|| ১০ ||
শনিবার রাত্তিরে বিক্রমাদিত্য হোটেলে খেতে গিয়ে বিকাশ একটু অবাক হলেন। রোজ যে বেয়ারাটি ওনার জন্যে রোটি-সব্জি-আচার-কড়ী-পাঁপড় নিয়ে আসে সে আজ এলো খালি হাতে, তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে।
কাছে এসে নীচু গলায় বললো—আপকো উনলোগ বুলা রহে।
—কৌন লোগ?
—মালিক লোগ!
ওর ইশারা অনুযায়ী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন কোণের ওই বিশিষ্ট টেবিল থেকে হাত নেড়ে ইশারা করছেন রমেশ বহল।
আর বেশ হাসি হাসি মুখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে ডোডেজা ও তার জনাকয়েক সাঙ্গোপাঙ্গ।
বিকাশ মনে মনে ভাবলেন—কী আপদ! কায়লা? ফালতু কা লফড়া!
তারপর ধীরপায়ে ওদের টেবিলের কাছে দাঁড়াতেই রমেশ বল্লেন—আংকল! আমরা, মানে এই হোটেলের পেট্রনরা ঠিক করেছি আপনার রাত্তিরের খাওয়াটা ফ্রি করে দেব।
—কেন? ফ্রি কেন?
—কাকাজী, আপনি আমাদের সম্মানিত ক্লায়েন্ট। গত দু'বছর ধরে নিয়মিত আসেন। অন্য কোথাও যান না। বুজুর্গ আদমী। কোন লফড়া নেই, কোন হল্লা-গুল্লা নেই, দারু-আরু কা চক্কর নহীঁ, না কোঈ লফড়া! কোন বেয়ারাকে গাল-মন্দ করেন নি। ম্যানেজারের কাছে কোন কমপ্লেন করেন নি।
—- ভালো লোক আরো আছে। আমাকেই কেন? আর ফ্রি তে আমি খাই না। আমাকে সম্মান করলে ফ্রি-তে খাওয়ানোর বাত ছোড় দীজিয়ে।
এবার মুখ খুললেন ডোডেজা।
—আংকল! বাত আউর ভী হ্যায়। আমাদের বিছড়ে হুয়ে বসের সম্মানে আমরা একজন ক্লায়েন্টকে আজীবন ফ্রি এন্টারটেইন করতে চাই। আপনি বুজুর্গবার, তায় বসের অন্তিমদিনে আপনি আর আমরা তো একসঙ্গেই ছিলাম।
ইসীলিয়ে আপকো চুনা গয়া।
কিন্তু বিকাশ আস্তে আস্তে দুদিকে মাথা নাড়েন।
বহল বললেন—ঠিক আংকল! কোঈ জবরদস্তি নহীঁ। আপ পহলে জ্যায়সা হী খানা খায়েঙ্গে। পর কাল ইতওয়ার কী রাত শরদ পূর্ণিমা হ্যায়। হম আপ একসাথ খানা খায়েঙ্গে, ইহাঁ। আপকো বসকী তেরহী মেঁ বুলানা থা, হমেঁ চুক হো গয়া থা। পর কল কী প্রোগ্রাম কে লিয়ে আপ মান জাঈয়ে। বসকী আত্মা কো শান্তি মিলেগী।
রোববার রাত্তিরে খাওয়াটা ভালই হল। কিন্তু বিকাশ অল্পই খেলেন। ওদের অনুরোধ-উপরোধে সবই একটু একটু ছুঁলেন।
তারপর রমেশ বহল বল্লেন—চলুন, আংকল! আপনাকে আপনার বাড়ির কাছে রাস্তার ওপর নামিয়ে দেব। আরে আমি তো আজকাল বসের পুরনো বাড়ির দোতলায় থাকি। আপনার গলি তো পথেই পড়ে। আমার কোন অসুবিধা হবে না।
এবার বিকাশ আর কথা বাড়ালেন না। পরিচয় অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। তাই কালো ফোলিও ব্যাগটি হতে নিয়ে বহলের পাশে বসলেন।
গাড়ি স্টার্ট হওয়ার পর রমেশ সম্ভবত: বাড়িতে একটি ফোন করলেন। —আর কুড়ি মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাব।
গাড়ি চলছে। রমেশ আজ বিশেষ ড্রিংক করেন নি। গল্প শুরু করলেন।
—আংকল, ইহাঁ আপকে ঘর মেঁ কোঈ নহী হ্যায় ক্যা?
—ছিল। সবই ছিল। ছেলে মুম্বাইতে রেল দুর্ঘটনায় মারা যায়। তার দু'বছর পর ছেলের মা, ক্যানসারে। এখন আমি একা।
রমেশ মুখ দিয়ে চুক চুক আওয়াজ করে বললেন—সরি আংকল! আপনাকে এইসব কথা মনে করিয়ে তকলিফ দেয়ার জন্যে।
ভগবান কেন যে ভাল লোকদের বেশি কষ্ট দেন! প্রভূ কী লীলা সমঝনা—। আরে, আপনার পাড়া তো পেরিয়ে গেছে। ব্যাক করবো?
—না, না! আমাকে এই মাঠের পাশে নামিয়ে দিন। আমি হেঁটে চলে যাবো। আমার হাঁটতে ভালো লাগে।
—ঠিক হ্যায়, আংকল! আমারও হাঁটতে ভাল লাগে। আমারও বাড়ি বেশি দূর নয়। আমিও আজ হেঁটেই যাব।
নতুন ড্রাইভার মৃদু প্রতিবাদ করতেই রমেশের মুখ দিয়ে কিছু চোস্ত পাঞ্জাবী গালি বেরিয়ে এল। ড্রাইভার আর কথা না বাড়িয়ে সোজা স্টার্ট নিয়ে বেরিয়ে গেল।
বড় অশ্বত্থ গাছটার নীচে দুজনে বিদায় নিলেন।
—ওকে, আংকল! বায়! এবার তো আমরা উল্টো দিকে যাব। কাল রাত্তিরে আবার দেখা হবে।
বিকাশ মাথা নেড়ে পেছন ফিরে কালো ব্যাগটির জিপ টানলেন।
কিন্তু জিপ পুরো খুলে যাওয়ার আগেই গাছের ছায়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে তিন ছায়ামূর্তি। দুজনের হাতে উদ্যত রিভলবার।
—ব্যাগটা ফেলে দিন। আর হাত মাথার ওপর!
কম্যান্ডিং গলার স্বরটি মি: পটেরিয়ার। তৃতীয় ব্যক্তিটি সিভিল লাইনস্ থানার এ এস আই। হতভম্ব বিকাশের হাত থেকে ব্যাগ মাটিতে পড়তেই ঝাঁপিয়ে তুলে নিয়ে পটেরিয়ার হাতে তুলে দিয়েছে, আর মুচড়ে ধরেছে বিকাশের হাত। বিকাশ কঁকিয়ে উঠলেন।
—ইয়ে ক্যা হো রহাঁ হ্যায়? আপ সব কৌন?
কেউ উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করলেন না। সবার চোখ পটেরিয়ার হাতে আসা কালো ব্যাগটির দিকে।
ব্যাগ থেকে এক এক করে বেরুলো ব্যাংকের পাস বুক। পোস্টাপিসের পাস বুক। রাহুল সাংকৃত্যায়নের "দর্শন- দিগ্দর্শন''। আর একটি ছোট পানের ডিবে।
বিমুঢ় পটেরিয়া খালি বল্লেন—আপনি পান খান? কবে থেকে?
—ইদানীং ধরেছি। দাঁতের ডাক্তারের পরামর্শে। ক্যালসিয়ামের জন্যে।
রায়পুরের এস পি অফিস, বেলা বারোটা। চশমা চোখে ফর্সা হ্যান্ডসাম এস পি মি: ধাওলিয়া গদি-আঁটা চেয়ারে বসে সিভিল লাইনস্ থানার টি আইয়ের থেকে ইদানীং কালে পুলিশবিভাগের অপদস্থ হওয়ার সবচেয়ে রসালো গল্পটি শুনছেন আর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন।
—না:, দেখলেন তো! পটেরিয়াকে সাসপেন্ড না করে করলো আমার এ এস আই কে! কত্তাদের একচোখোমিটা দেখুন!
কারণটা কী? না এ এস আই যে ওই বুড়োর হাত মুচড়ে ধরেছিল, মানে গায়ে হাত দিয়েছিল! আরে পটেরিয়া যে বুড়োকে পিস্তল দেখিয়েছিল, তার বেলা? ও গরীব বেচারা তো পটেরিয়া সাবকা আদেশ পালন হী কর রহা থা!
—গরীব কী লুগাই, জগত কী ভৌজাই!
(গরীবের বৌ, সক্কলের বৌদি!)
—আরে আসল খিলাড়ি হল ওই ব্যাটা তেঁতুল, ওই পার্থসারথি। নিজের চামচাটাকে ঠিক বাঁচিয়ে নিয়ে গেল।
গত মাসের মিটিংয়ে পার্থসারথি যে তেতো কমেন্টটি করেছিলেন সেটা আজও ধাওলিয়া ভুলতে পারেন নি।
—যাকগে, মরুকগে। তারপর কী হল, সেটা বল! বড়সায়েবদের ব্যাপারই আলাদা! কেউ ক্রাইসিস এর সময় কবিসম্মেলনে দোহারকি দেবেন, কেউ মাসতুতো বোনের পিসতুতো ননদের আইবুড়ো ভাতে গিন্নিকে নিয়ে যাবেন, তাতে কোন দোষ নেই! আর আমাদের বাড়িতে ডেলিভারি হলেও—।
—যা বলেছেন স্যার! সে রাত্তিরে তো হতভম্ব পটেরিয়া গাড়িতে করে ভাউকে বাড়ি অব্দি ছেড়ে এল। বল্লো—ভুল হয়ে গেছে। আর ইশারা করলো এনিয়ে আর কিছু না করতে! কিন্তু নতুন বেরুনো "নঈ দুনিয়া'' পত্রিকার সিটি রিপোর্টার ভেতরের পাতায় কালকে বের করেছে "আসলী খুনীকো পকড়নে মেঁ নাকাম পুলিশ অব নির্দোষ বুজুর্গবার কো এনকাউন্টার করনে কী ফিরাক মেঁ''। এই দেখুন কাটিং!
—কই দেখি! কিন্তু ওই বুড়ো ভাউয়ের স্টেটমেন্ট কই?
—সেটাই তো আশ্চর্য্যের! বিকাশভাউ রিপোর্টারের উৎসাহে ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়েছে। বলেছে -পুলিশও মানুষ। ওদের জেনুইন মিস্টেক হয়েছে। আমার কোন শিকায়ৎ নেই। আমি মানবাধিকার বা কোন অধিকারে যেতে চাইনে!
—তারপর!
—তারপর শুনেছি ওই ‘এভার প্রেগন্যান্ট, নেভার ডেলিভারড্' পার্থসারথি নিজে ভাউয়ের বাড়ি গেসলো।
—সে তো যাবেই! আসলে ওই চুতিয়া প্ল্যানটা তো ওরই! বেশ হয়েছে, সি এম এর কাছে কড়কানি খেয়েছে। বড় বড় কতা! হল তো?
—"চৌবেজি গয়ে থে ছব্বেজি বননে, লৌট আয়ে দুবেজি বনকর''।
(চার গিয়েছিল ছয় হতে, ফিরে এলো দুই হয়ে!)
—এটা ভাল বলেছো তো! কিন্তু পার্থসারথি আর বিকাশভাউয়ের মধ্যে কি বাক্যালাপ হল কিছু জানতে পারলে?
—না স্যার! আর বাক্যালাপ কী হবে, বারবার সরি বলা ছাড়া? তবে ব্যাটা ঘন্টাখানেক ওখানে বসে ছিল।
—এক ঘন্টা! পক্কা মালুম? জরা পতা লাগাও।
ভর দুপুরে পার্থসারথি আর পটেরিয়া এসেছেন বিকাশ রঞ্জনেকরের বাড়িতে। ওঁরা সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্যে বিশেষ অনুতপ্ত। ওনাদের খাটে আর একটি পুরনো কাঠের চেয়ারে বসিয়ে বিকাশ গেলেন ছাদে। কী ব্যাপার! না, কলের জল আসার সময় হয়েছে। ওপরে গিয়ে জলের ট্যাংকের ভালভ্ খুলে দিতে হবে। যেহেতু ছাদের চিলেকোঠাসম ঘরে বিকাশ একা থাকেন, ফলে দিনে দুবার ভালভ্ খোলা আর বন্ধ করার অঘোষিত দায়িত্ব ওনার কাঁধে এসে পড়েছে, প্রত্যেকবার আউটলেটের ভালভ্ বন্ধ করে ইনলেটের ভালভ্ খুলতে হয়। পটেরিয়া কখন ছাদে পৌঁছেচেন বিকাশ টের পান নি। লোহার ঢাকনা খুলে একটি পেনসিল টর্চ দিয়ে উনি উবু হয়ে কিছু দেখছিলেন, সম্বিৎ ফিরলো ঘাড়ের কাছে পটেরিয়ার কথায়।
—কী দেখছেন ভাউ, আমি একটু দেখতে পারি!
—কেন নয়? দেখছি জলের লেভেল। আপনিও দেখুন!
এবার বিকাশ হেসে এগিয়ে দিলেন ওই পেনসিল টর্চ।
—দেখে নিন কোন অস্ত্র লুকনো আছে কি না! আমি যদি অপরাধী হই এমন অবভিয়াস জায়গায় লুকিয়ে রাখবো কেন? আপনাদের সিভিল লাইনস্ থানার পুলিশ আগেই দেখে গেছে। তবু আপনিও দেখুন।
পটেরিয়ার কাটাঘায়ে নুনের ছিটে পড়লো।
—আরে না না, আমি এমনিই জিগ্যেস করছিলাম। আসলে আমার বস্ অনেকক্ষণ বসে আছেন কি না! আরো দু'এক জায়গায় যাওয়ার আছে। আপনার কাজ হয়ে গেলে চলে আসুন।
খাটের ওপর বসে পা দোলাচ্ছেন পটেরিয়া। একটু অস্থির অস্থির ভাব। পার্থসারথি বসেছেন টেবিলের সামনে চেয়ারটিতে। আর বিকাশভাউ গেছেন ঘুপচি রান্নাঘরে লাল চা বানিয়ে আনতে।
পটেরিয়া হটাৎ উত্তেজিত। একদৃষ্টে দেখছেন কিঞ্চিৎ অগোছালো ঘরের চারদিক। আধময়লা মশারিটি পেছনের দিকে গুটিয়ে রাখা।
সামনের দেয়ালে একটি পেরেক থেকে ঝুলছে মশারির দড়ি টাঙানোর জন্যে টোয়াইন সুতোর তৈরি ফাঁস। কিন্তু চতুর্থ কোণাটি? দেয়ালে কোন পেরেক বা হুক নেই কেন?
আরে! জানলার লোহার শিক থেকে ঝুলছে মশারি টাঙানোর জন্যে ফাঁস বাঁধা দড়ি। কিন্তু এই ভাবে মশারি টাঙানোতে সিমেট্রির অভাব। মশারিটা টাঙানো হলে আয়তক্ষেত্র না হয়ে ট্র্যাপিজিয়ম হয়ে যাবে না? কেন এমনি হবে? অংক নিয়ে স্নাতক হওয়া পটেরিয়ার ব্যাপারটা ভালো লাগছে না।
—স্যার! একটু দেখুন। জানলাটি দেখেছেন? এই জানলাটি খুলছে ওদিকের বিশাল তিনতলা মারোয়াড়ি বাড়ির পেছনের বন্ধ দেয়ালের সরু গলিতে। এখানে সবাই ময়লা ফেলে, অন্য কোন বাড়ির জানলা এদিকে খোলে না। কপাট খুললে সামনে শেঠ বাজোরিয়াদের ছাইরঙা নিশ্ছিদ্র দেয়াল। কাজেই কেউ যদি নীচের কার্ণিশে কোন জিনিস এই জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে সুতো বেঁধে নামিয়ে দেয় তো কেউ দেখতে পাবে না।
—তারপর?
—ধরুন স্যার, মশারির সুতো দিয়ে নামিয়ে দিল। তারপর ব্লেড দিয়ে সুতোটা কেটে দিল!
—তা বেশ, আমরা খুঁজছি একটি স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসেন রিভলবার, বেশ ভারি। পরে দরকার মত তুলবে কী করে? এই প্রশ্নটার উত্তর দাও।
এক যদি ওয়ানস্ ফর অল্ হয়। কিন্তু ওখানে ফেলে রাখাটাও বিপদ। আর যদি ওখান থেকে তুলতে চায়? তাহলে? এদিকটা ভেবেছো?
