• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৫ | জুন ২০১৯ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • “নিষিদ্ধ লোবান”-- অমানবিকতার বিরুদ্ধে মনুষ্যত্বের জয়ের কাহিনি : নাহার তৃণা

    নিষিদ্ধ লোবান—সৈয়দ শামসুল হক; প্রকাশক: অনন্যা, ঢাকা; প্রচ্ছদঃ মাসুক হেলাল; প্রথম প্রকাশঃ এপ্রিল ১৯৮১; পৃষ্ঠাঃ ৭১; ISBN: 984 701050481 1

    একটি দেশের জন্মযুদ্ধের ইতিহাস শুধু গৌরবগাথা নিয়ে হয় না। অশ্রু আর রক্তের অক্ষরেও লেখা হয়। আর সেটি যদি হয় বাংলাদেশ নামের দেশটির জন্মযুদ্ধের কাহিনি তবে এক নদী রক্ত, লক্ষ মা বোনের অশ্রু উজিয়ে পৌঁছাতে হয় সে ইতিহাসের কাছে। আত্মদানের নিদারুণ দুঃখ জাগানিয়া ইতিহাস, বুকভর্তি দ্রোহ নিয়ে আগুন পাখি হয়ে ওঠবার কথা তাই বাংলাদেশের পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের বুক জুড়ে। স্বভাবতই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আমাদের প্রাত্যহিক জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনাসহ শিল্প সাহিত্যের নানান শাখায় আপন মহিমায় চলমান থাকবার কথা ছিল । কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের জীবন যাপন কিংবা রাষ্ট্রীয়ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধকে সেভাবে স্হাপনে আমরা চরমভাবে ব্যর্থ। তবে আশার কথা, রাষ্ট্রীয়ভাবে কিংবা প্রাত্যহিক জীবনযাপনে একে সেভাবে ধারণ করতে ব্যর্থ হলেও একদল শিল্পী তাঁদের আপন আপনক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করে গেছেন, যাচ্ছেন। এঁরা কেউ শব্দকারিগর, কেউ রঙের বাজিকর। শিল্প সাহিত্যের নানান শাখায় এইসব শিল্পীরা এঁকে চলেছেন, লিখে চলেছেন, গড়ে চলেছেন। এঁরা আঁকিয়ে, লেখক কিংবা স্থাপত্যকুশীলব।

    মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এসব শাখার মধ্যে সবচে' বেশি কাজ হয়েছে সাহিত্যে। গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা ইত্যাদি নানান শাখায় অসংখ্য কাজ হয়েছে। উপন্যাস তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য শাখা। নানান পটভূমিকায় রচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক অসংখ্য উপন্যাস, তার মধ্যে কিছু উপন্যাসকে এখনই হয়তো ‘কালোত্তীর্ণ’ আখ্যা দেওয়া যায়। সৈয়দ শামসুল হক রচিত 'নিষিদ্ধ লোবান' রকম একটি উপন্যাস। মাত্র ৭১ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসের পরিধি খুব বেশি বিস্তৃত হয়ত না। কিন্তু তার দ্রোহ কিংবা যে গভীর বোধের বিষয়টি সৈয়দ হক তাঁর নিপুণ লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন, তার রেশটি ভীষণ গভীর, বড়বেশি মানবিক। উপন্যাস গড়িয়েছে মোটামুটি দুই-আড়াই দিন-রাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। একদিকে দানবরূপী পাকিস্তানী বর্বর হানাদার বাহি্নী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার। যাদের অধিকাংশই বিহারী। অন্যদিকে বিলকিস ও সিরাজ। উপন্যাসে জীবিত চরিত্রের চেয়ে লাশ সংখ্যায় বেশি। যে লাশগুলো পড়ে আছে পাকিস্তানীদের বর্বরতার সাক্ষী হয়ে খোলা আকাশের নীচে। ডিক্রি জারি হয়েছে, লাশগুলো ওভাবেই পড়ে থাকবে, শেয়াল-শকুনের খাদ্য হবে। কারণ পাকিস্তানী বাহিনী নিজেদের শৌর্য আর বীর্যের গর্বে এতটাই মাত্রা ছাড়িয়েছে যে নিজেদের বাদে বাকিদের অবলীলায় কুকুর হিসেবে ভাবতে দ্বিধা করেনি। এমন অমানবিক একটা পরিস্হিতির মুখে বিলকিস সিদ্ধান্ত নেয় সে তার ভাই খোকার লাশকে কবরের মাটি দেবে। একদল অমানবিক মানুষ নামের পশুর বিরুদ্ধে আপাত শোকহীন বিলকিস বুকভর্তি দ্রোহ নিয়ে ভ্রূক্ষেপহীন ভাবে এগিয়ে যায়। কারণ, "শোক কখনো এত বড় নয় যে মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।" মনুষ্যত্ববোধই মানুষকে সাহসী করে তোলে, বিলকিস তাই ভয়হীন, মৃত্যুচিন্তাহীন সাহসী।

    জলেশ্বরীর মাটিতে সফোক্লিসের পাতা ফুঁড়ে কি নেমে আসে আরেক ভাইহারা বোন আন্তেগনে (Antigone)? যে ঠিক বিলকিসের মতো শোকে বিহ্বল না হয়ে ফুঁসে উঠেছিল থিবস্ অধিপতি ক্রেয়নের ডিক্রির বিরুদ্ধে, তার ভাইয়ের প্রাণহীন দেহ কখনোই খোলা আকাশের নীচে পড়ে থাকবে না। সে আন্তেগনে, ভাই পোলিনিসাসকে যে-কোনো মূল্যে কবর দেবে। আশ্চর্যজনকভাবে এখানে এসে কেমন একটা মিল খুঁজে পাই মানুষে মানুষে! মনুষ্যত্ববোধে আক্রান্ত সব কাহিনিতে হয়ত জয় সেভাবে নিশ্চিত হয় না, কিন্তু মানুষ শেষমেশ ঠিক জিতে যায়। 'নিষিদ্ধ লোবান' উপন্যাস আমাদের জিতে যাবার সেই এলিজি শোনায়। ভাইকে কবর দেবার অটল সিদ্ধান্তে হাত মেলায় বিলকিসের সাথে সিরাজ। যে কিনা পাকিস্তানী বাহিনীর ধর্মীয় তাণ্ডবের আঁচ থেকে বাঁচতে প্রদীপ নামটি আড়াল করে সিরাজ হয়ে গেছে এক ফাঁকে। কাহিনি গড়িয়ে যায় শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্হিতির বর্ণনার হাত ধরে। রাতের অন্ধকার ভেদ করে আলোকময় দু'জন মানুষ স্তূপীকৃত লাশের কবর দেবার যুদ্ধে নেমে পড়ে। এ যেন যুদ্ধের ভেতরে আরেক মর্মস্পর্শী যুদ্ধ, মানুষকে সম্মানিত করবার জন্য মানুষের প্রাণপণ যুঝে যাওয়া। যা পাঠের আবেগ পাঠককে যতটা না ব্যথিত করে তারচে' বেশি করে ক্রুদ্ধ! পাকিস্তানী জানোয়ার বাহিনী কর্তৃক মনুষ্যত্বের এমন অপমান প্রকৃতি চোখ মেলে দেখতে লজ্জা পেলেও তার এই দুই সন্তানকে সাহায্য করতেই যেন "চাঁদ আরো সরে আসে। আকাশে আজ মেঘ নেই। চত্বরের ওপর বীভৎস শ্বেতীর মতো ছেঁড়া আলো পড়ে থাকে।" মেঘহীন আকাশে চাঁদের আলোর ভাবালুতায় ভেসে যেতে প্রকৃতিও দ্বিধাগ্রস্ত বুঝি!

    'নিষিদ্ধ লোবান'-এর জলেশ্বরী জনপদটি যেন যুদ্ধ আক্রান্ত রণক্ষেত্র, বিলকিস জননী বাংলাদেশ, যে তার মৃত সন্তানকে বুকে টেনে নেবার আয়োজন করে। পাকিস্তানী মেজর তার লালসার রাশ টেনে, নিজেকে নিজেই অসীম ধৈর্য্যের কথা শুনিয়ে তক্কে তক্কে থাকে হিন্দু রমণী ভোগের ক্ষণটির জন্য। সিরাজের শরীর আগুনের মাঝে প্রদীপ হয়ে জ্বলতে শুরু করলে বিলকিস আগুন পাখির মত দু'বাহু বাড়িয়ে মেজরকে টেনে নেয়। যে বীর্যের গর্বে কিছুক্ষণ আগেও মেজর দম্ভভরে বলেছিল "আমি তোমায় সন্তান দিতে পারব। উত্তম বীজ উত্তম ফসল। তোমার সন্তান খাঁটি মুসলমান হবে, খোদার ওপর ঈমান রাখবে, আন্তরিক পাকিস্তানী হবে, চাওনা সেই সন্তান? আমরা সেই সন্তান তোমাদের দেব, তোমাকে দেব, তোমার বোনকে দেব, তোমার মাকে দেব, যারা হিন্দু নয়, বিশ্বাসঘাতক নয়, অবাধ্য নয়, আন্দোলন করে না, শ্লোগান দেয় না, কমিউনিস্ট হয় না। জাতির এই খেদমত আমরা করতে এসেছি। তোমাদের রক্ত শুদ্ধ করে দিয়ে যাব, তোমাদের গর্ভে খাঁটি পাকিস্তানী রেখে যাব, ইসলামের নিশানা উড়িয়ে যাব। তোমরা কৃতজ্ঞ থাকবে, তোমরা আমাদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তোমরা আমাদের সুললিত গান শোনাবে।” তার সে দম্ভ চূর্ণ হয়, বাধ্য হয়ে সে শিখা অনির্বাণের অহংকারের কাছে সঁপে দেয় নিজেকে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এমন কত বিলকিসের আগুন পাখি হবার, কত প্রদীপের আলোকময় আত্মা বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে, তার সবটা হয়ত আমাদের জানা হয় না। তাই নিষিদ্ধ লোবান আমাদের যে কাহিনি শোনায়, আমরা বড় মমতায় শুনে যাই। কেননা এ কাহিনি আমার--আমাদের কাহিনি। এ কাহিনি মনুষ্যত্বের জয়ের কাহিনি!


  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)