‘—বৃক্ষ তোমার নাম কী?
—ফলে পরিচয়।’
ফলের পরিচয় ঘটে বৃক্ষের নামটি ধরেই। সাধারণত বৃক্ষের একটি সুনিদির্ষ্ট নামকরণ থাকে। গাছটি যদি কাঁঠাল গাছ হয়, ফল হিসেবে তাতে কাঁঠালই জন্ম নেবে, জামরুল নয়। ভাব প্রকাশের সুবিধার জন্য ব্যক্তি, বস্তু, স্থান ইত্যাদির নামকরণের প্রচলন। সাধারণত বস্তু, স্থানের নামের মধ্যে থাকে তার আত্মপরিচয়ের ইতিহাস ভূগোল। জন্ম নেবার পর, মানুষের ক্ষেত্রে নামকরণের মাধ্যমে ঘটে তার দ্বিতীয় জন্মলাভের সুযোগ। প্রথমতঃ একজন মানুষ একটি পরিবারের সদস্য বা সন্তান হিসেবে জন্ম নিয়ে থাকেন। নামকরণের মাধ্যমে মানবসমাজে নিজের অস্তিত্বের সাক্ষরসহ ঘটে তার উত্তরণ।
মা-বাবার স্নেহের বৃত্ত ভেঙে একজন সন্তান যখন মানবসমাজের অংশ হিসেবে উপস্থিত হন, তখন তার নিজস্ব একটি নামকরণের প্রয়োজন পড়ে। কারণ এই যে মানুষটি, তখন আর শুধুমাত্র মা বাবার একক সম্পদ নন। তিনি মানব সমাজেরও অংশ।
একজন মানুষের নামকরণ প্রয়োজন কেন, সে সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মতো সহজবোধ্য করে আর কে বলতে পারেন! “নামকরণ” প্রবন্ধে এ বিষয়ে তিনি কী বলছেন, আসুন একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক—
“...জন্মের আরম্ভেই প্রকৃতির বিশ্বদরবারের দরজা খুলিয়া গেল। মা বাপের যে স্নেহ সেও প্রকৃতি প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছে। শিশুর কান্না যেমনি আপনাকে ঘোষণা করিল অমনি সেই মুহূর্তেই জলস্থল আকাশ সেই মুহূর্তেই মা বাপের প্রাণ সাড়া দিল, তাহাকে অপেক্ষা করিতে হইল না।
কিন্তু আরও একটি জন্ম ইহার বাকি আছে, এবার ইহাকে মানবসমাজের মধ্যে জন্ম লইতে হইবে। নামকরণের দিনই সেই জন্মের দিন। একদিন রূপের দেহ ধরিয়া এই শিশু প্রকৃতির ক্ষেত্রে আসিয়াছিল, আজ নামের দেহ ধরিয়া সে সমাজের ক্ষেত্রে প্রথম পদার্পণ করিল। জন্মমাত্রে পিতামাতা এই শিশুকে স্বীকার করিয়া লইয়াছে, কিন্তু এ যদি কেবলই ইহার পিতামাতারই হইত তবে ইহার আর নামের দরকার হইত না, তবে ইহাকে নিত্য নূতন নূতন নামে ডাকিলেও কাহারও ক্ষতিবৃদ্ধি ছিল না। কিন্তু এ শিশুটি নাকি শুধু পিতামাতার নহে, এ নাকি সমস্ত মানবসমাজের, সমস্ত মানুষের জ্ঞান প্রেম কর্মের বিপুল ভাণ্ডার না কি ইহার জন্য প্রস্তুত আছে, সেইজন্য মানবসমাজ ইহাকে একটি নামদেহ দিয়া আপনার করিয়া লইতে চায়।”
বস্তুত ভাব প্রকাশের সুবিধার জন্য নামকরণের দ্বারস্থ হওয়া। নইলে চটি, বাটি, এবং ঘটি নামের অভাবে সময় বিশেষে যথেষ্ট বিপত্তি ঘটিয়ে বসতো, তা বলাই বাহুল্য। এক্ষেত্রেও, (প্রায়) সর্ব বিষয়ে আমাদের মুখে শব্দের যোগানদার মানুষটির “বাঙালি কবি নয়” প্রবন্ধের বক্তব্যটি স্মরণ করা যায়—
“ভাব প্রকাশের সুবিধা করিবার জন্য লোকসাধারণে একটি বিশেষ পদার্থের একটি বিশেষ নামকরণ করিয়াছে, সেই নামে তাহাকে সকলে ডাকিয়া থাকে ও অনেক দিন হইতে ডাকিয়া আসিতেছে। ভাব প্রকাশের সুবিধার জন্য লোকে পদতল হইতে আরম্ভ করিয়া কটিদেশ পর্যন্ত প্রসারিত অঙ্গকে পা বলিয়া থাকে, তুমি যদি আজ বল যে, পদতল হইতে আরম্ভ করিয়া স্কন্ধদেশ পর্যন্তকে পা বলা যায় তাহা হইলে কথাটা কেমন শোনায় বলো দেখি?”
