্ছে করে ছেড়ে দেন — ‘এরপর কি হতে পারে বলোতো’ — যাতে তার কল্পনাশক্তি বাড়তে পারে। প্রায় সবসময়েই পিকাই যা বলে তার সঙ্গে মূল গল্পের কোনো মিল থাকে না। এইভাবে নাতিকে প্রচুর দেশবিদেশের গল্প শুনিয়েছেন তিনি। পিকাইও খুব মজা পায় গল্পের এই খেলায়।
“কিন্তু পিকাইভাই, বশিষ্ঠমুনি তো তা করলেন না - তিনি সোজা এগিয়ে গেলেন কল্মাষপাদের দিকে - তারপর তার চোখে চোখ রেখে শান্তকন্ঠে বললেন — 'রাজা কল্মাষপাদ! তুমি আত্মবিস্মৃত হয়েছো! ভুলে গেছো তুমি কি ছিলে! তোমার চেতনা ফিরে আসুক! আবার রাজার মতো নিজেকে ফিরে পাও' — বলেই মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে দিলেন তার দিকে। আর সেই জলের স্পর্শ পেতেই কল্মাষপাদের মনে পড়ে গেল সব পুরোনো কথা। মনে পড়ে গেল কিভাবে অতি তুচ্ছ কারণে তিনি নিজেকে একটা অশুভ জগতে ঠেলে দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কল্মাষপাদ যেন অন্যচরিত্র হয়ে গেলেন। হাত জোড় করে বললেন — 'আমি সৌদাস। আপনার যজমান। আমায় মাফ করে দিন প্রভু। আপনি যা বলবেন তাই করার জন্য আমি প্রস্তুত।'
"বশিষ্ঠ বললেন — 'যাও কল্মাষপাদ - নিজের রাজ্যে ফিরে যাও - মন দিয়ে রাজকার্য কর - প্রজাদের যত্ন নাও - আর জীবনে কখনো এমন অন্যায় কাজ কোরো না।'"
এই পর্যন্ত বলে সুধীন তার প্রিয় রিভলভিং চেয়ারটায় পিঠটা ঠেকিয়ে হাতের সামনে রাখা মৌরির কৌটো থেকে এক চিমটি মৌরি মুখে নিয়ে সৌজন্যের দিকে তাকালেন। গল্প বলা শেষ করে এটাই সুধীন রায়ের অতি পরিচিত ভঙ্গী। সুধীন রায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তার নাতির দিকে। কারণ সে এখন গল্পের শেষে বিজ্ঞের মতো নিজের মতামত দেয়।
“কি মানে হল এটার?” — দুহাত উল্টে তার দাদাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল সে।
সুধীন রায় এবার তার নাতির মুখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বললেন, “ডিভিয়েন্ট।”
তারপর একটু থেমে বললেন — “ডিভিয়েন্ট কথাটার মানে জিজ্ঞেস করছিলে না? এই কল্মাষপাদ হল এক ডিভিয়েন্ট। মানে খুব সোজাভাবে বলতে গেলে — পথছুট। যে কিনা নিজের যাওয়া উচিত যে পথে সে পথে না গিয়ে অন্য রাস্তায় চলে যায় - যা কখনোই তার পক্ষে আর তার আশেপাশের মানুষদের জন্যে ভালো নয়।”
“কিন্তু এই বেপথে চলে যাওয়ার ব্যাপারে বাইরের কিছু মানুষ থাকে — যেমন কল্মাষপাদের বেলায় বিশ্বামিত্র। তারা এই ভুল রাস্তায় চলা মানুষকে আরো ভুলের পথে ইন্ধন দেয়। এইভাবেই তৈরি হয় এক একটা অন্ধকার-পথে-চলে-যাওয়া মানুষ, যেমন এই কল্মাষপাদ। আজকাল একেই বলে — ‘ডিভিয়েন্ট’। এদেরকে আলাদা করে দিয়ে শাস্তি দিয়ে মূল সমস্যার সমাধান হয় না। এদেরকে এদের নিজেদের জীবনের রাস্তায় ফিরিয়ে আনাটাই সঠিক কাজ। যেমন বশিষ্ঠমুনি করলেন। কি বুঝতে পারলে পিকাইভাই?” — নাতির মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন সুধীন রায়।
