• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৬ | সেপ্টেম্বর ২০১৯ | রম্যরচনা
    Share
  • হাঁকিয়ে বেড়ান ট্যাক্সি যাঁরা : নিবেদিতা দত্ত


    বেশিরভাগ সময়ই কালিঝুলি মাখা ঘাম শুকোনো শার্টে নির্লিপ্ত ভাবে স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকেন তাঁরা। প্যাসেঞ্জার উঠব উঠব করলে মিটার না ঘুরিয়ে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করেন ‘যানা কঁহা হ্যায়?’ গন্তব্য পছন্দ হলে লোক তোলেন না হলে নাকের ডগা দিয়ে সোজা বেরিয়ে যান। এরা হলেন হলুদ ট্যাক্সির চালক। (আজকাল ওলা উবেরের যুগে ড্রাইভাররা অবশ্য আর একটু উন্নত স্বভাবের।) তা এ হেনদের সাথেও কত সময় কত বকবক করে ফেলেছি। আর নিস্তরঙ্গ গতানুগতিকের পর্দা ভেদ করে এসেছে কত রকমারি মানুষ। কথা শুনে মনে হয়েছে, বাঃ--এতো সব রূপ সাগরের অরূপ রতন।

    যাচ্ছিলাম কলেজ স্ট্রীট—পিছনের সীট থেকেই প্রশ্ন করলাম ‘ড্রাইভারজী দেশ কোথায় আপনার?’ ব্যাস ‘দেশ’ কথাটা যেন ম্যাজিকের মত কাজ করল। সবার মনেই বোধহয় তাই করে। (আমরা স্বদেশেই থাকি--তবু কলকাতা পরবাস। খড়্গপুর—ওই ‘খ’টা যেন কত বাহারে, কি অপরূপ তার প্যাঁচানো ভঙ্গি; আর ড় গ য়ের যুক্তাক্ষর? এমনটি আর সারা পৃথিবীতে নেই। খড়্গপুর একক অনন্য--এমন নামটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।) তারাপদ রায় মহাশয়ের ‘কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি’ তাই তো এত টানে।

    ড্রাইভাররা বেশীরভাগই থাকেন টালিগঞ্জ এলাকায়, আর দেশ কারু সেই মজঃফরপুর, কারু দ্বারভাংগা, মোতিহারি বা উত্তর প্রদেশের কোনও গ্রাম--এত কথা বলি নামটাই ভুলে খেয়েছি—কোনো হেভিওয়েট মন্ত্রী সান্ত্রী ড্রাইভারজীর সাথে ও-গ্রামের ভাগীদার—শিখ ড্রাইভারজী, অহং তাতেই—দারুন উন্নতিও তাই সেখানকার।

    যখন রূপসাগরের রতন এঁরা তখন কাকে দিয়ে শুরু করি তাই ভাবছি। আছেন তো অনেকেই। তবে সবার চাইতে বেশী ছাপ ফেলেছিলেন ধর্মরাজ সিং। বাড়ি বিহারের বেগুসরাই অঞ্চলে। ন বছর বয়সে পালিয়ে আসেন কোলকাতা। বাবা ছিলেন বিহার পুলিসের কন্সটেবল। একদিন যখন ট্রেনে কয়েদি নিয়ে যাচ্ছিলেন, ওঁর অনবধানতায় চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে পালায় সে। সহকর্মীরা নাশির নামে কোনো আধপাগল ভবঘুরেকে জেলে ভরে চাকুরি বাঁচানোর পরামর্শ দেয়। মন কিছুতেই সায় না দেওয়ায় ধর্মরাজের বাবা চাকুরীতে ইস্তফা দেন।

    খুব সঙ্গতভাবেই ইস্তফার হাত ধরে সংসারে আসে অভাব অনটন। ধর্মের তখন ন’ বছর। ছোট বোন ক্ষিদে সইতে পারে না দেখে মা ছোটেন পাড়ায় চেয়েচিন্তে কিছু আনতে, কিন্তু বিফল হন। সেই দিন বিকেলেই ধর্মরাজ পাড়ার এক বৌদির কাছ থেকে দশ টাকা নিয়ে বোনকে এনে দেয় পাঁচ টাকার ভুট্টাদানা আর পাঁচ পান মা। ধার করেছে জানলে মার ছড়ি আছে তাই বিনা টিকটেই উঠে বসেন কোলকাতাগামী কোনো ট্রেনে। টিকট না থাকায় ধরা পড়েন বর্ধমানে। রেলপুলিসের কর্তা মন দিয়ে শোনেন ধর্মের কথা। শুনে খাওয়ান জলেবি অউর সামোসা। হাঁথে ছাপ দিয়ে তুলে দেন কোলকাতার ট্রেনে। মানিকতলা অঞ্চলে ছিল ধর্মের এক দূর সম্পর্কের চাচা যিনি বিস্কুটের কারখানায় নোকরি করতেন। সেখানে গেলে পাছে চাচা বাবার কাছে ফেরত পাঠন তাই সে তাঁর কাছে যায় নি কারণ ও এসেছে কলকাতায় রোজগার করে বাবার দুখ ঘটাতে। সুরু হয় ন’ বছরের বালকের অভিযান--ঠেলাগাড়ি টানা আর ফুটপাথে শোওয়া নিয়ে যার শুরু। আর তিনশো টাকা জমার পর টালিগঞ্জ অঞ্চলের কিছু আত্মীয়কে খুঁজে বার করে চিঠি সমেত মনিট-অর্ডার করে বাবাকে টাকা পাঠানো।

    তারপর বিস্কুট কোম্পানীতে কর্মরত চাচার কাছে আসা। জামা কাপড়ের অবস্থা দেখে তিনি করিয়ে দিলেন পাজামা কুর্তা। কিছুদিন বিস্কুট কম্পানির ভ্যান চালিয়েছিলেন, আজ হলুদ ট্যাক্সির চালক। বোনেরও সাদি করান। বাবা ওঁরও বিয়ে দিলেন। তিন সন্তানের পিতা--দুই কন্যা, এক পুত্র। গর্ব করে বলেন ‘আজকালকার বাচ্ছারা কত বায়না করে, আমার ছেলে মেয়েরা কিছু চায় না।’ দেশে ছোটভাইকে করে দিয়েছেন আটা চাকির দুকান যেখানে পড়াশোনার পর ওঁর মেয়েরা বিক্রীবাটায় হাঁত বাটায়। ছেলের ইচ্ছে মিলিটারিতে ভর্তি হয়। এক ছেলে, তাই ধর্মের সায় নেই। প্রশ্ন করেছিলাম ‘ভাইকে যে আটা চাকি করে দিলেন ভাই ভাইয়ে সম্পর্ক টিঁকবে তো?’ গাড়ি চালাতে চালাতে নির্লিপ্ত উত্তর এল ‘নাই রইল। এই তো এক ভাই ওর ভাবী মানে আমার স্ত্রীর সাথে অচ্ছা বর্তাও করেনি, তাতে কি? আমি তো সবার বড়, সেটা ভুলি কি করে!’ --এ যে রূপ সাগরের কাঁচা সোনা—এই তো মানুষ।

    চাঁদের উল্টো পিঠ বলতে যা বোঝায় সে হলেন রাণী রাসমণির এক তলার ঘর লাইট পাখা সমেত বার টাকায় জবরদখল করে থাকা পাকা বাঁশের মত ঘুঘু বুড়ো এক ট্যাক্সি চালক--কথার মাঝে মিন মিন করে বলা ‘এতো ভারি অন্যায় আপনার’-তে সাপ্টা উত্তর ‘আমার কাছে সিদ্ধার্থবাবুর (তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী) কাগজের পূর্জি আছে, কেমন করে ওঠায় দেখি, দেখে নোব না!’ --এও এক—তামা পিতল, সে যাই বলি, ভুললে চলবে কেন সাগর মন্থনে কেবল অমৃতই তো ওঠেনি গরলও তো ছিল।

    রং বিরঙ্গি এই ক্যালাইডোস্কোপে আরো কত যে রং পড়ছে দেখে বিভোর হচ্ছি। ঠাঠা রোদে চাঁদনির কাছে দাঁড়িয়ে আছি—যথারীতি নাকের ডগা দিয়ে মিটারে লাল কাপড় বেঁধে বা না-বেঁধে বেরিয়ে যাচ্ছে ট্যাক্সি, যদিও গায়ে লেখা ‘নো রিফিউসাল’। কিন্তু মসীহা তো ছিলেনই কেউ—এগিয়ে এলেন রোজায় উপবাসরত মাথায় রুমাল বাঁধা ধর্ম ভীরু মুসলিম ড্রাইভার—বারোটার নমাজ বাদ পড়ল কিন্তু ইমান তো রইলো।

    ঝিলিক দিয়েই হারিয়ে গেছে মুম্বাই থেকে আসা যুবক। বইমেলায় কেনা বইয়ের ভার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, এল ট্যাক্সি, তুলেও নিল আমাকে—কথায় কথায় জানলাম আত্মীয়ের বাড়ি কদিনের জন্য এসেছেন, বসে থেকে কি লাভ তাই ট্যাক্সি চালিয়ে রোজগার করা এই ফাঁকে—কোলকাতার গাড়ি চালানোর লাইসেন্স কি ছিল? আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়, তবে মিলন মেলার মত যানবাহনের সমস্যাক্লিষ্ট দুরুহ জায়গা থেকে আমি তো উদ্ধার হলাম।

    এবার অন্য এক ঝাঁক ট্যাক্সিচালকদের কথায় আসি। এরা রেন্টাল কার চালান ট্যুরিষ্ট স্পটে। পাহাড়ে রাস্তায় কত বিপজ্জনক বাঁক--পাছে ঘুমিয়ে পড়ি, ড্রাইভারবাবুও ঝিমিয়ে পড়েন, তাই তার ওষুধ বকবকানি। কারুর কারুর রেডিওতে গান চলে, তাতে ভরসা পাইনে।

    সার বেঁধে, নিজস্বতা নিয়ে ওইতো ওরা। রাণিখেতের রাহুল--ধর্মভীরু—পাহাড়ীদের জঙ্গলে বাঘের ভয় থেকে গেছে শৈশব থেকে—রাহুলেরও তাই—ত্রাণকর্তারা হলেন কনকনে ঠান্ডা ঝুম ঝুম ঝর্নার ধারে শান্ত আশ্রমের নিভ করলি বাবা বা মৃদু হাস্যময়ী ঝুলা ওয়ালি মাতা।

    বিট্টু সিংজি—হিমাচলে পেয়েছি তাকে--ঘরোয়া মানুষ, ঘরোয়া টুকিটাকিতে ভরে আছেন। গ্যাংটকে পেলাম বিশ বছরের ছেলেমানুষ জন সুব্বাকে, যে বলে পদবী অনুযায়ী ওদের মাতৃভাষা, তাই ওর ভাষা সুব্বাই। সারাক্ষণ চিবাতো ইয়াকের দুধ থেকে তৈরি সুপুরির মত শক্ত ছুরপি যা আমি মুখে রাখতে পারিনি। পাথর কুড়োতে ভালোবাসি তাই হঠাৎ গাড়ী থামিয়ে কুড়িয়ে দিয়েছে ছোট চিকচিকে সাদা পাথর, সযত্নে রেখেছি সেটা।

    গ্যাংটকেই কালিপুজোর দিন লাল-মার্কেট যাব, ইচ্ছে রুমেই একটু পুজো করব। হোটেল থেকেই ওরা গাড়ি আনিয়ে দিলে, পেলাম ঘ্যাঁচা বাংলাদেশী মিঠুকে। নানান দরদস্তুর ভাড়া নিয়ে। বলেই দিলে ‘আজ দিওয়ালি, আজ রেগুলার ভাড়ায় হবে না।’ কিন্তু ঘরের কথায়, দ্যাশের কথায় মুহূর্তে ভোজবাজি। নরম গলায় বলে গেল সেই কবে দেশ ছাড়া ওরা। ওর জন্ম --কি যেন বলেছিল, গ্যাঙটকেই বোধহয়। ভাড়া যাই নিক আর রাগ করে নি।

    নাম নরেন্দ্র, মুচকি হেসে প্রথম পরিচয়েই বলেছিলেন ইয়ার-বক্সীরা নরেন্দ্র মোদী বলেই ডাকে। ইংল্যান্ডের রাণীকে মা মানেন। কারণ এরা বেশীরভাগই ব্রিটিশ আমলের সেই গোর্খা রেজিমেন্টের সাথে যুক্ত। বাপ পিতেমোরা এ দলেই নাম লিখিয়ে ছিলেন। গরীবগুর্বো গোর্খারা তাই সুযোগ পেলেই সাগর ডিঙ্গিয়ে ইংল্যান্ডে বসতি জমিয়েছে। নরেন্দ্রের দুই জামাইও ওই রেজিমেন্টে, তাই ওঁর দুই কন্যাও সেই সূত্রে ওখানে। নরেন্দ্র দেশ ছাড়তে চান না। বাপ মা পাহাড়ে। আমাদের নিমন্ত্রণ জানালেন, ‘আসুন পাহাড়ে বসতি করুন, মাঝে মাঝে কোলকাতা যাবেন।’ ওনার মতে ওঁর বাবা মার দীর্ঘ সবল জীবনের রহস্য ওই পাহাড়ের স্বচ্ছ বাতাস আর সবুজ ঘাসে পরিপুষ্ট গাইয়ের দুধ। ভূগোলের জ্ঞান যৎসামান্য—সভয়ে প্রশ্ন করেছিলেন ‘ক্যালকাটা কি একেবারে সমুদ্রের ধারে?’ কিন্তু জীবন উদ্ভূত জীবনদর্শন নিখাদ--বলেছিলেন শিক্ষাই মূল মন্ত্র আর পরিচ্ছন্নতা---ভাবছিলাম এ মন্ত্র নামের মাহাত্ম্যে নয় তো? পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ঘুরপাক খেয়ে নামতে নামতে কত শাকসব্জির নাম বললেন, গাড়ি থামিয়ে কিছু কিনে সেসবের রেসিপিও শেখালেন। পাছে ঝিমিয়ে পড়ি তাই কথা চালিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু না চাইতে পেলাম জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার মত মানুষ।

    আবার সেদিন যাচ্ছিলাম কলেজ স্ট্রীট। সেখানে আর পাহাড় কই। বসে থেকে কি করি তাই কথা। উবের চালক সেই উত্তর বিহারের মানুষ। একথা-সেকথায় বললেন ‘মাঈ বাবুজী যাতে ভাল থাকেন তাই দেশে বড় বাড়ি করে দিয়েছি। শখ তো অনেক ছিল কিন্তু দিদিজী জীবন তো একা নিজের জন্য নয়। --মাঝে মাঝে ভাবি এঁরা সারাদিন ভ্রাম্যমাণ তাই কি ক্ষুদ্রতায় আটকে নেই?

    আর দুজন এর মধ্যেই এসে পড়েছেন মনে। কোলকাতায় তবলা সারায় কোথায়, দামেও যাতে পড়তা হয় ভেবে পাচ্ছি না। ট্যাক্সিতে বসেও সেই আলোচনা। ড্রাইভিং সীট থেকে উত্তর এল ‘বাবুজি, খান্না সিনেমার কাছে ভাল তবলা সারাই হয়, আমরা অবসরে খোল বাজিয়ে ভজন গাই, তাই জানি।’ নিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের সেখানে যদিও খুব ভাল কাজ সেখানে হয় নি, তবে সে অন্য কথা।

    শ্যামবাজার যেতে পেয়েছিলাম এমন একজনকে যার মধ্যে মিশে আছে হিন্দুয়ানা ও ক্রিশ্চিয়ানিটির যুগ্ম স্রোত দুশো বছর ধরে। ওই ধারাকে নিজের করে নিয়েছেন তাই রহন সহনও দুই ধারায় রাঙানো।

    এ লেখা যখন বেশ এগিয়ে গেছে, গিরীশ পার্ক যেতে পেলাম ইক্রম ভাইকে। এবার কিন্তু দেশের কথায় নির্বাক পর্দা ওঠে নি। ভীষণ দাবদাহের পর হঠাৎ মাঝরাতে বৃষ্টির কথা উঠল। ড্রাইভার সাব বললেন ঠিক দুটো দশে বৃষ্টি নেমেছিল। অমনি প্রশ্ন করেছি ‘কটায় বাড়ি যান? বৃষ্টির সময় গাড়ি চালাচ্ছিলেন?’ হেসে বললেন রাত দশটা অব্দি তো পথেই থাকি। এখন তো রোজা তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে সবাই খুশি। পরদা একবার উঠলে তো আর নামতে দোব না। ক্রমে জানলাম নাম ইক্রম আমি তাতে জুড়েছি ভাই। পঁচিশ টাকা ভাড়ায় থাকতেন পার্ক সার্কাস এলাকায় সেই বাপজানের আমল থেকে, এখন অবশ্য তপসিয়ায়। স্ত্রী এক সময় স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন, আছে দশ বছরের এক কন্যা। ‘মাদ্রাসায় দিয়েছেন?’ সবিনয় উত্তর ‘বিকেলে মাদ্রাসায় যায়, সকালে নামী ইংলিশ মিডিয়ম স্কুলে দিয়েছি। ওর মা ওকে আরবি ফারসি কোরান থেকে ইংরাজি অঙ্ক সবই দেখে। শুধু মাদ্রাসায় কি হবে দিদি? নিজে তো পারিনি। তিন বছর মাদ্রাসায় থাকার পর দশ বছর বয়সে প্রথম রোজগার-–কি আনন্দে, মাকে এনে দিয়েছিলাম প্রথম মাইনে।’ চাকরীটা?’ চামড়ার দোকানে চটি বানানোর শিক্ষানবিশী। এক্ মাসের দশ টাকা, ভালো কাজ করে পরের মাসে পনের, তারপর পঁচিশ। নিজে পারিনি মেয়েকে জান দিয়ে শেখাব।’ তারপর ক্ষোভ--‘আমার এক ভাইজান অনেক টাকা জোগাড় করে নামী দামী এক স্কুলে পুত্রকে দাখিলা দিতে চেয়েছিলেন—ওনার কালেজি শিকশা নেই বলে ভরতি করা গেল না।’--এ্তো যেন ‘নীল বাটে সন্নাটা’-র গল্প। যত দেখছি বিভোর হচ্ছি। নেমে যাওয়ার সময় বললাম, ‘যত যাই হোক মেয়ের শিক্ষা যেন জারি থাকে।’ মর্মস্পর্শী উত্তর, ‘হ্যাঁ দিদিজি, ব্যাস আপনারা দুয়া দিতে থাকবেন।’

    ফিরলাম হলুদ ট্যাক্সিতে। এমন ঘ্যানঘ্যানে মানুষ কমই দেখেছি। সারা পথ বলতে বলতে এলেন ‘সল্ট লেক যাচ্ছি বিশ টাকা বেশি দিবেন।’ বাড়ির খানিক দূরেই নামালেন--ভাড়া নিয়ে যাবার সময় বলে গেলেন, ‘কি করব, আজই যে দুটো টায়ার পাল্টেছি।’

    আজ কদিন পর মানিকতলা এলাকায় গিয়ে ফিরতি পথে পেলাম নরেন্দ্র দাশকে। নামের সাথে জুড়ে দিলেন কায়স্থ বোষ্টম। বেশ কজনের দ্বারা রিফিউজড হয়ে তড়িঘড়ি গন্তব্য না জানিয়েই উঠে বসেছি--কোলকাতায় কত কসরত যে করতে হয় পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সাথে! ড্রাইভারবাবু শুধু বললেন, ‘উঠেই যখন পড়েছেন চলুন ছেড়ে আসি। আমি বাড়ি যাচ্ছিলাম, দুদিন ধরে ইলেক্ট্রিক নেই। আমার কষ্টের কিছু না। দুই নাতি নাতনি--বছর পাঁচ আর মাস চারেকের--ওদের জন্যই ভাবনা। সবই মায়া, বুঝলেন!’--বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব?

    থাকেন বেলেঘাটা। মজা করে বললেন, ‘আগে ছিল যার নাই পুঁজিপাটা সে যায় বেলেঘাটা, আমি সেই সময়ের বেলেঘাটার বাসিন্দা।’ তারপরই কেমন করে মনের আগল খুলে গেল, বলে যেতে লাগলেন, ‘বার বছর বয়সে বাবা মারা গেলেন। বড় দিদির বিয়ে দিলাম। ছোট দুই ভাইকে মানুষ করলাম। বুঝতেই পারলাম না কখন আটান্নতে পৌঁছে গেছি।’ (একি আর এক ধর্মরাজ সিং?) ‘কিছু পাওয়ার আশা রাখেন নাকি?’ ড্রাইভ করতে করতে এক হাতে কলা দেখিয়ে বললেন ‘কিছুই না।’ আমার বাপ দাদারা তো এই কলা নিয়েই গ্যাছেন, আমিও তাই নিয়েই যাব, আমার আমার করি, কিন্তু আমার বলতে তো শুধু আমার ব্যবহারটাই নিজের কি বলেন--তাই না?’ সাম্প্রতিক ভোটপর্ব নিয়ে বললেন, ‘সব দলই ক্ষমতায় থাকাকালীন সব কিছুকেই “আমার” বলেন, পরবর্তী দল এলে তাদেরও এক সুর কিন্তু এটা বোঝেন কি ওদের চিহ্নিত করবে ওদের ব্যবহার--ওটাই ওদের এক মাত্র নিজের।’

    বাইশ বছরের উগেন দোরজির কথা না লিখলে অধরাই থেকে যাবে লেখা। আমাদের ভুটান ট্রিপের প্রায় পুরোটারই ড্রাইভার উগেন। যা দেখার তা সবই দেখিয়েছিল ও, কিন্তু ওকে মনে আছে অন্য কারণে। মনের চোখে ওকে দেখছি অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে, টাইগারস নেস্ট দেখাবেই দেখাবে। দূ-উ-রে মেঘে ঢাকা নেস্ট, নীচে, অনেক নীচে আমরা, পাশে উগেন। প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে মেঘ সরল, দেখলাম তাক সাং। যেদিন চলে যাব উগেন এয়ারপোর্টে ছাড়তে এসেছিল। হঠাৎ বলে ‘তোমাদের ফ্লাইট নাম্বারটা দাও।’ আমরা বেশ হকচকিয়ে ইতস্তত করাতে ও বুঝিয়ে বলে ‘হোটেল ছেড়ে দিয়েছ, যদি ফ্লাইট ছাড়তে দেরি হয় বা ধরো ক‍্যানসেলই হয়ে যায়, তাই আমি আর আজ থিম্পু ফিরব না, পারোতেই থাকব দরকার হলে কল করো। টাকা দিয়ে না পারি থাকার ব্যবস্থা করে দোব।’ সদ্য পরিচিতের সাহায্য হয়ত নিতাম না তবু কেমন যেন হয়ে গেলাম। বিদেশে এমন আপন হয় নাকি? স্বদেশেই তো এর নজির দেখি না । ঝট করে কাউকে ভালবাসতে নেই, অপরিচিতকে তো নয়ই। কিন্তু কে যে আপন কে পর তা মাঝে মাঝে ভাবায়। ওই দূর দেশের আর কোনো দিনও দেখা হবে না মানুষটা আমার মনে পাকা জায়গা করে নিল।

    এমনি কত ট্যাক্সিচালককে হয়ত বিরক্ত করে ফেলেছি। মিটার দেখে ভাড়া মিটতেই ওদের ওপর আবার সেই নির্লিপ্ততার পরদা ঝুপ করে পড়ে গ্যাছে। কিন্ত জানি স্থির জানি তার অন্তরালে লুকিয়ে আছে কত সব জীবন্ত মানুষ, যারা হয়ত নিজেদের কথা বলতে উদ্গ্রীব আমাদেরই জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠে নি।

    ___________০____________

    পুনঃ---লেখা তো শেষ। কমা দাঁড়ি দেখা হয়ে গেছে। একটু ফেলে রেখেছি, যদি কিছু চোখে পড়ে। তাই মন বেশ ফুরফুরে। চালের থলি হাতে বেরুলাম, দৈনন্দিনে তো মন রাখতেই হবে। ওমা, বাড়ির ঠিক বাইরে, মোড়ের মাথায় ইনি আবার কে? হলুদ ট্যাক্সির ডিকির ওপর আয়েসে আসীন, গায়ে ছাই-রঙ্গা ইউনিফর্মে স্বয়ং চালক ভাপা গরমে হাওয়া খাচ্ছেন। শোনার ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই নেই তবু কানে এল ‘ক্রুনাময়ী যাবেন?’ ‘মিট্রে যো উঠবে, সো উপ্রে দোশ টাকা দিবেন তো চলেন।’ ‘ওই চল্লিশই দোব, যাবেন?’ ‘আসেন, চলিয়ে আসেন, মিট্রে দোশ বেশি—’ কি যে বলি--বলব নাকি সেই ওঁর কথা য়—‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?’





    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments