“—জানিস? বিট্টু না? মানে...কালকে...আমাকে...উম্”
“কী? অ্যাঁ? কী ব্যাপার?”
“আরে, কাল, বুঝলি—আমরা কণা ম্যামের কাছে পড়তে যাই তো? এক ব্যাচে? তা—”
ফিসফিস করে বলা কথাগুলো সমন্বিতার কানে আসছিল। এই মেয়েগুলো যে কিভাবে ‘ফিসফিস’ করে, দু বেঞ্চ সামনে বসে কানে ইয়ারফোন গুঁজে রাখলেও, এবং সেই ইয়ারফোনে ফুল ভল্যুমে লিংকিং পার্ক চালিয়ে রাখলেও প্রত্যেকটা কথা এত স্পষ্টভাবে কানে আসে, বোঝে না সমন্বিতা।
সমন্বিতা ফিসফিসের অন্য মানে বোঝে। শব্দগুলোকে আর্দ্র বাতাস আদর করে মুড়ে নিয়ে আসবে শুধু একজনেরই কানের জন্য…। তবে দল বেঁধে বোধ হয় হয় না সে ফিসফিস।
“—হ্যাঁরে? বিট্টু না কদিন আগে তুলিকাকে প্রোপোজ করল?”
“এঃ! জানিস না? ওদের ব্রেক আপ হয়ে গেছে তো!”
“হ্যাঁরে! আমিও জানতাম না তো! রেগে গেছিলাম আমার খাতায় ওইসব লিখে রেখেছে দেখে! একটা গার্লফ্রেন্ড থাকতেও…গালাগালি দিচ্ছিলাম, তখনই—”
“কী লিখেছে? কী লিখেছে?”
“হ্যাঁরে? সবে তো একসপ্তা মত হল প্রেম করছিল ওরা, এর মধ্যেই ভেঙে গেল? কীরে?”
“এই দ্যাখ্ না! সাদা পাতায় ট্রেস করে লিখেছে। আলোয় একটু ঘুরিয়ে…হ্যাঁ, বুঝতে পারছিস? আরে! বলিস না! বিট্টু স্মোক করে তো আমরা সবাইই জানি! তা, তুলিকার চলবে না তাতে। স্মোকিং ছাড়তে হবে, তা প্রেম করতে গেছিলি কেন তবে? অ্যাঁ? ও তো সেই কবে থেকেই—ইশশ্, কী সব লিখেছে দেখছিস?” লজ্জায় মেয়েটার গলা নুইয়ে এসেছিল।
জোরে একটা শব্দ করে বেঞ্চ সরিয়ে উঠে পড়েছিল সমন্বিতা। নিজের মনে ধীর মাথা নাড়িয়ে মৃদু বিরক্তিতে ভেবেছিল, নাঃ! এদের এই বকবকের মধ্যে বসে থাকা যাবে না।
কী অর্থহীন কথাই বলে যেতে পারে আশেপাশের এইসব ছেলেমেয়েরা সারাক্ষণ!
অর্থহীন প্রেম করে যেতে পারে!
অর্থহীন বন্ধুত্ব।
ও এখান থেকে বেরিয়ে গেলেই ওকে নিয়ে আলোচনা শুরু হবে এই মেয়েদের মধ্যে, সমন্বিতা জানে।
অর্থহীন!
লাইব্রেরীর দিকে চলেছিল সমন্বিতা।
বইয়েরা অদ্ভুত ভাল।
বইয়েরা নিঃশব্দে কত কথা বলে দেয়, কত গল্প, কত জ্ঞান! কত খুশি কত বেদনা! অথচ কাউকে বিরক্ত করে না। যে ভালবেসে কাছে টানে শুধু তার সঙ্গেই আদর সোহাগ বইয়ের।
এই বাইরের পৃথিবীর একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যান শব্দ বিরক্তিকর। নিষ্ফল কান্না। নিষ্ফল হাসি। নিষ্ফল প্রেম ঝগড়া!
“শোন রে!” লাইব্রেরীয়ান স্যারের নাম অশোক কর্মকার, বা অসীম কর্মকার, বা ওরকম কিছু একটা। ছাত্রছাত্রীরা ডাকে এ কে। এ কে স্যার বলছিলেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অহিংসা’কে ওর নামে ইস্যু করতে করতে, “তুই যে-হারে পড়িস, আর ক্লাসিকস্ পড়িস, ভাল ভাল! তা যে-হারে পড়িস তাতে মোটামুটি ভালই লিখবি। লেখা দিবি একটা? কলেজ পত্রিকার জন্য লেখা জোগাড় করছি আমরা।”
“লিখতে পারি না স্যার।” বলেছিল সমন্বিতা।
“পারবি পারবি। চেষ্টা করলেই হবে!” এ কের মুখে অভয়ের হাসি, “দ্যাখ একবার হ্যাঁ? সপ্তাদুয়েকের মধ্যে? পারিস যদি?”
“হুম্!” সমন্বিতা বলেছিল, লেখার কোনও ইচ্ছা ওর নেই। কিন্তু কথায় কথা বাড়ে। তাই শুধু একটা “হুম্” বলে চুপ করেছিল ও।
‘অহিংসা’ গল্পটা ভাল নয় এই মুহূর্তে পড়ার পক্ষে। লাইব্রেরীর এক কোণে বইটা নিয়ে বসেই বুঝতে পেরেছিল সমন্বিতা। ঠান্ডা মাথায় পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে পড়ার গল্প!
আউল সিটির গান চালিয়েছিল ও তখন মোবাইলে। আর কী? গানই শোনা যাক তাহলে।
~~
“কী রে, লিখছিস?”
সমন্বিতা মাথা নাড়িয়েছিল। না।
মাসদেড়েক পরে অন্য একটা বই ফেরাতে গিয়েছিল সমন্বিতা। সেই সেদিনের পর থেকে ওকে দেখতে পেলে রোজই একই প্রশ্ন করেন এ কে স্যার।
সমন্বিতাও একই উত্তর দেয়।
“আরে চেষ্টা কর অন্ততপক্ষে! চেষ্টা করে দ্যাখ তো। সময় আছে। আরও একসপ্তা সময় দিলুম তোকে নাহয়।” বলেন তাতে স্যার। হাসিমুখে। কোনও বিরক্তি না দেখিয়ে।
এ কে স্যার মানুষটা ভালই। শুধু বড় বেশি মিশুকে।
সমন্বিতা মৃদু হাসে স্যারের কথার উত্তরে। হাসি ভারি ভাল জিনিষ, সোশ্যাল সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করতে। যাকে বলে সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ।
হাসি টেনে আনতে খুব বেশি জোরও করতে হয়নি আজ। আজ সমন্বিতার মনটা তুলনামূলকভাবে ভাল ছিল। শীতটা কমে এসেছে কয়েকদিনের হাড়-কাঁপানো ঠান্ডার পরে। সরস্বতী পুজো এসে গেল। তার কয়েকদিন পরেই বইমেলা। কেন যেন অল্প উষ্ণ রোদ সেঁকে নিতে নিতে খুশি খুশি লাগছিল সমন্বিতার।
খুশি খুশি ফুরফুরে ভাবটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সমন্বিতার কপাল!
“তুই! আই…আই কান্ট বিলিভ ইউ!” মেয়েটা বলছিল, “কী তুই!” ওর গলা থেকে ঝরে পড়ছিল যেন রাজ্যের বেদনা আর ধিক্কার।
কলেজের রোদ ছায়া রোদ ছায়া করিডর ধরে চলতে চলতে সমন্বিতার কানে এসেছিল মেয়েটার গলার স্বর। সেদিনকে এই মেয়েটাই ‘বিট্টু’ ওর খাতার পাতায় ‘কী সব’ লিখেছে বলে লাজুক হেসে গদগদ হচ্ছিল। আজ মেয়েটার গলা কেঁপে গিয়েছিল কান্নায়।
করিডরের বাইরে একটা ঝাঁকড়ামত কাগজ ফুল গাছের তলায় দাঁড়িয়েছিল দুজনে। মেয়েটা, আর বিট্টু। ঝুঁকে পড়া কাগজফুল গাছের তলায় দাঁড়িয়েছিল, বোধ হয় একটু গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্যই। কিন্তু এখন মেয়েটা চিল চিৎকারে সচকিত করে তুলেছিল নিস্তব্ধ ক্যাম্পাসকে।
“চার-পাঁচদিন আমার হোয়ার, মেসেঞ্জারের উত্তর দিচ্ছিস না। ফোন তুলছিস না! তুই—আর এখন বলছিস ব্রেক আপ—”
“তুইই তো বললি, আমি যে পরিমাণে স্মোক করি, তোর পছন্দ নয়।” বিট্টু বলেছিল নির্বিকারভাবে।
“আমি—তুই! আমি কী ব্রেক আপ করব বলেছি? আমি তো জাস্ট—” মেয়েটার গলায় করুণ একটা আকুতির ছোঁয়া লেগেছিল এবার।
সমন্বিতার ভুরুতে ভাঁজ পড়েছিল একটা। প্রেমটা মেয়েটার কাছে আর তেমন অর্থহীন নেই মনে হচ্ছে যেন।
চেঁচামেচি একদম সহ্য হয় না সমন্বিতার। সহ্য হয় না কান্নাকাটি।
“সোজা কথা বলি। আমার আর ভাল লাগছে না তোকে।” বলেছিল বিট্টু, “—জাস্ট, আয়াম টায়ার্ড অফ—”
“তুই, তুই একটা!” কান্নাভেজা গলায় বলেছিল তখন মেয়েটা, “দুমাস আগে আমাকে এত ভাল লাগছিল, আর এখন আর—বল কেন ভাল লাগছে না আমাকে, কী করেছি আমি! বল—”
“যারা আমার প্রেমে পড়ে যায় তাদের ভাল লাগে না আমার।” বলেছিল বিট্টু।
বিট্টু বা পরীক্ষিৎ সেনের সম্পর্কে অনেক কথা শোনা যায়। ভাল কথা নয় সেগুলো। এই কলেজের ইতিহাস বিভাগের এইচ ও ডির ছেলে বিট্টু। পড়াশুনোয় তুখোড়। ডিবেট চ্যাম্পিয়ন। অসংখ্য মেয়েদের সঙ্গে নাকি রিলেশন ওর। আর কোনও রিলেশনশিপই মাসদুয়েকের বেশি টেঁকে না।
তবু মেয়েরা ওর প্রেমে পড়ে যায়। ওর প্রেমে, নাকি ওর স্ট্যাটাসের প্রেমে। কে জানে?
দেখতেও ভালই ছেলেটাকে। যদি বাঁকা হাসি, শীতল চোখ, এইধরনের জিনিষ তোমার ভাল লাগে তবে ছেলেটার চেহারা তোমার প্রেমে পড়ে যাওয়ার পক্ষে আদর্শ, ভাবে সমন্বিতা।
মেয়েটা ফুঁপিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে। বিরক্ত লাগছে সমন্বিতার। কিন্তু সরে যাওয়ার উপায় নেই আপাতত। একটা মোটা থামের আড়ালে ও লুকিয়ে পড়েছিল ওদের চেঁচামেচি প্রথম কানে যাওয়ার মুহূর্তেই। এখন, এরা জায়গাটা ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত বেরোনোটা অস্বস্তিকর।
কী যে এরা কলেজে, রাস্তা ঘাটে সিন ক্রিয়েট করে!
একটু পরে মেয়েটা চলে গিয়েছিল। আরো একটু কেঁদে। একটু অভিশাপ দিয়ে, একটু গালিগালাজ করে। বিট্টুও যাবে এবার, ভেবেছিল সমন্বিতা। কিন্তু হা হতোস্মি! ফস্ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল বিট্টু। তারপর এমন রসিয়ে রসিয়ে আবেশ করেই সেই সিগারেটে টান মারতে লাগল, যেন আদিগন্তকাল ধরে সিগারেট ফোঁকা ছাড়া ওর আর কোনও দায়িত্ব কর্তব্য নেই, চাহিদা নেই কোনও।
কাঁহাতক এই থামের আড়ালে ছায়ায় লুকিয়ে থাকা যায়? একেই শীতের কাঁপুনি লাগছে।
সমন্বিতা মনস্থির করে বেরিয়েই এসেছিল আড়াল ছেড়ে শেষপর্যন্ত।
“আঃ! সমন্বিতা!” ওকে দেখে বলেছিল বিট্টু। ওর চোখে কৌতূক ফুটেছিল। “থামের আড়ালে কী করছিলি?” ধোঁয়া ছেড়েছিল একটু ফুরফুর করে ঠোঁট গোল করে।
‘হাহ্! আমার নাম জানে অ্যাঁ?’ সমন্বিতা ভেবেছিল মনে মনে। উত্তর দেয়নি ওর কথার। ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়েছিল শুধু একবার ওর দিকে।
তারপর ওকে অগ্রাহ্য করেই এগিয়ে চলেছিল করিডর ধরে।
“তুই আমায় খুব অপছন্দ করিস। না রে?” পিছন থেকে বলেছিল বিট্টু।
সমন্বিতা থমকে গেছিল একটু। সত্যি কথা বলতে ও খুবই অপছন্দ করে বিট্টুকে। ওর সম্পর্কে তেমনভাবে কিছু না জেনেই করে। কিন্তু সেকথা এমন মুখের উপর কেউ বললেও ভাল লাগে না।
ওর অস্বস্তিটা লক্ষ করেছিল বোধ হয়, “ঠিকই আছে। ঘাবড়াস না।” চটচটে হাসি হেসে বলেছিল বিট্টু, “তোর ওই প্রবল বিরক্তিতে কুঁচকে থাকা ভুরু, ওই কুঁচকোনো ঠোঁট, আমার বেশ ভালই লাগে। কালের মন্দিরায় রট্টার যে সখীটা ছিল, কী যেন তার নাম ছিল…তার কথা মনে পড়ে যায়। বা রাজসিংহের নির্মলা। বুঝলি? ওরাই আমার ফেভ ক্যারা কিন্তু! ওরম মেয়ের সঙ্গেই প্রেম করতে চাই আমি।”
“কী সব!” বলেছিল সমন্বিতা এবারে, নাকটা কুঁচকে গেছিল ওর, “একেবারেই পাতে দেওয়ার মত নয় তোর স্বভাব অ্যাঁ? তোর প্রেমিকা, মানে এক্স…হোয়াটেভার, সে এইমাত্র কাঁদতে কাঁদতে—”
ফ্যাক ফ্যাক করে হেসেছিল তখন বিট্টু।
আজব বদ প্রকৃতির ছেলে! ভেবেছিল সমন্বিতা।
~~
বাড়িতে ঢোকার আগেই কানে এসেছিল মা-বাবার চিৎকার।
“তোমার এই অ্যাটিচ্যুডটাই না—এই ঠিক এই অ্যাটিচ্যুডটাই—” বাবার গলা কানে এসেছিল, “আর লজ্জা করে না তোমার? অ্যাঁ? লজ্জা করে না? কেন আসে নির্মাল্য এ বাড়িতে? কী হিসেবে? নির্লজ্জ বেহায়া!”
“বেশ করবে আসবে! তোমার একার বাড়ি এটা? বেশ করবে—নিজে বেলেল্লাপানা করে মাল খেয়ে চুর হয়ে বাড়ি আসার সময় লজ্জা করে না তোমার? তুমি অন্যকে লজ্জা শেখাচ্ছো?”
আবার শুরু করেছে ওরা। আশেপাশের বাড়ি থেকে যে ওদের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যায়, এটুকু বোধ নেই ওদের!
ইয়ারফোনটা কানে ভাল করে গুঁজে নিয়েছিল সমন্বিতা। ফুল ভল্যুমে চালিয়ে দিয়েছিল ‘থার্টি সেকন্ডস্ টু মার্স’, ‘দিস ইজ ওয়ার’! তারপর মেইন গেট খুলে ঢুকে পড়েছিল বাড়িতে। সটান উপর তলায় নিজের ঘরে।
ওর ঘরে প্রচুর বই আছে। প্রচুর বই। বইয়ের তলায় চাপা পড়ে মরে যেতে পারে সমন্বিতা, এত বই আছে।
মামাবাড়ি থেকে দাদুর পুরো কালেকশন নিয়ে এসেছে ও। দেশী-বিদেশী কত বই! পড়া হয়নি সব, পড়া হয়নি কিছুই।
তবু, এই বইগুলোকে এমন আপন লাগে ওর! প্রত্যেকটা বইয়ের মধ্যে নতুন নতুন এক একটা জগৎ লুকিয়ে আছে। হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে। বইগুলোকে বুকে জড়িয়ে ঘুমোতে খুব ভাল লাগে সমন্বিতার।
ছোটবেলা থেকেই ও লক্ষ করেছে, বইয়ের মধ্যে বুঁদ হয়ে গেলে বাইরের ঝঞ্ঝাট ঝামেলা, মা-বাবার চিৎকার চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাঁটির আওয়াজ কিছু কানে যায় না ওর। ওরা মারামারি কাটাকাটি করে মরে পড়ে থাকলেও সমন্বিতা বুঝতে পারবে না। শুনতে পাবে না কিছু। কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে নিলে তো আরও ভাল। আরও সহজ বাইরেটাকে বোবা করে দেওয়া।
এদের ওই অর্থহীন ভালবাসাবাসি, অর্থহীন ঝগড়া অশান্তি—ওর মা-বাবা—
মা-বাবার নিত্যদিনের অশান্তি থেকে নিজেকে আড়ালে রাখতেই একসময় সমন্বিতা আঁকড়ে ধরেছিল বইকে, ওর মনে আছে।
বইয়ে বুঁদ হয়ে থাকলে ওদের মধ্যেকার অসন্তোষ ছুঁতে পারে না যেন ওকে।
বইয়ের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকলে মাঝে মাঝে সমন্বিতা শুনতে পায় নিজের হৃদয়ের শব্দ। যে হৃদয় চুপ থাকে বাকি বেশিরভাগ সময়।
‘কী অদ্ভুত ছেলেটা!’ আজ ভেবেছিল ও, ‘কী অদ্ভুত ওই সব পাওয়া, আর সবকিছুকে ঠেলা মেরে দূরে সরিয়ে দেওয়া বদ প্রকৃতির ছেলেটা!’
ওর ইয়ারফোনের গান ভেদ করেও ওর মনে ভেসে আসছিল বিট্টুর ফ্যাক ফ্যাক হাসিটা।
~~
“এই শুনেছিস, শুনেছিস?” আজকেও মেয়েগুলো ওর থেকে দুই বেঞ্চ পিছনে বসেই ‘ফিসফিস’ করছিল। কয়েকটা ছেলেও ছিল আজকে। আজকেও সমন্বিতার কানে এসেছিল ওদের ফিসফিসিয়ে বলা কথাগুলো।
“বিট্টুর মা—উম্, ইলা সেন রে, ইতিহাসের এইচ ও ডি—”
“আরে মা! জানি আমরা, কে বিট্টুর মা আর কে ইলা সেন, বলছিস টা কী বলবি তো?”
“ওঁর পি এইচ ডির ব্যাপারে শুনেছিস? থিসিসটা নাকি চুরি ছিল? কে খবর পাঠিয়েছে অ্যাননিমাসলি? শুনেছিস?”
“কই না তো রে? কোত্থেকে শুনলি তুই?”
