|| ১ ||
যাবেন না কি?
একবার যাবেন না কি ওই সাঁকোটার উপরে?
দেখবেন না কি ওর নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটাকে?
আর বিকেলের পড়ন্ত আলোয় সামনের ওই বিশাল আকাশটাকে?
না না ভয় পাবেন না — আপনার জন্য কোনো দুর্ঘটনা অপেক্ষা করে থাকবে না।
ওই সব আকাশকুসুম শুধুমাত্র আমার জন্য —
আমি — আমি প্রফেসর সুকান্ত রায় –
এটাই লিখেছি — বহুবার — অনেক ভাবে — নাম বদলে বদলে ——জায়গা চেঞ্জ করে করে — ঘটনগুলোও কিছুটা এদিকসেদিক করে — কিন্তু শেষটা — শেষটা কিন্তু বদলাই নি কক্ষনো — ওকে সুইসাইড করিয়েছি প্রতিবার — এতো বছর ধরে — প্রতিটি লেখার শেষে — নয়তো আমি বেঁচে থাকবো কি করে বলুন তো? রীতাকে ছাড়া একা এভাবে — সেই ঘটনার পর থেকে —
তাহলে শুনুন না — আরেকবার গোড়া থেকে শুনুন না —
...."আঠারোই জুলাই। উনিশশো তিরাশি। বিকেল পাঁচটা। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকের একটি বেঞ্চ। সেন্ট পলস ক্যাথিড্র্যালের দিকে। সেখানেই বসে আছে সুনন্দ আর রিক্তা। সুনন্দ আসে ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে। আর রিক্তা আসে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে। কোনদিন ভিক্টোরিয়া। কোনদিন গঙ্গার ধার। কিংবা ময়দানের পাশ দিয়ে অ্যাকাডেমির সামনে। প্রায় প্রতিদিন বিকেলে। গত ছ মাস ধরে। কথা হয় ঘন্টাখানেক। একান্তে। যেমন সেই বিকেলে —
— 'কি হোলো রিক্তা? কি হোলো তোমার? হঠাৎ এমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলে কেন?' — জিজ্ঞেস করছিলো সুনন্দ।
— 'না — কিছু না' — উত্তর দিয়েছিলো রিক্তা।
— 'কিছু না বললেই হোলো?'
— 'সত্যি বলছি — কিচ্ছু হয় নি।'
|| ২ ||
— 'বললেই হোলো। হতেই পারে না। কিছু একটা হয়েছেই। তোমায় বলতেই হবে। তোমার মা কিছু বলেছেন? না ক্লাসে কিছু ..?'
— 'আরে না বাবা। ওসব কিচ্ছু না।'
— 'তাহলে? তাহলে কি প্রবলেম? বলতে তোমায় হবেই। নয়তো উঠতেই দেবো না এখান থেকে।'
— 'দূর! কি হবে বলে? ভাববে আমার মাথায় ছিট আছে।'
— 'সে তো নতুন কথা নয়। নাও বলো,' — রিক্তার হাতদুটো ধরে বললো সুনন্দ।
রিক্তা সুনন্দর চোখের দিকে কেমন একটা অসহায় ভাবে তাকিয়ে বললো — 'আমার কেমন ভয় করছে'
সুনন্দ ভুরু কুঁচকে উত্তর দিয়েছিলো — 'সে কি? কেন?'
রিক্তা মুখটা নামিয়ে আস্তে করে উত্তর দিয়েছিলো — 'কেউ একজন মারা যাবে। আমার চেনাজানা কেউ। কয়েকদিনের মধ্যেই। আমি নিশ্চিত।' চমকে উঠে সুনন্দ বলেছিলো — 'সে কি! কে মারা যাবে? কেন?'
'কেউ একজন মারা যাবেই। আমার চেনা জানা কেউ। কয়েকদিনের মধ্যেই। আমি নিশ্চিত।' — খুব শান্ত স্বরে বলেছিলো রিক্তা। সুনন্দ অবাক হয়ে বলেছিলো — 'তার মানে? কি বলছো পাগলের মতো?'
রিক্তা নির্বিকার কন্ঠে উত্তর দিয়েছিলো — 'যা বলছি তা ঘটবেই।'
সুনন্দ বলেছিলো — 'তুমি কি জ্যোতিষী নাকি?'
রিক্তা উত্তর দিয়েছিলো — 'না জ্যোতিষী নই। তবুও আমি জানি। নিশ্চিতভাবেই। কিন্তু কাউকে বলি না। বললে পাগল ভাবতে তাই।'
'কিন্তু আমাকে তো বলতে হবেই। এবং এক্ষুনি।' — রিক্তার চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে বলেছিলো সুনন্দ।
রিক্তা বলতে শুরু করলো খুব নীচু গলায় — যেন নিজেই বলছে নিজেকে —
'এই যে টানা কদিন বৃষ্টির পর রোদ উঠলো গতকাল — বিকেল বেলার আকাশটা কি সুন্দর লাগছিলো — তখন মেঘের মধ্যে আমি ওই সিম্বলটা দেখলাম।'
'সিম্বল? কিসের সিম্বল?' — ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিলো সুনন্দ।
'একটা ফুলের তোড়া। হলুদ রঙের। অনেকটা গোলাপের তোড়ার মতো দেখতে।' — সুনন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো রিক্তা।
সুনন্দ ছদ্মগাম্ভীর্যে বলেছিলো — 'তা সেন্স অব ইমাজিনেশন থাকলে মেঘের মধ্যে গোলাপের তোড়া কেন একটা পুরো বাগান পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়।'
রিক্তা সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলেছিলো — 'এইজন্যেই কাউকে বলি না। কেউ সিরিয়াসলি নেয় না। নেবেই না কক্ষনো। আমি জানি।'
সুনন্দ হেসে বলেছিলো — 'আচ্ছা বেশ। গোলাপের তোড়া না হয় দেখতে পেলে মেঘের মধ্যে — তো কি হোলো?'
|| ৩ ||
রিক্তা দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো — 'ভয় পাই। ভীষণ ভয় পাই। ওই সিম্বলটাকে।'
সুনন্দ ফের অবাক হয়ে বলেছিলো — 'কেন? ভয়ের কি আছে এতে?'
রিক্তা মুখ নীচু করে বলেছিলো — 'ঠিক এইরকম সিম্বলটা দেখেছিলাম বাবা চলে যাওয়ার আগের দিন।'
সুনন্দ রিক্তার হাতে হাত রেখে বলেছিলো — 'ওটা জাস্ট একটা কয়েন্সিডেন্স।'
রিক্তা বলেছিলো — 'না। কয়েন্সিডেন্স নয়। এরপর আরো দুবার ঘটেছে ব্যাপারটা।'
— 'কি ঘটেছে?'
— 'ঠিক একবছর বাদে একই ঘটনা ঘটেছিলো। মহালয়ার দিন। প্রীতম মারা গিয়েছিলো। ছাদ থেকে পড়ে। অ্যান্টেনা ঠিক করতে গিয়ে। আমার ছোট্ট বেলার বন্ধু। হঠাৎ করে ছাদ থেকে পড়ে মারা গেলো।'
— 'কিন্তু এর সঙ্গে তোমার ওই সিম্বলের কি সম্পর্ক?'
— 'সম্পর্ক আছে। গভীর সম্পর্ক। আগের দিন বিকেলেই ছাদে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম ওই সিম্বলটাকে। সূর্যাস্তের ঠিক আগে। প্রীতমও ছিল। ওকেও দেখিয়েছিলাম। ও বলেছিলো — "ঠিক বলেছিস তো! একেবারে একটা ফুলের তোড়া! ছবি তুলে রাখার মতো দুর্দান্ত দেখতে"' — রিক্তা বলে যাচ্ছিলো আর সুনন্দ একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো রিক্তার মুখের দিকে।
রিক্তা বলতে থাকলো — 'গত বছর জুলাই মাসের মাঝামাঝি। এর কদিন আগেই আমার রেজাল্ট বেরিয়েছে। দিদুর বাড়ি হাওড়ায় গেছিলাম। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছিলো। বিকেলের দিকে ছাড়লো। দিদুর ঘরের পশ্চিমের বিরাট জানলা দিয়ে পড়ন্ত রোদ এসে ঘর ভরিয়ে দিচ্ছিলো। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম সোনালী রঙের মেঘে ছেয়ে আছে গোটা আকাশ। আর তার মধ্যেই সেই সিম্বল। সেই ফুলের তোড়া। এবার আমি ব্যাপারটাকে পাত্তা দিই নি। হৈ হৈ করে আড্ডা মারছিলাম ওখানকার ছোটোবেলার কয়েকজন বন্ধুদের সঙ্গে। রাতে খবর পেলাম মলিনা মাসি মারা গেছে সেদিন সন্ধেয়। বাস অ্যাক্সিডেন্টে। মলিনা মাসি আমায় খুব ভালোবাসতো। ছোটোবেলায় ওই ই আমায় কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলো।'
সুনন্দ চুপচাপ শুনলো ওর কথাগুলো। তারপর ধীরে ধীরে বললো — 'যাকগে। ওসব ভেবে মন খারাপ কোরো না। এগুলো তোমার কুসংস্কার। ঘটনাগুলো ঘটতোই। তুমি তোমার মতো করে ভাবছো।'
রিক্তা চুপ করে রইলো। সুনন্দ বললো — 'ওঠো। আমার সঙ্গে চলো। একটা আশ্চর্য জায়গায় নিয়ে যাবো। চলো।'
সুনন্দ ওকে নিয়ে গিয়েছিলো প্রফেসর সিদ্ধান্তের বাড়ি। হাতিবাগানে। সেখানে আগেকার দিনের নানান জিনিসের বিশাল সম্ভার। বহু পুরোনো আমলের ঘড়ি, ল্যাম্পশেড, ফ্লাওয়ার ভাস, পেন, দোয়াত এইসবের এক আশ্চর্য ভাণ্ডার। প্রফেসর সিদ্ধান্ত সুনন্দর বাবার বন্ধু। ভারী মজার মানুষ। খুব যত্ন করে নানা বিষয়ে মজার মজার কথা বলতে বলতে দেখাচ্ছিলেন সবকিছু। ঘন্টাখানেক কখন যে কেটে গেলো বোঝাই গেলো না। আসলে সুনন্দ চেয়েছিলো রিক্তাকে খানিকক্ষণ অন্যমনস্ক করে রাখতে। রিক্তা এইসব পুরোনো জিনিস খুব পছন্দ করে। তাই সুনন্দ জানতো এইসব পুরোনো জিনিস দেখতে দেখতে রিক্তার মনের আতঙ্ক কেটে যাবে।
সুনন্দ ওকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলো গল্প করতে করতে। বাড়ি ফেরার পথে সুনন্দর চোখ পড়লো আকাশের দিকে। আকাশ ভরে আছে পূর্ণিমার আলোয়। সুনন্দর মনে হোলো এতো সুন্দরভাবে দিনটা তার বহুকাল কাটেনি।
|| ৪ ||
পরদিন বিকেলে যখন ওদের দেখা হোলো রবীন্দ্রসদনের মোড়ে, সুনন্দ জিজ্ঞেস করেছিলো রিক্তাকে — 'কি? সবঠিক আছে তো?' রিক্তা চুপ করে ছিলো। সুনন্দ হৈ হৈ করে বলে উঠেছিলো — 'বলেছিলাম না? বলেছিলাম না? সব তোমার মনের ভুল। কুসংস্কার। এতো লেখাপড়া শিখে — ' সুনন্দর কথার মাঝখানেই রিক্তা বলে উঠলো — 'ইকবালদা মারা গেছে। কাল রাতে।' সুনন্দ ভুরু কুঁচকে বললো — 'ইকবালদা আবার কে?' রিক্তা ম্লান মুখে বললো — 'আমাদের বাড়ির তলায় জুতো, ব্যাগ এইসব সারাতো। খুব ভালো লোক। সবাই খুব ভালোবাসতো। কাল রাতে ওর মেটিয়াবুরুজের বাড়িতে কারা ওকে মেরে — ' রিক্তার কথা থামিয়ে সুনন্দ ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো — 'তুমি থামবে? কোথাকার কে — ফুটপাথে ব্যাগ সারায় — মেটিয়াবুরুজে মারা গেলো — সেটাকে রিলেট করে কি যা তা শুরু করেছো বলোতো?' রিক্তা থতমত খেয়ে তাকালো সুনন্দর মুখের দিকে। আসলে সে কোনোদিন সুনন্দকে এভাবে কথা বলতে শোনে নি বলে হয়তো।
সুনন্দ বলে যাচ্ছিলো — 'অতো সেন্টিমেন্টাল হোয়ো না তো — অতো ইমোশনাল হোলে বাঁচতে পারবে না পৃথিবীতে — আসলে তুমি একটা কন্টিনিউয়াস ইনসিকিয়োরিটির মধ্যে থাকো আজকাল — যার থেকে এইসব আজগুবি জিনিস মাথায় আসে — একটু লজিক্যালি ভাবতে শেখো —'
রিক্তার এসব কথা কানে ঢুকছিলো না। তার চোখের সামনে ভাসছিলো তার ইকবালদার মুখটা।
সুনন্দ তখনও বলে যাচ্ছিলো — 'কোথায় কোন্ মেঘ দেখা দিলো আর কোথায় কোন মেটিয়াবুরুজের মুচি মারা পড়লো — সেটাকে এভাবে কো-রিলেট করে —'
সুনন্দ খেয়ালই করলো না ঠিক সেই সময়ই মুখ নীচু করে থাকা রিক্তার চোখের থেকে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়লো তার শাড়ির আঁচলে।
এই ঘটনার পর বেশ কিছু দিন কেটে গেলো। এসে গেলো অক্টোবরের তিন তারিখ। অর্থাৎ সুনন্দর জন্মদিন। ওরা এসেছিলো প্রিন্সেপ ঘাটের দিকটায়। নীল আকাশে শরতের ঝলমলে শাদা মেঘ। সূর্য ডোবার সময় সোনালী আভায় চারিদিক ভরে গেলো। সুনন্দ হঠাৎ বলে বসলো — ‘দ্যাখো তো আকাশে এই মেঘের মধ্যে কোনো ফুলের তোড়া-টোড়া খুঁজে পাও কিনা — আমার আজকের দিনের উপহার হিসেবে অন্তত যদি একটা আধটাও দেখতে পাওয়া যায়,' — বলে হো হো করে হাসতে লাগলো।
রিক্তা কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো। এই দিনটায় এসব প্রসঙ্গ শুনতে তার ভালো লাগছিলো না। সুনন্দ কিন্তু রিক্তাকে খোঁচা মেরেই যাচ্ছিলো। তার ওই অন্ধবিশ্বাস কিংবা কুসংস্কারটা নিয়ে। 'আমি পাপী তাপী মানুষ — আমার জন্যে প্রকৃতি আকাশে ফুলের তোড়া রাখে নি — আরে একটু বার্থ-ডে উইশ করে অন্তত একটা ফুলও যদি রাখতো —' বলে আবার হো হো করে হাসতে লাগলো সুনন্দ। রিক্তা কোনো উত্তর না দিয়ে আঙুল দেখিয়েছিলো আকাশের পশ্চিম কোণে।
সুনন্দ হৈ হৈ করে উঠে বলেছিলো — 'ওইদিকে? ওইদিকে আছে বলছো? কিন্তু আমি তো। ওখানে কোনো ফুলের তোড়া-টোড়া দেখছি না। যা দেখছি তা মনে হচ্ছে একটা পেটমোটা সোনালী মাছের মতো কিছু।'
রিক্তা গম্ভীর হয়ে বললো — 'ওখানেই ছিলো — একটু আগেই — এখন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না — অন্য মেঘের সঙ্গে মিশে গেছে বলে বোঝা যাচ্ছে না।'
'যাবেই তো! যাবেই তো! সেটাই তো নিয়ম। এই মেঘগুলোকে কি বলে জানো? কিউমুলোনিম্বাস — এসো তোমাকে একটু জিওগ্রাফি পড়াই।' — ফের হাসতে হাসতে বলেছিলো সুনন্দ।
রিক্তার হাসি পাচ্ছিলো না। কারণ ও স্পষ্ট দেখেছিলো মেঘের মধ্যে যেন হলুদ গোলাপের মতো একটা আকৃতি।
|| ৫ ||
রিক্তা দেখতে পেয়েছিলো মেঘের মধ্যে সেই ফুলের আকার থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে সূর্যাস্তের আলোর ছটা। মুহূর্তের জন্য ও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল সেই আকাশকুসুমের অপরূপ সৌন্দর্যে। পরক্ষণেই একটা শীতল স্রোত বয়ে গিয়েছিলো তার শরীরের ভিতর দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে আকাশের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে মাথা নীচু করে বসেছিলো সে। আর ঠিক সেই সময়ই সুনন্দ তাকে নিয়ে অর্থাৎ তার এই সংস্কারকে নিয়ে ঠাট্টা করতে শুরু করেছিলো। অন্য কোনোদিন হলে রিক্তা অবশ্যই সুনন্দকে এই ঠাট্টা ইয়ার্কি মারতে দিতো না। কিন্তু সেদিন ছিলো সুনন্দর জন্মদিন। তাই রিক্তা সুনন্দর কথাগুলো চুপচাপ হজম করে নিচ্ছিলো। কিন্তু যখন সুনন্দ বারবার এই ব্যাপারটা নিয়ে রিক্তাকে খোঁচা দিতে লাগলো আর থাকতে না পেরে তখন রিক্তা জোর গলায় বলে উঠেছিলো — 'আমি মিথ্যে কথা বলি না — আমি অবশ্যই দেখেছি — আকাশের ওই কোণে — সূর্য ডোবার সাথে সাথেই সাদা মেঘগুলো হঠাৎ কমলা রঙের হয়ে গেলো — আর তার মধ্যেই —'
রিক্তার কথার মাঝেই সুনন্দ বলে উঠলো — 'আর তার মধ্যেই আমার বার্থডে গিফট — তোমার ফ্যান্টাসটিক ফ্লাওয়ার! — নাও ওঠো এবার — তোমাকে আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে যাবো — মাথাটা একটু গরম হয়ে গেছে তোমার।’ এইভাবে হাসতে হাসতে গোটা রাস্তায় রিক্তার সঙ্গে খুনসুটি ঝগড়া করতে করতে বাড়ি ফিরেছিলো সুনন্দ।
আর বাড়ি ফিরেই দেখেছিলো তার একমাত্র বোন মীনাক্ষীর কি ভয়ানক অবস্থা। গত দু দিন ধরে সর্দি জ্বরে ভুগছিলো সে। ছোটো থেকেই তার হাঁপানির রোগ। সেদিন সন্ধেয় হঠাৎ শ্বাসকষ্টটা বেড়ে গিয়েছিলো। সুনন্দ বাড়ি ঢোকার সাথে সাথেই দেখতে পেলো সারা শরীরে কেমন একটা খিঁচুনি শুরু হোলো মীনাক্ষীর। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালের এমার্জেন্সির দিকে দৌড়োলো সুনন্দ। কিন্তু সেখানে গিয়ে বেডে দেওয়ার সাথেসাথেই হঠাৎ স্থির হয়ে গেলো সতেরো বছরের ফুটফুটে মেয়েটা।
এরপর সুনন্দ একেবারে ভেঙে পড়েছিলো। বারবার তার মনে হচ্ছিলো সেদিন যদি সন্ধেয় একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতো। বাড়িতে কোনোদিনই সেভাবে তার জন্মদিন পালন করা হয় না। রাতে মা-বাবা-বোন সবাই মিলে একসঙ্গে একটু ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়া করে। এবছর রিক্তাকে নিয়ে গঙ্গার ধারে ঘুরতে ঘুরতে আইসক্রিম খাওয়ানোর শখ হয়েছিলো তার। প্রিন্সেস ঘাট থেকে রিক্তাকে গড়িয়ায় তার পাড়ায় পৌঁছে দিয়ে যখন নিজের সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে ঢুকলো তখন রাত নটা।
ঘটনাটার মাসখানেক বাদে ভিক্টোরিয়ার মাঠে দুপুর বেলায় চুপচাপ বসে ছিলো সুনন্দ আর রিক্তা। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ। চারিদিকের মানুষজনদের মধ্যে যেন নতুন বছরের ছড়ানো ছেটানো হৈচৈ। ওদের নিজেদের মধ্যে বিশেষ কোনো কথার আদানপ্রদান হচ্ছিলো না। সুনন্দ যেমন নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করেছিলো, তেমনিভাবে রিক্তারও প্রায়ই মনে হতো যে সেদিন বিকেলে ওই মেঘের কথাটা তার না তুললেই হোতো ...তাহলে তো সুনন্দ কিছুই জানতে পারতো না ... হয়তো এতোবড়ো দুর্ঘটনাটা ঘটতোই না ওর জীবনে ...
'চলো এবার বাড়ি যাই,' — বলে সূর্য ডোবার ঢের আগেই উঠে পড়লো রিক্তা। এই ঘটনার পর থেকেই সূর্যাস্তের আকাশ আর সহ্য করতে পারতো না সে।
ওদের পরস্পরের এই স্বল্পকথার দিনগুলো বেশ কিছুকাল ধরে যেন বিরাট পাথরের মতো বসেছিলো ওদের উপর। তারপর হঠাৎই একদিন সেই পাথরটা যেন গড়িয়ে সরে গেলো অনেক দূরে। সুনন্দ কলেজে পড়ানোর চাকরি পেলো। রিক্তারও এম. এ.-র রেজাল্ট খুব ভালো হোলো। তাই দুই পরিবারের সম্মতিতে চারহাত সহজেই এক হয়ে গেলো।
বিয়ের মাসখানেক বাদে রিক্তা সেদিন আবার বাপের বাড়ি এসেছিলো। বরং বলা উচিত তাকে বাপের বাড়ি পাঠানো হয়েছিলো। সুনন্দর কথায়। কারণ এই সময়টায় সুনন্দ একেবারে একা থাকতে চেয়েছিলো।
|| ৬ ||
সুনন্দর জীবনে তখন আরেকটি বিরাট ধাক্কা এসেছিলো। দুদিন আগেই মারা গিয়েছিলেন ব্রজ রায়। যিনি ছিলেন সুনন্দর জীবনের সবচেয়ে বড়ো সহায়। জীবনের প্রতিটি সংকটে তার সত্যিকারের ফ্রেন্ড ফিলসফার অ্যান্ড গাইড। পরশু রাতে হঠাৎ তিনি মারা গেলেন ঘুমের মধ্যেই। হার্ট অ্যাটাকে। খবরটা শুনে সুনন্দ একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো। নিজেকে বড়ো অসহায় মনে হচ্ছিলো তার। এই সময়টায় সে একেবারে একা থাকতে চেয়েছিলো। তাই রিক্তাকে দিন দুয়েকের জন্য পাঠিয়েছিলো তার বাপের বাড়িতে।
মাঝরাতে একা ঘরে এটা সেটা নেড়েচেড়ে দেখছিলো সুনন্দ। কাঠের আলমারিটা খুলে পুরোনো অ্যালবামগুলো থেকে ব্রজদার কয়েকটা ছবি বের করতে গেলো সে। আর সেটা করতে যেতেই হুড়মুড়িয়ে পড়লো কিছু নতুন জিনিসপত্র। বিয়ের ব্যাপারে এসে জড়ো হয়েছে এই আলমারির ভিতরে। সেগুলোর সাথেই ধপ করে পড়লো একটা ঝকঝকে মেরুন রঙের ডায়েরি। কি মনে করে সুনন্দ সেই ডায়েরির পাতাগুলো আলগোছে ওলটাতে লাগলো।
রিক্তার ডায়েরি। সুনন্দ জানতো বিয়ের আগে থেকেই রিক্তা ডায়েরি লেখে। অন্য সময় হলে হয়তো সুনন্দ পড়তো কয়েক পাতা। কিন্তু তখন তার মনের অবস্থা অন্যরকম। তাও সুনন্দর চোখ আটকে গেলো ডায়েরির শেষ পাতায় — 'আমি চাই না। সত্যিই চাই না ওকে কথাটা বলতে। নিজেও চাই না মনে রাখতে। কিন্তু কি করবো? ওই ঘটনার পর থেকেই ভীষণ একটা ভয় আমায় সমানে কুরে খাচ্ছে। তাই লিখে একটু হালকা হতে চাইছি—'
সুনন্দ পড়ে যেতে লাগলো —
'কাল সত্যিই খুব ভয় করছিলো। এমনিতেই আমার জলে খুব ভয়। নৌকো চড়তে ইচ্ছেই করছিলো না। ওর জোরাজুরিতে বাধ্য হলাম। তারপর দেখলাম গঙ্গার ওই বিরাট জল। যেন এপার ওপার কিছুই দেখা যায় না। তার মাঝে বিকেলের রোদ পড়ে আসছে। এই পড়ন্ত রোদে আমি আর এখন বাড়ির বাইরে থাকিই না। নৌকোয় আরো যারা ছিলো তাদের দিকে তাকিয়ে মনটা অন্য দিকে ঠেলে রেখেছিলাম। যাতে কিছুতেই ওই আকাশের দিকে চোখ না যায়।
'হঠাৎ জলে বিরাট ঢেউ দিলো। নৌকোটা খুব দুলে উঠলো। আরেকটু হলেই হুমড়ি খেয়ে উল্টে পড়ছিলাম। ও আমার হাতটা ধরে সামলে দিলো। আর তখনই আমার চোখ অজান্তেই চলে গেলো আকাশের দিকে। দেখলাম আকাশ ভর্তি কমলাহলুদ মেঘের সারি। আর তার মাঝে সেই ভয়ঙ্কর সিম্বলটা। যেন নিখুঁত একটা হলুদ গোলাপফুল। সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরের মধ্যে যেন একটা ইলেকট্রিক শক বয়ে গেলো। আমি তক্ষুণি মুখ ঘুরিয়ে লাজলজ্জার বালাই না রেখে ওর কাঁধে মাথাটা রেখেছিলাম। ও বললো — "কি হোলো? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?" বললাম "মাথা ঘুরছে।" আসলে তখন আমার চোখের সামনে ভাসছিলো ওই বিভীষিকাটা। এর মাঝেই সূর্য ডোবার আবছায়ায় ঢেকে গেলো চারপাশ।
'আমি ঘটনাটার বিন্দুবিসর্গও ওকে জানাই নি। কোনোদিন জানাবোও না। ঘটনাটার পর একদিন কেটে গেছে। কোনো বিপদ ঘটে নি। কিন্তু এমন নিখুঁত দেখতে মেঘের ফুলটা কি আমায় এতো সহজে নিস্তার দেবে?'
এখানেই শেষ হয়ে গেছে লেখাটা। সুনন্দ দেখলো এই লেখাটার পরের দিনই ব্রজদার ঘটনাটা ঘটেছিলো। তক্ষুণি তার মাথায় দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো এক ভয়ানক রাগের আগুন। ডায়েরিটাকে সে আছড়ে ফেললো ঘরের কোনায়। চরম আক্রোশে।
এরপর কেটে গেলো আরো বেশ কিছু মাস। একটা অজানা চোরা দূরত্ব যেন তৈরি হচ্ছিলো ওদের মাঝে। কিন্তু ওদের কেউই সেটা চাইছিলো না। হঠাৎ সুনন্দই ঠিক করলো ওরা বেড়াতে যাবে। কারণ সামনে পুজোর ছুটি। কিন্তু বিখ্যাত কোনো জায়গায় নয়। ট্যুরিস্টদের দমবন্ধ করা ভিড়ভাট্টা, নামীদামী হোটেলের জাঁকজমক এইসবে তার ভীষণ আপত্তি। রিক্তারও তাই মত। সেইমতো ওরা রওনা দিলো ওদের পছন্দসই জায়গায়।
|| ৭ ||
জায়গাটা অত্যন্ত নিরিবিলি। কিন্তু খুবই মনোরম। পাহাড়ি এলাকা। চারদিকে ছেয়ে আছে অজস্র উঁচু উঁচু গাছ। এরই মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে একটা পাহাড়ি নদী। এখানকার বাসিন্দারা অধিকাংশই আদিবাসী। একটু দূরে ছড়ানো ছেটানো কয়েকটি গ্রাম। আরেকটু দূরে গেলে একটা উঠতি শহুরে চেহারা দেখা যায়। সেখানে তৈরি হচ্ছে পরপর করে কিছু ভারি সুন্দর দেখতে ছোট ছোট পাকা বাড়ি। অর্থাৎ সম্পন্ন লোকদের চোখে পড়ে গেছে জায়গাটা। সুনন্দরা এই রকমই একজনের সূত্রে এসেছে এখানে।
তিনি সুনন্দর ছোটবেলার বন্ধু। এখন বেশ নামকরা এক ডাক্তার। ইচ্ছে করেই কলকাতা থেকে অনেক দূরে এই ছবির মতো সুন্দর জায়গায় একটা ছোট্ট বাড়ি বানিয়েছেন তিনি। তাঁর প্রোমোটার ভগ্নিপতির সাহায্যে। প্রতি মাসেই দু-এক দিন করে এসে এখানে থেকে যান সেই ডাক্তারবাবু। কখনো-সখনো খুব কাছের কাউকে সেখানে দুচার দিন থেকে আসার জন্যে পাঠিয়েও দেন। যাতে বাড়িটি দিনের পর দিন বন্ধ হয়ে না থাকে। যদিও একজন স্থানীয় কেয়ার-টেকার রাখা আছে। ছোটবেলার বন্ধু সুনন্দকে তিনি জোর করেই পাঠালেন এখানে। আর সুনন্দ মনে মনে এমন জায়গায় যেতেই চাইছিলো।
একেবারে গোছানো ঝকঝকে দোতলা বাড়ি। দোতলার ঘরের জানলা থেকে ঝলমলে পাহাড়ি ফুলের থোকা দেখা যায়। 'সূর্যের আলো এখানে যেন নরম তুলোর মতো—' বলেছিলো রিক্তা।
‘এককালে ভালো কবিতা লিখতে বোঝাই যাচ্ছে।' — সুনন্দ বলেছিলো হাসতে হাসতে।
'শুধু কবিতা নয় ছবিও আঁকতাম।' — চোখ বড়ো বড়ো করে উত্তর দিয়েছিলো রিক্তা। 'এখন শুধু এই ক্যামেরাটাই আছে শখের মধ্যে।'
‘বেশ তো এই ক্যামেরা নিয়েই চলো না যাই একটু কিছু খেয়ে নিয়ে—' বলেছিলো সুনন্দ।
খানিকবাদেই বেরিয়ে পড়লো ওরা। রিক্তা তো যা দেখছে তারই ছবি তুলছিলো। দূরের পাহাড় থেকে সামনের বুনো ফুল কিচ্ছু বাদ দিচ্ছিলো না। তাই দেখে সুনন্দ বললো — 'আরে এইভাবে তুললে রীল শেষ হয়ে যাবে যে!' রিক্তা হেসে বললো — 'ভয় নেই, আরো দুটো সঙ্গে এনেছি।' সুনন্দর তখন রিক্তার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হোলো যে সে অনেক দিন বাদে রিক্তার এমন মিষ্টি হাসিটা দেখতে পেলো।
'এবার তোমার ছবি তুলবো' — বলে সুনন্দকে একটা গাছের পাশে দাঁড় করালো রিক্তা। তারপর শুরু হোলো একটার পর একটা ছবি তোলা। কখনো কোনো পাথরের উপর বসিয়ে। কখনো গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে। এই করতে করতে তারা এসে হাজির হোলো ওই পাহাড়ি নদীটার সাঁকোর উপরে। 'এতক্ষণে একটা দারুণ ব্যাকগ্রাউন্ড পেয়েছি! — দাঁড়াও তো দেখি এইখানটায়,' — বলে রিক্তা সুনন্দকে সাঁকোর উপর নিয়ে গিয়ে ঠিক মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দিলো। তার ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে বললো — 'দারুণ! দুর্দান্ত ব্যাকড্রপ পাওয়া গেছে। এবার মুখটা তুলে দূরের দিকে তাকাও তো,' — বলেই শাটার টিপলো রিক্তা। ‘এবার একটু অন্য অ্যাঙ্গেল থেকে — উল্টো দিকটায় যাও তো।' — ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখেই বললো রিক্তা, 'এবার আমি তোমার কয়েকটা অন্য রকমের ক্লোজ আপ নেবো।'
'নিয়ে নাও — যতো পারো নিয়ে নাও — এমন হ্যান্ডসাম মডেল কোনো ফোটোগ্রাফার কিন্তু সহজে পাবে না —' শার্টের কলারটা ঠিক করতে করতে মুচকি হেসে বলেছিলো সুনন্দ। ক্যামেরায় চোখ রেখে সুনন্দর খুব কাছে এগিয়ে এসেছিলো রিক্তা। 'নাহ্। ঠিক হচ্ছে না। আমি ওখানে দাঁড়াচ্ছি — তুমি আমার উল্টো দিকটায় যাও।' — বলে সাঁকোটার রেলিং ঘেঁষে দাড়ালো রিক্তা। সুনন্দকে দাঁড় করালো তার দুহাত দূরেই। ক্যামেরায় চোখ রেখে বললো — 'হ্যাঁ — এবার আলোটা ঠিক যেমনটা চাইছি তেমনিভাবে তোমার মুখে পড়ছে।' — বলতে বলতে ভিউফাইন্ডারে ব্যাকগ্রাউন্ডটা দেখতে থাকলো রিক্তা।
|| ৮ ||
'ঠিক এইভাবেই থাকো — নড়ো না,’ — বলে শাটার টিপলো রিক্তা। এবার মুখটা ডানদিকে একটু ঘোরাও'— বলে ক্যামেরার লেন্সটা আবার অ্যাডজাস্ট করতে গিয়ে আকাশের দিকে চোখ পড়তেই যেন হঠাৎ পাথরের মতো স্থির হয়ে গেলো সে।
সুনন্দ বলে উঠলো — 'কি হোলো? তোলো! কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো?'
