[দুই সন্তানের মা এক গৃহবধূর কাছে যুদ্ধ, দেশভাগ এসবের তাৎপর্য কী? রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনা অথবা রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ যেসব প্রশ্ন, তা তাঁকে স্পর্শ করে না। ঘরের ভেতরে এই জননী ও স্ত্রী অন্য এক লড়াই লড়ছেন, অন্য এক অনুভূতির জগতে তিনি বিরাজ করছেন। তথাকথিত আধুনিকতা তাঁকে ছোঁয়নি, ফেলে পালিয়ে গেছে। তাঁর প্রশ্নগুলো একেবারে হৃদয় থেকে উৎসারিত। মানুষের অস্তিত্ব নির্ভর করছে সেইসব প্রশ্নের উত্তরের ওপর। সরল গদ্য, সহজ গল্প। প্রশ্নগুলোও কি সরল? এই যুদ্ধে বিজয়ী কে? যুদ্ধ করে লাভ কী? উত্তর মিলবে তো?এই হলেন উর্দু গদ্য সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘অঙ্গন’-এর লেখিকা খাদিজা মাস্তুর (১৯২৭ – ৮২)। কোনও নীতিজ্ঞান পাঠককে গিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা নেই। তিনি গল্প বলেন না, প্লটের ধার ধারেন না। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলে চলেন। আর পাঠকের মনে জাগিয়ে তোলেন প্রশ্ন। যে প্রশ্নের কোনও সহজ উত্তর নেই। অন্য গ্রহের ধাতু কোন্ কাজে লাগবে? বন্দুকের গুলি তৈরির জন্য নয় তো? আমরা কেউই তো আসলে গুলি-গোলা বিস্ফোরণ চাই না। চাই একটু শান্তি, একটু স্বস্তি, একটু ঠান্ডা মিঠে জল। সেই আশ্বাসটুকু পেলেই আমরা আমাদের সমস্ত সঞ্চয় উজাড় করে দিতে পারি।
এই অনুবাদের জন্য লাহোর থেকে ‘খালিদ আহমেদ, নাজিব আহমেদ’ (‘মতবুয়াত’)কর্তৃক ১৯৮১-তে প্রকাশিত ‘ঠান্ডা, মিঠা পানি’ শীর্ষক গল্পসংগ্রহে মুদ্রিত গল্পটি ব্যবহার করেছি।
—অনুবাদক]
এখন যুদ্ধ শেষ হয়েছে। আত্মরক্ষার্থে এখানে-সেখানে যে পরিখা খোঁড়া হয়েছিল, সেগুলো মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। কামানের গোলাবর্ষণে যেসব ঘরবাড়ির ভাঙাচোরা ইটপাথর ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না, সেগুলোর পুনর্নির্মাণ হচ্ছে। গোলাগুলি থেমেছে তাও বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। যুদ্ধ যখন শুরু হল তখন হেমন্ত কাল। তারপরে শীত এল। এখন তো বসন্ত এসেছে। এখন মানুষজন তেমনি ব্যস্ত আর হাসিখুশি যেমন যুদ্ধের আগে ছিল। যে ব্যবসার মন্দা চলছিল, সেগুলোও আবার ঝকমক করতে শুরু করেছে।
ছ-সাত মাস পরে যুদ্ধকালীন সে উদ্বেগ-বেদনা কী মানুষের আর মনে আছে? জীবনের ধাক্কাধাক্কি আর গুঁতোগুঁতি সব কিছুকে খুব তাড়াতাড়ি যেন ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু অন্যদের কথা কী আর বলি! আমি নিজেই তো যদি কখনও-সখনও দেখি জ্যোৎস্না পৃথিবীকে চুম্বন করছে, তখন চাঁদের আলোকে যেন ফিকে লাগে। আমার মনে হয় যেন চাঁদ এখনও পড়শি দেশের বিরুদ্ধে নালিশ জানাচ্ছে। এখন কেউ বলতে পারেন যে চাঁদ তো কিছু বলতেও পারে না, শুনতেও পায় না। এসব কবি-সাহিত্যিকদের আজগুবি কল্পনা, তা হলে তো সে যুক্তি খণ্ডন করা যাবে না। এগুলো কল্পনার বিষয় তো বটেই। আমি গল্পকার। চাঁদকে নিয়ে আমার অদ্ভুত সব অনুভূতি আছে। যেদিন শুনেছিলাম রুশ মহাকাশযান লুনা ৯ চাঁদে নেমেছে, মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিকে আমি আরও সম্মান করতে শুরু করলাম। কিন্তু আমার হৃদয়ের কোনও কোণ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসও উঠেছিল। আমি একবার যখন খুব মন দিয়ে চাঁদকে দেখেছিলাম, বিশ্বাস করুন, আমার এই অত্যন্ত কমজোরি চোখ দুটি দিয়েও দেখতে পেয়েছি চাঁদের বুকে রুশ পতাকা পোঁতা আছে। আমি চাঁদের বুকে চরখা কাটত যে বুড়ি তার শবদেহও দেখেছি। লুনার সঙ্গে সংঘর্ষে সেই চরখা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল।
কে জানে মানুষের চন্দ্রবিজয়ের পরে কী হবে! কতটা লাভ হবে, কতই বা লোকসান। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে আমার যেন মনে হচ্ছে এই পৃথিবীর মানুষদের কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন তো চাঁদকে দেখে কোনও সুন্দর ছবির কথা মনে করতেও ভয় করে। আমার কল্পনার পৃথিবীতে এখন প্রেম-প্রণয়ের এই ঝিকিমিকি আলোর গোলকটির জ্যোৎস্নায় কাউকে প্রণয়ীর স্মৃতি-রোমন্থন করে চোখের জল ফেলতে দেখা যাবে না। যখন আমি এইসব দেখার আর অনুভব করার চেষ্টা করি, তখন ভাবি চাঁদে কোন্ কোন্ ধাতু মেলে আর কী জানি সেইসব ধাতুর সাহায্যে মানুষের সংরক্ষণ অথবা ধ্বংসের কোন্ কোন্ অধ্যায়গুলো রচিত হবে। কে জানে কবে ওই চাঁদও রণাঙ্গনে পর্যবসিত হবে!
চাঁদের চারপাশ ঘিরে থাকা সেই অন্ধকারে আমি তখনও বিভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম যখন সন্ধ্যাকাশে যে তারাটি প্রথম আবির্ভূত হয়, সেই শুক্রগ্রহেও রুশি ঝাণ্ডা পোঁতা হয়ে গেল। তা হলে এখন আমি কারও উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে কীভাবে বলতে পারি যে তার তারায় ভরা চোখ? আমি কেমন করে বলি, ‘মানুষ! যখন তুমি দুনিয়ার দুঃখ সয়ে সয়ে ক্লান্ত, তখন তোমার কল্পনায় কোনও সুন্দর ছবি আর অবশিষ্ট থাকবে না। তুমি জ্যোৎস্নায় বসে বসে প্রেমিকের গল্প না করে বলবে যে চাঁদে কোন্ কোন্ ধাতু পাওয়া গেল! আর রাতে যখন প্রণয়ীর ভাবনা তোমাকে উথাল-পাথাল করবে, তখন তুমি আকাশের তারা গোনার বদলে শুক্রগ্রহে বাংলো বাড়ি তৈরির কথা ভাববে।’
ওহ্, আমি কোথায় শুরু করেছিলাম আর কথা বলতে বলতে কোথায় চলে এলাম! বলছিলাম যে আজও আমার চাঁদকে খিটখিটে, নালিশপ্রিয় বলে মনে হয়। আজও যখন আশপাশের কোনও বাড়িতে শাদির সময় গুলি ছোঁড়া হয়, তখন আমার বন্দুকের গুলিবর্ষণ আর বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ মনে পড়ে। আজও যখন রান্নাঘরে ঢুকি, তখন খুঁটি থেকে ঝুলন্ত লণ্ঠনটা দেখে আমার সতেরো দিনের আঁধারের কথা স্মরণে আসে। ওই লণ্ঠনের শিখার অস্পষ্ট আলোয় আমরা একে অপরকে চিনতাম, চলতে-ফিরতে খাটপালঙ্ক আর কুর্সির সঙ্গে ধাক্কা লাগত। হাঁটুতে কালশিটে পড়ত, আঙুল কেটে রক্ত ঝরত। ওই লণ্ঠনের চিমনিটি আজ পর্যন্ত কেউ পরিষ্কার করেনি। আমি চাই না কেউ সেটা পরিষ্কার করুক; যাতে আমার স্মরণে থাকে যুদ্ধের সেই রাতগুলো কত অন্ধকার ছিল। আমি শান্তি ভালোবাসি, যুদ্ধকে আমি ঘৃণা করি। কিন্তু আমি সেই যুদ্ধকে শান্তির মতই ভালোবাসি যা মানুষ নিজের স্বাধীনতা, নিজের সম্মান আর স্বদেশকে বাঁচানোর জন্য লড়ে।
তাই বলছিলাম যে যুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু আমি যতদিন বেঁচে থাকব, আমার স্মৃতি মুছে যাবে না। আমি সেই আট-দশ বছরের ছেলেটাকে কেমন করে ভুলি যে যুদ্ধের সময় আমার পাশের বাড়ির ছাদের ওপর উঠে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল। আর সেদিন যেন উড়োজাহাজের ওড়ার বিরাম নেই, তাদের আওয়াজে কান ভোঁ-ভোঁ করছিল। যদিও জানতাম যে সে বিমানগুলো আমাদের, তবু আমার হৃদয় যেন ভয়ে আর অমঙ্গলের আশঙ্কায় ভরে উঠছিল। আমি চিৎকার করে ছেলেটাকে বললাম, ‘তুমি ছাদ থেকে নেমে এসো।’ সে বলল, ‘শত্রুদের বিমান এলে আমি ঘুড়ি দিয়েই ওদের নামিয়ে দেব। আমি তোমার মত ভয় পাই না।’
এক মুহূর্তের জন্য যেন আমার বুকের ধকধক শান্ত হয়ে এল। কিন্তু পরমুহূর্তেই আরেকটি বিমান ধেয়ে এল, জোরে সাইরেন বেজে উঠল, ভয়ংকর সে আওয়াজ। আমি আবার উদ্বেগ-আশঙ্কায় আমার ছেলে পারভেজকে ডেকে ডেকে আর পাই না। জানি না সে কোন্দিকে গেল। ঘর থেকেই চিৎকার করছি, ঘর ছেড়ে বেরোলে কিরণ, আমার মেয়েটা, যে ভয় পাবে। ভাগ্য ভালো যে পারভেজ আরেকটা ঘরে বসে বই পড়ছিল। আমার ডাক শুনে সে বইপত্র ফেলে ছুটে এল। সে দিনগুলোয় আমার কী হয়েছিল কে জানে, প্রতি মুহূর্তে বাচ্চাদের ওপর নজর রাখতাম। আমার ইচ্ছে হত নিজের বুক চিরে ওদের সেখানে লুকিয়ে রাখি। যুদ্ধের কোনও ছায়াও যেন ওদের ওপর না পড়ে। সিনেমায় দেখা সেই দৃশ্যটি বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠত যেখানে বোমা পড়ার পরে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা লাশ দেখেছিলাম, আর সেই শবদেহের স্তূপের নিচ থেকে একটা বাচ্চা ক্রমাগত কেঁদে কেঁদে জানি না কাকে ডেকে চলেছিল।
সেই সময় আমার কিরণ আর পারভেজকে আমার কাছে বসিয়ে রেখেছি। আমার প্রাণান্তকর ইচ্ছে যে কোনওভাবে ওদের আগলে রাখব। কিন্তু আমি সেই ঘুড়ি ওড়ানো ছেলেটার কথাও ভেবে চলেছি। সে কি এখনও ঘুড়ি ওড়াচ্ছে? আল্লাহ্, স্বাধীনতার জন্য এই আবেগ কেমন যাকে আজ পর্যন্ত কোনও শক্তি পরাজিত করতে পারল না? আর সে আবেগ কি এই ছোট ছোট প্রাণগুলোকেও রাঙিয়ে দেয়? জানি না বড় বড় দেশের সরকারও কী কখনও এমন ভাবে? তারা সম্ভবত মনে করে যে বড় মাছ অনায়াসে ছোট মাছকে গিলে নিতে পারে। মানুষ আর মাছের মধ্যে কীই বা তফাত, যদিও ভিয়েতনাম সারা পৃথিবীকে ঢোঁড়া পিটিয়ে জানিয়ে দিয়েছে যে পুকুর আর সমুদ্র থেকে বেরোনো এই প্রবচনটি আসলে কিছুই প্রমাণ করে না।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই জ়াহির ঠিক করল যে বাচ্চাদের লাহোর থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে যাতে রাতদিন এই ভয়ংকর বিস্ফোরণের আওয়াজ থেকে তাদের দূরে রাখা যায়। আমি সে সিদ্ধান্তের প্রবল বিরোধিতা করি। আমি কোনওভাবেই আমার প্রিয়জনকে ফেলে দূরে থাকতে পারব না। কিন্তু আমার বেটি কিরণের ভয়ার্ত চোখ দুটি আমাকে বুঝতে বাধ্য করল যে ওই ছোট্ট প্রাণটিকে এখান থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া জরুরি। পরদিন আমি দুটি বাচ্চাকে নিয়ে গাড়িতে মুলতান রওনা হয়ে গেলাম। যে লাহোরকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলাম, তাকে যে কত কষ্টে বিদায় জানালাম সে শুধু আমিই জানি। আমি এতই আবেগবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম যে চোখে জল এল। অতি কষ্টের সে যাত্রা। আমি ক্লান্তিতে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে কোনওভাবে পড়েছিলাম। এক জায়গায় গাড়িটা হঠাৎ ঝটকা দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তারপরে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলেও গাড়ি যখন আর চলছে না, তখন আমি জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বাইরেটা দেখলাম। ফৌজিদের গাড়ির লাইন লেগেছিল। রাস্তা খারাপ থাকায় একটা-একটা করে গাড়ি ছাড়ছিল।
আমি ভেবে মরি যে এরা কোন্ যুদ্ধক্ষেত্রে চলেছে? এদের মধ্যে কজনই বা ফিরে আসবে? আমি মনে মনে তাদের ‘আলভিদা’ বলে বিদায় জানিয়েই আবার আঁচলে মুখ ঢেকেছি। কিন্তু পরমুহূর্তেই হাততালির আওয়াজ শুনে চেয়ে দেখি যে সেই লাইনের একদম পেছনের গাড়ির সেনারা ভাংরা নাচছে। আর এই রকম দেখতে দেখতেই সব গাড়ির ফৌজিরাই ভাংরা নাচতে শুরু করে দিল। তারা জোরে জোরে হাসছে, কারও কারও ঠোঁটে সিগারেট চেপে ধরা আছে। হে খুদা! তাদের কারও কারও তালিতে সে কী প্রাণশক্তি! তাদের দেখছি বটে, কিন্তু আমার চোখদুটি যেন বিশ্বাস করছে না। ইয়া আল্লাহ্! এরা কি সত্যি সত্যি কামানের গোলা আর বন্দুকের গুলির মোকাবিলা করতে যাচ্ছে? আমি চোখ বড় বড় করে ওদের মুখগুলো দেখার চেষ্টা করছি। সত্যি বলছি তাদের মুখে উদ্বেগের কোনও চিহ্ন ছিল না। সে মুখগুলো যেন ফুল ফোটার আলোয় উজ্জ্বল!
আমি যেন অনুভব করলাম লাহোর আমাকে ছেড়ে যায়নি। আমার মন চাইছিল এক লাফে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে ওদের সঙ্গে নাচতে শুরু করি। আর যদি নাচতে নাও পারি, তা হলে ওদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে গোটা বিশ্বে আমাদের আওয়াজ পৌঁছে দিই। পৃথিবীকে জানাই যে এই নাচ বড়ই বিপদজনক। কেউ এর মোকাবিলা করতে পারবে না। তারপরে সেনা-ভর্তি সেই গাড়িগুলো এগিয়ে গেল। যতক্ষণ তাদের দেখা যায় ততক্ষণ আমি সেই ট্রাকগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তাদের তালির আওয়াজ আমি তখনও শুনতে পাচ্ছি, আর নিজেকে প্রশ্ন করছি যে আমি কি মৃত্যুকে ভয় পাই? জীবনে সেই প্রথমবার মৃত্যুকে এক ঢোক মধুর মত মিষ্টি মনে হল!
যুদ্ধের দিনে ঘুম যেন এতটুকু স্বস্তি দেয় না। মুলতানে সেটা ছিল আমাদের দ্বিতীয় রাত। গৃহস্বামীর পরিবার আর বাচ্চারা সব ঘুমিয়ে পড়েছে। হাওয়াই জাহাজের ঘড়ঘড় আমার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল। আমি ঘরের জানলা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখি দূর আকাশে রক্তিম আভা। আমি ভাবছি গৃহস্বামীকে জাগিয়ে জিগ্যেস করি ওটা কী। কিন্তু ভাবতে ভাবতেই সজোরে বিস্ফোরণ হল। জানলার শার্সিগুলো ঝনঝন করে উঠল। দেওয়ালগুলো এমন কাঁপছে যেন আমাদের মাথার ওপরেই ভেঙে পড়বে। এখন কী হল তা বোঝার চেষ্টা করাই অর্থহীন। লোকজন ঘুম থেকে জেগে এদিক-ওদিক দৌড়চ্ছে। আমার বাচ্চারা ডাকাডাকি শুরু করেছে আর আমি তাদের বলছি গ্যালারির টেবিলের নিচে গুটিশুটি মেরে বসে থাকতে।
বলতে বলতেই আগের চেয়ে আরও জোরে আবার বিস্ফোরণ! টেবিলের নিচে বাচ্চারা একজন আরেকজনের ওপর গিয়ে পড়ল। আমি কিরণকে জড়িয়ে ধরে আমার শরীরের সঙ্গে লেপটে নিলাম। পারভেজের কানে-কানে বললাম, ‘মৃত্যুকে ভয় পাবে না, তুমি সেই ফৌজিদের ভাংরা নাচতে দেখেছ না? মনে নেই?’ আমার ছেলেটা হেসে সোজা হয়ে বসল বটে, কিন্তু আমি টের পেলাম সে কাঁপছে। কয়েক মিনিট পরেই আবার পরপর দুবার বিস্ফোরণ, তবে আগের মত যেন জোরদার নয়। দূর থেকে আসছে সে আওয়াজ। পরক্ষণেই একটা উড়োজাহাজ যেন বাড়ির ছাদ ঘেঁষে চলে গেল। দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে থাকা সব প্রিয়জনের কথা তখন আমার মনে পড়ছে। গভীর হতাশায় আমার মন ছেয়ে গেল। নিজের মানুষদের থেকে দূরে বিদেশে মৃত্যু হলে সে মরণ কী দুঃখের! আমি কল্পনায় সব প্রিয়জনের মুখ দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু একবার উদয় হয়েই তারা আবার মুহূর্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। এবারে দুটো বিমান পাশাপাশি উড়ে এসে ছাদ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। আমি খুদাকে স্মরণ করছি, এই কঠিন সময় পেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রার্থনা করতে করতে যেন খুব শান্তি পেলাম।
উড়োজাহাজের আওয়াজ পলক পড়তে না পড়তেই দূরে যেতে যেতে একেবারে মিলিয়ে গেল। তারপরে বেশ অনেকক্ষণ কোনও বোমা ফাটার শব্দ নেই, কোনও বিমানও আর আসেনি। চারদিক একেবারে নিশ্চুপ। মাঝে মাঝে পাশের বাড়ির কুকুরটার ঘেউ-ঘেউ আর কারও কান্নার আওয়াজ সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে দিচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত পরে অল-ক্লিয়ার সাইরেন শোনা গেল। আমরা যে যার জায়গায় উঠে দাঁড়ালাম। গৃহস্বামীর স্ত্রী, যিনি এতক্ষণ তাঁর তিন বছরের বাচ্চাকে শরীর দিয়ে আগলে রেখেছিলেন, এইবার বলে উঠলেন, ‘আপাজি, সন্তানেরা আমাদের কত আদরের! যদি বিস্ফোরণে ছাদ ভেঙে পড়ত, তা হলে আমার গায়ের ওপরেই পড়ত। আমার মুন্না আমার শরীরের নিচে একদম নিরাপদে থাকত, তাই না?’ আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই সে নিজের ঘরে চলে গেল।
বাচ্চারা আবার তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেও সারা রাত আমার চোখে আর ঘুম নেই। যেখানে আসলে বোমাটা ফাটল তার এখন কী চেহারা আমি তাই ভেবে চলেছি। সেখানে নিষ্পাপ শিশু আর মহিলারা কী করছে? আমি ভাবছি আর আমার ঘুমন্ত বাচ্চাদের বারবার জড়িয়ে ধরছি। আমি যেন অন্ধকারে অসংখ্য শিশুর লাশ দেখছি, আহত শিশুদের ছটফট করতে দেখছি। এপাশ-ওপাশ করতে করতে রাত কাটল। পরদিন খুব ভোরে পোশাক পরে আমার গৃহস্বামী আর তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে যেখানে বোমা পড়েছে সেই জায়গাটা দেখতে গেলাম। মুলতান শহরের বাইরে দু-তিন মাইল যাওয়ার পর এক জায়গায় অনেক মানুষের ভিড়। সেই ছোট্ট গ্রামে অনেক কাঁচা বাড়ি আর ঝুপড়ি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। মহিলারা ঝুপড়ির তলা থেকে জিনিসপত্র খুঁজে বার করার চেষ্টা করছে। ঘটিবাটি ইতস্তত ছড়িয়ে আছে।
গ্রামের বাচ্চারা একেবারে স্তম্ভিত, সন্ত্রস্ত। কারও কারও মাথায়, পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। মহিলারা কেউ কেউ হাতজোড় করে উবু হয়ে বসে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে তারা সর্বস্ব হারিয়েছে। তাদের কাছে ওই ঝুপড়িগুলোই যেন প্রাসাদ। বাইরের আগন্তুকদের গ্রামের পুরুষরা বোঝাচ্ছে যে কেউ প্রাণে মারা যায়নি। আমি হাজার উদ্বেগ বুকে ধরে দাঁড়িয়ে দেখছি। আর্ত মানুষের ভিড়েও আমি যেন একা। তবু তো কারও প্রাণ যায়নি। আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে ষাট-সত্তর গজ দূরে অনেক লোক ভিড় করেছে। তারা ঝুঁকে কিছু দেখার চেষ্টা করছে। চাপরাশি জানাল যে ঠিক ওই জায়গায় বোমা পড়েছে।
পরে ভিড় একটু পাতলা হলে আমি এগিয়ে গেলাম। যেখানে বোমা পড়েছে সেখানে একটা ছোট কুয়োর মত গর্ত। সেই গর্তের পাশে এক বৃদ্ধ সাদা চাদর পেতে বসেছে। চাদরের ওপর অসংখ্য পয়সা পড়ে আছে। আমাকে দেখেই বুড়ো চিৎকার করে উঠল, ‘চাঁদা দাও বেগম সাহেব। কুয়ো খোঁড়া হবে, এখানে ঠান্ডা, মিঠা পানি মিলবে।’ আমার হাত ব্যাগটা আমি তার চাদরের ওপর উপুড় করে দিলাম। আর সেই বৃদ্ধও যেন হঠাৎ প্রাণ ফিরে পেয়ে আরও জোরে চিৎকার শুরু করল, ‘ঠান্ডা মিঠা পানি, আল্লাহ্, ঠান্ডা মিঠা পানি।’