“জানিস না—”
নিমকি ভাজা খেতে খেতে শুনতে পাচ্ছিল সমন্বিতা। শোনার ইচ্ছা করছিল না ওর। কোনও একদিন পাতে দেওয়ার মত কোনও বিষয় নিয়েও তো ফিসফিস করতে পারে এরা? অলসভাবে ভাবছিল সমন্বিতা।
লি ফ্র্যান্সেসকার নতুন একটা বই আসছে নাকি? মনে মনে ভাবছিল ও, কিভাবে কিনবে সেটাকে। কানে আসছিল ওদের কথার টুকরো ভেসে।
“ওই শোন! বলছি যে, সরাসরি ওকেই জিজ্ঞেস করবি? বিট্টুকে?”
“অ্যাঁ? বলিস কী? লজ্জা পাবে না? যাঃ!”
“ওর লজ্জা আছে নাকি?” বলেছিল কোনও একটা অপেক্ষাকৃত গম্ভীর গলা। আঃ! সেই মেয়েটা, যাকে কদিন আগে ডাম্প করেছে বিট্টু।
“হিহি!” “হিহি!” “যা বলেছিস!”
আবার উঠে যেতে হল এখান থেকে। এদের এই গসিপ থেকে যত দূরে থাকো, যথেষ্ট নয় সেটা।
কলেজ বিল্ডিঙের দোতলার কোণের দিকে একটা বিরাট বড় ঘর আছে। ফাঁকা পড়ে থাকে ঘরটা। আগে বোধ হয় লাইব্রেরী ছিল ওটাই। তারপর রিকন্স্ট্রাকশন বা কিছু করার কথা ছিল। ঘর ফাঁকা করা হয়েছে। বাকি কাজ আর শুরু করা হয়ে ওঠেনি। অন্তত যে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে এই কলেজে আসছে সমন্বিতা তাতে ও দেখেনি এই ঘরে কোনও কাজ হতে।
ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কয়েকটা বইয়ের আলমারি আছে এখনো। আলমারিগুলোতে বই নেই যদিও।
সেই ঘরের জানলার ধারে একা একা বসে থাকে সমন্বিতা অফ পিরিয়ডের সময়। কখনো হয়তো ক্লাস কেটেও।
আজও চলেছিল ও ওইদিকেই। শীতকালের দুপুরের মত বিশ্রী বদ সময় খুব কম আছে। দুপুরটাকে ভাল করে ধরতে না ধরতে দুপুর গায়েব হয়ে যায়। ছোটবেলায় মা গায়ে সর্ষের তেল মাখিয়ে দিয়ে ছাদে, বা বাড়ির সামনের চাতালে রোদের উপর বসিয়ে দিত ওকে। তখন যেন অল্প সেটুকু সময়ের মধ্যেই দুপুর ধরা পড়ে যেত হাতের মুঠোয়। সারাশরীর দিয়ে মেখে নেওয়া যেত দুপুরকে। কেন যেন সেই কথা মনে পড়ে গিয়েছিল আজ সমন্বিতার।
চলতে চলতে হঠাৎ দেখে, বিট্টু দাঁড়িয়ে আছে একলা হয়ে, আর ওকে ঘিরে সেই মেয়ের দল।
এদের আশেপাশের মধ্যে পড়ে গেলেও অহেতুক ঝঞ্ঝাট, ভেবেছিল সমন্বিতা। সাবধানে গা বাঁচিয়ে পাশ কাটিয়ে চলেছিল ও চোখ সরিয়ে চুপচাপ।
“সত্যি নাকি? এর’ম কমপ্লেন হয়েছে নাকি?”
“সত্যি বিট্টু?”
“আর? তারপরে? কী করবেন ম্যাডাম এবার?”
“তোকে বলেছেন কিছু? কেন এর’ম কমপ্লেন এল হঠাৎ? মানে—”
বিট্টু হাসছিল, হেঁ হেঁ হেঁ। ডানহাত দিয়ে মাথার পিছন দিক চুলকোচ্ছিল বোকাদের মত।
ওদিকে তাকাবে না তাকাবে না করেও একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ফেলেছিল সমন্বিতা।
দেখেছিল, হাসি হাসি মুখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে বিট্টু।
আর, হঠাৎ সমন্বিতার মাথায় রক্ত চড়ে গেছিল।
কী ধরনের সব মানুষ সত্যি!
এগিয়ে গিয়ে ও বিট্টুর হাত চেপে ধরেছিল। তারপর ওকে টেনে নিয়ে চলেছিল নিজের সঙ্গে। বিড়বিড় করে বলেছিল, “এদের কি আর কোনও কাজ নেই অন্যের পিছনে কাঠি করা ছাড়া?” বিট্টু বোধহয় একাই শুনতে পেয়েছিল সে কথা। চোখ একটু বড় হয়েছিল ওর যেন বিস্ময়ে।
বেশ একটু চেঁচিয়েই সমন্বিতা বলেছিল তারপর, বিট্টুকে নিয়ে একটু এগিয়ে যাওয়ার পরে, “ওর মা ওর সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা করেন না। যা, ইলা ম্যা’মকেই জিজ্ঞেস কর না নিজেরা? অদ্ভুত সব! মা-বাবারা কিসের জন্য কী করে, ছেলেমেয়েরা জানবে কী করে তা!”
মেয়েগুলো সমন্বিতাকে নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে এতগুলো কথা একসঙ্গে বলতে দেখেনি আগে কখনো। অবাক হয়েছিল মনে হয়। ওর পিছু নেয়নি ওরা, বা গালাগালিও শুরু করেনি। তার আগেই বিট্টুর হাত ধরে টানতে টানতে সমন্বিতা সেখান থেকে পগার পার!
এক্কেবারে সেই ফেলে রাখা অব্যবহৃত ক্লাসরুমে ওকে নিয়ে গিয়ে ওর হাত ছেড়েছিল ও।
ক্লাসরুমে গিয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলেছিল, তারপর হাঁফাচ্ছিল।
আর বিট্টু হঠাৎ লুটিয়ে পড়েছিল হেসে। হো হো শব্দে সে কী ঘর কাঁপানো হাসি!
সমন্বিতা তাকিয়েছিল চুপচাপ খানিকক্ষণ ওর দিকে। এত হাসির কী আছে! হাসি জিনিষটা ছোঁয়াচে। বিট্টুর দামাল হাসি দেখে ওর নিজেরও হাসি পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সমন্বিতার হাসি পায় কম।
খানিকক্ষণ পরে জানলার ধারে নিজের জায়গায় গিয়ে বসেছিল ও। বলেছিল, “হাসি থামলে কেটে পড়।”
পেটে হাত চেপে হাসছিল বিট্টু। “না মানে—”
বড় একটা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে সামলেছিল তারপরে। “কোনওদিন তোকে এত জোরে চেঁচাতে দেখিনি। বা এতগুলো কথা একসঙ্গে বলতে শুনিনি। মেয়েগুলো ঘাবড়ে গেছে না যা! মানে, ওদের মুখগুলো তখন যা—”
আবার হাসিতে ভেঙে পড়েছিল বিট্টু।
“থ্যাংকিউ।” একটু পরে বলেছিল বিট্টু।
“কিসের জন্য?” সমন্বিতা বলেছিল অন্যমনস্কভাবে।
“বাঁচালি আমাকে?”
“বাঁচালাম?” ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছিল সমন্বিতা, তারপরে বলেছিল, “ওঃ! না। তোকে বাঁচানোর জন্য বাঁচাই নি। ওই পরের ব্যাপারে নাক গলানো দেখে মাথা গরম হয়ে গেল। তাই—”
বিট্টু হো হো করে হেসেছিল তখন আবার। তারপর হাসি-টাসি থামলে বলেছিল, “সে অবশ্য ঠিক। তুই এমনিতেও আমাকে পছন্দই করিস না।” তারপর ছোট একটা নিঃশ্বাস নিয়ে মুখের উপর একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বলেছিল, “তুই বিশ্বাস করিস ওই গুজবে? যে আমার মা চুরি করেছে?”
সমন্বিতা ভুরু কুঁচকেছিল তখন, “না বিশ্বাস করার কী আছে? সকলেই তো চুরি করে আজকাল।” তারপর মনে হয়েছিল, বেশি জেনারালাইজড্ হয়ে গেল কথাটা, বলেছিল, “অনেকেই করেও না আবার! হতেই পারে। আবার নাও হতে পারে।”
মুখ টিপে হেসেছিল বিট্টু। তারপর আড়মোড়া ভেঙেছিল একটা।
"আমি মোটামুটি নব্বই পার্সেন্ট শিওর যে চুরি করেছিল মা। শি ইজ্ লাইক দ্যাট। আমার পেরেন্টসরা। ওরা অ্যাম্বিশনের জন্য—”
“আহ্হ্হ্হ” করে তারপরে একটা মস্ত হাই তুলেছিল বিট্টু, “এই দৌড়োদৌড়ি, হাঁটাহাঁটি আর হাসাহাসি করে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ বেড়ে গেছে শরীরে। বাব্বা! এট্টু বিশ্রামের দরকার।”
ভুরু কুঁচকে চুপ করে ছিল সমন্বিতা।
বিট্টু তাকিয়েছিল ওর মুখের দিকে হাসিমুখে, “তোর অ্যাড্রিনালিন পাম্পিং হয়নি? এত জোরে চেঁচালি অ্যাঁ?”
সমন্বিতা চুপ করে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল।
“এইরকমভাবে দিন কাটাতে ভাল লাগে?” জিজ্ঞাসা করেছিল তখন বিট্টু হঠাৎ, “এত চুপচাপ? উইদাউট এনি কাইন্ড অফ এন্টারটেইনমেন্ট?”
