আমাদের জীবনে এমন কিছু কিছু ঘটনা ঘটে যা ঠিক যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। কেমন করে ঘটে, কে এভাবে ঘটনাটা সাজায় তা আমাদের অজানা। এমনি এক ঘটনা ঘটেছিল আমার জীবনে।
নব্বই দশকের প্রথমদিকে সুরকার, গীতিকার সলিল চৌধুরী, আমাদের সবার প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় সলিলদা, স্ত্রী সবিতাদি, ও ছেলেমেয়ে সঞ্জয়, অন্তরা ও সঞ্চারীকে নিয়ে বস্টনে এসেছিলেন অনুষ্ঠান করতে। ওনারা চারজনেই একসঙ্গে স্টেজে। সঞ্জয় সাউন্ড সিস্টেমে সাহায্য করছিল, আর বাকিরা গান-বাজনা। এ দৃশ্য খুবই বিরল। আমার দুই পুত্র অর্জুন ও কর্ণ যখন খুব ছোট, তখন এরকম ভাবে আমরা চারজন একসাথে অনুষ্ঠান করেছিলাম। সে গল্প এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
সলিলদারা এসেছেন আর আমি তাঁদেরকে আমার বাড়ি নিমন্ত্রণ করব না সে কী হয়! আসলে দেশ থেকে যারাই আসেন তারাই আমার অতিথি, তারাই আমাদের আত্মীয় — আমি তাই মনে করি। আর এইভাবে বহু মানী-গুণী ব্যক্তি আমাদের কাছে এসেছেন, থেকেছেন। এবারেও যে সাংস্কৃতিক সংস্থা ওদের এনেছিল তাদের জানালাম যে অনুষ্ঠানের শেষে তাঁদের আমাদের বাড়ি নিমন্ত্রণ রইলো।
আমি অনুষ্ঠান থেকে বেশ একটু আগে ফিরে এসেছি। আর এসেই একেবারে সাজ-সাজ রব! সলিল চৌধুরীর মতো এক বিখ্যাত লোক আসবেন আমাদের বাড়িতে, এটা কি কম কথা! ওঁর পরিচিত গানের প্রথম লাইন দিয়ে সারা বাড়িতে ছোটো ছোটো পোস্টার করে লাগালাম, আলপনা দিলাম, আর বাড়িতে ঢোকার মুখে ‘এসো আমার ঘরে এসো’ লেখা পোস্টার বোর্ড লাগলাম।
তাঁরা অনুষ্ঠানের শেষে সদলবলে এলেন। অনুষ্ঠানে সাউন্ড সিস্টেম নিয়ে খুব ঝামেলা হয়েছিল। তাতে উনি বেশ মনঃক্ষুন্ন হয়েছিলেন, ও অনেক সময় নিয়েছিলেন সেটাকে মোটামুটি একটা চলনসই অবস্থায় নিয়ে আসতে। তাই আমি খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম যে এতকিছুর পর কী আর ওনারা আমার বাড়িতে আসবেন। কিন্তু না, তাঁরা এলেন।
অবাক হলাম, আর খুব খুশিও হলাম যে উনি আমার প্রতিটি জিনিষ, আলপনা, আবাহন বার্তা, পোস্টার সব সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখলেন ও সবিতাদি ও ছেলে-মেয়েদের দেখালেন। এরপর আরো অবাক হলাম যখন আমার কানে পিয়ানোর সুর বেজে উঠলো। বাড়িতে তো কোন পিয়ানো নেই, তাহলে পিয়ানোর আওয়াজ আসছে কোথা থেকে?
ছুটে গিয়ে দেখি আমার ছেলে অর্জুনের ঘরে একটা ভাঙ্গা-চোরা, ছোট্ট কি-বোর্ড ছিল, তাতেই উনি ম্যাজিকের মতো সুরের জলতরঙ্গ তুলছেন। এ না শুনলে বিশ্বাস করা যায় না।
বড় সুন্দর কেটেছিল সেই রাতটা। ওনারা বারবার বলে গিয়েছিলেন যে দেশে গেলে যেন নিশ্চয়ই তাঁর বাড়ি যাই।
১৯৯৪ সালের নভেম্বরে আমার ছোট বোনের বিয়েতে আমি দেশে গিয়েছিলাম। আর তখন আমি সলিলদার বাড়িতে ফোন করতে সবিতাদি ধরলেন। খুব খুশি হলেন। একথা সেকথার পর বললেন -- “স্বপ্না তুমি যখন কলকাতায়, তাহলে ১৯শে তোমাদের সলিলদার জন্মদিন। সেদিন আমাদের বাড়ি চলে এসো।”
সলিলদার জন্মদিনে আমার নিমন্ত্রণ! এতো বিরাট ব্যাপার! কিন্তু আমি যাই কী করে, কারণ সেদিন যে আমার বোনের আইবুড়ো ভাত। বাড়িতে প্রায় শ’খানেক লোক নিমন্ত্রিত। তাছাড়া আমার অনেক কাজ, তত্ত্ব সাজানো, বাড়িতে ভিয়েন বসেছে, সেই ময়রাদের সঙ্গে সন্দেশের পালকি, প্রজাপতি ইত্যাদি তৈরী করা, বোনের দুই জাপানি বন্ধু এসেছে সেদিনই সকালে জাপান থেকে, তাদের সঙ্গ দেওয়া ইত্যাদি। সুতরাং খুব ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারব না।
বাড়িতে একথা বলতেই সবাই আমার মতামত এক ধমকে পাল্টে দিল। সলিল চৌধুরীর জন্মদিনে নিমন্ত্রণ আর তুই যাবি কিনা ভাবছিস? এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে! আমার চেয়েও দ্বিগুন উত্সাহে তারা আমার যাবার প্রস্তুতি করতে লেগে গেল। নতুন কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবী, ফুলের মালা মিষ্টি সব ট্রেতে সাজিয়ে সবাই রেডি।
তখনকার দিনে তো সবায়ের হাতে হাতে মোবাইল ফোন আর তার সাথে ক্যামেরা ছিল না, তাই ক্যামেরায় আগে ছবি তোল, তারপর রীল শেষ হলে ‘ডেভেলপ’ করতে দাও। হয়তো দেখা গেল কোন ছবিই ওঠেনি কোন কারণে। আর কারণের কী কোন অভাব আছে? ক্যামেরার লেন্সের মুখের ঢাকানা খুলে শাটার টিপেছে কেউ, ছবিরও দফা-গয়া!
আমার সঙ্গে ছিল সদ্য-কেনা এক পোলারয়েড ইনস্ট্যান্ট ক্যামেরা। একটা ফিল্ম-ক্যাসেটে আটটা ছবি তোলা যায়। তবে ফিল্মের দাম ভালই। সেই ক্যামেরাটা ছিল বিয়ে বাড়ির একটা বিশেষ আকর্ষণ। কারণ, ছবি তোলার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই ছবি বেরিয়ে আসছে ক্যামেরা থেকে, আর সেটা চোখের সামনেই ডেভেলপড হয়ে যাচ্ছে ম্যাজিকের মতো! এ যে সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম! আমার কাকা ভাই বলল এটা নিয়ে যা, ছবি তুলে আনবি, আমরা সবাই দেখবো।
আমি সবিতাদিকে ফোন করে জানালাম, আমি আসবো সন্ধেবেলা, কিছুক্ষণ থেকে চলে আসব। কিন্তু সঙ্গে কে যাবে? অনেকেই যেতে চায়। শেষপর্যন্ত আমার এক দিদির ছেলে গেল। কারণ ও ভালো ছবি তোলে। আমাকে সাজিয়ে, তত্ত্বর ট্রে সাজিয়ে আমার বাড়ির লোকেরা আমায় গাড়িতে তুলে দিল।
আমাকে দেখে সবিতাদি খুব খুশি, খুব আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ধরলেন। সলিলদাকে বললেন --“দেখো তোমার বিদেশ থেকে বোন এসেছে। কি সুন্দর সব জিনিষ সাজিয়ে এনেছে তোমার জন্যে।” তখনও বাড়িতে বেশি কেউ আসেনি। দ্বিজেনদা (মুখার্জি) ছিলেন, আর কে কে ছিলেন আমার মনে নেই। অন্তরা ছিল, সঞ্চারীকে দেখিনি। আমাকে অবাক করে দিয়ে সলিলদা নিখুঁতভাবে দ্বিজেনদাকে বলে যাচ্ছিলেন কিভাবে আমাদের বাড়ি সাজিয়ে ছিলাম। নানা গল্প, হাসিঠাট্টায় কোথা দিয়ে কেটে গেল দেড় ঘন্টা। সবিতাদি চিকেন পকৌরা করে খাওয়ালেন. এরই মাঝে মাঝে আমি আমার ম্যাজিক (তখন এটা ম্যাজিক বলেই মনে হতো) ক্যামেরায় দু একটা ছবি তুলছিলাম, আর সবাই মিলে ৩০ সেকেন্ডে ডেভালাপ হয়ে যাওয়া ছবি নিয়ে হাসিঠাট্টা করছিলাম। শীগগির আরো মানুষজন আসতে শুরু করেছে, আমি সবিতাদিকে জানালাম এবার আমায় বাড়ি ফিরতে হবে।
সবিতাদি ও অন্তরার খুব ইচ্ছে যে আমি থাকতে থাকতে সলিলদাকে জন্মদিনের পায়েসটা খাওয়ানো হয়ে যাক। আমিও তাতে রাজি। কারণ তখনো আমার ক্যামেরার ক্যাসেটে দুটো ফিল্ম বাকি আছে, তাই সেই ছবি তুলে বাড়িতে সবাইকে দেখাতে পারব। সবিতাদির ইচ্ছেয় সলিলদা আমার দেওয়া পাঞ্জাবী পরে এলেন। প্রথম ছবি ওদের তিনজনের একসঙ্গে। এরপর সবিতাদি পায়েস আনলেন, অন্তরা পায়েসের বাটি ধরে, সবিতাদি চামচে করে পায়েস খাওয়ালেন আর আমি সেই ছবি তুললাম। আর সবায়ের বিস্ময়ের মধ্যে সেই ছবিগুলো একেবারে পুরোপুরি ডেভেলপড হয়ে বেরিয়ে এলো প্রায় মুহূর্তের মধ্যে। পোলারয়েডের ছবির সমস্যা হল এর কপি করা সহজ নয়, কারণ এর কোন নেগেটিভ নেই। তাই সবিতাদি একটা ছবি চাইলেও তা কিন্তু আমি প্রাণে ধরে দিতে পারলাম না। এটা আমার কাছে একটা অমূল্য সম্পদ। সলিলদার আরও কত জন্মদিন হবে, কিন্তু আমার ভাগ্যে কী সেখানে থাকার সুযোগ আসবে? তাছাড়া, বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করে আছে ছবি দেখার জন্যে। খুব খারাপ লেগেছিলো তবু একটা গ্রূপ ছবি ওদের জন্যে রেখে, সলিলদাকে প্রণাম করে কিছুটা পরিতৃপ্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। পরের ক’দিন আমার বোনের বিয়ের উৎসবে সলিলদার জন্মদিনের ছবিগুলো ছিল আমার ট্রাম্প কার্ড।
পরের বছর, ১৯৯৫-এর ৫ই সেপ্টেম্বর এক মর্মান্তিক খবর পেলাম — ভারতের এক অমূল্যরতন, সুরকার, গীতিকার সর্বজন প্রিয় সলিলদা আর আমাদের মধ্যে নেই। ভারতীয় সঙ্গীত জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি হল। কিন্তু সেদিন এই খবর শোনার কষ্টের থেকেও ছাপিয়ে উঠেছিল আমার অপরাধবোধ বা গিল্ট ফিলিং।
গতবছরে সলিলদার জন্মদিনে আমার তোলা ছবি সবিতাদির অনুরোধ সত্ত্বেও আমি দিতে পারিনি। বলেছিলাম বাড়িতে সবাইকে দেখিয়ে তারপর পাঠাবো। শেষপর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি নানা কারণে।
নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার একমাত্র উপায়, যদি কোনভাবে সলিলদার ছবির একটা কপি সবিতাদির হাতে তুলে দিতে পারি। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে জানলাম যে কোনো এক স্পেশাল ফটোগ্রাফির দোকানে নিয়ে গেলে ওরা পোলারয়েড ক্যামেরায় তোলা ছবি বড় করে দিতে পারে। সেই দোকান থেকে আনলাম সলিলদার ছবি বড় করে, কিন্তু পাঠাবো কি করে?
দেখতে দেখতে নভেম্বর এসে গেল। পাঠাতে পারব কিনা জানিনা। তবে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে একটা কার্ড তৈরী করলাম, তাতে একদিকে সলিলদার ছবি, অন্যদিকে আমার লেখা একটি কবিতা। কার্ডের বাইরে আলপনা দিয়ে লিখলাম, ‘ফিরবে না তা জানি, আহা তবু তোমার পথ চেয়ে জ্বলুক প্রদীপখানি’। কিন্তু এসব পাঠাবো কি করে?
সুযোগ এসে গেল অভাবনীয় উপায়ে, একদিন ইন্ডিয়ান গ্রসারী স্টোরে বাজার করতে গেছি। ওখানে দেখা আমার এক বন্ধু, ভানুর সাথে।
ভানু জিজ্ঞাসা করলো-- “কি দিদিমনি, কি খবর? তোমাদের গান-বাজনা কেমন চলছে?”
আমরা পরস্পরকে দাদামনি-দিদিমনি বলে ডাকি। বললাম-- “সবই ঠিক চলছে, দাদামনি, কিন্তু একটা ব্যাপারে মনটা বড় অশান্ত। তুমি কি জানো কেউ দেশে যাচ্ছে? আমার একটা ছোটো জিনিষ পাঠাতে চাই।”
দাদামনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল-- “কারুকে দরকার নেই দিদিমনি, আমি তোমার জিনিষ নিয়ে যাবো। তুমি যা দেবে, তা ছোট-বড় যে প্যাকেটই হোক আমি নিয়ে যাব।”
“কবে যাবে?” আমার প্রশ্ন।
“এই শনিবার, ১১ই নভেম্বর। তুমি কবে আমাকে দিতে পারবে?”
কার্ড আর ছবিটা আমার গাড়িতেই ছিল। দাদামনিকে দোকানে দাঁড় করিয়ে এক ছুটে আমি গাড়ি থেকে লেটার সাইজের খামটা নিয়ে এলাম। খামটা দেবার পর আমি একটু কিন্তু করেই বললাম--“খামটা বম্বেতে একজনের কাছে পাঠাতে হবে, যদি সম্ভব হয় ১৯-শে নভেম্বরের মধ্যে। তুমি যদি কলকাতা পৌঁছেই মেইল করে দিতে পারো তাহলে তোমায় যে কীভাবে ধন্যবাদ দেবো তা জানিনা।”
আমাকে অবাক করে দাদামনি বলল-- “ধন্যবাদের কোন দরকার নেই। আমি তো বম্বেই যাচ্ছি, মার কাছে, কলকাতায় নয়। দেখি তোমার ঠিকানা।”
ঠিকানা দেখে দাদামনি অবাক-- “এই ঠিকানা তো আমার মা যেখানে থাকে সেই এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সেরই।”
অবশ্যই আমি জানতাম না যে সবিতা চৌধুরী ওখানেই থাকেন। কিছু কিছু জিনিষ যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না। এ কি করে সম্ভব? তেমন করে চাইলে হয়ত সত্যিই সেই জিনিষ পাওয়া যায়!
দাদামনিকে সব ঘটনা বললাম, কার্ডটা দেখালাম। দাদামনি আমায় আশ্বাস দিয়ে বললো--“তুমি চিন্তা কোর না, ১৯শে সকালে আমি একেবারে সবিতা চৌধুরীর হাতে খামটা দিয়ে দেব।”
আমার কাছে সব ঘটনাটাই যেন কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। কেউ যেন আমার মনের কষ্ট বুঝে পর-পর ঘটনাগুলো সাজিয়ে দিয়েছে, অথচ গত দু মাস ধরে আমি কত চেষ্টা করেছি!
এরপরের ঘটনা আমার দাদামনির কাছ থেকে শোনা। ১৯শে সকালে আমার দেওয়া ঠিকানা দেখে চিঠি নিয়ে দরজার কলিংবেল বাজাতে অন্তরা এসে দরজা খুলে দেয়। দাদামনি আমার নাম করে বলে যে আমি একটা খাম পাঠিয়েছি। ছবি ও কার্ড পেয়ে সবিতাদি যতটা অবাক হয়েছিলেন, ততটাই কষ্ট পেয়েছিলেন। এক বছর আগে সলিলদার জন্মদিনের সেই ছবি! ওঁর চোখের জল বাধা মানেনি।