“কিন্তু আজকাল বশিষ্ঠমুনির বড় অভাব — সবাই বিশ্বামিত্র হতে চায়। তাই কল্মাষপাদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে।” — তারপর মাথাটা নীচু করে নিজের হাতের আংটিটার দিকে আনমনে তাকিয়ে খুব আস্তে করে নিজের মনেই বললেন কথাটা।
“এ কেমন হল? কল্মাষপাদের তো কোনো শাস্তিই হল না - এ গল্পটা ভালো?" — কথাটা বলেই সুধীনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো তার বারো বছরের নাতি সৌজন্য।
“গল্পটা তো এখানে শেষ হয়নি পিকাইভাই।” — বললেন সুধীন।
“সে কি? – এরপর আরও আছে? – বল বল” - চোখ বড়ো বড়ো করে বলল পিকাই।
“মহাভারতের গল্প তো - তাই ওইভাবে কিছুই শেষ হয় না - একটা গল্পের ভিতর আরেকটি গল্প পুরে দেওয়া থাকে। এই যে কল্মাষপাদ চলে গেলেন নিজের রাজ্যে - কিন্তু এরপর কি হল - ওই যে তুমি একটু আগেই বললে না - ‘কি মানে হল এটার?’ সেই ‘মানে’টার একটা আভাস আছে পরের ঘটনায়।” — সুধীন বলতে শুরু করলেন — “এরপর অদৃশ্যন্তীর সেই পুত্রের জন্ম হল। পুত্রের নাম পরাশর। ‘পরাশু’-অর্থাৎ জীবন বিসর্জন করতে যাওয়া পিতামহকে সেই শিশু ঘরমুখো করল। আর সেই শিশুপুত্র বশিষ্ঠমুনিকেই নিজের বাবা ভেবে বড় হতে লাগল। কোনো একসময়ে অদৃশ্যন্তী বলে দিলেন — “পুত্র তুমি যাকে পিতা বলে জানো তিনি কিন্তু তোমার পিতা নন - পিতামহ। তাই তুমি এবার থেকে ওনাকে আর পিতা বলে ডেকো না।” কিশোর পরাশর বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো — “তাহলে আমার পিতা কোথায়?” তখন অদৃশ্যন্তী বলতে বাধ্য হলেন কল্মাষপাদের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটি। সমস্ত ব্যাপারটা শুনে পরাশর যেন রাগে অন্ধ হয়ে গিয়ে বলল — “আমি এর উপযুক্ত প্রতিশোধ নেবই- আমি রাক্ষসসত্র যজ্ঞ করব।” — সুধীন বলতে লাগলেন তার নিজস্ব ভঙ্গিতে আর তার সৌজন্য শুনতে থাকলো হাঁ করে।
“আর রাক্ষসসত্র যজ্ঞ মানে কি জানো? তোমায় যে আগে সর্পসত্র যজ্ঞের কথা বলেছিলাম মনে আছে? জনমেজয় রাজা করিয়েছিলেন সমস্ত সর্পকুলকে ধ্বংস করার জন্য এও হুবহু সেরকম। যজ্ঞ শুরু হওয়ার সাথেসাথেই শয়ে শয়ে রাক্ষস এসে পড়তে লাগল সেই যজ্ঞের আগুনে। ফলে শুরু হল এক ভয়ানক মারণযজ্ঞ।” — বলতে থাকলেন সুধীন।
“আরেব্বাস! এ তো ঠিক সেই সর্পসত্রের মতো!” — সুধীনের দিকে তাকিয়ে বড়ো বড়ো চোখ করে বলল সৌজন্য।
“এক্কেবারে ঠিক ধরেছো। দারুণ স্মৃতিশক্তি তোমার। আর ঠিক সেই সময়েই পুলোমা আর কয়েকজন বিশিষ্ট রাক্ষস যারা রাক্ষসকুলে অতি সম্মানিত তারা পরাশরের কাছে এসে উপস্থিত হয়ে বললেন — “এ কি ভয়ানক কাজ করছো তুমি? তোমার এই কাজের জন্য কত নিরীহ রাক্ষস মারা পড়েছে জানো? – যাদের তোমার বাবার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই - ভেবে দেখো তো তোমার বাবা যে ভয়ঙ্কর অভিশাপটা দিয়েছিলেন সেটাই ঘুরে এসে তার মৃত্যুর কারণ হয়েছিল কিনা - সেই কল্মাষপাদ তো কবেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন - আর তুমি যে কিনা রাগ-শোক জয় করা ক্ষমাধর্মের শেষকথা মহামুনি বশিষ্ঠের নাতি - এই বিরাট হত্যার যজ্ঞ করছো - এ যজ্ঞ এখনই বন্ধ কর।”
“এ বাবা! এ তো ঠিক সেই আস্তিকমুনির গল্প! — পিকাইয়ের বিস্মিত মন্তব্য।
“অপূর্ব! অসামান্য! তোমার মনে রাখার ক্ষমতা! হ্যাঁ। ঠিক জনমেজয়ের সর্পসত্রের মতো এই পরাশরের রাক্ষসসত্র যজ্ঞ থেমে গেল তখনই। যজ্ঞের আগুন নিভিয়ে পরাশর উঠে পড়লেন।” — চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন সুধীন।
“যাহ্। তাহলে এত কাণ্ড আবার সব জলে গেল!” — খুব বিজ্ঞের মতো গম্ভীরভাবেই বলল পিকাই।
“নাহ্। - ‘জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা’ - কথাটার মানে তুমি বড় হয়ে বুঝবে পিকাইভাই। জলে কিছুই যায় নি। বশিষ্ঠের এই অকল্পনীয় ক্ষমা, শক্তির ওই দারুণ অপমান আর পরাশরের সেই ভয়ঙ্কর ক্ষোভ কি জলে যেতে পারে? এরপর এইসব রাগ-দুঃখ-ক্ষমা রক্তে নিয়ে জন্মালেন এক অসামান্য প্রতিভার মানুষ — নাম তার কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। এইসব গল্পকথা কুড়িয়ে নিয়ে জড়ো করে বানালেন এক বিরাট ভাণ্ডার। এতে তার নিজের জীবনের অন্ধকার দিকের কথাও বাদ গেল না। সৃষ্টি হল পৃথিবীর এক চিরকালের আশ্চর্য গ্রন্থ — মহাভারত। ক্ষত্রিয় রাজাদের চরম দুরাচার, ব্রাহ্মণ ঋষিদের বিপুল অহংকার - কিভাবে সময়ের স্রোতে কোথায় ভেসে যায় সে কথা সব লিখে গেলেন অসংখ্য কাহিনীর মোড়কে।”
“এইগুলো সেই গল্প?” — পিকাই প্রশ্ন করল তার দাদাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে।
“ঠিক বলেছো। সত্যিই তুমি বুদ্ধিমান। আর যে এইসব গল্পকথা শোনে সে হল – পুণ্যবান’। অর্থাৎ--" বলে সুধীন রায় ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে তাকালেন তার নাতি পিকাইয়ের দিকে। পিকাই সঙ্গে সঙ্গে একলাফে সুধীন রায়ের বিছানার উপরে দাঁড়িয়ে উঠে নিজের বুকের উপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করে মুখ তুলে বলে উঠলো — “পুণ্যবান! সৌজন্য পুণ্যবান!”
ঠিক তখনই পিকাইয়ের দাদাই হো হো করে হাসতে হাসতে দুহাতে জড়িয়ে ধরল তাকে।