• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৬ | সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • সোনার গোপাল রহস্য : রূপা মণ্ডল



    (১)

    আবার দীর্ঘদিন একঘেয়ে ক্লান্তিকর জীবন যাপনের পর অর্কর মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতেই ওর বাবা ঘোষণা করলেন "চলো, বেরিয়ে পড়ি। শ্রী জগন্নাথ ধাম বারেক আসিব ফিরি।"

    এবারের গন্তব্য পুরী, জগন্নাথ ধাম। অর্কর বাবা ও মা আগে পুরীতে গেলেও অর্ক তখন খুবই ছোট ছিল। ওর প্রায় কিছুই মনে নেই। শুধু সমুদ্র গর্জনের শব্দ শুনে ওর কান্নার আবছা স্মৃতিটুকু ছাড়া।

    অর্কর মনটা ভীষণ খুশিতে ভরে গেল। পরদিন থেকে সে তার ব্যাকপ্যাকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে শুরু করল। বাবার বাতিল করা মোবাইল ফোনে গুগলে সার্চ করতে লাগল পুরীর আশেপাশে কি কি সাইট সিয়িং করা যেতে পারে। মাঝে মাঝে দেখতে লাগল টিকিটগুলো আর. এ. সি. থেকে কনফার্ম হয়েছে কি না।

    অর্কর মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে থেকেই অর্কর বাবা ট্রেনে রিজার্ভেশন করেই রেখেছিলেন। টিম সেই আগের মতই— অর্কর বাবা ও মায়ের সাথে অর্ক আর অর্কর জেঠু-জেঠিমার সঙ্গে পুঁটি ওরফে পূবালী। হাওড়া থেকে শ্রী জগন্নাথ এক্সপ্রেসে থার্ড এ. সি.-র টিকিট কাটা আছে অর্কদের জন্য এবং জেঠু-জেঠিমার সঙ্গে পুঁটি উঠবে খড়্গপুর স্টেশন থেকে।


    (২)

    ২৩ শে মার্চ সন্ধ্যাবেলায় অর্করা হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠল। ট্রেন ছেড়ে দিল সন্ধে সাতটা পাঁচে। মৃদু দুলুনির সাথে সরে সরে যাওয়া আলো, রাস্তা, জনপদ দেখতে দেখতে অর্ক অনুভব করল ট্রেন ছুটতে শুরু করেছে। কোথাও রেলগেটের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো সাইকেল, বাইক ও গাড়ি। কোথাও আবার নিকষ কালো অন্ধকার।

    দু'জন অবাঙালি ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা গোটা দুয়েক ট্রলি ব্যাগের সঙ্গে বেশ কিছু লাগেজ এবং দুটি শিশুকে নিয়ে হেঁটে গেলেন ওদের সামনে দিয়ে। ভদ্রমহিলার হাতে আবার পিতলের সাজিতে একটা গোপাল ঠাকুর। তিনি দু'হাতে সেটাকে বুকের কাছে ধরে রেখেছেন। তাঁর দুই কাঁধ দিয়ে দুটো ব্যাগ ঝুলছে।

    পিতলের সাজির মধ্যে গোলাপী রঙের তোশক বালিশে ঠেসান দিয়ে বসে আছে। খুব চকচকে। একটা হাত মুখের কাছে ধরা। যেন এক্ষুনি একটা লাড্ডু খেয়েছে।

    জেঠু-জেঠিমার সাথে পুঁটির সিট হয়েছে ৩৬, ৩৭, ৩৮শে। আর অর্করা সিট পেয়েছে ৪৯, ৫০, ৫১য়। ৪৪, ৪৫, ৪৬ আর ৪৮ ওই অবাঙালি পরিবারের চারজনের সিট। ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোক অর্কদের সামনের সিটে পাশাপাশি বসে এখন একটা বড়সড় শপিং ব্যাগের ভেতর থেকে নানা রকম খাবারের কন্টেনার বের করেছেন। ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোকের মাঝখানে সিটের উপর গোপাল ঠাকুরের সাজিটা রাখা রয়েছে। ফলে বাচ্চা দুটিকে বেশ চেপেচুপে বসতে হয়েছে।

    ভদ্রমহিলা কন্টেনার থেকে খাবার বের করে করে কাগজের প্লেটে সাজিয়ে সার্ভ করলেন। খাবারের সুগন্ধে অর্কর ক্ষিদেটা এক লাফে বেড়ে গেল। সে খুব মনোযোগ দিয়ে একটা বই নিয়ে চোখের দৃষ্টি আড়াল করল ওদের দিক থেকে।

    খাওয়া দাওয়া মিটে যেতেই ভদ্রমহিলা তাঁর মোটাসোটা চেহারা নিয়ে অনেক কষ্টে সাইড আপার বার্থে উঠলেন, সঙ্গে গোপালও উঠল। সাজির মধ্যে গোপাল ঠাকুর এখন ছোট্ট মশারি ঢাকা।


    (৩)

    মেচেদা স্টেশনের কাছে আসবার আগেই অনেকে রাতের খাবার খেয়ে নিতে শুরু করে দিল। কিন্তু অর্কদের খাবার সাথে নিয়ে আসবেন জেঠু-জেঠিমা, তাই ওরা অপেক্ষা করছে। সঙ্গে অবশ্য বিস্কুট, চিঁড়েভাজার প্যাকেট আছে, কিন্তু সেসব খেতে ইচ্ছা করছে না। মেচেদা স্টেশনে একজন ফেরিওয়ালা গরম সিঙাড়া নিয়ে উঠেছিল কিন্তু বাবা কিনতে চান নি পেটের সমস্যা হতে পারে বলে।

    অবশেষে খড়্গপুর স্টেশনে ট্রেন এসে পৌঁছাল রাত্রি ন'টায়। ট্রেন একটু লেট আছে। জেঠু-জেঠিমার সঙ্গে পুঁটি উঠল ট্রেনে। নিজেদের ব্যাগ ট্যাগ ঠিক করে রেখে তারপর খাবার বের করা হ'ল - লুচি, আলুর দম এবং কালাকাঁদ সন্দেশ। অনেক দিন পর ঠাকুমার হাতের রান্নার স্বাদ পেল অর্ক। পুঁটি অর্কর প্লেট থেকে একটা সন্দেশ তুলে খেয়ে নিল। অর্ক ওর ঝুঁটিটা ধরে একটু নেড়ে দিল।

    ক্ষিদেটা কতটা পেয়েছিল অর্ক খাওয়ার শেষে তা বুঝতে পারল। খাবার যেন এক নিঃশ্বাসে পেটে চলে গেছে। পেট ভরে খাওয়ার পর অর্কর ভীষণ ঘুম পেতে লাগল। চোখ যেন জুড়ে আসছে। অর্ক আপার বার্থে উঠে পড়তেই সবাই যে যার বার্থে চাদর পেতে বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়ল।


    (৪)

    ট্রেনের দুলুনিতে অর্কর ঘুম আসে না, কিন্তু আজ কি হয়েছে কে জানে, দু'চোখের পাতা সে মেলে রাখতে পারছে না। বোধহয় অনেকখানি জার্নির জন্যই।

    জলেশ্বর স্টেশন আসবার কিছু পরেই তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সিগন্যাল না পেয়ে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। অর্ক ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য আপার বার্থ থেকে নেমে এসে দেখল সবাই ঘুমের অতলে কিন্তু লোয়ার বার্থে সেই অবাঙালি ভদ্রলোক মোবাইল ফোনে কি যেন দেখছেন আর মাঝে মাঝে হাসছেন।

    ওয়াশরুম থেকে ফেরার সময়েও সে দেখল লোকটা নীচু গলায় কারো সাথে কথা বলে চলেছে আর মাঝে মাঝে হাসছে। ভদ্রমহিলা কিন্তু সাইড আপার বার্থে গোপাল ঠাকুরের সাজিটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন। অর্কদের বিপরীতে মিডল এবং আপার বার্থে ঘুমোচ্ছে বাচ্চা দুটি।

    অর্কর বাবা, মা যথাক্রমে লোয়ার ও মিডল বার্থে ঘুমে আচ্ছন্ন। অর্ক কসরৎ করে তার আপার বার্থে উঠে পড়ল। কিন্তু একবার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় তার সহজে ঘুম আসছে না। অর্ক মোবাইল ফোনে দেখল রাত্রি এগারোটা - বাড়িতে হলে এত তাড়াতাড়ি শোয় না, কিন্তু ট্রেনে খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।

    ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে। অর্ক আবার ঘুমানোর চেষ্টা করল।


    (৫)

    আবার ট্রেন থেমে গেছে। 'গরম চা' বলতে বলতে ফেরিওয়ালা হেঁকে যাচ্ছে। অর্ক উঠে বসতে গিয়ে দেখল ঘাড় সোজা করে বসা যাচ্ছে না। তাই নীচে নেমে পড়ল। একটু চা খেলে মন্দ হ'ত না, কিন্তু চা-ওয়ালা কোন দিকে চলে গেছে আর দেখতে পেল না।

    লোয়ার বার্থে সেই লোকটা এখনও মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘুমায় নি। সারা রাত ঘুমোয় না নাকি লোকটা? অর্কর ভীষণ অবাক লাগল।

    এটা ভদ্রক স্টেশন। স্টেশনে অল্প কিছু যাত্রী প্ল্যাটফর্মে যাতায়াত করছে। দু'জন যাত্রীর মধ্যে কি নিয়ে যেন বচসাও বেধে গেছে। ওরা উড়িয়া ভাষায় কথা বলছে। অর্ক দরজার কাছ থেকে চলে আসছিল। বার্থে উঠার আগে শুনতে পেল অবাঙালি লোকটা বলছে, "অবভিয়াসলি অরিজিনাল। আই হ্যাভ চেকড প্রপারলি। নো নো, নো চান্স অব ডুপ্লিকেট।"

    অদ্ভুত লোক। সারাক্ষণ ফোনে ব্যস্ত রয়েছে। একটুও ঘুমায় না।

    অর্ক নিজের বার্থে উঠে শুয়ে পড়ল। ট্রেন এখন খুব জোরে দৌড়চ্ছে। অর্ক লোকটার কথাগুলো আর শুনতে পাচ্ছিল না। খুব নিচু স্বরে কথা বলছে। অর্ক একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল।


    (৬)

    গায়ে কেউ চাদরটা ঠিক করে দিচ্ছে অনুভব করে অর্কর ঘুম ভেঙ্গে গেল। ওর মা উঠে পড়েছে। বাইরে ভোরের আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সাক্ষীগোপাল স্টেশন আসছে সামনেই। এখন উপর আর মিডল বার্থ থেকে সবাই এসে আবার লোয়ার বার্থে বসেছে। অবাঙালি ভদ্রমহিলা বোধহয় ওয়াশরুমে বা মুখ ধুতে গেছেন। ভদ্রলোক একহাতে পেতলের সাজি এবং অন্য হাতে মোবাইল ফোন নিয়ে বসে আছেন। ফুটফুটে বাচ্চা দুটি নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করছে।

    জানালার বাইরে গাছগাছালি আর তার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যরশ্মি দ্রুত গতিতে পিছনে ছুটে চলেছে। সামান্য কুয়াশাও আছে কি? জানালার কাঁচের বাইরে সব কিছু একটু ঝাপসা লাগছে। সবাই ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে ট্রেনের দরজার দিকে এগোচ্ছে দেখে অর্করাও প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।

    সাক্ষীগোপালের পরের স্টেশনই পুরী। অবাঙালি ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা তাঁদের ব্যাগপত্র, সাজি সমেত গোপাল এবং সন্তান দুটিকে নিয়ে একটু একটু করে এগোবার চেষ্টা করছেন।


    (৭)

    অর্করা স্টেশনে নেমে দেখল প্রচণ্ড ভীড়। স্টেশনের বাইরে বেরোতে অনেকটা সময় লাগল। হোটেল থেকে গাড়ি পাঠিয়েছিল। স্বর্গদ্বারের কাছে একদম সী ফেসিং সুন্দর হোটেল। তিনতলায় পাশাপাশি ঘর পেয়েছে ওরা। অর্ক আর পুঁটির ভীষণ পছন্দ হয়েছে নিজেদের ঘর দুটি। সামনে টানা বারান্দা। বারান্দায় বসে সমুদ্র দেখা যায়, প্রচুর লোক স্নান করছে, সী-বীচের উপর থিক থিক করছে লোকজন। সামনের রাস্তা দিয়ে প্রচুর গাড়ি যাতায়াত করছে। এক কথায় ভীষণ জমজমাট জায়গা।

    যে যার ঘরে ঢুকে স্নান সেরে হোটেলের রেস্টুরেন্টে জলখাবারের অর্ডার দিয়ে দিল। রেস্টুরেন্ট থেকে মিনিট পনেরো পরেই রুমের ইন্টারকমে ফোন করে জানালো যে খাবার রেডি আছে। অর্করা রেস্টুরেন্টের দিকে চলল। তিনতলা থেকে লিফটে উঠল ওরা। লিফটের এক দিকে কাঁচ লাগানো। সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। নীচে নেমে কিছুটা হেঁটে গিয়ে রিসেপশনের সামনে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বাঁদিকে দোতলায় উঠলেই খাবার ঘর। অর্করা রিসেপশনের সামনের সাজানো বাগানটার দিকে চোখ রেখে এগোচ্ছিল। হঠাৎ অর্ক লক্ষ্য করল সেই ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা রিসেপশনের ভিতরে দাঁড়িয়ে আছেন।

    ব্যাপারটা অর্কর বাবারও নজরে এসেছে, তিনি বলে উঠলেন, "আরে, ওরাও এখানে এসেছে। ভদ্রমহিলা তো গোপাল ছাড়া এক পা চলেন না দেখছি। এখানে তো আমিষ খাবারও পাওয়া যায়, গোপালের অসুবিধা হবে না তো?"

    সবাই হাসতে হাসতে খাবার ঘরের দিকে চলল।


    (৮)

    গরম গরম পরোটার সাথে সুন্দর একটা তরকারি। সবাই বেশ তৃপ্তি করেই খেল। তারপরে ঘরে গিয়ে তৈরি হয়ে সমুদ্র স্নানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। সমুদ্রের ধারে ভীষণ ভীড়, কেউ ডাব খাচ্ছে, কেউ স্নান করছে, কেউ উটে চড়ছে, কেউ আবার ছাতার তলায় চেয়ার ভাড়া নিয়ে বসে আছে।

    অর্করা একজন ডাবওলার দিকে এগিয়ে গেল। চড়া রোদে সবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ডাব খেতে খেতেই অর্ককে পুঁটি বলল, "ওই দ্যাখ দাদা, সেই আন্টি, গোপাল নিয়ে আসছে।"

    আশ্চর্য ব্যাপার, ভদ্রমহিলা খাওয়া, শোওয়া, স্নান করা কোন সময়েই গোপাল ঠাকুরকে কাছ ছাড়া করেন না। বাচ্চা দুটি ভদ্রলোকের হাত ধরে আগে আগে হাঁটছে। পিছনে সাজি হাতে গোপাল সমেত ভদ্রমহিলা আসছেন। ওদের পাশ দিয়েই ওরা সমুদ্রের দিকে চলে গেল।

    অর্করা ডাবের খোসা ফেলে দিয়ে সমুদ্রে নামার জন্য তৈরি হ'ল। বড় বড় ঢেউ তটে আছড়ে পড়ছে। ঢেউয়ের টানে বেসামাল হয়ে উল্টে পড়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। অর্করা একে অপরকে শক্ত হাতে ধরে জলে নামল। তট থেকে একটু দূরে ঢেউ পার হয়ে জলের মধ্যে স্নান করলে গায়ে বেশি বালি লাগে না। অর্ক বাবা আর জেঠুর সাথে সেখানে গিয়ে স্নান করল। পুঁটি অর্কর মা আর জেঠিমার সাথে পারের কাছেই রইল।


    (৯)

    স্নান সেরে উঠে এসে অর্ক দেখল পুঁটি বালি দিয়ে একটা শিবলিঙ্গ গড়েছে। বেশ সুন্দর বানিয়েছে সেটা। কিন্তু ছবি তোলার জন্য কোন মোবাইল ফোন আনা হয় নি, সব হোটেলেই পড়ে আছে। অর্ক একজন ফটোগ্রাফারের খোঁজ করার আগেই বড় ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল শিবলিঙ্গটাকে।

    ফেরার সময় ওরা দেখল ভদ্রমহিলা তাঁর গোপাল নিয়ে ছাতার নীচে একটা চেয়ারে বসে আছেন। দেখে মনে হচ্ছে তিনি সমুদ্রে স্নান করেন নি। তবে ভদ্রলোক একটা তোয়ালে দিয়ে বাচ্চা দুটোর মাথা মুছিয়ে দিচ্ছেন ।

    হোটেলে ফিরে নিজেদের রুমে ঢুকে অর্কর জেঠু-জেঠিমা বেশ অবাক হয়ে গেল। ঘরে কেউ ঢুকেছিল। ট্রলি থেকে জিনিসপত্র বের করে কেউ বিছানায় এবং মেঝেতে ছড়িয়ে ফেলে রেখেছে। চাবি ওরা রিসেপশন থেকে নিয়ে ঢুকেছে। তাহলে? রিসেপশনে ফোন করতেই একটা ছেলেকে ওরা সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিল। সে এসে জানালো ঘর পরিষ্কার করার সময় সুইপারের সাথে সে নিজে এসেছিল, তখন জিনিসপত্র যথাস্থানে ছিল।

    জিনিসপত্র চেক করে দেখা গেল কিচ্ছু খোয়া যায় নি, শুধু কেউ যেন তন্ন তন্ন করে কিছু খোঁজার চেষ্টা করেছে।


    (১০)

    এই ঘটনার জন্য রিসেপশনের তরফে বারবার ক্ষমা চাওয়া হলেও অর্করা বেশ দমে গেল। বেড়াতে এসে যেখানে নিরাপত্তা নেই, সেখানে থাকাটা কতটা সমীচীন হবে - সেটা ওরা বুঝে উঠতে পারছিল না। একটু পরেই হোটেল ম্যানেজার নিজে এসে দেখা করে অনুরোধ করলেন যেন ওরা হোটেল চেঞ্জ না করে।

    ম্যানেজার ছেলেটা অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী এবং কম বয়সী। সে প্রাণপণে চাইছে যাতে হোটেলের কোন বদনাম না হয়, তাহলে তার চাকরি নিয়েও টানাটানি হবে। তাছাড়া এমন ঘটনা এর আগে এখানে কখনো ঘটেনি বা সে নিজেও কোনদিন শোনেনি। সে শুধু বারবার বলে গেল এই কারণে অর্করা যেন হোটেল না ছাড়ে। তারা এর তদন্তের ব্যবস্থা করে অভিযুক্তকে যথাযোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করবে। ওরা দেখছে যে যদি হোটেলের কেউ এটা করে থাকে তাহলে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে। আর কিভাবে চাবি নিয়ে অন্য কেউ ঢুকল ঘরের মধ্যে।

    সে চলে যেতে অর্কর বাবা, মা আর জেঠু-জেঠিমারা আলোচনায় বসলেন এরপর কি করা হবে সেই নিয়ে। হোটেলের ম্যানেজারের অনুরোধ রক্ষা করা ঠিক হবে, নাকি হোটেল বদলানোই উচিত?

    শেষ পর্যন্ত জেঠু রায় দিলেন যে ম্যানেজারকে একটা দিন সুযোগ অন্ততঃ দেওয়া উচিত এবং কিভাবে এটা ঘটল তা জানা ভীষণ জরুরি। তাই এখানে এখন থাকাটাই ফাইনাল। আগামীকাল অন্য হোটেলে উঠা হবে।


    (১১)

    ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছিল সবার, এই গণ্ডগোল না হলে অনেকক্ষণ আগেই খাওয়া হয়ে যেত। খাবারের অর্ডার দিয়ে মিনিট পনেরো পরে ইন্টারকমে ফোন পেতেই সবাই মিলে দ্রুত রেস্টুরেন্টে গিয়ে হাজির হ'ল। অর্করা ভেতরে ঢুকেই দেখতে পেল সেই পরিবারটি একটা টেবিলে বসে মহানন্দে খেয়ে চলেছে। ভদ্রমহিলার কোলেতে গোপাল ঠাকুর।

    ওদের দেখে পুঁটি বলল, "জানিস দাদা, ওরা না আমাদের পাশের ঘরে আছে। বারান্দায় ওই বাচ্চা দুটো খেলছিল।"

    গরম ভাত, ডাল মাখানি, আলু ভুজিয়া, পনীর বাটার মশলা, ইলিশ ভাপা আর টক দই দিয়ে জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হ'ল। অর্কর মনে হল সে একটু বেশি খেয়ে ফেলেছে। তাই সবার আগে হাত ধুয়ে সে নিজেদের রুমের দিকে চলল। বাকিরা রেস্টুরেন্টের লাগোয়া বারান্দায় বসে সমুদ্র দেখছে।


    (১২)

    অর্ক লিফট থেকে নেমে বারান্দার দিকে ঘুরতে গিয়েও থেমে গিয়ে একটু পিছিয়ে দেওয়ালের গায়ে সেঁটে গেল।

    দুটো লোক দাঁড়িয়ে আছে ঠিক ওদের রুমের সামনে। একজন সাদা টি-শার্ট পরেছে, অন্যজন ব্লু শার্ট পরা। সাদা টি-শার্ট নীচু গলায় অপরজনকে জিজ্ঞেস করল, "কোনসা রুম সার্চ কিয়া থা?"

    ব্লু-শার্ট লোকটা অর্কর জেঠু-জেঠিমার রুমের দিকে আঙ্গুল দেখাল।

    —আরে বুদ্ধু, তুমকো বোলা থা না রুম নাম্বার 305? তুম কোনসা রুম মে ঘুস গিয়া থা? গাধা কাঁহিকা।

    লোক দুটো এবার লিফটের দিকে আসছে দেখে অর্ক নিঃশব্দে পিছিয়ে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে দ্রুত উঠে পড়ল। লোক দুটো লিফটে না উঠে সোজা হেঁটে করিডোর ধরে অন্য দিকে চলে গেল।

    অর্ক অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে ধীরে ধীরে হেঁটে দেখে এল ওদের ঘরটা। রুম নম্বর ৩২২, আচ্ছা তাহলে এই রুমে আছে ওরা? কিন্তু রুম নম্বর ৩০৫-এ ওদের কি দরকার? ওটাতে তো ওই অবাঙালি ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা উঠেছেন? তাহলে ৩০৪ মানে অর্কর জেঠু-জেঠিমার রুমে ওরা ভুল করে ঢুকেছিল? ওদের উদ্দেশ্যটা কি?


    (১৩)

    অর্ক বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকল এই লোক দুটো কারা? ওদের সাথে ওই অবাঙালি ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলার কি এমন সম্পর্ক যে লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র সার্চ করছে? কি খুঁজছে ওরা? কিভাবে ওরা জেঠুদের রুমে এন্ট্রি পেল? তাহলে হোটেলের কারো সাথে ওদের কোন ষড় আছে?

    ঠিক তখনই বাইরের দরজায় কেউ বেল টিপল। বাইরে পুঁটি, মা-বাবা, জেঠু-জেঠিমার গলা পাওয়া যাচ্ছে। অর্ক দরজা খুলল। সবাই মিলে ওদের ঘরেই ঢুকল। বিকেলবেলা কোথায় যাওয়া হবে সেই আলোচনা শুরু হল। ঠিক হল গৌরবিহার আর স্থানীয় কয়েকটা জায়গায় ঘুরতে যাওয়া হবে। কিন্তু সকালের ঘটনার পর সবাই চিন্তিত হয়ে গেছে। হোটেল-ম্যানেজার বারবার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও ঘর বন্ধ করে যাওয়ার রিস্ক নিতে চাইছে না কেউই।

    অর্ক কাউকে ওই লোক দুটোর কথা বলল না। শুধু বলল, "তোমরা নিশ্চিন্তে ঘুরে এসো। আমি ঘরে থাকব।" প্রথমে কেউ তাতে রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু অর্ক বারবার একই কথা বলাতে সবাই নিমরাজি হ'ল। অবশ্য বিকেলবেলা ঘুরতে যাওয়ার থেকেও বড় কথা একটা ভালো হোটেল খোঁজা। যাতে পরদিন সকালেই তল্পিতল্পা নিয়ে সেখানে চলে যাওয়া যায়। আজকের ভাড়া তো এরা নিয়েই নিয়েছে।

    বিকালে বেরোনোর আগে অর্কর বাবা-মা এবং জেঠু-জেঠিমা ওকে পাখি পড়ানো করে বলে গেল যেন সে হোটেলের ঘরেই থাকে, কোথাও যেন না যায়, কোন ঝুট-ঝামেলায় যেন জড়িয়ে না পড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি।


    (১৪)

    বাবা-মা আর জেঠু-জেঠিমার সঙ্গে পুঁটি বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই অর্ক ঘরের বাইরে বেরিয়ে দেখে নিল ওদের দুটো ঘরের দরজা ঠিকমতো বন্ধ আছে কি না। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল রুম নম্বর ৩২২-এর দিকে। সেই ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ বলেই মনে হ'ল।

    বাইরে এখন ভীষণ রোদ, তাই বারান্দায় কেউ নেই। অর্ক নিজেদের ঘরের দিকে ফিরে আসছিল। হঠাৎ কি মনে করে সমুদ্র দেখার জন্য চলে এল লম্বা বারান্দার একেবারে শেষ প্রান্তে। এখনও প্রচুর লোক স্নান করছে, হৈ চৈ করছে। এখানে দাঁড়িয়ে রিসেপশনের ঠিক উপরে দোতলায় ম্যানেজারের ঘরটা আর তার সামনে বারান্দাটা দেখতে পাওয়া যায়। দেখল ম্যানেজার লোকটা একটা রোগা, কালো ছেলেকে খুব বকাবকি করছে। কি বলছে তা শোনা যাচ্ছে না। তবে তাকে যে খুব ধমক দিচ্ছে এটা বোঝা যাচ্ছে। ছেলেটা ভীষণ কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ছেলেটাই কি তবে....

    অর্ক একটু সরে এল যাতে ওরা ওকে দেখতে না পায়। পিছন ফিরে দেখল ৩২২ নম্বর রুমের লোক দুটো হেঁটে লিফটের দিকে আসছে। আগে যে সাদা টি-শার্ট পরেছিল সে এখন কালো শার্ট পরেছে। আর আগের ব্লু শার্ট এখন আকাশী রঙের স্ট্রাইপ।

    লোক দুটো লিফটে করে নীচে নেমে হোটেলের বাইরে চলে গেল।


    (১৫)

    পাশের ৩০৫ নং রুমের ভদ্রলোক বাচ্চা দুটিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, মনে হয় সমুদ্রের পারে গেছেন। অর্ক বারান্দায় বসে সমুদ্র দেখছিল। কিছুক্ষণ পরে সে রুমে চলে এল মোবাইল চার্জ দেবার জন্য।

    বাবা ফোন করে অর্ককে জানালো একটা ভাল হোটেলের সন্ধান পেয়েছে ওরা। আগামীকাল সকালেই হোটেল চেঞ্জ করবে।

    অর্ক ভাবছিল ৩২২ নম্বর রুমের লোক দুটোর রহস্যজনক আচরণ ও সেই সাথে জেঠু-জেঠিমার ঘরের জিনিসপত্র তছনছের কি যোগসূত্র থাকতে পারে? তাছাড়া ৩০৫ নং রুমের ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার সঙ্গে ওই লোক দুটোর কি সম্পর্ক?

    তখন প্রায় বিকেল সাড়ে পাঁচটা, হঠাৎ একটা চিৎকার ভেসে এল, "ছোড় দো মুঝে, ছোড় দো!"

    অর্ক লাফিয়ে উঠে দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে এল। কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পেল না। অর্ক বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ, কিন্তু না, আর কোন আওয়াজ শুনতে পেল না।


    (১৬)

    বাবা-মা জেঠু-জেঠিমার সঙ্গে বাইরে ঘুরলেও অর্কর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। অর্কর ক্ষিদে পেয়েছে। ব্যাগ থেকে বিস্কুট বের করে খেতে যাবে এমন সময় একটা বিকট চিৎকার আর তার সাথে কান্নার আওয়াজ শুনে সে বিদ্যুৎগতিতে ঘরের বাইরে এসে দেখল ৩০৫ নম্বর রুমের সামনে বাচ্চা দুটি দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। আর সেই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক কাকে যেন মোবাইলে ফোন করছেন, কিন্তু তিনি থর থর করে কাঁপছেন। বাচ্চা দুটি অর্ক আর আরো দু-চারজন কৌতূহলী লোকজনকে দেখে বলল, "মাম্মি, মাম্মি!"

    অর্ক বাইরে থেকে উঁকি মেরে দেখতে পেল, ভদ্রমহিলা বিছানায় শুয়ে আছেন, পাশে গোপাল ঠাকুরটা উল্টে পড়ে আছে। আর বিছানা রক্তে ভিজে গেছে। ভদ্রলোক ফোন হাতে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাইরে থেকে যাতে কেউ না দেখতে পায় সেইভাবে গার্ড করে দাঁড়িয়ে আছেন।

    মুহূর্তে ভীড় জমে গেল বারান্দায়। ম্যানেজারের সাথে হোটেলের কিছু কর্মী ছুটে এল। ৩০৫ নম্বর রুমে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। কানাকানি শুরু হয়ে গেছে "খুন, খুন"।


    (১৭)

    একটু পরেই বারান্দায় ভারী বুটের আওয়াজ পাওয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন শুরু হ'ল— "পুলিশ, পুলিশ আসছে!"

    একজন খাকি উর্দি পরা রাশভারী চেহারার মানুষ সবার আগে আগে আসছিলেন। তিনি বললেন, "এখানে এত ভীড় কেন? সকলকে সরে যেতে বলুন।"

    সঙ্গে সঙ্গে একজন কনস্টেবল হাতের লাঠি দিয়ে ভীড় সরানোর ভঙ্গি করল। সবাই একটু সরে দাঁড়াল।

    রাশভারী ভদ্রলোক যে কোন নিকটবর্তী থানার ওসি তা বুঝতে অর্কর দেরী হল না। ঘরের ভিতরে তিনি আর একজন অফিসারকে নিয়ে ঢুকলেন। তারপর হাত নেড়ে কাউকে একটা ডাকলেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা হাতে আর একজন ঘরের মধ্যে ঢুকল। নিজেদের কাজ সেরে বডি হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়ে তিনি ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলেন, "চলুন আপনার অফিসে যাই। আর এখন কাউকে হোটেলের বাইরে যেতে দেবেন না। আমি কয়েকজনের জবানবন্দী নেব। তাদের আপনার অফিস ঘরে পাঠিয়ে দিন।"


    (১৮)

    ওসি প্রথমে ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন।

    —যে ভদ্রমহিলা মারা গেছেন তিনি আপনার হোটেলে কবে এসেছিলেন?

    —আজ সকালে।

    —ওনার সাথে আর কে কে আছেন?

    —শুধু ওনার স্বামী আর দুটো বাচ্চা।

    —ওনার বডি প্রথম কে দেখতে পান এবং কখন?

    —ওনার স্বামী বাচ্চা দুটিকে নিয়ে একটু ঘুরতে গিয়েছিলেন। ঘন্টাখানেক বাদে ফিরে এসে তিনিই প্রথম দেখতে পান এবং ফোনে আমায় জানান।

    —ভদ্রমহিলার পাশে একটি গোপালের মূর্তি দেখলাম। উনি কি সব সময় ওটা নিয়ে থাকতেন?

    —হ্যাঁ।

    —মূর্তিটা সোনার বা সোনার পাত দিয়ে মোড়া। এত দামী জিনিস নিয়ে সব সময় ঘুরতেন?

    —হ্যাঁ। কখনো কাছছাড়া করতেন না।

    —স্বাভাবিক। অমরবাবু, মূর্তিটাকে সঙ্গে নিয়েছেন তো?

    পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অফিসার বললেন, "হ্যাঁ স্যার। কাগজে মুড়ে নিয়েছি। ভদ্রলোক কিছুতেই দিতে চাইছিলেন না। তাই জোর করে নিতে হ'ল। বলছিলেন, বাড়ির গৃহদেবতা।“

    —হুঁ।

    এবার ম্যানেজারকে বললেন, "আপনি ওদের আইডেন্টিটি কার্ড আমাকে দেবেন। আর ঘরটা আমরা সিল করে দিয়ে যাব। তাছাড়া আগামীকাল থেকে এই হোটেল থেকে কেউ যেন চেক আউট না করতে পারে। চেক আউট করতে গেলে আমাদের পারমিশন নিতে হবে। আপনি হোটেলের কর্মীদের একে একে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। আর হ্যাঁ, যদি আসপাশের ঘরের কোন বোর্ডার ওই সময় রুমে থেকে থাকে তাহলে তাকেও আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন।"


    (১৯)

    সব কর্মীদের জেরা করা হয়েছে, শুধু একজন বাকি। ম্যানেজারবাবু জোর করে তাকে ধরে নিয়ে এল। রাশভারী ও. সি. সাহেব তার আপাদমস্তক জরিপ করলেন। তারপর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, "নাম কি তোমার?"

    সে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ঢোঁক গিলে উত্তর দিল, "আজ্ঞে, গোপাল দাস।"

    —কতদিন কাজ করছ এখানে?

    —আজ্ঞে, সবে সাতদিন।

    —ওকে এখানে কে এনেছিল?

    প্রশ্নটা ও. সি. সাহেব ম্যানেজারবাবুর উদ্দেশ্যে করলেন।

    —আমাদের এখানে আগে একজন কাজ করত লোকনাথ। সে এখন অন্য একটা হোটেলে চাকরি করে। সেই সাথে করে এনেছিল। বলেছিল ওর দূর সম্পর্কের পিসির ছেলে। কোন কাজ পাচ্ছে না, তাই।

    —তুমি কি কি কাজ করো এখানে?

    —আজ্ঞে, অন্য বয়রা যা যা করে - বোর্ডারদের ব্যাগ বই, ঘর পরিষ্কার করি।

    —আজ সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কোন অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছ কি?

    ছেলেটা চুপ করে রইল। ও. সি. সাহেব তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন, যেন মনের ভেতর অবধি দেখে নিচ্ছেন। ছেলেটা মুখটা নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

    —কি হ'ল জবাব দাও? কোন অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছ কি?


    (২০)

    —হ্যাঁ, মানে আমি আর গজানন সকালে ঘর পরিষ্কার করতে গিয়েছিলাম। তিনশো চারের পর আমরা পাঁচ নম্বর ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। গজানন তিনশো পাঁচে ঢুকে গিয়েছিল, আর আমি বাইরে দাঁড়িয়ে তিনশো চারের দরজায় চাবি দিচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা লোক ছুটতে ছুটতে এসে বলল, "আরে, চাবিটা একটু দাও তো? মানি ব্যাগটা ফেলে চলে গেছি।"

    আমাদের নিয়ম হচ্ছে রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে ঘর পরিষ্কার করে আবার রিসেপশনেই জমা দেওয়া। আর বোর্ডাররাও কেউ কখনও অন্যের ঘরের চাবি চায় না। আমি যদিও তিনশো চার নম্বর রুমের বোর্ডারদের ঠিকমত চিনি না কিন্তু যেভাবে লোকটা বলল তাতে আমার অবিশ্বাস হয় নি, আমি চাবিটা দিয়ে দিলাম। আমার ভুল হয়েছিল গজাননকে জিজ্ঞেস না করা। তারপর তিনশো চারের বোর্ডাররা এসে যখন ম্যানেজার বাবুর কাছে কমপ্লেন করেন তখন ম্যানেজার বাবু আমায় -ভীষণ বকাবকি করে হুমকি দেন যে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবেন ও পুলিশে খবর দেবেন। বিশ্বাস করুন স্যার, আমি সত্যিই ইচ্ছা করে চাবি দিয়ে দিই নি, লোকটা এসে এমনভাবে আমাকে বলল যেন সে ওই রুমেরই বোর্ডার। অবশ্য আমার গজাননকে না জিজ্ঞেস করায় সমস্যাটা হয়েছে। আসলে এত বড় হোটেলে যারা আসেন সবাই ভদ্রলোক হ'ন তো।

    —তোমরা লোকটাকে পরে খুঁজে পেয়েছ?

    —হ্যাঁ, সে তিনশো বাইশ নম্বর রুমে উঠেছে আর একজন লোকের সাথে।

    এবার ও. সি. সাহেব ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বললেন,

    —তোমরা তাকে আইডেন্টিফাই করতে পেরেছ?

    —না, এখনও বুঝতে পারছি না কে সেই লোকটা। তবে খোঁজ খবর নিচ্ছিলাম, তার মধ্যেই তো এই ঘটনা ঘটল। তাই আর...

    ও. সি. সাহেব বললেন, "খোঁজ নিন, কোন রুমে কোন বোর্ডার আছে, কারা কারা বাইরে গেছে আর যে রুমে খুনের ঘটনাটা ঘটল, তার আশেপাশের রুমে কেউ কিছু দেখতে বা শুনতে পেয়েছে কি না?"


    (২১)

    ও. সি. সাহেবের কথামত ৩০৫ নম্বর রুমের আশপাশের বোর্ডারদের খোঁজ নিয়ে দেখা গেল ৩০১ ও ৩০২ নম্বর রুমের বোর্ডাররা সকালবেলা কোথাও বেড়াতে গেছেন, সন্ধ্যা অবধি ফেরেন নি। ৩০৩ ও ৩০৪ নম্বর রুমের বোর্ডাররা বিকেল হতে না হতেই বেড়াতে বেড়িয়েছেন, তবে ৩০৩-এ একজন খুব অল্পবয়সী একটা ছেলে আছে। আর সকালে ৩০৪ নম্বর রুমেই ঘর তছনছের ঘটনাটা ঘটেছিল। সেটার সাথে এই ঘটনার কোন সম্বন্ধ আছে কিনা তাও যাচাই করে দেখা দরকার বলে মনে হল ও. সি. সাহেবের। ওই রো-তে ৩০৬ ও ৩০৯ নম্বর রুমের বোর্ডাররা আজ সকালে চেক আউট করেছেন। ৩০৭ এবং ৩১০ নম্বর রুমের বোর্ডাররা সকালে বেরিয়ে ছিলেন এবং ফিরেছেন খুনের ঘটনার পর।

    ও. সি. সাহেবের নির্দেশে ৩০৩ নম্বর রুম থেকে অর্ককে ডেকে আনা হ'ল। ছেলেটিকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললেন, "তোমাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু তুমি তো এখানে টুরিস্ট। হয়ত তোমার সাথে কারো মিল থাকতে পারে। আচ্ছা, তুমি তো ঘরেই ছিলে। ঘটনাটা যখন ঘটে, তখন তুমি কিছু শুনেছিলে বা দেখেছিলে কি?"

    —একটা চিৎকার শুনেছিলাম, মহিলা কন্ঠে। বলছিলেন, "ছোড় দো মুঝে, ছোড় দো!"

    —তখন ক'টা বাজে বলে মনে হয় তোমার?

    —ঘড়িতে দেখেছিলাম বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে।

    ও. সি. সাহেব পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অফিসারকে বললেন, "অমল, টাইমটা নোট করে নাও।"

    ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি খচখচ করে নোটবুকে কিসব লিখতে লাগলেন।

    ও. সি. সাহেব আবার অর্ককে জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি তখন কি করলে?"

    —আমি ঘরের বাইরে এলাম। কিছুক্ষণ বারান্দায় পায়চারি করলাম, তারপর আবার ঘরে ঢুকে গেলাম। কাউকে দেখতে পাই নি।

    —তখন বারান্দায় আর কেউ ছিল না?

    —না, চড়া রোদ থাকার কারণে হয়তো বা কেউ ছিল না।

    —তোমাদের ঘরেও তো আজ সকালে জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি হয়েছে, তাই না?

    —হ্যাঁ, আমার জেঠু-জেঠিমার ঘরে, রুম নম্বর ৩০৪।

    —আচ্ছা, এর পিছনে কি কোন কারণ থাকতে পারে বলে তোমার মনে হচ্ছে?

    —সঠিক জানি না, তবে আমার মনে হয় কেউ ভুল করে আমার জেঠু-জেঠিমার রুমে ঢুকে পড়েছিল।

    —কেউ এত বড় ভুল করে কি? নিজের রুমের নম্বর মনে থাকবে না?

    ভদ্রলোক যেন স্বগতোক্তি করলেন।


    (২২)

    খুনের খবর রাষ্ট্র হতে বেশি সময় লাগল না। অর্কর বাবা-মা ও জেঠু-জেঠিমার কানেও সে খবর যেতেই তাঁরা মার্কেটিং ফেলে দ্রুত হোটেলে ফিরে এলেন। অর্কর মা ছুটতে ছুটতে এসে ওকে দেখে প্রায় বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "বাবা, তুই ঠিক আছিস তো? কি সাংঘাতিক জায়গায় এসে পড়লাম রে বাবা! সকালে ঘরে লোক ঢুকে জিনিস তছনছ করল। বিকেলবেলা পাশের ঘরে লোক খুন হ'ল। এই হোটেলে আর এক মুহূর্তও নয়। চলো, এখনই চলে যাই এখান থেকে।"

    অর্কর বাবা ওর মাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে তাঁরা তো আগামীকাল সকালেই এই হোটেল ছেড়ে চলে যাবেন, কিন্তু কে শোনে কার কথা! অগত্যা অর্কর বাবা ও জেঠু বাধ্য হয়ে ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে গেলেন। সেখানে তখন ঘরের মধ্যে ও. সি. সাহেব বসে ছিলেন। বাইরে থেকে দুজন ভদ্রলোককে উঁকি ঝুঁকি দিতে দেখে তিনিই হাতছানি দিয়ে ভেতরে ডাকলেন।

    —কি ব্যাপার? কাকে খুঁজছেন?

    —আমরা এই ম্যানেজার বাবুকেই খুঁজছিলাম। ওনার সাথে একটু কথা আছে।

    অর্কর জেঠু ম্যানেজার বাবুকে বললেন, "আমরা এখনই চেক আউট করতে চাই। আপনি ব্যবস্থা করে দিন।"

    এবারে ও. সি. সাহেব উত্তর দিলেন, "এখন তো কাউকে যেতে দেওয়া যাবে না। আমরা ইনভেস্টিগেট করব, তারপর।"

    —কি আশ্চর্য, আমরা ক্রিমিনাল না কি?

    —দেখুন, এরকম ঘটনা যেখানে ঘটে সেখানে আসল অপরাধীকে সনাক্ত না করা পর্যন্ত সকলের উপর সন্দেহ থাকতেই পারে। আমাদের অনুমতি ছাড়া কেউ যেন এখন হোটেল না ছাড়ে।

    শেষ কথাগুলি তিনি ম্যানেজারকে উদ্দেশ্য করে বললেন।


    (২৩)

    ৩০৩ নম্বর রুমের খাটের উপর অর্কর মা ও জেঠিমা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। ভাবটা এমন যেন কি কুক্ষণে এখানে এসে উঠেছেন। দুটি গদি আঁটা চেয়ারের একটায় অর্কর বাবা ও দ্বিতীয়টিতে অর্কর জেঠু গম্ভীর মুখে বসে আছেন। আর বিছানার একপাশে বসে আছে অর্ক আর পুঁটি।

    পুঁটির হাতে একটা নতুন কেনা খেলনা। সে সেটা নিয়ে খেলছে। তরলের মধ্যে লাল গুঁড়োগুলো ভাসতে ভাসতে ক্রমশঃ নীচে নেমে আসছে। সব গুঁড়োগুলো নীচে নেমে আসলে পুঁটি আবার উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে খেলনার মাথাটা, ব্যস, আবার গুঁড়োগুলো নীচে নেমে আসছে খুব ধীরে ধীরে।

    অর্ক মোবাইল ফোনে কন্ট্যাকটসগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ পেল অরূপ সরকারের মোবাইল নম্বরটা। ভদ্রলোকের সাথে ওর আলাপ হয়েছিল লালবাজারে, পুলিশ হেডকোয়ার্টাসে, 'সম্রাটের ছোরা' কেসে পুরস্কার নেবার সময়। ভদ্রলোক একজন পদস্থ অফিসার। অর্ককে ভূয়সী প্রশংসার পর নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে বলেছিলেন, "কোন ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে পড়লে আমাকে নির্দ্বিধায় ফোন করবে। আমরা তোমায় সর্বতোভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করব। তোমার মত ছেলেরা আমাদের দেশের গর্ব।"

    কিন্তু এতদিন পরে ফোন করলে তিনি চিনতে পারবেন তো? অর্কর মন একটা সংশয়ের দোলাচলে দুলতে লাগল।


    (২৪)

    এখন রাত্রি দশটা। খাওয়া দাওয়া মিটে গেছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। অর্ক মোবাইল ফোন নিয়ে পা টিপে টিপে বাথরুমে গেল। এখন কি কোন ভদ্রলোককে ফোন করা যেতে পারে? উনি অবশ্য বলেছিলেন, "তোমার যখন খুশি ফোন করবে।" তবু এত রাতে... ভাবতে ভাবতে অর্ক শেষমেষ নম্বরটা ডায়াল করেই ফেলল।

    রিং হচ্ছে, সেই সাথে অর্ক শুনতে পাচ্ছে নিজের হার্টবিটও। ওদিক থেকে ভারী গলায় উত্তর এলো, "হ্যালো"।

    —আমি অর্ক বলছি।

    —কে বলছেন? আমি ঠিক শুনতে পাচ্ছি না। একটু জোরে বলুন।

    অর্কর ভয় লাগছে বাবা-মা না জেগে উঠে। তাই সে জোরে কথা বলতে পারছে না।

    —স্যার আমি অর্ক, আপনার সাথে আমার 'সম্রাটের ছোরা' কেসে পরিচয় হয়েছিল।

    —কি কেসে? আমি ঠিকমত শুনতে পাচ্ছি না। মনে হয় টাওয়ার....

    ফোনটা কেটে গেল। অর্ক ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ল। এবার সে একটা এস.এম.এস. লিখল - "Sir, my name is Arka. I met with you in the case of Samrater Chhora. I need your help in another case. I want to talk to you."

    নাহ্‌, কোন রিপ্লাই আসছে না। অর্ক হতাশ হয়ে আবার শুয়ে পড়ল। ঠিক আধ ঘণ্টা পরেই ওর মোবাইল ফোনটা ভাইব্রেট হতে শুরু করল। মোবাইল স্ক্রিনে নামটা ভেসে উঠেছে "অরূপ সরকার।"


    (২৫)

    —বলো, কি খবর? অনেকদিন বাদে তোমার গলা শুনলাম। অনেক পাল্টে গেছে। মনে হচ্ছে তুমি বড় হয়ে গেছ। তোমার সাথে মোবাইলে কথা বলতে গিয়ে টাওয়ারের প্রবলেম হচ্ছিল। তাই ল্যান্ড ফোন থেকে ফোন করছি।

    —স্যার, আমি এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষার পর আমরা পুরীতে ঘুরতে এসেছি। কিন্তু এখানে এসে আমরা একটা সমস্যার মধ্যে পড়েছি, আর সেই ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলতে চাই।

    অর্ক সংক্ষেপে বলল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা। তার সাথে ওদের ভোগান্তির কথাও। এমনকি ৩২২ নং রুমের সেই সন্দেহজনক লোক দুটোর কথাও।

    —এতো খুব সাংঘাতিক ব্যাপার। তোমরা সাবধানে থেকো। আমি দেখছি ওখানে ও. সি. কে আছেন। তবে তুমি যেমন চারিপাশে নজর রেখেছ, তেমনি রেখো। আর আমাকে সময়মতো সব জানাবে। মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা খুব সাধারণ নয়।

    —আমি ৩২২ নম্বর রুমের লোক দুটোকে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুনেছি দুপুর বেলা। ঠিক আমাদের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা বলছিল ভুল করে আমাদের রুমে ঢুকেছিল। কিন্তু বিকেলবেলা ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর আর দেখিনি। খুনটা হয়েছে বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। আমি একবার ভদ্রমহিলাকে "ছোড় দো, মুঝে, ছোড় দো" বলে চিৎকার করতে শুনেছি, কিন্তু বারান্দায় বেড়িয়ে কাউকে দেখতে পাই নি। আর ওই লোক দুটো ফেরতও আসে নি।

    —এমনও তো হতে পারে লোক দুটো ছদ্মবেশে ফিরে এসেছিল।

    ছদ্মবেশে? সঙ্গে সঙ্গে অর্কর মাথার মধ্যে যেন হাজার ওয়াটের লাইট জ্বলে উঠলো। হতে পারে, হতে পারে। তাহলে যে লোকটাকে সে ছ'টা পাঁচ নাগাদ লিফটে চড়ে নামতে দেখেছে, সে তাহলে কে?


    (২৬)

    ফোন ছাড়ার পর অর্ক নিজের ডায়েরিটা বের করে একটা হালকা স্কেচ করল। সেই আকাশী স্ট্রাইপ দেওয়া শার্ট পরা লোকটার স্কেচ। মাথার চুলগুলো ছোট ছোট করে ছাঁটা, কানের পাশে হালকা ঝুলপি আছে, গোঁফটা সরু। বাম ভুরুর পাশে একটা গভীর কাটা দাগ আছে। এবার সে ছ'টা পাঁচ নাগাদ লিফটের সামনে দেখা লোকটার চেহারা মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। ঘন সবুজ টি-শার্ট, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, কানের দুপাশে ঝুলপি, গোঁফ নেই, ডান দিকের গালে একটা বড় আঁচিল। হ্যাঁ হ্যাঁ, তারও বাম দিকের ভুরুতে কাটা দাগ ছিল! তার মানে সেই লোকটাই... বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছদ্মবেশে! উঃ এইটা আগে তার মাথায় আসে নি?

    কিন্তু খুনের মোটিভটা কি হতে পারে? অবাঙালি ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাকে তো ভীষণ ভালো বলেই মনে হয়। আর নিষ্পাপ শিশু দুটি? ওদের কান্নার ছবিটা মনে আসতেই অর্কর চোখে জল এসে গেল।

    —কি হ'ল? এত রাতে আলো জ্বেলে বসে আছিস কেন?

    মায়ের গলা শুনে সম্বিত ফিরল অর্কর। শুকনো গলায় বলল—

    —কিছু না। ঘুম আসছে না আমার।

    —আয়, আমার কাছে আয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুম এসে যাবে।

    অর্ক কিছু না বলে ডায়েরিটা সরিয়ে রেখে শুয়ে পড়ল।


    (২৭)

    কিসের যেন আওয়াজ? অর্ক ঘুম চোখে দেখল বালিশের নিচে তার মোবাইল ফোনটা ভাইব্রেট করছে। ভোর হয়ে গেছে। পাশে ওর বাবার এখনও নাক ডাকার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। মা বোধহয় বাথরুমে। ফোনটা ধরে "হ্যালো" বলতেই ওদিকে অরূপ সরকার বললেন, "গুড মর্নিং অর্ক। ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম বোধহয়। আসলে আমার তো নাইট ডিউটি চলছে। তাছাড়া তোমাকে যেটা বলব তা খুব ইম্পর্টেন্ট। তাই এত সকালেই ফোন করলাম। আমাদের কাছে খবর এসেছে, কোচবিহার থেকে হাত বদল হয়ে কিছু মহামূল্যবান হীরে এসেছে যা অষ্টাদশ শতাব্দীর কোন রাজা-মহারাজার ছিল এবং সেসব কলকাতা হয়ে উড়িষ্যায় চলে গেছে। সেখান থেকে পাচার হবে সিঙ্গাপুর বা অন্য কোথাও, সম্ভবতঃ দেশের বাইরে। হয়ত এই সন্দেহজনক লোক দুটো ওই দলের হতেও পারে। আর হ্যাঁ, ওখানকার ও. সি. প্রশান্ত বড়াল বাবু ভীষণ ভালো মানুষ। উনি কিছুদিন দীঘার কোস্টাল এরিয়াতেও সাব ইন্সপেক্টর ছিলেন, যখন সেই সম্রাটের ছোরার কেসটা ঘটেছিল। আমার সাথে ওনার কথা হয়েছে। তোমাদের প্রোটেকশনের দায়িত্ব উনি নেবেন বলেছেন। আচ্ছা, আমি এখন রাখছি। তুমি সব সময় চোখকান খোলা রাখবে আর আমায় জানাবে অবশ্যই।"

    অর্কর বাবার নাসিকাগর্জন বন্ধ হয়ে গেছে। তার মানে এখনই জেগে উঠবে। মা এখনো বাথরুম থেকে বেরোয় নি।

    অর্ক ট্রেন থেকে আজ সকাল পর্যন্ত ঘটনা পরম্পরা ও তার সময়াবলী ডায়েরির পাতায় দ্রুত লিখে ফেলছে।


    (২৮)

    অর্করা সবাই মিলে ভোরবেলা স্নান সেরে রেডি হয়ে ম্যানেজার বাবুর সাথে দেখা করে বললেন যে তাঁরা জগন্নাথ মন্দিরে পুজো দিতে যেতে চান। বেড়াতে এসে কেউ তো আর হোটেলের ঘরে বসে থাকবে না। ম্যানেজার বাবু ফোন করলেন ও. সি. সাহেবকে।

    —স্যার তিনশো তিন আর তিনশো চারের বোর্ডাররা জগন্নাথ মন্দিরে পুজো দেবার জন্য যেতে চাইছেন, কি করব?

    —সঙ্গে একটা ছোট ছেলে আছে তো? নাম অর্ক?

    —হ্যাঁ স্যার।

    —ঠিক আছে, যেতে দিন। তবে কেউ যেন এখন হোটেল না ছাড়ে। আমরা একটু বাদে যাচ্ছি আপনাদের ওখানে। একটু ইনভেস্টিগেট করব।

    —স্যার হোটেলের বোর্ডাররা খুব অসন্তুষ্ট হচ্ছেন।

    —কিছু করার নেই। এরকম একটা খুনের ঘটনায় আমাদের তো ইনভেস্টিগেশন করতেই হবে। তার তো নির্দিষ্ট কিছু প্রসিডিওর আছে, না কি?

    অর্করা বেরিয়ে পড়ল পুজো দেওয়ার উদ্দেশ্যে। অটো চলল মন্দির অভিমুখে।


    (২৯)

    মন্দিরের সামনে সকাল বেলাতেই বেশ ভীড়। পুণ্যার্থীদের দীর্ঘ লাইন দেখে সকলের মনে হতে লাগলো কতক্ষণে মন্দিরে প্রবেশ করা যাবে। ঠিক সেই সময় উদয় হলেন একজন অল্প বয়সী পাণ্ডা। তিনি অর্কদের আশ্বাস দিলেন ভালো করে জগন্নাথ দর্শন করিয়ে দেবেন। অর্করা জুতো আর মোবাইল ফোন নির্দিষ্ট স্থানে জমা রেখে লাইনে দাঁড়াল। অত বড় লাইন দেখে মনে হয়েছিল মন্দিরে প্রবেশ করতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। কিন্তু আধঘন্টার মধ্যে অর্করা মন্দিরে ঢুকতে পারল।

    পুজো দিয়ে এসে ওরা আবার হোটেলে ফিরে এসে ব্রেকফাস্ট করল। ততক্ষণে ও. সি. প্রশান্ত বড়াল তাঁর দলবল নিয়ে এসে সমস্ত রুমগুলি পরীক্ষা করে ও তার বোর্ডারদের সাথে কথাবার্তা বলে তাঁদের যথা ইচ্ছা তথা যাবার অনুমতি দিয়েছেন। শুধু সীল করে দিয়েছেন ৩০৫ ও ৩২২ নম্বর রুম দুটি। ৩০৫ নম্বরের বাকি বোর্ডারদের অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়েছে। ৩২২ নম্বর রুমের বোর্ডাররা গতকাল বিকেলে বাইরে যাওয়ার পর আর ফিরে আসেন নি। তাদের খোঁজ চলছে।

    হোটেলের রেস্টুরেন্টে জলখাবারের অর্ডার দিয়ে অর্করা যখন বসে ছিল তখনই একজন হোটেল বয় এসে অর্ককে বলল, "আপনাকে ম্যানেজার বাবু একটু ডাকছেন।"

    —কোথায়?

    —ওনার ঘরে।

    অর্ক একাই যাচ্ছিল। ওর বাবা বললেন, "দাঁড়া, আমিও তোর সাথে যাব।"


    (৩০)

    অর্ক ম্যানেজার বাবুর ঘরে ঢুকতেই দেখল সোফায় বসে আছেন ও. সি. প্রশান্ত বড়াল। অর্ককে দেখে বললেন, "আরে, এসো এসো, ব্রেভ বয়! আমি গতকাল তোমাকে চিনতেই পারি নি। একটু চেনা চেনা লাগছিল বটে। আজকে অরূপবাবু ফোন করে বলতেই আমার সব মনে পড়ে গেল। তারপর? এখানে এসেও কেসে জড়িয়ে পড়লে?"

    অর্কর বাবা হাঁ হাঁ করে প্রতিবাদ করে উঠলেন, "না না, মোটেই না। ও কেন কেসে জড়িয়ে পড়তে যাবে? আগে যা হয়েছে, তা হয়েছে। আর কোন ব্যাপারে থাকবে না অর্ক।"

    ও. সি. সাহেব ঠান্ডা গলায় বললেন, "আপনার ছেলে, তাকে মায়ের আঁচলের তলায় রাখবেন, না তার বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতাকে গুরুত্ব দেবেন সে আপনার ব্যাপার। তবে আপনারা না বাঙালি? আর সেই বাংলাতেই তো একদিন ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, বাঘা যতীন, বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রাসবিহারী বসু, স্বামী বিবেকানন্দ। আর কত নাম বলব? বাঙ্গালী জাতি তার সাহসিকতার ও বুদ্ধিমত্তার জন্য পৃথিবী জুড়ে অবিসংবাদিত খ্যাতি অর্জন করেছে। আর আপনার মুখে এই কথা শুনে আমি খুব দুঃখ পেলাম।"

    অর্কর বাবার মাথাটা বুকের কাছে নেমে এসেছে। এটা দেখে অর্কর নিজের খারাপ লাগছিল। অর্কর বাবা হঠাৎ মুখ তুলে বললেন, "অর্কর কাছে আপনারা যেমনটা আশা করেন ও সেভাবেই কাজ করবে। আমারই ভুল ছিল চিন্তাভাবনায়।"

    —ভেরি গুড। অর্ক, তুমি ব্রেকফাস্ট করেছ?

    অর্ক দু'দিকে মাথা নাড়ল।

    —ঠিক আছে। আমারও সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয় নি। আমরা একসাথে ব্রেকফাস্ট করতে করতেই কথা বলে নেব? ম্যানেজার বাবু, আপনাদের হোটেলে ব্রেকফাস্টে কি কি আইটেম পাওয়া যেতে পারে?

    —স্যান্ডুইচ, আলু পরোটা, ইডলি, দোসা - যা চাইবেন স্যার।

    ম্যানেজার বাবু একটা মেনু চার্ট ও. সি. সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলেন।

    —আমি আলু পরোটা নেব। আর আপনারা?

    অর্কর বাবা বললেন, "আমাদের অলরেডি ব্রেকফাস্টের অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে। আপনারা খেতে খেতে কথা বলুন। আমি ওদিকে যাচ্ছি।"

    এই বলে অর্কর বাবা চলে গেলেন।

    অর্কও আলু পরোটা নেবে বলে জানালে ম্যানেজার বাবু ওদের ব্রেকফাস্টের তদারকি করতে স্থানত্যাগ করলেন।


    (৩১)

    এবার ও. সি. সাহেব অর্ককে বললেন, "দেখো, আমরা তো নিজেদের মতো তদন্ত করবই। কিন্তু তুমি আমাদের কিছু সূত্র দিয়ে সহায়তা করতে পারো। যেমন, গতকাল সকালে যখন এখানে এসেছিলে, তখন থেকে এখন পর্যন্ত যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নোটিশ করেছ তা আমায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করলে আমি তার মধ্যে থেকে দরকারী জিনিসগুলো বুঝে নিতে পারব।"

    অর্ক বলে গেল জেঠু-জেঠিমার ঘর অগোছালো হওয়া, দুপুর বেলা খাবার পর লিফট থেকে নেমে দেখা সেই লোক দুটোর কথা এবং তাদের কথোপকথন, দুপুর বেলা নতুন হোটেল বয়কে ম্যানেজার বাবুর ধমক, বকুনি এবং বিকেলে ৩২২ নম্বর রুমের লোক দুটোর হোটেলের বাইরে যাওয়া, তারপর বিকেল সাড়ে পাঁচটার একটু আগে ৩০৫ নম্বর রুমের ভদ্রমহিলার চিৎকার, বাইরে বেরিয়ে তৎক্ষণাৎ কাউকে দেখতে না পাওয়া, এবং ছ'টা নাগাদ বাইরে পায়চারি করতে বেরিয়ে লিফটে উঠতে দেখা সেই রহস্যজনক লোকটার কথা। অর্ক তার ডায়েরিতে যে লোকটার স্কেচ করেছিল তার একটা ছবি তুলে রেখেছিল ওর মোবাইল ফোনে। সেটাও দেখাল ও. সি. সাহেবকে। তিনি তাঁর মোবাইল ফোনে ফরওয়ার্ড করতে বললেন।

    ও. সি. সাহেব যাওয়ার সময় অরূপ সরকারের মতো একই কথা বলে গেলেন, "চারিদিকে চোখকান খোলা রেখো। কিছু দেখলেই ফোন করে জানিও। এবং পুলিশ রয়েছে তোমাদের পাশে সব সময়ের জন্য।"


    (৩২)

    অর্করা আজ কোনারক আর ধবলগিরি-খণ্ডগিরি হয়ে নন্দনকানন দেখে ভুবনেশ্বর হয়ে কলকাতা ফিরে যাবে বলে ঠিক করেছে। সেইমত গাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। একটা ইনোভা গাড়ি। ড্রাইভার ছেলেটার নাম 'বিজয়', সে বেশ অল্প বয়সী আর খুব আমুদে। সহজেই সবার সাথে ভালো আলাপ জমিয়ে নিল।

    বিজয় গাড়ি চালাতে চালাতে তার নানা অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করছিল অর্কর সঙ্গে। সে সামনে বসেছে বিজয়ের পাশে। হঠাৎ অর্ক খেয়াল করল বিজয়ের কপালের বাঁদিকেও একটা কাটা দাগ আছে।

    কোনারক থেকে ধবলগিরিতে যাওয়ার সময় ওরা চন্দ্রভাগা সমুদ্রতটে নেমে ছিল ঢেউয়ের পরশ নিতে। সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ এসে তটে আছড়ে পড়ছে আর তার সাথে ভেসে আসছে ছোট্ট গোল গোল কোন প্রাণী এবং তার থেকে নীল সুতোর মতো কিছু ঝুলছে। অর্কর সেগুলোকে জেলিফিস বলে মনে হল। ও আর পুঁটি সেই জেলিফিস ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

    সবাই সমুদ্রের ঢেউ উপভোগ করতে ব্যস্ত, হঠাৎ অর্ক লক্ষ্য করল একটা টুপি পরা লোক কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্কর সাথে চোখাচোখি হতেই সে মুখ ফিরিয়ে নিল।


    (৩৩)

    এখনও সমুদ্রতট থেকে সকলে গাড়ির কাছে আসতেই চাইছে না। উত্তাল জলতরঙ্গ আছড়ে পড়ছে সমুদ্র সৈকতে। বিজয় বার কয়েক তাড়া দিয়েছে। তবু আসছে না কেউ। মাথার উপর সূর্য এখন গনগনে। পায়ের তলায় বালি তেতে গেছে। খালি পা হলে ফোস্কা পড়ে যেত এতক্ষণে। দেরী হয়ে যাচ্ছে দেখে বাধ্য হয়ে বিজয় বলল, "এখন না গেলে ধবলগিরি পৌঁছতে অনেক দেরী হয়ে যাবে।"

    সবাই গাড়িতে উঠল। গাড়ি চলতে শুরু করল। পিছনে পিছনে আরো একটা গাড়ি ফলো করতে শুরু করেছে, সামনের গাড়ির কেউ লক্ষ্যই করল না।

    বিজয় তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে আবার গল্প জুড়ে দিল অর্কর সঙ্গে। সে বলছিল, গতকাল তার গাড়িতে দুজন লোক উঠেছিল চন্দ্রভাগা থেকে। একজনের কপালে ভ্র-র উপর কাটা দাগ ছিল। লোক দুজনের ব্যবহার অত্যন্ত খারাপ এবং তারা ভুবনেশ্বর যাবে বলে গাড়ি ভাড়া নিয়ে মাঝপথে নেমে যায়। ভাড়া নিয়ে ভীষণ ঝামেলা করেছে। এমনকি বিজয় ভাড়া চাইতে গেলে তাকে ছুরি দেখিয়ে ভয় দেখাতেও ছাড়ে নি। শেষে তারা ভাড়া না দিয়েই চলে গেছে।


    (৩৪)

    ধবলগিরি পৌঁছে অর্করা যখন বৌদ্ধ মন্দির দর্শনে গেছে, ঠিক তখনই দুজন লোককে এগিয়ে যেতে দেখা গেল অর্কদের গাড়ির দিকে। বিজয় একা বসেছিল গাড়ির ভিতরে। লোক দুটো সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে থাকল অন্য দিকে তাকিয়ে। ঠিক সেই সময় বিজয় কাউকে ফোন করছিল। সে ফোনে ব্যস্ত থাকায় লোক দুটোকে ঠিকমত খেয়াল করল না।

    ধবলগিরি মন্দির থেকে বেরিয়ে অর্কদের ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছিল। খুব কাছাকাছি একটা ভালো রেস্টুরেন্টও পেয়ে গেল। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং খাবারের রেট রিজনেবল। অর্করা ফোন করে বিজয়কেও আসতে বলল। সে কিছুতেই ওদের সাথে খাবে না। তাকে অর্কর বাবা একরকম জোর করেই ধরে নিয়ে এলেন। বাধ্য হয়ে সে এসে অর্কদের বিপরীত দিকে একটা টেবিলে বসে দুটি রুটি আর ডিমের কারি নিল।

    খেতে খেতে অর্ক হঠাৎ লক্ষ্য করল কার যেন একটা ফোন আসতেই বিজয় ফোনটা কেটে দিল। দু'-তিনবার ফোন এল, প্রত্যেকবার সে ফোন কেটে দিল।


    (৩৫)

    এদিকে অর্কদের গাড়িতে যখন কেউ ছিল না, ঠিক সেই সময় দুটি লোক ছোট্ট একটা ম্যাগনেটিক বস্তু গাড়ির পিছনে লাগিয়ে দিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে একবার দেখে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ফিরে গেল যেদিক থেকে এসেছিল সেই দিকে।

    অর্করা খাওয়া শেষ করে যখন ফিরে এল গাড়ির কাছে তখনও বিজয় আসে নি। অর্ক তাকে খুঁজতে গিয়ে দেখল সে একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত হয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। কিন্তু উড়িয়া ভাষাতে বলায় অর্ক ঠিকভাবে বুঝতে পারল না। তবে মনে হচ্ছিল ওপাশ থেকে কেউ কোন কিছু বলায় বিজয় বলছে, "সব কিছুকে এত লাইটলি নিলে চলবে না। তোমাদের যথেষ্ট সচেতন হওয়া উচিত।"

    অর্ককে দেখে সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, "তোমরা গাড়িতে গিয়ে বোসো, আমি এক্ষুনি আসছি।"

    এই বলে সে গাড়ির চাবি দিয়ে রিমোটে গাড়ির লক খুলে দিল।


    (৩৬)

    বিজয় তার কথা শেষ করে আসছে না দেখে সবাই একটু উশখুশ করছিল। জেঠিমা তো বলেই ফেললেন, "এত কিসের কথা রে বাবা! অনেকক্ষণ তো হ'ল।"

    অর্কদের চিন্তা হচ্ছিল যদি নন্দনকানন বন্ধ হয়ে যায়, তাই ওদের তাড়া ছিল। সেই কারণে খণ্ডগিরি যাওয়াটাও ওরা বাতিল করেছে।

    অর্কর চঞ্চল হাত দুটো হঠাৎ করে গাড়ির ড্যাশবোর্ডের দিকে চলে গেল। যদি কোন পেনড্রাইভ পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো গান শুনে সময়টা একটু কাটতে পারে।

    ড্যাশবোর্ডের ভিতরে ছিল একটা পলিথিন প্যাকেট। সেটা খুলতে একটু ইতস্তত বোধ করছিল অর্ক, কিন্তু কৌতূহল বশে খুলে ফেলতেই দেখল ভেতরে রয়েছে পরচুলা, মেক-আপের সরঞ্জাম। অর্ক সঙ্গে সঙ্গে সেটা যেরকম ভাবে ছিল সেভাবেই রেখে দিয়ে ড্যাশবোর্ড বন্ধ করে দিল।

    অর্ক নিজের মোবাইল ফোনটা বের করল। দেখল তাতে অরূপ সরকারের একটা মেসেজ এসেছে - "অল ইজ ওয়েল?"

    অর্ক লিখল, "অ্যাভেঞ্জার্স এন্ড গেম"।


    (৩৭)

    বিজয় গম্ভীর মুখে গাড়ি চালাচ্ছে। মনে হচ্ছে মুডটা ঠিক নেই। অর্কর সাথেও খুব একটা কথা বলছে না। হুঁ, হাঁ বলে উত্তর দিচ্ছে। সে গাড়িটা বেশ জোরে চালালেও রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং মাঝে মাঝেই সিগন্যালে দাঁড়িয়ে পড়ায় শেষ পর্যন্ত নন্দনকাননে পৌঁছে দেখা গেল ভেতরে ঢোকার সময় পার হয়ে গেছে।

    অর্কর জেঠিমা তো বিজয়ের সামনেই বলে ফেললেন, "এর গাড়িতে ঘুরলে অর্ধেক জিনিসই দেখা হবে না।"

    বাধ্য হয়ে ওরা লিঙ্গরাজ মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হ'ল। বিজয় চুপচাপ থাকলেও মাঝে মাঝে একটু-আধটু কমেন্ট করছে। লিঙ্গরাজ মন্দিরের সামনেই পার্কিং-এ গাড়ি রেখে ওরা গেট দিয়ে ভেতরের উঠানে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে একজন পাণ্ডা এসে পুজোর জন্য প্রস্তাব দিল।

    সবাই মিলে পুজো দিতে গেলে অর্ক হঠাৎ টয়লেট যাবার জন্য বাইরে এল। ওর উদ্দেশ্য ছিল বিজয়ের উপর একটু নজর রাখা। গাড়ির কাছে এসে বিজয়কে কোথাও দেখতে না পেয়ে ও একটু চিন্তিত হ'ল। কোথায় গেল?

    বিজয় আশেপাশে কোথাও নেই। অর্ক অনেক দূর পর্যন্ত খুঁজতে খুঁজতে গেল।


    (৩৮)

    —অর্ক কোথায় গেল?

    অর্কর মা চমকে উঠলেন।

    —সে তো অনেকক্ষণ টয়লেট গেছে!

    অর্কর বাবা বললেন।

    সবাই মিলে তড়িঘড়ি অর্ককে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অর্ক কোথাও নেই, কোথাও না। বিজয়কেও গাড়ির কাছে দেখা যাচ্ছে না। সবাই চিন্তা করতে লাগল তাহলে বিজয়ের সাথেই অর্ক কোথাও গেছে। কিন্তু না বলে যাবে কেন?

    মন্দিরের সামনে অনেক ভিখারী বসে আছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে আর মোবাইল ফোন থেকে অর্কর ছবি দেখাতে একজন হাত তুলে কার পার্কিং জোনের পাশের রাস্তাটা দেখিয়ে দিল। অর্কর বাবা সমেত সবাই সেদিকে হাঁটতে লাগল।

    আশপাশের কোথাও তারা অর্ককে খুঁজে না পেয়ে ও. সি. প্রশান্ত বড়ালকে ফোন করলেন। তিনি বললেন, "আমি আসছি। আপনারা ওখানেই থাকুন।"


    (৩৯)

    পুরোনো বাড়ির স্যাঁতসেঁতে ঘরে অর্ক যখন চোখ খুলল তখনও নাকের কাছে একটা হালকা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিল। এবারে তার আসতে আসতে সব কিছু মনে পড়েছে।

    বিজয়কে খুঁজতে খুঁজতে সে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দেখতে পাচ্ছিল না। হঠাৎ তার মনে হলো পেছনে কেউ সন্তর্পণে আসছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার আগেই কেউ তার মুখে একটা রুমাল চেপে ধরল পিছন থেকে। রুমালের মিষ্টি গন্ধটা তার স্নায়ুকে শিথিল করে দিল, লুপ্ত পেল জ্ঞান।

    ঘরের ভেতরটা অন্ধকার হলেও বাইরে আলোর আভাস আছে। লোকজনের গলা পাওয়া যাচ্ছে। দরজাটা কিঞ্চিৎ ফাঁক হ'ল - একজন মুখ বাড়িয়ে দেখে ভারী গলায় কাউকে বলল, "জ্ঞান ফিরেছে।"

    তিনজন লোক একসাথে ভেতরে ঢুকল। অন্ধকারের মধ্যেও বিজয়কে চিনতে তার অসুবিধা হচ্ছে না।

    —এই বয়সেই টিকটিকিগিরি? একটা চড় দিলে তো মুখ দিয়ে দুধ গড়িয়ে পড়বে?

    গলাটা বিজয়েরই।

    —ওর লাশটা বস্তায় ভরে ট্রেন লাইনে ফেলে দিবি। ভাগ্যিস, গাড়ির পিছনে আমার নজর গিয়েছিল তাই রিমোট ট্র্যাকারটা দেখতে পেয়েছিলাম।

    বিজয়ের হাতে একটা খোলা ছুরি।


    (৪০)

    বাইরে হঠাৎ কেউ চেঁচিয়ে উঠল, "পুলিশ, পুলিশ!"

