|| ১ ||
জাহাজ আবার চলতে শুরু করল।
খিদিরপুরের ছয় নম্বর ডক থেকে ছেড়ে এসেছিল কাল রাত্রেই। শেষ বৈশাখের তাপে গঙ্গা একেই কিছু শীর্ণা হয়েছেন, তারপর রাতে পড়ল ভাটা—জাহাজ দাঁড়িয়ে গেল গার্ডেনরীচে, ক্লাইভ মিলের ঠিক সামনেটায়। এখন ১৩ই মে, ১৯১৫; সময় সকাল সাতটা।
“সানুকি-মারু”র প্রথম শ্রেণীর ডেকের ধারে ঝুঁকে জাহাজের গায়ে আছড়ে পড়া জল দেখছিলেন ঊনত্রিশ-ছুঁই বলিষ্ঠদেহী যুবকটি। পতিতপাবনী ভাগীরথীর জল। তাঁর বাড়ির কাছেও—চন্দননগরে ফটকগোড়ায় এমনি করে বয়ে যেত এ নদী। ছেলেবেলায় সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে বিকেলের দামাল খেলাধুলো সাঙ্গ হয়ে গেলে গোঁসাইঘাটে জোড়া-অর্জুন গাছের কাছে নদীর জলে পা ডুবিয়ে একলা বসে থাকতেন। আর ছলাৎছল শব্দে হৃৎস্পন্দন এঁকে যেত তাঁর আজন্মলালিত স্বপ্ন—দেশের মাটিকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করার স্বপ্ন।
হ্যাঁ, সেই মাটিই তো! বয়া ফেলে মাঝনদীতে দাঁড়িয়ে আছে জাহাজ—ওই দূরে কূল দেখা যায়, ওই তো সেই পবিত্র মাটি! তবে তাকে ফেলে আজ কোথায় চলেছেন তিনি? মানুষটার সারা শরীর চঞ্চল হয়ে ওঠে। না, কোথাও একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ জাহাজের হুইসল তীব্র জোরে বেজে ওঠে। অজান্তেই কয়েক পা পিছিয়ে আসেন তিনি, বুঝতে পারেন, জাহাজ চলতে শুরু করল! একবার চলে গেলে আর তো ফেরা হবে না! এই মাটিতে, মায়ের কোলে আর কোনোদিন ঠাঁই হবে না যে!
পায়ের তলার জাহাজ দুলছে, যেন সমস্ত পৃথিবীটাই দুলে উঠছে তাঁর চারদিকে। তিনি মনস্থির করলেন, না। শত বিপদ থাকলেও এ দেশ ছেড়ে যাওয়া হবে না তাঁর। দৃঢ় পদক্ষেপে রেলিঙের ধারে এগিয়ে আসেন তিনি আবার। তারপর জলে ঝাঁপ দেন।
জলের খেলায় তাঁকে হারাবে, গঙ্গার জোয়ারের এমন সাধ্য নেই। আর-একটু...একটু দূরেই তীর। ফিরে আসা—মরণ-বাঁচন যা হবে, সব ওই মাটির বুকে হোক। প্রাণপণে সাঁতরাতে থাকেন তিনি—আর-একটু...আর-একটু...কিন্তু এ কি দৃষ্টিবিভ্রম? মরীচিকার মত দূরে সরে যাচ্ছে কেন তাঁর জন্মভূমির উপকূল? দূরে, দূরে, আরও দূরে… এদিকে উচ্ছল তরঙ্গে ক্রমে অবসন্ন হয়ে পড়ছে তাঁর শরীর। চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে... দেশের মাটিতে সূর্যের আলো আর কি দেখা হবে না? উত্তাল ঢেউ সহসা একেবারে ঢেকে দেয় তাঁর দৃষ্টিপট...
কিমোনোর বুকের কাছটা খামচে ধরে বিছানায় উঠে বসেন মানুষটি। শ্বাসপ্রশ্বাস মাত্রাধিক দ্রুত। অসুস্থ হৃৎপিণ্ডের গতিও তথৈবচ। হাত বাড়িয়ে জলের গ্লাস খোঁজেন তিনি।
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়েই বিছানার পাশের আলোটা জ্বালিয়ে দেন পঞ্চান্ন বছরের বৃদ্ধ রাসবিহারী বসু।
প্রায় তিনদশক আগের জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সেই দোটানা এখনও ঘুমের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে। কী প্রবল মানসিক শক্তিসঞ্চয় করে সেদিন তিনি ফিরে গিয়ে কেবিনের দরজা বন্ধ করেছিলেন, কলকাতার সীমানা একেবারে পার হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত চোখ রেখেছিলেন হাতে-ধরা ভগবদ্গীতার পাতায়, তা এখনও ভেসে ওঠে মানসপটে। আন্দামানের পাশ দিয়ে, পিনাং বন্দর, সিঙ্গাপুরের পুলিশী তল্লাশি পেরিয়ে, হংকঙে “প্রিয়নাথ ঠাকুর” ছদ্মপরিচয়ে পারমিট আদায় করে, কোবে শহরের মাটিতে সেই যে এসে পৌঁছেছিলেন, আর তাঁর ফেরা হল না। বছরের পর বছর ধরে কর্তব্য আর ব্যক্তিগত ইচ্ছার টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে…
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে তাঁর। চোখের দৃষ্টি যথাসম্ভব তীক্ষ্ম করে খোলা হাতঘড়ির দিকে তাকান। তারপর চশমাটা খুঁজে চোখে দিতেই হয়।
এখন রাত তিনটে হলেও, আর ঘুমানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। আজ আটই জানুয়ারী, ১৯৪৩। সকালেই বিদাদরীর ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগের সভায় যেতে হবে তাঁকে। পুঞ্জীভূত অন্তর্কলহের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে হবে। আই.আই.এল. সর্বাধিনায়ক রাসবিহারী বসুর আজ অগ্নিপরীক্ষা।
|| ২ ||
পুরানো কালো মোটরখানা যখন সভাঘরের সামনে বাঁক নিচ্ছে, সামনে উত্তেজিত জনজোয়ার দেখে মনে-মনে নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন তিনি। সাধারণ জনতা নয়, ভারতীয় মুক্তিসঙ্ঘের সঙ্গে জড়িত কর্মী, সামরিক-অসামরিক নেতৃবৃন্দ। এঁরা তাকে চেনে না—সামরিক অফিসারদের প্রচারের ভিত্তিতে তৈরি করে নেওয়া তাঁর ভাবমূর্তিটুকু জানে শুধু।
"ডাউন উইথ প্রেসিডেন্ট বোস!"
"গো ব্যাক রাসবিহারী!"
কালো পতাকার ভিড়ের মাঝে পথ করে সভাগৃহের দিকে হাঁটতে থাকেন তিনি। বয়সের ভার থাবা রেখেছে তাঁর পদচারণায়—তবু তিন সহচরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিক্ষোভ এড়িয়ে যথাসাধ্য দ্রুত এগোনোর চেষ্টা করেন। আচমকা তাঁর খুব কাছেই কোনো একটা গলা চিৎকার করে উঠল—"দেশদ্রোহী রাসবিহারী দূর হটো!"
পাশের লীগকর্মীর সতর্ক হাতটা ঠিক সময়ে তাঁর কাঁধ চেপে না ধরলে হয়তো হোঁচট খেয়ে পড়তেন তিনি। সম্বিৎ ফিরল পাশের মানুষটির দয়ার্দ্র কণ্ঠে—"থোড়া সমহালকে, সেনসেইজী!"
সামলে নিলেন অবশ্য তিনি মুহূর্তেই। দিল্লী ও লাহোর ষড়যন্ত্রের কর্ণধার, সর্বভারতীয় সেনা-অভ্যুত্থানের কাণ্ডারী দুঃসাহসী বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর এত অল্পেই বিচলিত হওয়া সাজে না।
থমথমে সভাঘরে বক্তৃতা দিতে উঠে দাঁড়ানোর পরেই পিছন দিকে অপ্রসন্ন গুঞ্জন উঠল। তাতে কর্ণপাত না করে রাসবিহারী মাইকটা কাছে টেনে নিলেন। তারপর চিরাচরিত সংযত আবেগে উচ্চারণ করলেন প্রিয় সম্ভাষণ—"মেরে হাতিয়ারবন্দ্ দোস্তোঁ!"
সভাস্থলের মৃদু আলোড়ন হঠাৎ তীব্র ক্রুদ্ধ বিস্ফোরণে ফেটে পড়ল। ছিটকে উঠে দাঁড়ালেন সামনের সারিতে বসে থাকা এক সামরিক অফিসার—"উই আস্ক য়ু টু উইথড্র দ্যাট!"
বিরোধিতার কারণ যে পূর্বনির্ধারিত, তা জেনেই বিচলিত হলেন না সভাপতি। শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন, "মে আই নো দ্য রীজন অফ সাচ …"
"উই ডোন্ট ওয়ান্ট টু বী কলড কমরেড-ইন-আর্মস…" লাফিয়ে উঠেছে তরুণতর এক সেনানায়ক, "বাই য়ু! জাপানীর দালাল! বিশ্বাসঘাতক!"
সহর্ষ স্বতঃস্ফূর্ত করতালিতে সভাঘর ধ্বনিত হয়ে ওঠে। সমর্থনে বারংবার রব ওঠে—ভারতের শত্রু, জাপানের গুপ্তচর রাসবিহারী নিপাত যাও!
যাঁকে উদ্দেশ্য করে এই বজ্রপাত, তাঁর কোনো ভাবান্তর লক্ষিত হয় না। বিষণ্ণ চোখের কোণে কোনো অবাঞ্ছিত তারল্যের ঝিকিয়ে ওঠা লক্ষ্য করার জন্যও কেউ ছিল না যদিও।
বিরুদ্ধতার কারণ তাঁর কাছে স্পষ্ট। দলীয় সংঘাত। দেশে থাকতে তাঁকে এ-জিনিস প্রত্যক্ষ করতে হয়নি কখনো—নেতৃত্ব, শিষ্যত্ব এ-সবই ছিল অন্ততঃ তাঁর সংগঠনে পরম শ্রদ্ধার জায়গা। তবে বিশ্বাসঘাতকতার স্বরূপ তাঁর অপরিচিত নয়। সেদিন কৃপাল সিং-এর চক্রান্তে ‘গদর’ ব্যর্থ হয়েছিল, স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল তাঁর। কিন্তু আজ তিনি হার মানতে আসেননি। পরম বিশ্বাসে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন যার উপর, সেই মোহন সিং-এর ক্ষমতালোভী মানসিকতাই আজকের এই সংকটের জন্ম দিয়েছে। সে চেয়েছিল একচ্ছত্র আধিপত্য—লীগের নেতাদের সম্মতিক্রমে সাংগঠনিক দায়িত্ব রাসবিহারীর উপর অর্পিত হওয়ার পরও। রাসবিহারী প্রাণপণ চেষ্টায় দলের দুটি ভিন্নমতাবলম্বী অংশের মাঝে দাঁড়িয়ে মধ্যস্থতা করতে চেয়েছেন নানা উপায়ে। কিন্তু পদে পদে প্রতিটি নেতৃস্থানীয় সদস্যের সঙ্গে বিরোধ তৈরি করে গেছে মোহন সিং—বিনা অনুমতিতে সৈন্যদের বিভিন্ন জায়গায় দলে দলে পাঠিয়ে দিয়ে, ব্যক্তিগত ইচ্ছায় আর্মিকে ব্যবহার করে, ব্রিটিশ গুপ্তচর সন্দেহে ধৃত অফিসারকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার অবান্তর দাবি না মেটালে দল ভেঙে দেওয়ার ভয় দেখিয়েছিল সে।
বিস্মিত রাসবিহারী প্রশ্ন করেছিলেন, কোনো দেশের সৈন্যবাহিনী কি ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ভাঙে-গড়ে?
মোহন সিং-এর দল জবাব দিয়েছিল, যে কোনো বাহিনী ভেঙে ফেলার অধিকার আছে সংগঠকের। তা ছাড়া, ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় দেশ ছেড়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা রাসবিহারী বসুর কী অধিকার? তার জাপানী কন্যা বিবাহ করা, তার সামুরাই-ঘনিষ্ঠতা, জাপানী ভাষায় গ্রন্থরচনা, আর শেষ পর্যন্ত জাপানের হাতে ভারতকে বিকিয়ে দেওয়ার গোপন উদ্দেশ্য—এ তো কারোর অবিদিত নেই!
বিচলিত হয়েছিলেন রাসবিহারী সেদিনই। যেহেতু দলের মূল নেতারা সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তাঁকে নির্বাচন করেছিলেন, তাই শেষ পর্যন্ত ইস্তফা দিয়ে চলে যেতে হয়েছিল সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা মোহন সিং-কেই। দলের নিয়ম-বহির্ভূত আচরণহেতু গ্রেফতারও হতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু যাওয়ার আগে দলে যে ভাঙন সে ধরিয়ে দিয়ে গেছে, তা যে একদিন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে সে আন্দাজ করেছিলেন উত্তর ভারতের একদা অবিসংবাদিত চরমপন্থী নেতা। পদত্যাগ করা সদস্যদের ছেড়ে অনতিবিলম্বে সংগ্রাম-পরিষদ অর্থাৎ কাউন্সিল অফ অ্যাকশনের সমস্ত ক্ষমতা তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন—ঠিক এক মাস আগে।
ডিক্টেটর! ডিক্টেটর! ত্রস্ত অবিশ্বাসের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে আই.এন.এ-র প্রতিটি স্তরে। জাপানী দালাল রাসবিহারীর গা-জোয়ারি করে ক্ষমতা আত্মসাৎ করায় জাপানের হাতের পুতুল হয়ে গেছে ভারতবর্ষের মুক্তিসঙ্ঘ—এই মর্মে মোহন সিং-গোষ্ঠীর পুরোদস্তুর প্রোপাগান্ডায় মনোবল ভেঙে গেছে সিংহভাগ আজাদী সৈনিকের। বিরোধিতার সেই তুফান যে আজ ফুঁসে উঠবেই, সে তো তাঁর জানা!
সভার উত্তেজনা কিছু স্তিমিত হলে তিনি আবার বক্তব্যে ফিরে আসার চেষ্টা করলেন।
“আমি বিশ্বাস করি, আমাদের মুক্তি আন্দোলন পরিচালনার পথে কোনো মতদ্বৈধ হয়ে থাকলে…”
এবার বাধা এল দ্বিতীয় সারি থেকে। প্রশ্ন ছুটে এল—"ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলার কী যোগ্যতা আছে আপনার? আপনি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন আই.এন.এ.-র জন্য সবকিছু দান করতে। নিজে কী দিয়েছেন? আপনার...”
অভিযুক্ত অধিনায়ক আত্মপক্ষ সমর্থনের আগেই সপাটে আছড়ে পড়ে বাকি প্রশ্নটা—"নিজের ছেলেকে আই.এন.এ.-র বদলে জাপানী সেনাবাহিনীতে পাঠিয়েছেন কেন?”
সোল্লাস গর্জনে ফেটে পড়ল বিদাদরীর টাউন হল। মাসাহিদে বসু। রাসবিহারীর জ্যেষ্ঠ সন্তান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ওকিনাওয়ার রণাঙ্গনে জাপ-বাহিনীর নয় নম্বর ট্যাঙ্কবিভাগের নেতৃত্ব দিতে গেছে সে। ছেলের মধ্যে সেদিন চারদশক আগের নিজেকে দেখতে পেয়েছিলেন রাসবিহারী—সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা চন্দননগরের দামাল কিশোর রাসুর মুখ ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে।
মাসাহিদে জাপানের নাগরিক, জাপানের স্নেহমায়া-ঘেরা পরিবেশে পিতার থেকে বহুদূরে মাতামহীর কাছে লালিত। পিতৃদত্ত নাম ভারতচন্দ্র হলেও, ভারতীয় বাহিনীর প্রতি আনুগত্যের দায়ভার তার উপরে চাপানো চলে না।
শান্তকণ্ঠে সেই কথাই পুনরাবৃত্তি করলেন রাসবিহারী, বিক্ষুব্ধ জনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে। দৃঢ়স্বরে জানালেন, “মানুষের উপর জন্মদাতার চেয়ে জন্মভূমির দাবি অনেক বেশি। আপনারা—যারা মাতৃভূমির প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করে পরিবার-পরিজন ছেড়ে এসেছেন—তাঁরাও কি এ কথা মানেন না?”
সমবেত কর্মীদের সংশয়ী গুঞ্জনে ভ্রূক্ষেপ না করে রাসবিহারী বলে চললেন, “আজ মোহন সিং পদত্যাগ করেছেন, কাল হয়তো আর কেউ না থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের মত কয়েকটি ক্ষুদ্র মানুষের পদে থাকা-না-থাকার উপরেই কি এত বড় একটা জাতির মুক্তিসংগ্রাম দাঁড়িয়ে আছে? আমি কাউন্সিল অফ অ্যাকশনের সমস্ত দায়িত্ব নিজেই নিয়েছি, এ কথা সত্য। কিন্তু ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ ও তার প্রতিটি শাখাকে আমি এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে কোনো সামরিক বা অসামরিক গঠননীতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আমি করব না। আমার দ্বারা আমার মাতৃভূমির বিন্দুমাত্র ক্ষতিসাধন হবে না এ কথা আমি…”
প্রবল জনরোষের চিৎকারে তাঁর স্বর চাপা পড়ে গেল। বারবার জনতাকে সংযত করার চেষ্টা করলেন রাসবিহারী—কিন্তু বিদ্বেষ তাদের একত্রিত করেছে। তিনি নীরব হলেন, শাণিত বিক্ষোভের তীর ছুটে আসতে লাগল শ্রোতা-কর্মীদের মধ্য থেকে—
“তোমার নেতৃত্বে আমরা বিশ্বাসী নই!”
“ইউ আর আ ডিক্টেটর!”
“দিস ইজ সাবোটাজ! আমাদের আন্দোলনকে জাপানীদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে!”
“ক্ষমতার লোভে তুমি দলকে বিভ্রান্ত করছ!”
রাসবিহারীর মানসপটে জেগে ওঠে কয়েকটা প্রিয়মুখ। "দেশের কাজে নিশ্চিত-মৃত্যু"র পুরস্কারের লোভে যারা শর্তবিহীন আনুগত্যে সমর্পিত হয়েছিল তাঁর কাছে। আজ এই মুক্ত সংগঠনে, ক্ষমতা দখলের কালঘূর্ণিতে নিজেকে বড় বেমানান লাগে মন্ত্রগুপ্তির মহানায়কের। না, একাধিপত্যের লোভ নয়। কর্মসফলতার তীব্র বাসনাই তাঁকে বাধ্য করেছে এই পদক্ষেপ নিতে। এ ক্ষমতা তাঁর নিজের ব্যবহারের জন্য নয়… জরাবিকম্পিত হাতে কি তরবারি ধরা যায়?
এতক্ষণ ধরে শত বাক্যবাণেও অবিচল প্রবীণ মানুষটিকে ডায়াসের উপর ঋজু ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কর্মীবৃন্দের বিদ্রূপ-উচ্ছ্বাসে কোথায় যেন ছেদ পড়ে। বোধহয় খেয়াল পড়ে, যে নৃশংস মানুষটির ছবি এতদিন বিক্ষুদ্ধ অফিসাররা তাদের মনে গড়ে তুলেছে, এই ভগ্নস্বাস্থ্য, বিনয়ী ও সংযমী অকালবৃদ্ধ মানুষটার সঙ্গে তার কোথাও একটা অমিল হচ্ছে প্রথম থেকেই। কোলাহল ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে থাকে। আর কক্ষজুড়ে পিনপতনের নৈঃশব্দ্য না আসা পর্যন্ত অপার ধৈর্যে, অটল ভঙ্গিমায় দণ্ডায়মান থাকেন মুক্তিসঙ্ঘের সভাপতি।
স্তব্ধবাক উদ্দেশ্যে ধীরোদাত্ত স্বরে বলে ওঠেন রাসবিহারী—"একবিন্দু জলকণার শক্তি কতটুকু? কিন্তু সমষ্টিগতভাবে তা প্রবল বন্যা আনতে পারে। আমি যা-ই হই, আপনাদের মত অগণিত সাধারণ জলবিন্দুর মধ্যেই আমি একজন। আমার মত একজন সামান্য ব্যক্তিকে নিয়ে দেশ নয়, স্বাধীনতা সংগ্রাম কারোর একার সিদ্ধান্ত নয়, সেনাবাহিনী কোনো ব্যক্তিবিশেষের নিজস্ব সম্পত্তি নয়। ভারতীয় সেনার দায়বদ্ধতা কোনো পদাধিকারীর কাছে নয়, কোনো আশ্রয়দাতা রাষ্ট্রের কাছে সে শর্তাধীন নয়—তাদের সর্বস্ব এক ও একমাত্র মাতৃভূমির জন্য বলিপ্রদত্ত। নিজস্ব স্বার্থপূরণে, দেশকল্যাণ-বহির্ভূত উদ্দেশ্যে সংগঠনের কোনো ক্ষমতা ব্যবহার করলে তাঁকে পদচ্যুত হতে হবে, সে তিনি যত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বই হোন না কেন। আমি আপনাদের সামনে ঘোষণা করছি, এই নিয়মের ব্যত্যয় স্বয়ং সর্বাধিনায়কের ক্ষেত্রেও সহ্য করা হবে না।"
চোখ ভরে আসা জলে নয়, জাপানের আধিপত্য নস্যাৎ করাতেও নয়—বিক্ষোভের সামনে তাঁর অকুতোভয় স্থৈর্যেই বশীভূত হয়েছে জনতা। পলকের বিরতি নিয়ে তিনি যোগ করলেন—"ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে, তার মাটিতে একটি নির্জন কোণে আমার শেষ আশ্রয় নেওয়ার অনুমতি পাব, কেবল এই আকাঙ্ক্ষাতেই আমি আমার ব্যক্তিগত যা-কিছু লীগের কল্যাণে উৎসর্গ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি।"
সম্মোহিত শ্রোতৃমণ্ডলীর উদ্দেশ্যে অবশিষ্ট দুটি-একটি প্রয়োজনীয় কথা বলে নিতে কোনো অসুবিধা হল না তাঁর।
"জিতে রহো সেনসেইজী!"
পিছনের সারি থেকে চিৎকারটা শোনার পর আর দাঁড়ালেন না বিজয়ী সভাপতি।
|| ৩ ||
জাতীয় পতাকা আটকানো কালো গাড়িটায় উঠে বসলেন তিনি। সভা শেষের ভিড়ের মধ্যে পথ করে ফাঁকা রাস্তায় উঠে অ্যাক্সিলেটরে চাপ বাড়াল ড্রাইভার। পিছনের সীটে হেলান দিয়ে মাথাটা এলিয়ে দেন ক্লান্ত রাসবিহারী।
সব অভিযোগই তাঁর পূর্বশ্রুত, কিন্তু কোনোটিই মিথ্যে নয়—সেটাই মর্মান্তিক পীড়া দেয় তাঁকে। মাসাহিদের প্রসঙ্গে তিনি দৃঢ় উত্তর দিয়েছেন, জাপ-সংস্কৃতির আত্মীকরণ নিয়েও তাঁর বিন্দুমাত্র গ্লানি নেই—তারা তাঁর আশ্রয়দাতা, সর্বোপরি মুক্তিসঙ্ঘের সহমর্মী রাজনৈতিক মিত্র। বিমান-দুর্ঘটনায় নিহত আই.এন.এ. নেতাদের শোকযাত্রায় যোগ দিয়েছেন স্বয়ং জাপ-প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজো। অপার শ্রদ্ধায় তারা তাঁকে ডেকেছে “সেনসেই” বলে, গুরু বলে। তাঁর মনে শুধু ফিরে আসে মোহন সিং-এর সেদিনের প্রথম অভিযোগটা — তিনি পলাতক! এসকেপিস্ট!
অথচ পালানো ছাড়া তাঁর উপায় ছিল না। ভাইসরয়-হত্যাপ্রচেষ্টার মূল অভিযুক্ত, সর্বভারতীয় সেনা-অভ্যুত্থানের নেতা রাসবিহারী বসুকে তাদের চাই—মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনালের তালিকায় তখন একেশ্বর হয়ে বিরাজ করছে এই রাজদ্রোহী। রাসবিহারী ছায়ার মত সরে গেছেন বহুবার পুলিশ-গোয়েন্দাদের গ্রাস থেকে, আর অপমানে জ্বলে উঠেছে ব্রিটিশ সিংহ! তাঁর মাথার উপর ঘোষিত পুরস্কারের অঙ্ক বেড়ে গেছে এক লক্ষ টাকায়! এমতাবস্থায় ধরা দেওয়ার অর্থ ব্রিটিশের আত্মতৃপ্তি। তা কি হতে দেওয়া যায়?
“Slaves of a century longing to be free
From the yoke of British tyranny.
Our leaders imprisoned, our people cry,
For succour, lest they die.”
তিনি জানতেন, দেশের মানুষের হাতে প্রভূত পরিমাণে অস্ত্র না পৌঁছলে গণজাগরণ কয়েক মাস আগের গদরের মতই বিফল হবে। সেই অস্ত্রশক্তির জোগান দেওয়ার কাজ এবার তাঁকেই করতে হবে, বিদেশের মাটি থেকে। তাই সানুকি-মারুর সওয়ারী হয়ে দেশ ছেড়ে এলেন তিনি। জাপানে ছড়িয়ে থাকা ভারতীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা শুরু করেছিলেন অবিলম্বেই।
তবু ভুলতে পারেন না জাহাজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে দেশে ফিরে যেতে চাওয়ার তীব্র ইচ্ছের মুহূর্তক’টি। দুঃস্বপ্নের মত তাঁর কাছে বার বার ফিরে আসে সে-দৃশ্য, মনে হয়—সেদিন তাঁর ভুল হয়েছিল। বিপ্লবী অনুজদের ফেলে দেশ ছাড়া উচিত হয়নি তাঁর; নতুন জীবনের সবকিছুই যদি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, সবদিক দিয়ে শেষ হয়ে যাবে তাঁর সার্থকতা।
ব্যর্থতা তাঁর পিছু ছাড়েনি কোনোদিনই।
জাপানে চারমাসের প্রাণান্ত পরিশ্রমের পর ভগবান সিং-এর কেনা পিস্তল আর কার্তুজ যেদিন অবনী মুখার্জীর হাত দিয়ে দেশের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন—মন ভরে উঠেছিল কানায়-কানায়। স্বগতোক্তি করেছিলেন—"জ্যোতিদা, আমরা পেরেছি। শেষপর্যন্ত দেশের বাইরে থেকে অস্ত্র পাঠাতে পেরেছি। আপনি আর একটু ধৈর্য ধরে থাকুন…"
আজ তাঁর মনে হল, জ্যোতিদা—যতীন মুখোপাধ্যায় সেদিন এ আকুতি শুনতে পেলে হাসতেন। ধৈর্য ধরার পরামর্শ তিনিই দিয়েছিলেন একদিন রাসবিহারীকে, গদর অভ্যুত্থানের সূচনা করতে অনর্থক ব্যস্ততা দেখে। বলেছিলেন, বালেশ্বরের পথে পূর্ব ভারতে অস্ত্র আসবে, একসঙ্গে অতর্কিত আক্রমণে শেষ করে দেওয়া হবে একের পর এক ক্যান্টনমেন্ট... শুধু আর কয়েকটি মাস অপেক্ষা করো তুমি!
সেদিন রাসবিহারী বলেছিলেন, তা হয় না জ্যোতিদা। পঞ্জাব এখন বারুদের স্তূপ, একটা অসতর্ক আগুনের ফুলকিতে সে বিধ্বংসী রূপে আমাদেরই উপর ফেটে পড়তে পারে।
রাসবিহারী ক্ষণেকের জন্য হারিয়ে যান সেই স্মৃতিতে। তাঁর মনে পড়ে, এ-কথা শুনে চুপটি করে বসে ছিলেন বাঘা যতীন। কাশীর সেই ঘুপচি গলির মধ্যে ভাড়া বাড়িতে নেমে আসা বিকেলের আঁধার যেন ভিড় করেছে তাঁর মুখেও—অভিব্যক্তি পড়া যাচ্ছে না স্পষ্ট করে। হঠাৎ বাইরে একটা শব্দ আর বালিকা-কণ্ঠে চিৎকার শুনে রাসবিহারী একছুটে বেরিয়ে যান। জ্যোতিদার বড় ছেলে, চার বছরের তেজেন গড়িয়ে পড়ছে সিঁড়ি দিয়ে, আর তার দিদি আশালতা ছয়মাসের ছোটো ভাইটিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে—পড়ন্ত তেজেনকে থামানোর সাধ্য নেই তার।
রাসবিহারী দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তার গতিরোধ করে, দুই হাতে জড়িয়ে কোলে তুলে নেন। পরখ করেন, কোথাও চোট লাগল কিনা। হঠাৎ তেজেন মাথা তুলে বলে ওঠে, "আমি কিন্তু কাঁদিনি, বাবা! একটুও না!"
রাসবিহারী পিছন ফিরে দেখেন, যতীন্দ্র এসে দাঁড়িয়েছেন অদূরেই। প্রসন্ন হাসি ঝরিয়ে তিনি বলে ওঠেন, "তাই বুঝি? তবে তো তুই আমার বাঘের বাচ্চা, বাহাদুর!”
