ঢং ঢং করে ছুটির ঘন্টা বাজলো।
হৈ হৈ করে ব্যাগ গুছিয়ে ক্লাস থেকে বেরোচ্ছে ছেলেমেয়েরা। হাতব্যাগে কলম আর একটা দুটো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ভরে নিয়ে দরজার দিকে এগোলেন শিশিরবাবু।
—স্যার?
অনামিকা —স্কুলের হেড গার্ল, লেখাপড়ায় ক্লাসের সেরা মেয়ে।
যাদবপুরের এই স্কুলে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী এই অনামিকা।
—কি রে? কিছু বলবি?
—না স্যার, তেমন কিছু নয়। গতকাল মেঘনাদ সাহাকে নিয়ে যে essay-টা লিখতে বলেছিলেন আজ শেষ হয়ে যাবে সেটা। কাল নিয়ে আসবো, স্যার?
—আমি তো আর আসবো না রে। আজ এই স্কুলে আমার শেষ দিন।
—আর আসবেন না আপনি?
অবাক হয়ে শিশিরবাবুর মুখের দিকে তাকায় অনামিকা। অবাক হবারই কথা, আর যে আসবেন না সেটা ক্লাসে তো আর ঢাক পিটিয়ে বলেন নি শিশিরবাবু, তাই জানবে কি করে অনামিকা?
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শিশিরবাবু। খুব, খুব মায়া হয় মেয়েটার উপর। বড় ভালো মেয়ে। ডিভোর্সি মা-বাবা, বখে যাওয়া মস্তান দাদা—একটা অসুস্থ পরিবেশ বাড়িতে। তবু এত জানার আগ্রহ, এত পরিশ্রম করার ক্ষমতা মেয়েটার!
কি করবেন শিশিরবাবু? কাল আসবেন আর একবার, শুধু ওর জন্য?
নাঃ, মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই। দীর্ঘদিন ধরে শরীর অসুস্থ তাঁর। এতদিন কোনোরকমে চালিয়েছেন। আজ মনে হচ্ছে শুধুমাত্র যেন অনামিকার কথা ভেবেই চালিয়েছেন। সত্যিই শরীর আর টানতে পারছে না।
গতকাল সন্ধ্যাবেলা ডাক্তাররা তাঁর মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেছে। আর মাত্র ছ’ মাস আছে হাতে। অনেক কাজ বাকি এখনো। ব্যাংকের কাজ, দেনাপাওনা মেটানো, বাড়িটার একটা ব্যবস্থা করা—প্রতিটা মুহূর্ত মূল্যবান।
একদৃষ্টে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে অনামিকা, যেন কৈফিয়ত চাইছে। কিছু একটা বলতে হবে তাড়াতাড়ি।
—না রে, আর আসবো না। আমার সাথে প্রিন্সিপালের কথা হয়ে গেছে। আমার ক্লাসগুলো শক্তিবাবু নেবেন কাল থেকে, ওনাকেই দেখাস 'এসে'-টা।
অনামিকার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কথাটা পছন্দ হয় নি ওর। শক্তি? তিনি তো জানেন শক্তিকে। ও কি সেই সময় দেবে মেয়েটাকে যতটা তিনি দিয়েছেন? ও কি তাঁর মতন লেগে থেকে থেকে নিংড়ে নিতে পারবে অনামিকার মধ্যে যেখানে যতটুকু প্রতিভা রয়েছে তার সবটুকু?
আরো একটা বছর যদি হাতে পেতেন শিশিরবাবু, আরো একটু যদি পোক্ত করে দিয়ে যেতে পারতেন মেয়েটাকে ...
—শোন, পড়াশুনোটা করিস কিন্তু মন দিয়ে, একটু লেগে থাকলে নাইন্টি ফাইভ পার্সেন্টের উপর নম্বর তুই পাবিই। আর হ্যাঁ, যত পারিস, যেখান থেকে পারিস, বই জোগাড় করে নিয়ে পড়ে যা সমানে ...
এসব বলতে হয়, তাই বলা। পালিয়ে যাবার আগে সকলেই এরকম ভালো ভালো উপদেশ দেয়। অর্থশূন্য বাগাড়ম্বর সব …
অনামিকা কি হতাশ হলো? চোয়াল এত শক্ত কেন মেয়েটার? কান্না চাপার চেষ্টা করছে?
সাড়ে চারটে বেজে গেছে। শীতকাল— ভালো করে কোনোকিছু বোঝার আগেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। হু হু করে গায়ে কাঁটা দেওয়া হিমেল হাওয়া বইছে। উকিলের সাথে বাড়ি বিক্রির কথাটা আজই সেরে ফেলতে হবে, সন্ধ্যার আগে।
নিজের মনকে শক্ত করে স্টাফরুমের দিকে এগোন শিশিরবাবু।
—স্যার?
যায় নি এখনো?
না, যায় নি। ক্লাসরুমের সামনে, ঠিক যেখানে ছিলো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে অনামিকা। মুখ ভার। দু চোখে স্পষ্ট অভিমান।
অনামিকাকে কি বলবেন কি হয়েছে তাঁর?
কি দরকার মেয়েটাকে মিছে আরো কষ্ট দিয়ে? পরে খবর পাবে ঠিকই, তবে ওর কষ্টটা তো দেখতে হবে না নিজের চোখে। তার চেয়ে এই ভালো।
—কি রে? আবার কি হলো?
—আমি … মানে আমরা আপনাকে খুব মিস করবো স্যার।
কি বলবেন শিশিরবাবু? ঠিক এই মুহূর্তে কি বলতে পারেন যা আদ্যোপান্ত সৎ, অথচ কোনো অর্থহীন বাগাড়ম্বর নয়? এক টুকরো শুকনো হাসি ছাড়া আর কি বিদায় উপহার দিতে পারেন তিনি মেয়েটাকে?
যেতে হবে, তবু কে যেন পা দুটো আটকে রেখেছে শিশিরবাবুর, আঁজলা ভরে ঢেলে দিয়েছে সময়। হ্যাঁ, সময়! এই সময়ের সবটুকু শুষে নিয়ে অনামিকাকে দেবেন শিশিরবাবু।
স্টাফরুমে পরে গেলেও চলবে।
কেন জানি না সে সময় নিলো না অনামিকা। শিশিরবাবু কিছু বলার আগেই তাড়াতাড়ি ঘুরে মাথা নিচু করে দ্রুত হাঁটা দিলো উল্টোদিকে।
কেন বুঝলো না অনামিকা, শিশিরবাবু চাইছেন—সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে চাইছেন—অনামিকা এখন থাকুক, আর একটুক্ষণ অন্তত থাকুক তাঁর কাছে? আরও অনেক কিছু দেওয়ার আছে তাঁর অনামিকাকে।
স্কুলের মাঠের মাঝখানের সরু পায়ে চলা পথটা দিয়ে এখন আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে অনামিকা। শিশিরবাবু জানেন—আসলে তিনি নিজেই সরে যাচ্ছেন অনামিকার থেকে।
আকাশে লাল আভা, কনে দেখা আলো।