    অমনি ছুরি-টুরি ফেলে বিজয় আর তার সঙ্গীরা মুহূর্তে ছুটে পালাল। অর্ক একটা চেয়ারে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল, তাই সে উঠতে পারছিল না।

    তখন বাইরে ভারী জুতোর শব্দ আর হুড়োহুড়ি হচ্ছে। "ধরো, পাকড়ো" জাতীয় শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু অর্কর কথা কেউ জানে না। তাকে যেভাবে কষে বেঁধে রেখেছে তাতে করে সে নিজেও নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না। অর্কর মুখেও একটা রুমাল বাঁধা। অর্ক ইচ্ছা করেই গোঙাতে শুরু করল যাতে বাইরে থেকে কেউ একজন শুনতে পায়।

    —স্যার, একটা গোঙানির শব্দ মনে হচ্ছে!

    —কোথায়? কোন ঘরে? সার্চ করে দেখো। কুইক।

    —স্যার, একটা কমবয়সী ছেলে, রুমালে মুখ আর সারা শরীর দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।

    —বাঁধন খুলে ওকে এখানে নিয়ে এসো।


    (৪১)

    হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে প্রশান্ত বড়াল অর্কর প্রাথমিক চিকিৎসার পরে স্পেশাল কোচ দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন ভুবনেশ্বর থেকে হাওড়া আসার ট্রেনে। নিজের হাতে অর্ককে দিলেন একটা বড়সড় মিষ্টির বাক্স। বললেন, "আগে রাঘব বোয়ালগুলোকে লক-আপে চালান করে আসি, তারপর কালকে সব ক'টাকে কোর্টে তুলব। ও হ্যাঁ, তোমার সাথে জমিয়ে গল্প করার জন্য একদিন যাব লালবাজারে। তুমিও সাবধানে থেকে পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে এভাবেই হেল্প করো সারাজীবন।"

    অর্কর ফোনে অরূপ সরকারের কল এল—

    —এখন শরীর ঠিক লাগছে তো?

    —হ্যাঁ।

    —গাড়িতে যে মোবাইল আর লোকেশন ট্র্যাকার লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার আওতার বাইরে চলে যাওয়াতেই তোমার বিপদ এসে গেল। একটু সাবধানে থাকলে এমনটা হ'ত না, তবে তোমার জন্যই তাড়াতাড়ি ওদের ডেরার খোঁজ পাওয়া গেল। কখনও এমন হঠকারী ডিশিসন নিও না। তোমাকে সামনের সপ্তাহে একদিন ডাকছি। অনেক কিছু বলার আছে।

    এই বলে অরূপ সরকার ফোনটা ছেড়ে দিলেন।


    (৪২)

    আজ অর্ক তার বাবা-মায়ের সাথে লালবাজারে এসেছে। তাকে উর্ধ্বতন পদস্থ অফিসার পুরস্কৃত করার পর তার ভূয়সী প্রশংসা করে চা-পানের আয়োজনে নিমন্ত্রণ জানালেন। চা আর নানাবিধ ভাজাভুজি, মিষ্টি ইত্যাদি খেতে খেতে কথা হচ্ছিল। সেখানে প্রশান্ত বড়ালও উপস্থিত ছিলেন।

    অরূপ সরকার বললেন, "পুরো গল্পটা তোমার জানা দরকার অর্ক। তাই বলছি তোমাকে।"

    —কোচবিহার রাজপরিবারের কিছু মূল্যবান হীরা চুরি হয়েছিল বহুদিন আগেই। যে চুরি করেছিল সে একসময় আর্থিক অবস্থার চাপে সেগুলি নিয়ে আসে কলকাতার একজন সোনা ও হীরা ব্যবসায়ীর কাছে। সেই ব্যবসায়ী হীরাগুলো পরীক্ষার জন্য নিজের কাছে রেখে দেয়। এবং সেগুলোর মূল্য বহুগুন বুঝতে পেরে সরিয়ে ফেলতে উদ্যত হয়। যে হীরা চুরি করেছিল সেই লোকটার কাছ থেকে হীরা পাচারকারী ও মাদক ব্যবসায়ী বিজয় ঘটনাটা জানতে পেরে স্বর্ণ ব্যবসায়ীর গতিবিধির উপর নজর রাখে এবং এই কাজে সে দু'জন লোককে নিযুক্ত করে, যারা ৩২২ নং রুমে উঠেছিল। বিজয় ওই হোটেলের নব নিযুক্ত হোটেল বয়কে টাকার টোপ দিয়েছিল যাতে সে ওই লোক দুটোকে সহায়তা করে। কিন্তু বিজয় ওই লোক দু'জনের বুদ্ধি ও কাজের উপর ভরসা রাখতে না পেরে নিজেই ময়দানে নামে।

    তোমার আঁকা ছবিটা আমাদের খুব কাজে লেগেছে। আমরা সেটা আমাদের এক্সপার্ট আর্টিস্টকে দিতেই সে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে এঁকে ফেলে মুখখানা। একবার দাড়ি এঁকে, মুখে আঁচিল—যেমনটা তুমি এঁকেছিলে... তারপর শুধু মুখের রেখাগুলোর স্কেচ করে... শেষ পর্যন্ত আমরা দেখলাম সেই ছবি ক্রমশঃ রূপ নিচ্ছে যাকে আমরা অনেক দিন ধরে খুঁজছিলাম সেই কুখ্যাত হীরা পাচারকারী... যাকে তুমি বিজয় নামে চিনতে… আসলে ওর নাম 'পবন'।

    খুনের ঘটনার দিন দুপুরে ৩২২ নং রুমের লোকদুটো পবন ওরফে বিজয়ের কথামত নতুন হোটেল বয়ের সাহায্য নিয়ে রুম নং ৩০৫ এর জায়গায় ৩০৪ নং রুমে ঢুকে পড়ে। সেই ঘটনা নিয়ে শোরগোল শুরু হতেই তারা বিকেলবেলা গা-ঢাকা দেয়। বিজয় ওরফে পবন ওদের কাজের উপর ভরসা রাখতে না পেরে নিজেই আসে সেই মূল্যবান হীরাগুলোর সন্ধানে। কিন্তু ৩০৫ নং রুমের স্বর্ণব্যবসায়ী অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মত হীরাগুলোকে সোনার গোপাল মূর্তির ভিতরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেগুলো হাতাতে বিজয় মরিয়া হয়ে উঠে। কিন্তু সে জানত না কোথায় লুকোনো আছে। তাই সে বাধ্য হয়ে ভদ্রমহিলাকে খুন করে। যাতে না তিনি পুলিশের কাছে ওর বর্ণনা দিতে পারেন।


    (৪৩)

    ফেরার সময় অর্ক গাড়ির জানলার ধারে বসে ছিল, বৌবাজার ক্রশিং-এর কাছে হঠাৎ সে দেখল সেই স্বর্ণব্যবসায়ীকে যিনি সেই সদ্য মাতৃহারা শিশু দুটির পিতা। দিন কয়েকের ঝড়ে যেন শুকিয়ে গেছেন।

    অর্ক ড্রাইভারকে গাড়ি সাইডে দাঁড় করাতে বলল। তারপর গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সাবধানে এগিয়ে গেল লোকটির দিকে।

    —কেমন আছেন?

    মুখটা তুলে দেখলেন অর্ককে। চিনতে পারলেন। দু'দিকে ঘাড় নেড়ে বললেন, "একদম ঠিক নেহি হ্যায়।"

    —বাচ্চালোগ ক্যায়সা হ্যায়?

    —মাম্মিকে লিয়ে রো রহে! বহুত রো রহে।

    হঠাৎ তিনি বললেন, "ম্যায় যো গলতি কিয়া উসকা সজা মেরা বাচ্চোকা মিল রহে।"

    লোকটা আর দাঁড়াল না। টলতে টলতে এগিয়ে গেল ফুটপাত ধরে।

    অর্ক সেদিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। লোকটার বিরুদ্ধেও বোধ হয় মামলা হবে। তবে ও নিজের সব অন্যায় স্বীকার করেছে।


    (৪৪)

    সোনার গোপাল মূর্তির মধ্যে হীরাগুলো লুকিয়ে রাখার বুদ্ধিটা ছিল ওরই। সেটা আর কেউ জানত না। এমনকি বিজয় নিজেও বুঝতে পারে নি। তাই সে খালি হাতেই ফিরে আসে।

    খুনের পর লোকটা যখন বাচ্চাদের নিয়ে হোটেলে ফিরে আসে তখন দেখে গোপালের মূর্তিটা তার মৃতা স্ত্রীর পাশে পড়ে আছে। সেটা সোনার হওয়া সত্ত্বেও খুনী নেয় নি। আসলে সে ধরতেই পারে নি যে একটা ছোট কাপড়ের পুঁটুলিতে হীরাগুলোকে বেঁধে ভরে রাখা হয়েছে সোনার গোপালের মধ্যে। তাই পুলিশ আসার আগেই স্বর্ণব্যবসায়ী সেই পুঁটুলি আবার সরিয়ে ফেলে খালি গোপাল মূর্তি তুলে দেয় তাদের হাতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ষা পায় না সে। তার বাচ্চা দুটিকে অপহরণের চেষ্টা করে বিজয় এবং সেজন্যই সেদিন সে ধবলগিরিতে ফোনে অনেকক্ষণ ব্যস্ত ছিল। কিন্তু লিঙ্গরাজ মন্দিরের কাছে তাকে অর্ক ফলো করতে করতে প্রায় তাদের ডেরার কাছে পৌঁছে যাওয়ায় অর্ককে তারা প্রথমে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে ধরে নিয়ে যায়।

    বিজয় অনেক আগেই সেই নতুন হোটেল বয়ের কাছ থেকে জেনে যায় যে অর্কর সাথে পুলিশের যোগাযোগ আছে। তার ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর এজেন্সির ফোন নম্বরে গাড়ির জন্য অর্কদের কল আসতেই সে নিজে ড্রাইভার সেজে চলে আসে অর্কর উপরে বিশেষ ভাবে নজর রাখার জন্য।

    সে অর্কর চিন্তাভাবনা অন্য দিকে ঘোরানোর জন্যই চন্দ্রভাগা হয়ে ধবলগিরিতে যাওয়ার পথে আগের দিন সেই লোক দুটোর মাঝপথে নেমে যাওয়ার ও ছুরি দেখিয়ে ভাড়া না মেটানোর মিছিমিছি গল্প ফাঁদে।

    বিজয় ওরফে পবন ও তার দলবল এখন জেলে এবং তাদের যে খুব কঠিন শাস্তি হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

    বাড়ি ফিরে পুরস্কারের সার্টিফিকেট আর মেডেলটা অর্ক সাজিয়ে রাখে তার বইয়ের আলমারিতে।


    (সমাপ্ত)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ পিতলের গোপাল মূর্তি
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)