• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৫ | জুন ২০১৯ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • জয়সলমীর : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা


    বিকেলের পড়ন্ত রোদে জয়সলমীর শহরটি সত্যিই সোনার শহর বলে মনে হয়। জয়পুর বা যোধপুরের মত রং করা নয়। বাড়িঘর, অফিস, কাছা্রি থেকে মন্দির, দুর্গ — সবকিছুই স্থানীয় স্যান্ডস্টোন দিয়ে তৈরী। হালকা সোনালী-হলুদ পাথর বাড়িঘর বেশ ঠান্ডা রাখে। লোকেরা বলে ঐ পাথরের ওষুধের গুণাগুণও আছে। পাথরের বাটি, গ্লাস ইত্যাদি বিক্রি হয় প্রচুর। বাটি ভর্তি জল সারারাত রেখে পরের দিন সকালে খেলে অনেক অসুখবিসুখের উপশম হয় বলে শুনেছি।

    জয়সলমীর শহরটা রাজস্থানের অন্য ট্যুরিস্ট শহরগুলি থেকে বেশ দূরে। প্লেনে অবশ্য দিল্লী থেকে সোজা পৌঁছানো যায় কিন্তু আমরা গেছিলাম গাড়ীতে, উদয়পুর থেকে — পাক্কা দশ ঘন্টা লেগেছিল। কিন্তু লাভের মধ্যে আরাবল্লীর অপূর্ব পাহাড়ী জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া আর ধীরে ধীরে মরুভূমির ঘোমটা খোলা দেখে নিলাম।

    শহরটা ঠিক থর মরুভূমির মাঝখানে — পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সত্তর মাইল দূর মাত্র। ১১৫৬ সালে রাওল জয়সল, এই শহরের পত্তন করেছিলেন। সেই সঙ্গে জয়সলমীর দুর্গও। এই দুর্গই সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ছবি “সোনার কেল্লা”-র দুর্গ। স্যান্ডস্টোন দিয়ে আগাগোড়া তৈরী দুর্গটি ঠিক সোনার দুর্গই বটে।

    সীমান্তের এত কাছে বলে এখানে একটি বড়সড় মিলিটারী আবাস আছে। এই জন্যেই শহরটি বেশ ছিমছাম ও পরিচ্ছন্ন। উদয়পুর বা জয়পুরের তুলনায় ছোট্ট কিন্তু অনেক সুন্দর।

    মরুভূমির শহর বলে গরমের সময় তাপমাত্রা ১২০°ফা: ছাড়িয়ে যায়। শহরের বাইরে খোলা রোদ্দুরে হয়ত আরও গরম। থর মরুভূমিটা কিন্তু পৃথিবীর অন্য মরুভূমির চেয়ে অন্যরকম। সাহারা বা গোবিতে অন্তহীন বালির সমুদ্র। থরে কিন্তু এখানে ওখানে কাঁটাঝোপ, বাবলা (acacia) দু’একটা নিম গাছ, এমনকি লোকেদের বসবাসও দেখা যায়। অনেক আদিবাসীরা — ভিল, লোহার, রাবারি ও অন্যান্যরা পুরাকাল থেকেই মরুভূমিতে বসবাস করছেন। থর নাকি পৃথিবীতে সবথেকে বসবাসযোগ্য মরুভূমি। রাজস্থানের চল্লিশ শতাংশ লোক মরুভূমিতেই থাকে।


    দেওয়ালের গায়ে আলপনা
    তবে ফাঁকা জায়গাও অনেক আছে। বাড়িঘর ছাড়িয়ে একটু দূরে গেলেই দেখা যায় বালির চর — sand dunes — অনেক বড় বড় হোটেল ধারে কাছে রিসর্ট বানিয়েছে — অনেকে পাকা বাড়ি না করে তাঁবু খাটিয়েছে — ক্যাম্পিং-এর অভিজ্ঞতার জন্য। অবশ্যই এসব তাঁবুতে এসি, পাখা, ইলেকট্রিসিটি, গরম জল ও লাগোয়া বাথরুম সবই আছে। অনেকে এ গুলিকে Glammer Camp বা Glamp বলেন।


    যাত্রীবাহী উটের দল

    প্রত্যেক Glamp-এ উট ভাড়া করার ব্যবস্থা আছে। বিকেলে গরমটা একটু পড়লে ঝলমলে সাজানো উটে চড়িয়ে কাছাকাছি কোনো বালুচরে নিয়ে যায়। সেখানে বসে বেশ সূর্যাস্ত দেখা যায়। অনেকে চা-এর (বা অন্য পানীয়র) সরঞ্জামও নিয়ে যান। বেশ একটা ছোটখাট পিকনিক হয়ে যায়। মরুভূমি বলে পশুপাখির অভাব নেই। রাস্তার ধারে বুনো উট দেখেছি — বেশ আরামসে কাঁটা গাছের পাতা চিবুচ্ছে। এছাড়াও আছে সাপ, বেজী, বিছে, হরিণ, বুনো গাধা ইত্যাদি। আমাদের গ্ল্যামপের ঠিক পাশেই দেখেছি ইন্ডিয়ান বাজার্ড।

    সোনার কেল্লাটাই শহরের কেন্দ্র। ১৭শ শতাব্দী পর্যন্ত সব নগরবাসী আটশ’ বছরের পুরনো দুর্গটির ভেতরেই থাকত। বাইরে ছিল শুধু জঙ্গল। এখন নতুন শহর অনেকখানি ছড়িয়ে পড়েছে। তবু এখনো প্রায় ৪০০০ ব্রাহ্মণ রাজপুত কেল্লার ভেতরেই বসবাস করেন। এঁরা পুরোনো জমানার লোক — বংশানুক্রমে ঐতিহাসিক পুরোনো বাড়িতে (যাকে রাজস্থানে হাভেলি বলে) রয়ে গেছেন। মজার কথা — এই প্রজারা দুর্গে থাকে কিন্তু রাজা (অবশ্য আজকাল নামমাত্রেই) নিজে থাকেন দুর্গের বাইরে — নতুন শহরে। উলটো ব্যাপার, তাই না?

    ত্রিকূট পাহাড়ের ওপর এই দুর্গটি বিখ্যাত সিল্ক রুটের পথে পড়ে। স্বাধীনতার পর এই রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৩শ শতাব্দীতে আলাউদ্দিন খিলজী যুদ্ধ করে কেল্লা জয় করেন ও প্রথামত কয়েক’শ মহিলা জহর করে আত্মহত্যা করেন। দুশ’ বছর পর আকবর দুর্গ দখল করেন। এবার জহর করতে না দিয়ে একজন রাজপুত রাজকুমারীকে বিয়ে করেন। সেই থেকে দুর্গটি মোগলের দখলে রইল ১৮শ শতাব্দী পর্যন্ত।


    নাথমুল্লা-র হাভেলী

    হাভেলির উল্লেখ করেছি। রাজস্থানে সব শহরে গ্রামে এরকম বড়সড় পারিবারিক বাড়ি, প্রচুর জালি দেওয়া জানলা, ঝোলানো বারান্দা — কারুকার্য করা — এখানে বংশানুক্রমে অনেক পরিবার যৌথভাবে বসবাস করেন। কিছু কিছু হাভেলি কারুকার্যের জন্য দর্শনযোগ্য। তবে অনেকগুলোই ভাগাভাগি হয়ে গেছে। কিন্তু হাভেলির ঝুলন্ত বারান্দা, জালি দেওয়া জানলা, কারুকার্য করা দরজা ইত্যাদি বড় বড় হোটেল রেস্টুরেন্টেও দেখা যায়। পুরোনো শহরে নাথমুল্লার হাভেলিটি দর্শনযোগ্য তবে বাইরে থেকেই। ভেতরে পর্দানশীন মহিলাদের বসবাস এখনও। শোনা যায় নাথমুল্লা রাজার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন দুই ছেলে হাথী ও লালু এই হাভেলিটির দুই ভাগ তৈরী করে — একজন ডানদিক, অন্যজন বাঁদিক — একদম হুবহু একরকম কারুকার্য।


    জৈন মন্দির গেটের কারুকার্য

    জয়সলমীরে বেশ কয়েকটি মন্দির আছে-- শিবের মন্দির, দেবী চামুণ্ডার মন্দির ইত্যাদি। কিন্তু সবথেকে পুরোনো ও ঐতিহাসিক মন্দিরগুলি জৈন। দুর্গের ভেতরেও জৈন মন্দির রয়েছে। শহর থেকে ছ-সাত মাইল বাইরে লোদুর্ভা বলে একটি জায়গায় একটি জৈন মন্দির দুর্গের চেয়েও পুরোনো। মুসলমান আক্রমণকারীদের হাতে অনেকবার ধ্বংস হয়েছে। শেষ ১৯৭০ সালে মেরামত করা হয়েছে। ভারী সুন্দর দেখতে এবং অন্যান্য হিন্দু মন্দিরের তুলনায় অনেক পরিচ্ছন্ন ও নির্জন। আপনার যদি একটামাত্র মন্দির দেখার ইচ্ছা বা সময় থাকে তবে লোদুর্ভার এই জৈন মন্দিরটি দর্শন করে নেবেন।


    বড়া বাগের ছত্রী

    জয়সলমীরে আমার সব থেকে প্রিয় জায়গা বড়া বাগ (বড় বাগান)। শহর থেকে মাইলখানেক দূরে একটি টিলার ওপর অনেকগুলি স্যান্ডস্টোনে তৈরী ছত্রীর সমাবেশ। চারদিকে আমের বাগান। এই ছত্রীগুলি রাজা বা রাজপ্রাসাদের যে কোনো উঁচু পদের ভি.আই.পি-দের স্মৃতিস্তম্ভ। কোনোটি ছোট্ট, ছিমছাম, কোনোটি বা বেশ বড়সড় — নানারকমের কারুকাজ, দেয়ালে ও ছাদে। প্রত্যেকটিতে একটি ফলকে স্মৃতির মালিকের নাম ও মৃত্যু তারিখ লেখা। বেশীর ভাগই ১৮শ শতাব্দীতে তৈরী। এঁরা সবাই রাজপুত বংশীয় তাই এটা সমাধির জায়গা নয়। শুধুই স্মৃতিচিহ্ন। সমস্ত জায়গাটা সূর্যের আলোয় ঝকমক করে। ভেতরে পাথর থেকেও যেন আলো ফুটে বেরোয়। জায়গাটি নির্জন ও বেশ পরিষ্কার - পিকনিক করা বা ফোটো তোলার উপযুক্ত।

    রাজস্থানের একেবারে গভীরে থাকার দরুন সব জায়গায় চোস্ত রাজস্থানী খাবারই খেতে হয়েছে। আগে কেমন ছিল জানি না কিন্তু ইদানীংকার রাজনীতির কারণে বেশীরভাগ খাবার নিরামিষ। আমিষ খাবারের মধ্যে একমাত্র মাটনকারী — এরা যাকে “লাল মাস” বলে। মাছ-টাছ তো দূর অস্ত। আর নিরামিষ খাবারের মধ্যে সব থেকে পর্যাপ্ত “দাল-বাটি-চুর্মা”-- প্রত্যেক রাজস্থানী “থালি”তে এ-তিনটে থাকবেই। ডাল তো যে-কোনো সাধারণ ডাল হলেই হল। মশলাদার তড়কা দেওয়া। বাটি-টা একধরনের রুটি (পাওভাজির ‘পাও’ এর মত) গোলাকার আটার বল — গরম কয়লার ওপর সেঁকা। আর চুর্মাটা একটা মিষ্টি পদ — বাজরা, গম, ঘী ও চিনির সংমিশ্রণে তৈরী। অনেকে গোলাপের আতরের ছিটেও দেন। খেতে কেমন? Acquired taste যাকে বলে। বাঙালী মুখে হয়ত রুচবে না কিন্তু রাজস্থানীদের এসব না হলে পেটই ভরে না।


    জ্বলন্ত তলোয়ার মাথায় কুইন হরিশের নাচ

    জয়সলমীরে থাকাকালীন আমার একটা কোনো প্ল্যান-না-করা হঠাৎ-সৌভাগ্য হয়েছিল কুইন হরিশের নাচ দেখবার। অনেকেই হয়ত কুইন হরিশের নাম শুনেছেন, ইনি রাজস্থানী লোকনৃত্যে পারদর্শী, এখন দেশে ও বিদেশেও প্রচুর নামডাক। ভদ্রলোকের আসল নাম হরিশ কুমার। বয়স প্রায় চল্লিশ। হালকা পলকা শরীর। বিয়ে করেছেন, দুটি ছেলেমেয়েও আছে। কিন্তু স্টেজে যখন নামেন — একেবারে সুন্দরী অপ্সরার সাজে — নিখুঁত মেক আপ, চোলি ঘাগরা পরে তাঁকে দেখলে একেবারেই পুরুষ মনে হবে না। মাথায় জলের ঘড়া নিয়ে বা জ্বলন্ত তলোয়ার দাঁতে কামড়ে, বিদ্যুৎগতিতে পা ফেলেন তবলার সঙ্গে তাল রেখে। ভদ্রলোক খুবই অমায়িক। নাচের পর ঘন্টা খানেক ধরে ফ্যানদের সঙ্গে পোজ দিয়ে ফোটো তুললেন। ছেলে, বুড়ো সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথাও বললেন। এই নৃত্যপ্রদর্শনী আমার একটা হঠাৎ পাওয়া অভিনব অভিজ্ঞতা। এর আগে আমি এঁর নামও শুনিনি কখনো।

    বিস্তৃত মরুভূমি, ঝলমলে সাজানো উটের দল, বড়া বাগ-এর ছত্রী, দাল-বাটি-চুর্মা, কুইন হরিশ সব মিলিয়ে জয়সলমীরের স্মৃতি জমা রইল মনের কোঠায়।


    মরুভূমিতে উটের সারি


    (ভ্রমণকাল-- ফেব্রুয়ারি ২০১৯)


    এ-যাত্রার প্রায় তিনমাস পরে রাজস্থানের রাস্তায় এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় কুইন হরিশের মৃত্যু হয়।





    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখিকা
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments