মধুপুরের ঘটনা তো, আমিই লিখি, কেমন? আগে পড়েছেন মেনে নিলাম, কিন্তু এটা ওটা আগে থেকে আঁচ করতে পারলেও বাগড়া না দিয়ে চুপচাপ চানাচুর চিবোন না? ঠিক আছে?
একটা কথা—এটা কিন্তু বড়োদের গপ্পো, ভুলেও কচিকাঁচাদের শোনাতে যাবেন না।
বোধ হয় সাহেবি আমলের কথা।
কলকাতার নামজাদা এক বনেদি বাড়ির (ন্যাচারালি নামটা চেপে গেলাম—গপ্পোর কিসসু আসবে যাবে না) একটি ভারী সুন্দর ছুটি কাটাবার জায়গা ছিল মধুপুরের লালগড়ে। আর তেমনি ছিল বাগান, বিশেষতঃ গোলাপের—সব কলমগুলি মিহিজাম আর দেওঘর থেকে আনা। মনে আছে, পেছন দিকটায় ছিল আরও বড়ো সবজির আর ফলের বাগান—সপরিবারে দুজন মালি থাকতো, তাদের আলাদা আলাদা বাড়ি ছিল। বাগানের আর মালিদের কুয়ো পর্যন্ত আলাদা ছিলো পেছনদিকে। ইলেকট্রিসিটি তো ছিল না, তাই বড়ো বাংলোর ছাতের ট্যাঙ্কে জল তোলবার হ্যান্ড পাম্প ছিল পেছনের কুয়োয়। শহরের মতো জলের কল দেওয়া সাহেবি বাথরুম ছিল বাড়িটায় কয়েকটা। ঘরের মধ্যে শুধু নয়, বাগানে পর্যন্ত হ্যাজাক আর পেট্রোম্যাক্স জ্বলতো। কেরোসিনের ফ্রিজ ছিল, কেরোসিনের পাখা ছিল।
যে ভদ্রলোক বাড়িটা তৈরী করেছিলেন তিনি সময়মতো মারা গেলেন—তাঁর ছেলে আগেই গিয়েছিলেন। আদরে দস্তুরমতো বাঁদর হওয়া নাতি হয়ে বসলো মালিক। প্রায়ই নানা ইয়ারবক্সি নিয়ে মধুপুরে আসতো। ঠাকুরদাদার পারিবারিক ছুটির বাড়িকে করে তুললো আমোদ প্রমোদের বাগানবাড়ি। সব রকম ব্যবস্থাই আস্তে আস্তে হয়ে গেলো, শুনেছিলাম শহুরে বন্ধুদের মধ্যে একজন ডাক্তারবাবুও ছিলেন।
ধোপা নাপিতের ব্যবস্থাও বাড়ির সঙ্গেই লাগোয়া ছিল।
মস্ত বড়ো হলঘর ছিল বাড়িটার সামনের দিকেই। অনেক বাড়িতে যেমন ইটালিয়ান স্ট্যাচু, "আ ছি ছি..." ধরনের, বাগানে থাকে, এই বাড়িতে বাগানে ছাড়াও হলঘরের ভেতরে ছিল, অনেক দিন পরে আমিও দেখেছি।
বাবুর বন্ধুর দলে দুই ভাই ছিলেন—তাঁদের মধুপুর জায়গাটা ভারী ভালো লেগে গেলো। কলকাতার একটি বিখ্যাত ওষুধ কোম্পানির এজেন্সী নিয়ে তাঁরা ওখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করলেন। দুজনেই ছিলেন অবিবাহিত—তাতে কোনো "অসুবিধে" হলো না অবশ্য। মাঝখান থেকে ওনারা আমাদের সেই বনেদি বাবুর বাগানবাড়ির ম্যানেজার হয়ে গেলেন প্রায়।
মালি দুজনের মধ্যে একজন ছিল মুসলমান, অন্যজন ছিল মুন্ডা। মুসলমান মালির কাজের মধ্যে গোলাপ বাগানের সঙ্গে পাঁঠা মুরগি তৈরী করাটাও পড়তো—আম লিচু কাঁঠাল ছাড়া বুনো শুওর ও অন্যান্য শিকার তৈরী করার দায়িত্ব ছিল মুন্ডা মালির। মালিরা সপরিবারে বেশ বড়ো কোয়ার্টার্সেই থাকতো। সেই কোয়ার্টার্স আমিও দেখেছি, মালিদের দেখিনি।
মুন্ডা মালি তার ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলো। একটিই ছেলে—বেশ ধুমধাম করেই হলো সবকিছু। শুওর, হাঁড়িয়া, পেট্রোম্যাক্স, গড়ের বাদ্যি, আবার শুওর, সব কিছু। বাবুরা তখন ছিলেন না, সুবিধে ছিল।
ছোট ম্যানেজার ছিল তখন মধুপুরেই, দাদা ওকে রেখে কলকাতায় গিয়েছিলো। নেমন্তন্নয় হাঁড়িয়া গিলতে এসে হতভাগা নতুন মুন্ডা কনেকে দেখলো। ভালো করেই।
মাস খানেক পরের কথা। সন্ধে বেলা নাচ গান হয়ে গেলে বাঈজী-পার্টি জানালেন যে তাঁদের পরের দিন পাটনায় মেহফিল আছে, তক্ষুনি চলে যেতে হবে। কলকাতায় যথেষ্ট প্রতিপত্তি তাঁদের, বাবুমশাইরা আর কি করেন, মেনে নিলেন।
মনটা সকলের বেশ খারাপ হয়ে গেলো। নানা রকম রসসিক্ত আলোচনা চলতে লাগলো, সেই সঙ্গে প্রভূত আক্ষেপ। বোতল দুচ্চার পর ছোট ম্যানেজারের মনে পড়ে গেলো ...
পরে দেওঘরের মহকুমা আদালতে মুসলমান মালি সাক্ষ্য দেয় যে বাবুমশাই নিজেই আগ বাড়িয়ে প্রথমে মুন্ডা মালির কোয়ার্টার্সে ঢোকেন—পুরোপুরি প্রমত্ত অবস্থায়। অন্য অনেকে পেছনে ছিলেন। ফলে মুন্ডারীতে গালাগালের সঙ্গে প্রচণ্ড টাঙ্গির কোপটা ওনার মাথাটিকে দু-ফাঁক করে দেয়। বাকিরা যখন হতচকিত, মানে সামান্য একটা "সাঁওতাল" মালির স্পর্দ্ধায় বিস্মিত, তখন ওনারাও জনদুয়েক একটু জখম হয়ে যান। আর কিছু না।
সকালে হাসিমুখে ডবলক্যারি সাইকেল চালিয়ে থানায় গিয়ে নিজেদেরই নামে "এফ আই আর" করলো বাপব্যাটায় মুন্ডা মালি ও তার ছেলে।
ছেলের হলো ফাঁসির হুকুম, মালির জেল—ক' বছরের তা মনে নেই—আমার তো সবটাই শোনা।
ছোকরা বেঁকে বসলো—ফাঁসি সে যাবে না। ফাঁসি হলে নাকি সে তাদের স্বর্গে ঠিক করে পৌঁছতে পারবে না। নানারকম ঘ্যানঘেনে কারণে—ঠিক বলতে পারবো না। এদিকে ইংরেজের আইন-ও ছাড়বে না—ফাঁসিই দেবে ছোঁড়াটাকে। সে নাকি অনেকরকম অফার দিয়েছিলো—তাকে বল্লম দিয়ে মেরে খেলা হোক, তরোয়াল দিয়ে কেটে ফেলা হোক, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারা হোক—সরকার কিছুই আর মানে না।
নতুন কনেটা স্বামী আর শ্বশুরকে জেলে দেখতে আসে, পুরীটা, জিলিপিটা নিয়ে এসে দেয় আর হাউ হাউ করে কাঁদে। সেপাইগুলোর মায়াই হয়, কিছু বলে না।
একদিন ছোঁড়াটা দেখলো যে যে সেপাই দুটো রয়েছে তারা মুন্ডারী ভাষা বোঝে না। বাপের কাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে অনেক কিছু সান্ত্বনা দিলো বৌকে—আর কিছু হুকুম।
পরের সপ্তাহে বৌটা পরোটা আর লাড্ডু করে আনলো। প্রচুর কান্নাকাটি করে জেল থেকে যখন বেরোচ্ছে, তখন তার মুখে হাসি আর ধরে না। সেপাইগুলোর কেমন একটা সন্দেহ হয়—জেলের ভেতরে এসে দেখে পরোটার মধ্যে লুকোনো একটা দাড়ি কামাবার ক্ষুরের হাতলভাঙ্গা ফলা!
ফাঁসির আসামি, আত্মহত্যা করে আইনকে ফাঁকি দিতে চাইতেই পারে। বেশ মার খেলো জেলারের হাতে ছোঁড়া। হাসিমুখে। মধুপুরে সেপাই পাঠানো হলো তক্ষুনি বৌটাকে ধরে আনতে।
দুজন সেপাই, একজন মধুপুরে, একজন দেওঘরে, পরদিন সকালে দেখলো দুটো মানুষ মরে পড়ে আছে—সেঁকো বিষ ঠাসা লাড্ডু কয়েকটা খেয়ে। হেসে কুটিপাটি বুড়ো মুন্ডা মালি।
কি, খুব তো ভাবছিলেন ঘটনাটা আপনাদের জানা? এখন কেমন?
সাধে সাঁওতাল, ওরাওঁ, হো এরা সব মুন্ডাদের বুদ্ধি মেনে নেয়!
শুনে তো ছিলাম, কে জানে সত্যি কি না! ওখানে সবাই আসল ঘটনা এটাই বলে জানে কিন্তু।
(চলবে)