এলোমেলো চুলধারী, বিস্রস্ত-বসনা মহিলা বলল, 'তুমি শহরে যাও আবার। আমার মানিককে ফিরিয়ে আনো।' নাসির আলি শূন্যদৃষ্টিতে তাকায় স্ত্রীর দিকে।
স্ত্রী তাকে ধাক্কা দেয়। কিন্তু নাসির আলি নড়ে না।
আবার স্ত্রীর ধাক্কা খেয়ে নাসির আলির হুঁশ হয়। সে উঠে দাঁড়ায় অবসন্ন ভঙ্গিতে, এবং পরদিন ভোরে আবার রওনা হয় শহরের উদ্দেশে।
...নাসিরের ছেলে আবু রুশদ হোস্টেলে থেকে টেকনিক্যাল কলেজে ডিপ্লোমা পড়ছিল। কিন্তু একদিন সে নাই হয়ে গেল। হোস্টেল কর্তৃপক্ষ নাসিরকে ফোন করে জানাল যে, আবু রুশদকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে বাড়িতে গেছে কিনা।
'না।' আর্তনাদ করে উঠে নাসির বলল, 'আমার খোকা তো বাড়িতে আসেনি।'
সে ছুটে আসে শহরের হোস্টেলে। হোস্টেলের প্রধান বললেন যে, রুশদ মনোযোগী ছাত্র। সময়মতো হোস্টেল থেকে কলেজে যেত, ফিরে আসত সময়মতো।
নাসির হোস্টেল থেকে ছুটে গেল কলেজে। কলেজের শিক্ষকেরা জানালেন, তাঁরা ওকে দুইদিন ধরে দেখছেন না ক্লাসে। আরো জানালেন, রুশদ মেধাবী ও মনোযোগী। কিন্তু ও বাইরে কোনো কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল কিনা তাঁরা জানেন না। নাসির আলি বলল, 'ছিল না। বাপধন পড়াশোনার চাপে বাড়িতেও আসত না। আর আমি যে-কয়বার এসেছি ওর সহপাঠী ও রুমমেট বলছে, রুশদ ভালো ছেলে। কোথাও আড্ডাবাজি করে না। সময় নষ্ট করে না।'
সবাই অবাক বনে গেল--কোথায় ও কেন গেল। সে কি বাড়িতে অভিমান করেছে? রাগ করে অজ্ঞাতবাসে গিয়েছে?
'না। শেষবার সে বাড়িতে এসে হোস্টেলের খরচ চায়। বইপত্রও কিনতে হবে। আমার হাতে নগদ টাকা ছিল না। শোধে টাকা ধার করে বাপধনকে দিয়েছি। বাপধন খুশিমনে ফিরে গেছে। রাগ করবে কেন?'
তাহলে?
হোস্টেল-সুপার ওর দুইজন রুমমেটকে তাঁর কামরায় ডেকে জিজ্ঞেস করলেন। 'রুশদ কি রাজনীতি করত, কোনো সংগঠনের সাথে জড়িত ছিল?'
'না, স্যার।' ওরা সমস্বরে জবাব দিল।
'আপনি থানায় যান। পুলিসের কাছে বলুন। পুলিস যদি আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, আমরা ভালো সার্টিফাই করব।' সুপার বললেন।
...নাসির আলি থানায় এলে থানার সেকেন্ড অফিসার বললেন, 'আপনি কি জিডি করতে চান?'
'স্যার, আমার বুকের ধনরে খুঁইজা বার কইরা দেন।' টপটপ করে চোখের পানি ফেলল নাসির আলি।
'আমরা খুঁজব, কিন্তু আপনাকে জিডি করতে হবে।'
'স্যার, সবাই বলে, আমার ছেলে গুম হয়ে গেছে। কিন্তু ও তো মনোযোগী ছাত্র ছিল। কোনো রাজনীতি করত না। তাইলে গুম হবে কেন?'
'আপনার এইসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারছি না। আপনি জিডি করুন। আমরা ইনকোয়েরি করব।'
নাসির জিডি করল। তারপর পাগলের মতো শহরের অলিতেগলিতে ঘুরে ফের ফিরে এলো হোস্টেলে। ছাত্রদের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে।
সুপার এসে বললেন, 'আপনি বাড়িতে ফিরে যান, রুশদ ফিরে এলে আমরা জানাব।'
নাসির আলি বলল, 'না।'
'কোথায় থাকবেন, কী খাবেন?'
'গাছতলায়। কিছু খাব না। আমি খোকনকে না নিয়ে বাড়িতে ফিরব না।'
সুপার কিছু না বলে চলে গেলেন। নাসির শহরের এই এলাকাটা সামান্য চেনে। ছেলেকে দেখতে এসে এলাকাটা চেনা হয়ে গেছে তার। একদিকে গ্রামীণ একটা পরিবেশ, অন্যদিকে শিল্প এলাকা। রাস্তাগুলো লম্বা ও চওড়া। রাস্তার দুইপাশে বস্তি গড়ে উঠেছে। এই বস্তির কাছে বড়ো অশথ গাছের নিচে চায়ের দোকান। নাসির তার পোঁটলাটা হাতে নিয়ে একপাশে বসে পড়ে।
পরের কয়েকদিন সে পুলিসের কাছে গেল। তারা জানাল তারা খুঁজছে। নাসির আলি ততদিনে বুঝে গেছে এই খোঁজার কোনো শেষ নেই। সে অশথতলায় গেড়ে বসে। রুশদের বন্ধু সোহেল মাঝেমধ্যে আসে। নাসিরকে চা বিস্কিট খাওয়ায়। তাকে দেখে নাসিরের মনে হয় সোহেল যেন কিছু বলতে চায়। কিন্তু বলে না।
নাসির আলি বিড়বিড় করে বলে, 'ওরা আমার আত্মাকে খুন করেছে।'
গাছতলায় বসে একদিন নাসির আলি আবিষ্কার করল তার কন্ঠ দিয়ে ক্ষণেক্ষণে বিলাপের সুর তরঙ্গায়িত হয়। সেই সুর অনেকটা নেকড়ের ডাকের মতো। তার বসার ভঙ্গিটিও নেকড়ের মতো।
ততদিনে তার দশাসই দাড়িগোঁফ গজিয়ে গেছে এবং তার সাথে অশথতলায় যোগ দিয়েছে তার স্ত্রী।
বস্তি ও আশেপাশের লোকজন উপচে পড়ল, নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে নাসির আলির দিকে এগিয়ে এলো। নাসির আলি বলল, 'আমি দানব। আমি নেকড়ে। হিংস্র জন্তু, আমি একদিন মানুষ ছিলাম। কিন্তু তারা আমার আত্মাকে খুন করে ফেলেছে। আমি এখন আর জীবিত নই। তারা আমার আত্মাকে মেরে ফেলেছে। তারা মানুষ নামধারী পশু। তারা সমাজে বাস করে, দামি বাড়িতে থাকে, এসিতে নিদ্রা যায়, রাজনৈতিক বুলি কপচায়, মিথ্যাচার করে, সভা-সমিতিতে গলা ফাটায়। তারা লম্বা লম্বা কথা বলে, অন্যের গীবত করে, টেন্ডারবাজি করে, ঝোপ বুঝে কোপ মারে, কইয়ের তেলে কই ভাজে। তারা আমার আত্মাকে গুম করেছে, খুন করেছে।'
'ঠিক, ঠিক।' সমবেত জনতা বলল। অনেক মূল্যবান কথা তারা শুনল।
সোহেল শেষবারের মতো একদিন এসে বলল, 'চাচা, আপনি বাড়িতে ফিরে যান।'
'আমার বাপ কি আর ফিরে আসবে না বাবা?'
সোহেল মাথা নিচু করল একথায়।
'বাবা, আমারে কিছু কও।'
'ইয়ে চাচা,' সোহেল ইতস্তত করে বলল, 'আমি হোস্টেল আর কলেজ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আমার আব্বা আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবেন।'
'আরেকটা কথা চাচা,' সোহেল ফের ঘাড় নিচু করে বলল, 'কলেজে অনেক পলিটিক্স। অনেক বহিরাগত আসে। আর কলেজের ভেতরেও কোনো শৃঙ্খলা বা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নেই। তারা রাজনৈতিক ইঙ্গিতে ওঠে-বসে।'
সোহেল আর দাঁড়াল না। সোহেলের নির্গমন পথের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে নাসির আলি।
'আমার ছেলেকে জ্যান্ত না পেলে তার লাশটা এনে দিন ইন্সপেক্টর সাহেব।'
'আপনার ছেলের লাশ কই আমি জানি?'
'ছেলে কই জানেন না; জ্যান্ত না মৃত তাও জানেন না? আপনাদের অসাধ্য কিছুই নেই স্যার, একটু দয়া করুন স্যার।'
'আমরা খুঁজছি।' ইন্সপেক্টরের ইশারায় একজন কনস্টেবল দৌড়ে এসে হ্যাঁচকা টানে নাসিরকে বাইরে এনে রীতিমতো ছুড়ে দিল রাস্তায়। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে নাসির।
সে ধীরে ধীরে ফিরে আসে অশথতলায়।
...
'কোনো সন্ধান পাইছো?'
'না। সে গুম হয়ে গেছে।'
স্ত্রী স্তব্ধ হয়ে যায়। তার শূন্য দৃষ্টি সুদূরে নিবদ্ধ হয়।
'আত্মার মৃত্যুর বিচার আর চাই না; তার নিথর দেহটা একটু দেখতে চাই। কী অপরাধ করেছি আমি? আমি তো মানুষকে ভালোবেসেছি, বিশ্বাস করেছি। এই বিশ্বাসের মধ্যে বেঁচে থেকেই আমি সুখের সংসার করছিলাম। আমার স্ত্রী ভালো মহিলা। ওই চেয়ে দেখুন, সে আজ পাগলিনী। আমার স্ত্রী এখনও যৌবনবতী ও সুন্দরী। চারপাশের হায়েনার দল তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। আমি জানি না ওকে বাঁচাতে পারব কিনা।
'খোকনকে খুঁজতে ভিটেবাড়ি বিক্রির সব টাকা খরচ করে ফেলেছি। তবু পাষণ্ডরা আমার খোকনের লাশটাও আমাকে দেখাল না।
'আমাদের সন্তান হচ্ছিল না। অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েছি। অনেক তাবিজ নিয়েছি। কত কী করেছি। তারপর অনেক সাধনার পর খোকনকে আমাদের কাছে পাঠালেন পরম দয়াময়। খোকনকে নিয়ে আমার দিন কেটেছে আদর স্নেহে আর সুখের ঘুমে কেটেছে রাত। একদিন খোকন কিছুতেই ঘুমাবে না। সে খেলনা নিয়ে খেলছে। সারারাত আমি আর ওর মা খোকনের তামাশা দেখেছি। আমাদেরকে রাত জাগিয়ে খোকন বেশ মজা পাচ্ছিল।'
...তারপর একদিন নাসির শুনল স্ত্রীর গোঙানি। সে অন্ধকারে ছাপড়া ঘরটার কাছে এলো। একটা থাবড়া খেয়ে সে পড়ে গেল। ভাঙা দরজা দিয়ে সে বস্ত্রহীন স্ত্রীকে দেখল। তিনজন দুর্বৃত্ত জোবেদাকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
নাসির মুখ ফিরিয়ে নেয়। দুর্বল শরীরে সে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলল।
পরদিন জোবেদার দিকে সে এগিয়ে গেল। জোবেদা তীব্র আক্রোশে ঠেলে দিল নাসিরকে। নাসির বুঝতে পারে স্ত্রী উন্মাদিনী হয়ে গেছে। তার কাছে যাওয়া যায় না। সে সারাক্ষণ বিড়বিড় করে কী যেন বলে।
'....একদিন আমি জোবেদার নিথর দেহ আজিমপুরে কবর দিয়ে এলাম। খোকন গুম হয়ে গেছে। খোকনের মা চিরবিদায় নিয়েছে। মরে যাবার কদিন আগে আমার স্ত্রী আমার দিকে কেমন করে জানি তাকিয়ে ছিল। আমি সেই দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে অন্যদিকে চেয়ে ছিলাম।
'আমি অশথ গাছের সাথে কথা বলি, চাঁদের সাথে কথা বলি। আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখি। বৃষ্টি হলে ছাপড়ায় ঢুকে যাই।'
নাসির আলি অভুক্ত, কেউ তাকে খাবার দেয় না। সবাই এড়িয়ে চলে। তবে পাশের কারখানার গেটের দারোয়ান তাকে একদিন ডেকে নিল। বলল, শ্রমিক নেতা নাকি তাকে কী কাজ দেবে।
নাসির এগিয়ে যায়। একটা অন্ধকার ঘরে সমস্ত রাত তার ওপর নারকীয় নির্যাতন চলে। সকালে তার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়া হয়। সে রাস্তায় বের হয়। পায়ুপথে অসহ্য যন্ত্রণা তার। শরীর গুলিয়ে ওঠে।
নাসির একটা টং দোকান থেকে রুটি কেনে। কিন্তু খেতে পারল না। মুখ থুবড়ে পড়ে। সে চেতনা হারায়।
নাসির আলিরও কবর হলো আজিমপুরে। স্ত্রীর কবর থেকে কয়েকহাত দূরে। যারা কবর দিতে এসেছিল, তাদের একজন বলল--ওর স্ত্রীর কবরের পাশেই সে শুয়ে থাকুক।
সে সবার অলক্ষে চোখ মোছে। সে কারখানার দারোয়ান রহমত আলী--সে জানত, শ্রমিক সর্দার নাসিরকে কাজ দেবে। জানত না যে, তারা বিকৃত লালসা চরিতার্থ করবে। সে মনে মনে মাফ চায় নাসিরের কাছে।
কবরস্থান থেকে ভারাক্রান্ত মনে সে ফিরে এসে গেটের সামনে তার নির্ধারিত চেয়ারে বসে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে।