• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৬ | সেপ্টেম্বর ২০১৯ | গল্প
    Share
  • দ্রোহের কবিতারা : সোহম ঘোষ


    ঞ্জুর স্বপ্ন দেখে ঘুমটা আজও ভেঙে গেল বীণার। তবে আজকের আটান্নর বীণার নয়, স্বপ্নে বীণার বয়স ছিল সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ। এরকম বেশ কয়েকবার হয়েছে আগেও। বীণা রান্না করছে, আর সদর দরজার কাছ থেকে রঞ্জু চীৎকার করে বলছে, "মা আসছি।" চুল পেতে আঁচড়ানো, গায়ে একটা হলুদ গেঞ্জি যেটার বুকের কাছটায় সুতো দিয়ে কাজ করা একটা ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। নস‍্যি হাফপ্যান্ট। কখনো দেখেছে রঞ্জুকে সাইকেলে, কিন্তু বাকিটা এক। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল বীণা।

    স্বপ্ন দেখছিল বুঝতে কয়েকটা মিনিট কেটে গেল। পাশে রুদ্রপ্রসাদ নেই, হয়ত সকালে উঠে হাঁটতে গেছে কিংবা হয়তো বাগানে গেছে। আজকাল ওই এক শখ হয়েছে ভদ্রলোকের। যবে থেকে রঞ্জু নেই তবে থেকেই এই নিয়ে মেতে আছেন তিনি। রিটায়ারের পর থেকেই করত এখন বেড়েছে সেটা। বীণাও একটা সময়ে ঐসব করেছেন পাল্লা দিয়ে, সন্ধ‍্যায় রোজ মঠে যেতেন; তবে আজকাল আর ওসব ভালো লাগছে না তার। মঠে গিয়ে রোজরোজ শুধু গয়না আর বাড়ির বৌ-শাশুড়ির ঝগড়া এ নিয়েই আলোচনা চলে। পরনিন্দা-পরচর্চাতে হাঁফিয়ে যান বীণা। এভাবে তো ভোলা যায় না তার আদরের রঞ্জুকে। রুদ্র পেরেছে, বীণা পারেনা।

    সকাল থেকেই রুদ্রর বাড়ির কাজে লেগে পড়তে হয়। কি বাজার হবে, কি রান্না হবে, কোথায় কি ফাঁকি পড়ল এসব থেকে আর মুক্তি নেই তার। রঞ্জু যে বছর চলে গেল সেই বছরে পেল্লায় দোতলা হাঁকিয়েছে রুদ্র, সেই বাড়ির পেছনে বেগার খেটে যান। তাও দুবছর হয়ে গেল। মাঝেমধ্যে কখনো হয়ত প্রতিবাদ করেন বীণা, সে আওয়াজ চাপা পড়ে যায়। রুদ্র থাকে তার প্রাসাদ নিয়ে। আর তার প্রাসাদের একমাত্র উত্তরাধিকারী বিপ্লব। বিপ্লব রুদ্রের ভাইপো। কিভাবে ধীরে ধীরে গিলে ফেলল সবকিছু, বীণা প্রতিবাদও করেনি। করতে পারেনি কোনদিন। আর তাই রুদ্রের সবকিছু মেনে নিতে হয়েছে বারবার।

    অঙ্কের মাথাটা তুখোড় ছিল রঞ্জুর। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বারো ক্লাস পাস করে আইআইটি করতে গেল খড়গপুর। নরেন্দ্রপুরে যখন পড়ত, বাড়িতে একগাদা ছেলে আসত। ওর বন্ধুরা। অঙ্ক নিয়ে আলোচনা করত।

    রঞ্জু যেদিন খড়গপুর চলে গেল তখন থেকেই আস্তে আস্তে বিপ্লব বাড়িতে আসা বাড়িয়ে দেয়। রুদ্রও সেটা নিয়ে আশ্বস্ত হয়। দিনে দিনে রুদ্র খড়দহে আসা কমিয়ে দিয়েছিল। কমলার বাড়িতে যেতে লাগল। সে খবর আসত বীণার কানে। সুলতা বলত, "কাইন্দেন না বৌদি। হেরা হয় এমনে। আমারে ছাইড়া ওই মীংসে এক মুখপুড়িরে ঘরে তুলছে। টিবি অইল। ও হারামজাদি ফ‍্যালাইয়া পালালো। আমার থেকে টাহা নিয়া চিকিচ্ছে করালো‌। বাবু পাঁচ হাজার টাহা দিছিলো, ওর গীটার কারে বেইচ‍্যা দিয়া। আমি বললাম দিও না বাপ। দাদা জানলে কাইট‍্যা ফেলাইব তোমারে। কইল, মাসি তুমি আমার গুমুতের ত‍্যানা ধুইছো। মায়ের তুল‍্য, কিছুই হইব না। আর ও ব‍্যাডা কি করল, ঠিক হইয়া আবার ওই মাগীর ঘরে উঠল গিয়া। কি কইবেন?"