—ভেবেছি স্যার!
পটেরিয়া এবার কঠিন প্রশ্নের উত্তর জানা ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের মত গর্বিত হাসি হাসেন।
—উত্তর আপনার সামনেই আছে, স্যার!
—আমার সামনে?
—হ্যাঁ স্যার! টেবিলের ওপর জ্যামিতির বই আর নেসফিল্ডের গ্রামারের পাশে আতসকাঁচ আর একটি হর্স শু' ম্যাগনেট দেখুন। সূতোয় ম্যাগনেট বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে ঐ রিভলবারটিকে টেনে তোলা যাবে না?
পটেরিয়া উঠে হর্স শ্যু ম্যাগনেটটি নিয়ে জানলার কাছে গিয়ে শিকের থেকে সুতোর ফাঁস খুলে ম্যাগনেটের গায়ে বাঁধতে লাগলেন।
—"উৎসাহে কী না হয়, কী না হয় চেষ্টায়?''
পটেরিয়া চমকে পেছন ফিরলেন।
দরজায় হাসিমুখে দাঁড়িয়ে বিকাশ, হাতে একটি স্টিলের থালা। তাতে তিনটি ধূমায়িত কাঁচের গ্লাসে লাল চা'।
—মানে?
—এটি একটি পপুলার বাংলা কবিতার লাইন।
হিন্দিতে এর মানে "লগে রহো মুন্নাভাই''। কোলকাতায় চাকরি করার সময় যখন বাংলা শেখার চেষ্টা করতাম তখন বাঙালী বন্ধুরা বলতো। সে যাকগে, আপনার উৎসাহকে দাদ দিতেই হয়! পর আপ ফিজিক্স ক্লাস ঠিকসে নহীঁ কিয়ে ভাইজী!
ম্যাগনেট বাঁধা সুতো দিয়ে কার্নিশ থেকে কিছু টেনে তুলতে গেলে ম্যাগনেটিক ফিল্ড যে আপওয়ার্ড ফোর্স লাগাবে জিনিসটির ভর, মানে mg তার বিপরীতে ডাউনওয়ার্ড ফোর্স দিয়ে তাকে নীচে টানবে। তবু এক্সপেরিমেন্ট করে দেখুন। হাতে নাতে করার মজাই আলাদা।
বেলুন চুপসে যাওয়া মুখ করে জানলার কাছ থেকে ফিরে এলেন পটেরিয়া। তারপর যেন কিছুই হয় নি—এমনি ভাব করে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখা থালার ওপর থেকে একটি কাঁচের গ্লাস তুলে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। কিন্তু সদ্য তৈরি চা' অনুমানের চেয়ে বেশি গরম ছিল।
—না:, থিওরিতে আরো গলদ আছে।
মুখ খুলেছেন পার্থসারথি। ওঁর চোখে একটু দুষ্টুমি ভরা হাসি।
—জানলা থেকে কার্নিশের হাইট? সেটাও ভাবা দরকার। অতক্ষণ ম্যাগনেটিক ফিল্ড অ্যাকটিভ থাকবে? এই সাইজের ম্যাগনেটে?
বিকাশভাউয়ের চোখও হাসছে। কিন্তু গরম চায়ে মুখ পুড়িয়ে পটেরিয়ার মেজাজ একটু তিরিক্ষি।
—আচ্ছা, আপনার সায়েন্সে যখন এত টনটনে জ্ঞান তাহলে অন্য সব ব্যাপারে আপনি এত ব্যাক্ ডেটেড্ কেন?
—মানে?
—এই ধরুন আপনি টোয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরিতে পৌঁছেও মোবাইল রাখেন না। অধিকাংশ সময় পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ান। এটিএম রাখেন না। মাঝে মধ্যে আপনার নামে মানি অর্ডার আসে।
—ওরে বাবা! আপনারা তো আমার ওপর রিসার্চ করে ফেলেছেন। তাহলে শুনুন:
মুম্বাইয়ে একটি রেল দুর্ঘটনায় ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকে আমার স্ত্রী ডিপ্রেসনে ভুগতে থাকেন। ডাক্তারের পরামর্শে ওঁকে ওর বচপন কা জগহ্ এই রায়পুর শহরে নিয়ে আসি। উনি আসলে এখানকার বামন রাও লাখে ওয়ার্ডে জন্মেছিলেন। সাপ্রে স্কুলে পড়েছেন। তারপর ওঁর বাবা ট্রান্সফার হওয়ায় পুণে গিয়ে কলেজে পড়েন। এখানে এসে ওঁর অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল।
কিন্তু দু'বছরের মাথায় ধরা পড়ল ক্যান্সার।
বিকাশ চুপ করলেন। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন জানলার কাছে। সুতোয় বাঁধা ম্যাগনেট তখনও গরাদ থেকে ঝুলছে। খানিকক্ষণ সুতোটা ধরে দোলালেন। তারপর যেন নিজেকেই বলতে থাকলেন।
—শুভদা চলে যাবার পর কিছুই ভাল লাগছিল না। কোলকাতার জোনাল অফিসে পদত্যাগ পত্র পাঠালাম। চলে এলাম এই রায়পুরে, যেখানে শুভদা বড় হয়েছিল, যেখানে শেষ ক'টি বছর কাটিয়েছিল। ওর ইচ্ছে ছিল সেরে উঠে একটা অন্যরকম স্কুল খুলবে, রায়পুর শহরে। কথা দিয়েছিলাম। কিন্তু ওর চিকিৎসায় আমার সারাজীবনের সঞ্চয় প্রায় শেষ। অফিস থেকে ঝড়তি-পড়তি যা পেলাম মহারাষ্ট্র ব্যাংকে রাখলাম। কিছু পোস্ট অফিসে। সুদ যা পাই তাতে একজন বুড়োর খরচা চলে, কিন্তু স্কুল চলে না। তাই টিউশন করি।
কোলকাতা অফিসে সহকর্মীরা মিলে একটি থ্রিফট ফন্ড খুলেছিলাম। তার ডিভিডেন্ড/সুদ সামান্য যা হয় ওখানকার একজন ক্লার্ক আমাকে পাঠিয়ে দেয়। ও সেকেলে লোক। ডিজিটাল ব্যবস্থার চেয়ে মনি অর্ডারে স্বস্তি বোধ করে।
মিনিটখানেক সবাই চুপ।
পটেরিয়া জিভে আর দাঁতে চুক চুক শব্দ করে বল্লেন—আজ তাহলে উঠি?
পার্থসারথি এতক্ষণ টেবিলের ওপর ফেলে রাখা জমা খরচের হিসেব আর এলোমেলো করে রাখা বইপত্তর একটু যেন অলস ভঙ্গিতে দেখছিলেন। এবার হলদে হয়েযাওয়া পুরনো খবরের কাগজের মলাট দেয়া একটি চটি বই হাতে নিয়ে বল্লেন—এই বইটি কি আমি ক'দিনের জন্যে নিয়ে যেতে পারি?
—এ তো বাংলা কবিতার বই, সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের "ছাড়পত্র''! এ নিয়ে আপনি কী করবেন?
—আমার গিন্নি বাঙালী, তায় কবিতার ভক্ত।
বিকাশ একটু অবাক হয়ে পার্থসারথিকে দেখলেন।
—বেশ তো, নিয়ে যান।
ফেরার পথে পটেরিয়া বল্লেন—স্যর, আমরা একচক্ষু হরিণের মত শুধু একদিকেই তাকিয়ে আছি। মানলাম, শোলাংকিকে হত্যার সবচেয়ে বেশি সুযোগ ওই মিটমিটে শয়তান ভাউয়েরই ছিল। কিন্তু আরেকজনের সবচেয়ে স্ট্রং মোটিভ রয়েছে, তার দিকে আমরা নজরই দিচ্ছি না।
—কে সে?
—কেন, অ্যাডভোকেট তিওয়ারির শ্বশুরবাড়ির লোকজন! শ্বশুর মালদার পার্টি, রুলিং পার্টিতেও ভাল হোল্ড। ওর জামাইকে শোলাংকির নির্দেশে শংকর পার্টির ক্যাডাররা ওরই ঘরে ঢুকে কুপিয়ে মারল। ওর মেয়ে বিধবা হল। অনেক চেষ্টা চরিত্র করে ও সবকটাকে জেলে পুরলো। কিন্তু আটমাসের মাথায় ওরা একে একে জামিন নিয়ে বেরিয়ে এল।
আর রায়পুর শহরে বাইরে থেকে সুপারি দিয়ে খল্লাস করা তো নতুন নয়, স্যার!
পার্থসারথি কি একটু অন্যমনস্ক?
—স্যার! ওকে একটু তিওয়ারির শ্বশুরকে কি আমরা একটু কালটিভেট করব না?
—হ্যাঁ, কাল দুপুর একটায়। আমি পি এইচ কিউ থেকে ফেরার পরে।
—সকালে নয়?
—সকালে আমাকে কটা মেসেজ পাঠাতে হবে, আর কোলকাতায় দু-এক জনের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
পটেরিয়া একটু ঠোঁট ওলটালেন।
রিং রোড ধরে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে গাড়ি ঘোরালে ভি আই পি রোডের শুরু। চওড়া মসৃণ পাকা রাস্তা সোজা গিয়েছে মানা এয়ারপোর্ট অব্দি। রাস্তা ফাঁকাই থাকে, শুধু ফ্লাইট ধরতে ব্যস্ত যাত্রীদের গাড়ি গুলো সাঁ সাঁ করে চলে যায়। রাস্তার দুধারে সারি সারি গুলমোহর, স্যুবাবুল ইত্যাদি গাছের ছায়াঘন পরিবেশ। মাঝে মাঝে একটি দুটি ফার্ম হাউস, বড় বড় বিজনেস হাউসের বোর্ড লাগানো।
আর আছে আজকালকার হাই- ভোল্টেজ কিছু যোগগুরু-বাবাজিদের প্রাসাদোপম আশ্রম।
বেলা দুটোর সময় একটি সাদা প্যালেসিয়াল বাড়ির সামনে ইন্টেলিজেন্স বিভাগের মারুতি জিপসী এসে থামলো।
পটেরিয়া এগিয়ে গিয়ে সিকিউরিটির গোর্খা প্রহরীকে আইডেনটিটি কার্ড দেখালেন। আর পার্থসারথি এগিয়ে গিয়ে সোনার বিভ্রম জাগানো হলদে মেটালিক অক্ষরে লেখা ফলকটি পড়তে লাগলেন।
বাড়ির নাম হোয়াইট হাউস। গেট ও দীর্ঘ মোরম ঢালা পথের শেষে সুন্দর বাড়িটি আপাসমস্তক দামী সাদা রঙে মোড়া। হোয়াইট হাউসই বটে!
ডানদিকের ফলকে ক্যালিওগ্রাফিক অক্ষরে লেখা
"সুষমা ত্রিবেদী, অক্ষয় ত্রিবেদী''।
খানিকক্ষণ ইন্টারকমে কথা বলে গার্ড গেট খুলে দিল। সরকারি জিপসী সোজা পাথরকুচি বিছানো পথ ধরে বাড়ির সামনে পোর্টিকোর নীচে দাঁড়াল।
সাদা সার্ট প্যান্ট পরা একজন লোক ওঁদের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বিশাল ড্রইংরুমে বসাল। এল ঠান্ডা জল, আর কোকাকোলা।
পার্থসারথি দেখছিলেন দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো। একটা হুসেনের অর্জুন, মোটা ব্রাশের কাজ। আরেকটায় ভিভান সুন্দরম এর বড় সাইজের তেলরঙের কাজ। জ্বলন্ত বাড়ির থেকে বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো দিশাহীন মেয়েটি। এবার একটু এগুতেই অবনীন্দ্রনাথের সিন্দবাদ আর নন্দলাল বসুর কংকালসার শিব অন্নপূর্ণার দ্বারে।
গলা খাঁকারি শুনে পেছন ফিরে যাকে দেখলেন তার জন্যে এরা বিশেষ প্রস্তুত ছিলেন না।
পাঁচফুটি হাইটের একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক, আদ্দির তৈরি সাদা শার্ট আর পাজামা পরা। ফর্সা মানুষটির হাতে নবগ্রহ আংটি আর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। বেশ বড় বড় দুই চোখে পলক পড়ে না।
—আপনিই শ্রীমান অক্ষয় ত্রিবেদী?
—তাতে আপনার কী?
—আপনার কী মানে? আমরা ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছি। ইনি চীফ, মি: পার্থসারথি। আমি পটেরিয়া। আমরা বিক্রম সোলাংকি কেসটার ব্যাপারে আপনাদের কো-অপারেশন চাই।
—কো-অপারেশন? হা:-হা:-হা:! কো অপারেশনের মানে জানেন আপনারা? "হোয়েন উওম্যান কুউ'জ অ্যান্ড ম্যান অপারেটস্''—এই হল আপনার ছাতার কো-অপারেশন! ডেফিনিশন তো শিখলেন। এবার বলুন কেমনিধারা কো-অপারেশন চাই আপনাদের?
পুলিশ আর শংকর সেনার কো-অপারেশন? না পুলিশ আর মাফিয়ার কো-অপারেশন?
অক্ষয় ত্রিবেদী বিড়বিড় করতে থাকেন।
—হুঁ:, শালে পুলিস কে কুত্তে! পতা নহীঁ ক্যায়সে অন্দর ঘুস গয়ে। হমারে দিন হোতা তো বাহর সে হী খদেড় দেতেঁ। সব বেইমান! সব নেতাও কে ফেকে গয়ে রোটি কে টুকড়োঁ সে পলনেওয়ালে!
পটেরিয়ার কোথায় যেন একটা কিছু ছিঁড়ে যায়। হঠাৎ লাফিয়ে ধরে ফেলেন ত্রিবেদীর কুর্তার কলার।
—তেরী ইয়ে মজাল! তব সে শুন রহা হুঁ তেরি বকর্। মাদর্—!
ঝাঁকাতে থাকেন আর চেঁচান—বোল্, আউর বোলেগা পুলিস কে কুত্তে! আউর কুত্তে বোলেগা?
আচমকা এই অভাবিত হামলায় অক্ষয় হতভম্ব, পলকহীন চোখ দুটো আরও বড়বড়। মুখে বাক্যি নেই। কিন্তু প্যাসেজের থেকে ভেসে এল এক চিৎকার।
—আরে, বড়ে মালিক পর হাত উঠায়া কুত্তে নে। আবে জলদি আ!
নিমেষের মধ্যে হলঘরের দুপাশের দুটি বন্ধ দরজা খুলে যায় আর দৌড়ে ঢোকে জনা পাঁচেক মুশ্কো জোয়ান, দুজনের হাতে লাঠি। কিন্তু ঢুকেই ওরা থমকে যায়।
কারণ টেবিলের ওপাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন পার্থসারথি, হাতে ছোট একটি রিভলবার।
প্রথমেই ধমকালেন পটেরিয়াকে।
—ছোড়ো ইনকো, জলদি! দিমাগ তো ঠিক হ্যায়?
—লেকিন স্যার?
—কোই লেকিন-একিন নেহি। জ্যায়সা বোল রহা হুঁ, অ্যায়সা কিয়া করো।
ইতিমধ্যে দৌড়ে ঘরে এসেছেন আরেকজন। গেঞ্জি গায়ে গলায় সোনার চেন পরনে দামী চপ্পল। অক্ষয়ের সঙ্গে চেহারায় মিল আছে, তবে একটু চাপা রঙ।
—আরে, ইয়ে সব ক্যা হো রহা হ্যায়?
উনি জড়িয়ে ধরলেন অক্ষয়কে।
—ভাইয়া শান্ত হো যাইয়ে, সব ঠিক হো যায়েগা। ম্যাঁয় হুঁ না!
মাপ করবেন সায়েবরা। আমার দাদার মাথা একটু খারাপ; সেই ওনার মেয়ে বিধবা হল তখন থেকেই। আসলে আমাদের জামাই অ্যাডভোকেট তিওয়ারি ওনার জুনিয়র ছিল। ট্যালেন্টেড উকিল। বিয়েটা উনিই ঠিক করেছিলেন।
বিক্রম সোলাংকি যখন জামানতে ছাড়া পেল আর কেসের ডেট পাল্টাতে লাগলো, সাক্ষীরাও কাজেকম্মে শহরের বাইরে, কেউ এই মামলার সঙ্গে আর যুক্ত থাকতে চাইল না, তখন দাদার মাথা পুরোপুরি খারাপ হল। পুলিশ দেখলেই খেপে যান। চিকিৎসা চলছে।
একটু অপেক্ষা করুন, ভাইয়াকে শুইয়ে দিয়ে আমি আসছি।
—চলিয়ে ভাইয়া! আস্থা চ্যানেল মেঁ আপকা সুধাংশু মহারাজকা প্রবচন শুরু হো গয়ে। জলদি চলিয়ে। আপনারা বসুন।
পাইক-বরকন্দাজের দল আবার বন্ধ দরজার পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
উনি ফিরে এসে বল্লেন আমি সঞ্জয় ত্রিপাঠী। দাদা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আমাদের সব কাজকম্ম আমিই দেখি।
আপনারা কী জানতে চাইছেন? বিক্রমের খুনটা কে করেছে? আরে মশাই! ও তো কোনো মহাপুরুষ ছিল না। অনেক দুশমন বানিয়েছিল। আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোকের শেষ এই ভাবেই হয়। কিছু মনে করবেন না, একটু জ্ঞান দিচ্ছি।
আপনারা দেখুন ওর মৃত্যুতে কার কার লাভ, তাহলেই বুঝতে পারবেন।
না মশাই, আমরা কেন মারতে যাবো? আমাদের কী লাভ, বলুন।
ভাইঝির বিধবা হওয়ার বদলা নেয়া? দুর মশাই! ও তো মরে পার পেয়ে গেল। হিন্দুদের একাংশের চোখে ও শহীদ।
আজ ও নেই, তাই বলছি। আমরা ওকে এত সহজে ছাড়তাম না। কাউকে ভাড়াটে আততায়ী লাগিয়ে মেরে ফেলা খুব সহজ কাজ। ওই সুপারি না কি যেন বলে আজকাল!
আমরা চেয়েছিলাম ওকে তিলে তিলে দগ্ধে দগ্ধে মারতে, ওর বিজনেস এম্পায়ার নষ্ট করে দিতে। সব গুড়-গোবর হয়ে গেল।
বেলা ন'টা হবে। বিকাশ রঞ্জনেকর আজ একটু তাড়াতাড়ি স্নান করেছেন। ঘর ভাল করে ঝাঁট দেয়া, তাক টেবিল সব খালি। মোট তিনটে লাগেজ হয়েছে। রান্নাঘরে কিছু পুরনো বাসন, কিছু পুরনো বাতিল জামাকাপড় পড়ে আছে। বাড়ি ভাড়া, বিজলী বিল, জলের ট্যাক্সো উনি চুকিয়ে দিয়েছেন। ট্রানজিস্টর বাজছে, বিকাশ গুনগুন করতে করতে গোছগাছ শেষ করছেন।
পাসবুক রেলের টিকেট সব বারবার করে চেক করে নিলেন।
গতকালই ট্রেনের টিকেট কেটে এনেছেন, মুম্বাই মেলে জেনারেল ডিব্বা। আপন মনে হাসলেন।
তারপর কুলুঙ্গী থেকে ছোটোখাট মাঝবয়সী ব্যক্তিত্বসম্পন্না এক নারীর ছবি বের করে খবরের কাগজে মুড়ে টিনের তোরঙ্গে রাখতে গিয়ে থেমে গেলেন।
ফিস্ফিস্ করে বল্লেন--শুভদা আমাকে মাপ কর, আর পারছি না।
গতকাল একটি মানি অর্ডার এসেছে। ১২০০ টাকা, কোলকাতা থেকে।
তার নীচের অংশে লেখা—Dividend for 2009 remitted. Paid to the Last Woman.
পোস্টম্যানকে রসিদ দস্তখত করে দেয়ার পর বিকাশভাউ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন।
মেসেজের টুকরোটা আবার ভাল করে পড়ে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে পায়খানার প্যানে ফেলে খুব করে জল ঢাললেন।
অত্যন্ত সিম্পল কোডে মেসেজটি লেখা। বিকাশ জানেন যে শেষ বাক্যটির ক্যাপিটালে লেখা প্রত্যেকটি অক্ষর জুড়ে যা হবে -সেটাই মেসেজ। কিন্তু প্রত্যেক শব্দের খালি প্রথম দুটো অক্ষর নিতে হবে।
তাহলে মেসেজটি দাঁড়াল—Pa-La-Wo. অর্থাৎ "পালাও''?
তারপর উনি চা বানিয়ে বসে চুমুক দিতে দিতে ভাবতে লাগলেন। কতক্ষণ সময় আছে? ট্রানজিস্টরে রেডিও পুণেতে বাজছে লতার গলায় মেছুনিদের গান।—"ডোলকারা, মি ডোলকারা--''। আধঘন্টা কাটলো। উনি বেরিয়ে পড়লেন মহারাষ্ট্র ব্যাংকের পাড়ায়। সেখান থেকে রেল স্টেশনের বুকিং কাউন্টার হয়ে বিজলী অফিস, তারপর বাড়িওয়ালার ঘর। উনি বাড়িতে ছিলেন না। ওনার স্ত্রীকে দু'মাসের অগ্রিম ভাড়া দিয়ে বল্লেন—দু'মাসের জন্যে ঘুরতে যাচ্ছি। কয়েকটি বিয়ের তারিখ আছে। চাবিটা রাখুন, ঘরদোর একটু মাঝে মাঝে সাফসুতরো করিয়ে রাখবেন।
এসব পালা গতকালই চুকিয়ে দেয়া গেছে।
আজ বেলা এগারোটায় ট্রেন। ট্রানজিস্টর বাজছে। আরেকবার চা বানিয়ে নিয়ে নেয়ারের খাটে আরাম করে বসে গান শুনতে লাগলেন।
এদিক ওদিক ঘোরাতে ঘোরাতে লেগে গেল কোলকাতা ক'। অতুলপ্রসাদের এই গানটি বিকাশরঞ্জনের চেনা।
"ফুরায়ে এল যে বেলা, সাঙ্গ করি ভবের খেলা, তুমি কর নিঠুর লীলা আমার প্রাণে লাগে ডর।''
আর নয়, সময় এগিয়ে এসেছে, উঠতে হবে। বিকাশ ট্রানজিস্টর বন্ধ করে টেবিলের ওপর রেখে গোটা ঘরটা একবার জরিপ করে নিলেন। তারপর জানলা-দরজা বন্ধ করে ছিটকিনিগুলো লাগাতে লাগলেন। এবার অল্প কটি লাগেজ বের করে তালা লাগিয়ে নীচে নামতে হবে। তারপর একটি অটো রিকশা ধরে দশ মিনিটে রায়পুর স্টেশন।
তালাচাবিটা কোথায়? হ্যাঁ, দেয়ালে একটি পেরেকের থেকে ঝুলছে। বিকাশ তালা খুলে হাতে নিয়ে পেছন ফিরলেন।
কিন্তু দরজায় কারো ছায়া পড়েছে।
জগিং এর পোশাকে কপাট ঠেলে ভেতরে ঢুকেছেন পার্থসারথি। সুইচ্ টিপে জ্বেলে দিয়েছেন ঘরের একমাত্র আলো।
—আরে, আপনি দেখছি বেশ ব্যস্ত। কোথায় ভাবলাম ছুটির দিনে আপনার সঙ্গে একটু গল্প করবো, আপনার হাতের চা খাব আর ঐ বাঙালী কবির বইটিও আপনাকে ফেরৎ দিয়ে যাব, কিন্তু আপনি তো সব গোছগাছ করে কোথাও যাচ্ছেন! কোথায়?
—হ্যাঁ, তা পুণে যেতে হচ্ছে। শালার বাড়ি থেকে খবর এসেছে।
—পুণে না কোলকাতা? টিকিট কোথাকার কেটেছেন ভাউ?
—কোলকাতা কেন? আমার শালা থাকেন পুণেতে।
—ঠিকই বলেছেন, আমারই ভুল। তা আপনার শালার কাছ থেকে জরুরী মেসেজ এল কীভাবে? টেলিগ্রাম এসেছে না কি?
মানে, আপনার তো কোন ফোন নেই, মোবাইলও না। তাই বলছি--টেলিগ্রামটা একবার দেখান না।
গোটা দরজাটা আগলে দাঁড়িয়েছেন পার্থসারথি। বেঁটে খাটো পেট বেরিয়ে থাকা মানুষটা হঠাৎ যেন লম্বা হয়ে গেছেন।
হাসিমুখে বল্লেন—কী হল? দেখান মশাই টেলিগ্রামটা! নাকি কোন দূত এসেছিল খবর দিতে?
