অশোকের আলমারিটা হাট করে খোলা। কিং-সাইজ বেডের ওপর ছত্রাকার হয়ে পড়ে আছে পুরনো বিল, ক্রেডিট কার্ড স্টেটমেন্ট, ব্যাঙ্কের পাস বই ইত্যাদি। আধঘণ্টা আগেও মধুরিমা আজকের কিটি পার্টির জন্য জম্পেশ সাজগোজের প্ল্যানে ব্যস্ত ছিল। এখন পাথরের মূর্তির মত নিশ্চল হয়ে খাটের একপাশে পা ঝুলিয়ে বসে সে সামনের বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে ব্যথা নেই, নালিশ নেই, প্রশ্ন নেই, আছে শুধু শূন্যতা আর জ্বালা।
উজ্জ্বল হলুদ সবুজ ফুল ছাপ জর্জেট শাড়িটা পরা হয়ে গিয়েছিল তার, কানে এখনও সবসময়ের দুটো হীরের ফুল, জর্জেট শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং বার্সিলোনার ঝোলা দুলটা পরা হয়নি, বাঁ-হাতে লোহা বাঁধানো, ডান হাতের চুড়িটা খুলে রেখেছে, হয়তো সাদা ব্যান্ডের অ্যাপেল-ওয়াচটা পরত।
কাগজের ঢিপির পাশেই মধুরিমার নতুন কেনা ইটালিয়ান ক্লাচটা চেন খোলা অবস্থায় পড়ে, ক্লাচের ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে এক জোড়া মোটা সোনার বালা। এই সোনার বালা জোড়াই কালপ্রিট। না না বালা জোড়ার বিলটা আসল কালপ্রিট। যা খুঁজতে গিয়ে এত বড় সর্বনাশ হল মধুরিমার। সর্বনাশ ছাড়া আর কী, বিশ্বাসের ভিত নড়ে যাওয়ার মত সর্বনাশ জীবনে আর কী আছে!
শোয়ার ঘরের দেওয়াল জোড়া কাঁচের জানালা বন্ধ, তবু ফিনফিনে সাদা লেসের পরদা ফ্যানের হাওয়ায় মৃদু মৃদু উড়ছে। গতকাল ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা হলুদ গ্ল্যাডুলারা এখনও সতেজ, টিভি স্ট্যান্ডের ওপর লাফিং বুদ্ধর মুখের হাসি এতটুকু ম্লান হয়নি। শুধু মধুরিমার সুন্দর মুখটা লজ্জায় অপমানে ফ্যাকফ্যাকে সাদা দেখাচ্ছে।
ঘরের যেদিকে তাকাও শুধু বৈভবের চিহ্ন। তার মধ্যে মধুরিমা বসে আছে এক ভিখারিনির মত, আধঘণ্টা আগেও যার আচরণে ছিল সম্রাজ্ঞীর অহংকার। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মধুরিমা, সে দেখেও কিছুই দেখছে না, শুনেও কিছুই শুনছে না, শুধু ভাবছে। গত আধঘণ্টায় যা ঘটে গেল তা মধুরিমার কীভাবে গ্রহণ করা উচিত?
কিটি পার্টি থেকে বন্ধুরা ক্রমাগত ফোন করে চলেছে, মধুরিমার দু-হাত ব্যবধানে ফোনটা বাজছে তো বাজছেই, কিন্তু সে বধির হয়ে গেছে যেন। বধির নয়, আসলে শারীরিকভাবে উপস্থিত হয়েও মধুরিমা এখনএই ঘরে নেই। সে দাঁড়িয়েছিল পাহাড় চুড়োয়, অতর্কিতে ধাক্কা দিয়েছে কেউ। পড়ে যাচ্ছে সে। একটা ঢিলের মত সটান পড়ে যাওয়া নয়, পাখির পালকের মত ভাসতে ভাসতে সে নেমে আসছে, একটু একটু করে নীচে, আরও নীচে, আরও আরও। স্মৃতি সমুদ্রের তলদেশে জমে আছে কত কথা, এমনকি সে যখন মুড়কি ছিল সেই সব দিনেরও।
অপমানে জ্বলতে জ্বলতে পুরনো কথামালা উল্টেপাল্টে দেখছে মধুরিমা —
বড় নালাটার ওপর একটা সরু কাঠের তক্তা পাতা, ওটাকেই সবাই সাঁকোর মত ব্যবহার করে। বড় নালার পাশ দিয়ে চলে গেছে বাস রাস্তা। বাস রাস্তার ধার দিয়ে একতলা দোতলা পরপর পাকা বাড়ির সারি। পাকা বাড়িগুলোর মাঝ দিয়ে ভিতরে ঢুকে, ঘোষ-পাড়া নন্দী-পাড়া পিছনে রেখে, গার্লস-স্কুল বয়েজ-স্কুল ছাড়িয়ে মিনিট দশেক হাঁটার পর আর পাকা বাড়ি নেই, টিনের-চাল টালির-চাল দরমার-বেড়ার ঘরগুলো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। ওখানেই একটা টিনের চালের বাড়িতে ভাড়া থাকতো মুড়কিরা, আর পাশের টালির চালের ঘরে নেড়ুরা। নেড়ুর খুব পছন্দ ছিল মুড়কিকে, সারাক্ষণ মুড়কির পায়ে পায়ে ঘুরতো।
সেই মনে পড়ছে, দু-দিকে দু-হাত ছড়িয়ে ব্যালেন্স করে, পা টিপে টিপে মুড়কি এগোচ্ছে কাঠের তক্তার ওপর দিয়ে, আর পিছন থেকে ‘মুড়কি যাসনি, মুড়কি যাসনি’ বলে নেড়ু সমানে চেঁচাচ্ছে। ব্যালেন্স হারানোর ভয়ে নীচের ঠোঁটকে ওপরের দাঁত দিয়ে সজোরে কামড়ে ধরে রেখেছে মুড়কি, একটু এদিক ওদিক হলেই তো চিত্তির, নালার জলে ধপাস!
