• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৫ | জুন ২০১৯ | গল্প
    Share
  • আলো-আঁধার : গৌরী দত্ত


    কাঠের মেঝে। পার্কে ফ্লোর।

    পা ফসকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল পত্রালী। হাই-হিল চটি পরে চলার অভ্যেস নেই। কিন্তু আজ বিশেষ দিন, অনন্য সময়।

    আসছে কাল মেয়ে উপলার বিয়ে। আজ সন্ধ্যায় মেহেন্দি ও সঙ্গীত।

    গির্জার মত উঁচু সিলিঙের ফ্যামিলি রুম। কাঠের মেঝে, কাঠের দেয়াল, কড়িকাঠ। দেয়ালে একদিকে ধূসর আলপাকা লামা উলের ইকোয়াডোর থেকে আনা আসন। অন্যদিকে মরুভূমির বালির রঙের জাপানী বেতের মাদুর। ইতস্তত কিছু এশিয়ান আর্ট। চিয়াং মাই থেকে ব্রাশ পেন্টিং-এর কোয়ালা ভাল্লুক কচি বাঁশের শাঁস চিবোচ্ছে। কিছু কিছু যোগেন চৌধুরীর কাঠের এচিং। যামিনী রায়ের গেরুয়া-সিপিয়া-বার্ন্ট-অ্যাম্বার প্রাধান্যের কিছু ছবি। স্বপময় এই ঘরটা নিজের রুচি মত সাজিয়েছিল। শৌখিন স্বপ্নময়, তখনকার প্রাণবন্ত স্বপ্নময়। এখন বহুদিন সে এই ঘরে ঢোকেনি, উপরে নিজের ঘর থেকে নিচে নামতে পারেনি।

    ব্রাউন অন ব্রাউন, বলে উপলা এই ঘরটাকে। অন্যান্য দিন একটা শীতল নিঝুম ছায়াময় ভাব থাকে। আজ তার উলটো।

    ঘরের চার কোণে চারটে লম্বা ফ্লোর ল্যাম্প।

    একটু চোখ কুঁচকে তাকাল পত্রালী। বড় বেশি আলো। চোখ ধাঁধায়। ল্যাম্পের সিন্ধুসারসের গলার মত লতানো বাঁকানো ডাঁটির মুখে এক থোকা মোরগফুলের মত চারটে করে বাল্‌ব ঝুলছে। প্রত্যেকটার মধ্যে পেঁচানো জরির সুতোর মত তার পঁচাত্তর ওয়াটের বিদ্যুৎ আলো হানছে বড় খামারের মত ঘরটার আনাচে কানাচে। আগে কত দেশবিদেশ বেড়াত ওরা তিনজনে মিলে। কিন্তু সেসব দিন আর নেই। গত সাত বছরে এই শহরের চৌহদ্দি পেরিয়ে কোথাও যায়নি পত্রালী। স্বপ্নময়ও যায়নি। যবে থেকে মিশরে বেড়ানোর সময় পাগলা ধাবমান উটের পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে ঘাড়ের শিরদাঁড়া ভেঙেছিল স্বপ্নময়ের।

    প্লেন থেকে স্ট্রেচারে নেমেছিল স্বপ্নময়। চার হাত পা খোলনলচেহীন পুতুলের মত অসাড়। পেটে ফিডিং টিউব। ঝকঝকে রিসার্চ হাসপাতালে দু’মাস তার নবীকরণের যুদ্ধ চলল। কিন্তু হাত পায়ে অল্প জোর আসলেও শক্তির ফুঁ দিয়ে কোনো শাদা জুলফিওয়ালা বিজ্ঞ ডাক্তার, নীল এপ্রনধারী কোনো মমতাময়ী নার্স, বা ল্যাবকোট-পরিহিতা কোনো জাদুকরী ফিজিওথেরাপিস্ট তাকে দাঁড় করাতে পারল না।

    হাল্কা বাদামী ওক্‌ কাঠের কয়েক টুকরো মাছের কংকালের মত ক্রিসক্রস প্যাটার্নে তেরছা ভাবে বসানো। এই নকশায় চৌখুপ্পি করে ঢাকা পুরো মেঝেটা। সকালে পরিচারিকা সদলবলে বাড়ি পরিষ্কার করে গেছে, বিয়েবাড়ি বলে আরো হাসিমুখে ব্রাজিলিয়ান বিয়ের গান আর ওদের নাচের পা ফেলা তালের সাথে সাথে পার্কে ফ্লোর মেশিন দিয়ে পালিশ করেছে। পত্রালী দেখল গলা প্ল্যাটিনামের মত আলোর তোড়ে পার্কের কারিগরির সূক্ষ্মতা হেরিং মাছের হাড়ে হীরের কুচির মত চিক্‌চিক্‌ করতে লাগল। পালিশের তেল পিছলানো উষ্ণতার উপরে জুতোর গোড়ালি আরেকটু সাবধানে ফেলল। পদস্খলন না হয়। তা আবার এত লোকের সামনে।

    ‘মা, তুমি মেহেন্দি লাগালে না?’ উপলা জিজ্ঞেস করে পত্রালীকে। কনেকটিকাট থেকে দুই গুজরাটি ভদ্রমহিলা এসেছেন, মেধা ও অরুণা। তারা মেহেন্দি আঁকাতে প্রফেশনাল। মাটি রঙের মেহেন্দিপাতা বাটা গোল বাটিতে সাজিয়ে নিয়েছে তারা। নানান সাইজের বুরুশ ও নিব টেবিলে লম্বা করে রেখেছে। এক এক করে উপলার বন্ধুরা আসছে। নানান রঙের জামা, সালোয়ার কামিজ, লাহাঙ্গা, চুনরি, শাড়িতে বাড়ি রঙিন হচ্ছে। পত্রালী একটু ইতস্তত করল। বহুদিন ও সাজার কথা ভাবেনি। মুখে অল্প ক্রিম ও অল্প পাউডার ছাড়া গত সাত আট বছর আর কিছু ব্যবহার করেনি। তবে আজ না বললে উপলার মন খারাপ হবে। মেহেন্দির নানা ডিজাইন একটা ফাইলে এনেছেন--লতা, পাতা, পদ্মফুল, আমের মুকুল। পত্রালী একটা হাল্কা প্যাটার্ন বাছল--হাতের তালুতে একটা লক্ষ্মীর জোড়া পা দেওয়া আলপনা। অল্প সময়ের মধ্যে ওকে নানান কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে। মেয়ের মার হাতে আলাদা সময় নেই।

    সারা দিন বিশেষ কিছু খায়নি পত্রালী। এত আলোতে বেশি কিছু খায়নি পত্রালী। অন্য ঘরে স্বপ্নময়ের কোনো দরকার আছে কি না সেটাও মাঝে মাঝে দৌড়ে জেনে আসতে হয়।

    উপরে ওর নিজের বেডরুমে গেল পত্রালী। অসুস্থ স্বপ্নময় হসপিটাল-বেডে বড় বেডরুমে শোয়। খাটের মাথাটা অল্প উঁচু করা, আধবসা অবস্থায় টিভি দেখছে; বাংলা সিরিয়াল চলছে। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে শুধু বাংলাই দেখে সে। যেন মাতৃভাষাতেই তার কমফর্ট জোন, স্বস্তির জায়গা।

    –-‘অনেক মিষ্টি এসেছে খাবে?’-–প্রশ্ন করে পত্রালী। ‘মিষ্টি লাল দই তুমি তো ভালবাসো’।

    -- না, মাথা নাড়ে স্বপ্নময়। ক্ষীণ গলা। ট্রেকিওস্টোমি করার পর থেকে স্বরের জোর কমে গেছে। গত সাত বছরে সেই জোর ফিরে আসেনি। বিছানার পাশে পড়ে যাওয়া পাশবালিশটা তুলে দেয় পত্রালী। অসহায় শিশুর মত তার মধ্যবয়সিক স্বামী।

    পত্রালী ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। সেপ্টেম্বর মাস। গ্রীষ্ম বিদায় নিয়েছে। নিউ ইংল্যান্ডে পাতাঝরার সদ্য আভাস, অথচ পত্রালীর মনে হল যে ইতিমধ্যেই যেন শীত কোন দূরে খিড়কিদুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমধ্যে আগেভাগে এসেই মুখ দেখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, তর সইছে না। যেমন এইরকম এই কুয়াশাময়, ঝাপসা ইশারাময় সন্ধেগুলোতে।