প্রচলিত নামকরণেই সনাক্ত ঘটে সংশ্লিষ্ট বস্তু, ব্যক্তি বা স্হানের। সে নাম ধরে ডেকে ওঠার মাঝেই তার অকৃত্রিম পরিচয়ের উন্মেষ। চোখ বুজে গোলাপ শুঁকলে তাই সঠিক নাম বলে দিতে আমাদের সমস্যা হয় না। স্থান হিসেবে ইতালির ‘ভেনিস’ শহরের নাম করলে পর্যটন পিয়াসী মানুষের মনে খালের নগরী হিসেবে রূপসী ভেনিসের ছবি ভেসে ওঠে। ফ্রান্স নামের দেশটি আমাদের মানসপটে প্রেমের নগর হিসেবে আবেশ ছড়ায়। এভাবে পৃথিবীর নানান দেশ-স্থানকে নামের সূত্রেই প্রাথমিকভাবে আমরা চিনে থাকি। সৌন্দর্য, পরিবেশের ভৌগোলিক গুরুত্ব ইত্যাদি আসে পরের ধাপে। কিন্তু প্রাথমিক পরিচয় ঘটে নামের সূত্রেই। যদিও অনেকক্ষেত্রে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে পাল্লা দিয়ে স্থান বিশেষের নামের বদল ঘটে, তবে সেসব রাজনীতির উলট পুরাণ কথা। সে ভোল বদলের ভিন্ন প্রসঙ্গ।
শিল্প-সাহিত্যে নামকরণের রীতি গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়। বস্তু, স্থান ইত্যাদির নামকরণের রীতির পথ ধরে আমরা সাহিত্য কর্মকে বিশেষ নামের মাধ্যমে প্রকাশে সচেষ্ট থাকি। শ্রুতিমধুর বিভিন্ন নাম দেয়ার ঝোঁক থাকে এ ক্ষেত্রে। তবে নামটি কেবলমাত্র শ্রুতিমধুর হলেই হয় না, একই সাথে বিষয়বস্তুর সাথে তার নিবিড় সংযোগ স্থাপিত হলো কিনা সে নজরদারিটাও সযত্ন হওয়া চাই। যদিও উইলিয়াম শেক্সপিয়র বলেছিলেন, “নামে কি আসে যায়!” কিছু ক্ষেত্রে আসে যায় বৈকি। বিশেষ করে প্রকাশনা সংস্থা কর্তৃক বাজার নীতি আর পাঠকের পকেট কাটার অর্থনীতি যখন বেশ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত একে অন্যের সাথে। যে কারণে প্রকাশকগণ একটি বইয়ের নামকরণ বা শিরোনামের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে থাকেন। বইয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে লেখকও তাতে তেমন একটা দ্বিমত করেন না।
যুক্তরাজ্যের নটিংহিল ইউনির্ভাসিটির স্কুল অফ এডুকেশন বিভাগের অধ্যাপক প্যাট থমসনের অভিজ্ঞতা এখানে টেনে আনা খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না হয়ত। শিরোনাম বিষয়ে প্যাট থমসনের অভিজ্ঞতাটি পড়ে নেয়া যাক—
“পেশাদার লেখকরা তাঁদের বইয়ের নাম নিয়ে প্রায়শই তিতিবিরক্ত থাকেন। তারা অবশ্য প্রচ্ছদ নিয়েও কম উদ্বিগ্ন থাকেন না। আমিও ব্যতিক্রম নই, যদিও আমি কিছুটা সহনশীল হবার শিক্ষা নিয়েছি। এর কারণ হলো আমি ঠেকে শিখেছি যে আমি যেটা মনে করি সেটাই সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত নয়, এর বাইরেও কিছু থাকতে পারে। শিরোনাম ও প্রচ্ছদ দুই বিষয়েই আমার ভালোমন্দ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে।
একটা উদাহরণ দেয়া যাক। কিছুদিন আগে আমি প্রধান শিক্ষকের কাজ নিয়ে একটা বই লিখি। একজন সাবেক প্রধান শিক্ষক হিসেবে এই বিষয়ে আমি মোটামুটি ভালো ধারণা রাখি, এবং বিষয়টি নিয়ে আমার নিজের একটা ভালোবাসা কাজ করে। অস্ট্রেলিয়া থেকে ইংল্যান্ডে ফেরার পর এখানকার শিক্ষকদের মূল্যায়নের কায়দাটা দেখে আমি বিরক্তবোধ করলাম, এবং সিদ্ধান্ত নিলাম এই বিষয়ে একটা বই লিখবো।... বইটা প্রকাশের আগে আমি প্রকাশককে যে শিরোনাম দিতে বলেছিলাম তা হলো নিরীহ গোছের শিরোনাম “Heads on the block”, কিন্তু প্রকাশকের হাত পার হয়ে যাবার পর দেখা গেলো সেটা হয়ে গেছে একটি কড়াগোছের শিরোনাম “School leadership – heads on the block?”
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বইটা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। সেটা প্রচ্ছদ নাকি শিরোনামের কারণে আমি নিশ্চিত নই... তবে এটা খুব সত্যি যে জনপ্রিয় লেখকদের জন্য চটকদার শিরোনামের কোন প্রয়োজন হয় না। বই বিক্রির জন্য তাদের নামই যথেষ্ট। বাকি আম লেখকদের জন্য শিরোনাম অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সেখানে আমাদের খুঁজতে হয় এমন কোনো শিরোনাম যেটা পাঠকের চোখে লাগবে। এই কারণে আমি শিরোনামের ব্যাপারে প্রকাশকের মতামতকে প্রাধান্য দেই। কারণ বইয়ের বাজার ধরার জন্য, পাঠকের মন জয় করার জন্য প্রকাশকই সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে পারেন।
আমার অভিজ্ঞতার বেশীরভাগ বইয়ের শিরোনাম আমার দেয়া নয়। মার্কেটিং টিমের বড় ভূমিকা আছে এতে। এটা খুব বিরল নয় যে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত শিরোনামটি চুক্তির সময় গিয়ে বদলে যেতে পারে। প্রকাশকের মার্কেটিং কৌশলের সাথে এর গভীর সম্পর্ক আছে এবং আমি তাতে দ্বিমত করি না। কারণ লেখক যেমন লেখার বিষয়টি বোঝেন, প্রকাশক বোঝেন বাজারের বিষয়টি। দুটো বিষয়কে মাঝামাঝি কোথাও আপোষ খুঁজে নিতে হয়। অধিকাংশ প্রকাশক বইয়ের নামকে প্রচ্ছদের চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।”
এমন অনেক লেখক এবং প্রকাশকের অভিজ্ঞতার বয়ান থেকে এটা স্পষ্ট পৃথিবীর বিভিন্ন ভূগোলের কম বেশি দেশের প্রকাশনা দুনিয়ায় বইয়ের নামকরণ বা শিরোনাম সংক্রান্ত বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে প্রকাশক সংস্হা যদি ভেবে নেন যে প্রকাশিত বইটি নামের ধারে বাজারকে হয়ত খুব একটা কব্জা করতে পারবে না, তখন বইয়ের নামকরণ পরিবর্তন নিয়ে সংশ্লিষ্ট লেখকের সাথে আলোচনায় বসতে কুণ্ঠিত হন না। বইয়ের ভার পাঠক পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে আগে নামের ধারে পাঠককে ধরাশায়ী করার প্রাথমিক চিন্তাভাবনা যে কারণে প্রকাশক মহল গুরুত্বের সাথে করে থাকেন। প্রচারেই প্রসার বাণিজ্যে মনোলোভা একটি শিরোনাম বাজার মাতের ক্ষমতা রাখে এ হিসাবটা তারা ভালোই বোঝেন।
বাংলাদেশ বা ভারতের প্রকাশনা সংস্হাগুলোর ভূমিকাও কমবেশি একই খাতে প্রবাহমান। দময়ন্তী তালুকদারের ‘সিজনস অব বিট্রেয়াল’ বইটির শিরোনাম সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার বয়ান তাঁর মুখ থেকে শুনে নেয়া যাক—
“আমার অভিজ্ঞতা বলতে পারি। আমার বইটি বই হবার আগে যখন ধারাবাহিকভাবে বেরোত তখন থেকেই ইংরাজী নাম ছিল। তবে যখন প্রকাশক স্থির করেন বই করবেন তখন সম্পাদনার এক পর্যায়ে বলেন নামটা বাংলা হলে ভাল হয়, আমি সেরকম কিছু ভাবছি কিনা। সেই সময়ই একদিন অন্যত্র কথাপ্রসঙ্গে লেখক মাহবুব আজাদ একটি বাংলা নাম প্রস্তাব করেন, বাংলা বইয়ের ইংরিজি নাম তাঁরও ঠিক মনে হয় নি। তো আমার ইংরাজী নাম দেবার পেছনে একটু নিজস্ব কারণ ছিল। আমি প্রকাশককে মাহবুব আজাদ প্রস্তাবিত নামটি জানাই, এটা তাঁরও পছন্দ হয়। কিন্তু আমি আমার কারণ জানিয়ে বদলাতে বারণ করি। আর দু একবার বললেও প্রকাশক জোর করেন নি বা নিজে বদলে দেন নি। বইটি ইংরাজী নাম নিয়েই প্রকাশিত।”
পত্রিকাভিত্তিক সাহিত্যের ক্ষেত্রে সম্পাদকেরাও শিরোনাম বিষয়ে ভূমিকা রাখেন। প্রখ্যাত সাহিত্যিক দেবেশ রায়কে তাঁর সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে শিরোনাম বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে শ্রদ্ধেয় লেখকের মন্তব্যটি পড়লে সেটি স্পষ্ট হবে—
“প্রশ্ন: ...আপনি তো সম্পাদকও ছিলেন। তখন এই নামকরণের বিষয়টা কিভাবে বিবেচনায় আনতেন?
দেবেশ রায় : ঘনিষ্ঠ কারো হলে বলেই দিতাম, কি নাম দিয়েছেন—বলেই বদলে দিতাম। আবার এমন অনেক তরুণ লেখক ছিলেন, যারা নাম দিতেনই না। গল্পটা আমাকে দিয়ে বলতেন, নাম আপনি দেবেন। এ রকম অনেক হয়েছে। কিন্তু নামকরণের জন্য কোনো গল্প আমি প্রত্যাখ্যান করিনি।”
লেখার শিরোনাম বা নামকরণ কেমন হলে ভালো হয় বলে ভাবেন পাঠক? এর আসলে সুদির্নিষ্ট কোনো নিয়ম নীতি নেই। লেখক তাঁর লিখিত বিষয়ের মূলভাবনা, রুচি এবং কিছুক্ষেত্রে চলতি সময়ের ছাঁচে লেখাটিকে ফেলে শিরোনাম তৈরি করেন। কখনও তা বিষয়কেন্দ্রিক আরোপিত ক্ষেত্র, কখনও সেটি শিল্পসম্মত স্বতঃস্ফূর্ত।
যাঁরা নিয়মিত বাংলা সাহিত্যের পাঠক তাঁরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন অতীতের তুলনায় এখনকার লেখার নামকরণে বেশ একটি পরিবর্তন এসেছে। সবার ক্ষেত্রে এমন ঘটেছে তা বলছি না। আগের লিখিত গল্প উপন্যাস ইত্যাদির নামকরণ হতো মোটামুটি সংক্ষিপ্ত এবং চমকদার। বিশেষ করে চল্লিশ পঞ্চাশ দশকে বাংলা গল্প-উপন্যাসে নাম দিয়ে ক্রেতা বা পাঠককে আকৃষ্ট করার একটি রীতির বেশ প্রচলন ছিল। নাম শুনেই যেন পাঠকের মনে হয় লিখিত গল্প বা উপন্যাসটিতে বেশ রোমান্টিক ব্যাপার স্যাপার আছে। কাব্যিক ভাব ছিল সেসব নামকরণে স্পষ্ট। সংক্ষিপ্ত শিরোনাম বা নামকরণের ক্ষেত্রে লেখকের ভাবনাটা পাঠকের কাছে এসে (সব সময়) না পৌঁছালেও মোটামুটি একটি ব্যাখ্যা হয়ত পাঠক দাঁড় করাতে পারেন। নামকরণ যত ছোটো হবে অন্যদের মনের গভীরে সেটি ততই দ্রুত গিয়ে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। যদিও লেখক বস্তুর ভর কম হলে আর গতিবেগ সমান থাকলে সেক্ষেত্রে বেগ বেশি হবে এমন বৈজ্ঞানিক সূত্রে মনোযোগী না হয়ে কাব্যের প্রতিই বেশি পক্ষপাতিত্ব রাখেন বলে বিশ্বাস। কিন্তু কাব্যের রস সমেত আড়ালে থাকা বিজ্ঞান ঠিকই দ্রুতবেগে পাঠক মনে কড়া নেড়ে যায় যেন। সংক্ষিপ্ত নামকরণের মোড়কে থাকা গল্প-উপন্যাস ইত্যাদির মধ্যে অনেক পাঠকই হয়ত একধরনের স্মার্টনেসের দেখা পান। উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে চলা জীবনের সাথে পাল্লা দিয়ে পাঁচ মিনিটে তৈরি হয়ে যাওয়া ধুমায়িত নুডুলস্ কিংবা ঝটপট কর্নফ্লেক্সের পাশাপাশি সাহিত্য পাঠেও এহেন পাঠককুল হয়তবা ছোটো নামকরণের পাতে স্বীয় পছন্দ তুলে দেন। আবার অনেক পাঠকের ক্ষেত্রে এহেন নামকরণের কারণে বইটি তার জন্য সহজপাঠ্য হিসেবেও ভেবে নিয়ে তার রস আস্বাদনে বেশ আনন্দ পান বা আপ্লুত হন। তাই বলে এটি কখনও বলছি না যে দীর্ঘ শিরোনামের লেখা পাঠক সেভাবে উপভোগ করেন না। পাঠক কী পছন্দ করবেন কী করবেন না, সেটি সম্পূর্ণই পাঠকের নিজস্ব রুচি, খেয়াল খুশি নির্ভর এবং স্বতন্ত্র।
অতীতের তুলনায় বর্তমান বেশির ভাগ লেখার শিরোনাম আর যেন সেরকম ছোটোখাটো বলয়ে থাকতে চাইছে না। বিশাল বিশাল শিরোনামের ভারে পাঠক অনেক ক্ষেত্রেই কুপোকাত প্রায়। নাম ছাপিয়ে লেখার কাছাকাছি পৌঁছানই যদিও পাঠকের লক্ষ্য, কিন্তু কিছুক্ষেত্রে শিরোনামের বিশালত্বের ভারে পাঠকের গল্প/উপন্যাস/প্রবন্ধটি পড়ে ফেলার আগ্রহ কোণঠাসা হয়ে পড়ার ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেবার নয়। ‘সময় কোথায় সময় নষ্ট করবার’ পাগলা ঘোড়ায় সাওয়ার হয়ে তো আর সাহিত্য রসে ডুব দেয়া সম্ভব নয়। তাই হয়ত শিরোনামের বিশালত্বের গভীরে না জড়িয়ে সংক্ষিপ্ত নামকরণের প্রতি নিজের ভালোলাগার জানান দিয়ে স্বস্তি খুঁজেন কেউ কেউ। আবার অনেক পাঠকের ক্ষেত্রে এহেন নামকরণের কারণে বইটি তার জন্য সহজপাঠ্য হিসেবেও ভেবে নিয়ে তার রস আস্বাদনে বেশ আনন্দ পান বা আপ্লুত হন। এক্ষেত্রে নামী দামী লেখকদের মধ্যে আবুবকর সিদ্দিকের 'পায়রা হামার লদীটো!—কুথা কুন্ঠে বটে তু?' বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের 'হায় রে, ইলা মিত্র যদি এই সন্ধ্যাটা দেখে যেতে পারতেন' মঞ্জু সরকারের 'দলেবলে এবং বিলবোর্ডেও হুমায়ুন' প্রমুখ লেখকদের ব্যক্তিক নামের ভারে হলেও পাঠক যতটুকু আগ্রহ পাবেন এর বিপরীতে কম পরিচিত লেখকের দীর্ঘ শিরোনামের লেখা পাঠক কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ নিয়েই পড়তে চাইবেন। অপ্রাসঙ্গিক চটকদার শিরোনামের একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের লেখা 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো আসেননি'। অথচ বইয়ের বিষয়বস্তুর সাথে রবীন্দ্রনাথের কোন সম্পর্কই নেই। এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তি এবং তাঁর সৃষ্টি দুই বিষয়েই 'নামে' বেশ আসে যায় বলে ধারণা করি। তবে এটি লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত ভাবনা। এটি অন্যদের মধ্যে কতখানি কাজ করে জানবার একখানা কৌতূহল অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছি।
সব্যসাচী সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক দীর্ঘ শিরোনাম বিষয়ে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন 'কালি ও কলম' পত্রিকায়। ১৯৮০ সালে সৈয়দ হক 'ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছে না' নামে একটি গল্প লিখেন। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী এ গল্পের অলংকরণ করতে গিয়ে কিছুটা বিপাকে পড়ে যান। কারণ গল্পের এবং লেখকের নাম লিখে ছবি আঁকার জন্য কোনো জায়গাই অবশিষ্ট থাকছিল না। সেসময় শিল্পীরা হাতে এঁকেই অলংকরণের কাজ করতেন, এখনকার মত কম্পিউটারে কাজ করা হতো না। অবশ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর অনবদ্য বাংলা লিপির নতুন নতুন আকার উদ্ভাবনের অসামান্য কলমকার ছিলেন বলে পরিস্থিতি সামাল দিতে সমস্যা হয়নি। সৈয়দ হক তাঁর অভিজ্ঞতা বয়ানের সাথে সাথে শিরোনাম বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি বক্তব্য উল্লেখ করেন, যা সত্যিই মজাদার। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘'নামটা হচ্ছে লাউয়ের বোঁটার মতো, ওটা খাওয়া যায় না। তবে লাউটাকে ধরবার সুবিধা হয়।' সৈয়দ হকের আশঙ্কা 'আমরা বোধহয় এখন বোঁটাটিকেও পাচ্য করে তুলতে শুরু করেছি।” লাউয়ের বোঁটাসম (দীর্ঘ) শিরোনাম পাচ্য কী অপাচ্য সেটা না হয় সময়ের হাতেই ছেড়ে দেয়া যাক।
যে কোনো বাড়িতে প্রবেশের জন্য একটি প্রবেশদ্বার থাকে। শিরোনাম বা নামকরণকে আমরা যে কোনো লেখার প্রবেশদ্বার বলতে পারি। রুচি, ভাবনা, সময় মনমানসিকতা ইত্যাদি নানান অনুষঙ্গের হাত ধরে পাঠক শিরোনামের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারেন বলে মনে করি। পাঠক একটি গল্প বা উপন্যাসের নামে আকৃষ্ট হয়ে অনেক সময়ই সেটি পড়বেন বলে নির্বাচন করে থাকেন। এক্ষেত্রে লেখক বা লেখার বিষয়বস্তু ছাপিয়ে শিরোনামটির প্রতি একধরনের পক্ষপাতিত্ব চলে যায়। শিরোনাম যে কোনো লেখার প্রাণভোমরা হয়ত নয়, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি নিয়ামক বটে। লেখক সাহিত্যিকেরা বিশেষত বাংলা সাহিত্যের কয়েকজন স্বনামখ্যাত লেখক তাঁদের লেখায় কী ধরনের শিরোনাম দিতে পছন্দ করতেন বা কিভাবে শিরোনাম নির্বাচনকে বিবেচনায় রাখতেন কিঞ্চিৎ দেখে নেয়া যাক। এক্ষেত্রে প্রথমেই অনিবার্যভাবে চলে আসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। রবীন্দ্রনাথ নামকরণকে পরম গুরুত্ব দিতেন। যতক্ষণ না সেরা শিরোনাম খুঁজে পেতেন ততক্ষণ চলতো তাঁর নিরলস গভীরতম অন্বেষণ। শ্রুতিমধুর নামকরণের প্রতি মানুষটির ছিল ভীষণ ঝোঁক। সে কারণে আমরা দেখি নিজের জীবনসঙ্গীর ‘ভবতারিণী’ নামটি পালটে তিনি রাখলেন ‘মৃণালিনী’।
সাহিত্য ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটতো না। তাঁর রচিত প্রায় সব রচনাতেই রয়েছে পরিমিতিবোধের ছাপ। সেখানে আরোপিত বা বানোয়াট ব্যাপারটা খুব খাটে না যেন। 'ডাকঘর' 'দেনা পাওনা' 'একরাত্রি' 'খোকাবাবুর প্রত্যার্বতন' 'পোস্টমাস্টার' 'ছুটি' ইত্যাদি নামে গল্পের নির্দেশ হয়ত আছে এবং তেমন চটকও হয়ত নেই, কিন্তু একই সাথে পাঠককে সে রচনার ভেতরে নিয়ে যাবার এক সম্মোহনী হাতছানিও কম নেই। অবশ্য তাঁর ব্যক্তি নামটিও ব্র্যান্ড হিসেবে পাঠক টানতে কাজ করে বৈকি।
মানিক বন্দোপাধ্যায় আগে শিরোনাম দিয়ে তারপর লিখতে পছন্দ করতেন। তার মানে গল্পটি তাঁর ভেতরে আগেই তৈরি হয়ে থাকতো, তার ভেতর থেকে নামটির উঠে আসা কেবল। অনেক বোদ্ধাই বাংলা সাহিত্যের এই অমর কথাশিল্পীর নামকরণের প্রশংসা করেছেন। 'দুআনা ও দুপয়সা', 'সোনার চেয়ে দামি', 'পুতুল নাচের ইতিকথা’, 'চতুষ্কোণ’, 'পদ্মা নদীর মাঝি', 'কাকে ঘুষ দিতে হয়' ইত্যাদি নাম পাঠক মনে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সৃষ্টি সম্পর্কে আগ্রহ জাগাতে যে যথেষ্ট সক্ষম ইতিহাস তার সাক্ষ্য বহন করছে।
সত্যজিৎ রায়ের ‘এক ডজন গপ্পো’-এর নামকরণ বা শিরোনাম দেবার ভঙ্গিটিও কম চিত্তাকর্ষক নয়। 'এক ডজন গপ্পো' নামকরণের পর প্রকাশক বাদল বসু ভাবছিলেন সত্যজিৎ তার পরের বইটির কী নামকরণ করতে পারেন? সত্যজিৎ তার পরের বইটির নামকরণ করেন 'আরো এক ডজন' নামে। প্রকাশক তখন ভাবলেন ঠিক আছে, বার বার দু'বার হলো। তৃতীয়বার তো আর একডজন চলবে না। তখন কী দেবেন বইয়ের শিরোনাম? বেশ একটা চমক দিয়ে সত্যজিত তাঁর পরবর্তী বইটির শিরোনাম দিলেন 'আরো বারো'। এর পরের বইটি এলো ‘এবারও বারো' নামে যা দেখে প্রকাশকের মন্তব্য, ‘তখন তো আমার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়।' বারো নামকরণটি কিন্তু সত্যজিত এরপরও বহাল রাখেন তাঁর অভিনব কায়দা বজায় রেখেই। কারণ তার পরের খণ্ডের নামটি হয়েছিল এভাবে 'একের পিঠে দুই' অর্থাৎ বারো।
শিরোনাম নিয়ে একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