সরু কাঠের তক্তার নীচ দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে কালো থিকথিকে দুর্গন্ধময় নালার জল। ওই নালার জলে পড়ার ভয়ে নেড়ু সাঁকো পার হতে চায় না। অবশ্য নেড়ু, মুড়কি এরা নিজেরাই যেন কত ফুটফুটে! দুজনেরই পোশাক মলিন, রং চটা, জায়গায় জায়গায় সেলাই খুলে গেছে, বোতাম ছেঁড়া, সেফটিপিন দিয়ে তা আটকানো। নাকের নীচে শুকনো সিকনির দাগ, পায়ে কাগজের মত পাতলা হয়ে যাওয়া পুরনো ধুলো মাখা হাওয়াই চপ্পল, মাথার চুলে গুঁড়ি গুঁড়ি সাদা উকুনের ডিম। উকুন অবশ্য নেড়ুরই বেশি, তার তেল জবজবে চুলের ওপর দু-চারটে উকুন সবসময়ই বিন্দাস ঘুরে বেড়ায়।
নেড়ুর সাবধানবাণী মুড়কি শুনেও শোনে না, সে পা টিপে টিপে পুরো সাঁকোটা পার হয়ে শেষে একটা বড় লাফ মেরে নালার এপারে চলে আসে। মুড়কি সাঁকো পার হয়ে গেল দেখে ওপারে শুকনো মুখে নেড়ু হাতের লাট্টু ঘোরাতে ঘোরাতে উল্টোদিকে হাঁটা দেয়।
বড় নালার এদিকটা খুব শুনশান, চারপাশ আগাছায় ছেয়ে আছে, লোকজনের বাস কম। যে দু-চার ঘর বাস করে, তাদের অধিকাংশই বাগদী। আগাছার মাঝ দিয়ে একটা পায়ে হাঁটার সরু কাঁচা রাস্তা চলে গেছে এঁকেবেঁকে।
কাঁচা রাস্তাটা ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে বাঁ-দিকে ঘুরে মিনিট পনেরো হাঁটলেই সেই আশ্চর্য দেশ এসে যায়, যার জন্য নালার নোংরা জলে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও মাঝেমধ্যেই মুড়কি সাঁকো পার হয়ে এদিকে আসে। কাঁটাঝোপ, খেসারিক্ষেত, অড়হর ডালের গাছগুলো পেরিয়ে গেলে হঠাৎই এক ধুধু সবুজ প্রান্তরের দেখা মেলে, সেখানে শুধুই ঘাসফুল ফুটে আছে, কত যে রঙের বাহার তাদের! লাল, সাদা, নীল, হলুদ, কমলা, বেগনে ঘাসফুল চারপাশে। আর সেই ঘাসফুলেদের মাঝে উড়ছে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রজাপতি। নীল আকাশের নীচে, উন্মুক্ত সবুজ প্রান্তরে, প্রজাপতিরা নাচছে উড়ছে, আপন বিভায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
উড়ে যাওয়া প্রজাপতির ফিনফিনে ডানায় রামধনুর সাত রঙের খেলা দেখে মুড়কির ভিতরটা এক অদ্ভুত ভালোলাগায় শিরশির করে, মনে হয় সে যেন তার চেনা পৃথিবীর বাইরে এক স্বপ্নের দেশে এসে পড়েছে। প্রজাপতির পিছন পিছন মুড়কি দৌড়োয়, ছুটে এগিয়ে যায় হলুদ ফুলের ওপর ডানা মুড়ে বসে থাকা হলুদ প্রজাপতিটার পাশে, কচি আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চায় ডানার রং। প্রজাপতিটা উড়ে যায় হলুদ ফুল থেকে লাল ফুলে।
বারংবার চেষ্টায় কখনসখনও মুড়কি সার্থক হয় বৈকি। তার দুই হাতের তালু দিয়ে তৈরি কোটরে বন্দী প্রজাপতি তখন ফড়ফড়িয়ে বেরোনোর ফাঁক খোঁজে। মুড়কি প্রাণপণে তর্জনীর সঙ্গে মধ্যমার, মধ্যমার সঙ্গে অনামিকার, অনামিকার সঙ্গে কনিষ্ঠার ফাঁক ন্যূনতম করার চেষ্টা করে, সেই চেষ্টার অবসরে ধরা পড়া প্রজাপতি তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের অপেক্ষাকৃত বৃহৎ ফাঁক দিয়ে ফুড়ুৎকরে শূন্যে উড়ে যায়।
কোন কোনদিন দুর্ঘটনা ঘটে, হাতের তালুর চাপে প্রজাপতিটা মরে যায়। সে নিজে দুর্ঘটনার কারণ হওয়ার অপরাধে অনুশোচনায় ভোগে। তবু সে বিরত হয় না, অপার কৌতূহলে মৃত প্রজাপতিকে উল্টেপাল্টে দেখে, সৃষ্টিকর্তার কারিকুরি মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে।
প্রজাপতির ডানা দুটো যেন মুড়কির বাবার ছবি আঁকার ক্যানভাস, প্রকৃতি সেখানে আপন খেয়ালে বিচিত্র সব নকশা এঁকেছে। কত রকমের নকশা, কত রকমের রঙের মেলবন্ধন! দেখতে দেখতে মুড়কির নেশা ধরে যায়, তাকে যেন প্রজাপতি পেয়ে বসে।
সেরকমই বলেছিল মুড়কির মা অনিতা। প্রজাপতির প্রতি মুড়কির এই বাড়াবাড়ি রকমের আকর্ষণ দেখে অনিতা বলেছিল, মানুষকে ভূতে পায়, ভগবানে পায়, তোকে যেন প্রজাপতিতে পেয়েছে!