    নিচের ঘরের হই-হট্টগোল আলো গরম ঝংকার থেকে বেরিয়ে এসে একটা ছোট্ট হাঁফ ছেড়েছে সে। নিজের এই মনোভাবে কিঞ্চিত লজ্জিতও হল। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে আলোর চমক হবে না তো কখন হবে। আজ স্বপ্নময় সুস্থ থাকলে আরো কত ঝলকানি হত।

    জুলাই মাস। বসন্ত বহুদিন গত। আইরিস শেষ। অ্যাজেলিয়া শেষ। ডগ্‌উড, রোডোডেনড্রন, ফরসিথিয়ার এখন পালা। গন্ধ নেই তেমন। রূপ আছে, তবে যেন দরদ নেই, মোহময়তা নেই। শুধু গোলাপের গন্ধ আছে। তাতে পত্রালীর মন ভরে না। যূঁই টগর, চাঁপা, হাসনুহানার গন্ধে দেশে মন আকুল হয়ে থাকতো। খাওয়াতেও যেন স্নেহ নেই। ফুলকপি দেশে খেলে কি স্বাদ, আলুতেও যেন মিষ্টি মাটির শ্যামল স্বাদ দেশে। এখানে কোনো কিছু বিস্বাদ নয়, তবে স্বাদের মাধুরীও তাতে নেই। খাওয়ার পরে তূরীয় ভাব আসে না। প্রেমও কি এইরূপ এ দেশে? না, তা হয়তো নয়। উপলা ও রূপকের প্রেমে হয়তো লুকোচুরির উত্তেজনা, বা অধরার আকুলতা নেই, তবে খোলামেলা এক বন্ধুতা আছে, অন্তরঙ্গতায় অনাবশ্যক ব্রীড়া নেই, এক নির্মল মাধুরী অবশ্যই আছে।

    মুঝে ইয়ে কফ্‌স অজীজ হ্যায়
    যঁহা জী তো লুঙ্গা করার সে
    মুঝে উস্‌ চমন্‌ মেঁ না লে চলো
    ম্যাঁয় ঘবড়া গয়া হুঁ বহার সে।

    অনেকদিন পরে হিন্দী-উর্দু আবৃত্তি শুনে বেশ অবাক হল পত্রালী। বিহারে বড় হওয়া কৈশোর যৌবনের উর্দু শের জানা প্রেমপত্র লেখার মতই রোমাঞ্চকর। আর বন্ধুমহলে পরস্পরকে এক একটা নতুন মুখস্ত করা শের শোনাতে পারাটা বয়:সন্ধি থেকে প্রাপ্তবয়স্কতার পথে এক অপরিহার্য পদক্ষেপ।

    এত সুন্দর উর্দু উচ্চারণ কার? তাদের তো কোনো হিন্দী-উর্দু ভাষী বন্ধু নেই।

    দ্বিতীয়বার পুনরাবৃত্তি করল সেই গলা, পুরুষের মন্দ্র স্বর। ধীরে, প্রত্যেক লাইনের প্রতি কথা যেন যেচে বলছে--মণিমুক্তোর রত্তি তৌল করার মত। প্রতি কথার মোহরের ভার মাপার মত।

    আমার এই মরুভূমিই পছন্দ
    ঐখানে আমি শান্তিতে বেঁচে থাকতে পারি
    আমায় ওই বাগানে নিয়ে যেওনা
    আমি বসন্তের বাহারকে বড় ভয় করি।

    --নিজের মনে ভাবতে শুরু করেছিল পত্রালী, কিন্তু তার আগেই সেই গলা তার মনে ভাবা তর্জমাটাকে সেই অন্ধকারের মধ্যে থেকে বলতে লাগল।

    সত্যিই তো, এই কথায় তো ভাবছিল সে। এই মরুভূমি, এই ধুসর পাখপাখালির ডানার ছাউনি ঢাকা আধঘুমে-ঢলা নিস্তব্ধ ছায়াবীথিই এখন তার পরিচিত স্বস্তিযুক্ত পরিধি। আলোর চমকন্যস্ত প্রতিশ্রুতিতে আর বিশ্বাস নেই তার।

    কিন্তু কে এই আবৃত্তিকার, হেমন্তের এই মর্মরহীন বাতাসের নিরুচ্চারিত বিষণ্ণতার পশ্চিমের গোধূলিতে প্রাচ্যের কবিতা ওড়াচ্ছে খেলাড়ু পারাবতের মত শিলায়িত মেঘনারীদের জয় করতে? একটু ঝুঁকে দাঁড়াল পত্রালী। কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। ড্র্যাগনের লেজের মত কুয়াশা কুণ্ডলি পাকাচ্ছে। ভৌতিক ব্যাপার।

    এটাতো তার বাড়ি, কে বাগানের অন্ধকারে বসে আবৃত্তি করছে, গৃহকর্ত্রী হিসেবে তাকে জানতে হবে। ‘কে ওখানে?’--একটু কাঁপা গলায় স্বর তোলে পত্রালী।

    একটা খসখস করে আওয়াজ। চামড়ার চটি ঘষটানোর স্বল্প শব্দ। বদ্ধ বাতাসে একটা যেন বারুদের গন্ধ, মাটিতে ধিকিধিকি ফসফরাসের জোনাকি কুঁচমুখ, কে যেন পা দিয়ে মাড়িয়ে নিভিয়ে দিল।

    সরি, সিগারেট খেতে পর্চে এসেছিলাম। আপনাকে দেখে ওই উর্দু শেরটা মনে হল।

    কে যেন নিচের জানলা দিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া আলোর ত্রিভুজ শাবলের মুখে ঘাসের উপর এসে দাঁড়াল।

    ‘আমি তমোঘ্ন, ভয় পাবেন না।’

    পত্রালীর মনে পড়ল যে তার বন্ধু শুভশ্রীর কলকাতার অন্তরীক্ষ্য টিভি স্টেশনের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। তাদের কর্মীরা গত জুলাই মাসের বার্ষিক সম্মেলন কভার করতে এসেছিলেন, সকলেই ফিরে গেছেন কলকাতায়। ফটোজার্নালিস্ট তমোঘ্ন চৌধুরী শুধু রয়ে গিয়েছিল, আমেরিকার নানান অঞ্চলের বাঙালিদের থাকা খাওয়া ইত্যাদি সম্বন্ধে একটা ডকিউমেন্টারি তৈরি করতে। শুভশ্রীর কোন লতায়-পাতায় আত্মীয়ের পরিচিত। শুভশ্রীর মুখে মধুপর্ণা ও রবিনের বিয়ের কথা শুনে ‘বিদেশে বাঙালি বিয়ে’ নিয়ে ভিডিও ফিচার তুলতে বস্টন পৌঁছে গেল।

    ভদ্রলোক গত তিন ধরে পত্রালীদের বাড়িতেই আছেন। ওখানে না থাকলে নাকি স্টোরি লাইনটা ঠিক যুত হবে না।

    পত্রালী ওনার থাকাটা খারাপ নেয় নি--কলকাতার টিভিতে মেয়ে জামাই, বিয়ের ব্যবস্থা--সব দেখানো হবে। ভালই তো। একটা গল্প করার মত গল্প।

    কিন্তু ভদ্রলোকের ওই ‘আপনাকে দেখে উর্দু শেরটা মনে পড়ে গেল’ শুনে পত্রালীর হতচকিত মুখের ভাব দেখে ভদ্রলোক বলেন--‘না, না ভয় পাবেন না। আমি দিল্লীর ছেলে। আপনি বিহারের মেয়ে জেনে একটু হিন্দী-উর্দু বলার শখ হল। আপনার নিচের বেসমেন্টে দুটো শের-এর বই ও বহু কবিতার বই দেখলাম।’

    ভদ্রলোক ঘুরে ঘুরে সারা বাড়ির খোঁজখবর নিয়ে ফেলেছেন এর মধ্যেই। পত্রালী তার তৎপরতায় মুগ্ধ হবে, না তার অনুসন্ধানী গোয়েন্দাগিরিতে বিরক্ত হবে, ভেবে পেল না। পরে ওনার সাথে কথা বলতে হবে, ভেবে ড্রয়িং রুমের দিকে চলল।

    রাত বাড়ছে। বাড়ি ভর্তি লোক এখন। মেহেন্দি পর্ব শেষ হয়ে এখন ‘সঙ্গীতের’ পালা। সঙ্গীতের দিন হিন্দী গান শোনার প্রচলন অবাঙালি বাড়িতে। বাঙালি বাড়িতেও ছেলে মেয়েরা এখন দেখাদেখি আবদার করে--সঙ্গীত না হলে কি করে চলবে। বন্ধুরা কি ভাববে। উষা বলে একটি কেরালার মেয়ে ক্যারিওকি সহকারে হিন্দী সিনামের গান করছে। উপলা কোনটি চেনেনা, তবে তালের গানের সাথে ওর বন্ধুরা উঠে উর্দ্ধবাহু বক্রাঙ্গ হিন্দোলে নাচছে। উপলাও তাদের দেখাদেখি বেশ কিছুক্ষণ নাচল। পত্রালী শুধু পুরনো হিন্দী সিনেমার গানগুলো চিনল--সাহেব বিবি আউর গুলাম, যব যব ফুল খিলে, শ্রীমান চারশো বিশ, ইত্যাদি।

    ছেলেরা কেউ মেহেন্দি বা সঙ্গীতে থাকে না। আত্মীয় পুরুষেরা দূরে ফ্যামিলি রুমে আড্ডা দিল। তমোঘ্ন তার মধ্যে। স্বপ্নময়ের ঘর দোতলায়, তাছাড়া সাউন্ড মেশিন চলে সন্ধে আটটা থেকে--যাতে স্বপ্নময় বাইরের আওয়াজে বিব্রত না হয়, ধীরে ঘুমিয়ে পড়িতে পারে। বড়ো পাতলা ঘুম স্বপ্নময়ের, সহজেই ব্যাঘাত ঘটে। পাতলা, ফর্সা, নিয়মী মানুষের পাতলা, স্বচ্ছ, অগভীর ঘুম। পরে নিচের সব লাইট নিবিয়ে উপরে ওঠার সময় তমোঘ্ন বলল--এ দেশের ছেলে মেয়েরা দেশৈর কিছু কিছু জিনিস কিন্তু ধরে রেখেছে, পুরোপুরি তার মর্ম না বুঝলেও।

    --হিন্দী গান শুনছে সেটা ভাল। তবে ওর বাবার মোটেই ভাল লাগতো না যে রবীন্দ্রসঙ্গীত একটাও হয় নি, তবে ছেলে মেয়েদের যা মতামত ওরা নিজেরাই বেছে করে। উপলাকে অবশ্য যদি বলা হত হিন্দী গান করাস না, বাংলায় বেশি করা, দু-একটা না হয় হিন্দী হোক--তাহলে উপলা অবশ্য সে কথা অমান্য করত না, পিতৃমুখী ও পিতৃ-আহ্লাদিত মেয়ে সে, অবুঝ ও নয়।

    তবে পত্রালী এই নিয়ে কোনো আপত্তি তোলেনি, তাছাড়া তারও একটু হিন্দী শোনার জন্য এক প্রায়লুপ্ত সাধ যেন বহু যুগ পেরিয়ে দূর দিগন্তে দেখা দিচ্ছিল।

    --ম্যায় ইয়ে সোচ কর উসকে দর সে উঠা থা--গানটা খুব সুন্দর। আজ সন্ধ্যার সব গানের মধ্যে এই গানটার লিরিক সবচেয়ে কাব্যিক। গানটা বড় দুখী, কেন যে করেছিল উষা এই আনন্দ উচ্ছল দিনে, পত্রালী একটু অবাক হয়েছিল। পরে বুঝতে পারল--এক বয়স্ক অতিথির থেকে অনুরোধ গেছে। বয়স্কার অনুরোধ, উপেক্ষা করা যায় না। পত্রালীও খুশি-বিষন্নতা মেশানো কানে শুনল। পত্রালী অবাক হল--অত দূরে ফ্যামিলি রুম থেকে, অত জোর আড্ডার আওয়াজ ভেদ করে প্রত্যেকটা গানই শুনছে মনে হয় তমোঘ্ন।

    তমোঘ্ন সিঁড়ির ব্যানিস্টারে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

    বহুত দর্দি সে উয়ো সরকনে লগে
    ম্যায় কহতা রহুঁ
    জনাব আহিস্তা আহিস্তা
    হজুর আহিস্তা আহিস্তা

    --ঐটা ঠিক শের নয়, গজলের একটা অংশ। জগজিৎ সিং-এর অ্যালবামে আছে, শুনেছেন?

    --না, শুনিনি। মাথা নাড়ে পত্রালী।

    হিন্দী গান বিয়ের পর থেকে শোনেনি সে। স্বপ্নময় কলকাতায় বড় হওয়া--রবীন্দ্রসঙ্গীত, অনুরোধের আসরের আধুনিক শুনে বড় হওয়া ছেলে। হিন্দী গানে আসক্তি তো নই, বরঞ্চ বিরক্তি। নিজেকে নতুন ভাবে গড়ে তুলল পত্রালী অজান্তেই, না শুনতে শুনতে হিন্দীর প্রতি ভালবাসা কমে এল। অল্প বিরহে প্রাণ কাঁদে। দীর্ঘ বিরহে আসে বিস্মারণ। পত্রালী এখন দুষ্ম্যন্তের মতন বিস্মারণপ্রাপ্ত। বহু দিন পরে তমোঘ্নের শের শুনে মাছের পেট থেকে উদ্ধারিত কোনো প্রেমাঙ্গুরিয়ের মতন বুকের মধ্যে কিছু একটা ছটা ফেলতে লাগল।

    বহুদিন পরে ওই শেরগুলো শুনে কোথায় যেন একটা উৎসাহ পেল পত্রালী। কলেজের কথা মনে পড়ল। বন্ধুদের কথা মনে পড়ল। আরেক জন কেউ শের ভালবাসত মনে পড়ল। মুসলমান ছেলে আফতাব। পত্রালীর বন্ধু নিলুফরের যমজ ভাই। মাঝে মাঝে বোনের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে আসত, নিজের লেখা শের পড়ে শোনাতো--উর্দু কথার মানে বোঝাত। নিলুফর বিরক্ত হয়ে বলতো, --তুই এখানে থেকে যা তো, মেয়েদের সামনে বারফাট্টাই মারছিস। আফতাব অনেক্ষণ বোনের খিচ খিচ শোনার পরে উঠে যেত বটে, তবে তা হাসতে হাসতে। এক দিন পত্রালীর মনে হয়েছিল, তাকে যেন এক চোখ বুজে এক বিশেষ রসিকতার ইঙ্গিত করে গেল। কোনো দিন আফতাবের সাথে একা কথা হয়নি অবশ্য, তবে নিলুফর ওকে বলেছিল, ভাইজানের তোকে খুব পছন্দ। তোকে ইমপ্রেস করতে ও শের নিয়ে আসে। পত্রালী মনে মনে খুশি হয়েছিল, তবে মুখে বলেছিল—ভ্যাট। তারপর অবশ্য মনকে প্রশ্রয় দেয়নি, সে হিন্দু, আফতাবরা মুসলমান। পত্রালীদের পুরনোপন্থী বাড়ি। নিলুফরদের বাড়িও পুরনোপন্থী। সমাজ মান্ধাতার আমলপন্থী ও রক্তচক্ষু পরাক্রমী ভাবে রক্ষণশীল। সেখানেই থেমে গিয়েছিল সেই ভাল লাগা।

    বহু দিন পরে তমোঘ্নের শের শুনে বুকের অতলান্ত গভীরে ছোট্ট দলা অনুভব করতে শুরু করছিল পত্রালী। দোলাটা গত দু-দিনে বড় হয়েছে। অদ্ভুত মানুষ এই তমোঘ্ন। পত্রালী মুখে কিছু না বললেও তার মনের কথা যেন বুঝে ফেলছে, দু দিন আগে সকালবেলা নিচে নেমে দেখে--রান্নাঘর পরিষ্কার, সিঙ্কের বাসন সাবান দিয়ে ধোয়া।

    --অবাক হচ্ছেন কেন। আমি আগে আমেরিকা এসেছি। বাসন ধুতে জানি, ভ্যাকিউম করতে জানি।–

    সত্যি সত্যি কেউ কিছু বলা কওয়ার আগে হুভারটা নিয়ে দ্রুত চালায় তমোঘ্ন। কার্পেট পরিষ্কার, কাচা, ইস্তিরি করা, সরু লম্বা আলের মত মেশিনটা চলার লাইন।

    ভ্যাকিউম ওর হাত থেকে নিতে গিয়েছিল পত্রালী--অতিথি আবার কবে ভ্যাকিউম করে। দ্রুত ইলেকট্রিক কর্ড গুটিয়ে মেশিনটা ক্লসেটে রেখে দেয় তমোঘ্ন।

    --তার চেয়ে বরং একটা শের শুনুন। আমি চা বানাচ্ছি। আর কয়েকটা শের শোনে পত্রালী।

    উপলাও মুগ্ধ—মা, হিইস লাইক মেরি পপিনস। উপলা অযথা প্রশংসা করার মেয়ে নয়, টিচার্স টেনিং করা মেয়ে। লোকের ওজন মাপতে জানে। অন্তত পত্রালীর চেয়ে বেশি। পত্রালী তাই মনে করে।

    নান্দীমুখ হয়ে গেছে। গায়েহলুদ হয়ে গেছে। থরে থরে তত্ত্বের ট্রে সাজিয়েছে বন্ধুরা--রূপা, গৌতমী, কুহু। পত্রালী ওদের উপরেই সেই ভার ছেড়ে দিয়েছিল। বেয়াইবাড়ির সাথে তত্ত্ব নিয়ে রেষারেষি--এটাও একটা বাঙালি বিয়ের অঙ্গ। কে কতটা জমকালো, অভিনবভাবে তত্ত্ব সাজাবে। কবির লড়াই-এর মত একটা মজার রীতি। গতকাল বিকেলে তমোঘ্নও যেন পত্রালীর বন্ধুদের সাথে সেলোফেন পেপার, সেলোটেপ, কাঁচি কাগজ নিয়ে তত্ত্ব সাজাতে লেগে পড়েছিল। প্রজাপতির মত রঙিন মেয়েদের মাঝে এক বিরাট বপুর শ্যামবর্ণ গুম্ফচর্চিত পুরুষকে দেখে এক ক্লাউনের মত বেখাপ্পা কিছু দেখার মজা পেয়েছিল পত্রালী। তবে বন্ধুদের সাথে রসিকতা করে মিশতে কোন অসুবিধা হয়নি তমোঘ্নের, দূর থেকে লক্ষ করেছিল পত্রালী।

    রান্নাঘরে খাবারের মেলা। সবাইকে প্লেটে প্লেটে সাজিয়ে দিচ্ছে বন্ধুরা, পত্রালীর বোনেরা। স্বপ্নময়ের ভাইঝি, ভাইপোদের বৌয়েরা।

    আইরিস শেষ। অ্যাজেলিয়া শেষ। ডগ্‌উড, রোডোডেনড্রন, ফরসিথিয়ার এখন পালা। গন্ধ নেই তেমন। রূপ আছে, তবে যেন দরদ নেই, মোহময়তা নেই। শুধু গোলাপের গন্ধ আছে। তাতে পত্রালীর মন ভরে না। যূঁই টগর, চাঁপা, হাসনুহানার গন্ধে দেশে মন আকুল হয়ে থাকতো। খাওয়াতেও যেন স্নেহ নেই। ফুলকপি দেশে খেলে কি স্বাদ, আলুতেও যেন মিষ্টি মাটির শ্যামল স্বাদ দেশে। এখানে কোনো কিছু বিস্বাদ নয়, তবে স্বাদের মাধুরীও তাতে নেই। খাওয়ার পরে তূরীয় ভাবে আসেনা। প্রেমও কি এইরূপ এদেশে? না, তা হয়তো নয়। উপলা ও রূপকের প্রেমে হয়তো লুকোচুরির উত্তেজনা, বা অধরার আকুলতা নেই, তবে খোলামেলা এক বন্ধুতা আছে, অন্তরঙ্গতায় অনাবশ্যক ব্রীড়া নেই, এক নির্মল মাধুরী অবশ্যই আছে।

    পরের দিন বিয়ে--হায়াটে হোটেল, কেম্ব্রিজ। স্বপ্নময় যেতে পারবে না মেয়ের বিয়েতে, বড় কষ্ট। তাকে তার চেনা নার্সের তদারকে রেখে পত্রালী বিয়েতে যাবে। অনেক পরিবারে মেয়ের মা’র বিয়ে দেখার নিয়ম নেই। কিন্তু বিদেশে অন্য নিয়ম। বাবা-মা দুজনেই যায়। বাবা যখন যেতে পারবে না, সেখানে মা না গেলে ভীষণ ভেঙে পড়বে উপলা। পিতৃমুখী, পিতা অন্তপ্রাণ মেয়ে। এখন মাকেই বাবার স্থানে ভরসা হয়ে দাঁড়াতে হবে।

    সন্ধেয় ফোন। নার্স গার্লার ছেলের হাত ভেঙেছে। সে আসতে পারছে না, ইমার্জেনসি রুমে।

    অত তাড়াতাড়ি কাকে পাবে। উপলাকে বলল পত্রালী। সে কাঁদল। তবে সে তার বাবার অবস্থা এই সাত বছর ধরে জানে। বলল, ঠিক আছে মাসিরা যাবে। সবাই আদর করে বুকে জড়িয়ে নিয়ে যাবে। তারা বর বরণ করবে। বাঙালি বর রণজিৎ। বস্টনেই বড় হওয়া ছেলে। স্বপ্নময়ের বড় প্রিয় পাত্র। তার সুস্থ সময়ের গলফ খেলার পার্টনার। তার পছন্দমত হাসিখুশি প্রাণবন্ত ছেলে। স্বপ্নময়ের অল্প বয়সের প্রোটোটাইপ যেন।

    একটু কেঁদে, নিজেকে শান্ত করে উপলা নিচে তৈরি হতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দৌড়ে ফিরে এল সে।

    --মা, ওই টিভির কাকু তোমায় কিছু বলতে চায়।

    স্বপ্নময়কে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বসিয়েছিল পত্রালী। উপলাকে বলল--ওনাকে আসতে বল, বাবাকে আবার শুইয়ে যেতে পারব না।

    দরজা খুলে তমোঘ্ন ঢুকলো। একটা টি-শার্ট ও জিন্‌স পরা। বড় ভুঁড়ি প্রকট। ভুরু আর গোঁফে এক রকম শু-ব্রাশের মত কালো কদমফুলের রোঁয়া।

    মাথা ঢুকিয়ে বলল, আপনি মেয়ের বিয়েতে নিশ্চই যাবেন--

    --না, দেখার নার্স আসতে পারবেনা, সবার কাছে রেখে যেতে পারি না।

    --আমি দেখব।

    --সেকি--

    --হ্যাঁ, আমার বাবাকে বহুদিন দেখাশুনো করেছি, স্ট্রোক হয়েছিল। খুব বড়সড় মানুষ ছিলেন, প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে চেয়ারে বসানো হত।

    পত্রালী দেখল টি শার্টের নিচে মাসলের ইশারা, চওড়া চৌকো গড়ন, ভুঁড়ি সত্ত্বেও থলথলে নয়। স্বপ্নময়কে তুলতে পারবে দরকার হলে।

    স্বপ্নময় আস্তে বিড়বিড় করে বলল--তুমি যাও, উপার বিয়ে, তুমি যাও।

    --কিন্তু আপনার বিয়ের ছবি তোলা, টিভির ডকিউমেন্টারি? পত্রালী তমোঘ্নকে প্রশ্ন করে।

    --গায়েহলুদ, নান্দীমুখ, বিয়ের হইচই, সঙ্গীত, মেহেন্দির মিশ্রণ, তত্ত্ব বানানো, আত্মীয়দের আসা, সাহায্য করা, বন্ধুদের দল বেঁধে হইচই করা--সব তুলে নিয়েছি। বিয়ের কয়েকটা স্টিল হলেই হবে। অনেকেই ছবি তুলবেন, ওয়েডিং ফটোগ্রাফারের সাথে ফোনে কথা বলে নিয়েছি, সব আন্ডার কন্ট্রোল। কি বলুন স্বপ্নময়বাবু, তাই মনে হচ্ছে না?

    স্বপ্নময় একটু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল, এবার একটু মাথা নাড়ল।

    পত্রালী একটু ইতস্তত করে বেরিয়ে গেল। সময় নেয়। বিয়ের প্রশেশন আধঘন্টার মধ্যে বেরিয়ে যাবে।

    ঘরের বাইরে তিন চার জন বন্ধু যেন ওত পেতে ছিল। --চল, চল তোর খোঁপা বাধতে হবে।

    --তোরা জানলি কি করে যে আমি যেতে পারব? পত্রালী অবাক হয়ে বলে।

    --তমোঘ্নবাবু বলে গেলেন তো; আমরা, কাঁটা, সেফটিফিন, নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

    --ভদ্রলোক একটু বেশি কনফিডেন্ট তো--

    পত্রালী একটু বিরক্ত, সব ব্যবস্থাই করে গেছেন। আমি যদি যেতে রাজি না হতাম--

    --তোর মেয়ের বিয়ে, যেতে রাজি হবি না আবার কি? কুমকুম মুখে পাউডার মাখাতে থাকে।

    গৌতমী পত্রালীর আধারুক্ষ চুলে কি একটা স্প্রে করল। --ড্রাই শ্যাম্পু, একটু যাতে পদের লাগে। তোর বেয়ান, মেয়ের মাসশাশুড়ি, ননদ, মায় দিদিশাশুড়ি পর্যন্ত দেখবি কেমন ফিটফাট হয়ে আসবে, আর তুই যাবি পেত্নীর মতন। মেয়ের বাড়ির মানসম্মান বলে কিছু নেই?

