আপনাকে একটা গল্প বলি। গল্প নয়, একেবারে সত্যি।
মানুষ তো ছোটবেলায় নানারকম দুষ্টুমি করে, বদমাইশি করে। কেউ বেশি, কেউ কম। বকাঝকা খায়, মার খায়। তাও করে। আমিও করেছি। কেউকেউ তো হাতেপায়ে দুষ্টুমি করে। কিন্তু আমার বদমাইশিটা ছিল একটু অন্যরকম। ছোটবেলায় মাঝেমাঝে বেরিয়ে যেতাম আমি বাড়ি থেকে একা একা কাউকে না বলে। এমনিতে চঞ্চল ছিলাম না তেমন একটা, কিংবা অন্য দুষ্টুমি করতাম না তেমন। কিন্তু বাড়ি থেকে না বলে-কয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ছিল। মা হয়তো কাজ করছে, বাবা বাড়িতে নেই। মা’কে না বলে আমি টুক করে বেরিয়ে গেলাম খানিকটা দূরে মাঠে ফুটবল খেলা দেখতে। খুঁজতে খুঁজতে মা চলে এল মাঠে আর কান ধরে নিয়ে গেল বাড়িতে।
কিংবা দরজা খোলা রেখে হয়তো চলে গেলাম ট্রেন দেখতে। আমাদের বাড়ি থেকে একটু গেলেই রেললাইন। সারাদিনই ট্রেন যেত। ট্রেন দেখতে দারুণ লাগত আমার। তখনও ষ্টীম ইঞ্জিন ছিল। আকাশটা কালো হয়ে যেত ধোঁয়ায়, যেন মেঘ করেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম সেসব। ট্রেন দেখে বাড়ি ফিরে শুরু হল বকা-ঝকা। ঠেঙানিও হয়েছে।
আমার বদমাইশির বেশিটাই ছিল এরকম। আসলে একাএকা বাড়ি থেকে বেরনো বারণ ছিল আমার। মানে সেই বয়সে। কত হবে তখন – সাত, আট। বাপ মায়ের সবেধন নীলমণি, প্রায় পুতুপুতু করে রাখা হত আমায়। তবু মাঝেমাঝেই কেটে পড়তাম বাড়ি থেকে। বাবা মা-র সঙ্গে গিয়ে দেখেছি সব, যেমন অন্য বাচ্চারা দেখে। তবু না বলে একা যাওয়ার মজাটাই আলাদা। এভাবেই একা একা গিয়ে উট দেখেছিলাম সার্কাসের মাঠে। কিংবা ফেরিঘাটে লঞ্চ। একটা লোক দড়ি দিয়েছিল গলায়। আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে লোকটার কথা বলছিল অনেকে। যেই কানে এল, সুযোগ বুঝে বেরিয়ে গেলাম লোকটাকে দেখতে। তারপর ওই ঝুলন্ত লোকটাকে দেখে ভয়ের চোটে তিন-রাত ঘুম হাওয়া।
আমাদের ওখানে একজন আসত সাইকেলের খেলা দেখাতে। টানা তিনদিন সাইকেল থেকে নামত না লোকটা। সাইকেলেই খাওয়া, সাইকেলেই সব। মাটি ছোঁবে না তিনদিন। ফুটবল মাঠে খেলা দেখাত ও। কাউকে না বলে চলে গিয়েছিলাম ওকে দেখতে। বাবা-মা জানতেই পারেনি সেবার।
আমায় আটকাতে বাধ্য হয়ে সারাদিন দরজায় তালা দিয়ে রাখা শুরু করেছিল মা। স্কুলে যাতায়াত মা’র সঙ্গে। মানে একা রাস্তায় যাওয়ার সুযোগ দেওয়া নেই। তাতে একটু কমেছিল বেরনো, তবু বন্ধ হয়নি একেবারে। সকাল নেই, দুপুর নেই, যদি সুযোগ পেলাম আর মাথায় পোকা নড়ে উঠল অমনি বেরিয়ে পড়লাম কোথাও একটা। রাস্তা চেনাচেনির সিন নেই, পোকা নড়লেই হল। আস্তে আস্তে সুযোগ কমে আসছিল কিন্তু আমি ঠিক ব্যবস্থা করে নিতাম। আমাদের বাড়িটা ছিল বড়, তাই একটা না একটা ফাঁক ঠিক পাওয়া যেত। পাঁচিলও টপকেছি বার দুই আর ওই বয়সেই।
সাঁতার না জানা সত্ত্বেও একদিন চলে গিয়েছিলাম একা নদীতে চান করব বলে। একজন দেখতে পেয়ে নিয়ে এসেছিল বাড়ি জোর করে। বাড়ি ফিরে ওষুধ দমাদ্দম।
প্রথম যেদিন সবথেকে বেশিক্ষণ বাইরে ছিলাম আমি সেটা কালীপুজোর দিন সকালে। তখন আমার আট পেরিয়েছে সবে। সেবার মুনিরবাগানে ভ্যানিশ কালী করেছিল। মুনিরবাগান আমাদের ওখানে একটা জায়গা। মুনিরবাগানের কালীপুজো বিখ্যাত, সেইসময় লোকে লাইন দিয়ে দেখত। এখন তো দেখি সব প্যান্ডেলেই লাইন। তো মুনিরবাগানে নাকি কালীঠাকুর ভ্যানিশ হয়ে যাবে চোখের সামনে। আবার ফিরে আসবে একটু পর। কানে এসেছিল এসব। ব্যস নড়ে উঠল পোকা। কালীপুজোর দিন সকালে বাবা কিছু একটা করছে, মা রান্নাঘরে, আমি বেরিয়ে পড়লাম মুনিরবাগানের দিকে। কেউ টের পায়নি। আমায় নিয়ে বাজি কিনতে যাবে বলে যখন খোঁজাখুঁজি শুরু করল বাবা, তখন টের পাওয়া গেল আমি হাওয়া। তার আগে অনেকদিন একা পালানো বন্ধ ছিল। তাই হয়তো আমায় বিশ্বাস করে দরজায় তালা দিয়ে রাখেনি।
মুনিরবাগান একটু দূর ছিল আমাদের বাড়ি থেকে। কোনদিকে জানতাম না ঠিকঠাক তবু হাঁটা লাগালাম যেদিকে মনে হল। কাউকে জিজ্ঞেস করা যাবেনা। বাবা-মা’র কানে গেলে প্ল্যান বানচাল। মজার কথা, চোখেও পড়ল না পাড়ার কারও। আমিও মুনিরবাগান খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলাম উল্টোদিকে – যেদিকে হাইওয়ে।
যাচ্ছি তো যাচ্ছি, মুনিরবাগান আর আসেনা। আসবে কীকরে, যাচ্ছিলাম তো উল্টোদিকে। অনেকটা চলে গিয়েছিলাম সেদিন। কতটা, বুঝেছিলাম পরে, যখন রাস্তাঘাট চিনে গেছি। একসময় পাড়ার একজনের সঙ্গে দেখা। নামটাও মনে আছে – হেমন্ত কাকা। কাকা সাইকেল থামিয়ে খুব ধমক দিলেন, ‘তোর বাবা-মা তোকে পাগলের মতো খুঁজছে আর তুই এখানে? কী করছিস এখানে একা একা, শীগগির বাড়ি যা, ওরা কান্নাকাটি করছে।’ বলে তিনি চলে গেলেন যেদিকে যাচ্ছিলাম মুনিরবাগান খুঁজতে, সেদিকে। কাকা হয়তো ধরে নিয়েছিলেন, একা গেছি যখন এতটা, ফিরতেও পারব একা রাস্তা চিনে।
আরও খানিকটা গিয়েছিলাম হয়তো সেদিন, মনে নেই আর। মুনিরবাগান কিন্তু দেখা হয়নি। পরের বছর বাবা নিয়ে গেছিল। কিন্তু সেদিন যা হয়েছিল বাড়ি ফিরে, বলে কাজ নেই। একটা গাছের ডাল হাতে নিয়ে হাঁটছিলাম আমি। পাড়ার কাছাকাছি আসতেই খবর হয়ে গেল। বাড়ি পৌছনোর আগেই দেখি কয়েকজন ছুটে আসছে আমার দিকে। বাবা-মাও আছে তার মধ্যে। রাস্তা থেকেই ওষুধ শুরু। বাড়ি ঢোকার আগেই গাছের ডাল কয়েক টুকরো।
যা হয়েছিল সেদিন ভাবলে হাসি পায় এখন। প্যাঁদানি আর কান্নাকাটি একসঙ্গে। তিনজনই কাঁদছি আমরা একসাথে। এমন প্যাঁদানি খেয়েছিলাম, মনে ছিল অনেকদিন। তারপর থেকে দ্বিগুণ করে দেওয়া হল সিকিউরিটি। আমারও একা বেরনো টোটালি বন্ধ।
ভাবছেন সেদিনের পর থেকে আমার না বলে পালানো বন্ধ হয়ে গেছিল। ভুল। বন্ধ ছিল ক্লাস টেন অবধি। টেনে উঠে একবার পালালাম হাইওয়েতে অয়েল ট্যাঙ্কার উলটেছে দেখতে – অনেক বছর বাদে সেই প্রথম। সেই শুরু হল আবার। কলেজে ঢুকে তো এসব করার কোনও বাধা ছিল না। ছোটবেলায় পালাতাম আধঘণ্টা-একঘণ্টার জন্য। কলেজে ঢোকার পর সেটা হয়ে গেল একদিন-দুদিন। ততদিনে ঠ্যাঙ্গানি স্টপ। অতএব বাবা-মাকে ভয় পাওয়ার সিন নেই। ওরাও বুঝে গিয়েছিল সেটা।
মনে হয় ওরা বুঝে গিয়েছিল এসব বন্ধ হওয়ার নয়। টেনশন করত। মা কান্নাকাটি করত, খেত না রাতে। তখন কয়েকদিন বন্ধ রাখতাম। তারপর একদিন হুট করে আবার। কম করেও বার পঁচিশ পালিয়েছি কলেজে ওঠার পর থেকে। যখন বাড়িতে ফোন এল, একটা ফোন করে দিতাম রাতের দিকে, যাতে বাবা, মা দুশ্চিন্তা না করে। বাবা একটু শক্ত ছিল, কিন্তু মা’র চিন্তা কি আর কমে? রাতে জেগে থাকত না ঘুমিয়ে।
মা’কে কাঁদতে দেখে কষ্ট হত। কিন্তু আমারও কেমন যেন নেশা ধরে গেছিল। ক’দিন বাদে বাদেই মাথায় পোকা নড়ে উঠতো আর ...। এখনও মাঝেসাঝে ইচ্ছে করে না, তা নয়। এই ছুরিকাঁচির জন্য হয়ে ওঠেনা।
আমার এই নেশার চোটে মা’র যা অবস্থা হত, ভাবলে এখন তো খারাপই লাগে। আমার ছেলেও তো বড় হচ্ছে, বৌ’কে দেখে মনে পড়ে মা’র কথা। খুব জ্বালিয়েছি মা’কে। বাবাকেও জ্বালিয়েছি, তবে মা’কে বেশি।
রেগে গিয়ে মা একবার যা বলেছিল শুনলে আপনি হাসবেন। তখন আর বাবা নেই। রাতে খেতে বসে মা বলেছিল, ‘তোর পা দুটো কেটে বাদ দিলে তবে যদি এসব বন্ধ হয়।’ বলে খুব কেঁদেছিল মা ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে। খারাপও লাগছিল মা-কে ওভাবে কাঁদতে দেখে, ওদিকে হাসিও পাচ্ছিল মা-র কথা শুনে। চিন্তা করে দেখুন, একজনের পা কেটে বাদ দিতে কেন বলা হচ্ছে? যাতে অন্য একজন টেনশন থেকে মুক্তি পায়। শুনেছেন কখনও এরকম?
সেবার সবে জ্বর থেকে উঠে তিনদিনের জন্য গায়েব হয়ে গিয়েছিলাম সমুদ্রের দিকে মা’কে না বলে। বাড়ি ফেরার পর মা বলেছিল এসব। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল মা সেবার। রেগেও গিয়েছিল।
---------
অন্য একটা ব্যাপারে কথা হচ্ছিল আমাদের আর সেখান থেকে ডঃ সামন্ত হঠাৎ তাঁর বাড়ি থেকে গায়েব হয়ে যাওয়ার গল্পে চলে গিয়েছিলেন। ডাক্তাররা কি পেশেন্টের কাছে নিজের লাইফের গল্প করে? জানি না। কিন্তু ডঃ সামন্ত তো করেছিলেন। যদি তিনি এসব বানিয়ে বলে থাকেন, তাহলে অবশ্যি অন্য কথা।
এই প্রথম দেখলাম একজন সার্জন পেশেন্টের সঙ্গে এতক্ষণ ধরে কথা বলছেন আর নিজের লাইফের গল্প বলছেন। হতে পারে পুরোটাই বানানো, তবু বলেছিলেন তো অনেকটা সময় নিয়ে! এত ব্যস্ত একজন সার্জন, অনেকক্ষণ ধরে এমন রসিয়ে রসিয়ে বলছিলেন সব, যেন সিনেমা দেখছি। হাসিহাসি মুখে বলছিলেন এসব। সামান্য উঁচু হয়ে ওঠা ভুঁড়ি নাচছিল হাসির তালে তালে। আমার মোটেও হাসি পাচ্ছিল না, তবু জোর করে হাসিহাসি ভাব করেছিলাম মুখে। তাঁর মা যে তাঁর পা কেটে বাদ দেওয়ার কথা বলেছিলেন, এটা দু-বার করে সেদিন বলেছিলেন তিনি আর দু-বারই হাসতে হাসতে, যেন এটা একটা হাসির কাজ।
আমার যে শুনতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল, তা নয়। তবু শুনছিলাম। একবার মনে হয়েছিল বলে দিই, ‘আমি জানি, কেন এসব বলছেন।’ কিন্তু বলিনি। সেটা বাজে দেখাত। এত বড় একটা ডাক্তারকে মুখের ওপর বলা যায় নাকি এসব? তাছাড়া ভেবে দেখলাম, খারাপ কিছু তো করছেন না তিনি। ধরে নিলাম, যেসব ঘটনা নিজের বলে চালাচ্ছেন, সেগুলো সব বানানো আর মনগড়া। না, শুধু ধরে নেব কেন, আমার তো মনে হয় বানানোই। কিন্তু একজন ডাক্তার যদি কারও মনের জোর বাড়াতে কিংবা সান্ত্বনা দিতে কিছু বলেন বানিয়ে বানিয়ে, তাতে অন্যায়টা কোথায়?