পিতা-পুত্রের রহস্যটুকু সেদিন অপরিচিত ঠেকেছিল। তবু সেদিন যখন অবনীর শেষ সংবাদ পেয়েছিলেন, এক-ঘর জনতার মাঝে চিত্রার্পিত দাঁড়িয়ে তাঁর চোখের উপর সেদিনের সেই অদ্ভুত দৃশ্যটাই ভেসে উঠেছিল আর-বার। তিনি জেনেছিলেন, অবনী ধরা পড়েছেন সিঙ্গাপুরে। আর তার আগেই, ৯ই সেপ্টেম্বর রাতে যখন ভগবান সিং নবলব্ধ অস্ত্রগুলি বাক্সে বোঝাই করছেন, তাঁর আপন দেশে বালেশ্বরে বুড়িবালাম নদীর তীরে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে অসমযুদ্ধে ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের জীবনদীপ।
ইন্দ্রপতনের অভিঘাতেও প্রকাশ্যে এতটুকু বিচলিত হননি তরুণ রাসবিহারী। ব্রিটিশ পুলিশ তখন জাপানের মাটিতে পাগলা কুকুরের মত খুঁজে চলেছে তাঁকে। পরিকল্পনার চরম পর্যায় থেকে টুকরো টুকরো হয়ে রূঢ় বাস্তবের মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর, ভূলুণ্ঠিত সৈনিকের জন্য চোখের জল ফেলবার অবসর তাঁর কই!
গাড়িটা গন্তব্যে পৌঁছতেই অবশ্য বিশ্রামের অবকাশ শেষ হয়ে যায় তাঁর। যুদ্ধের প্রথম দিবস সমাপ্ত, ক্ষণিকের জন্য জয়পতাকা তাঁর করতলগত হয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাঁকে আবার নতুন করে সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
|| ৪ ||
ফেব্রুয়ারীর মধ্যেই পূর্ণ উদ্যমে যেভাবে বিক্ষিপ্ত অংশগুলিকে একসুতোয় গেঁথে ফেললেন রাসবিহারী, তাতে যৌক্তিক বিরোধিতার পরিসর ক্রমেই ক্ষুদ্রতর হতে থাকল। ভগ্নপ্রায় কর্মযন্ত্রে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করলেন তিনি। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিভিশন চালু করলেন প্রথমেই। তারপর যোগ্যতম অফিসারদের বেছে নিয়ে মিলিটারি ব্যুরো, আর্মি কম্যান্ডিং ইউনিট… ছয়টি সংবাদপত্র সফল প্রকাশে দক্ষ প্রচারবিভাগ… কোন মহামন্ত্রে যেন বৃদ্ধ ফেরৎ পেয়েছেন তাঁর যৌবনের সাংগঠনিক দক্ষতা!
বহুদিনের অভিজ্ঞতা! জাপান এমব্যাসিকে লেখা চিঠিটা শেষ করে আনমনা হয়ে যান তিনি। সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় তিনি আগেও দিয়েছেন—যেদিন আমীরচাঁদজী সম্পূর্ণ উত্তর ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের দায়ভার তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, “বঙ্গালকা শের! তুমকো হাম সব নেতা মান্ লি!”
সেদিনের সঙ্গে এর কোনো তুলনা হয় না অবশ্য। আজকাল কাজের মধ্যে পরিদর্শন ছাড়াও পাতার পর পাতা নথি তৈরী করতে হয় তাঁকে, আইন-সংবিধানের তিলমাত্র বিচ্যুতি যাতে না হয়, স্বচ্ছতা থাকে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায়। সে-কালের মন্ত্র ছিল গোপনীয়তা। চাঁদনী চকে লর্ড হার্ডিঞ্জের উপর বোমা ছোঁড়া হয়েছিল তাঁর আদেশেই—সে কথা প্রত্যক্ষ কর্মী ছাড়া দলের আর কেউ জানত না। নিশ্ছিদ্র মন্ত্রগুপ্তির বলেই আহত হার্ডিঞ্জের মুখোমুখি হয়ে অনায়াসে তাঁর কুশলকামনা করে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি। নিজেকে ধরার জন্য ছদ্মবেশে অম্লানবদনে অর্থ সংগ্রহ করেছেন গোয়েন্দাদের কাছ থেকে। তখন বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি ছিল মৃত্যু—কিন্তু সে পরোয়ানা দেওয়ার পর হত্যাকারীর নাম জানবার অধিকার ছিল না দলনেতারও।
সেই সমস্ত কর্মীরা এখন আত্মগোপন করে আছে ভারতের নানা প্রান্তে। কেউ-বা কারাবরণ করেছে, কেউ প্রাণ দিয়েছে বিপ্লবের যূপকাষ্ঠে। সেই-সব চরিত্ররা বেঁচে আছে কেবল তাঁর অন্তরে। বসন্ত, শ্রীশ, বালমুকুন্দ, বিষ্ণুগণেশ—টোকিওয় তাঁর বাড়ির বাগানে একটা ওক-কাঠের ফলকে তাদের নাম উৎকীর্ণ করে রেখেছেন রাসবিহারী। সেটাই তাঁর সান্ধ্য উপাসনার বেদী।
লালা লাজপৎ রায়ের জাপান-তোলপাড় করা সভার পরই মাথার উপর নেমে এসেছিল ডিপোর্টেশনের খাঁড়া। তারপর মিৎসুরু তোয়ামার সহায়তায় নাকামুরার বেকারিতে সোমা-দম্পতির কাছে আশ্রয় নেওয়া, পুলিশের আনাগোনায় পলায়নরত, মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি এসে পড়া...হঠাৎ জমাট বেঁধে আসা অন্ধকারকে মায়াময় দীপ্তিতে ভরিয়ে দিয়ে তোশিকোর আবির্ভাব! সামুরাই-বংশের মেয়ের বিবাহবন্ধনে রাজনৈতিক সুরক্ষাকবচ লাভ করলেন মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু। তারপরও বিপ্লবীর দ্বন্দ্ববিধুর জীবন...ভূমিকম্প...গৃহহারা...পুনরায় ধ্বংসস্তূপের উপর সে-সব গড়ে তোলা...কবিগুরুর আগমন...পুত্রকন্যাকে আশীর্বাদ...সুদূর স্বপ্নের মত মনে হয় সব!
আজ কেবল আজাদ হিন্দের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করাই রাসবিহারীর জীবনের শেষ মিশন। গোপনীয়তার কাল গেছে, এখন চোখে-চোখ রেখে লড়াই করার দিন।
পাহাড়প্রমাণ চিঠিপত্রের পাশে রাখা ছোট্ট ডায়েরিতে অন্ত্যমিলে আঁচড় কাটে তাঁর কলম।
“Hands outstretched across the Indian Seas,
Eyes turned towards us, saying "if you please,
Send us aid to fight the British foe:
This is the only way to drive away our woe."
তিনি যে দেখতে পাচ্ছেন, তাঁর দেশের কোটি কোটি মানুষ, নিরন্ন-অসহায় হাত বাড়িয়ে ডাকছে—সাহায্য করো! সাহায্য! ভারতভাগ্যবিধাতা তাদের প্রতি রুষ্ট—কিন্তু ঘরছাড়া এই ভারতীয়রাও কি ভাইয়ের ডাকে সাড়া দেবে না?
What shall our answer be? "Yea" or "Nay"
Shall we close our eyes and say:
"We know you not," or shall we
Reveling in our manhood and our strength,
Call across the open Seas: “Stand up and fight
We are behind you with our might
To set you free, land of our destiny..."
কলম বন্ধ করেন রাসবিহারী। অসুস্থ বোধ করছেন তিনি। যৌবনে বিপ্লবীর ভবঘুরে অভ্যাস, কৃচ্ছ্রসাধন—সবকিছুই অকাল-জরায় প্রতিশোধ নিচ্ছে তাঁর শরীরের ওপর।
পালমোনারি টিউবারকিউলোসিস—সহৃদয় চিকিৎসক প্রথম লক্ষণেই স্পষ্ট জানাতে দ্বিধা করেননি। আরও জানিয়েছেন, বর্তমান অবস্থায় পরিপূর্ণ বিশ্রামের চেয়ে এ-রোগের আর কোনো বড় ঔষধ নেই।
হেসে জবাব দিয়েছেন রাসবিহারী, “দ্যাট উইল হ্যাভ টু ওয়েট আহোয়াইল!"
ডাক্তার সবই জানতেন। অসহায় শ্রাগ্ করেন তিনি একবার।
কর্মযোগী নিবেদিতার শেষ উক্তি মনে পড়ে যায় সেনসেইয়ের। “The boat is sinking, but I shall see the sunrise.”
উদয়ভানুর দেশে তাঁর জীবনতরণী ডুবে যাওয়ার আগে সুপ্রভাতের অরুণ আলো মাখবে না?
|| ৫ ||
অসুস্থ মানুষের ঘরে মিলিটারি জেনারেলের সৌজন্যসাক্ষাৎ!
রাসবিহারী এ সঙ্কেতের অর্থ বোঝেন। আগমন-সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র সর্বাধিনায়কের বর্মটা চড়িয়ে নিতে বিলম্ব হয় না তাঁর।
সেইজো আরিসুয়ে স্পষ্ট কথার মানুষ। সোজা বিষয়বস্তুতে চলে এলেন তিনি, “মাৎসুদাকে যদি পূর্ব এশিয়ায় আসার ছাড়পত্র দেওয়া হয়…”
বক্তব্য শেষ করার আগেই অব্যক্ত আকুতিতে তাঁর হাতটা জড়িয়ে ধরেন রাসবিহারী। বলে ওঠেন, “যেমন করে পারেন নিয়ে আসুন! আর তো দেরি করা সম্ভব নয়!”
আরিসুয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েন ব্যাকুল চোখদুটির দিকে তাকিয়ে। বেশ খানিকটা সময় লাগে তাঁর পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে। তারপর ঝানু ডিপ্লোম্যাটের সুরে বলেন, “কলিং হিম ওভার ইজ ফাইন, বাট আই হোপ ইউ উইল নট ফিল…”
“নেভার। রেস্ট অ্যাশিওরড।” পাল্টা দৃঢ়তায় জেনারেলের হাতে একটা চাপ দিয়ে ছেড়ে দেন প্রবীণ মানুষটি।
এবার তবে সত্যিই সময় হল!
সে আসবার চেষ্টা করেছিল আগেও; দূতাবাস, গোয়েন্দা-বিভাগের ফিতেবাঁধা সর্পিল পথে। লাভ হয়নি কিছুই। টোকিও দূতাবাস থেকে নিরুত্তাপ জবাব গেছে—এই পরিস্থিতিতে আরেকজন বিপ্লবীকে আনার কী দরকার?
দূতাবাসের দোষ ছিল না—“আরেকজন” সত্যই তাদের কাছে দর্পণে প্রতিবিম্বিত রাসবিহারী। বর্তমান পরিস্থিতিতে সে-ও গুপ্তসমিতির বিপ্লবীর মতই বহুরূপে বিরাজমান—পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ভারত ছাড়ার সময় সে ছিল ইনশিওরেন্স এজেন্ট জিয়াউদ্দিন, ইতালিতে পৌঁছে তার নাম অরল্যান্ডো মাসসোত্তা। দেশে থাকাকালীন তার প্রতিটি কুশলী পদক্ষেপ নিবিষ্টচিত্তে লক্ষ্য করেছেন রাসবিহারী। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও সে এখন বিপ্লবীর পদচিহ্ন ধরেই এগিয়ে আসছে—সশরীরে গোপন থেকে, বেতার-তরঙ্গে আত্মপ্রকাশ ক’রে। বার্লিনের বুক থেকে তার হুঙ্কার শোনা গেছে—“সময় উপস্থিত হলেই আমি ভারতের সীমানায় পৌঁছে যাব। যে শক্তি আমাকে ভারতের বাইরে যেতে বাধা দিতে পারেনি, সে আমার ভারতে প্রবেশ করাও আটকাতে পারবে না!”
ব্রিটিশ সিংহের জাত্যভিমানের উত্তরে বাংলার বাঘের গর্জন! রেডিওতে সমস্ত শুনে গর্বে বুক ভরে উঠেছিল রাসবিহারীর। একদিন তিনিও বহু-নামে চর্চিত হয়ে ফিরেছেন গোয়েন্দার নজর এড়াতে। কোথাও মানিকচাঁদ, কোথাও সুরেশ, কোথাও সতীশচন্দ্র, কোথাও নরেন্দ্র সেন, শেষমেশ চূচেন্দ্রনাথ দত্ত—পলায়নপথে স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় প্রিয়নাথ ঠাকুর পরিচয়ে! মৃদু হাসি ফুটে ওঠে রাসবিহারীর ওষ্ঠাধরে। না, বিপ্লবীর আসল নাম জানতে নেই! যেখানে যেমন, সেখানে তেমন ছদ্মনামে তাকে পরিচিত হতে হয়।
ইতালীয় মাসসোত্তা-কে এবার জাপানী ছাঁদে বদলে নেওয়া হয়েছে। ডায়েরির মার্জিনে রাসবিহারী নতুন সাংকেতিক নাম লিখে রাখেন—মাৎসুদা!
সযত্ন-নির্মিত স্বাধীনতার সেনাপতির বিগ্রহে প্রাণ-প্রতিষ্ঠাটুকু করা বাকি আছে তাঁর।
One fight more. The last and the best.
|| ৬ ||
ত্রিশে এপ্রিল। ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগের সংবিধানে সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য আয়োজিত চারদিনের সিঙ্গাপুর মহাসম্মেলন শেষ হওয়ার মুখে। আহুত অতিথিমণ্ডলীর মধ্যে পূর্ব এশিয়ার সমস্ত ভারতীয় নেতৃমণ্ডলী সগৌরবে উপস্থিত।
ভারত-জাপান মৈত্রীবন্ধন-সূত্রে বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে রয়েছেন কর্নেল বিন ইয়ামামোতো। একমাত্র এই ব্যক্তিটির উপস্থিতিতেই কিছুটা বিচলিত হতে দেখা যাচ্ছে এ সমাবেশের হোতা রাসবিহারী বসুকে। জনৈক মাৎসুদা-র সংবাদ নিতে নিতান্তই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি।
ইয়ামামোতোকেও চিন্তিত দেখিয়েছে। গত আঠাশ তারিখ থেকে থেকে তিনি ছুটে গেছেন দূরভাষ-যন্ত্রের কাছে। তবে সে শুধু হিকারি কিকানের সর্বময় কর্তা হিসাবে মাৎসুদার আগমনের দায়িত্ব তাঁর উপর বর্তায় বলেই নয়। বার্লিনে অবস্থানকালে তাঁদের মধ্যে এক নিবিড় বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল—ব্যক্তিগত উদ্বেগও কিছু সঞ্চারিত হচ্ছে এ কর্তব্যে। সঙ্গে কর্মব্যস্ত উদ্যোক্তাকেও নিয়মিত সংবাদ জানিয়ে যেতে হয়েছে। জার্মান আন্টারসিবুটে দুঃসাহসিক সমুদ্র অভিযানে পাড়ি দিয়েছে সে—সুমাত্রার উপকূলে এসে পৌঁছলেই তাকে গোপনে বিমানে তুলে নিয়ে টোকিও উড়ে যাবেন ইয়ামামোতো স্বয়ং।
রাসবিহারী জানেন, তাঁর তিল-তিল পরিশ্রমে গড়ে তোলা আই.আই.এলের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা নির্ধারিত হবে আজই। কনফারেন্সের চারটি দিনই অক্লান্ত ছুটে বেড়িয়েছেন তিনি। জোরালো সওয়াল করে গেছেন প্রস্তাবিত প্রতিটি পরিবর্তনের সপক্ষে। তার মধ্যে প্রধান হল সর্বাধিনায়কের ক্ষমতার প্রসারণ। নতুন নিয়মাবলীতে তাঁর হাতে সমর্পিত হবে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে যে কোনো আইন পুনর্লিখন করার ক্ষমতাও।
তীক্ষ্ণধী রাসবিহারী বিন্দুমাত্র সংকোচবোধ করেননি। লীগের এতকালের কার্যাবলী পর্যালোচনা করে উদাহরণ তুলে দেখিয়ে দিয়েছেন কোন-কোন ক্ষেত্রকে প্রেসিডেন্টের আয়ত্তের বাইরে রাখার জন্য কার্যপ্রণালীর গতিবিধি ব্যাহত হয়েছে। কীভাবে বিভিন্ন স্তরে দায়িত্বহীন ক্ষমতাবণ্টনের ফলে, ব্যক্তিবিশেষের অবিবেচনায় ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছিল সঙ্ঘের ভিত্তি। অকাট্য সে যুক্তিজালের সামনে নতি স্বীকার করতে হয়েছে সকলকেই। তাছাড়া তিন মাসে লীগের এই অত্যাশ্চর্য পুনর্গঠনের পর রাসবিহারীর সাংগঠনিক তথা নেতৃত্বদানের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলার কোনো ভিত্তি নেই। আজ সমস্ত প্রস্তাব সকলের ঐকমত্যে গ্রহণ করা শেষ হল।
সভাপতি ইয়েলাপ্পা ঘোষণা করলেন, নাউ দ্য কনস্টিটিউশন হ্যাজ বীন চেইঞ্জড্!
সম্মতি ধ্বনিত হল সকলের কণ্ঠে। ইয়ামামোতো সাধুবাদ জানালেন উচ্চৈঃস্বরে।
রাসবিহারীর পানে চেয়ে মৃদু হেসে ইয়েলাপ্পা যোগ করলেন, অ্যান্ড মিস্টার বোস ইজ দ্য কনস্টিটিউশন!
উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি হাসলেন। তারপর মৃদুকণ্ঠে যোগ করলেন, বোস ইট ইজ!
এতটা দাম্ভিক স্বীকারোক্তি আশা করেননি কেউই। সর্বসম্মতিক্রমে একনায়কত্ব যাঁর হাতে এইমাত্র তুলে দেওয়া হল, সেই নব-অভিষিক্ত নেতার কাছে আরও একটু বিনীত ধন্যবাদ প্রত্যাশিত নয় কি?
রাসবিহারী ধীরে ধীরে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন। অনুভব করলেন, সব-কটি চোখের দৃষ্টি তাঁকে বিদ্ধ করছে—কিছু কৌতূহলে, কিছু সংশয়াকীর্ণ বিরুদ্ধতায়।
“আপনাদের সকলের সম্মিলিত সহায়তায় আজ আমরা ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগের সংবিধানে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন আনতে পেরেছি…”
সকলকে তাঁদের কৃতিত্বের জন্য একে-একে ধন্যবাদ জানানোটাও আহ্বায়ক হিসেবে তাঁরই কর্তব্য। সংক্ষেপে, সাবলীলভাবে বক্তব্যের প্রয়োজনীয় অংশগুলি পেরিয়ে গেলেন তিনি। “সবশেষে আমার ব্যক্তিগত একটি সিদ্ধান্তের কথা জানানোর প্রয়োজন বোধ করি। আপনারা সকলেই জানেন, অদূর ভবিষ্যতে আমরা সম্মুখযুদ্ধে ভারতবর্ষের মাটিকে ভারতীয়দের জন্য ছিনিয়ে আনব। কিন্তু আমি অশক্ত, এ মহাসঙ্ঘকে সেই সর্বোচ্চ দক্ষতায় পরিচালনা করতে শারীরিক ভাবেও অক্ষম। তাই আজ আপনাদের জানাতে চাই—খুব শীঘ্রই আমাদের মধ্যে এক নতুন অধিনায়ককে বরণ করে নেওয়া হবে। অতঃপর তাঁর অধীনে একজন সাধারণ নিষ্ঠাশীল কর্মী হিসাবেই আমি এই সংগঠনের অংশ হয়ে থাকতে চাই। নবতম সংশোধনী অনুযায়ী, সর্বাধিনায়ক-পদের উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করার সাংবিধানিক অধিকার আমার আছে…”
মাথার উপর পাখার কর্কশ আওয়াজটা বাদ দিলে ঘরে শ্বাসরোধকারী নৈস্তব্ধ্য নেমে এসেছে। সমস্ত ক্ষমতা আত্মসাৎ করার পর বিনামেঘে এ কেমন বজ্রপাত!
বিগত ব্যাঙ্কক সম্মেলনের একত্রিশতম প্রস্তাবের কথাটা থেমে থেমে পুনরুচ্চারণ করলেন প্রেসিডেন্ট রাসবিহারী বসু।
কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পর পূর্ব-এশিয়ার ভারতীয় প্রতিনিধিকুল একযোগে উঠে দাঁড়ান। করতালির ঝড়ে ভেসে যায় মন্ত্রণাকক্ষ।
বিদায়ী প্রেসিডেন্ট অভিবাদন করে আবার চেয়ারে বসে পড়েন। তাঁর ক্ষীণদৃষ্টিতেও ধরা পড়ে, ইয়ামামোতো এই অবসরে চোখের কোল মুছে নিচ্ছেন।
|| ৭ ||
প্রতীক্ষিত আগন্তুক পিনাং বন্দর ছেড়ে টোকিওর উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছে। ৯ই মে কুয়ালা লামপুরের সৈন্যঘাঁটি পরিদর্শন করে ফিরেই সে সংবাদ পেলেন রাসবিহারী। আর শ্রবণ-মাত্রই চঞ্চল হয়ে উঠলেন প্রথম সাক্ষাতের অভিলাষে।
তেৎসুকোকে চিঠি লিখলেন তৎক্ষণাৎ। “এ মাসের বিশ তারিখের আশেপাশেই আমি ফিরছি।” তারপর যোগ করেছিলেন, “আমি সুস্থ আছি। যদিও কিঞ্চিৎ ক্লান্তবোধ করছি…”
মেয়ের কাছে মিথ্যাকথা বলেছেন তিনি আগেও। চূড়ান্ত অসুস্থতার মাঝেও আশ্বস্ত করে লিখেছেন, ভালো আছি। কিন্তু এক বছরের অদর্শনের পর ছোট্ট চিঠিখানায় আর অনৃতভাষণ করতে পারলেন না রাসবিহারী।
সিঙ্গাপুর থেকে আকাশপথে সায়গন হয়ে কুওয়াংতাং। রাত্রিবাসের পর তাইপেই হয়ে ফুকুওকা। টোকিও পৌঁছতে সাতাশ তারিখ হয়ে গেল তাঁর।
পয়লা জুন, পাঁচটা বাজতে তখনও তিন মিনিট বাকি। ইম্পিরিয়াল হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে আসছিলেন রাসবিহারী। ইয়ামামোতো দুই ধাপ পিছনে, যদিও পথনির্দেশ তাঁরই করার কথা। এই আগত সাক্ষাৎ তাঁরও বহু-প্রতীক্ষিত।
২১৭ নম্বর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে স্নায়ুতে একটা চাপা উত্তেজনা অনুভব করছিলেন রাসবিহারীও। মাৎসুদা। বয়স পঁয়তাল্লিশ পার করলেও দুঃসাহসের বিচারে সে নিতান্তই যুবক; যাকে দেখে তিনি একদিন লিখেছিলেন, সকল ভারতীয় নেতাদের প্রাচীনপন্থার মাঝে সত্যকার ভবিষ্যতের অগ্রদূত বলে যদি কেউ থাকে, তবে—
স্বহস্তে দরজা খুলে সে-ই তাঁদের স্বাগত জানাল। পরনে হালকা বাদামী স্যুট, সাদা শার্ট, নেকটাই। চোখে সুপরিচিত বাদামী বৃত্তাকার ফ্রেমের চশমা।
একমুহূর্তের দ্বিধা চেপে ধরল অভিজ্ঞ ডিপ্লোম্যাট রাসবিহারীকে। করমর্দন করার জন্য হাত এগিয়ে দিতে বুঝি-বা দেরি হল তাঁর। কিন্তু তার প্রয়োজনও ছিল না। ততক্ষণে স্মিতমুখে দুই হাত বিশুদ্ধ বাঙালি নমস্কারের ভঙ্গিতে তুলে জড়ো করেছে সে।
রাসবিহারী দু'চোখ ভরে দেখলেন তাঁরই মত আর-এক দেশ-ছাড়া দেশের মানুষকে।
ইয়ামামোতো আনুষ্ঠানিক পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য মুখ খুলেছিলেম। "সেনসেই" শব্দটুকু উচ্চারণ শেষ করার আগেই তিনি দেখলেন, আশ্চর্য দুটি অপরিচিত মানুষ পরম আত্মীয়তায় আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছেন।
“Today we stand outside our Mother's door,
Armed, ready, poised to strike her foe,
Mother of us all, Your hour of liberty
Draws nigh; Your sons will set you free…”
কবিতার খাতায় বেঁধে রাখা স্বপ্ন সফল হওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। পরদিন সকালে টোকিও রেডিও থেকে নবাগত অতিথির অগ্নিবর্ষী ভাষণ শুনতে শুনতে প্রতিমুহূর্তে সে-কথা অনুভব করছিলেন সেনসেই রাসবিহারী বোস।
শেষ স্বাধীনতা-যুদ্ধের শুভক্ষণ সমাগত।
***
চৌঠা জুলাই, উনিশশো তেতাল্লিশ। ভিড়ে উপচে পড়ছে সিঙ্গাপুরের ক্যাথে হল—নবীনবরণের উৎসবে ভাগীদার হতে চায় সবাই! একবার চোখের দেখা দেখতে চায় তাদের স্বপ্নের নতুন নায়ককে!
“মেরে হাতিয়ারবন্দ্ দোস্তোঁ!”
জনগণের সহর্ষ প্রত্যভিবাদনে ভ্রূক্ষেপ করেন না আজ বক্তা। তাঁর নিজের কর্তব্য-সমাপ্তির উচ্ছ্বাস সমস্ত মানুষের আনন্দকে আজ ছাপিয়ে উঠছে।
“টোকিও থেকে আজ আপনাদের জন্য যে উপহার আমি নিয়ে আসতে পেরেছি, তার কোনো আনুষ্ঠানিক পরিচিতি দেবার প্রয়োজন পড়ে না…”
জনতার গর্জনে ক্যাথে হল কেঁপে কেঁপে ওঠে যেন! রাসবিহারী গলা চড়ান, “তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি দেশসেবক! দেশগৌরব!”
শ্রোতৃবৃন্দের— তাঁর সামনে দাঁড়ানো একখণ্ড ভারতবর্ষের আনন্দ-উল্লাস দেখে গর্বে ভরে ওঠেন রাসবিহারী। এ তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহার নয়, নতুন অধিনায়ক নির্বাচনে স্বৈরাচারের প্রয়োগ নয়—এ তাঁর দেশের হৃদয়ের নির্বাচন! তিনি পেরেছেন উপযুক্ত কাণ্ডারীর সন্ধান দিতে!
“আজ আপনাদের উপস্থিতিতে আমি এই মহাসঙ্ঘের নেতৃত্বপদ থেকে অব্যাহতি প্রার্থনা করছি। এই মহাভার স্কন্ধে তুলে নেওয়ার জন্য আহ্বান করছি তাঁকে, ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতম গুণাবলী যাঁর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। আমার সশস্ত্র বিপ্লবের সাথীরা! তোমরা জেনো, আমি এ-যাবৎ আমার সীমিত সামর্থ্যে, আমার ক্ষুদ্রজীবনের যা-কিছু সবই আমার মাতৃভূমির মুক্তির জন্য উৎসর্গ করেছি—এ-ই আমার জীবনের ব্রত। যতক্ষণ এ দেহে প্রাণ থাকবে, আমি সৈনিকের ব্রত ত্যাগ করব না, আমার শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত আমি দিয়ে যাব আমার নতুন নেতৃত্বের আদেশে, ভারতমাতার শৃঙ্খলমোচনের যুদ্ধে। আমার যথাসর্বস্ব সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, আজ আমি সর্বান্তঃকরণে নবীন প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানাচ্ছি।”
জনসমক্ষে জীবনের শেষ বক্তৃতা দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন রাসবিহারী। করতালির ঝড় গ্রহণ করেন বিনীতশির। পাশে চেয়ে দেখেন, উঠে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে তাঁর নতুন উত্তরাধিকারী। বাদামী চশমার পিছনে বুদ্ধিদীপ্ত, সহৃদয় দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বড় পরিতৃপ্ত লাগে তাঁর। ঈষৎ মাথা ঝুঁকিয়ে ধীরে ধীরে বসে পড়েন তিনি। ভেঙে-পড়া শরীরটাকে কেঠো চেয়ারের গর্ভে ছেড়ে দেন।
তারপর নিমীলিতনয়নে স্মরণ করেন অস্তাচলগামী রবীন্দ্রের সেই অমোঘ বাণী—
“আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি— পিছনের ঘাটে কী দেখে এলুম, কী রেখে এলুম, ইতিহাসের কী অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ! কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।”
সভাস্থলে সমবেত সংগীত শুরু হয়েছে। ভাবী অর্ডার অফ দ্য রাইজিং সান—বৃদ্ধ রাসবিহারী বসু একতানমন হয়ে শুনতে থাকেন নব অরুণোদয়ের সেই বন্দনগীতি—
“সুভাষজী, সুভাষজী, ও জান-এ-হিন্দ আ গয়ে…”