আমাদের সবারই যেমন একটা নাম আছে, তেমনি নামের সঙ্গে একটা পদবিও আছে। যথার্থভাবে বলতে গেলে আমাদের নাম দুই বা ততোধিক শব্দ নিয়ে গঠিত, তবে সাধারণত তিনটি শব্দের মধ্যেই সীমিত। এদের আমরা নামের আদ্যংশ, মধ্যাংশ আর শেষাংশ বলতে পারি, আর এই শেষাংশটিই পদবি। যদিও আমাদের আলোচনা মুখ্যত বাঙালি হিন্দুনামেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তবু প্রসঙ্গত বলা দরকার যে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের নামের গঠনভঙ্গিতে এই একই ধারা অনুসৃত, এবং পাশ্চাত্য নামের ক্ষেত্রে তো বটেই। আমাদের নামের এবং আত্মপরিচয়ের অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে মেনে নিয়েছি। পদবি নিয়ে আমাদের প্রচ্ছন্ন গর্ববোধও আছে, এবং আমাদের অনেকেরই ধারণা যে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই পদবি অত্যন্ত প্রাচীন।
কিন্তু সত্যিই কি তাই? ইতিহাসে এর সমর্থন মেলে না। বেদ পুরাণ জাতক কথাসরিৎসাগরের পাতা ওলটালে পদবির হদিস পাওয়া যায় না। সেখানে শুধুই নাম, কোন পদবি নেই। জন্মসূত্রের পরিচায়ক হিসাবে নামের সঙ্গে বাবার নাম যোগ করার রেওয়াজ ছিল বৈদিক বা পৌরাণিক যুগে — অরুণের পুত্র উদ্দালক আরুণি, বিবস্বানের পুত্র বৈবস্বত মনু। মাতৃপরিচয়ে জবালার পুত্র জাবালি সত্যকাম। এই ধারা এখনও অব্যাহত আছে দক্ষিণ ভারতে, মহারাষ্ট্রে, গুজরাটে। মহাভারতে কুরুবংশীয়দের পরিচয় ছিল কৌরব নামে। ধৃতরাষ্ট্রপুত্র আর পাণ্ডুপুত্রেরা সকলেই কৌরব, কিন্তু এই ‘কৌরব’ পদবি হিসাবে দুর্যোধন যুধিষ্ঠির অর্জুনের নামের শেষে শোভা পায় নি। তেমনটাই ঘটেছে যদুপতি কৃষ্ণের বেলায়। বর্তমান উত্তর ভারতের অতি-পরিব্যাপ্ত ‘যাদব’ পদবি তাঁর নামের শেষে কখনও যুক্ত হয়নি। রামায়ণের রামচন্দ্রও বংশপরিচয়ে রাঘব, কিন্তু ‘রাঘব’ তাঁর পদবি হিসাবে কখনই ব্যবহৃত হয়নি। বিক্রমাদিত্য চন্দ্রগুপ্তের সভায় নবরত্নরা শুধুমাত্র নিজেদের নামেই সমুজ্জ্বল — কালিদাস, বরাহমিহির, বররুচি, ঘটকর্পর, শঙ্কু, বেতালভট্ট, ধন্বন্তরি, ক্ষপণক, অমরসিংহ — কোন পদবি নেই।
লক্ষণীয়, চন্দ্রগুপ্ত কালিদাস বেতালভট্ট অমরসিংহ নামগুলির দ্বিতীয়ার্ধ গুপ্ত দাস ভট্ট সিংহ পরবর্তীকালে বহুপ্রচলিত পদবি হয়ে উঠেছে। তেমনই ঘটেছে পঞ্চতন্ত্র রচয়িতা বিষ্ণুশর্মা কিংবা কৃষ্ণস্বামী জাতীয় নাম থেকে শর্মা এবং স্বামী পদবি হিসাবে রূপ নেওয়ার ক্ষেত্রে। শর্মা উত্তর ভারতে ব্রাহ্মণপদবি হিসাবে প্রচলিত। বাংলার ব্রাহ্মণপণ্ডিতরা অনেকে নিজেদের নামের শেষে শর্মা লিখতেন। ‘বর্ণপরিচয়ের’ পৃষ্ঠায় বিদ্যাসাগরের ‘ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা’ স্বাক্ষরটি বাঙালি মাত্রেরই পরিচিত। শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকর্মে এখনও ব্রাহ্মণেরা নিজেদের পদবির জায়গায় দেবশর্মণঃ বলে মন্ত্র উচ্চারণ করেন। ‘স্বামী’ সন্ন্যাসীদের উপাধি হিসাবে ব্যবহৃত হলেও পদবি হিসাবে স্বামী পরিবর্তিত হয়েছে গোস্বামীতে, যার থেকে গোঁসাই বা সাঁই, আরো পূর্বে আসামে গিয়ে গোঁহাই বা বড়গোঁহাই।
চন্দ্রগুপ্ত রাজন্যনাম। সেই নামের অংশ গুপ্তকে ব্যবহার করে নিজেদের বংশপরিচয়কে গৌরবান্বিত করার প্রচেষ্টা অভিজাত বণিকেরা করে থাকতেই পারেন। উত্তর ভারতে গুপ্ত সেজন্যই হয়তো বানিয়া পদবি, বাংলায় কিন্তু তা মুখ্যত বৈদ্য পদবি। বৌদ্ধযুগের মুদ্রা আর শিলালিপিতে চন্দ্রবর্মা বিজয়মিত্র রুদ্রসহ বিশ্বসহ অত্রিদাম ইত্যাদি রাজাদের নামোল্লেখ পাওয়া যায়। কারো কারো অনুমান নামান্ত ‘সহ’ থেকে উৎপত্তি সা এবং সাহা পদবির। দাম পদবি হিসাবে গৃহীত হয়েছে, এবং তার অপভ্রংশ দাঁ-ও। হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক কামরূপরাজ ছিলেন ভাস্করবর্মা। ক্ষত্রিয় পদবি বর্মা আর বর্মণ, উত্তর ভারতে যার রূপান্তর ভার্মা, অনুমিত হয় চন্দ্রবর্মা ভাস্করবর্মা বা যশোবর্মণ জাতীয় রাজন্যনাম থেকে উদ্ভূত। তেমনই বিজয়মিত্র থেকে মিত্র। কালিদাসের ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’-খ্যাত রাজা অগ্নিমিত্র, তাঁর পিতা পুষ্যমিত্র কিংবা পুত্র বসুমিত্রও মিত্র পদবির উৎস হতে পারেন। তেমনই পৌরাণিক রাজা উগ্রসেন চিত্রসেন কিংবা ঐতিহাসিক রাজা চন্দ্রসেন বা নাগসেন থেকে সেন, বিভাবসু থেকে বসু। বাংলায় পালবংশীয় রাজারা ছিলেন গোপাল ধর্মপাল মহীপাল। পালবংশীয় বলা হলেও পাল ছিল এঁদের নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ, বিচ্ছিন্ন পদবি নয়। পরবর্তীকালে পাল বাংলায় এক বহু প্রচলিত পদবি হয়ে উঠেছে।
বৌদ্ধ জাতকচরিত্র ও বৌদ্ধনাম -- দেবদত্ত, সোমদত্ত, শান্তিরক্ষিত, কমলশীল, বিমলমিত্র, বুদ্ধগুহ, বিশুদ্ধসিংহ, কল্যাণমিত্র, জগৎমিত্র, ধনগুপ্ত, পরহিভদ্র -- বেশ কিছু বাঙালি পদবির উৎস বলে অনুমান করা হয়। ‘বুদ্ধচরিত’ রচয়িতা অশ্বঘোষ অথবা মধ্যযুগীয় বাঙালি নাম ঈশ্বরঘোষ বা অনন্তঘোষ থেকে কি ঘোষ পদবির উৎপত্তি? নাকি বৃন্দাবনের আয়ান ঘোষ? কারো কারো মতে বীরভূমের ঘোষ গ্রাম থেকে ঘোষ এবং ঘোষাল এই দুটি পদবির উৎপত্তি। অন্ত্যনাম থেকে গড়ে ওঠা পদবির মধ্যে যেগুলি নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাসে’ উল্লিখিত হয়েছে সেগুলি হল — দত্ত, পাল, মিত্র, নন্দী, বর্মণ, দাস, ভদ্র, সেন, দেব, ঘোষ, কুণ্ডু, পালিত, নাগ, চন্দ্র, দাম (দাঁ), ভূতি, বিষ্ণু, যশ, শিব, রুদ্র। ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর ‘চিন্ময় বঙ্গ’ গ্রন্থে লিখেছেন বসু, মিত্র, দত্ত, দেব, চন্দ্র, সেন, নন্দী, ধর, ভদ্র, শূর, নাথ এসেছে জৈন সূত্র থেকে। এঁদের তালিকা থেকে গুপ্ত কেন বাদ পড়ল বোঝা গেল না। এটা লক্ষণীয় যে প্রায় সমস্ত সংস্কৃত শব্দের পদবিই ঐতিহাসিক নামের অন্তিমাংশ থেকে গড়ে উঠেছে এবং সেগুলো প্রায় সবই ব্রাহ্মণেতর জাতির পদবি।
এই যে ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণেতর জাতি বলা হল সেটা এক হিসাবে বিভ্রান্তিকর। ব্রাহ্মণ কোন জাতিবাচক নাম নয়, ব্রাহ্মণ একটি বর্ণ। বৈদিক ঐতিহ্যবাহী আর তিনটি বর্ণ হল ক্ষত্রিয়, বৈশ্য আর শূদ্র। এগুলো ছিল মূলত বর্ণভিত্তিক বিভাজন। ক্ষত্রিয়ের ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠা সম্ভবপর ছিল, বিশ্বামিত্র তার উদাহরণ। ব্রাহ্মণ শুক্রাচার্য পরশুরাম দ্রোণাচার্য ক্ষত্রিয়বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন। ঐতিহাসিক যুগে দেখা যায় ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শেষ মৌর্যরাজা বৃহদ্রতকে হত্যা করে রাজা হয়েছিলেন। তিনি এবং তাঁর পুত্র অগ্নিমিত্র ও পৌত্র বসুমিত্র বৌদ্ধধর্মের অবসান ঘটিয়ে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনঃপ্রবর্তন ঘটিয়েছিলেন। মধ্যযুগের বাংলায় সেনবংশের প্রতিষ্ঠাতা বল্লালসেন ছিলেন কর্ণাটক থেকে আগত ব্রহ্মক্ষত্রিয়। বৈশ্যেরা ছিলেন কৃষি ব্যবসা বাণিজ্যে নিযুক্ত জনসমূহ। শূদ্র নাম দেওয়া হয়েছিল বিজিত বা বশ্যতা স্বীকারকারী আর্যেতর জনগোষ্ঠীদের, যাদের জন্য কর্ম নির্দিষ্ট হয়েছিল অন্য তিন উচ্চবর্ণের সেবা। স্বাভাবিক জৈবিক নিয়মেই পারস্পরিক বিবাহমিলনের মাধ্যমে বর্ণসংকরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চবর্ণের পুরুষের সঙ্গে নিম্নতর বর্ণের রমণীর বিবাহকে বলা হত অনুলোম, এর বিপরীত হল প্রতিলোম। মনুসংহিতার পর্যায়ে সংকরত্ব নির্ণয় করে সমাজে বিভিন্ন সংকর শ্রেণির স্থাননির্দেশ করা হয়। মনু এ-বিষয়ে সমদর্শী হতে পারেননি। ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় পিতা হলে তাকে অম্বষ্ঠ বা উগ্র নামে অভিহিত করে ব্রাহ্মণদের অব্যবহিত পরেই তাদের স্থান দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ব্রাহ্মণী মাতা আর অব্রাহ্মণ পিতার সন্তানদের চণ্ডাল নাম দিয়ে সমাজের একেবারে নীচে তাদের স্থান নির্দিষ্ট হয়েছে। নৃতাত্ত্বিক নিরিখে সৃষ্ট অম্বষ্ঠ পরবর্তী পর্যায়ে বৈদ্য জাতিনাম পেয়েছে, উগ্র হয়েছে উগ্রক্ষত্রিয় জাতি। মনুসংহিতায় করণ নাম আছে, কায়স্থ নেই। পরবর্তীকালে করণ কায়স্থ জাতিনাম পেয়েছে। এভাবেই জাতিসংখ্যা আর জাতিনামের ক্রমবৃদ্ধি ঘটেছে। বৃহদ্ধর্মপুরাণ (১২-১৪ শতক) নির্ধারণ করেছে অব্রাহ্মণ সব বাঙালিই শূদ্র ও সংকর, এবং তাদের জাতিবিভাগ করা হয়েছে পেশা বা বৃত্তিকে ভিত্তি করে। যেমন, কায়স্থ বৈদ্য সুবর্ণ বণিক কামার কুমোর নাপিত তাঁতি ময়রা ইত্যাদি। এদের মধ্যে কয়েকটি জাতি উত্তম-সংকর বলে চিহ্নিত। ব্রাহ্মণ এবং এইসব সংকর জাতিরা মিলিতভাবে এখন বর্ণহিন্দু নামে পরিচিত। এদের বাইরে রয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে সামাজিক অধিকারে বঞ্চিত কিছু অন্ত্যজ জাতিগোষ্ঠী, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে যাদের অধিকার নিশ্চিত করতে আইনের এক বিশেষ তপশীলভুক্ত করা হয়েছে এবং সেই সুবাদে এইসব জাতি তপশীলি জাতি নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এই রক্ষাকবচের দাবি কিছু বর্ণহিন্দুগোষ্ঠীর মধ্যে সোচ্চার হওয়ার ফলে পরবর্তী সময়ে তারা চিহ্নিত হয়েছে ‘অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি’ নামে, অবশ্য তাতে তাদের স্বতন্ত্র জাতিনামের পরিবর্তন হয়নি।
বাংলায় ব্রাহ্মণেতর জাতির বিপুলসংখ্যক পদবি যেমন পৌরাণিক আর ঐতিহাসিক নামের নামান্ত থেকে এসেছে, বাংলার ব্রাহ্মণদের পদবির ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। এক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে গাঞিনাম, অর্থাৎ এইসব ব্রাহ্মণদের আদি বাসস্থান ছিল যেসব গ্রামে সেইসব গ্রামের নাম থেকেই হয়েছে তাঁদের পদবির উৎপত্তি। অবশ্য অনেক গাঞিনাম কালক্রমে পরিবর্তিত হয়েছে এবং সেগুলোই প্রাধান্য লাভ করেছে। এদের উদাহরণ দিয়েই শুরু করা যাক। বাঙালি ব্রাহ্মণদের দুটি প্রধান শ্রেণি — রাঢ়ী এবং বারেন্দ্র। রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের যেসব পদবি সবচেয়ে পরিচিত সেগুলি হল চট্টোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায় এবং ঘোষাল। প্রথম চারটি পরিবর্তিত পদবি। আদি পদবি গ্রাম নাম অনুসারে চাটুতি বা চট্ট, বাড়বি বা বন্দ্যঘটি, মুখটি, গাঙ্গুর বা গঙ্গ। চাটুতি গ্রামের ব্রাহ্মণপণ্ডিত বা উপাধ্যায় (যার অপভ্রংশ ওঝা) হয়ে উঠেছিল চাটু আর ওঝার সম্মিলনে চাটুজ্যা, তার থেকে চাটুজ্যে, পরে সংস্কৃতায়নে চট্টোপাধ্যায় (চট্ট+উপাধ্যায়)। তেমনই বাড়ব গ্রাম থেকে বাড়বি বা বাড়ুরি, পরে বন্দ্যোপাধ্যায়। মতান্তরে, বন্দ্যঘটি থেকে সরাসরি বন্দ্যোপাধ্যায়। মুকুটি বা মুখুটি গ্রাম নাম থেকে মুখুজ্যে, পরে মুখোপাধ্যায়। গাঙ্গুর গ্রাম নাম থেকে গাঙ্গুরি, তার থেকে গাঙ্গুলি এবং পরে গঙ্গোপাধ্যায়। মতান্তরে, গঙ্গ থেকে সরাসরি গঙ্গোপাধ্যায়। ঘোষাল এসেছে ঘোষ গ্রাম নাম থেকে। আদিতে রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের গাঞি পদবি ছিল ঊনষাটটি। এদের সবগুলির দেখা এখন মেলে না। অনুমান করা যায় সেগুলি অন্য পদবিদের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। সীমিত পরিসরে কিছু কিছু গাঞিনাম পদবি হিসাবে প্রচলিত আছে। যেমন, বটব্যাল কাঞ্জিলাল কুশারী কুলভি পালধি গড়গড়ি পতিতুণ্ডি বাপুলি ইত্যাদি। তেমনই বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের একশোটি গাঞি পদবির মধ্যে পাঁচটি সুপরিচিত — বাকচি (বাগচি), লাহিড়ি, মৈত্র, ভাদুড়ি আর সান্যাল। এক আতর্থী বাদে অন্যেরা বিলুপ্তপ্রায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষদের পদবি ছিল কুশো গ্রাম থেকে সৃষ্ট কুশারী। রাঢ় অঞ্চল থেকে যশোরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে তাঁরা স্থানীয় মানুষদের কাছে ঠাকুরমশাই হয়ে ওঠেন, তার থেকে ঠাকুর পদবি। তবে তার আগের থেকেই ব্রাহ্মণ পদবি হিসাবে বাংলায় ঠাকুর প্রচলিত ছিল। পাশ্ববর্তী রাজ্য বিহারে ঠাকুর নাপিতের পদবি।
বাংলায় এক কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে বৌদ্ধযুগ পরবর্তী সময়ে বাংলায় ব্রাহ্মণপণ্ডিতের অভাব থাকার কারণে মহারাজা আদিশূর কান্যকুব্জ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণ নিয়ে আসেন। তাঁদের নাম — ভট্টনারায়ণ, শ্রীহর্ষ, দক্ষ, ছান্দর এবং বেদগর্ভ। তাঁদের সঙ্গে এসেছিলেন পাঁচজন কায়স্থ -- মকরন্দ ঘোষ, বিরাট গুহ, দশরথ বসু, পুরুষোত্তম দত্ত এবং কালিদাস মিত্র। আদিশূরের ঐতিহাসিকতা প্রমাণিত হয়নি, আর কায়স্থদের যে পদবিগুলির উল্লেখ করা হয়েছে উত্তরপ্রদেশে কায়স্থদের পদবি হিসাবে সেগুলি প্রচলিত নয়। সুতরাং আদিশূর কাহিনি কিংবদন্তীই। দক্ষিণ ভারতীয় কিংবদন্তীতে অন্তর্বেদি অর্থাৎ কনৌজ অঞ্চল থেকে পাঁচ সদ্ব্রাহ্মণ ও তাঁদের ছত্র-পাদুকাবাহী পাঁচ শূদ্রভৃত্য তামিলনাড়ুতে নিয়ে আসার কাহিনি পাওয়া যায়। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে এই কিংবদন্তী সেনযুগে তামিলনাড়ু থেকে বাংলায় আমদানি করা হয়েছিল। অনেকে মনে করেন কায়স্থদের আদি বাস ছিল মেদিনীপুর জেলায়, সেখান থেকে তাঁরা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন।
বাংলায় ব্রাহ্মণদের পদবি মূলত গ্রামনাম ভিত্তিক হলেও তার বাইরেও কিছু আছে। আগে উল্লিখিত হয়েছে শর্মা আর গোস্বামী নামের উৎপত্তি বিষয়ে। অধুনা শর্মা বাঙালিদের মধ্যে দুর্লভ হলেও গোস্বামী প্রচলিত। গোত্রনাম সরাসরি পদবি হয়ে ওঠার উদাহরণ শাণ্ডি্ল্য ভরদ্বাজ গৌতম, যদিও উত্তর ভারতে কাশ্যপ কৌশিক বৃহস্পতি প্রচলিত। ব্রাহ্মণদের বৃত্তিমূলক পদবিগুলির মধ্যে রয়েছে আচার্য ভট্ট ভট্টাচার্য উপাধ্যায় ওঝা ঘটক পাঠক পাণ্ডা(পণ্ডা) শাস্ত্রী পণ্ডিত। আচার্যের মূল অর্থ বেদ বিষয়ে শিক্ষাদানকারী, পরে অর্থবিস্তারে হয়েছে যে কোন শিক্ষক। বিভিন্ন বংশের পরিচয়দাতা ভট্ট নামে অভিহিত হতেন। আদি পদবি ভট্ট, তার সঙ্গে আচার্য যোগ করে ভট্টাচার্য প্রণীত-পদবি। উপাধ্যায় টোলের শিক্ষক, ওঝা উপাধ্যায়ের অপভ্রংশ, পাঠক অবশ্যই শাস্ত্র বা পুরাণ পাঠ করে সাধারণ্যে ব্যাখ্যাকারী, পাণ্ডা ধর্মস্থানে পূজাকর্মাদি সম্পাদনের পুরোহিত, ঘটক বিবাহ সম্পাদনে দুপক্ষের মধ্যে সংযোগসাধনকারী, শাস্ত্রী সাধারণভাবে শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি, পণ্ডিত একটি বেদ বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনকারী অথবা সাধারণভাবে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। যাঁরা দুটি তিনটি বা চারটি বেদে পারঙ্গম উত্তর ভারতে তাঁদের পদবি ছিল দ্বিবেদী ত্রিবেদী চতুর্বেদী, আরো পূর্বদিকে বিহারে এসে যেগুলোর পরিবর্তিত রূপ দুবে তেওয়ারি চৌবে। বাংলায় রামেন্দ্রসুন্দরই কি ত্রিবেদী পদবির শেষ প্রতিনিধি? হয়তো নয়। বঙ্গভাষী তেওয়ারির দেখা পাওয়া যায় বর্ধমান মেদিনীপুর জেলায়। এঁদের পূর্বপুরুষেরা অবশ্যই বিহার থেকে বাংলায় এসেছিলেন। যাই হোক, এইসব পদবিধারীরা এখন আদিবৃত্তি থেকে সরে এলেও তাঁদের পদবি বজায় রেখেছেন। এমনটা ঘটেছে ব্রাহ্মণেতর পদবির ক্ষেত্রেও — বৈদ্য, কর্মকার, উকিল, গায়েন, বায়েন, বণিক, নাইয়া, গোপ্পী, কীর্তনীয়া শেঠ ইত্যাদি তারই উদাহরণ। প্রসঙ্গত, বৈদ্যের অপভ্রংশ বেইজ বা বেজ। গোপ্পী এসেছে গাল্পিক থেকে, গল্প শোনানোই ছিল যাঁদের বৃত্তি বা উপজীবিকা। শেঠ বণিক সম্প্রদায়ের পদবি, এসেছে শ্রেষ্ঠী থেকে। এরই পরিবর্তিত রূপ কর্ণাটকে শেট্টি, তামিলনাড়ুতে চেট্টিয়ার।
বাঙালির পদবির এক বড়োসড়ো অংশ এসেছে উপাধিনাম থেকে। মধ্য যুগে রাজা মহারাজারা সম্ভ্রম-উদ্রেককারী নানা উপাধি গ্রহণ করতেন, কৃতী এবং বশম্বদ প্রজাদের উপাধি প্রদানও করতেন। চক্রবর্তী এমনই এক উপাধি, যেটার অর্থ ছিল সার্বভৌম নৃপতি। পরে এই উপাধি ব্রাহ্মণপণ্ডিতদেরও দেওয়া হত তাঁদের অধিগত বিদ্যার স্বীকৃতি হিসাবে এবং কালক্রমে তা তাঁদের পদবি হয়ে উঠেছে। বিদ্বানসূচক অন্যান্য উপাধিদের মধ্যে ছিল কাব্যতীর্থ স্মৃতিতীর্থ পঞ্চতীর্থ স্মৃতিতীর্থজ্যোতির্ভূষণ সরস্বতী ন্যায়রত্ন তর্কালংকার বিদ্যাসাগর ইত্যাদি। মূল পদবিকে স্থানচ্যুত করে এইসব উপাধিকে পদবির স্থান গ্রহণ করতে দেখা যেত, যার অন্যতম উজ্জ্বল উদাহরণ পরবর্তী কালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তবে এগুলো পুরুষানুক্রমিক হত না। সামন্ত হিন্দু যুগের রাষ্ট্রীয় উপাধি, পরে তা উপাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোমিলা থাপার জানাচ্ছেন, গুপ্তোত্তর যুগে যেসব রাজকর্মচারী ভূমিদান পেতেন তাঁরা সামন্ত উপাধি গ্রহণ করতেন। এর আদি অর্থ ছিল প্রতিবেশী, পরে পরিবর্তিত হয়ে অধস্তন শাসক হয়ে দাঁড়ায়। রায় শব্দের উৎপত্তি রাজ থেকে — ছোটোবড়ো ভূম্যধিপতিদের উপাধি। এরই দক্ষিণ ভারতীয় রূপ রাও। উত্তর ভারতে রাজ পদবি প্রচলিত। আভিজাত্যসূচক কিছু কিছু পদবি, যেমন অধিকারী আঢ্য চৌধুরী, এরাও সেই যুগে প্রদত্ত উপাধির সাক্ষ্য বহন করছে। অধিকারী হয়তো কোন ধর্মীয় অধিকারের কথাই ব্যক্ত করে। আঢ্যর অর্থ ধনবান। রাজশেখর বসুর মতে চৌধুরী ‘চতুর্ধুরিন’ শব্দের অপভ্রংশ, যার অর্থ চতুঃসীমানার অন্তর্গত অঞ্চলের শাসক বা রাজপ্রতিভূ। লোকেশ্বর বসুর মতে শব্দটি এসেছে চৌথহারী থেকে, যার অর্থ রাজপ্রতিভূ হিসাবে চৌথ বা উৎপন্ন শস্যের এক চতুর্থাংশ রাজকর আদায়কারী। উত্তর ভারতে পদবিটির রূপ চৌধরী।
মুসলমান আমলে প্রদত্ত বেশ কিছু সম্ভ্রান্ত উপাধি পদবি হিসাবে পুরুষানুক্রমে অনুসৃত হয়েছে এবং এখনও হয়ে চলেছে। এইসব উপাধিসূচক পদবির মধ্যে আছে সরকার মজুমদার হাজারি হাজরা হালদার খাঁ। খাঁ উপাধি মুসলমানরা বিজয়সূত্রে আমদানি করেছিল মঙ্গোল রাজদরবার থেকে। স্মর্তব্য কুবলাই খাঁ, চেঙ্গিস খাঁ। আমির ওমরাহরা নিজেদের নামের শেষে সম্ভ্রান্তসূচক খাঁ বা খান উপাধি সংযুক্ত করে নিলেন। সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলেছে। শুধু তাই নয়, সম্ভ্রান্ত বা কৃতবিদ্য হিন্দুদেরও এই উপাধি প্রদান করা হত। ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ রচয়িতা মালাধর বসুকে হুসেন শাহ ‘গুণরাজ খাঁ’ নামে ভূষিত করেছিলেন। সরকার বলতে বোঝায় মোগল আমলের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি। উত্তর ভারতে সরকারি আমলারা এখনও ‘সরকার’ নামে সম্বোধিত হয়ে থাকেন। হাজরা ও হাজারি এসেছে হাজার সৈন্যের মনসবদারি বা সেনানায়কের দায়িত্ব থেকে, আসামে পৌঁছে হয়েছে হাজারিকা। সাসমল (শাসমল)পদবিও তাই -- সহস্র মল্ল যাঁর অধীনে। মজুমদার বোধ হয় মজমা বা মৌজার অধিকর্তা। হালদার শব্দের প্রকৃত অর্থ জানা যায় না।
মোগল যুগে সরকারি চাকরির সূত্রে বহু পদবির সৃষ্টি হয়। যেমন তালুকদার চাকলাদার সমাজদার সমাদ্দার তরফদার মহলানবিশ সেহানবিশ খাসনবিশ পত্রনবিশ বকশি মুনশি মুস্তাফি বিষয়ী কারকুন শিকদার পোদ্দার ওয়াদ্দেদার নস্কর নায়েক মীরবহর ইত্যাদি। মহলানবিশ মহল্লার হিসাবরক্ষক, সেহানবিশ রাখতেন দৈনন্দিন হিসাব, কারকুন জমিদারের গোমস্তা, মুনশি ও মুস্তাফি কেরানি ও বড়োবাবু। শিকদার ছিলেন শান্তিরক্ষক, ওয়াদ্দেদার আদালতে ওয়াদা বা শপথ গ্রহণ করাতেন, নস্কর আসলে লস্কর — এযুগের হাবিলদার, নায়েক সেনাবাহিনির ল্যান্স কর্পরাল, মীরবহর ছিলেন নৌ-সেনাধ্যক্ষ। এইসব উপাধি থেকে উদ্ভূত পদবি যাঁরা ধারণ করতেন তাঁদের সকলেরই একটা-না-একটা আদি পদবি ছিল, কিন্তু সেগুলো হয়তো কেবলমাত্র পারিবারিক নথিপত্রে রক্ষিত আছে অথবা হয়তো পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। ইংরেজ আমলেও উপাধি প্রদান প্রথা অনুসৃত হয়েছে। রায়সাহেব রায়বাহাদুর খানসাহেব খানবাহাদুর স্যার ইত্যাদি ইংরেজ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত উপাধি শুধুমাত্র নামের আগে বসে শোভাবর্ধন করত, পদবি হয়ে ওঠেনি।
পদবির নাম আর জাতিনাম সমার্থক নয়। কোন একটা পদবি থেকে বোঝা যাবে না ব্যক্তিটি কোন্ জাতিভুক্ত। অন্যভাবে বলতে গেলে একই পদবির ব্যবহার একাধিক জাতির মধ্যে দেখা যায়। রাজ-প্রদত্ত উপাধিজাত কিংবা সরকারি পদে বহাল থাকার সুবাদে উপাধি থেকে প্রাপ্ত পদবি তো বটেই, অন্যান্য অনেক পদবির ক্ষেত্রে এ কথা খাটে। অধিকারী পাওয়া যাবে ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব মাহিষ্য সদগোপ কর্মকার মালাকার প্রভৃতি বর্ণহিন্দুদের মধ্যে, নমঃশূদ্রদের মধ্যেও। ঘোষ কুলীন কায়স্থ আর গোয়ালা দুটি জাতিরই প্রচলিত পদবি। সেন সোম দত্ত দে কর গুহ মুখ্যত কায়স্থ আর উগ্রক্ষত্রিয়দের পদবি হলেও সেন চব্বিশটি জাতির পদবি, সোম আটটি জাতির, কর বাইশটি জাতির। কুণ্ডু কায়স্থ বৈদ্য ছাড়াও আরও সাতাশটি জাতির পদবি, বিশ্বাস কায়স্থ ছাড়াও তিরিশটি জাতির পদবি। সিংহ তিরিশটি জাতির পদবি। পুরকায়স্থ মোটেই পুরো বা অর্ধেক কায়স্থ না হতেও পারেন। এটি একটি বৃত্তিসূচক পদবি, পুর বা নগরের কোন পদাধিকারে প্রাপ্ত। রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের ঊনষাটটি গাঞি পদবির মধ্যে নন্দীও একটি, যদিও এখন তা ব্রাহ্মণেতর কয়েকটি জাতির পদবি। দাস কোন জাতিবাচক পদবি নয়। দাসের অর্থ ভৃত্য হলেও এর উৎপত্তি অনুমান করা যায় দিবোদাস সুদাস কালিদাস জাতীয় দেবদেবীর সেবক পরিচায়ক নামের নামান্ত থেকে। বৈষ্ণবরা এই অর্থেই নিজেদের দাস বলে থাকেন এবং সেখানে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ ভেদাভেদ নেই। কায়স্থ থেকে শুরু করে অনেক বর্ণহিন্দু জাতির পদবি দাস, এবং তপশীলি জাতিরও। বিংশ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত বৈদ্যরা দাস পদবি ব্যবহার করলেও পরে তা দাশ বা দাশগুপ্ততে পরিবর্তিত হয়েছে। অথচ পৌরাণিক সূত্রে দাশ শব্দের সরলার্থ ধীবর --এমনই এক দাশরাজের কন্যা ছিলেন শান্তনুজায়া সত্যবতী।
বাঙালির পদবির অরণ্যে প্রবেশ করে তাদের পরিচয় নির্ধারণে উদ্যোগী হলে দিশাহারা হতে হবে। কী নেই সেখানে? পাওয়া যাবে খাদ্যবস্তুর নাম — গুড় চিনি আটা আলু পটোল কাঁঠাল পান পুঁই মাড়; জন্তুজানোয়ার পাখির নাম — হাতি ঘোড়াই বা ঘোড়ুই বোয়াল ঘুঘু নাগ এবং অবশ্যই সিংহ; ঘর ও গৃহস্থালির সরঞ্জামের নাম — ঘর ঘড়া চাকি বেলুন ঢাক ঢোল ঢেঁকি কপাট। আছে পর্বত পাহাড়ি পাঁজা রাহা অর্ণব হোম দণ্ড বল বর সাধু আশ তোষ শী এবং আরও অনেক। কিছু কিছু পদবি কয়েকটি জেলার নিজস্ব, যেগুলো অবশ্য কালক্রমে অন্যত্র প্রসারিত হয়েছে। মেদিনীপুরে প্রধানত মাহিষ্য জাতির পদবি মাইতি ধারা মান্না বেরা জানা কুইরি দিন্দা পিরি বারিক ঘণ্টা শাসমল খাঁড়া গাঁতাইত; প্রতিবেশী ওড়িশা থেকে আসা ব্রাহ্মণ পদবি — পাণিগ্রাহী সন্নিগ্রাহী পণ্ডা নন্দ হোতা দণ্ডপাট, কায়স্থ পদবি — মহান্তি সেনাপতি। বাঁকুড়া জেলায় কামিল্যা দরিপা প্রতিহার ঘর বেইজ রুজ শিট। পুরুলিয়া জেলায় মাহাতো। বর্ধমান জেলায় হাটি যশ মাজিলা সাঁই সর চিন্যা দাঁ তা দিগর। এদের মধ্যে বেশ কিছুর উৎস আর অর্থ উদ্ধার করা গে্ছে, বেশ কিছুর ক্ষেত্রে তা রয়েছে অজ্ঞাত। তাতে কি কিছু আসে যায়? কিছু কিছু পদবি সাধারণের কাছে উদ্ভট মনে হয়েছে এবং কখনও বা পরিহাসের বস্তুও হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘মুচিরাম গুড়’ কাহিনিতে তার নিদর্শন আছে। স্কুলের ছেলেরা তাকে উত্যক্ত করত এই ছড়া কেটে —
গুড়ের কলসিতে ডুবিয়ে হাতআমার পরিচিত এক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি সহপাঠীদের বিদ্রূপ সহ্য করতে না-পেরে এফিডেভিট করে তার পদবি গাঁতাইত (ইংরেজি বানানে Gantait – সহপাঠীদের উদ্ভাবনী চিন্তায় যা রূপ নিয়েছিল জ্ঞান-tight হিসাবে) থেকে চৌধুরীতে পরিবর্তন করে নিয়েছিল। একটু অনুসন্ধান করলে সে জানতে পারত গাঁতাইত এসেছে গাথাবিৎ(কবি) কিংবা সুনীতিকুমারের মতে গ্রন্থাগারিক অর্থে গ্রন্থাইত থেকে। সমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বতন্ত্র পরিচয় জ্ঞাপন ছিল পদবি সৃষ্টির প্রাথমিক উদ্দেশ্য। এখন পদবি পরিবর্তনের বিজ্ঞপ্তি মাঝে মাঝেই সংবাদপত্রে চোখে পড়ে। কোন আইনগত বাধ্যবাধকতা না-থাকলে পদবি পরিবর্তনের কথা না-ভেবে তাঁদের ‘গোঁফের আমি গোঁফের তুমি / গোঁফ দিয়ে যায় চেনা’ অনুসরণ করে ‘পদবির আমি পদবির তুমি / পদবিতে যায় চেনা’ বলে গর্বে নেচে বেড়াতে পরামর্শ দিতে পারি।
বুঝতে নারি সার কি মাত।
পদবি প্রসঙ্গের উপসংহার টানা যাক বাঙালি মেয়েদের পদবির কথা বলে। ছেলেদের মতো মেয়েরাও জন্মসূত্রে পিতার পদবিই প্রাপ্ত হয়, বিবাহের পর স্বামীর। কিন্তু উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাদের নামের সঙ্গে পদবি প্রযুক্ত হতে দেখা যায় না। বিবাহিতা ব্রাহ্মণ রমণীদের ক্ষেত্রে লেখা হত দেবী, অন্যদের দাসী। স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের সাথে আর মেয়েদের বাইরের কর্মজগতে প্রবেশের সুবাদে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। রবীন্দ্রনাথের অগ্রজা ও লেখিকা স্বর্ণকুমারী দেবী হিসাবেই পরিচিতা। অন্যদিকে প্রথম বাঙালি মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলির নাম স-পদবি উল্লিখিত। পরবর্তী সময়ে অনেক বিবাহিতা রমণী, যাঁরা উচ্চশিক্ষিতা এবং আর্থিক বিষয়ে স্বনির্ভর, পিতা ও স্বামীর যুগ্ম পদবি ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। দেখা যাচ্ছে দেবসেন, বসু ভট্টাচার্য, চক্রবর্তী চট্টোপাধ্যায় জাতীয় পদবি। মাতৃপরিচয় আইনগত অনুমোদন লাভ করায় আশঙ্কা একটাই থেকে যাচ্ছে -- চক্রবর্তী চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে পদবি দীর্ঘতর হবে, এবং তার পরের প্রজন্ম একই ধারার অনুসারী হলে ফরম ভর্তির সময় নির্দিষ্ট পরিসরে স্থানসংকুলান হবে তো!
তথ্য স্বীকারঃ
১। আমাদের পদবীর ইতিহাস -- লোকেশ্বর বসু (আনন্দ, কলকাতা), ২০১৫
২। বাঙ্গালীর ইতিহাস -- নীহাররঞ্জন রায় (দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা), ১৯৯৩
৩। বাঙালী জীবনের নৃতাত্ত্বিক রূপ – অতুল সুর (বেস্ট বুক্স্, কলকাতা), ১৯৯২