অধ্যাপক এবং কবি নরেশ গুহ তার কবিতাগ্রন্থের নামকরণ করেছিলেন 'তাতার-সমুদ্র-ঘেরা' এভাবে। তাঁর ভীষণ ইচ্ছে বইটির প্রচ্ছদ যেন সত্যজিতের হাতেই হয়। সত্যজিতকে যখন প্রকাশক বাদল বসু জিজ্ঞেস করেন তিনি সেটি করছেন কিনা? প্রশ্নের উত্তরে সরাসরিই তিনি জানান, 'না আমি অত হাইফেন দিয়ে কাভার আঁকতে পারবো না।' কিন্তু নাছোড় বান্দা নরেশ গুহের আব্দারের কাছে শেষমেশ হার মানতেই হয় সত্যজিতকে। তবে তিনিও কম যান না। কবির দেয়া শিরোনামের হাইফেন তাতার সমুদ্রে নিক্ষেপপূর্বকই তিনি সে বইটির প্রচ্ছদ আঁকেন। বইটির হাইফেনশূন্য শিরোনামটি হয়—'তাতার
সমুদ্র
ঘেরা।'
পরবর্তীতে বইটির প্রকাশককে লেখা চিঠিতে সত্যজিত কর্তৃক হাইফেন শূন্য শিরোনামটি তাঁকে ব্যবহার করতে দেখে এটাই বোঝা যায় কবি নরেশ গুহ তাতে মোটেও ক্ষুদ্ধ হননি।
সাহিত্যিক বিমল মিত্র বিশ্বাস করতেন, ‘বিষয়বস্তুর সঙ্গে বহিরঙ্গের সামঞ্জস্য থাকা দরকার।’ সাহিত্যের শিরোনাম বা নামকরণের ক্ষেত্রেও তাঁর এই বিশ্বাসকে তিনি এক অদ্ভুত পদ্ধতির মাধ্যমে প্রয়োগ করে গেছেন লেখালেখির জীবনে।
বিমল মিত্র জ্যোতিষ চর্চা করতেন। কুষ্ঠিবিচারেও তাঁর খুব আগ্রহ ছিল। নিজের বইগুলোর নামকরণ তিনি কুষ্ঠিবিচার করেই ঠিক করতেন। কখনও তিনি পর পর তিনটি শব্দ দিয়ে শিরোনাম ঠিক করতেন। যেমন, ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, ‘আমি বিশ্বাস করি’, ‘পতি পরম গুরু’। আবার কখনও দুটি শব্দে শিরোনাম দিতেন, ‘নগর সংকীর্তন’, ‘রাজা বদল’, ‘আসামী হাজির’। কুষ্ঠি বিচারে এক শব্দে শুভযোগ দেখে সেরকম শিরোনামও দিয়েছেন। ‘স্ত্রী’, ‘ক্ষমা’ ইত্যাদি।
নামকরণ বা শিরোনাম স্থির করতে এমন সংস্কারাচ্ছন্ন পথে সাহিত্য জগতের আর কোনো পথিক হেঁটেছেন কিনা আমার জানা নেই।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক দেবেশ রায়ের নামকরণ পদ্ধতি আবার মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সম্পূর্ণ উল্টো। অর্থাৎ দেবেশ রায় লেখা শেষেই নামকরণ করতে পছন্দ করেন। এ বিষয়ে তাঁর নিজস্ব মতামত হলো, 'গল্পের নামকরণটা গল্পের নির্দেশ হবে না, গল্পের নামকরণটা হবে গল্পের ভেতর থেকে।' তাঁর গল্পের নামকরণগুলো একটু অন্য ধাঁচের হয়ে থাকে। তিনি তাঁর শিরোনামে বৃত্তান্ত, প্রতিবেদন, পুরাণ ইত্যাদি ব্যবহার পছন্দ করেন এবং সেগুলো তিনি সচেতনভাবেই ব্যবহার করে থাকেন। এসব সাদামাটা নামের আড়ালে দেবেশ রায়ের কী জাদু যে লুকিয়ে আছে সেটি পাঠক তাঁর বইটি পড়বার আগে ঠিক ঠাওর করতে সক্ষম হন না সেভাবে। শিরোনামের এহেন পরিস্থিতিতে 'নামে কী যায় আসে' এ বাক্যের যথার্থতায় শেক্সপিয়র নামের মানুষটি হাসি চাপেন কী!
তথ্য সূত্র:
১. “নামকরণ”, প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২. “বাঙালি কবি নয়”, প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩. “Judging a book by its cover – or title – or author order” by Pat Thomson
৪. মাসিক ‘কালি ও কলম’
৫. দৈনিক ভোরের কাগজ, ২৪ জুলাই ২০১৫
৬. “পিওন থেকে সম্পাদক” বাদল বসু