    বলত না বীণা কিছু। ততদিনে যাদবপুরের দিকে জমি কিনে বাড়ি করছে রুদ্র। রঞ্জু আইআইটির প্রথম বছরে দারুণ রেজাল্ট করল। সেটা ২০০৬, সে বছর রথের সময় যাদবপুরের বাড়িতে গৃহপ্রবেশ হল। বিপ্লবরাও সপরিবারে উঠে এল বাড়িতে।

    রঞ্জুকে দেখে বোঝা যেত না ও আদৌ খুশি হয়েছিল কিনা।

    বলেছিল, "মা, বিগবস তো পেল্লায় বাড়ি হাঁকালো, কত মানুষ না খাবার পেয়ে পিঁপড়ের ডিম খাচ্ছে জানো? সুলতা মাসির কি হবে? কাজ ছাড়িয়ে দেবে? খাবে কি?"

    "তুই যে বিগবস বলিস, বাবা জানলে রাগ করবে না?"

    "না সোনা মা আমার। বিগবস আমায় ঘাঁটাবে না। তবে এর পরে যখন আসব চমকে যাবে বিগবস।"

    সুলতা গেছিল যাদবপুরে। থেকেও গেছিল। রঞ্জু আসেনি আর কখনো এরপর, তুফান এসেছিল তিনবার। রঞ্জু হয়তো শেষ হয়ে গেছিল খড়দহের বাড়িতেই। খবর এসেছিল খড়গপুর আইআইটি থেকে রঞ্জু নাকি চলে গেছে মাওবাদীদের দলে। রঞ্জুর একতলায় ঘরটা বন্ধ পড়ে থাকত, বীণা গিয়ে রোজ পরিষ্কার করে রাখত। আজও রাখে, যেন রঞ্জু এসে শোবে রাতে বিছানায়। তাক থেকে নামিয়ে বই পড়বে। তাও তো কত বইপত্তর নিয়ে গেছিল পুলিশ এসে। রুদ্র দাঁড়িয়ে থেকে সেসব ব‍্যবস্থা করেছে। দেখতে পায়নি আর সেসব। রঞ্জুর বাকি সব স্মৃতিকে আঁকড়ে রেখেছে বীণা। বিপ্লবের বৌ ঋতু চাইত বুটিকের জন‍্য রঞ্জুর একতলার ঘরটাকে নিয়ে নিতে। রুদ্রকে রাজি করিয়ে ফেলেছিল, বীণা রুখে দাঁড়ানোয় শেষ পর্যন্ত আর ঘাঁটায়নি রুদ্ররা। কমলার ছেলে মৈনাক আর বিপ্লব প্রোমোটারি ব‍্যবসা শুরু করল তারপর। বছর পাঁচেকে ফুলে ফেঁপে উঠছিল। কাঁচা টাকা হাতে এলে মাটিতে পা রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে। বাড়িতে ঋতুর বান্ধবীদের রোজ আড্ডা বসতে লাগল, এখনো চলে সেসব। আর আসে বিপ্লবের ছেলে বিজয়ের বন্ধু-বান্ধবী। পেছনের ডোবার পাশে পড়ে থাকে বিয়ারের বোতল, কন্ডোমের প‍্যাকেট। রুদ্রকে একবার বলতে গেছিল বীণা, কাজ হয়নি। উল্টে শুনেছে, "বীণা আমার বাড়িতে যার পোষাবে না সে বেরিয়ে যেতে পারে। আর বিজয়ের যা বয়স তাতে এসব করবেই। বিপ্লব মারাতে যায়নি তোমার ছেলের মত। কুলাঙ্গার একটা। চে হবেন উনি। মানসম্মান সবকিছু শেষ করে দিয়েছে তোমার ছেলে।"

    বীণা যেতে পারে না কোথাও। তার কোথাও যাবার নেই। মা বাবা মারা গেছেন। তবু তার মনে হয়, রঞ্জুরা হয়ত ভুল পথ বেছেছিল, কিন্তু তাদের আদর্শ ভুল ছিল না। সেরা মাথাগুলোকে হয়ত সহজেই কব্জা করা যায়। নীতি, আদর্শ চেপে বসে। তার রঞ্জু শেষবার যখন এল, ২০১৬তে সেবার বিপ্লবরাও ছিল বাড়িতে। কথা বলছিল হেসে। সারাদিন মজা, হাসিঠাট্টা হল। পরের দিন জন্মদিন ছিল রঞ্জুর। বলল "বহুদিন পায়েস খাই না মা তোমার হাতে।" সুলতা দুধ জ্বাল দিচ্ছিল যখন ফোন আসে থানা থেকে। সেবার বলছিল, "আর ভালো লাগে না এসব। বুঝলে মা, কিছু হবার নয় এভাবে। মানুষকে ভুল পথে চালায় ওরা। ভাবছি ম‍্যাথসে অনার্সটা করে ফেলি। বিগবস তো টাকা, শেল্টার দেবে না আর। আর ফিরতে ইচ্ছে করে না, জানো। সবজায়গায় স্বার্থ জড়িয়ে পড়েছে মা, আদর্শ নিয়ে আর কেউ ভাবছে না। আচ্ছা তোমাদের মিশনে সাধু করে নেবে আমায়?" খালি হাসত এসব বলে।

    নাদুস নুদুস চেহারাটা ভেঙে গেছিল। চোখের তলায় কালি, গলার কন্ঠা বেরিয়ে গেছে, গাল তুবড়ে গেছে। মায়া হত দেখে।

    উঠে দাঁতমুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নিলেন। সাড়ে সাতটা বাজে ঘড়িতে। শাওয়ারটা চালিয়ে দিলেন, আজ আর গিজার চালাতে মন চাইছে না। ঠান্ডা জল শরীর বেয়ে নেমে আসছে। মাথাটা দপদপ করছে। পেটে ব‍্যথাটা বেড়েছে কদিন ধরে। রঞ্জু যখন পেটে, সেই সময়কার কথা মনে পড়ে গেল। ঠাকুরঘরে গিয়ে বসলেন। মনটা অস্থির হয়ে আছে বড়। বারবার গর্ভাবস্থার দিনগুলো ফিরে আসছে। বি. এ. ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার দিনগুলো এগিয়ে আসছে তখন, নোটস নেওয়া, পড়া মুখস্ত নিয়ে ব‍্যস্ত তখন বীণা। এদিকে বাড়িতে কেউ নেই। রুদ্রপ্রসাদ পুলিশের চাকরি করত আর যেটুকু অবসর পেত কখনো বাড়ি থাকত না। ক্লাব, কমলাদের বাড়ি যাওয়া এসব নিয়েই ব‍্যস্ত থাকত। সারাদিন বাড়িতে একা থাকতে থাকতে বীণা অভ‍্যস্ত হয়ে পড়ে সেই জীবনে। যে রাতে গর্ভযন্ত্রণা শুরু হয় সে রাতেও রুদ্র বাড়ি ছিল না। রঞ্জু আসার আগে শরীর ভারী হয়ে গেছিল। এমনিতে শান্ত ছিল পেটের মধ‍্যে। তার আগে বারবার নষ্ট হয়েছে গর্ভের বাচ্চারা। রুদ্র বারবার বোঝাত তখন, সামান‍্য পুলিশের চাকরি করে বাচ্চা নেওয়া সম্ভব নয়। তারপর বারবার ভোগ করেছে বীণা অ্যাবর্শনের কষ্ট। বাচ্চা হারানোর যন্ত্রণা। তখনও রুদ্র তৈরী ছিল না। বি.এ. ফাইনাল ইয়ারের দ্বিতীয় পরীক্ষা দিয়ে ফিরেছে, হঠাৎ যন্ত্রণা শুরু। সুলতাও তখন দ্বিতীয় বাচ্চার মা হবে। কাজ করত না, তবে বীণা চেয়েছিল বলে রুদ্রপ্রসাদ আর ছাড়িয়ে দেয়নি তাকে।

    সুলতা সে-রাতে বলেছিল, "বাবু আইতাছে। বৌদি হাসপাতালে যাওন লাগব।"

    দুজনে মিলে মন্টুর রিক্সা করে হাসপাতালে গেছিল সেদিন। জন্মাষ্টমীর দিন ছিল সেটা। সারারাত বৃষ্টি পড়ছিল। না, তার অষ্টম গর্ভ রাতে হয়নি। সকাল সাতটা দশে এসেছিল সে। তার রঞ্জু।

    গলায় কর্ড জড়িয়ে একে তো যায় যায় হয়েছিল। তারপর রাখার সময় নার্স ঠিক ভাবে রাখতে পারেনি, কটের লোহায় বাড়ি লেগে রঞ্জুর তখন যমে মানুষে টানাটানি। ড. মৈত্র খুব যত্ন নিয়ে ফিরিয়ে এনেছিলেন তাকে। এদিকে রঞ্জু হবার তৃতীয় দিনের মাথা থেকে পাকতে শুরু করে সেলাই। মা-ছেলের বোধহয় আর দেখা হবার ছিল না, কিংবা ছিল হয়ত অন‍্য কোন দুনিয়ায়। দুজনেই একসাথে যায় যায় অবস্থা। মা কালীকে খুব মানত বীণা, সুলতাকে দিয়ে প্রসাদী ফুল আনিয়েছিল বীণা। ঠেকিয়েছিল ছেলের মাথায়, নিজের মাথায়। সেই বোধহয় বিদ্রোহের শুরু। পাঁড় বৈষ্ণব রুদ্রের বাড়িতে কালীভক্ত বীণা। রঞ্জু যতদিন ভগবানে বিশ্বাস করত, কালীভক্ত ছিল। তারপর বলত, "মা, মাটির মূর্তির কি ক্ষমতা বলো? ওরা যাদের সব আছে তাদের আরো দেয়। আর যে লোকগুলো খেতে পায় না তাদের?"

    বড় দয়ার শরীর ছিল তার ছেলের। কোনো কেউ না খেয়ে থাকলে হল! মাঝেমাঝে বলত, "মা, দেখো বড়দার ছেলেকে বিগবস একসপ্তাহে যা হাতখরচ দেয়, সুলতা মাসিকে তার আর্দ্ধেক টাকাও মাসমাইনে দেয় না!"

    হঠাৎ জড়িয়ে ধরত, কলেজ থেকে ফিরে এসে, "মা, খেয়েছো? শুকনো কেন মুখ?"

    সুলতা আর রঞ্জু ছাড়া আর কেই বা তার খেয়াল রাখত। প্রায় অনিয়ম করে। রুদ্রপ্রসাদ হয়তো সব বোঝে, বলে না কিছু। বিপ্লব আর তার ছেলে-বৌ নিয়ে বোধকরি তার সংসার। সুলতা হয়ত বলে, "খাইয়া লন বৌদি। আমি বাসনগুলা মাইজ‍্যা দি।"

    "খেয়ে নিয়েছি। তুই রান্নাঘর মুছে বাড়ি যা।"

    "বাসন লাই ক‍্যান আপনার? এমন কইরেন না। ছোটবাবুডাও চইল‍্যা গেল। আফনেও খাওন-দাওন ছাইড়া দেছেন।"

    "ছোটবাবু?! তুই তো রঞ্জুকে শুধু বাবু বলতিস?"

    "রঞ্জুবাবা তো আমারে কইত, সুলতামাসি বাবু বইল‍্যা আমারে কেডা ডাকে কইতে পারো? তুমি, মা আর বড়মা। কিন্তু কাল দাদাবাবু কইল, সুলতা রঞ্জু মারা গেছে। তুমি বিপ্লবকে এখন থেকে বাবু কবা।"

    "ওহ। তাই বল। আমার রঞ্জুকে একটা ঘরের মধ‍্যে আটকে রেখেও শান্তি নেই?! ও তো আর আসবে না ফিরে। মা বলবে না কোনোদিন।"

    লাশকাটা ঘরের ঠান্ডা বরফের চাঁইয়ের মধ‍্যে চোখ বুঝে ঘুমাচ্ছিল রঞ্জু। বেঁচে থাকলে সেদিন তিরিশে পড়ত সে।

    হাসপাতালের সাদা চাদরটা খামচে ধরেছিলেন বীণা। মাস্ক পরা ড. মৈত্রর মুখ কালো হয়ে আসছিল। সতেরোই আগষ্ট ছিল দিনটা। ঠিক যেমনটা হয়েছিল ২০১৬তে। সতেরোই আগষ্ট।

    ফোন এসেছিল রাতে।

    "তুফান কে হয় আপনার?"

    "তুফান?!"

    "হ‍্যাঁ। তুফান অ্যালায়েস রঞ্জন ভট্টাচার্য।"

    "রঞ্জু..."

    "আপনার ছেলে? একবার যাদবপুর থানায় আসবেন।"

    রুদ্র রিটায়ার করেছিল ডিসি হিসেবে। দ্রুত বিপ্লবকে নিয়ে লালবাজার ছুটেছিল সেরাতে। আর সুলতাকে নিয়ে বীণা গেছিলেন যাদবপুর থানায়। পোড়া দুধের গন্ধে নেশা লাগছিল সেদিন। সারারাত থানায় বসে সকালের দিকে পুলিশ জিপে চড়ে গেছিলেন নীলমাধব সেন লেনের পুলিশ মর্গে। শুয়ে ছিল রঞ্জু, বুকের কাছটাতে শুকিয়ে আসা কালচে গোল একটা দাগ। কপালের পাশে একগোছা আলগা চুল এসে পড়েছে। শান্ত বড় দুচোখ বুজে শুয়েছিল বরফের চাঁইয়ের উপর। ঠান্ডায় ধোঁয়া উঠছিল। মর্গ থেকে শ্মশান অব্দি সব কিছু যান্ত্রিক তৎপরতায় হয়েছিল। রুদ্রকে দেখতে পান নি বীণা কোথাও সেদিন। তবে পরে জেনেছেন রুদ্র অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ধামাচাপা দিয়েছিল সেদিন। টাকা পয়সা খাওয়াতে হয়েছিল। ধামাচাপা দিয়েছিল তার ছেলের মাওবাদী পরিচয় লুকিয়ে ফেলতে। টাকার বিনিময়ে সুবিধা পাওয়াকে ঘৃণা করতে থাকা ছেলেটার পরিচয় শ্মশান থেকে মর্গ অব্দি লোকানো গেছিল সেদিন।

    রঞ্জু বারবার বলত, "মা গ্র‍্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট করে নাও। আমার জন‍্য পরীক্ষা দিতে পারোনি, আমার খুব খারাপ লাগে।"

    "এই বুড়ি বয়সে কি হবে আর বল তো? তার চেয়ে তুই বরং পিএইচডি করা মেয়ে বিয়ে করিস।"

    "ধুসস।"

    বীণা জানত একটি মেয়েকে ভালোবাসত রঞ্জু।

    নীচে নেমে এলেন বীণা। রান্নাঘরে তোড়জোড় চলছে, তার মানে আজ আবার কিছু আছে বাড়িতে। পার্টি তো লেগেই থাকে প্রায়। বীণা জানেন না। জানতে চানও না আর। আজ মনে হল একবার খড়দহে যাবেন। ওখানের গঙ্গার ধারে গিয়ে বসবেন। রঞ্জু বাড়ি থাকলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। গঙ্গার ধারে গিয়ে বসে থাকত। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। একটা কালোপেড়ে ঘিয়েরঙা তাঁতের শাড়ি পড়েছেন। রঞ্জু মারা যাবার পর থেকে সেভাবে আর রঙিন শাড়ি পরতে মন হত না। বাড়ির গাড়িটা নিল না ইচ্ছে করেই। যাদবপুর স্টেশন থেকে ট্রেন ধরল একটা শিয়ালদহের। বেশ ভিড় আছে লেডিস বগিটাতেও। পেটের ব‍্যাথাটা বেশ বেড়েছে, আর গা-টা গুলিয়ে উঠল পার্ক সার্কাসের ওখানটায়।

    শিয়ালদহ নেমে একটা ফাঁকা ট্রেন পেয়ে গেলেন বীণা। জানলার ধারে সিট পেয়ে গেলেন। সকাল থেকে গুমোট হয়ে আছে আকাশ। বৃষ্টি নামার নামগন্ধ নেই। চোখ বুজে ভাবতে লাগল অঙ্কিতার কথা। একবার রঞ্জু আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। তখন এগারো ক্লাসে পড়ছে দুজনে। হঠাৎ বলল একদিন, "মা, একজনের সাথে দেখা করবে?"

    "কে রে? কার সাথে?"

    পিকুও ছিল তখন। মুচকি হাসছিল সে। সাইকেলে করে নিয়ে গেছিল সেই গঙ্গার ঘাটে।

    "এ হল অঙ্কিতা। আমাদের সাথেই পড়ে।"

    "আচ্ছা, তা বাড়িতে নিয়ে আয় একদিন। একদিন এসো রঞ্জুর সাথে বাড়িতে।" পরের কথাগুলো অঙ্কিতাকে বলা। মিষ্টি হেসে ঘাড় নেড়েছিল সে।

    ট্রেনটা ছাড়ল প্ল‍্যাটফর্ম। রঞ্জু আইআইটি ছেড়ে চলে যাবার পর একদিন দেখা করেছিলেন বীণা। সন্ধ‍্যা নেমে আসছে তখন। ইউনিভার্সিটি ফেরত অঙ্কিতার জন‍্য বসেছিলেন বীণা। পলাশ গাছটা সেদিন ফুলের ভারে নুইয়ে পড়েছে। ঝড় হয়েছিল বিকেলের দিকে। টিভির দোকানের টিভিতে খেলা চলছিল। শচীন দুশো করেছিল সেই ম‍্যাচে। কারেন্ট চলে গেছিল ঝড়ের পর, অসীমের দোকানে ইনভার্টার ছিল। কত ছেলে সেদিন খেলা দেখছিল। রঞ্জুও এভাবে খেলা দেখত বীণা জানেন। শচীনের কোনও ম‍্যাচ বাদ দিত না। বেশ খানিকক্ষণ পর অঙ্কিতাকে নামতে দেখেছিলেন লেডিস কামরা থেকে। বীণাকে দেখে চোখ কুঁচকে গেছিল সেদিন অঙ্কিতার।

    "একটু কথা ছিল তোমার সাথে।" কুন্ঠিত গলায় বলেছিল বীণা।

    "বলুন।"

    "চল কোথাও বসি। আমাদের বাড়ি যাবে?"

    "কেন? আশংকা করছেন মাওবাদীর মায়ের সাথে কথা বললে বিপদে পড়ব?" ঠান্ডা ছিল তার গলা।

    "না না, সেটা নয়। আমার কথা তো রঞ্জু শুনল না। দেখো না যদি তোমার কথা শোনে।"

    "দেখুন কাকিমা, আপনার ভুল হচ্ছে কোথাও। আমি মাধবীলতা নই, আর আপনার ছেলে অনিমেষ বা ব্রতী নয়। রঞ্জন আপনার ছেলে। সে আমার কেউ নয়। আমি আমার জীবনকে কারোর খামখেয়ালিপনার ওপর ছাড়তে পারি না।"

    মুখ কালো হয়ে গেছিল বীণার।

    "আমার এবার এসএসসিতে সিলেকশন হয়ে গেছে। বাড়িতে আসবেন কখনো মিষ্টি খেতে। আর রঞ্জুর সাথে আমার পাঁচ বছর কোনো যোগাযোগ নেই। ও অনেক কিছু বলেছিল শেষবার। বদল, বিপ্লব নিয়ে। কোথায় সেসব, দেখলাম না তো।"

    "ও তো বাচ্চা। বোঝেনা।"

    "বাজে কথা। যথেষ্ট বোঝে।"

    চলে গেছিল সেদিন অঙ্কিতা। প্ল‍্যাটফর্মের অল্প আলোয় প্রেতাত্মার মত বসেছিলেন বীণা। মনে পড়ছিল রঞ্জুর শরীর খারাপের কথা। সেবার টাইফয়েড হল। সন্ধ‍্যা থেকে শরীর খারাপ ছিল। কমলাদের বাড়িতে কিছু একটা পুজো ছিল। অফিস থেকে ফিরে রুদ্র গেছিল সেখানে। সে-রাতে ফেরেনি আর। মাঝরাতে খুব জ্বর বাড়ল। রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ ওই ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটেছিল বীণা। কতবার তো এমন হয়েছে। রুদ্রপ্রসাদ পুলিশের চাকরি সামলে বীণা-রঞ্জুকে সময় দিতে পারেনি। বীণা মেনে নিয়েছেন। স্কুলের প্রতিটা গার্জেন মিটিং, রঞ্জুর রুগ্ন শরীরের যত্ন, দায়দায়িত্ব একা মিটিয়েছেন। একার হাতে মানুষ করেছেন ছেলেকে। আদৌ করতে পেরেছেন নাকি ঋতুর মা যেমন বলত বিজয়কে, কাকার মত গুন্ডা হয়ো না। এসব অবশ‍্য রঞ্জু যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন চলত, রঞ্জুর না থাকা অবস্থায় তার কথা হত না কখনোই। মাঝেমধ্যে বীণার মনে হত রঞ্জু বলে কেউ ছিলো না হয়তো।

    খড়দহতে নামল তখন বেলা দশটা মত বাজে। খানিকক্ষণ বসে থাকল প্ল‍্যাটফর্মে। বেরতে গিয়ে দেখল লাইনে মন্টু রিক্সা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল বীণা।

    "বৌদি আপনি এদিকে?" প‍্যাডেলে পা দিল।

    "কেমন আছো?"

    "ভালো না বৌদি। বাজারের হাল খারাপ। স্কুল বাচ্চা নেওয়া ছেড়ে দিয়েছি। আর কি, বয়স হয়ে গেছে। বৌদি রঞ্জু কেমন আছে? বিয়ে দিলেন?"

    "রঞ্জু মারা গেছে মন্টু।"

    "কি?!"

    "জানতে না?"

    "না। কবে?"

    "২০১৬-র আগষ্টে।"

    অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল মন্টু।

    "আপনি যাবেন কোথায়?"

    গলাটা ভারী ঠেকল মন্টুর।

    "কোথাও না। গঙ্গার ধারে নামিয়ে দিও। আজ দুবছর হল তো। মনটা সকাল থেকেই খারাপ করছিল। তোমাদের খড়দহের কথা মনে পড়ছিল। বড্ড ভালোবাসত তোমাদের খড়দহকে।"

    "তা ঠিক বৌদি। তবে এখান থেকে ওকে না নিয়ে গেলেই পারতেন। কত্ত ভালো ছেলে ছিল। খড়দহতে অমন ছেলে কম এসেছে। কি করে হল বৌদি?"

    "সে অনেক কথা। আরেকদিন বলব।"

    "মনে আছে বৌদি, প‍্যান্টে পায়খানা করে ফেলেছিল একবার স্কুলে পড়তে। টুতে পড়ত বোধহয়।

    তারপর স্কুলের মিস বলল, "রঞ্জনের গার্জেন কে আছে?"

    আমি বললাম, "আমি।"

    আমার হাতে ধোওয়া কাপড়ের প‍্যাকেট আর রঞ্জনকে ধরিয়ে দিয়ে গেল। আমি স্কুল থেকে বেরিয়ে বললাম, "তোর গুয়ের প‍্যাকেট ধর।" আমায় বলে কি, "আমি পারব না, তুমি গার্জেন, তুমি ধর।" হাউ হাউ করে উঠল মন্টু, "আর আপনি বলছেন রঞ্জন নেই!" অবাক হয়ে ভাবে বীণা তার রঞ্জনের কতটুকরো কত দিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে তিনি জানতেনই না।

    রাস্তা ফুরিয়ে গেল এক সময়। মন্টু নামিয়ে দিয়ে প‍্যাডেলে চাপ দিতে লাগল। আস্তে আস্তে মন্টুর ছোট হয়ে আসা দেখতে লাগলেন বীণা।

    পেছন থেকে কেউ মনে হয় ডাকছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরতেই দেখলেন ভবতোষের চায়ের দোকান থেকে পিকু বেরিয়ে আসছে। ভবতোষ, নাকি মনতোষ মনে পড়ছে না ঠিক।

    "কাকিমা, তুমি এখানে?" হাতে চায়ের গ্লাসটা থেকে ধোঁয়া পাকিয়ে উঠছে।

    "এমনি রে। তোদের দেখতে মন হলো। ভালো আছিস?"

    "হ‍্যাঁ, আসছি দাঁড়াও। তুমি যাও না ভিতরে। চা খাবে?"

    "না না। চা খাবো না। তুই আয়।"

    গিয়ে বসল সিঁড়ির ধাপটাতে। কালো হয়ে আছে পশ্চিম আকাশ। দূরের গাছগুলো কেমন একটা। হাওয়া চলছে না, বেশ গুমোট লাগছে।

    হঠাৎ গলা পেয়ে সম্বিৎ ফিরে এল বীণার।

    "কাকিমা, কেমন আছো?"

    "ভালো লাগে নারে। বস এখানে। তুই কি করছিস?"