রিক্তা কোনো উত্তর না দিয়ে একইরকম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
সুনন্দ বিরক্ত হয়ে বললো — 'আরে! কি হোলোটা কি তোমার?'
রিক্তা যেন ভূতে পাওয়ার মতো ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলে উঠলো — 'ওই যে! আবার সেই হলুদ ফুলের মতো!'
সুনন্দ মাথা ঘুরিয়ে পিছন দিকে তাকিয়ে দেখলো পড়ন্ত সূর্যের আলোয় ভেসে যাচ্ছে সারা আকাশ। তার মাঝে অসংখ্য ছোটো ছোটো সোনালী মেঘের ভেলা। সুনন্দ মুগ্ধ হতে গিয়েও পারলো না — তার কানে এলো রিক্তার ফিসফিসে স্বর — 'ওই সিম্বলটা! আবার এসেছে! আবার!'
সুনন্দ চিৎকার করে উঠে বললো — 'সিম্বল? কোথায় তোমার সিম্বল? দেখাও! এক্ষুনি দেখাও!' বলে রিক্তার কাঁধ দুটো ধরে পাগলের মতো ঝাঁকাতে লাগলো। তখন তার মনে হচ্ছিলো এই সেই মেয়ে যার ওই অপয়া কথায় অকালে মরেছে তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় বোন — তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভরসা ব্রজদা চলে গেছে হঠাৎ করে — এখন আবার সেই কথাটা উচ্চারণ করছে সেই সর্বনাশী!
রিক্তা এতক্ষণ যেন নিষ্প্রাণ দেহে দাঁড়িয়ে ছিলো — হঠাৎ ভূতে পাওয়ার মতো চেঁচিয়ে বলে উঠলো — 'ওই তো! ওই তো মেঘের মধ্যে ফুলের তোড়াটা! ওই তো পাপড়িগুলো —'
কথাটা শেষ করতে পারলো না রিক্তা। সুনন্দর একটা সপাটে চড় এসে পড়লো তার মুখে — সঙ্গে সঙ্গে সে টাল খেয়ে ছিটকে পড়লো সাঁকোর রেলিংয়ের উপর — আর তারপরেই ঝপ করে একটা শব্দ হোলো — সাঁকোর নীচ থেকে — রিক্তার শরীরের ভারের শব্দ — অবশ্যই নীচের জলের উপর।
সুনন্দ নির্বাক হয়ে দেখলো এতক্ষণ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো তার জীবনের একান্ত সঙ্গী — সেই জায়গাটা এখন একদম ফাঁকা। রিক্তার কোথাও কোনো চিহ্নমাত্র নেই। না সাঁকোর উপর। না নীচের সেই হু হু করে বয়ে যাওয়া নদীর জলে। সুনন্দ বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেই অস্তায়মান সূর্যের দিকে মুখ করে। শুধু খানিকবাদে আরেকটা আওয়াজ হোলো। একই রকম। ঠিক আগের আওয়াজটার মতো। সাঁকোর নীচ থেকে। অবশ্যই জলের উপরে। এবার সাঁকোর উপরটা একেবারে ফাঁকা।....
কি হোলো?
বুঝলেন না?
বুঝতে পারলেন না যে সুনন্দ সুইসাইড করলো জলে ঝাঁপিয়ে?
নয়তো রীতা এভাবে চলে যাওয়ার পর কি করে এতকাল বাঁচবে সুকান্ত?