“আমি এন্টারটেইনমেন্ট ছাড়া দিন কাটাই কে বলল তোকে?” সমন্বিতা বলেছিল চোখ সরু করে।
“আমি লক্ষ করি তোকে। তুই—বয়ফ্রেন্ড আছে তোর? বা, গার্লফ্রেন্ড?” বিট্টুর চোখ হেসেছিল আবার।
“না! সময় নষ্ট। এনার্জি নষ্ট।”
“অ্যাঁ? বলিস কী? প্রেম এনার্জি নষ্ট? বরঞ্চ এনার্জি পাওয়া যায় ওতে। এঃ! দিব্য চেহারাটা তোর, একটা বয়ফ্রেন্ড জোটাতে পারলি না?”
সমন্বিতা চোখ সরু করে তাকিয়েছিল তখন। বইটা বন্ধ করে গম্ভীর মুখেই বলেছিল, “আমার এখনও এত হোপলেস পরিস্থিতি হয়নি যে তোর কাছ থেকে লাভ অ্যাডভাইস নিতে হবে। তুই না তোর গার্লফ্রেন্ডেরা ভালমত প্রেমে পড়ে গেলেই তাদের ডাম্প করিস?”
“হমম্!” বড় সড় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেছিল বিট্টু। সত্যিই গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল যেন। বেঁকে পিছনের বেঞ্চটাতে হেলান দিয়ে বসেছিল অলস একটা ভঙ্গিতে।
“বিশ্বাস করতে পারবি কিনা জানি না, কিন্তু যখন ওদের কাছে কনফেস করি আমি, তখন সবসময়ই সিরিয়াস থাকি রে! কিন্তু, তারপরে—অত সহজেই ওরা আমার প্রেমে পড়ে গেলে মন ভীষণ দমে যায় বুঝলি। কত কান্নাকাটি, কত দুঃখ যন্ত্রণা! চোখের জল কি সস্তা নাকি?”
“আচ্ছা!” বলেছিল সমন্বিতা। ঝোলানো ব্যাগটা থেকে অন্য একটা বই বের করে খুলে ধরেছিল মুখের সামনে। কয়েকটা নিমকিও বের করেছিল, বাড়িয়ে ধরেছিল বিট্টুর দিকে, “খাবি?”
~~
তারপর থেকে কী হল কে জানে, বিট্টু মাঝে মাঝেই হানা দেয় সমন্বিতার এই গোপন ডেরায়। এইজন্য মুনি ঋষিরা বলে গেছেন, গোপন কথাটি রবে না গোপনে, যদি অন্য কাউকেই সে গোপনীয়তার ভাগ দাও।
অবশ্য একদিকে ভাল বিট্টু, বেশ বোঝনদার। সমন্বিতার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে না আদপেই।
সমন্বিতা বই পড়ে। বিট্টু নিজের মোবাইলে গেম খেলে।
খাবারদাবার কিনে আনে মাঝে মধ্যে। সমন্বিতা সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না বলে খুব সিগারেট তেষ্টা পেলে বাইরে যায়। সমন্বিতার পছন্দের গান শুনে মতামত দেয়।
“এত পড়লে, আর এত কম খেলে, তোর শরীর টিঁকবে না। কী ধরনের চেহারা এটা?” বলে সমন্বিতার শিরা বের করা হাতের কবজি ধরে নাড়িয়ে চাড়িয়ে।
সমন্বিতা ভুরু কুঁচকে একটানে হাত ছাড়িয়ে নিলে বলে, “রাগিস না, রাগিস না।” পকেট থেকে সমন্বিতার প্রিয় চকোলেট বের করে দেয়।
একদিন ঝামেলা হল। সেদিন ওই ফাঁকা ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে সমন্বিতা চলেছিল লাইব্রেরীতে। নতুন বই নেবে একটা, পুরোনো বইটাও ফেরৎ দিতে হবে। বিট্টু সঙ্গ নিল ওর।
প্রতিদিনকার মত সেদিনও এ কে বলেছিলেন, “কী রে? লিখলি লেখাটা?”
আর, সমন্বিতাও বলেছে, প্রতিদিনকার মতই, “না, লিখতে পারি না স্যার।”
ওটা এখন একটা খেলা মতন হয়েছে ওদের। সমন্বিতা লক্ষ করে দেখেছে, এ কে লাইব্রেরীতে নিয়মিত আসা যাওয়া যে সব ছাত্রছাত্রীদের, তাদের সবাইকেই এই একই অনুরোধ জানিয়ে থাকেন। কিছুতেই আর ম্যাগাজিনের জন্য লেখা জোগাড় করে উঠতে পারেন না। এইভাবে চলতে থাকলে এ কের স্বপ্নের ম্যাগাজিন কোনওদিনই চালু হয়ে উঠতে পারবে না। একটু মায়াই লাগে ওর এ কের জন্য। বেচারা!
কিন্তু সেদিন বিট্টু ছিল সঙ্গে। কানখাড়া করে শুনেছিল ও কথাটা।
তারপর থেকে ঝামেলা শুরু হল।
“লেখ না, লেখ। প্রাইজ-ট্রাইজ পেয়ে যেতে পারিস! তুই লিখলেই পাবি। জাস্ট শুরু করে দে! হয়তো এ বছরের যুব সাহিত্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডটাই, বা ধর—”
বেশির ভাগ সময় ওর এইসব ভুলভাল কথাকে অগ্রাহ্য করে সমন্বিতা। কিন্তু এক একদিন থাকতে পারে না, “তুই কি গাধা নাকি?"
“কেন কেন? গাধা কেন হব? তুই লিখলেই—”
"চুপ থাকতে পারলে থাক। নয়তো যা এখান থেকে।”
সেরকমই একদিন, সমন্বিতার তাড়া খেয়ে জলদি জলদি ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে, “আচ্ছা, বেশ! চললাম সত্যিই, হে বন্ধু বিদায়—” এইসব বলে কায়দা করে ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে দরজার কোণে রাখা একটা আলমারিতে ধাক্কা লাগিয়ে পায়ের নখ-টখ ভেঙে রক্তারক্তি কাণ্ড করেছিল বিট্টু।
সমন্বিতা ঠোঁট চিপে দেখেছিল কয়েকমুহূর্ত ওর ছটফট করা।
তারপর, নিজের ব্যাগের সামনের পকেট, যেখানে মাথার ক্লিপ, টিস্যু পেপার, ছোট নেল কাটার একটা, একটা ছোট্ট তুলি, ক্ষয়ে যাওয়া রাবারের টুকরো, এসব থাকে, সেখান থেকে একটা ব্যান্ড এড বের করেছিল সমন্বিতা।
তুলো দিয়ে মুড়ে ব্যান্ড এড লাগিয়ে দিয়েছিল ক্ষতস্থানে।
“সব কথায় অত নাটক করলে এরকমই হবে।” বলেছিল মুখ চিপে।
তারপর বিট্টুর ব্যথায় বিকৃত হয়ে যাওয়া মুখ দেখে মায়া লেগেছিল ওর, হেসেছিল একটু, “তোর মা আবার আমার নাম্বার কাটবেন না তো রে? তুই হলি এলিট! আমার তাড়া খেয়ে ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে চোট পেয়েছিস জানলে—”
বিট্টুও হেসেছিল তখন। শুকনো দেখিয়েছিল হাসিটা।
“মা খেয়ালই করবে না এটা। এমনকি আমি জোর করে ধরে দেখিয়ে দিই যদি ব্যথা পাওয়া জায়গা, তাও ভুলে যাবে মিনিট খানেক পরেই। আমার অভিজ্ঞতা আছে।”
সমন্বিতা থমকে গিয়েছিল একটু।
“কী হয়েছিল শোন,” বলেছিল বিট্টু, “তখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ি। পরীক্ষা সেদিন। একদম ইতিহাস পরীক্ষাই, বুঝলি? ইতিহাসে আমার হাইয়েস্ট মার্কস পাওয়াটা ছিল ম্যান্ডেটরি। অর এলস্ মায়ের সম্মান থাকবে না। তা, এমন উজবুক আমি, এমন গাধা, ঠিক সেই ইতিহাস পরীক্ষার আগের দিন পাকামো করে ব্লেড দিয়ে পেনসিল ছুলতে গিয়ে আঙুলের নখের উপর দিক সুদ্ধু একদম উড়িয়ে দিয়েছি! সে এক রক্তারক্তি কাণ্ড, আর কী বলব!”
হেসে মাথা নাড়িয়েছিল বিট্টু।
“তারপরে কী হল বলে তোর মনে হয়? মাকে দেখালাম কাটা জায়গাটা। মানে লুকিয়ে ফেলতে পারলে লুকোতাম, কিন্তু লুকোনোর উপায় ছিল না, এমনভাবে কেটেছিল। পরের দিন ইতিহাস পরীক্ষা। মা বকাবকি করল না সেভাবে। ওষুধপত্তরও লাগানো হল। কিন্তু পরীক্ষায় মাত্র ষাট নাম্বার মত প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছিলাম বহু কষ্টে। হাত টনটন করছে, নাড়াতে পারছি না। চোখের জলে ভেসে গিয়েও লিখেছি ওই ষাট নাম্বার। মায়ের সম্মান, ইম্পর্ট্যান্ট ছিল আমার কাছে—”
“বাইরে বেরিয়ে চোখে জল নিয়েও হেসে যেই বলেছি মাকে, কত কষ্ট করে লিখেছি, কত চেষ্টা করেছি, আর তারপরে যেই বলেছি উত্তর করেছি মাত্র ষাট নাম্বারের? সেই ইস্কুলে সবার সামনেই মা বেধড়ক ঠ্যাঙাতে শুরু করেছে বুঝলি? আগের দিন মারে নি বলে আমি তো বিলকুল প্রিপেয়ারড্ ছিলুম না এটার জন্য। বিশেষ করে অন্যায় করেছি আগের দিন, আর কপালে মার জুটছে কবে? না সবে যেদিন এত চেষ্টা করলাম, এত কষ্ট করলাম! অ্যান্ড ফর হার! হাতটা ব্যথায় ভেঙে যাচ্ছে—পরে বুঝেছি বুঝলি? আগের দিন থেকেই মনে মনে প্রস্তুত ছিল মা, রাগটা জমিয়ে রেখেছিল, মার খেয়ে যদি পরীক্ষায় আরো ঝামেলা করি? পরীক্ষা শেষ, তখনকার মত মায়ের প্রয়োজনও শেষ আমায়, দিয়েছে পিটিয়ে—”
“—ওঃ,” বলেছিল সমন্বিতা। এরকম মা-বাবা অনেকই দেখা যায় আশেপাশে। কোনও টিপ্পনী করার কথা, বা সান্ত্বনা দেওয়ার কথা মাথায় আসেনি ওর।
“ইয়েস। খেয়াল করেছি, খেয়াল, তারপর থেকে বহুবার, বুঝলি? শি ডাজন’ট কেয়ার। এই যে আমি রোজ নতুন নতুন মেয়ের সঙ্গে বেলেল্লাপানা করি, শুরু করেছিলাম মায়ের অ্যাটেনশন পাওয়ার জন্যই। বাট, যতক্ষণ ভাল রেজাল্ট করব, শি উডন’ট কেয়ার অ্যাবাউট ইট।”
‘আহ্-হ্-হ্-হ্-হ্’ করে নাটকীয় নিঃশ্বাস ফেলেছিল একটা তারপরে।
ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিল সমন্বিতা কিছুক্ষণ। কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর বলেছিল, “তা, বাজে রেজাল্ট করলেই পারিস, মা জব্দ হয়ে যাবে।”
“হুমম্!” ত্যাঁদড় একটা হাসি হেসেছিল তখন বিট্টু, “—আসলে কী জানিস, আমার মত জিনিয়াসের পক্ষে বাজে রেজাল্ট করাটা চাপের। তুই যেরকম মিডিওকার, বুঝবি না ঠিক, মানে প্রশ্নপত্রে প্রশ্ন দেখে জানা উত্তর দেওয়ার থেকে নিজেকে বিরত করাটা—” অর্থপূর্ণ বাঁকা হাসি হেসেছিল বিট্টু। সে হাসি কেঁপে যায়নি কোথাও।
সমন্বিতা মাথা নিচু করে বসেছিল একটু, তারপর মাথা তুলে অল্প হেসেছিল, বলেছিল, “তাও ভাল যে তুই জানিস যে মেয়েদের সঙ্গে বেলেল্লাপানা করিস তুই।”
“আরে!” বিট্টুও হেসেছিল তখন, “এটাও জানব না? মানে গাধা ভাবিস ঠিক আছে, বাট এতটাই গাধা ভাবিস নাকি আমাকে?”
একটু থেমে থেকে একটু হেসে সোজা তাকিয়েছিল সমন্বিতার চোখে, “তবে কিনা, যেটা সেদিন বলেছিলাম তোকে সেটাও ঠিক। আমি সত্যিকারের প্রেম করতেই চাই এখন, জাস্ট, কেউ আমার প্রেমে পড়েছে ভাবলে এত ডিস্যাপয়েন্টেড লাগে!”
সমন্বিতার মনে হয়েছিল হঠাৎ, বিট্টুর ট্রেডমার্ক হাসিটাকে চেনে ও। আয়নায় দেখেছে অনেকবার।
ছোটবেলায়, সমন্বিতার মনে আছে, শীলা বা মালবিকা যখন ওদের মা-বাবার সঙ্গে একসঙ্গে চিড়িয়াখানায় বা নিকো পার্কে যেত, আর তারপরের দিন ইস্কুলে এসে গল্প করত সেই ঘোরার—কেমন করে শীলার বাবা একটা রাইড চড়তে গিয়ে ভীষণ ভয় পেয়ে আঁকড়ে ধরেছিল মাকে, আর শীলা আর মা কিন্তু একটুও ভয় পায়নি, বা কেমন করে মালবিকার মা একটা জন্তুর নাম উচ্চারণে ভুল করেছিল বলে ওর বাবা পিছনে লেগেছিল ওর মায়ের, মালবিকা নিজে কিন্তু একদম ঠিক উচ্চারণ করেছিল, আর তাই মা রাগ করেছিল ওর আর ওর বাবার উপর—এইসব গল্প যখন করত ওরা, তখন সমন্বিতা ঠিক এরকমই হাসি হাসত একটা।
মামার বাড়িতে দিদিমা যখন চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করত, “হ্যাঁরে, এখনও ঝগড়া করে ওরা?” আর তারপরে আশান্বিত গলায় বলত, “এখন কমে গেছে না অশান্তি?” তখনও ওই হাসিটাই হাসত।
কিন্তু বিট্টু অমন হাসে কেন এখন? সমন্বিতা তো প্রশ্ন করেনি ওকে কোন?
কয়েকমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলেছিল সমন্বিতা, “আমায় বলছিস কেন তুই এসব? যদি পাঁচকান করি?”
বিট্টু থমকে গিয়েছিল তাতে, চুপ করেছিল কয়েকমুহূর্ত, তারপর হেসেছিল একটু, কাঁধ ঝাঁকিয়েছিল, “কে জানে? তোকে দেখে মনে হয় যেন তোকে বলা যায় সবকিছু।”
সমন্বিতার মুখের সামনে এসে পড়া দুগাছি চুল নিয়ে নাড়াচাড়া করে খেলা করছিল বিট্টু, “দয়া মায়া তো কিছু নেই তোর শরীরে—পিটি আসে না তোর। আর বন্ধুও নেই তোর কোনও এ শর্মা ছাড়া যে গসিপ করবি।”
তারপর হেসে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাতে ধরাতে চোখ মারার মত একটা ভঙ্গি করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল বিট্টু। বলতে বলতে গেছিল, “আমাদের সিক্রেট এটা, অ্যাঁ? জানাস না কাউকে, তোর কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে কমপ্লেন করেছিলাম।”
~~
বিট্টুর প্রেমে পড়াটা সমন্বিতার প্ল্যানের মধ্যে ছিল না। একদিন, বইয়ে পড়া ক্যারেকটারদের মত কেউ একজন এসে উপস্থিত হবে ওর সামনে, আর হুড়মুড় করে দুজনে দুজনের প্রেমে পড়ে ভেসে যাবে একদম আচমকাই, এই ধরনের একটা ভাসা ভাসা আইডিয়া ছিল ওর নিজের ভবিষ্যৎ প্রেমের সম্পর্কে।
তাছাড়া, বিট্টুর প্রেমে পড়া সম্পূর্ণই নিষ্ফল একটা ব্যাপার—মানে, বিট্টু তো, যারা ওকে ভালবাসে, তাদের পছন্দই করে না। এমন লোকের প্রেমে পড়া ভীষণ রকম বেয়াকুবি নয়?
তাই চমক লেগেছিল সমন্বিতার। ঘাবড়ে গেছিল ও।
বিট্টুকেই জিজ্ঞাসা করেছিল একদিন। “তুই যে এত মেয়ের সঙ্গে প্রেম করিস, বুঝিস কী করে যে পছন্দ হয়েছে তাকে?”
“সে বোঝা যায়।” বিজ্ঞের মত বলেছিল বিট্টু।
সমন্বিতা চোখ সরু করে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল একবার ওর দিকে। তারপর চোখ সরিয়ে নিয়েছিল ওর মুখের থেকে।
"ব্যাপার কি?” বিট্টু বলেছিল তখন, “প্রেমে পড়েছিস?”
“হুমম্।” সমন্বিতা বলেছিল।
“যার ব্যাপারে সন্দেহ তাকে বলে দে গিয়ে। কনফেস করে দে। কদিন ঘুরলে ফিরলেই বুঝতে পারবি প্রেম কি প্রেম নয়, বুঝলি?” নিশ্চিত স্বরে বলেছিল বিট্টু।
“হুমম্।”
সমন্বিতা তাকিয়েছিল বিট্টুর মুখের দিকে।
হেসেছিল একটু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে, “না! আনরিকুইটেড লাভই ভাল আমার! রোম্যান্টিক!”
“হুম্!” বিট্টু বলেছিল তখন। সমন্বিতার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিল কিছু।
কয়েকদিন পরে ফাঁকা পরিত্যক্ত ঘরে সমন্বিতার পিছনের বেঞ্চে বসে, জানলা দিয়ে ঘরে ঢোকা মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা হলদে রোদে পা ছড়িয়ে দিয়ে, বিট্টু বলেছিল, “আমার সঙ্গে প্রেম কর, বুঝলি?”
সমন্বিতা মন দিয়ে পড়ছিল ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’। চমকে তাকিয়েছিল এখন বিট্টুর মুখের দিকে। মুখের থেকে সব রক্ত সরে গিয়েছিল। নিজেই অনুভব করেছিল সেটা।
বিট্টু তাকিয়েছিল ওর মুখের দিকে।
“কে না কে তোর ক্রাশ। ভুলে যা তার কথা। কোনওদিন যদি নাই জানাস তাকে, তবে লাভ কী? আমার সঙ্গে প্রেম কর। দুদিনে ভুলে যাবি তাকে।”
“তারপর?” বহুকষ্টে যেন উচ্চারণ করতে হয়েছিল সমন্বিতাকে। গলাটা শুকনো শোনাচ্ছে।
“তারপর আর কী? তোকে আমার পছন্দ সত্যিই। মিথ্যা বলছি না। আমার সঙ্গে প্রেম কর। উই কুড বি গুড ফর ইচ আদার।”
“অ্যাজ ইফ!” বলেছিল সমন্বিতা।
“কী অ্যাজ ইফ? সত্যি বলছি। ভেবে দেখ।” বিট্টু বলেছিল বেশ যেন উত্তেজিত স্বরেই। অল্প হাসিমুখে। “তোর প্রেম করার ইচ্ছা নেই কিন্তু একজনকে পছন্দ। আমার প্রেম করার ইচ্ছা আছে কিন্তু কাউকেই পছন্দ নয়। উই আর লাইক, মেড ফর ইচ আদার!”
“আমার ক্রাশ যে, সে হচ্ছে একটা সত্যিকারের ভাল মানুষ। তোর মত উজবুক নয়। তোর প্রেমে পড়ব বললেই কি পড়া যায় নাকি?” সমন্বিতা বলেছিল।
বিট্টু তাকিয়েছিল ওর দিকে কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলেছিল, “আমি চিনি তাকে?”
“না।” বলেছিল সমন্বিতা।
“আমাদের কলেজের?”
“উম্...হতে পারে। বলব না।”
“কী করে দেখা হল তোর তার সঙ্গে? মানে পরিচয়?”
“রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ মুখোমুখি ধাক্কা লেগে গিয়েছিল। আমার ওড়না আটকে গিয়েছিল তার জামার বোতামে।” বলেছিল সমন্বিতা।
বিট্টু হেসেছিল। “তাতেই প্রেমে পড়ে গেলি?”
সমন্বিতাও হেসেছিল, "না। প্রেমে পড়ার অন্য কারণ আছে।” বইয়ের পৃষ্ঠাকে দু আঙুলে ঘষে ঘষে অনুভব করেছিল তার মসৃণতা, “—সেই ছেলেটা, খুব একলা, কিন্তু খুব ভাল। একা একা ফেরে, সবাইকে দূরে ঠেলে দিয়ে, নিজেই বোঝে না নিজে কতটা ভাল। সবাই ভাবে ওর গভীরতা নেই, কিন্তু আসলে—”
বিট্টু তাকিয়েছিল ওর মুখের দিকে।
~~
কয়েকদিন পরে সমন্বিতা লিখে ফেলেছিল ছোট্ট একটা গল্প। একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় প্রেমিক রাখালের অপেক্ষারত একটা মেয়ের অপেক্ষার কাহিনী। ভাল হয়নি অবশ্যই। ওর প্রথম গল্প লেখার চেষ্টা ওটা। তবু, নিয়ে গিয়েছিল সেটাকে এ কের কাছে।
এ কে সেই লেখা পড়েই হয়ে উঠেছিলেন উচ্ছ্বসিত। “দারুণ! দারুণ! সাতটা গল্প জমেছে এই তিনমাসে, আর খান পনেরো কবিতা। এই দিয়েই ছাপানো যাবে ম্যাগাজিন! আর কটা লেখা পেলে হত, বাট, না হলেও হবে। থ্যাংকিউ থ্যাংকিউ।”
ওঁর ছেলেমানুষী হাসি দেখে হেসেছিল সমন্বিতা।
সেই হাসি লেগেছিল ওর ঠোঁটে তখনও যখন ও পৌঁছেছিল ওদের ডেরায়, সেই ফাঁকা ক্লাসরুমে।
হ্যাঁ, ওটা আর আজকাল একা সমন্বিতার ডেরা নেই। বিট্টুরও অধিকার জন্মেছে ওটার উপর। অ্যাট লিস্ট চল্লিশ পার্সেন্ট ওর এখন ওটা।
বিট্টু পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে, বন্ধুত্বপূর্ণ আলিঙ্গন, “ওর’ম বিচ্ছিরি হাসিস না। মাথা গরম হয়ে যায়।” বলেছিল সমন্বিতার চুলে নাক গুঁজে।
“যা-তা!” সমন্বিতা বলেছিল। “এমনিতেই এখানে এতক্ষণ থাকিস তুই যে তোর আর আমার সম্পর্কে গুজব ছড়াচ্ছে। তার ওপর—”
“ছড়াক না! ক্ষতি কী?” বিট্টু বলেছিল, “আমার ক্ষতি নেই, আমি তো প্রেমে পড়েইছি তোর। জাস্ট তুই—”
এই ভাললাগার রেশটুকুই একমাত্র বিট্টু দিতে পারে ওকে, সেটা জানে সমন্বিতা। এর বেশি দাবি করতে গেলে শুধু শূন্যতা ঠেকবে হাতে।
মনে মনে হেসে নিয়ে কনুইয়ের বাড়ি মেরেছিল ও বিট্টুর বুকে, “ভাগ এখান থেকে। ন্যাকামো করিস না।” বলেছিল গম্ভীর মুখে।
“কী কাণ্ড!” বুকে হাত বোলাতে বোলাতে বিট্টু বলেছিল, “কী কাণ্ড অ্যাঁ? শুধু হৃদয়ে চোট দিয়ে শান্তি নেই, একেবারে কনুই দিয়ে বুকে গুঁতো?” তারপরে একটু মাথা-টাথা চুলকে বলেছিল, “আমি খুব ভাল কিসার। জানিস? আমার সব এক্সদের জিজ্ঞেস করলেই বলবে।”
সমন্বিতার দিক দিয়ে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে বলেছিল, “প্র্যাক্টিস করবি?”
সমন্বিতা ফেরেনি ওর দিকে। জানলার দিকে মুখ করে বসেছিল। মাথার মধ্যে গুনগুন করছিল কেলি ক্লার্কসনের গান।
আর কিছু চায় না সমন্বিতা। শুধু এইভাবেই কেটে যায় যদি বাকি দিনগুলো। এই খুনসুটি মজায়।
সমন্বিতা এই মুহূর্তগুলোয় জীবন কাটাতে পারে। অল্প অল্প উত্তেজনায়। অল্প অল্প ভাললাগায়।
দু’দিন পরে সমন্বিতা শুনেছিল, বিট্টু প্রোপোজ করেছে ঈশিতাকে, নাকি ঈশিতাই প্রোপোজ করেছে বিট্টুকে।
তা বেশ হয়েছে। ভেবেছিল মনে মনে।
~~
“ডিভোর্স নিচ্ছি আমরা।”
কোকিলের ডাক ভেসে আসছিল বাড়ির পাশের আমগাছটা থেকে। কোন এক অচিন কোকিলাকে বৌ হওয়ার জন্য ডাকছিল কোকিলটা। ঘর বাঁধবার জন্য নয় কিন্তু। কে না জানে, কোকিলেরা বাসা বাঁধে না?
মা বলেছিল, “কার সঙ্গে থাকতে চাস তুই? যার সঙ্গে থাকতে চাস তার সঙ্গেই—”
“যে কেউ।” বলেছিল সমন্বিতা, "তোমরা যা ভাল বোঝ!”
মা মাথা নিচু করে চুপ করে ছিল তখন খানিকক্ষণ। চুপ ছিল বাবাও।
তারপর মাথা তুলে কেমন একরকম একটা হাসি হেসে মা বলেছিল, “আমারই দোষ এটা, আমাদের দোষ, জানি। তুই এমন গুটিয়ে থাকা হয়েছিস—”
মনে মনে হেসেছিল সমন্বিতা। গুটিয়ে থাকা—
মা বলে চলেছিল, “ভেবেছিলাম, আমাদের জীবন যেমন তেমন ভাবে চলে যাবে, কিন্তু তোকে একটা পরিপূর্ণ সুস্থ জীবন দিতে পারব দুজনে মিলে চেষ্টা করলে। চেষ্টায় ত্রুটি রয়ে গেল...এখন মনে হয়, আগেই যদি ডিভোর্স নিয়ে নিতাম আমরা তাহলেই হয়তো—”
“সরি সমু।” বলেছিল বাবা, “সরি!”
তোমার দোষ নেই মা, তোমারও নয় বাবা, সমন্বিতার গলার কাছে আটকে ছিল কথাটা, তোমাদের দোষ নেই।
দোষ কারো নয়। দোষ কারো নয়।
কোকিলেরা ডাকছে। দোলযাত্রা এসে গেছে। পলাশে শিমূলে রাঙা হয়েছে নিশ্চয়ই এই বাংলার কোনও না কোনও জায়গা। শহরে বোঝা যায় না বসন্তের আগমন তত ভাল। তবু, দোলযাত্রা এসে গেছে। রঙের উৎসব।
সমন্বিতার কেমন ধূসর মনে হচ্ছিল পৃথিবীটাকে।
ডিভোর্সের জন্য পিটিশন ফাইল করতে গেছে আজই মা-বাবা। কদিন হল বাড়িতে কোনও অশান্তি ঝগড়াঝাঁটি কিচ্ছু নেই। সেই কদিনই গল্পের বইয়ে মন বসাতে পারেনি সমন্বিতা।
“সমু, অ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট করেছিস?” বিট্টু বলেছিল সমন্বিতার কাঁধে টোকা মেরে।
এক ঝটকায় ওর হাতটাকে সরিয়ে দিয়েছিল সমন্বিতা। “বাড়াবাড়ি করিস না।” বলেছিল রূঢ় কঠিন স্বরে, “তেমন কিছু বলি না বলে তুই বড় বাড়াবাড়ি শুরু করেছিস! ছুঁস না আমায়।”
বিট্টু তাকিয়েছিল অবাক হয়ে ওর দিকে।
সমন্বিতা চলে গিয়েছিল জায়গাটা ছেড়ে ঝড়ের মতন।
বিট্টুর মুখটা ভেসে আসছিল চোখের উপর—একটু আগে ঈশিতার সঙ্গে কোথাও যাচ্ছিল ও, দেখে ফেলেছিল সমন্বিতা। মুখে একগাল হাসি মেখে।
অনেক অনেক বই পড়া গেলে, যদি সব বই একদিনে পড়ে নেওয়া যেত। সব জ্ঞান আহরণ করে নেওয়া যেত একদিনে। সব হাসি একদিনে হাসতে পারতাম, সব ভয় একদিনে পেয়ে নিতাম। যদি সব প্রেম করে নেওয়া যেত একদিনে—ভেবেছিল সমন্বিতা, এই মুহূর্ত মুহূর্ত কষ্ট পেতে হত না। সব কিছু একটি মুহূর্তে লুটিয়ে পুটিয়ে উপভোগ করে নিয়ে শেষ হয়ে যেতাম সেই মুহূর্তেই। দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, আফশোষ, রিগ্রেট...কিচ্ছুটি থাকত না বেশ—বুঝিয়ে বলা মুশকিল, সমন্বিতার মনে আছে ওর ছোটবেলার কথা। যখন মা গায়ে বেশ করে তেল মাখিয়ে দিত হোলির দিন। বলত, “বাঁদুরে রঙ দিতে দিবি না কাউকে।”
আর বাবা বলত, “আমার মেয়ের গায়ে বাঁদুরে রঙ দেবে কার সাহস অ্যাঁ?”
আর মা বাবা মুখ টিপে হাসত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে।
সেই মুহূর্তটাতে বেঁচে থাকতে চায় সমন্বিতা। দোল এলে ওই একটি মুহূর্তে বাঁচে ও বারে বারে।
তখনও মা-বাবা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে পারত না চেঁচিয়ে।
তখনও, খুব সুস্থ হয়তো ছিল না ওদের সম্পর্কটা, কিন্তু দিনের পর দিন, মুহূর্তের পর মুহূর্ত জমে ওঠা ক্ষোভ এমন বিস্ফোরক হয়ে ওঠেনি।
সমন্বিতা যদি শুধু মুহূর্তে বাঁচতে পারত! একটা মুহূর্তে বুক খালি করে চেঁচিয়ে বলে দিত মা বাবাকে, কতটা ঘৃণা করে ওদের, কতটা ভালবাসে আর।
বিট্টুকে বলে দিত, “এইমুহূর্তের ভালবাসাটা সত্যি আমার। এটাকে ভালবাস। ডিস্যাপয়েন্টেড হোস না এই ভালবাসার প্রতি।”
বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত বিট্টুর। আঁচড়ে কামড়ে ওর এইমুহূর্তের সব ব্যথাগুলোকে বুকে নিয়ে ভালবাসতে পারত ওকে।
“শুনেছিস? ওইদিকে কার নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে একটা বাজে? বাঁচবে না।” সমন্বিতা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার ধারে তার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে গল্প করছিল মেয়েদুটো।
সমন্বিতা তাকিয়ে ছিল সামনের দিকে। হাওয়ায় দখিনা লেগেছে। তবু কাঁপুনি লাগছে মাঝে মাঝে। এক পা এক পা করে এগোচ্ছিল সমন্বিতা।
অন্যমনস্ক ছিল ও।
ভাবছিল।
অন্যমনস্কভাবে রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ক্ষতি কী?
ধরো, একটা বড় গাড়ি এল। কিম্বা একটা বাসই যদি হঠাৎ এসে পড়ে সামনে। এক ধাক্কা মারে সমন্বিতাকে।
সমন্বিতা ফুরিয়ে যাবে মুহূর্তের মধ্যে।
বসন্তের ফুরফুরে হাওয়া...একটু ঠান্ডা একটু গরম, এসে ছুঁয়ে যাবে ওকে। ওর ঠান্ডা শরীর মন। ওর উদ্ভ্রান্ত জীবন। ওর স্নেহ ভালবাসা, ওর প্রেম—মুহূর্তে পরিণতি পাবে সব। সব...
খুব সহজেই হতে পারে সেটা। দু একদিন একটু কান্নাকাটি করবে কয়েকজন। কিন্তু—কিন্তু, তারপর—শূন্যতার রেশটুকুও আর থাকবে না কারো মনে...
মা-বাবার অপরাধবোধ হবে, ভাববে ওদেরই জন্য—
অবশ্যই আসলে এরকম কিছু করবে না সমন্বিতা। কিন্তু, যদি করা যেত, যদি ফুরিয়ে যাওয়া—
এক হেঁচকা টান পড়েছিল হাতে। কবজি ধরে এক টানে সমন্বিতাকে রাস্তার মধ্যিখান থেকে সরিয়ে নিয়েছিল কে যেন। গাড়িটা হুস্ করে বেরিয়ে গিয়েছিল সামনে থেকে। আরেকটু হলেই—
“বেশি ন্যাকামি হচ্ছে? অ্যাঁ? ন্যাকামি?” দূর থেকে কানে এসেছিল গলাটা যেন। বিট্টুর গলা। কাঁধ ধরে ঝাঁকানি দিয়েছিল কে। “যথেষ্ট হয়েছে! চল! চল এখন।” তারপরে আশেপাশে জমে যাওয়া ভিড়কে লক্ষ করে, দাঁত খিঁচিয়ে, “দেখার কিছু নেই ভাইসকল। কেটে পড়ো।”
টানতে টানতে সমন্বিতাকে নিয়ে চলেছিল কোথায়, সিঁড়ি পেরিয়ে, করিডর পেরিয়ে, কোণের দিকের ঘরে।
অব্যবহৃত ফেলে রাখা ঘর। ওদের ঘর।
“বিট্টু!” সমন্বিতা বলেছিল, “বিট্টু! বিট্টু!” আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছিলাম না আমি। জাস্ট— ভয় পাসনা। বলবে ভাবছিল। বলা হচ্ছিল না। শোন, আমি না, ভালবাসি তোকে, বলবে।
“চুপ! একদম চুপ!” বলেছিল বিট্টু, “একদম চুপ করে থাকবি!”
“বিট্টু! বিট্টু!”
ঘরে ঢুকে সমন্বিতাকে বিট্টু চেপে ধরেছিল দেওয়ালের উপর।
“কী ভাবছিলিস তুই? অ্যাঁ? কী? একা তোর জীবনে দুঃখ হয়েছে? আর কারো মা বাবার ডিভোর্স হয়নি কখনো? আমাকে—আমায়—ওটা কী হচ্ছিল, রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে?” বিট্টু হাঁফাচ্ছিল, “আমি—”
সমন্বিতা চুমু দিয়েছিল ওকে তখন, বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। “বিট্টু! বিট্টু!”
বিট্টুর ছোট ছোট করে ছাঁটা চুলে আঙুল গুঁজেছিল। খুঁজেছিল কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টায়।
বিট্টুর ঠোঁটে লেগেছিল সিগারেটের তিক্ত স্বাদ আর গন্ধ—
তারপর—
তারপর...
সমন্বিতা তো জানত না ওর নগ্নতা এতটা চায় বিট্টুকে। ওর গলায় আর বুকে বিট্টুর দাঁতের কামড় আর ওর পিঠে আর কোমরে বিট্টুর নখের আঁচড় এতটা কাম্য ছিল ওর তা তো আগে কখনো জানতে পারেনি ও!
খানিকক্ষণ পরে সমন্বিতা বলেছিল, “আর আসিস না এখানে কখনো প্লিজ বিট্টু! আর কথা বলিস না কখনো আমার সঙ্গে।”
না জ্বালানো সিগারেটটাকে ঠোঁটের প্রান্তে ঝুলিয়ে রেখে বিট্টু বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে।
মাথার উপরে ক্লাসরুমের সিলিং ফ্যানগুলো বহু কষ্টে ঘুরছিল ভারী শরীর নিয়ে। তাদের গম্ভীর ঘর্ ঘর্ আওয়াজের মধ্যে বিট্টু হয়তো শুনতে পায়নি সমন্বিতার কথা।
জানলার পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের সবুজে লালের ছোঁয়া লেগেছে। সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়েই নিজের অবিন্যস্ত টপ পার স্কার্টকে গুছিয়ে নিয়েছিল সমন্বিতা সযত্নে। চোখের একফোঁটা জলকে মুছে নিয়েছিল গড়িয়ে পড়ার আগেই। আত্মস্থ হয়ে ভেবেছিল মনে মনে, এই আমাদের চাওয়া-পাওয়ারা এক মুহূর্তে একটি বিন্দুতে মিলিত হলেই, তারপর থেকে আসে কেবল প্রবল রিক্ততা। অতৃপ্তি আর ডিস্যাপয়েন্টমেন্ট। গল্পের ক্লাইম্যাক্সের পর আর গল্পকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া বোকামি। নায়ক-নায়িকার মিলনেই পরিণতি গল্পের। সেখানেই দাঁড়ি টানলেই চমৎকার অণুগল্প হয় একটা।
ওর মা-বাবার কথা মনে পড়েছিল ওর।
~~
বাবা বদলি হয়ে চলে গেছে। আগে থেকেই অ্যাপ্লিকেশন করে রেখেছিল নাকি। ফ্ল্যাটে মায়ের সঙ্গে রয়ে গেছে সমন্বিতা।
একবার মনস্থির করার পরে, মা-বাবার বিচ্ছেদের বাকি পথটুকু খুব সহজই ছিল।
“নিজের যত্ন নিস।” বলেছিল বাবা, “তোর মায়েরও—”, একটু লজ্জা পেয়েই চুপ করে গেছিল যেন তারপরে, আড়চোখে দু একবার তাকিয়েছিল সমন্বিতার মুখের দিকে। তারপর জোর করেই দ্বিধাটুকু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিল, “হয়তো অদ্ভুত শোনাবে কথাটা, আমার মুখে। তবু, যত্ন নিস মায়ের। সারাটা জীবন পরস্পরকে না বুঝেই কাটিয়ে দিলাম আমরা। চেষ্টা যে করিনি একেবারেই, তা নয়। কিন্তু মিট করতে পারিনি কখনো, এক বিন্দুতে। ধরতে পারিনি। ফস্কে গেছে বারবার। মাকে দেখিস। রাগ করে থাকিস না। তুই—তোকে আমরা দুজনেই ভালবেসেছি আমাদের সাধ্যমত।”
সমন্বিতা হেসেছিল। “জানি বাবা। তুমিও—যত্ন নিও নিজের।”
খালি খালি হয়ে গেছে বাড়িটা। সমন্বিতা মিউজিক সিস্টেমে জোরে জোরে গান চালিয়ে শব্দ সৃষ্টি করছিল। জোরালো শব্দ ওর পছন্দ ছিল না। কিন্তু, কখন যেন জোরালো শব্দে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল ও, নিজেই বোঝেনি এতদিন।
পছন্দ না হলেও অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া—এরকম বিড়ম্বনাও মানুষের জীবনে ঘটে। পছন্দের জিনিষের সঙ্গে কিছুতেই অভ্যস্ত না হওয়া—তেমনও তো ঘটে মানুষের জীবনে।
বিট্টুর সঙ্গে দেখা হয়নি আর তার পর থেকে।
সত্যিই ও আর আসেনি ওদের সেই গোপন ডেরায়। সমন্বিতার এলাকায়। সমন্বিতার ডিপার্টমেন্টে।
আসবে না। সেদিন সমন্বিতা যেমন দাপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওর বুকে—নিশ্চয়ই বিট্টুর বুঝতে বাকি নেই, কাকে ভালবেসেছে ও।
এখন বিট্টু পালাবে ওর কাছ থেকে।
ফিলোফোবিয়া বলে রোগ আছে একটা।
তাই—সমন্বিতা আর বিট্টুর প্রেম কখনো কাহিনী হতে পারে না।
আচ্ছা? কোনও প্রেমই কি কাহিনী হয়? প্রেম কি বিনি সুতোয় গাঁথা কয়েকটা মুহূর্ত নয় শুধু?
~~
আজ দোলপূর্ণিমা।
সমন্বিতা বসেছিল ঘরের মধ্যে।
রঙের উৎসব পছন্দ নয় ওর। কোনওদিনই নয়। হয়তো সেই ছোট্টবেলার দু একবছর বাদে।
শরদিন্দু পড়তে পড়তে বসন্তোৎসবের উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার ইচ্ছা অবশ্য হয়েছে মাঝে মাঝে। কিন্তু—সে অন্যরকম আনন্দ।
এই দোল নয়।
আর এবছর তো নয়ই।
এবছর, সমন্বিতা রূপকথার রাজ্যে পক্ষীরাজে চড়ে ঘুরে বেড়াতে চায়। জয় করতে চায় রাজ্যের পর রাজ্য। দেশের পর দেশ। সব দেশে আগুন লাগিয়ে দিয়ে, সব জ্বালিয়ে দিয়ে ছারখার করে দেবে সব। তারপর আসবে শান্তি।
এবছর, একলাটি বসে জগদীশ সিংহের গজল শুনতে চায় ও।
তাই, সদর দরজার বেলের শব্দে সন্দিগ্ধ বিরক্ত মুখভঙ্গি করেছিল সমন্বিতা। মা আজই গেছে মাসির বাড়ি।
আর দরজা খুলে চমকে উঠে দেখেছিল দাঁড়িয়ে আছে বিট্টু।
“কী চাস?”
বিট্টু জ্বলন্ত সিগারেটটাকে মাটিতে ফেলে পায়ের চটিতে ডলেছিল বেশ করে।
পরনে পাঞ্জাবী ওর। গালে না কামানো দাড়ি। ঠিক এইভাবে, এই সাজে আগে কখনো সমন্বিতা দেখেনি ওকে। সেই সেদিনের পর থেকেও দেখেনি বিট্টুকে। একটা ঢোঁক গিলেছিল ও।
মুখ তুলে হেসেছিল বিট্টু, “সিরিয়াসলি ভেবেছিলি নাকি যে আর কখনো দেখা করব না তোর সাথে? আর কথা হবে না?” তারপর ওর হাসি আলগা হয়েছিল একটু, চিকচিক করেছিল চোখ, “তোকে চাই।”
“কী যা-তা!” সমন্বিতার বুক ধুকপুক করে উঠেছিল, “তোর গার্লফ্রেন্ডের কী হল?” তারপর, নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, “এই হোলির দিন সকালবেলায়...চ্যাংড়ামো মারতে এসেছিস? মা আছে বাড়িতে। পালা।”
“গার্লফ্রেন্ড নেই আমার।” বিট্টু বলেছিল বিড়বিড় করে, তারপর হাঁক পেড়েছিল, “কই কাকীমা? আসুন না। একটু প্রণাম করি, হোলির দিন।”
সমন্বিতা ভুরু কুঁচকেছিল, “ঝামেলা করিস না বিট্টু। পালা।”
“উঁহু! আগে তোর সঙ্গে বোঝাপড়া আছে।”
“আমার কোনও বোঝাপড়া নেই তোর সঙ্গে। কোনও কথা নেই।” কেন যেন সমন্বিতার গলা শুকিয়ে আসতে চাইছিল। বিট্টুর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিতে গিয়েছিল যখন, দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছিল ও।
“বাড়াবাড়ি করিস না সমু। সিরিয়াসলি কথা আছে।”
“তাই বলে তুই দরজা ঠেলে ঢুকে পড়বি বাড়িতে? হামলা করবি? হোলির দিনে! আমি একা আছি বাড়িতে!”
“একা থাকলেই তো ভাল! একা থাকাই সুবিধা আমার।” বলেছিল বিট্টু, “তোর ঘরে চল।”
তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করেছিল নিজেই।
“পছন্দ করার মত কিছুই নেই আমার, তুই জানিস—” বলেছিল বিট্টু, “সেদিন পাখির মত কাঁপছিলি তুই, আমার হাতের বেড়ে, ওরকমটা আমার সঙ্গে আগে কখনো হয়নি—ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারছি না। কিন্তু ভোলা মুশকিল হয়েছে।”
“ভুল ওটা, মুহূর্তের দুর্বলতায়—” বলতে গিয়েছিল সমন্বিতা। বিট্টু শোনেনি। বলে চলেছিল, “আমি নিজেকে পছন্দ করি না জানিস? আমার মা-বাবা পর্যন্ত ভালবাসতে পারেনি আমাকে। আমি নিজেও—” বিট্টু মুখের উপর হাতের তালু ঘষে নিয়েছিল একবার, “কাউকে কষ্ট দেওয়া কিছুই নয় আমার কাছে। আই ক্যান হার্ট আদারস্ উইদাউট এনি রিগ্রেট। নিজেই নিজের আইডিয়াটাকে ঘেন্না হয় আমার।” হেসেছিল ও। “এমন ওয়ার্থলেস আমার প্রেমে পড়লি কী করে?”
“তুই—” বলতে গেছিল সমন্বিতা। কী বলবে ভেবে দেখেনি। তাই থমকে গেছিল কথা শুরু করেও।
“আমি জানি প্রথম থেকেই, তোর ক্রাশ কে।”
সমন্বিতা চোখ তুলে তাকাতে পারেনি ওর দিকে। জানবেই তো! বোকা তো আর নয় বিট্টু!
বিট্টু বলেছিল, “যে আমিটার প্রেমে পড়েছিস, সেটাকে চেনা আমায়। চেনাবি? যদি আমিও নিজের সেই কাল্পনিক রূপটার প্রেমে পড়তে পারি। নিজেকে অপছন্দ করতে থাকা টায়ারিং।”
হাত বাড়িয়ে আরো ঘেঁটে দিয়েছিল সমন্বিতার এলোমেলো চুলগুলোকে, “গ্যারান্টি নেই পারবই। কিন্তু—চান্স নিতে চাস?”
চান্স—সমন্বিতা ভেবেছিল, সমস্ত জীবনটাই তো প্রতি মুহূর্তে এক একটি চান্স!
চোখ তুলে বলেছিল, “হুম্।”
বাইরে হঠাৎ আকাশ ফাটানো চিৎকার শোনা গিয়েছিল, “হোলি হ্যায়!”
~~
বর্ষা নেমে গেছে।
সকালেই বাবার ফোন এসেছিল। সংহিতা আন্টিকে বিয়ে করছে বাবা। বলেছিল, “দেখা যাক—তুই...তোর আপত্তি নেই তো?”
“ধুর! কী যে বলো!” হেসেছিল সমন্বিতা।
“তোর মা?”
“কী? বিয়ে? না, এখনও তো আমায় বলেনি কিছু। তবে—কেন দেরি করছে জানি না। নির্মাল্য কাকু তো বহুদিনই অপেক্ষায়—”
“হুম্! আচ্ছা, জানিয়ে দিস তোর মাকে।”
“হুম্!” বলেছিল সমন্বিতা, “কংগ্র্যাচুলেশনস্!”
এ কে বলেছিলেন, “কী রে, পরের সংখ্যার জন্য লেখা?”
সমন্বিতা বলেছিল, “লিখব স্যার!”
বিট্টু বলেছিল, “তোর যুব সাহিত্য অ্যাওয়ার্ড আটকায় কে!”
“তুই! সত্যিই পাল্টালি না তুই। একই রকমের ছোটলোক—” বলেছিল সমন্বিতা ভুরু কুঁচকে।
“কে যেন বলেছিল যে আমার পাল্টানোর দরকার নেই? এমনিতেই আমি অসাধারণ। অ্যাঁ?” বিট্টু ভুরু নাচিয়েছিল।
“মোটেও এরকম কিছু বলিনি আমি!”
বিট্টু হেসেছিল। “কী নিয়ে গল্প লিখবি?”
“রঙ নিয়ে।”
“অ্যাঁ? সেকি রে? এই বর্ষাকালে?”
সমন্বিতা হেসেছিল তখন। গুনগুন করে গান গেয়েছিল, “রাঙিয়ে দিয়ে যাও।”