বঙ্গশার্দূল বা বাংলার বাঘ ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। ওনার ফেভারিট ছুটির জায়গা ছিল - ধরে ফেলেছেন তো? সেই মধুপুর! (বার বার বলছি তো - বাকিটা আপনি নিজেই লিখে নিন!) বাবা গঙ্গাপ্রসাদের নামে বিরাট বাড়ি তৈরী করেন ওখানে - গঙ্গাপ্রসাদ হাউস। ওনার দ্বিতীয় সন্তান রমাপ্রসাদ আর চতুর্থ সন্তান উমাপ্রসাদ, এনারাও প্রতি বছর মধুপুরে একটা না একটা লম্বা ছুটি কাটাতেন। আমরা, মানে ছোটরা, ওনাদের যথাক্রমে বড়দাদু আর সেজদাদু বলতাম। আহা, যখন বড়দাদু বড়দিদা থাকতেন তখন সপ্তাহে একদিন - বোধ হয় বিষ্যুৎবারের লক্ষীপুজোয় - দারুন প্রসাদ, পরে লুচি, এসব হতো। ওনারা সব ভাইবোনই আমার দাদুর (ঠাকুরদাদা) চেয়ে ছোট ছিলেন, আবার দাদু আমার বার বার অংকে মেডেল পেয়ে পেয়ে স্যার আশুতোষকে প্রায় চটিয়ে দিয়েছিলেন, তাই পারিবারিক আলাপ ছিল। আমাদের দলবলকে ভীষণ ভালোবাসতেন ওনারা সবাই। গঙ্গাপ্রসাদের ছেলে আশুতোষের ছেলে রমাপ্রসাদের ছেলে মনোতোষের ছেলে রবিপ্রসাদ আমাদের সঙ্গে খেলতে আসতো। কোথায়, কেমন আছে কে জানে আজ ! যাকগে, শুনুন -
বড়দাদু - অ্যাই, পায়ে ওটা কি?
রতনা - কই, কিছু না তো বড়দাদু!
বড়দাদু - ফেরেব্বাজি হচ্ছে, পাজি কোথাকার? ইদিকে আয়!
ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলে রতনা - কেটে গেসলো, মা ওষুধ লাগিয়েছে।
খপ করে ধরে ফেলে বড়দাদু নিয়ে গেলেন চকমিলানো বাড়ির অন্য প্রান্তে বড়দিদার কাছে। রতনা তখন হাউ হাউ করে কাঁদছে - জ্বালা করবে, জ্বালা করবে, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও - আইওডিন-এর শিশি দেখেই। আমরাও মুখ শুকিয়ে কাঁদো কাঁদো। যাই হোক, বড়দিদার আঁচলের আড়াল থেকে সন্দেশ বেরুলো এক-ই সঙ্গে ।
রতনা হারামজাদা কেটে গেসলো বলে সন্দেশ পাচ্ছে - এর মধ্যে বড়দাদু ছোঁ মেরে সন্দেশের থালাটা তুলে নিয়ে বাইরের রোয়াকে ফিরে যেতে যেতে বললেন - তোদের যখন ওষুধ লাগাবো, তোরাও পাবি।
একটু একটু দুর্নাম ছিলই বজ্জাতির জন্যে, চট করে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম - এই তো ওষুধ লাগান না। কটমট করে তাকিয়ে বড়দাদু বললেন - তবেরে! অ্যাই গোপলা, আমার খেউরির বাক্সটা নিয়ে আয় তো, এটার হাতটা একটু কেটে নিয়ে আইডিন লাগাতে হবে, নইলে সন্দেশ হজম হবে না।
পালাতে পারলে বাঁচি, যা হোক সব্বাই সন্দেশ পেলাম।
এই ছিলেন বড়দাদু। সেজদাদুর গপ্পো এবার।
সেজদাদু - “কি গো সেজদাদু, আজকে কি?”
আমি - “এক্ষুনি দেখে আসছি।”
সেজদাদু - “আরে, না না, তুমি এখানে বোসো। ভাবছি, প্যাঁড়াগুলো কিরকম হবে।”
বাজার থেকে ফিরছেন। উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। থলিতে শাক সবজি, মিষ্টি ইত্যাদি। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই যেতে হতো ওনাদের, ওখানেই একটা মস্ত পাথর পড়ে থাকতো, দূরে আমাকে দেখতে পেয়ে সেই চাঁইটায় “জিরোতে” বসে কথোপকথন। বুঝিয়ে দিচ্ছি। জিরোবেন সেজদাদু! ষাট পেরিয়েও যিনি দিনে মাইল বিশেক হাঁটেন পাহাড়ে!
বড়দাদুরা যখন ছুটিতে আসতেন না, তখন মাঝে মাঝে সেজদাদু চলে আসতেন। নির্ঝঞ্ঝাট ব্যাচেলর, খাওয়া-দাওয়া প্রায় পুরোটাই স্বপাক নিরামিষাশী, বিদ্যুৎ থাকুক আর না থাকুক কিছু না কিছু লেখা বা পড়া আর সন্ধেবেলা আমাদের বাড়িতে এক, দুই...পাঁচজন সমবয়সীদের সঙ্গে একটু আড্ডা। অনুপান আমার নিয়ে আসা অমৃত বাজার, হ্যান্ডিক্যাপ রেসে সেভেন আপ তুফান-কে সাইকেলে হারিয়ে! স্টেটসম্যান একদিন দেরিতে আসতো, তাই যদিও সবাই স্টেটসম্যান পড়তে চাইতেন, কাগজটা খোলার পর বিরক্ত হতেন।
চা থাকতো, আর থাকতো কিছু না কিছু দিদার হাতে তৈরী একটু জলখাবার। সোম-শুক্কুর হাট, ওপরে আপনারা যা পড়লেন ওই ডায়ালগ প্রতি সপ্তাহে দু’বার। সাবজেক্ট ছিল আসলে আগে থেকে জেনে নেওয়া দিদা সেদিন বিকেলের কি প্ল্যান করছেন - নিমকি, চিঁড়েভাজা, গজা, সিঙ্গাড়া (আমার নিজের হাতে বোনা ফুলকপি - চিনেবাদাম চাই সিঙ্গাড়াতে, আজকালকার মতো মটরশুঁটি হলে হবে না) ইত্যাদি। মাঝে মাঝে এঁচোড়, মোচা বা কাঁচকলার চপ হতো, বা শুধু তেল নুন লংকা পেয়াঁজ দিয়ে সদ্য ভাজানো মুড়ি।
দাদু মাঝে মাঝে আগের দিন পাওয়া তারও আগের দিনের স্টেটসম্যান-এর লীডার-এর ইংরিজি সামারি বা মিডল-এর বাংলা অনুবাদ (দুটোই আমার করা) পড়ে শোনাতে বলতেন। দাদুস্থানীয় দু’একজন কিছু কিছু বদলানো সাজেস্ট করতেন।
প্যাঁড়াতেই ফিরে যাই। শালপাতার দোনাটা একটু ফাঁক করে একটা বার করা হতো সেজদাদুর বাজারের ব্যাগের ভেতর থেকে। আমার “পৈতৃক” পাথরের চাঁই-এর ওপর সেজদাদুর বসার ট্যাক্স। আমাকে খেয়ে ভালো বলতে হবে। তেমন জোর গলায় ভালো না বললে তার মানে ছিল, আরেকটা খেতে হবে। উল্টে নিয়ে আঙুলের ছাপ দেখে বলা যেতো কোন হালুয়াই বানিয়েছে।
(আমার দাদামশাই কলকাতায় মারা যান ওর কিছু আগে। দিদা মধুপুরে আমাকে পৈতে দিইয়ে দাদামশাই-এর কাজ করিয়েছিলেন। দাদু এসব বড়ো একটা মানতেন না। কিছুদিন পর কেনেডি, নেহেরু মারা যাওয়ার পর দিদাকে চটাবার জন্যে দাদু বলতেন - কই তোমার নাতি কাজে বসবে না?)
ভাদ্দর মাসে একটা আদিবাসীদের মেলা বসতো দুদিন ধরে। জয়ন্তী নদীর ওপারে। প্রথম রবি ও সোমবার। তা একবার সেজদাদু আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে ওই পাঁচ মাইল লাল টাঁড়ের ওপর দিয়ে হেঁটে শর্টকাট করে মেলায় গেলেন। সে কিছু পাগল করা অভিজ্ঞতা, পরে ভূয়োদর্শন। আমার এক বন্ধু, যে প্ল্যাটফর্ম গেট-এ চেকার থাকলে চট করে কিছু প্ল্যাটফর্ম টিকিট কিনে প্ল্যাটফরম-এ ঢুকে বিক্কিরি করতো সদ্য-আগত বিনা-টিকিটের যাত্রীদের, তাকে দেখি দিব্যি রুলেট-এর জুয়ো সাজিয়ে বসেছে। লটারী! সেজদাদু সেবার বারণ করেছিলেন, তাই… পরে আরেকদিন ওসব হবে। থাক, না-ও হতে পারে।
একদিন সকালে সেজদাদু বললেন - “দিদাকে জিজ্ঞেস করে এসো তো দাদু, আমার সঙ্গে পোস্ট অফিস যেতে পারো কিনা?” গিয়ে দেখি বিরাট পার্সেল। ছাড়িয়ে আনলাম। সেজদাদু বললেন - চলো তোমাদের বাড়ি যাই - বলেই একটা টাঙায় উঠে পড়লেন।
আমাদের বাড়ি এসে পার্সেল খুলে বেরোলো - আগে কখনো দেখিনি - একগাদা গ্যালে প্রুফ। “হিমালয়ের পথে পথে”! সেজদাদুর প্রথম (?) বই! প্রথম এডিশন। আমার দাদুকে সেজদাদু বললেন - রায়সাহেব, আমি জানি বাবুয়া (আপনাদের এই অধীন) প্রুফরীডিং পারে, ওর সাহায্য চাই একটু। দাদু তো ভারী খুশি - এসব করলে সারাদিন টো টো কোম্পানি কমবে।
ওই বিশ্ববিখ্যাত বই-এর প্রথম প্রুফ - শেষ পর্যন্ত প্রায় পুরোটাই - আমার দেখা। ১৯৬৩-৬৪। দুই দাদু মিলে অবশ্য ভেরিফাই করেছিলেন কিন্তু উল্লেখযোগ্য খুঁত কিছু পান নি। দাদু বলেছিলেন - উমাপ্রসাদবাবু, পার্মানেন্ট প্লেস হয়ে গেলো আপনার বাঙলা সাহিত্যে।
আশুতোষ দেব-এর ডিকশনারি-র একদম শেষে একটা সুন্দর পাতা থাকতো - প্রুফরীডিং-এর উদাহরণ দেওয়া। আমি সেটা দেখে প্র্যাক্টিস করতাম, দাদুরা দেখেছিলেন। তাই ওই হেনস্থা।
“সেজদাদুকে - সেজদাদু” কপিটা হারিয়ে ফেলেছি, অন্য সব কিছুর মতো।
আরেকটু আছে - সেটা বলেই ফেলি। এই সব ঘটনার কিছু আগের কথা, সেজদাদুর কাছে অনেক পরে শোনা।
ওই পাণ্ডুলিপিটি সেজদাদু প্রথমে দেন দেশ পত্রিকাতে। বিখ্যাত সম্পাদক সাগরময় ঘোষকে। মাসে একবার করে খোঁজ নিতেন। সাগরময় বাবু প্রতিবারই নাকি বলেন, “এই এবারে ধরছি।” মাস ছয়েক বাদে সেজদাদু উত্তরে ওনাকে বলেন, “একবার দেবেন বান্ডিলটা?” কিছুক্ষন খুঁজে সাগরময় বাবু “এই যে, যত্ন করে রেখে দিয়েছি।” বলে পাণ্ডুলিপিটি বার করে আনেন দেরাজ, না কি আলমারি থেকে। সেজদাদু বান্ডিলটি বগলে নিয়ে “গুড ডে, মিঃ ঘোষ।” বলে সেই যে বেরিয়ে আসেন, আর কখনো দেশ-এর দপ্তরে ঢোকেন নি।
সাগরময়বাবু আমার মামারবাড়ির পাশে থাকতেন, ওনার ছেলের সঙ্গে আমার এক আত্মীয়ার বিয়েও হয়। কখনো খোঁজ করা হয় নি ওনার সাইড থেকে গল্পটি কিরকম!