১৬ এপ্রিল ২০১৯
রাত ১০টা - দার্জিলিং মেল ভরপেট লোক নিয়ে শিয়ালদহ স্টেশন ছাড়ল। আমরা সাত বয়স্ক চলেছি বরসে যাবার উদ্দেশ্য নিয়ে।
১৭ এপ্রিল
সকাল ৬টা - ঘুম ভাঙল। রাতে ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল, এখন অবশ্য বন্ধ।
সকাল ৯টা- নিউজলপাইগুড়ি। দিব্যি রোদ, বেশ গরম।
সকাল ১০.২৯- হিলে যাবার গাড়িতে মাল উঠল মাথায়, আমরা ভেতরে।
সকাল ১১টা-সেবক বাজারে দিব্যি এক রেস্তোরাঁয় 'উপবাস ভঙ্গের' আশায়।
ঠিক দুপ্পুরবেলা-আহারান্তে পুনর্চলন।
বেলা ১২.৫৭-তিস্তাবাজারে তিস্তাকে ডিঙোনো।
বেলা ১.৩৫-মল্লিতে পুল পেরিয়ে পশ্চিম সিকিমের এলাকায়।
বেলা ১.৫৫-উন্নয়নের সম্মুখীন। রাস্তা চওড়া করার জন্য পাহাড় ফাটানো পাথর সরানোয় ব্যস্ত দানবযন্ত্র। ফলে যাতায়াত স্তব্ধ।
বেলা ২.৪৬-অবশেষে বেগুনপোড়া হওয়া থেকে রেহাই। নড়ার সুযোগ পেল গাড়ি।
বেলা ৩.০৮-জোড়থাংয়ে রঙ্গীতকে পুলে চড়ে পেরিয়ে নয়াবাজার।
বেলা ৩.৩৪-পথ চড়ছে গরম কমছে।
বিকেল ৪.০২-বেশ আরামদায়ক ঠান্ডা।
বিকেল ৪.২৩-দারামদিন। আর বলা যাবে না গরম দিন।
বিকেল ৪.৪০-সোমবারে। দিব্যি বড় জায়গা। একসময় এই অবধি গাড়ির যাতায়াত ছিল।
বিকেল ৪.৫৩- আনডেন। একটা মাত্র হোমস্টে।
বিকেল ৫.১০- ওখরে। বেশ মনোরম। ৭৬০০ফুট।
বিকেল ৫.২১--হিলে। গাড়িপথের শেষ বাঁকে থামল গাড়ি। দুটো মাত্র হোমস্টে। আমাদের আস্তানায় পৌঁছতে হলে অন্তত চল্লিশটা পাথুরে সিঁড়ি ভাঙতে হবে।
বিকেল ৫.৩৬- 'বরসে রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারির' প্রবেশ পথের গা ঘঁষে রেডপান্ডা হোমস্টে। ঠাসবুনোট রডোডেনড্রন আর বাঁশবনের মাঝে শান্তির আগার। আস্তানায় পৌঁছতে হল প্রচুর রডোডেনড্রনের গা ঘেঁষে — গোলাপী, সাদা, লাল সবাই হাজির। পাখিরা মাঝমধ্যে এসে দেখে যাচ্ছে ক্লান্ত আগন্তুকদের। আমরা এসে পড়েছি বলেই কিনা জানি না, বিদ্যুৎবাবু বিদায় নিয়েছেন। গত ক'দিনের শিলাবৃষ্টিই এর কারণ বলে হোমস্টের মালিক আমাদের সান্ত্বনা দিলেন। উনি আবার এখানকার রেঞ্জারও।
১৮ এপ্রিল
সকাল ৬.০৭- ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। কপাল চাপড়ালাম। ক্যামেরা গুছিয়ে রেখে এসেছি বাড়ির সোফায়। মোবাইলে আর কতটুকু ধরা যায়! রাস্তায় গিয়ে পান্ডিম জুপলু তিনচেনখাং নরসিংদের দেখে এলাম। দুর্যোগ না হলে নাকি চতুর্দিক রঙেরঙে ভরে থাকত। বেশিরভাগ ফুলই নাকি ঝড়ে ঝরে গেছে।
সকাল ৭টা- চা-পান সহযোগে পরবর্তী কার্যক্রমের প্রস্তুতি।
সকাল ৮টা- নরম রোদ, ফুলের ভিড় আর পাখির ডাকের মাঝে ব্রেকফাস্ট। ঠিক হলো দু-জন হিলে থেকে হিলবে না, পাঁচজন যাব বরসে। গেটের ধারেই টিকিটঘর — মাথাপিছু ৫৫টাকা, ক্যামেরাপিছু ৫০টাকা।
সকাল ৮.২৮-- পাঁচ বুড়োবুড়ির, তাদের দু-জন আবার ৭০-এর ওপারে। (কল্যাণদার আবার পালটানো কোমর!) মিছিলটা চলল রডোডেনড্রন আর বাঁশের জঙ্গলের পথে। ওদের কষ্ট কমাতে গাছেরা মাথার ওপর চাঁদোয়া গড়ে দিয়েছে, ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যকিরণ আলোর আঙুল ছুঁইয়ে দিচ্ছে মাঝেমধ্যে।
সকাল ৯.৩৫- আস্তে আস্তে হালকা চড়াই অল্প উতরাই অল্প থামা রডোডেনড্রন দেখা আমাদের নিয়ে ফেলল পয়লা 'বিশ্রাম-ছাউনি'তে। যে যতটা পারল, এলিয়ে পড়ল।
সকাল ৯.৫২- জলপান বিরতি সমাপনান্তে গাত্রোত্থান।
সকাল ১০.১২- একটু না-বসা বিরতি।
সকাল ১০.৩১- দ্বিতীয় ছাউনি। কল্যাণদার কষ্ট হচ্ছে, বুঝতে পারছি। স্রেফ মনের জোরে চলেছেন। খানিক চলার পরেই দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে।
সকাল ১০.৪৮- পথের চড়াই উতরাই বেড়েছে, বেড়েছে কল্যাণদার কষ্ট। রডোডেনড্রনরাও বেড়েছে সংখ্যায়।
সকাল ১১টা- তৃতীয় ছাউনি। স্বাভাবিকভাবেই কল্যাণদার বিশ্রাম দীর্ঘায়িত হলো। ওঁকে কেকাদির সঙ্গে ফেরৎ পাঠাবার কথা ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে মাথায়।
সকাল ১১.১৮- হৃদয়ের কথা না শুনে মগজের কথায় সায় দিয়ে কল্যাণদাদের ফিরতি পথে পাঠাতে বাধ্য হলাম। সামনে আধ কিলোমিটারের একটানা চড়াই।
দুপুর ১২.০৬- খানিক আগে থেকেই গাছপালারা আকাশকে বেশি জায়গা ছেড়ে দিচ্ছিল, এবার উঠে এলাম এক পাঁচিল আর জালঘেরা জলাশয়ের ধারে। তাকে ঘিরে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে রডোডেনড্রনের দল।
দুপুর ১২.০৯- পুকুর পেরোতেই পথ নেমেছে হালকা চালে রডোডেনড্রন বনবীথির মাঝে।
দুপুর ১২.১৬- বরসে গুরাঁসকুঞ্জ বাংলোর চত্বরে। অনেক পর্যটক এবং তার তিনগুণ স্থানীয় মানুষে গমগম করছে চত্বর। এইসব দেখেই বোধহয় রডোডেনড্রনেরা বেশ খানিকটা সরে বসেছে। কাঞ্চনজঙ্ঘাও লুকিয়েছে মেঘের আড়ালে।
দুপুর ১২.৫৫- ডাল ভাত সবজি অমলেটে পেট ভরিয়ে, গার্গীদি সন্দীপদাকে ধীরেসুস্থে নামতে বলে পা ছোটালাম — কল্যাণদাদের শেষবেলাটুকুতেও যদি সাহায্য করতে পারি।
বেলা ১.২৭- 'তিন নম্বর ছাউনি'তে প্রথম বিশ্রাম। একদল স্কুলের ছাত্রছাত্রী বরসেতে 'পিকনিক' সেরে কলকলিয়ে ফিরছে। গোটা অরণ্য আনন্দমুখর।
বেলা ১.৪৩- 'দ্বিতীয় ছাউনি'।
বেলা ১.৫১- ডানপায়ে টান স্পীড ব্রেকারের কাজ করছে।
বেলা ২.০২- 'এক নম্বর ছাউনি'তে পদসেবা।
বেলা ২.৩৯- ধরে ফেললাম কল্যাণদাদের। অসম্ভব ক্লান্ত আর শ্রান্ত দু-জনে।
বেলা ২.৪৮- অরণ্যমোচন করে হিলে। কল্যাণদা কেকাদির লাঞ্চের ব্যবস্থা করতে হবে।
বেলা ২.৫৩- কল্যাণদারাও হোমস্টে-তে ফিরে স্টেব্ল্ হলো। তিন দিকের রডোডেনড্রন আর পাখিরা স্বাগত জানালো।
বিকেল ৪.২৪- গার্গীদিরাও ফিরে এলো। শুধু কারেন্ট ফেরেনি।
বিকেল ৫.৫৫- হিলেতে সকলে মিলে চা-পকোড়া সহযোগে স্বর্গগুলজার।
রাত ৮.১৮- দ্বিতীয় 'ক্যান্ডললাইট ডিনার'।
১৯ এপ্রিল
সকাল ৮টা- আজ হিলের টপহিল থেকে ওখরের মিডল হিলে যাওয়া — অতএব একটু বেশি করে চা খাওয়া। সকালে পান্ডিম থেকে নরসিং ছিল অবারিত — কাঞ্চনজঙ্ঘাও বনের আড়াল থেকে মুণ্ডু বাড়িয়ে টা টা বলল।
সকাল ১০.০১- নির্গমন।
সকাল ১১টা- প্রকৃতি মাখতে মাখতে হঠাৎ চড়াই মেরে ওখরে গুম্বা। প্রাচীন, শান্ত অনেক পারমুটেশন কম্বিনেশনের পর গুম্বার তালা খুলল।
সকাল ১১.৪৪- আস্তানার সন্ধানে সাত বুড়োবুড়ি। এক জায়গায় জায়গা না মিললেও চমৎকার কফি মিলল। হোমস্টে-র মালিক নানা জায়গায় ফোন করে ব্যবস্থা করে দিলেন।
ঠিক দুপ্পুরবেলা- ভদ্রলোক স্কুটার নিয়ে আমাদের সঙ্গে এসে পৌঁছে দিলেন। বেশ সুন্দর পরিবেশ। সামনে যতদূর চাও, কড়াইশুঁটি আর আলু বাঁধাকপির ক্ষেত পেরিয়ে দৃষ্টি উড়ান দেয় দিগন্তে। পথের ধারে গুটিকয় বাড়ি — দু-পা দূরে আলাপ করতে উৎসুক জঙ্গল। সব আছে — শুধু একজনই অনুপস্থিত বিদ্যুৎবাবা, ফোনেরা মৃতপ্রায়।
সন্ধ্যা ৬.০৬- বিদ্যুৎবাবা বার দুই চুপকি দিয়ে গেছেন। আজ রাতে কেকাদির নেতৃত্বে খিচুড়ি রন্ধন উৎসব — তারই তোড়জোড় চলছে। বর্ষা মাঝেমধ্যেই সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে।
রাত ৯টা- আমাদের খাওয়া শেষ হতেই চারদিন পর বিশ্বভ্রমণ সেরে বিদ্যুতের প্রত্যাবর্তন।
২০ এপ্রিল
আজ আবার মহাউষ্ণতার কারাগারে প্রত্যাবর্তন। সে কাহিনী না হয় উহ্যই থাক।