    পত্রালী হেসে ফেলে। তার হবু জামাই শুধু সোনার টুকরো ছেলে নয়, চেহারাও সুন্দর, ওর বাড়িশুদ্ধ সকলে সুন্দর ও সাজগোজ-এ যত্নবান। জামাই সম্বন্ধে খুব খুশি স্বপ্নময়।

    তার শাড়ির আর্ময়ার থেকে কয়েকটা শাড়ি বের করেছে রেখা। সব কটাই কুঁচকোনো, হেলায় কোনোরকমে দেরাজে ঢোকানো। পত্রালী কোনো দিনই সংসারী নয়। স্বপ্নময় অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আরও তার মন উবে গেছে। চাকরিটা করে যাচ্ছে উর্দ্ধশাসে, টাকার দরকার, মর্টগেজ, ইনসুরেনস, ট্যাক্স। আর কিছু ভাবার সময় নেই। এরই মধ্যে মেয়েটা যে ভাল হয়েছে, তার ভাগ্য।

    আয়নায় দেখে নিজেকে পত্রালী। শাড়ির মতই নিজেকে অবহেলা করেছে গত সাত বছর। দিনে খাটুনি। রাতে অনির্দিষ্ট ঘুম। স্বপ্নময়ের বাথরুমে যাওয়া, পড়ে যাওয়া, জল খাওয়া, পা ব্যথা করা, গা হাত পা মালিশ করা।

    কন্ঠার হাড় বের হওয়া।

    পত্রালীর নিজস্ব ঘরে ভর্তি জিনিস। বহু বছরের সঞ্চয়। ফেলতে পারেনা পত্রালী। সব কিছুতে স্মৃতি, নসট্যালজিয়া। প্রবাসীর নসটালজিয়া বড় তীব্র। পত্রালী বিহারে বড় হওয়া বাঙালি-- দেশে থাকতেই সে প্রবাসী বাঙালি, বিদেশে আসার পর সে ডবল প্রবাসী। দ্বি-প্রবাসীর নসট্যালজিয়া আরো তীব্র। কিছুই খুঁজে পায় না তার মধ্যে। কোথায় ভ্যানিটি ব্যাগ। কোথায় কপালের টিপ।

    বহু দিন পরে আজ মনে মনে প্রণাম করে ইশ্বরকে। স্বপ্নময়ের ভক্তি অটলা। কিন্তু পত্রালী বহু দিন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। পুজোমণ্ডপে গিয়ে ফুল নিয়ে আসে, তবে স্বপ্নময় তার জন্যে বসে থাকে বলে। তা না হলে হয়তো পত্রালী যেত না। বিয়ের আচার পুজো সবই করেছে, তবে মন থেকে উৎসাহ পায় নি। কোন কিছুতেই উৎসাহ পায় না, তবে স্বপ্নময়ের সামনে, লোকের সামনে হাসি মুখে থাকে।


    রাত একটা। ত্রস্ত হয়ে ফিরেছে পত্রালী।

    নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে স্বপ্নময়। মুখে প্রশান্তি। চুলটা আঁচড়ানো। ঠোঁটে মনে হয় ক্রীম লাগানো--বড় সৌখিন স্বপ্নময়, এত অসুস্থতার মধ্যেও তার পরিশীলিত রুটিন অভঙ্গ অটল।

    --পায়ের তলায় ভিক্স মালিশ করে দিয়েছি, শুনেছি তাতে ঘুম ভাল হয়। ফিশ ফিশ করে বলল তমোঘ্ন।

    সত্যি আরামে ঘুমাচ্ছে স্বপ্নময়। চাদর পাটপাট করে গলা অবধি ঢাকা, হাঁটুর নিচে বালিশ। প>

    বেবি মনিটর চালিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে বসেছিল পত্রালী দুদিন আগে। তাতে নিচের রান্নাঘর থেকেও স্বপ্নময়ের নি:শ্বাস শোনা যাবে, বা ডাকলে শোনা যাবে।

    --এক কাপ চা খান। অত ভোরেই তমোঘ্ন উঠে পড়েছিল।

    অনুমতির অপেক্ষা রাখেনা তমোঘ্ন। তবে আপত্তিজনকও কিছু করে না। ইচ্ছাগুলোকে বাঙ্ময় হওয়ার আগেই বুঝে ফেলে। এ এক গুণ। কিছু কথা বলতে বলতে আরো ভিতরের কথা হয়েছিল।

    --আপনার পরিবার? জিজ্ঞেস করেছিল পত্রালী।

    --আমি ডিভোর্সড, ছেলে মেয়ে নেই। বাবা অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পরে যখন দিল্লীর বাড়িতে বাবাকে এনে রাখলাম, আমার স্ত্রী বেশি দিন সেই স্ট্রেস নিতে পারল না, যদিও বাবার দেখাশোনা আমিই করতাম, স্টেটস্‌ম্যানে কাজ করতাম, কাজ কমিয়ে হাফ টাইম পজিশনে গেলাম। এক বছরের মধ্যে মলি অন্য একটা ফ্ল্যাটে চলে গেল আর ডিভোর্স ফাইল করল।

    তমোঘ্নের রোদে পোড়া মুখে একটা কালচে ভাব দেখা দিয়েছিল ভোরের আলোয়। কালো মানুষের সাময়িক রক্তবৃদ্ধির রং।

    আজ এই রাতে ব্যালকনিতে গিয়ে বসে পত্রালী ও তমোঘ্ন। দু জনে অল্পক্ষণ চুপচাপ। কিছুক্ষণ পরে পত্রালী শোনে তমোঘ্নের গলা।

    --তো--আপনাকে একটা প্রস্তাব জানাচ্ছি। অপছন্দ হলে না বলবেন। ধৃষ্টতা মনে হলে আমাকে তিরস্কার করবেন, কিন্তু নিজগুণে মার্জনা করবেন। কিন্তু আমার প্রস্তাব যদি কিয়ৎক্ষণের জন্যেও আপনার মনে অনুরণন জাগায়, তাহলে মৌখিক না হলেও ইঙ্গিতে আমায় জানিয়ে দেবেন।

    --কি আপনার প্রস্তাব বলুন।

    --ভয়ে বলব না নির্ভয়ে?

    পত্রালী হেসে ফেলে। --এটা কি আদ্যিকালের ঠাকুরমার ঝুলির গল্প?

    --না তা নয়, কিন্তু অনেক সময় হাতে থাকলে, বা সুসময়ে বা অল্প বয়সে যে-ঘটনা বিলম্বিত লয়ে ক্রমশ: প্রকাশিত হতে পারত, তাকেই সময় ও জীবনাবর্তের চাপে খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে নিয়ে যায় নিয়তি।

    --নিয়তি-টিয়তি নিয়ে ব্যাপারটা একটু গুরুচরণ মনে হচ্ছে।

    --নিয়তি তো বটেই, নিয়তি না হলে আমার অক্ষপথ দিল্লী থেকে বস্টনে এ-ভাবে নির্ধারিত হত না।

    --তাই? আবার একটু হাসে পত্রালী।

    --তাই। একশো বার তাই। একটা কাটা ঘুড়ির মত যে ভাবে লটকাচ্ছিলাম---এই টেলিফোনের তার থেকে ও বাড়ির ছাদ থেকে এ পাড়ার নারকেল গাছ তো ও পাড়ার খেলার মাঠ--সে ভাবেই চলতো।

    পত্রালী স্বপ্নময়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকায়। কি যেন মনে হয় তার। বলে, চলুন ব্যালকনিতে গিয়ে বসি। ওখানে একটু বাতাস পাওয়া যাবে।

    কাঁচের দরজাটা টেনে দেয় তমোঘ্ন।

    --হ্যাঁ, স্বপ্নময় বাবু আরামে ঘুমাচ্ছেন। ব্যঘাত ঘটিয়ে লাভ নেই।

    -এখান থেকে দেখতে পাবো ওকে। জেগে উঠে যদি বিয়ের কথা জানতে চায়, তাহলে একটু জানিয়ে দিতে পারব।

    ডগ্‌বেরী গাছের পাতাগুলো নি:শ্বাস নেওয়ার মত মৃদ আওয়াজে শিরশির করে উঠল। যেন শিশুর পাশ ফেরা। উত্তেজনায় উদ্বেগে বিশেষ কিছু খেতে পারেনি পত্রালী হোটেলে। বিয়ে শেষ হতেই ট্যাক্সি নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। স্বপ্নময়ও উদ্বিগ্ন হয়ে থাকবে, তার মনে অনেক প্রশ্ন থাকবে, সব প্রশ্ন কথায় প্রকাশ করতে অনেক বেগ পেতে হবে তাকে। ইতস্তত করবে, বহুবার থামবে। পত্রালীকেই তার চোখের ভাষা দেখে মনের প্রশ্নগুলো আন্দাজ করে নিতে হবে। গত আট বছর ধরে সেই ভাষা অনুধাবন করতে বিশেষভাবে পারজ্ঞ এখন পত্রালী।

    পেটটা জ্বালা করে উঠল পত্রালীর। এতক্ষণে খিদে পাচ্ছে। ভরা গ্রীষ্মের আকাশে খাপছাড়া মেঘ, ছিন্নভিন্ন পুরনো ছানা বাঁধার ন্যাকড়া হাওয়ায় শুকায়। জলভরা তালশাঁসের মত চাঁদ এদিক থেকে ওদিকে ঢলে, বুভূক্ষু রাতবিলাসীদের লোভ দেখায়।

    --সকালের জিলিপি এখনও অনেক আছে, আমি নিয়ে আসছি। বলে তমোঘ্ন।

    পত্রালী না বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু মনে হল যে তমোঘ্নও তো হয়তো সারা সন্ধে বিশেষ কিছু খায়নি, স্বপ্নময়ের পরিচর্যা করেছে, বিছানার পাশের চেয়ারে বসে থেকেছে। অস্পষ্ট আলো-আঁধারে মাথা নাড়ল পত্রালী; বললো—আচ্ছা।

    গাছের পাতা হয়ে গেছে সে, হাওয়ার ফিশফিশের তালে তার ভারহীন মাথা নাড়া।

    একটা কোয়ার্টার প্লেটে বেশ কিছুটা জিলিপি ও মাইক্রোওয়েভে সুষুম গরম করে নিয়ে এসেছে দুই সেরামিক মগে দুধ। একটা বড় ট্রে খুঁজে পেয়েছে কোথা থেকে। পত্রালীর মজা লাগলো। নিজের বাড়িতে পত্রালী নিজেই অর্ধেক জিনিস খুঁজে পায় না। অথচ স্বল্পদিনের এই আগন্তুক তার গর্ত গুহা গহ্বর আনাচ কানাচ অনেক কিছুই খুব তাড়াতাড়ি বুঝে নিয়েছে। তার এলোমেলো সংসারের একটা বোধগম্য মানচিত্রও গ্রাফ করে ফেলেছে। বিদেশে আসার পর থেকে গরম করা দুধ আর খাওয়া হয়নি পত্রালীর। এখানে বাচ্চারাও ঠান্ডা দুধ ফ্রিজ থেকে সোজা বের করে খায়।

    একটা স্ট্রবেরি সিরাপও খুঁজে পেতে দুধে ঢেলে নিয়ে এসেছে। না আনলেও চলতো। কিন্তু কিছু দেওয়ার মধ্যে কারোর দায়সারা ভাব থাকে, কেউ কেউ শুধু দায়িত্ব সম্পন্ন করে, আবার কারোর থাকে একটা অন্যের মন বুঝতে পারার শীলমোহর।

    এতটা ভাললাগা হয়তো ঠিক হচ্ছে না, মনে হল পত্রালীর। তবু জিলিপি চিবোতে চিবোতে ও দুধে চুমুক দিতে দিতে মনে হল যেন বহু জন্ম আগের অনাস্বাদিত এক যত্নের পরিমল ঘৃতমধুহরিদ্রাকর্পূর মিশ্রণ সে চাখছে।

    কিছুক্ষণ চুপচাপের পর পত্রালী বলল --কি বলবেন বলছিলেন বলুন--

    --এই শের টা শুনেছেন--

    --আপনি দেখছি শের পাগল, এখন কি শের শোনার সময়? হাল্কা হেসে বিরক্তি ঢাকে পত্রালী।

    --জানেন তো যে-কথা সোজাসুজি বলা যায় না, যা অভব্য বা নির্মম বা এক রকমের অসংলগ্ন প্রলাপ, কবিতাই তখন মনের সে-কথা সুষ্ঠুভাবে পুঞ্জিভূত করে শৈল্পিক ঢঙে ব্যক্ত করে।

    কহ দো কি উন হস্‌রতোঁ সে--
    কহিঁ অওউর যা বসেঁ
    ইতনি জগহ কহাঁ হ্যায়
    দিলে দাগদার মেঁ--

    আবার সেই মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ ঝফরের অনবদ্য কবিতা। এর মানে হল--

    --মানে জানি। তাড়াতাড়ি বলে উঠল পত্রালী। আফতাবের প্রিয় কবি, এই শের পত্রালী তার মুখেই শুনেছিল।

    এই বাসনা/ইচ্ছাদের বলো
    অন্য কোথাউ গিয়ে বাস করুক তারা
    এতটা স্থান কোথায় আছে
    আমার আহত হৃদয়ের মাঝে।

    আফতাব তাকে উদ্দেশ্য করেই এই শের আবৃত্তি করতো, ও আরো বহু শের খুঁজে পেতে নিয়ে পাঠ করতো। কৈশোরের প্রেম নিবেদনের এক চিরাচরিত শালীন পদ্ধতি। কিন্তু এ বয়সে, এই পরিস্থিতিতে, এই ক্ষণকালের পরিচয়ে--এখন কেন তাকে শের শুনিয়ে অস্থির করছে তমোঘ্ন? কোনও অতিথির কি গৃহস্বামীর অবস্থানকালে তার স্ত্রীকে এই ভাবে চঞ্চল করে তাদের অতিথিবৎসলতার সুযোগ নেওয়া উচিত? বিশেষ করে যে গৃহস্বামী অসুস্থ ও দুর্বল, ও যে স্ত্রী পতিসেবাপরায়ণ ও স্বামীব্রতা হওয়া সত্ত্বেও অঘটনচক্রে পরিশ্রান্ত ও তৃষ্ণার্ত? হাওয়া আন্দোলিত মেঘপাশের মত বহু চিন্তা পত্রালীর মনে ওড়াউড়ি করতে লাগল।

    তমোঘ্ন বলছে--আপনাকে দেখে মনে হল, এইতো আমি সারা জীবন ধরে যা চেয়েছি। রূপার্পিত চিত্রার্পিত প্রস্তর মূর্তি নয়, এক স্বভাবস্নিগ্ধ, অনুভূতিসম্পন্না মানুষ, যার অন্তরের সাথে আমার মনের এক অনুরণন নিক্কণিত হয়। এতদিনে আমার সন্ধান শেষ হয়েছে।

    পত্রালী বলতে চাইছিল--আপনি আজ রাতেই এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এক্ষুনি, এই মুহূর্তে--

    কিন্তু কোথায় যেন ভীষণ এক গোলমাল হয়ে গেল মাথার মধ্যে। বুকের ভিতরটা কাঁপতে লাগল। ফেনার মত বিজবিজ করে অন্য কথা জিভে উঠে আসতে লাগল।

    --আপনি কি ভুলে গেছেন যে আমি বিবাহিত? আপনি কি বুঝতে পারছেন না যে আমি আমার স্বামীকে ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি, স্নেহ করি? আপনার কি আমায় দেখে মনে হচ্ছে যে আমি এই অসহায় মানুষকে ছেড়ে অন্য কারোর সাথে ভবিষ্যৎ গড়তে চাইব?--

    এ কি, তিরস্কারের পরিবর্তে যুক্তি বদলের আমন্ত্রণ জানানো? পত্রপাঠ বহিষ্কারের বদলে আলোচনার সুযোগ দেওয়া? পত্রালী তো এটা চায়নি।

    --কোনদিন স্বপ্নময়বাবুকে ছাড়তে হবে না আপনার। বলে চলেছে তমোঘ্ন। --আমি আপনার পাশে থেকে ওনার সেবায় পূর্ণ সাহায্য করে দেব। আপনি শারীরিকভাবে ও মানসিকভাবে ক্লান্ত। আপনার এক বন্ধুর দরকার, এক শক্তসমর্থ পুরুষ বন্ধুর। স্বপ্নময়বাবুকে যে তুলে ধরতে পারবে। স্নান করিয়ে দিতে পারবে। পাঁজাকোলা করে ওনাকে তুলে গাড়িতে বসিয়ে হাওয়া খাওয়াতে নিয়ে যেতে পারবে উইক-এন্ডে। আপনার বাজার করে দিতে পারবে।

    পত্রালীর মনে ভাসলো স্বপ্নময়ের পাট করে তুলে চুল আঁচড়ানো মাথা বালিশে শোয়ানো। তমোঘ্ন পরিষ্কার করে সিঁথি কেটে চুল আঁচড়ে দিয়েছে, শৌখিন অসুস্থ মানুষটা এত ব্যথা ও কষ্টের মধ্যেও পরিচ্ছন্ন থাকতে বড় ভালবাসে। চিরকাল সৌন্দর্যের পিপাসী ও উপাসী স্বপ্নময়। পত্রালী সুন্দরী নয়, ঝকঝকে নয়। তবুও সম্বন্ধ করা বিয়ের মেয়ে দেখায় পত্রালীকে কেন বেছেছিল স্বপ্নময় আরো চারটে মেয়ে দেখার পরে, তা পত্রালীর অবিশ্বাস্য লেগেছিল। তাদের মধ্যে দুজন যে পরীর মতন ছিল, সেটা তার শাশুড়ি তাকে বেশ কয়েকবার শুনিয়েছে। তবে পত্রালী বুঝেছিল যে স্বপ্নময় সুন্দরের পূজারী হলেও বোকা নয়। সে নিশ্চয়ই পত্রালীর অন্ত:সলিলা স্নিগ্ধতার এক অধরা ছায়া পেয়েছিল, নির্ণয় করে নিয়েছিল--সৌন্দর্যের চেয়ে মাধুর্য বেশি, রূপের চেয়ে কোমলতার বেশি প্রয়োজন জীবনের পাথেয় হিসেবে।

    নিজের অজান্তেই মনে মনে একটু হাসি খেলে পত্রালীর। বিধাতা যার যা দরকার জুটিয়ে দেন, তার ঠাকুমা বলতেন। স্বপ্নময়ের দরকার ছিল এক ধীর স্নেহিহৃদয়া নারীর, তাই সে পেয়েছিল।

    কিন্তু পত্রালীর জীবনে তমোঘ্নর কি তাৎপর্য? এও কি বিধাতার বিধান?

    ও ঘরে একটু নড়ে উঠল স্বপ্নময়। এক অস্ফুট শব্দ করল।

    পত্রালী উঠতে যাচ্ছিল। তমোঘ্ন ততক্ষণে বেতের চেয়ার ঠেলে উঠে পড়েছে।

    --আমি গিয়ে ওনাকে একটু জল খাইয়ে আসি, তাহলে ঘুমিয়ে পড়বেন। আপনাকে দেখলে উত্তেজিত হয়ে নানান প্রশ্ন মাথায় জাগবে ও ঘুম কেটে যাবে। আপনাকে যদি চান আমি তাহলে ডেকে দেব—

    স্বপ্নময়ের মাথাটা আস্তে তুলে তাকে আধশোয়া ভাবে বুকে জড়িয়ে ঠেসান দিইয়ে ধরে রাখল তমোঘ্ন। গ্লাশের জল বাঁকানো স্ট্র দিয়ে টেনে খেলো স্বপ্নময়। কোন কথা না বলে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল।

    ব্যথার ওষুধ খাওয়া মানুষ, রাতের ঘুমটা বড় দরকার। কত রাত পায়ের ও হাতের স্নায়বিক ব্যথায় ককিয়েছে স্বপ্নময়। ঝিনঝিনে ব্যথা, ইলেক্ট্রিক শকের মত চিড়িক চিড়িক ব্যথা। ঘুমের ওষুধ, ব্যথার ওষুধ, মালিশ করার বেন্‌ গে, হিটিং প্যাড, পাতলা সিল্কের স্কার্ফ দিয়ে পা হাত ব্যথার জায়গায় বাঁধা সত্ত্বেও ছটফট করেছে স্বপ্নময়। সারারাত পত্রালীও ঘুমোয় নি। পরের দিন আবার দিনের নার্সের জিম্মায় রেখে কাজে দৌড়িয়েছে।

    মেয়ে উপলাকে রোজকার এই জীবন যুদ্ধের বিবরণ শুনিয়ে ব্যতিব্যস্ত করতে চায়নি পত্রালী। উপলার কলেজ আছে, পার্টটাইম কাজ আছে। সে আরেকটি মেয়ের সাথে কলেজের কাছে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকে--সে পড়াশুনা করুক, নিজের ভবিষ্যৎ দেখুক। বাবার জন্যে সে এমনিতেই ব্যথিত, আর তার উপরে মানসিক ভার ন্যস্ত করতে চায়নি পত্রালী। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়েছে যে দেশে এমন হলে আত্মীয়স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে তার কিছুটা কষ্ট কম হত হয়তো।

    তমোঘ্ন ব্যালকনিতে ফিরে এসেছে। পত্রালীর জন্যে একটা সোফায় রাখা পাতলা স্কার্ফ নিয়ে এসেছে।

    --চাঁদের আলোয় ঢাকা ছাড়া বসতে নেই। গ্রীষ্মে অঙ্গ জ্বলে, শীতে চাঁদহিম অঙ্গ ভেজায়। বলে তমোঘ্ন

    --আপনি এটা বানাচ্ছেন। একটু না হেসে পারেনা পত্রালী। জীবনে হাসির সুযোগ আসাটা খুব একটা মূল্যবান খনি আবিষ্কার করার মতো চিত্তচমৎকারী ব্যাপার, মনে করে পত্রালী। বিশেষ করে আজকাল, যখন আনন্দের আকাল।

    রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট গাছগুলোর মধ্যে দিয়ে ক্ষীণ আলো ছড়াচ্ছে। আকাশের চাঁদের সাথে তার চকাচকির মিতালি। গাছের তলায় মিশকালো অন্ধকার। বাড়ির আত্মীয় বন্ধুরা কেউ এখনও বিয়ের পার্টি ছেড়ে ফেরেনি। নিচের তলা নি:শব্দে।

    --দিল্লী টিভি থেকে আমায় দুই বছরের পোস্টিং দিয়েছে নিউ ইয়র্কে। সেখানে সারা সপ্তাহ কাজ করবো, ও উইক-এন্ডে ম্যাসাচুসেটস চলে আসব। ভয় নেই এ বাড়িতে উঠবো না--পত্রালীর ত্রস্ত মুখের ভাব দেখে বলে উঠলো তমোঘ্ন। একটা মোটর হোম কিনে কিছুটা দূরে ট্রেলর পার্কে রাখব। আমাদের গোপন জীবন সেখানে গোপন থাকবে। আমাকে সবাই জানবে আপনাদের শুভাকাঙ্খী বন্ধু হিসেবে। আমি স্বপ্নময় বাবুর সাথে সময় কাটাবো দিনের বেলায় শনি রবিবার, যাতে আপনি নিজের বাজার, স্পা, জিম, পরিচর্যা করতে যেতে পারেন। শখের ক্লাস নিতে পারেন। আপনাকে একটু রিলিফ দেওয়া--এই আর কি--

    --আপনি কি মনে করেন সমাজ ঘাসে মুখ দিয়ে চলে? পত্রালী কিছুক্ষণ পরে বলে। উপলা কি বলবে, জামাই কি বলবে?