পাঁচ বছরের মুড়কি এখন পনেরো বছরের মধুরিমা, সে বড় হয়েছে, তবু প্রজাপতিতে পাওয়া তার আজও গেল না। পনেরো বছরের মধুরিমা আর নালা পেরিয়ে বাগদীপাড়ায় প্রজাপতি দেখতে যায় না। কিন্তু স্কুল লাইব্রেরি থেকে এনসাইক্লোপিডিয়া নিয়ে প্রজাপতির ইতিহাস পড়ে, পাতায় পাতায় দেশ বিদেশের প্রজাপতির ছবিতে মগ্ন হয়ে যায়।
মধুরিমা পড়েছে, সবুজ পাতার ওপর একরত্তি ডিম ফুটে লার্ভা বার হয়, সে এক কিলবিলে ঘিনঘিনে শুঁয়োপোকা। সময়ের সঙ্গে লার্ভার অভ্যন্তরে রূপান্তর ঘটে, লার্ভা পরিবর্তিত হয়ে যায়, খুঁজে পায় এক বর্ণময় রূপ, যার নাম প্রজাপতি, যে চিরবসন্তের প্রতীক।
মধুরিমা আরও পড়েছে, প্রজাপতি জন্মের সেই অদ্ভুত ব্যখ্যা। বাটারফ্লাই ও ক্যাটারপিলার, এ যেন একই দেহে দুই প্রজাতির বাস, একই দেহ যেন যুগ যুগ ধরে দুই প্রজাতির জিন সমষ্টি বহন করে চলেছে।
ধরা যাক, জিন-এ যেন ক্যাটারপিলার জীবনের জন্য দায়ী, এবং জিন-বি তার রঙিন হয়ে ওঠার কারণ। ডিম ফোটার পর লার্ভার শরীরে জিন-এ সক্রিয় থাকে, তাই ক্যাটারপিলার রূপ। লার্ভা গোগ্রাসে পাতা খেয়ে বড় হয়, গুটি বাঁধে, গুটির ভিতরে ঘটে যায় সেই ছুমন্তর খেলা, এক আশ্চর্য ম্যাজিক, জিন-এ ঘুমিয়ে পড়ে, জেগে ওঠে জিন-বি। জিন-এ থেকে জিন-বি, ক্যাটারপিলার থেকে প্রজাপতি।
প্রজাপতি নামের প্রজাতি ফিরে পায় নিজেকে, গুটি ভেঙে উড়ে যায় শূন্যে, ফিনফিনে রঙিন ডানা মেলে। শুরু হয় সাথীর খোঁজ, সঙ্গমের উদ্দেশ্যে, কালের প্রবাহে আপন অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে। সার্থক সঙ্গমের পর এজন্মের মত পুরুষ প্রজাপতির কাজ শেষ, স্ত্রী-প্রজাপতির কাজ শেষ হয় ডিম্ব প্রসবের পরে।
মুড়কিরা কোনদিনই বড়লোক ছিল না, আবার বস্তিবাসীও নয়, তাদের অবস্থা ছিল সাধারণ কিন্তু সম্মানের। মুড়কির বাবা আর্টিস্ট ছিলেন, পেন্সিল আর চারকোল দিয়ে ছবি আঁকতেন। অনিতা সাধারণ ঘরের মেয়ে ছিল, বাড়ির অমতে নিম্ন জাতের ছেলেকে বিয়ে করে।
বিয়ের পর তারা ভালোই ছিল। আর্টিস্ট স্বামী, আয় কম। তবে অনিতা গুছুনে স্বভাবের, সংসার ঠিকই চলে যেত। মুড়কির দেড় বছর বয়সে অনিতার জীবনে সেই বিপর্যয়টা ঘটে, তার আর্টিস্ট স্বামী হঠাৎ রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। এলেবেলে গল্পের নায়িকার মত ক্লাস টেন পাস অনিতা পড়ে অথৈ জলে। প্রথমদিকে দু-চারজন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, তবে তা ছিল অনিয়মিত। ক-দিন যেতেই অনিতা বোঝে, পরের সাহায্যের ওপর নির্ভর করে একটা গোটা জীবন নির্বাহ করাঅতি দুরূহ ব্যপার।
দু-বছরের মুড়কিকে নিয়ে এই নিম্নমধ্যবিত্ত পাড়ায় অনিতা এক নিম্নমানের ভাড়াটে হয়ে চলে আসে। একটা মাত্র ঘর, সেখানেই মা-মেয়ের সংসার, বারান্দার কোণে রান্নার ব্যবস্থা, কমন কলঘর টিউবওয়েল। ব্লাউজের দোকানে কাজ করে, শাড়িতে ফলস লাগিয়ে যা দু-পয়সা হত, তাই দিয়েই টেনেটুনে সংসার চালাতো অনিতা।এই একটা ঘরের মধ্যে শুধু ডাল-ভাত খেয়ে দু-বছরের মুড়কি পনেরো বছরের মধুরিমা হয়ে গেল।
মধুরিমা ভাবে, জ্ঞান হওয়া থেকেই এই আধো অন্ধকার উঠোন, শ্যাওলা ধরা কলতলা, কাদা প্যাচপ্যাচে গলি সে দেখে আসছে, এই জীবনে এটুকুই কি তার জন্য বরাদ্দ?
তাদের টিনের চালের ঘরে একটাই জানালা, সেই জানালার শিকে মুখটা ঠেসে মধুরিমা বাইরে তাকিয়ে ছিল, আনমনে ভাবছিল প্রজাপতির জীবনচক্র। জিন-এ থেকে জিন-বি, ক্যাটারপিলার থেকে প্রজাপতি, সরু গলির টিনের চালের ঘর থেকে আলো ঝলমলে সাজানো ফ্ল্যাট, রেশনের চালের গলা ভাতের পরিবর্তে বাসমতী চালের বিরিয়ানি, আশা-স্টোর্সের সালোয়ার কামিজের জায়গায় ব্র্যান্ডেড পোশাক, সবই সম্ভব যদি সেই আশ্চর্য ম্যাজিক শেখা যায়, যদি সেই ছুমন্তর খেলার মন্ত্রটা জানা যায়!
মধুরিমার মনে হয়, সে পেয়ে গেছে সেই আশ্চর্য ম্যাজিক দণ্ডের খোঁজ। মেয়েকে ছোট থেকেই অনিতা পইপই করে বলে, মন দিয়ে লেখাপড়া করো, ভালো রেজাল্ট হয় যেন, ভালো কলেজ থেকে পাশ করলে সহজেই চাকরি পেয়ে যাবে, তখনই মুক্তি মিলবে এই নরক থেকে।
ছোটবেলায় এই টিনের চালের আস্তানাকে মুড়কির মোটেও নরক মনে হত না, ছেঁড়া জামা নিয়ে তার কোন দুঃখই ছিল না, নেড়ুর সঙ্গে পাড়ায় পাড়ায় ঘোরাতেই কত আনন্দ ছিল। কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনিতার কথাগুলো তার মনে ধরেছে, আজকাল সেও এই আধো অন্ধকার উঠোন, শ্যাওলা ধরা কলতলা থেকে বেরোতে চায়।
এমনিতে সে ভালো ছাত্রী, সাধারণ স্কুলে সাধারণ ছাত্রীদের মধ্যে বরাবরই ফার্স্ট হয়। এখন চ্যালেঞ্জটা অন্যরকম, সাধারণ স্কুল থেকে অসাধারণ রেজাল্ট চাই মধুরিমার।
গল্পের বই, সিনেমা, নাওয়াখাওয়া ভুলে মধুরিমা ডুব দেয় অধ্যয়নে, সে পড়তে থাকে, পড়তেই থাকে, দশবার পড়া বিষয় একশোবার পড়ে। গণিত পদার্থবিজ্ঞান রসায়ন শাস্ত্র, আবার রসায়ন শাস্ত্র পদার্থবিজ্ঞান গণিত, এই তিনের মধ্যে মধুরিমা ঘুরতে থাকে, ঘুরতেই থাকে। অবসরে এনসাইক্লোপিডিয়ার পাতা ওলটায়, নানা জাতের প্রজাপতির ছবি দেখে।
সাধারণ স্কুল থেকে সত্যিই অসাধারণ রেজাল্ট করেছিল মধুরিমা, জয়েন্ট এন্ট্রান্সও ক্লিয়ার হয়ে যায় হৈ হৈ করে, এক নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ইলেক্ট্রনিক্স শাখায় ভর্তি হয় সে, শুরু হয় মধুরিমার জীবনে পরিবর্তনের পালা।
সে সরু গলিতে থেকেও সেখানে না হয়ে থাকতো। সকাল আটটার মধ্যে কলেজের জন্য বেরিয়ে যেত, লাইব্রেরিতে পড়া সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ন-টা হত। টিনের চালের ঘরখানা ছিল শুধু তার রাতের আশ্রয়।
বছরখানেকের মধ্যেই গলি, গলির মানুষজন, তাদের যাপন গল্পের সঙ্গে মধুরিমার যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে পড়লো।
নেড়ু সেই আগের মতই মধুরিমার পাশ ঘেঁষতে চায়। নেড়ুকে আর মধুরিমা পছন্দ করে না এমনও নয়, তবু নেড়ুর সঙ্গে মধুরিমার আর জমে না। আসলে একই পাড়ায় পাশাপাশি ঘরে থেকেও দুজনের পৃথিবী এখন ভিন্ন গোলার্ধে।
ছুটির দিনেও মধুরিমা ঘর থেকে বেরোতে চায় না। চারপাশের আবাল্য-পরিচিত মানুষগুলোকে আজকাল কেমন অপরিচিত লাগে, তাদের ভাব-ভাষা কোনটার সঙ্গেই মধুরিমার আর মেলে না। অন্যদিকে, কলেজের অভিজাত পরিবেশে, ঝকঝকে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে, মেধাবী ছাত্রী মধুরিমা সহজেই মিশে যায়, সেখানে সে যেন জলের মাছ। কলেজে মধুরিমার বেশ কয়েকজন বন্ধুও হয়ে গেল, তার মধ্যে দু-জন আবার পুরুষ। এরা সবাই জানতো মধুরিমা কোন স্কুলের ছাত্রী, কোথায় তার বাস। কিন্তু অল্প বয়সের ধর্ম অনুযায়ী কেউই মধুরিমার ঠিকুজি-কুষ্ঠি নিয়ে মাথা ঘামাত না, বরং কেউ কেউ মধুরিমাকে রীতিমত হিংসে করতো।
একদিন ঈশিতা বলেছিল, গুল মারিস না তো, কোথাও না শিখেই এত ভালো তেল রং করতে পারিস?
পাশেই সিদ্ধার্থ ছিল, হা হা করে হেসেছিল, “মধু যদি তোর মত পাঁচ বছর বয়স থেকে আঁকা শিখতো, এতদিনে সিওর ভ্যানগগের বাজার পড়ে যেত।”
কলেজের গল্প শুনে অনিতা বলেছিল, “ও মা, ওরা তোকে মধু বলে ডাকে? তোর মুড়কি নামটা বলিসনি ওদের?”
উত্তরে মধুরিমা গা মুচড়েছিল, “মুড়কি নামটা খুব গেঁয়ো।”
অনিতা হেসেছিল, “তা কেন, তুই ছোটবেলায় খুব মুড়কি খেতে ভালবাসতিস, তাই তোর বাবা ওই নামে ডাকতো তোকে।”
মৃত বাবার প্রসঙ্গে মধুরিমা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। আজকাল সে বোঝে তার বাবা অসময়ে মারা গিয়েছিলেন তাই, নাহলে বালিগঞ্জের রত্নার সঙ্গে গুণগত বৈশিষ্ট্যে মধুরিমার কোন তফাৎ নেই। রত্না নিজেই বলেছিল, “সিল্কের শাড়ির তোর অত দরকার নেই মধু, ছাপা শাড়িতেই তুই কত সুন্দরী!”
আসলে, রত্না খুব ফরসা বেঁটে গোল মত, তাই লম্বা ছাড়ানো চেহারার মধুরিমাকে দেখলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলত।
একদিন লাইব্রেরির নিরালায় অশোকও বলল, “ফিগারটা যা বানিয়েছ না বস!”
মধুরিমা জিজ্ঞাসা করেছিল, “তাই?”
তাই অশোকের সঙ্গে বন্ধুত্বটা ক্লাস ফ্রেন্ড থেকে গড়িয়ে গেল ক্লোজ ফ্রেন্ডে। আর পুরুষ ক্লোজ ফ্রেন্ডের সঙ্গে ক্লোজ দরজার ওপারেও কিছু সম্পর্ক থাকে, চুমুর মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ রেখেছিল মধুরিমা।
অশোক স্বভাবে বড় দামাল ছিল, চশমার ওপরের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে বলেছিল, “ওকে, ওনলি কিস, রাইট? কিন্তু চুমু শুধু ঠোঁটে খেতে হয় এমন কথা তো মহাভারতে লেখা নেই।”
হাতের মোটা বইটা অশোকের দিকে তাক করতেই বত্রিশটা দাঁত বার করে অশোক হেসেছিল, “আমি তো কপালে চুমু খাওয়ার কথা বলছিলাম, তোরই খালি খারাপ খারাপ চিন্তা।”
ক্লোজ ফ্রেন্ড হলেও অশোক সম্পর্কে ফাইন্যাল ডিসিশনটা কিছুতেই মধুরিমা নিয়ে উঠতে পারছিল না, সেসময় হঠাৎই অশোককে বাইপাস করে অশোকের মা বসুধা এসে সামনে দাঁড়ায়।
সেদিন অফ-পিরিয়ডে মধুরিমা আর অশোক ডিপার্টমেন্টের পিছনের লনে বসেছিল। পিছনের লনটা ছিল বেশ নিরিবিলি, সুন্দর, সবুজ ঘাসে ঢাকা, চারদিকে রংবেরঙের মরশুমি ফুলের কেয়ারী। ঘাসের ওপর পা মুড়ে বসেছিল মধুরিমা, তার পাশেই অশোক ছিল আধশোয়া অবস্থায়। কোথা থেকে একটা ফড়িং এসে ওদের দু-হাত তফাতে ঘাসের ওপর বসে।
ফড়িংটাকে দেখে অশোক ঠোঁটে আঙুল রেখে বলে, “চুপ।”
তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে যায় ফড়িংটার দিকে, দক্ষ হাতে তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের সাহায্যে ধরে ফেলে ফড়িংয়ের দুটো ডানা। বন্দী ফড়িং ছটফটিয়ে ওঠে, অশোক হাত উঁচু করে নীল আকাশে উড়িয়ে দেয় ফড়িংটাকে।
অবাক হয়ে অশোকের কাণ্ড দেখছিল মধুরিমা। ফড়িংটা উড়ে যেতে সে জিজ্ঞাসা করে, “ওটাকে ধরলি কেন?”
অশোকের চোখে তখন অন্যমনস্কতা, “আই লাভ ইটস ফ্র্যজিলিটি, ওই ফিনফিনে ডানা দেখলে গা-টা কেমন শিরশির করে।”
মধুরিমার অবাক ভাব উধাও হয়ে গলায় উত্তেজনা, “আর প্রজাপতি?”
অশোক হাসে, “আমি তো প্রজাপতিদের মধ্যেই বাস করি রে!”
মধুরিমার ভুরু কুঁচকে যায়, “মানে?”
অশোক ব্যখ্যা করে—
অশোকের-মা বসুধা একজন আর্টিস্ট, ছবি আঁকেন। গত পনেরো বছর ধরে উনি শুধু প্রজাপতির ডানার ছবি এঁকে চলেছেন। মৃত প্রজাপতির সংরক্ষণশালা থেকে প্রজাপতির ডানার ছবি সংগ্রহ করেন। তারপর সেই ছবি বহুগুণ ম্যাগনিফাই করে মডেল বানান। প্রকৃতির তুলির টানের আঁকিবুঁকি, তার ডিটেইলস, সাত রঙের মেলবন্ধন, আপন তুলি দিয়ে ক্যানভাসের বুকে ধরে রাখেন।
বসুধার গল্প শুনে মধুরিমা জিজ্ঞাসা করেছিল, “তোর মা বুঝি প্রজাপতি ভালোবাসে?”
অশোক হেসেছিল, “ভালোবাসে মানে? চব্বিশ ঘণ্টা প্রজাপতির ডানার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে মা নিজেই বোধহয় এক প্রজাপতি হয়ে গেছে, ডানা দুটো গজানোই যা বাকি।”
অশোকের কথা শুনে মধুরিমা বুঝে যায় তার ভবিতব্য, অশোক সম্পর্কে যে ফাইন্যাল ডিসিশনটা নিয়ে হোঁচট খাচ্ছিল সে, এক লহমায় সেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে নেয়।
চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে মধুরিমা, নাহ দুপুর তিনটের সময় ডিপার্টমেন্টের পিছনের লন একদমই ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই। সে আর দেরি করে না, অশোকের দাড়ি ভর্তি গালে টপ করে চুমু খায়, একবার, দুবার, তিনবার।
বিস্ময়ে হতবাক অশোক ডান হাত দিয়ে বাঁ-গাল চুলকে বলে, “এটা কি হল, নিজে থেকেই তিনটে, তাহলে রাজি?”
মধুরিমা মাথা ঝাঁকায়, “রাজি, রাজি, রা-জি।”
অশোক বলে, “হঠাৎ? গত পাঁচ মাস ধরে যে ল্যাজে খেলাচ্ছিলি বড়?”
মধুরিমা ভ্রুভঙ্গি করে, “বেটার লেট দ্যান নেভার! কেন, তোর আর ইচ্ছে নেই?”
অশোক তাড়াতাড়ি বলে, “ষোল আনা ইচ্ছে আছে ম্যাডাম, আপনার প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে হালে আমার প্রাণ সংশয় দেখা দিয়েছে, আর ঝোলাস না প্লিজ, দয়া কর আমাকে।”
মধুরিমারও আপত্তি নেই তাতে। শেষ লাফটা দেওয়ার আগে নিজেদের আরও গভীরভাবে পরখ করে নিলে মন্দ কী, ইন্টেলেকচুয়াল কম্প্যাটিবিলিটি আছে বলে ইমোশনাল কম্প্যাটিবিলিটি হবে তার তো কোন মানে নেই!
অশোকের শোয়ার ঘরে ব্রা-র তিন নম্বর হুকটা লাগাতে লাগাতে মধুরিমা বলেছিল, “আই অ্যাম হ্যাপি। তুই?”
অশোক দু-হাত বাড়িয়ে মধুরিমাকে টেনে নিয়েছিল,“এখনই যাচ্ছিস? আরও একটুক্ষণ থাক না।”
সালোয়ারের দড়ি বাঁধা শেষ করে মধুরিমা বলেছিল, “তাহলে চল, তোর মা-র স্টুডিওটা দেখি।”
মধুরিমাকে এক ঠ্যালা দিয়েছিল অশোক, “তাহলে বাড়ি যা। বসুধা তার ছেলের ঘরে উইদাউট রেড পাস পরের মেয়েকে ঢুকতে দিতে পারে, কিন্তু নিজের স্টুডিওতে নয়। প্রজাপতির ক্যানভাসগুলো নিয়ে মা ভীষণ পজেসিভ রে।”
বিয়ের পর বসুধার সঙ্গে মধুরিমা ঢুকেছিল সেই স্টুডিওতে। বসুধাই ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছিলেন নিজের আঁকা ক্যানভাস, অনেক গল্প করেছিলেন প্রজাপতি নিয়ে।
সত্যি, কত জাতের, কত রঙের, কত আকারের যে প্রজাপতি এই দুনিয়াতে! সব থেকে বেশি দেখা যায় মনার্ক-বাটারফ্লাই। সামার-আজার-বাটারফ্লাই যে কী সুন্দর। আর ব্লু-মরফো-বাটারফ্লাইয়ের কী উজ্জ্বল রং!
ঘুরতে ঘুরতে একটা ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে মধুরিমা বলে উঠেছিল, “উফ কী সুন্দর, ইস আমি যদি এমন হতাম—”
মধুরিমার কথা শুনে বসুধা ঘুরে তাকান, তার চোখে তিরস্কার, “চুপ এমন কথা মুখেও এনো না, জানো তো উইশ অ্যাট্র্যাক্টস ডেস্টিনি! আসলে এই প্রজাপতির বর্ণনা আমার পড়া, চোখে দেখা নয়। প্রজাপতিটিকে সেখানে কল্পনা করা হয়েছে, হ্যাঁ শুধুমাত্র কল্পনা। আমিও মনের পর্দা থেকে প্রজাপতিটিকে ক্যানভাসে ধরার চেষ্টা করেছি। দ্য ডেথ ড্যান্স বাটারফ্লাই, দেড় থেকে দু বিঘৎ চওড়া, চোখ নেই এদের, স্ত্রী এবং পুরুষ দুজনেই অসম্ভব সুন্দর, ডানার রং ঘন ধূসর থেকে হঠাৎই সাদা, সাদা ডানার ওপর সরু সরু কালো শিরা উপশিরা, যেন নিখুঁত লেসের নকশা। এরা ফুলে ফুলে নয়, মৃতদেহের ওপর বসে থাকে, মৃত পশু বা মানুষের শরীরের রস এদের একমাত্র খাদ্য, প্রজাপতিটাকে দেখতেই সুন্দর, জীবনটা বড় ঘিনঘিনে।”
অশোকের সঙ্গে বিয়ের পর অনিতা বলেছিল, “ওমা মুড়কি, তুই যে সত্যি সত্যি প্রজাপতি হয়ে গেলি, টিনের চালের ঘর থেকে সোজা তিনতলা বাড়ি, সরু গলি থেকে একেবারে রাজপথ!”
অনিতাকে জড়িয়ে ধরে মধুরিমা হেসেছিল, “হ্যাঁ মা, ইওর ড্রিম লিডস টু ডেস্টিনি।”
একই কলেজের একই শাখা থেকে পাস করে অশোক ঢুকে গেল হোমরাচোমরা চাকরিতে, মধুরিমা বাড়িতেই বসে রইলো, ওসব আটটা পাঁচটার চাকরিবাকরি তার ভালো লাগে না। বেশ ছিল মধুরিমা। একমাত্র ছেলের বৌকে বসুধা কত ভালোবাসতেন। আর বাড়িতে বসে থেকেও মধুরিমার ফিগার সেই কলেজের মতই রয়ে গেল, যে ভাইট্যাল স্ট্যাটিসটিকস দেখে কুড়ি বছর বয়সে অশোক পাগল হয়ে যেত।
একটাই আফসোস, পনেরো বছর হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে, এখনও তাদের বাচ্চা হয়নি। আফসোস অবশ্য অশোকের, মধুরিমার তেমন নয়। কারণ মধুরিমা জানে, ডিম্ব প্রসবের পর স্ত্রী-প্রজাপতির কাজ শেষ।
কিছুদিন ধরেই মধুরিমার সন্দেহ হচ্ছিল। অশোকের অন্যমনস্কতা, শারীরিক অভিব্যক্তি, তেমন প্রসঙ্গে চোখের ভাষা সবই অদ্ভুত লাগছিল তার। অশোক যেন হঠাৎই খুব রঙিন হয়ে পড়েছে। নিয়মিত পার্লারে গিয়ে চুলে রং করে, শার্টের কলারে পারফিউম ছিটিয়ে অফিস যায়, অনেকগুলো নতুন জুতো কিনেছে। এক জোড়া সত্য পালের কাফলিঙ্ক আর পিয়ার কার্ডনের পেনটা কি অশোক নিজে কিনেছে নাকি কেউ উপহার দিল?
মধুরিমা চোখ সরু করে সব দেখে আর ভাবে, পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে অশোকের তো এখন ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, নিজের হার্ট, মধুরিমার সুগার, দেশের পলিটিক্স, নেক্সট প্রোমোশন নিয়ে সাদা কালো জীবন হওয়ার কথা। তার বদলে কোন মন্ত্রে দিনে দিনে অশোক এত রঙিন হয়ে উঠছে?
আজকাল অশোকের অল্পবয়সী সেক্রেটারি মেয়েটি এত ঘন ঘন ফোন করে! সেদিন দশবার ফোন করেছিল। কিসের এত প্রয়োজন মেয়েটির? কী কথা বলে ওরা? সবই অফিসি কথা? এত কথা? মেয়েটির কি স্বাভাবিক জ্ঞানগম্যি নেই? নান্দনিক সৌন্দর্যবোধ নেই? এক অনাত্মীয় মাঝবয়সী পুরুষকে কোন ভদ্রমহিলা রাত বারোটায় ফোন করে?
সে না হয় অশোকের সেক্রেটারির বোধবুদ্ধি কম, সেক্রেটারি মেয়েটির ওপর তো আর মধুরিমার হাত নেই। কিন্তু অশোক কি বলে অত রাতে বিছানা থেকে উঠে পাশের ঘরে বসে নিচু গলায় মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে, বলেই চলে?
মধুরিমার প্রশ্নকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল অশোক, “আমাদের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, অফিসের প্রয়োজন ব্যক্তিগত ইচ্ছে-অনিচ্ছের অনেক ওপরে। তাছাড়া এটা গ্লোবালাইজেশনের যুগ, তোমার এখানে রাত তো অন্য দেশে ভোর, রাত বারোটা বলে কিছু আছে না কি আর।”
ভাইস-প্রেসিডেন্ট অশোকের যুক্তির সামনে গৃহবধূ মধুরিমা চুপ করে যায়, তবু সন্দেহ মাথা তুলে থাকে, রাত বারোটা বলে সত্যিই কিছু নেই?
তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারিণী মধুরিমা জানে, সন্দেহের কালো ধোঁয়ার পিছনে অবশ্যই কোন কারণ থাকে, কিন্তু সেটা কী? মধুরিমা হাতড়ে মরছিল, অবশেষে আজ বিষ প্রহরে সে খোঁজ পেয়েছে সেই কারণের।
এমনিতে মানুষকে বিশ্বাস করতেই পছন্দ করে মধুরিমা, তাতে জীবন সহজ হয়, জটিলতা কমে। বিবাহিত জীবনে অশোকের ওপর অন্ধের মত নির্ভর করে সে। বাড়ির দলিল, ব্যাঙ্কের কাগজ, পাসবইয়ের ডিটেইলসের প্রতি মধুরিমার কোনদিনই আগ্রহ ছিল না, ফলে নজরও রাখতো না ওসবে।
আজ একটা পুরনো গয়নার বিল খুঁজতে খুঁজতে এই কাণ্ড। কোথাও বিলটা পাচ্ছিল না মধুরিমা। বিরক্ত হয়ে আলমারির ড্রয়ার খুলে খাটের ওপর উপুড় করে দেয় সে, চারদিকে ছত্রাকার হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সব। তখনই কাগজপত্রের অরণ্য থেকে বেরিয়ে আসে একগোছা কালো সাপ, অনেকগুলো ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট। ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্টে কতকগুলো বিসদৃশ সংখ্যায় চোখ আটকে যায় গণিতে পারদর্শী মধুরিমার, সে মন্ত্রমুগ্ধের মত তা উল্টেপাল্টে পাশ ফিরিয়ে দেখতে থাকে, দেখতেই থাকে।
অশোক ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলেছে, সোমবার চল্লিশ হাজার, দু-দিন পর আরও ষাট হাজার, পাঁচদিন পর আবার পঞ্চাশ হাজার, আবার, আবার—
এত টাকা তুলেছিল কেন অশোক? এত টাকা তো অশোক কোনদিন বাড়িতে নিয়ে আসেনি! তাহলে?
মধুরিমা থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে, চোখের সামনে সারা পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়। এক গহীন কালো কুয়োর মধ্যে সে ডুবে যেতে থাকে, তলিয়ে যায় গভীর থেকে গভীরে। একেবারে তলায় ছিল ক্রেডিট কার্ডের স্টেটমেন্টগুলো, সেখান থেকে কালো সাপ ছোবল মারে মধুরিমাকে। অশোক বলেছিল, অফিস ট্যুর। কিন্তু এসব কী! এই যে, এপ্রিলে মুনারের টিকিট, জুন মাসে থাইল্যান্ড, জুলাইয়ে গোয়া—
এত বিষ মধুরিমার আর সহ্য হয় না। যা ছিল সন্দেহের খাতায়, এখন তার প্রমাণ পাওয়া গেল।
মধুরিমা নিজেকে ধিক্কার দেয়, কপালে করাঘাত করে, কী দরকার ছিল গয়নার বিলের? কী লাভ হল এত দিনের সন্দেহ নিরসনে?
লাভ নেই, কোন লাভ নেই, ক্ষতি, শুধু ক্ষতি। বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে কেনা ভারি সোনার বালা ইটালিয়ান ক্লাচের ভিতর থেকে মধুরিমাকে মুখ ভ্যাংচায় যেন।
অপমান অপমান, মধুরিমার বুক পুড়ে যাচ্ছে, সারা শরীর জ্বলছে। অশোক, সেই আঠেরো বছরের অশোক, তার সহপাঠী অশোক, তার বন্ধু অশোক, তার বেটার হাফ অশোক, সে বিশ্বাসঘাতক? যে গাছের ডালে মধুরিমা নিশ্চিন্তে বসেছিল, তা পোকায় খাওয়া?
আলমারি হাট করে খোলা পড়ে থাকে, খাটের ওপর ছত্রাকার হয়ে থাকে ড্রয়ারের কাগজপত্র, মধুরিমা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় কিং সাইজ খাট থেকে। তার উজ্জ্বল হলুদ সবুজ ফুল ছাপ জর্জেট শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোয়। জ্বালা, বড় জ্বালা।
এক গ্লাস জল খাবে মধুরিমা?
না। সে এঘর থেকে ওঘরে গেল, একতলা থেকে দোতলায়, দোতলা থেকে তিনতলা, সেখান থেকে ছাদে। ছাদের আলসের ধারে দাঁড়িয়ে মধুরিমা নীচের দিকে তাকায়। ওই যে রাজপথ, পথে কত মানুষ। আর মাথার ওপরে ধুধু নীল আকাশ।
না, মানুষের জঙ্গলে মধুরিমা আর যাবে না। সে বরং উড়ে যাবে নীল আকাশে, দূরে, বহুদূরে— সে দু-হাত ছড়িয়ে দেয় দু-দিকে। কিন্তু ডানা মেলে উড়তে গিয়ে যদি পড়ে যায়, মাধ্যাকর্ষণের নিয়মে?
ভয় করে, খুব ভয় করে। সে পিছিয়ে আসে ছাদের আলসের থেকে, লুটোনো আঁচল গুছিয়ে নেয়। পায়ে পায়ে নেমে আসে দোতলায়, বসুধার স্টুডিওতে ঢোকে।
জিন-এ টু জিন-বি, প্রজাপতি, চারদিকে শুধুই রংবেরঙের প্রজাপতির ডানার ক্যানভাস। টেবিল থেকে একটা মোটা তুলি তুলে নেয় মধুরিমা, তাতে অনেকটা কালো রং লাগায়, এগিয়ে যায় ক্যানভাসগুলোর প্রতি, এলোপাথাড়ি তুলি চালিয়ে প্রজাপতির সুরূপা ডানাকে কুরূপা করে তোলে।
একটা দুটো পরপর সাতটা ক্যানভাস কালো রঙে কুচ্ছিত করার পর সে হাঁফিয়ে যায়, বসে পড়ে। তার চোখ যায় কোণের ক্যানভাসটার প্রতি, কী অদ্ভুত দুটো ডানা, কী অসামান্য রূপ তার!
সে আবার ওঠে, এগিয়ে এসে নিশ্চল প্রতিমার মত দাঁড়ায় ক্যানভাসটার সামনে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে, দ্য ডেথ ড্যান্স বাটারফ্লাই। তার দু-চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুধারা।
উইশ অ্যাট্র্যাক্টস ডেস্টিনি, তাহলে এই তার ভবিতব্য! মৃত্যু নয়, মৃত সম্পর্ক আঁকড়ে বেঁচে থাকা। যেমন ডেথ ড্যান্স বাটারফ্লাই বেঁচে থাকে মৃত শরীরের রস খেয়ে!
তার প্রতি অশোকের ভালোবাসা মরে গেছে, তাদের সম্পর্ক এখন মৃত। এদিকে মধুরিমার বাবা নেই, ব্যক্তিগত জীবীকার ব্যবস্থা নেই, অশোককে ছেড়ে সে যাবে কোথায়?
খুঁজলে একটা কাজ হয়তো পেয়ে যাবে সে। কিন্তু সেই কাজ তো এই বিলাসবহুল জীবন, প্রতি বছর বিদেশ ভ্রমণ, এত সামাজিক প্রতিপত্তি মধুরিমাকে দিতে পারবে না।
জিন-বি টু জিন-এ অসম্ভব, প্রকৃতির অভিধানে তা না-মুমকিন। তাই এই সমাধান, দ্য ডেথ ড্যান্স বাটারফ্লাই হয়ে আগামী জীবনেবেঁচে থাকা।
আজ থেকে অশোকের ক্রিয়াকলাপের প্রতি অন্ধ হয়ে এক মৃত সম্পর্কের ওপর ডানা বিছিয়ে মধুরিমা বেঁচে থাকবে, শুধু বেঁচে থাকার জন্যই।