গোটা ঘরটা নি:স্তব্ধ। বিকাশ রঞ্জনেকর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন পার্থসারথির দিকে, চোখের পলক পড়ছে না, প্রায় এক মিনিট। এবার বিকাশ চোখ নামালেন, একটু যেন শ্বাস ছাড়লেন। তারপর খুব শান্ত গলায় বল্লেন—ভেতরে আসুন, বসুন।
পার্থসারথি চেয়ারে বসেছেন।
—এবার বলুন, কী বলতে চান।
—বলতে চাই ভাউ, এবার আপনার খেল খতম। ইয়ে বাজি আপনে হারা হ্যায়। আপনার সব পাত্তি শেষ, এখন তুরুপের তাস আমাদের হাতে।
গত সপ্তাহে মুখ্যমন্ত্রী আমাদের তদন্ত শেষ করার জন্যে সাতদিন সময় দিয়েছিলেন, আমরা না পারলে কেস সিবিআইয়ের কাছে যাবে। এখনো দুদিন বাকি। কিন্তু আমার হিসেবে শোলাংকি মার্ডার কেস এবার শেষ। আজ আমি ফাইনাল রিপোর্ট ডিজিকে সাবমিট করবো। কাল উনি মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে জমা দেবেন।
বিকাশ হাসলেন।—- তাই নাকি! আপনাকে অভিনন্দন। তাহলে রায়পুর শহরের কেষ্টুবিষ্টুরা এবার নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোতে পারবেন, কি বলেন? আর আপনার প্রোমোশন, তাই তো!
—যা বলেছেন!
এক, ডেড বডি; দুই, হাতিয়ার; তিন, মোটিভ্।
এই কেসে তো কেবল ডেড বডিই পাওয় গেছে, না হাতিয়ার, না মোটিভ। কোর্টে চালান পুট আপ করবেন কীসের ভিত্তিতে?
—নহী জনাব! ধূপ মেঁ বাল অ্যায়সে হী নহী পকায়া! সব পাওয়া গেছে। হাতিয়ার, মোটিভ—সব।
আসলে আপনারা আমাদের যতটা বোকা বা ইনএফিশিয়েন্ট মনে করেন আমরা কি সত্যিই তাই? গত পনেরো দিন ধরে তিনজন সাসপেক্টের পেছনে লোক লাগানো আছে। আপনাদের প্রতিটি খুঁটিনাটি, চালচলন সবই আমাদের নখদর্পণে।
কাল যখন খবর পেলাম যে আপনি ব্যাংক হয়ে রেলস্টেশনের বুকিং কাউন্টার থেকে টিকিট কেটেছেন তখনই বুঝলান যে অব চিড়িয়া পিঁজরে সে উড়নেওয়ালে।
এবার বলুন, আপনি কোলকাতা যাচ্ছেন কেন?
—আমি কোলকাতাই যাচ্ছি কে বল্লো?
—দূর মশাই! কাল যখন টিকিট কাটছিলেন তখন লাইনে ঠিক দুজনের পেছনে দাঁড়ানো লোকটিই আমার লোক।
ও আপনার বুকিং ক্লার্ককে বলা কথা শুনেছে, আর কাউন্টারের ওপর ডিসপ্লে বোর্ডে আপনার ট্রেনের তারিখ নম্বর সবই দেখেছে।
—বা:, আমি কোলকাতা অফিসে চাকরি করেছি, বন্ধুবান্ধব আছে। যাচ্ছি তো কী হয়েছে? এতে আপনি কী পেলেন? মোটিভ না হাতিয়ার?
রঞ্জনেকরের গলায় বিদ্রূপ।
—তারপর আমি নিজে গেলাম ব্যাংক ম্যানেজারের চেম্বারে, ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড অনুযায়ী প্রপার অর্ডার নিয়ে। দেখলাম সমস্ত অ্যাকাউন্ট থেকে নমিনাল ব্যালান্স রেখে সব টাকাপয়সা তুলে নিয়েছেন।
—বেশ, তার থেকে কী প্রমাণ হল?
—আগে সবটা শুনুন। ম্যানেজারকে বল্লাম আপনার অ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফর্মটা দেখাতে। ইচ্ছে ছিল দেখবো ইনট্রোডাকটরি রেফারেন্স কে দিয়েছে, টাকা কবে কীভাবে এসেছে।
তখন পেলাম কেঁচো খুঁড়তে সাপ।
আপনার অ্যাকাউন্টটি এসেছে কোলকাতা শাখা থেকে ট্রান্সফার হয়ে। তাতে গ্রাহকের নাম ছিল ‘বিকাশরঞ্জন কর'। কিন্তু আপনি নামটা বদলে করলেন
‘বিকাশ রঞ্জনেকর'। সঙ্গে ডকুমেন্ট অ্যাটাচ্ড করেছেন কোলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টের একটি এফিডেভিট।
“আমি বিকাশরঞ্জন কর, পিতা প্রভাসরঞ্জন কর, সাকিন পায়রাডাঙ্গা, রাণাঘাট, আজি হইতে বিকাশ রঞ্জনেকর নামে পরিচিত হইব''।
অর্থাৎ আপনি বাঙ্গালী, এখানে মরাঠি সেজে আছেন।
—তাহলে আমাকে খুনী নয়, ইমপস্টার হওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করছেন?
—আপাতত:।
—পুলিশ স্কুলে আপনাদের ব্যাচকে ল' বোধহয় ভাল করে পড়ায়নি। কেউ এফিডেভিট করে পদবি বদলালে কী করে আইনের চোখে ইমপোস্টার হয়?
—পদবি বদলানো আর বাঙালী থেকে মারাঠি হওয়া কি এক হল?
—কেন নয়? যদি মারাঠি মেয়ে বাঙালী বিয়ে করে পদবী বদলে বাঙালী হতে পারে , তাহলে বাঙালী পুরুষ মারাঠি বিয়ে করে পদবী বদলে মারাঠি সারনেম নিলে কেন অপরাধ হবে?
—হবে না। কিন্তু আপনি আপনার স্ত্রীর পদবি তো নেন নি। ওনার মেডেন নেম তো শুভদা ঘাটগে। তাহলে?
—সংবিধানে কোথায় আছে যে কেউ নিজের কমিউনিটি বদলাতে পারবে না? করলে ক্রিমিনাল অফেন্স হবে?
—নেই। কিন্তু কেউ যদি এই কাজটা কোন ক্রিমিনাল ইন্টেনশন থেকে করে?
—আচ্ছা! কী সেই ইনটেনশন? শুনি একবার।
—শংকর সেনার আইকন চিফ বিক্রম সোলাংকিকে ঠান্ডা মাথায় খুন করা।
—পাগল হয়েছেন! আমি কেন খুন করতে যাবো ওই লোকটাকে? ও আমার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে? রায়পুর শহরে আসার আগে আমি ওর নামও শুনিনি।
—হ্যাঁ, আসার পরেই শুনেছেন। কিন্তু নাম পরিচয় ভাঁড়িয়ে বহুদিন পরিকল্পনা করে সুযোগ বুঝে কাজটি করেছেন। ইট'জ আ কোল্ড-ব্লাডেড মার্ডার!
—দূর মশাই! আমার মোটিভ কী? আসা করি ইন্টেনশন আর মোটিভের তফাৎ আপনার জানা আছে।
—আছে বৈকি! মোটিভ তো আপনিই খুলাসা করবেন, শ্রীমুখে। তবে আমি খানিকটা আন্দাজ করেছি। সূত্র পেয়েছি আপনার ওই বাংলা কবিতার বইটি থেকে। কী যেন নাম? হ্যাঁ, "ছাড়পত্র''।
—ওফ্! খোদা পাহাড়, নিকলা চুহা!
(পাহাড় খুঁড়ে বেরোল ইঁদুর!)
কবিতার বই থেকে খুনের মোটিভ! ইয়ার্কির একটা সীমা আছে।
—একটি কবিতায় লাল পেন্সিলে মোটা করে আন্ডারলাইন করেছেন "এ পৃথিবীকে শিশুদের বাসযোগ্য করে যাবো আমি,'' আর "প্রাণপণে দুইহাতে সরাবো জঞ্জাল''। পাশে মার্জিনে ক্যাপিটাল অক্ষরে লিখেছেন "মিশন''।
—ধেত্তেরি! ওটা কবি সুকান্তের মিশন, আমার নয়। বাংলা বোঝেন না, স্ত্রীর ব্যাখ্যা শুনে কবিতা থেকে খুনী সনাক্ত করছেন? ট্যাক্সের পয়সায় সরকার কেন যে আপনাদের মত লোক পোষে! রাস্তা ছাড়ুন, আমাকে ট্রেন ধরতে হবে!
—এক মিনিট! কে বল্লো আমি বাংলা জানি না? শান্তিনিকেতন থেকে সোশিওলজিতে অনার্স করেছি। তারপর আই পি এস পরীক্ষা দিয়ে এই চাকরিতে এসেছি।
—শান্তিনিকেতনে পড়ে পুলিশের চাকরি! ভাগ্যিস কবিগুরু বেঁচে নেই!
—শুনুন বিকাশভাউ, থুড়ি বিকাশ কর! আমিও আপনাদের রাজ্যে পড়ার সময় বাম রাজনীতির টাচে এসেছিলাম। কিন্তু গোটা সিস্টেম করাপ্ট, এ আমি মানিনা। আমি দেখাতে চাই এর মধ্যেও অনেস্টলি ভাল কাজ করা যায়।
—বেশ, অনেস্টলি কাজ করুন। সন্দেহের বশে বয়স্ক লোককে হ্যারাস না করে ট্রেন ধরতে দিন। মোটিভ নিয়ে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছেন, হাতিয়ার পান নি! খালি অনর্গল কথা বলে চলেছেন।
—হাতিয়ার এখন হাতে না পাই, ওর খোঁজ তো পেয়ে গেছি। খালি আপনি একটু কোঅপারেট করুন।
—মানে?
—পুলিশ ঠিক ভগবান নয়। হাতিয়ার আপনি বাড়িতে কোথায় রেখেছিলেন, আমরা জানি না।
হয়তো টালির চালের মধ্যে গোটা কয় টালি সরিয়ে; হয়তো জলের ট্যাংকির মধ্যে ঢাকনার পাশে ঢাকা সারফেসের মধ্যে ওয়েল্ডিং করা কোন ক্ল্যাম্পে ফাঁসিয়ে। কিন্তু আজ ওই রিভলবারটি কোথায় আছে আমি জানি।
—তাই নাকি? তা এখন কোথায় আছে, বলুন! তবে তো সাহায্য করার কথা ভাববো।
—আছে আপনার লকারে। গতকাল টিকিট কাটার আগে আপনি ব্যাংকে গিয়েছিলেন। লকার খুলেছিলেন। মানে খুব স্পষ্ট। সিক্রেট প্লেস থেকে ওটাকে বের করে লকারে রেখেছেন। আমাদের ট্রেস করতে সময় লেগেছে এইজন্যে যে লকারটি আছে আপনার স্ত্রীর নামে, কিন্তু আপনাকে অপারেট করার পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দেয়া আছে।
এইখানে আপনি আরো একটি বে-আইনি কাজ করেছেন। আপনার স্ত্রী মারা গেছেন ক্যান্সারে, এই খবরটি আপনি ব্যাংককে দেন নি। ওনার মৃত্যুতে ওই পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি ইনভ্যালিড হয়ে গেছে।
—আপনি ঠিক জানেন যে আমার স্ত্রীর নামের লকারটিতে একটি রিভলবার রাখা আছে?
—সার্টেনলি! এক কাজ করুন। আমার মোবাইলে ব্যাংকে কল করে বলুন আমি আর আপনি পাঁচমিনিটে ব্যাংকে পৌঁছুচ্চি। উনি যেন ওনার চাবি নিয়ে তৈরি থাকেন। লকার খোলা হলে যদি রিভলবার না পাওয়া যায় আমি নিজে আপনাকে ট্রেনে তুলে গিয়ে আসবো। আর আপনার নাম সন্দেহের তালিকা থেকে কেটে দেব। রাজি?
পুরো এক মিনিট দুজনেই একে অপরের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলেন।
তারপর বিকাশ মুচকি হেসে বল্লেন—আমি রাজি। কল করুন ব্যাংককে! কী হল? লাগান নম্বর।
এবার পার্থসারথির চোখে চোখ রেখে তাকানোর পালা।
তিরিশ সেকন্ড কাটলো। উনি হেসে উঠলেন। তারপর দ্রুত পায়ে এসে তিনটে লাগেজকে আড়াল করে বিকাশের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
—মি: কর! আপনি ধরা পড়ে গেছেন।
তার মানে যন্তরটি লকারে নেই। অর্থাৎ অ্যাদ্দিন লকারেই ছিল, বাড়িতে নয়। তাহলে কাল আপনি লকার খুলেছিলেন ওটাকে রাখতে নয়, ওখান থেকে বের করে নিয়ে আসতে।
ওটা এখন আপনার কাস্টডিতেই আছে। এখন যদি আপনার এই তিনটে লাগেজ সার্চ করি তাহলে কোন একটাতে ঠিক পেয়ে যাবো।
আমার শর্ত আগের মতই। যদি লাগেজ সার্চ করে না পাই তবে আপনি ফ্রি। আর আপনার কাছে মাপ চেয়ে আমি নিজের গাড়িতে আপনাকে স্টেশনে পৌঁছে দেব। কি, রাজি?
খাটিয়ায় বসে পড়েছেন বিকাশরঞ্জন কর, অ্যালিয়াস বিকাশ রঞ্জনেকর।
দুহাতের তালুতে মুখ গোঁজা, থরথর করে কাঁপছে শরীর।
ভাঙা ভাঙা অস্পষ্ট স্বরে বললেন—কী করে, —কী করে বুঝলেন?
—প্রথম থেকেই একটা ব্যাপার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হোটেলের ক্যামেরায় দেখছি প্রায় প্রতিদিন আপনি একই সময়ে ওই বিক্রমাদিত্য হোটেলে একটু রাতে খেতে আসেন। প্রায় প্রত্যেকবার শঙ্কর সেনাদের মোচ্ছবের সময় ওদের কাছাকাছি টেবিলে অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকেন। ওরা টেবিল ছেড়ে ওঠার সময় আপনি উঠে পড়েন। আর ক্লোজ আপে ধরা পড়েছে আপনার চোখে অপরিসীম ঘৃণা।
ঘৃণা খুব বড় মোটিভ ফোর্স, ভালোবাসার চেয়েও বেশি। আর সবচেয়ে ভাল সুযোগ আপনারই ছিল। একটা কথা বলুন তো। আপনি তো আর জানতেন না যে ওই দিন সোলাংকি আপনাকে গাড়িতে লিফট দেবে। তাহলে সেদিন আপনার হাতব্যাগে রিভলবার কী করে ছিল?
আমার অনুমান আপনি বহুদিন ধরে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। রোজ সঙ্গে করে অস্ত্রটি এনে খেতে বসতেন। কি, ঠিক বলছি তো?
বিকাশ মাথা নামালেন।
—কেন এই কাজ করলেন? মানুষ মারতে আপনার হাত কাঁপলো না?
ধীরে ধীরে মুখ তুললেন বিকাশ।
—মানুষ মারিনি তো! আরশোলা মেরেছি।
শুভদারও আরশোলা নিয়ে ঘেন্না ছিল খুব। কিন্তু মারতে ভয় পেত, আমাকেই মারতে হত।
—শুভদা তো আর পাশে নেই। তবে কার আদেশে আরশোলা মারার কথা ভাবলেন?
—নিজের।
—আর আপনার ওই আরশোলা মারার ফলে যে ছয়জন নিরপরাধ মুসলিম মারা গেল? তাদের জন্যে ভাবেন নি! তাদের জন্যে আপনার কোন দায়িত্ব নেই? নাকি অন্যদের মত কোল্যাটারাল ড্যামেজ ধরে নিয়ে নিজের বিবেককে চোখ মারবেন!
শুনুন। আমরা কোলকাতা পুলিশের সহায়তায় যা জানতে পেরেছি তা হল আপনি পুণেতে শুভদা ঘাটগেকে বিয়ে করার পর স্বেচ্ছায় ট্রান্সফার নিয়ে কোলকাতা অফিসে আসেন। ইউনিয়নে সক্রিয় ছিলেন। অন্য অতিবাম ঘেঁষা রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়ছিলেন। এই নিয়ে শুভদার সঙ্গে আপনার টেনশন হতে থাকে। তারপর ছেলে হলে শুভদার চাপে আপনি মুম্বাই চলে যান। সেখানে আপনার শ্যালক শঙ্কর সেনা জয়েন করতে আপনাকে চাপ দিতে থাকে। তিক্ততা বাড়তে থাকে।
এমন সময় একটি ঘটনা ঘটে। মামাবাড়ি পুণে থেকে মুম্বাই আসার সময় টেররিস্টদের বোম ব্লাস্টে নিহতদের তালিকায় আপনার ছেলের নাম উঠলে আপনার স্ত্রী ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে যান।
বাকিটা আপনি বলেছেন। কিন্তু এইসব থেকে আপনার এই বয়সে সোলাংকিকে মার্ডারের মোটিভ এখনও অস্পষ্ট।
—ভাইয়ের প্রভাবে স্ত্রীর মাইনরিটি বিদ্বেষ বাড়তে লাগলো। আমাকে উল্টো বোঝাতে লাগলো আমাদের একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর জন্যে আমার বামপন্থী রাজনীতির মাইনরিটি তোষণই দায়ী।
আমি যত বলি ওটি একটি দুর্ঘটনা; নিহতদের তালিকায় মুসলিম নামও আছে—ও ততই ফুঁসে ওঠে। রোজ ঝগড়া, রোজ ঝগড়া।
আমার কী যে হল!
একদিন ধৈর্য হারিয়ে চড় মেরে বসলাম। ও অবাক হয়ে আমাকে দেখল। আমি মাপ চাইলাম। অনেক কিছু বোঝালাম। কিন্তু ও কোন কথা বললো না। অফিস থেকে এসে দেখি ভাইয়ের বাড়ি চলে গেছে, ফ্ল্যাটের চাবি কেয়ারটেকার-এর কাছে দিয়ে। তারপর শালার ফোন এল। ও মানসিক ভারসাম্য পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে।
আমি গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ওকে রায়পুরে নিয়ে এলাম। সেসব কথা আগেই বলেছি।
যা বলিনি তা হল ওই মানসিক ভারসাম্যহীন স্ত্রীর সঙ্গে একটি বছর রায়পুরে বড় আনন্দে কাটিয়েছি। ওর সব কাজ আমি করে দিতাম। স্নান করানো, কাপড় বদলানো সব।
ও বলতো— ছেলে মুম্বাইয়ে পড়াশুনো করছে। পরীক্ষা হয়ে গেলে বাড়ি আসবে।
এমন সময় ওর জরায়ুতে ক্যান্সার ধরা পড়লো। ফলে ওকে আবার মুম্বাইয়ে শালার কাছে ছাড়তে হল। চিকিৎসার খরচা আমি পাঠাতাম। কিন্তু লোক্যাল গার্জিয়ান আমার শালা। সে তখন শংকর সেনার টিকিটে কাউন্সিলর।
শুভদা বাঁচলো না। কিন্তু আমি যখন পৌঁছুলাম দাহকার্য আগেই শেষ। আমাকে ওর ভাই এবং ওর বন্ধুবান্ধবরা প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে তাড়াল।
ফিরে এলাম রায়পুরে, শুধু একটি চিন্তা মাথায় ঘুরছে। আপনি ঠিকই বলেছেন।
ওই ছাড়পত্র বইটিতে পরের দিকে আরেকটি কবিতার লাইনে দাগ দেয়া আছে। আপনি খেয়াল করেন নি।
"প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,আমরা তিনজন একটা গ্রুপ গড়ে নিলাম। আমাদের কোন দল নেই। নাম নেই। কিন্তু আমরা নিজেদের মনে করি সভ্যতার মেথর।
ভেঙেছিস ঘরবাড়ি।
সেকথা কি আমি জীবনেমরণে
কখনো ভুলতে পারি!''
আমাদের কাজ সামান্য কিছু আরশোলা, কেন্নো এদের দূর করা। হিট স্প্রে বলতে পারেন।
—এবার আমি বলছি, এখন আপনারা আর তিন জন নেই, মাত্র দু'জন। একজন হার্ট অ্যাটাকে সম্প্রতি মারা গিয়েছে। আর কোলকাতা থেকে যে আপনাকে টাকাপয়সা এবং অস্ত্র সাপ্লাই করতো সে এখন ফেরার। কাজেই আপনি এখন পুরনো নামে কোলকাতায় ফিরে জনসমুদ্রে হারিয়ে যেতে চান। অথবা উত্তরবঙ্গ বা রাঢ় বাংলার কোন গ্রামে ছোটখাট টিউশন করে সময় কাটাবেন। কি, ঠিক ধরেছি কিনা!
বিকাশ মাথা নাড়েন।
—তবে একটা কথা। ওই কোল্যাটারাল ড্যামেজ যে এমন হবে ভাবিনি। নিহতদের মধ্যে মোদহাপাড়ার রফিক যে আমার ছাত্র!
তাই দল ভেঙে দিচ্ছি। বাকি জীবনটা—।
—দেখুন, আপনার সামনে দুটো পথ খোলা; আপাতত: আর্মস্ অ্যাক্টে আপনাকে গ্রেফতার করা। জেলে আপনি নিরাপদেই থাকবেন। বাইরে থাকলে শংকর সেনারা আপনাকে ছিঁড়ে ফেলবে।
কোর্টে কেস উঠলে অন্তত: দশবছর সশ্রম কারাদণ্ড নিশ্চিত।
—আর দুসরা রাস্তা?
—সেটা হল আপনি এক্ষুনি গিয়ে কোলকাতার ট্রেন ধরুন।
আপনার পজেশনে হত্যায় প্রযুক্ত হাতিয়ার না পাওয়া গেলে আপনার ওপর কোন চার্জ ফ্রেম করা যায় না। আমি আপনার ব্যাগ ছুঁয়ে দেখব না।
রিপোর্ট দেব—সোলাংকির মৃত্যুতে যে দু'জন প্রত্যক্ষ ভাবে লাভবান হয়েছে তাদেরি কেউ সম্ভবত: দোষী।
—এরকম করার জন্যে আপনার মোটিভ কী?
পার্থসারথি উঠে দাঁড়ালেন। দরজার দিকে যেতে যেতে খানিকটা যেন নিজের মনে বল্লেন—আমিও মাঝেমধ্যে আরশোলা মারতে চাই। কিন্তু সাহসে কুলোয় না।
বেলা প্রায় দুটো। পার্থসারথি নিজের অফিসে বসে কম্প্যুটরে রিপোর্ট টাইপ করছেন। লেখা প্রায় শেষ। শেষ প্যারাগ্রাফে রাজ্যপুলিশের জন্যে কিছু রেকমেন্ডেশন দিয়ে রিপোর্ট ক্লোজ করবেন। তারপর আগামী মাস থেকে ওনার পেরেন্ট অর্গানাইজেশন মধ্যপ্রদেশ পুলিশের হেড কোয়ার্টার ভোপালে ফিরে যাবেন।
এমন সময় টেবিলে রাখা ফোন বেজে উঠল।
—স্যার! আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? সেই জগিং করতে বেরিয়ে আর ফেরেন নি। মোবাইল বন্ধ রেখেছিলেন কেন?
এদিকে মামলা একদম হলিউড-জলিগুড! আপনিই ঠিক। একটু আগে সোলাংকির আততায়ী ধরা পড়েছে। এখন এস পি অফিসে পুছতাছ চলছে। আপনি শিগ্গির চলে আসুন। সবাই আপনাকে খুঁজছে।
আরে, আপনি ওই মারাঠি কড়িভাউয়ের পেছনে লোক লাগিয়ে রাখতে বলেছিলেন না? তো হারামি কে পিল্লে ট্রেনে করে পালাচ্ছিল। আমাদের লোক সন্দেহের বশে ওকে বলে লাগেজ খুলে দেখাতে। ও কিছুতেই রাজি হয় না। তখন আমার লোক ওকে জোর করে প্ল্যাটফর্মে নামায়। আপনাকে আর আমাকে ফোন করে। কিন্তু আপনার মোবাইল বন্ধ ছিল আর তখনও আপনি অফিসে আসেন নি।
তাই আমি এস পি অফিসে নিয়ে গিয়ে সার্চ করি। দু'নম্বর স্যুটকেসে কাপড়ের ভাঁজে ছিল ওটা। সেই পয়েন্ট ৪৫ ক্যালিবারের স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসেন।
এখন প্রেস কনফারেন্স হবে।
সবাই আপনাকে চাইছে, আপনিই ঠিক, স্যার।
(সমাপ্ত)