    "টিউশন করি। আজ ছুটি তাই এদিকে। আগে তো রঞ্জু আসত। আজকাল একাই কাটে।"

    "রঞ্জুটা যে কি করল।"

    "কাকিমা ব‍্যাপারটা মিটে গেছিল। রঞ্জুর সাথে আমার বহুবার কথা হয়েছে এ নিয়ে। শেষদিকে আমাকে বলত বেরিয়ে আসব পিকু। তুই আর্টস গ্রুপ পড়াস, আমি সায়েন্সটা পড়িয়ে দেব। তুই ব‍্যবস্থা কর। এমনকি ওকে যেদিন মেরে ফেলল, তার আগের সন্ধ‍্যায় এখানে বসে কথা হয়।"

    "এখানে এসেছিল রঞ্জু?" আর্তনাদ করে ওঠে বীণা।

    ২০০৭ থেকে ২০১০ অব্দি সেভাবে যোগাযোগ ছিল না ওর সাথে। বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-বর্ধমান বেল্টে মূলত কাজ করত। তবে এর মধ‍্যে অনেকটা সময় ও অন্ধ্রতে ছিল। স্টুডেন্ট হিসেবে ও দারুণ ছিল। তুমি তো জানোই কতবার তোমাদের খড়দহের বাড়িতে গেছি। আচ্ছা কাকিমা আর আসো না ওই বাড়িতে?"

    "না রে, প্রথম দিকে খুব মনখারাপ হত। ওই বাড়ির ছাদের বসার জায়গাটা, রান্নাঘর, পাশের বাড়ির বাবলিদের কথা তারপর সয়ে গেল আস্তে আস্তে। সব থেকে বড় কথা যাদবপুরের বাড়িতে কোনদিন সেভাবে রঞ্জু গেল না। আচ্ছা তারপর কি হল?"

    "তারপর একবার এল। দেখা করল, এখানে নয় হেদুয়া পার্কে। খুব চেঁচাল, বলল তুই বিপদের সময় পাশে থাকিসনি। আমি বললাম, ভয় পেয়েছিলাম। তাতে চুপ হল খানিক। তারপর আবার চেপে ধরল কেন ভয় পেয়েছি? তখন বললাম ওকে।

    "রঞ্জু আইআইটি ছেড়ে দেবার কিছুদিন পরের কথা। পুলিশ এল বাড়িতে। সন্ধ‍্যাবেলা। বাবা মা দাদা সবাই বাড়ি ছিল। ভয়ে সিঁটিয়ে গেল সবাই। ভয় লেগেছিল আমারও। একটা কথাই বলছিল যে রঞ্জু কোথায় গেল? ও যে ওদের ক‍্যাডারে যোগ দিল আমি কতটা জানি? প্রায় রাত দশটা অব্দি চলে এসব। বাড়িতে বকাবকি করে তারপর এসব নিয়ে। তবে সেসব নয়, আমি জানতাম আমাকে স্পাইং করা হচ্ছে। আমি বন্ধ করে দি যোগাযোগ। সে-রাতে অঙ্কিতাকেও জেরা করতে গেছিল পুলিশ।"

    "ওহ। তারপর?"

    "হেদুয়া পার্কে যখন দেখি রঞ্জুকে, ও তার আগে বিশাখাপত্তনমে ছিল। তার কিছুদিন পর থেকে শুরু হল অপারেশন গ্রীনহান্ট। সেসময় থেকে ওদের মধ‍্যেও শুরু হল ঝামেলা। ২০১১-এর নভেম্বরে কিষেণজি মারা যাবার পর দলে একঘরে হয়ে পড়ে রঞ্জু। আসলে শেষ ক'বছরে যেভাবে ওঠে সেটা সহ‍্য হয়নি অনেকের। দল ছেড়ে দেয় প্রায়। ফেরার চেষ্টা করে।

    "কাকুকেও অ্যাপ্রোচ করে। কিন্তু কোন কারণে আগের কথাগুলো ভুলতে পারেনি বা হয়ত ভুলতে দেয়নি।"

    "কি বলছিস কিছুই বুঝছি না তো!"

    "ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় রঞ্জু একবার থ্রেট দিয়েছিল কাকুকে। বিতানের বাড়ি যেত, বাড়িতে সময় না দিয়ে ওর মাকে সময় দিত।"

    "হে ভগবান। তখন থেকে বোধহয় ওরা কথাও বলত না।"

    "রঞ্জু খড়গপুর গেলে সবচেয়ে খুশি হয়েছিল বিতানরা আর ওর কাজিন, যে তোমাদের বাড়ি থাকে। ওরা জানত রঞ্জু না থাকলে লাভ ওদের। রঞ্জু জানত কার কোথায় লাভ। ও বলত, বিতান টাকা নেবে বিগবসের থেকে ব‍্যবসার জন‍্য। আর বড়দা বসে আছে বাড়িটা নেবে। হাসত বলে। বলত বিগবস ভাবে ওই বাড়ির লোভ দেখিয়ে আটকাবে আমায়।

    "পরের দিকে কান্নাকাটি করত। বলত ভুল করেছি রে।

    "শেষ যেবার দেখা হল, মানে যেদিন মারা গেল তার আগের রাতে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করল। স্কুলের কথা, অঙ্কিতার কথা, বাড়ির কথা বলছিল। রাত হয়ে এল। বললাম থেকে যা।

    "বলল, 'না রে। যাই। তোকে আর মাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারতাম যদি কোথাও। জানিস তো মা পায়েস রাঁধবে আজ। বহুদিন পায়েস খাই না রে।'

    "হাসছিল সেদিন। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছিল। একটা হলুদ পাঞ্জাবি পরে এসেছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, 'পিকু, মানুষের জীবন আসলে সব টুকরো স্মৃতির কোলাজ। তুই, মা, বিপ্লব সবার কাছে থেকে যাব। একদিন হয়তো থাকব না, তোদের কাছে সেদিনও থাকব আমি। তারপর ভুলে যাবি একদিন।' চলে গেছিল সেদিন। তারপর খবর পাইনি আর। মোবাইল তো ইউজ করত না। দেখাও পাইনি।"

    বৃষ্টি নামল। নাটমন্দিরে সরে এল দুজনে। চট করে হাতঘড়িটা দেখে নিল বীণা। বারোটা ছত্রিশ।

    সারারাত বসে ছিলেন থানায়। সকালে রিক্সা করে মর্গে গেছিলেন। সাদা বরফের চাঁইয়ের উপর পরম মমতায় শুয়েছিল রঞ্জু। ছোটবেলায় গল্প না শুনলে ঘুম আসত না যে ছেলের, সে কতগুলো বছর এভাবেই কাটিয়ে দিল। পাশে দাঁড়ানো ডোমটা সাদা কাপড়টা সরিয়ে দিল। মুখ দিয়ে ভকভক করে মদের গন্ধ আসছে।

    "মাইজি, আইয়ে।" আলগোছে বলল। আজ থেকে এই ডোমটারও মাইজি তিনি; শুধু রঞ্জু ছুটে এসে আর বলবে না, মা ভাত দাও।

    পিকু আবারও বলল, "পরে ভবতোষদার দোকানে শুনেছি, বিতান বলছিল সেদিন নাকি ফেউ লেগেছিল খড়দহ থেকে। বিপ্লবদা সকালে বসে প্ল‍্যান ছকে নিয়েছিল। সারাদিন হাসি গল্পে কাটিয়ে দেয়। বিকেলে ওর বাইকটা দেয় চালাতে। সেটা নিয়ে খড়দহে আসে রঞ্জু। বিপ্লবদা পুলিশকে দেয় নম্বরটা, আর এদিকে বিতান। হঠাৎ খড়দহ হাইওয়েতে বাইকটা চিনে যায়। চা খেতে দাঁড়িয়েছিল হয়ত। বিতান আর ওর আরেক বন্ধু মধু বাইকে পুরো ফলো করতে করতে যায়। খড়দহ হাইরোড থেকে, সাথে মোবাইল আপডেট দিতে থাকে। যাদবপুরে তোমাদের পাড়ায় ঢোকার মুখে ঘটনাটা ঘটে। খুব সম্ভবত কাকুকে এর বিন্দুমাত্র জানায়নি ওরা।

    "সেদিন বাড়ি যেতে গিয়েও ফিরে এসেছিল রঞ্জু। একটা বই হাতে দিয়ে বলল, রাখ এটা। দি মোটরসাইকেল ডায়েরীজ। পরে দেখেছি বইটার পঞ্চাশ পাতায় পেনসিলে লেখা 'আমি জানি হয়ত আর দেখা হবে না। পায়েসটা আজ মিস করা যাবে না রে। মাকে দেখিস।'

    "কি বলা যায় একে জানিনা। সুইসাইড নাকি মার্ডার?!

    "ওহ পঞ্চাশ পাতায় একটা চ‍্যাপ্টার শুরু হচ্ছিল বইতে। নাম 'ডিয়ার মামা', মাকে লেখা চে'র চিঠি।"

    বীণা থম মেরে গেলেন।

    "জল খাবে? শরীর খারাপ করছে কাকিমা?" কিছু বললেন না বীণা। পিকু ভবতোষের দোকানে গেল, জল আনতে বোধহয়।

    বীণা উঠে এলেন মেইনরোডের উপর। সদ‍্য স্কুল ছুটি হয়েছে। সাদা জামা লাল হাফ প‍্যান্ট, পিঠে ব‍্যাগ, গলায় জলের বোতল নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে রঞ্জু। থ্রিতে পড়া রঞ্জু। আর একটা ফুল পাঞ্জাব লরি ছুটে আসছে। রঞ্জু লরিটাকে খেয়াল করছে না। হাসতে হাসতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। বীণা ছুটে গেলেন, ঠেলে দিলেন রঞ্জুকে কিন্তু পড়ে গেলেন। সব অন্ধকার হয়ে আসছে, পেটের ব‍্যথাটা আর নেই।

    "রান ওভার করে দিয়েছে রে।" ভিড় থেকে কে বলল একটা। ভিড় জমে গেছে। রঞ্জু অবাক হয়ে দেখছে তাকে। অন্ধকার নেমে এল।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)