    --দেখুন আমি আপনাকে বিয়ে করতে বলছি না, লিভ টুগেদার করতে বলছি না, স্বামীকে ছেড়ে কোথাও যেতে বলছি না, আপনার টাকাপয়সা আত্মসাৎ করতে চাইছি না। আমি বলছি যে আপনি আরো ভাল করে স্বপ্নময়বাবুকে সারা জীবন দেখুন, আরো খুশি মনে, নিজের স্বাস্থ্য আরো সুগঠিত করে ওনাকে সেবা করুন। আমি আপনাকে সাহায্য করব সারা জীবন--

    একটা বেজির মতো প্রাণী চিক চিক করে আওয়াজ করতে করতে নিচের লন পার হয়। তার পেছন তারই মত দেখতে দুই ছোট ছোট বাচ্চা। লম্বা লেজ পতাকার মত উঁচিয়ে নাড়তে নাড়তে মার সাথে পাল্লা রাখতে দৌড়ায়।

    --আপনার মেয়ে যদি জানে যে তার বাবার জীবিতকালে মা কারোর সাথে একটা সম্পর্কে আবদ্ধ, তাহলে সে নিশ্চই রাগ করবে, ভয় পাবে যে তার ভালবাসার বাবা বুঝি আর যত্ন সেবা পাবে না। কিন্তু আপনার মেয়ে কোনোদিন জানবে না যে আমাদের মধ্যে কোন একটা সম্বন্ধ আছে। অন্তত: আমাদের এই সম্পর্কটা খুব সংগোপনে রাখতে হবে। তাছাড়া তার বাবার আরও ভাল করে সেবা যত্ন হবে।

    --কিন্তু স্বপ্নময়? সে যদি বুঝে ফেলে? প্রতি শনি রোববার আপনি আসবেন। সে তাহলে সন্দেহ তো করতেই পারে। হেড ইঞ্জুরি হতে পারে, নিন্তু তার বোধভাষ্যি তো পুরো চলে যায় নি! পত্রালী প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে।

    –-দেখুন আপনার সাথে স্বপ্নময়বাবু বহু বছর ধরে ঘর করেছেন। উনি আপনাকে অন্তর থেকে চেনেন, উনি জানেন যে আপনার মধ্যে কোনো খাদ নেই, কোনো স্বার্থপরতা নেই, আপনার গভীরতার কোনো সীমা নেই। এত বড় শারীরিক অসুস্থতায় এত বছর ধরে কষ্ট পেলে সেই কষ্ট মানুষকে একটা অন্য আধ্যাত্মিক স্তরে পৌঁছে দেয়। তার একটা অর্ন্তদৃষ্টির উদয় হয়। সে অন্য ভাবে জীবনের সুখ দু:খকে বুঝতে পারে। সে সাধারণ মানুষের চিন্তা অনুযায়ী নিশ্চয়ই ভাববে কোনো স্ত্রী অন্য পুরুষগামী হলেও সে ব্যভিচারিণী। কিন্তু যার অর্ন্তদৃষ্টি জন্মেছে সে জানবে যে আপনি যদি কারো ভালবাসায় সতেজ হন, পুষ্ট হন, তাহলে তাতে কোনো ক্ষতি নেই। বরং তাতে আপনার লাভ, স্বপ্নময়বাবুর লাভ ও আমার লাভ। কম্পাউন্ড ইন্টারেস্টের মত লাফিয়ে লাফিয়ে লাভ চলবে।

    --আপনি যে সেলসম্যানের মত এতগুলো কথা বলছেন, আপনি যেন ধরেই নিয়েছেন এতে আমার কিছুটা সম্মতি আছে—

    --কিছুটা সম্মতি তো আছেই নইলে এতক্ষণ বসে আপনি আমার কথা শুনতেন?

    -–আপনার সাহস দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে আমি বসে আছি, এটাকে সম্মতি মনে করবেন না।

    --প্রথমেই বলে নিয়েছি যে ধৃষ্টতা মনে হলে আমাকে চুপ করতে ও চলে যেতে বলতে পারেন।

    পত্রালী জানে যে তার তাই করা উচিত ছিল, কিন্তু এক সম্মোহিত ভাব তাকে যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

    তার মেয়ের বিয়ের দিনে, এই বিশেষ দিনে--নিয়তি তাকে এই অদ্ভুত প্রশ্নের সম্মুখীন কেন করালো? ভবে পত্রালী। সাতাশ বছর আগে যেদিন পত্রালীর বিয়ে হয়েছিল, সে-দিন সে আফতাবের কথা ভেবেছিল। তার নব্য স্বামী সুদর্শন যুবক স্বপ্নময় ও তার প্রথম পছন্দের কৈশোরের রং ধরানো নিষিদ্ধ পুরুষ তরুণ আফতাব--তার নিজস্ব মানসিক চরাচরে, এই দুজনের মাঝখানে পত্রালী সেদিন দাঁড়িয়ে ছিল। আজ তার মেয়ের বিয়ের দিনে, আবার পত্রালী দাঁড়িয়েছে দুই পুরুষের মাঝে। একদিকে দুর্বল নুয়ে যাওয়া কিশলয়ের মত করুণ ভরসাকামী স্বপ্নময়। অন্যদিকে প্রতাপী সবল বৃক্ষের মত তমোঘ্নের ভেক ধরা আফতাবের শের ভেট পেশ করা আরেক নিষিদ্ধ পুরুষ।

    --ভয় নেই আপনার ভাবমূর্তি সমাজের কাছে অক্ষুন্ন থাকবে, সম্পর্ক আমার সারাজীবনই গোপন রাখব। আর পাপ পুণ্য, সত্যিই কি পাপ পুণ্য বলে কিছু আছে? সমাজের শৃংখলা রাখার জন্যে পাপের নামকরণ হয়েছে। যদি কারো কোনো ক্ষতি না হয়, তাহলে সেই কাজ কি পাপ? এক এক বিশেষ পরিস্থিতিতে পাপ ও পুণ্যের বাউন্ডারি বিলীন হয়ে যায়। জীবনের সমুদ্রকূলে নিজের মুখোমুখি দাঁড়ালে অনন্তের ঢেউ এসে সব পাপ মুছে ফেলে।

    --এত সহজে সব কিছু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পত্রালী বলে।

    --দেখুন পুণ্য বহু সময়ে পাপের চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর নির্মম হৃদয়হীন। সেই পুণ্যে কাজ কি? তাছাড়া যাকে আমরা পাপ মনে করছি, সেটাই হয়তো আসলে পুণ্য। আর পুণ্যই হয়তো আসলে পাপ। নিউ এজে পাপের সংজ্ঞা বদলে গেছে।

    দূরে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা যায়। পত্রালী ত্রস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। বাড়ির লোকেরা বিয়ের নাচ গানের পর ফিরতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু গাড়িটা অন্য রাস্তায় মোড় নেয়।

    চাঁদের আলো তমোঘ্নের গোঁফের দু একটা শাদা চুলকে রুপোলি করে দেখায়। ঘরে স্বপ্নময়ের পাতলা ফর্সা শরীর, গেঞ্জি পরা কাঁধ দেখা যায়। চাদরটা সরে গেছে। স্বপ্নময়ের শুভ্র পরিশীলিত ছিপছিপে একহারা চেহারার পরে একজন গোঁফ ওয়ালা, চৌকো ধরনের গড়ন, ঘন শ্যামবর্ণ, মুখে ব্রণের খানা খন্দর, লুঙ্গি ও ভুসো রঙের ড্রেসিং গাউন পরা মানুষের সাথে পত্রালীর অন্তরঙ্গতা হচ্ছে--এ কথা সমাজ সহজে সন্দেহ করবে না।

    এ কথাটা ভেবেই লজ্জা পেয়ে গেল পত্রালী। তমোঘ্নের একটা শক্তি আছে পত্রালীর মনের কথা সহজে আঁচ করার।

    --দেখুন স্বপ্নময়বাবু আজ সুস্থ থাকলে আমি কোনো দিন এই কথা বলে আপনাকে বিব্রত ও স্বপ্নময়বাবুকে অপমান করতাম না। নিয়তিও আমায় সে সময়ে এখানে নিয়ে আসত না আপনার মেয়ের বিয়ে নিয়ে টিভি ডক্যুমেন্টারির জন্যে কাভার করতে। তবে এই মুহূর্তে ইশ্বরের হাত আমি সব ঘটনার মধ্যে নিহিত দেখতে পাচ্ছি।

    পত্রালী ট্রে-টা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। --এক্ষুনি সবাই এসে পড়বে। চায়ের কেটল-টা চালিয়ে আসি কিচেনে। পত্রালী বলে।

    তমোঘ্ন পত্রালীর হাত থেকে ট্রে-টা নিয়ে এগোয়। --দেখুন, আমি জানি আপনাকে এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আপনার মধ্যে আমার প্রতি কিছু একটা ভাল লাগা আছে সেটা আমি ক্ষীণভাবে অনুভব করেছি। আমি আর মাত্র তিন দিন আছি এ বাড়িতে। এই দ্রুতগতি প্রেমনিবেদন বা প্র্যাকটিকাল প্রস্তাব আমাকে তো তাড়াতাড়ি পেশ করতে হল কেননা আমাদের সময় বড় কম। আমাদের দুজনেরই বয়স মুহূর্তে মুহূর্তে বাড়ছে। উইন্ডো অব অপরচুনিটি বড় ছোট। কিন্ত বেশি দেরি করবেন না। সময় বহে যায়।

    পত্রালী কিছু বলল না। স্বপ্নময় আজ বড় আরামে ঘুমোচ্ছে। হয়তো এক ঘুমে ভোর হয়ে যাবে। বহু দিন যা হয় না।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments