• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৫ | জুন ২০১৯ | গল্প
    Share
  • ভ্রম-ণ কাহিনী : শ্রেয়া ঘোষ


    || ১ ||

    ল্প বা ছবি যাই বল, পুরোটা আমি নিজেই জানিনা। আধখাপচা ঘটনা কিছু দূর থেকে দেখা। পেন্সিলে লেখাই সাব্যস্ত করলাম তাই। লিখতে লিখতে আরও কিছু জেনে যেতেও পারি হয়তো। পেন বুলিয়ে স্থায়ী হবে তখন গল্পটা। রঙেরও হেরফের হতে পারে। হবেই। এখন খসড়া। যেমন জীবন। কিসের পর কি গুলিয়ে যায় আজকাল। হঠাৎ মনে পড়া ঘটনা নিজেরই জীবনে না অন্য কারও, শোনা কথা নাকি ফিল্মে দেখা নিশ্চিত মনে করতে পারিনা।

    লাল রংটা ফ্যাকাসে, সবুজটা কাল্টে মেরে গ্যাছে। দোতলার বারান্দাটা বেশ বড়, ভাঙা কাঠের ডাঁই। পুরাতন ইজিচেয়ারের অবশেষ হয়তো। মেন গেট তালা দেওয়া, তালা জং পড়া। পেছনের ছোট গেট হুড়কো দেওয়া শুধু। সরু প্যাসেজে দড়িতে শাড়ি, লুঙ্গি, হাফপ্যান্ট। প্যাসেজের শেষে ঘর। কোনকালে গ্যারেজ ছিল। এখন গেরস্থালি। বসবাসের ঘ্রাণ। ঘ্রাণটুকুই শুধু। এই সাড়ে পাঁচ বছরে দেখিনি কিন্তু কাউকে। অথচ প্যাসেজের দড়িতে সায়া, ছাপা শাড়ি, পাজামা, লুঙ্গি, বাচ্চার হাফপ্যান্ট, স্কুল ইউনিফর্মের সাদা জামা। কখনও শুকনো। কখনও সদ্য কাচা। জল ঝরছে। জল পড়ে প্যসেজে সরু একটা জলের ধারা। গড়িয়ে এসেছে গেটের মুখ অব্দি। খোবলানো সিমেন্টে ছোট্ট পুকুর। খাওয়ার পর ঐ জলটুকু। কুকুরটা বাঁধানো চাতাল থেকে নেমে আসে ঐ জলটুকুর জন্যে। কালো আর পাটকিলে মেশানো ওর গায়ের রঙ। বেশি হলে দশ মিনিট সময় ঐ বাড়ির সামনে। নাকুকে খাবার খাওয়ানো, গায়ে হাত বুলোন, দরকারে ওষুধ পথ্য। দুপুরের গলি তখন ফাঁকা। আমাদের সামান্য গল্পগাছা। নাকু আর আমার। প্রতিদিন এই এক ঘটনা, অবিকল। সাড়ে পাঁচ বছরে শুধু একদিন কি যেন একটা গণ্ডগোল। মনে পড়েছে। ভাত, আর মুর্গির ঝোল গুছিয়ে নিয়েছিলাম সাদা প্লাস্টিকের বাটিতে। হোম ডেলিভারিতে ভাত ডাল দুটো সব্জী দিয়ে যায় রাতে আমাকে। খেয়ে উঠে ঐ প্লাস্টিকের বাসন ধুয়ে শুকিয়ে রাখাটুকুই আমার হেঁসেল তোলা। বাটিগুলো কাজে লেগে যায় পরদিন সকালে। বাজারের মুর্গিওলার সঙ্গে মাসকাবারি। মুর্গির ছাঁট, দু একটা ঠ্যাং, মেটে। সব্জি তো দোরেই। শম্ভুর ভ্যানের দোকান থেকে।

    আমার মর্নিং স্কুল। বাচ্চাদের। সাদামাটা একতলা এল-শেপের স্কুল বাড়ি। সামনে ছোট জায়গাটায় ঘাস। সবুজ ছিল কখনও। এখন শুকিয়ে বাদামি। শীতে মরশুমি ফুল কিছু লাগাই ওখানে। তখন রঙীন ছোপ কিছু। সাড়ে ছটায় বেরিয়ে এগারোটার মধ্যে বাড়িতে। ফিরে হৈ হৈ ব্যস্ততা খানিকক্ষণের। দুটো বার্নারে ভাত আর সব্জি। মাংস পরিষ্কার করে নুন হলুদ মাখিয়ে রাখতে রাখতেই সব্জি নেমে যায়। প্রেসার কুকারের হুইশিল গুনে রান্না সেরে বাটিতে বাটিতে ভাগ করা, ব্যাগ গোছানো, খাওয়ানো। সব শেষে ঐ লাল সবুজ বাড়ি। কালো আর পাটকিলের মিশেল দেওয়া কুকুরটা অপেক্ষা করে। পাঁচিল ডিঙিয়ে এক ছুটে আমার কাছে। খাবারের কৌটোটা খুলতে যেটুক সময়। জিভ দিয়ে লাল ঝরে খাবারের গন্ধে। খাওয়া হলে গায়ে মাথায় একটু হাত বোলাই। ও যতক্ষন খায় আমি কত কথা বলি। খেতে খেতে চোখ তুলে তাকায় মাঝে মাঝে। --জানিস টিচার্স রুমে আজ টিফিনের সময়ে স্মিতা ওর বিয়ের কার্ড দিয়ে নেমন্তন্ন করলো সকলকে। আমি ভাবছি কত করে চাঁদা দিতে হবে, কি পরে যাবো। আমার সামনে এসে বলে, কার্ড কম পড়ে গেল গো সর্বাণীদি। যাবে কি তুমি? চুঁচড়ো থেকে ফিরতে রাত হবে কিন্তু। লগ্ন সেই রাত দশটায়। বাকিরা তো ফ্যামিলি নিয়ে। তুমি হাওড়া থেকে গড়িয়া অত রাতে একা... ওরা এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছিল। দূরত্ব কমছিল কারণ আমার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। চকচক করছিল ওদের চোখগুলো, জিভের লালায় ঠোঁটগুলো টসটস। গৌরী বললো আরে ওর লালু ভুলু কালুদের ডিনারটাও তাহলে তোকে প্যাক করে দিতে হবে তো। দাঁত বের করে কি হাসি ওদের। টপ করে এক ফোঁটা জল ওর গায়ে পড়তেই চমকে তাকালো মুখ তুলে। খাবার ফেলে রেখে এগিয়ে এসে আমার পাটা চেটে দিয়ে ফের খাবারে মন। আমি ঝুপ করে পাশে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই দেখি সব মন খারাপ হাওয়া। বিকেলে গড়িয়াহাট গেলাম। সিল্ক হাউস থেকে দুটো সিল্ক কিনলাম। লালটা স্মিতার জন্যে আর আকাশি নীল বুটি-টা নিজের।

    কোন কথা থেকে কোন গল্প। গণ্ডগোলের কথা। সাড়ে পাঁচ বছরে একদিন শুধু। একটা সাদা ভ্যান বাড়িটার সামনে। দূর থেকেই পেছনের বড় বড় করে স্বর্গদ্বার লেখাটা পড়তে পারছিলাম। আরও কয়েকটা গাড়ি, লোকজন। আমি বাটি নিয়ে ফিরে এসেছিলাম। পরদিন থেকে আবার একই ছবি। নাকুকে জিগ্যেস করেছিলাম। কিছুই জানেনা দেখলাম। বাড়িটা তো মরাই আবার নতুন করে মরার গাড়ি তবে কেন। মনে হয় ঘটনাটা হয়তো স্বপ্নে ছিল। তাই হবে। সত্যি যদি গলায় দড়ি দেয় বছর তিরিশের ছেলে হৈচৈ হত না? চুপচাপ শববাহী গাড়ি এল। আর সব মিটে গেল? নাকু তো ওখানেই ছিল। জানতে পারলোনা কিছু? এক হতে পারে অ্যাসাইলামেই হয়েছ। তাহলে সাদা গাড়ি এখানেই বা আসবে কেন? কাগজের খবর সুদ্ধু সবই কি স্বপ্নে?

    ।। ২ ।।

    স্বপ্ন -- ভাঙলে স্বপন। কতদিন পর স্বপনের কথা মনে পড়লো। আমাদের নার্সারি স্কুলে আমার পাশে এসে বসতো স্বপন। সাদা শার্ট। ছেলেদের নেভি ব্লু প্যান্ট আর আমাদের মেয়েদের নেভি ব্লু স্কার্ট। নাঃ রঙটা ঠিক আসছেনা। আরেকটু গাঢ় গুলতে হবে। মায়ের হাত ধরে আসতো স্বপন। আর ওকে পৌঁছে দিয়ে যেই ওর মা পিছন ফিরতো ও'ও ছুটে চলে যেতে চাইতো। দারোয়ান আটকে দিত। আর কি কান্না। দারোয়ান বলতো আরে তু লেড়কা আছিস না? ফির রোতা কিঁউ? স্বপনের মায়ের মুখটা মনে নেই। চেহারাটাও না। শুধু কি অসম্ভব নিষ্প্রভ রঙের শাড়ি আর ব্লাউজ পরতেন উনি। এখন আমি জানি ঠিক কতটা দুঃখ মিশলে ঐ রঙটা আসে। স্বপনের মায়ের আলাদা কোন নাম ছিল হয়তো। সকলে স্বপনের মা'ই বলতো। একটা খেঁসকুটে নীল ঝোলা কাঁধে নিয়ে ডান পাটা টেনে হাঁটতেন। ঝোলায় টিফিন বাটি, গামছা এই সব থাকতো। এত ঠেসে ভরা জিনিসে যে মুখটা দুটো বড় বড় সেফটিপিনে আটকাতে হত।

    আস্তে আস্তে স্কুলে মন বসে গেল স্বপনেরও। কাঁদতোনা আর। ভারি সুন্দর কবিতা বলতো। যেদিন কোন বিশেষ দিন থাকতো, প্রেয়ারের পর স্বপনকে গান গাইতে বলতেন বড় মামণি। বিপদে মোরে রক্ষা কর কবিতা শিখেছিলাম। স্বপন যখন গানটা গাইতো কেমন সাহস আসতো বুকে। বড় মামনি গানের দিদিমণিকে বলে আমাদের সকলকে তুলিয়ে দিলেন গানটা। মাঝে মাঝে প্রেয়ারে আমরা গাইতাম। আমাদের ছোট ইশকুলে ক্লাশ ফাইভ অব্দি। তারপর রঙ সব বদলে গেল। আমরা মেয়েরা বাণীমন্দিরে, ছেলেরা দেশবন্ধুতে। এরকমই মোটামুটি। দেখা সাক্ষাৎ কমে এল। তবে কানাঘুষো দেশবন্ধু ছাপিয়ে আমাদের মেয়ে ইশকুলের পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকে পড়তই ছোট মফস্বলে। দুর্গাপুজোর ভাসানে কি ছটপুজোয় স্বপন নাচের বায়না পেত। শাড়ি পরে, মুখে রঙ, লিপস্টিক স্বপনকে প্রথম নিজের চোখে দেখে হাউ হাউ কেঁদেছি। খেতে পারিনি ঠিক করে কতদিন। বই খুলে বসে থাকতাম। এক অক্ষরও মাথায় ঢুকতোনা। সয়ে এল সবই। সময় লেগেছে। বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে। দেখলে কথাবার্তা পর্যন্ত।

    -- বাড়ি ছাড়লি কেন ?

    -- আর কি করতাম? মাকেও হেনস্থা হতে হচ্ছিল, কাজ পাচ্ছিলনা। একঘরে মতো। কেউ কথাই বলতোনা।

    -- লুকিয়ে রাখতে পারলিনা? মায়ের মুখ চেয়ে অন্ততঃ।

    -- কি? ও, বুঝেছি। লুকিয়ে থাকতে দেয় না ওরা। হিঁচড়ে টেনে বের করবেই। সেই স্কুল থেকেই তো। ছোটবেলা থেকে। তোরা জানিস না। দারোয়ান থেকে শুরু করে, ড্রয়িং স্যার তিমির বাবু। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল আমার। এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছিল ওরা। হাতে চকোলেট কি খুচরো টাকার লোভ, না নিলে ভয় দেখানো। দূরত্ব কমছিল। ভেঙে বেরিয়ে আসা ছাড়া উপায় ছিলনা। এখন ভালো আছি। গ্রুপে থাকি তো। প্রোটেক্টেড লাগে। এন জি ও চালাচ্ছি কজন মিলে।

    -- ঠাম্মু বলে তোর কথা। আসবি একদিন? মাথায় হাল্কা চাঁটি মেরে হেসে চলে গেল।

    কলকাতায় চলে গেছে শুনেছিলাম আবছা। তারপর আমিও তো এখানেই, কবে থেকে। ট্রাফিকে গাড়ি দাঁড়ালে কি বাচ্চা নাচাতে এলে, ওদের ঢোলের শব্দ পেলে বেরিয়ে এসে খুঁটিয়ে মুখগুলো দেখা আমারও অভ্যেসেই দাঁড়িয়ে গেল।

    নাকুকে খাওয়াতে গিয়ে ওকেই জিগ্যেস করলাম, স্বপনের কথা মনে পড়লো কেন বলতো হঠাৎ? সুইসাইডের কথায়? ভুলেই গেছিলাম প্রায়। আবার নতুন করে কষ্টটা ফিরে এল। আমার কষ্ট হলে নাকু ঠিক বুঝতে পারে। পার্কে, খালপাড়ে সব মিলিয়ে আঠেরোজন। ওরা কাছে আসে, পা চাটে লেজ নাড়ে। পায়ে ব্যথা হলে, কি কেটে ছড়ে গেলে আমাকে দেখিয়ে যায়। গল্পগাছা ওদের সঙ্গেও। ভালোবাসে জান দিয়ে কিন্তু নাকু যেমন আমার না-বলা কথাও বুঝতে পারে তেমন আর কেউ নয়। ঠিক ঠাম্মুর মতো। মা আমাদের চার জন, হেঁপো রুগী বাবা, ঠাম্মুর বাত সব নিয়ে নাজেহাল থাকতো। কথা কইবার সময় পর্যন্ত নেই যেন। দুঃখ হলে, কষ্ট হলে ঠাম্মুই। ছানিপড়া চোখে, প্রায় বদ্ধ কালা বুড়ি -- মুখে কিছু বলতোনা। কিন্তু ম্যাজিক জানতো। মাথায় হাত রাখলেই সব কষ্ট জুড়িয়ে যেত। সেদিন আর সাধাসাধি করতে হতো না। আমিই খাটে জলচৌকি দিয়ে রামায়ণ, চশমা গুছিয়ে সামনে বসে বলতাম পড়ো দেখি। আর জানা কথাই ঠাম্মু বলবে তুই পড় দেখি আজ। সুর করে পড়তে শুরু করতাম –-

    আর বুক মুচড়ে, পাঁজর গুঁড়িয়ে যেন কান্না আসতো। ঠাম্মু বলতো থাক আজ এটুকুই শুনি। আমার দুধ খইটা দিয়ে দিতে বলতো বৌমাকে। খেতে খেতে বলতো কোথায় থাকে-টাকে এখন জানিস? আমি মাথা নাড়তাম। -- হারিয়েই যায় ওরা। এই ভবিতব্য। ভালো হয়েছে চলে গেছে। মা’টাও স্বস্তি পেয়েছে। একলার কান্না একলা কাঁদুক। নিত্যদিনের লোক হাসাহাসি তো সইতে হচ্ছেনা।

    ।। ৩ ।।

    সর্বাণী... ও সর্বাণী। অদ্ভুত স্বভাব ছিল অমিতের। বেল বাজাতোনা কখনো। গেট খুলতে খুলতে ডাক। তক্ষুণি খুলতে হবে দরজা। না হলেই রাগ। যতক্ষণ বাড়িতে সমস্ত ক্ষণ ডাক। সর্বাণী চা দাও। সর্বাণী কাগজ দিল না এখনও? সর্বাণী আজ দেরি হবে ফিরতে। বাজার করে ফিরবো একেবারে। আমি বলতাম আর তো তৃতীয় কেউ নেই বাড়িতে, নাম ধরে ডাকার কি আছে? -- তৃতীয় প্রাণী নেই বলেই তো আরও ডাকি নাম ধরে। তৃতীয় আসবে, চতুর্থ, পঞ্চম আর তোমার এই নামটা হারিয়ে যাবে। আমিও বলবো ও পুঁটির মা, কি হাবুর নানি। -- তুমি না বাংলার অধ্যাপক। আর এই সব নাম! ও পছন্দ নয়। তবে, তবে... হিরণ্যপ্রভা তোমার মাকে বল এক কাপ চা দিতে, নয়তো কাশ্যপেয়দ্যুতি তোমার ঠাম্মুকে জিগ্যেস কর তো বাতের তেল কি ফুরিয়েছে?

    গর্চা ফার্স্ট লেনের দোতলা বাড়িটা ঝকঝকে। একতলার পুবদিকের দু কামরার ফ্ল্যাট। শৌখিন আসবাব, ফুলছাপ পর্দা, বারান্দায় টব, গাছ, সবুজ। শেষ বিকেলে পশ্চিমের রোদ পড়ে ছবিটার রঙগুলো জ্বলে ওঠে। গরম ভাপে দপদপে। বিয়ের যোগাযোগটা হয়েছিল ঠাম্মুর বাপের বাড়ির কোন আত্মীয়তার সূত্রে। লতায় পাতায় সম্পর্ক ছিল বোধহয় একটা। কিম্বা পাতানো কিছু। অমিতের মা-বাবার খুব যে মত ছিল তা নয়। অমিতের ইচ্ছেটাই সব ছিল। দোষ দেওয়া যায়না। সব দিকেই আমরা ছিলাম বেশ ক’ধাপ নীচে। অমিত হাত ধরে টেনে তুলেছিল অনেকটা। নিচু ক্লাশের দু একটা টিউশন প্রথম দিকে। তারপর মাঝারি ক্লাশ অব্দি। বিকেলে দেড় দু ঘন্টা। আর আমার রঙ তুলি, ফ্রেম, কাগজ, বইপত্র। ও লিখতো আর আমার ছবি। আস্তে আস্তে খবরের কাগজে নিয়মিত কলাম। কয়েকটা যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল। বই-এর মলাট, পত্রিকার ইলাস্ট্রেশন। কিস্তিতে ফ্ল্যাটটা কিনে নেবার কথাবার্তা শুরু। আমার দুনিয়াটা দুলে গেল তখনই। প্রিয়া অমিতের আন্ডারে পি. এইচ. ডি. করছিল। প্রিয়া এগিয়ে আসছিল এক এক পা। পিছোতে পিছোতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল আমার। কিন্তু ভেঙে বেরিয়ে আসার ধক ছিলনা। বাড়িটাকে এত ভালোবেসেছিলাম, হয়তো অমিতের থেকেও বেশি। -- ঠিক না ভুল জানিনা বাড়িটা নিজের করে পেয়ে অমিতকে ছেড়ে দিতেও পারলাম। থাকতে পারিনি অবশ্য গর্চা ফার্স্ট লেনের ঐ ফ্ল্যাটে। তত দিনে পুরোপুরি আমার, একা আমার। তথাপি। জানলা, দরজা, ঘুলঘুলির ফাঁক সব চেপে চেপে বন্ধ করে সময়টাকে আটকে রেখে বেরিয়ে এলাম। তালা চাবি আমার কাছে। ছবিটা শেষ হলনা। ঐ অবস্থায় ঢেকে রেখে ফিরে এলাম। যখন ইচ্ছে তখন শুরু করতে পারি আবার ঐ ছবির মধ্যে ঢুকে পড়ে। একটু আধটু তুলি ছোঁয়াতে হবে। অনেকটাই ফিরে আসবে, পুরোটা না হলেও।

    ।। ৪ ।।

    একটা অটো। হলুদে সবুজে। আগে মাঝে মাঝে দেখতাম। দূর থেকে। এখন ঘন ঘন, বেশ কাছ থেকে। পিছনের টানা সীটে তিনজন। সামনে ড্রাইভারের দু পাশের ছোট সীটে দুজন। ঘন নীল কি সবুজ ঘাগরা বা হলুদ কামিজ কি কমলা শাড়ি। রঙগুলো খুব উজ্জ্বল কিন্তু আনন্দ নেই । চাপা একটা বিমর্ষতার পোঁচ। দুপুরের গলিতে আমি তখন রোদে একা। বাদে দু তিনটে নেড়ি। মাংস ভাত চেটেপুটে। একটা পাটকিলে দুটো সাদা কালো। কালোর ভাগ বেশি। অটোটা সাইড করে দাঁড় করিয়ে ৫ জন এদিক ওদিক। বারান্দায় কি ছাতে শুকোতে দেওয়া কাপড়ের ওপর নজর। আমার নজরও ঘোরে কুকুরগুলো খায় যতক্ষণ। হঠাৎ হয়তো ছোট্ট জামা, তোয়ালে, কাঁথা। সঙ্গে সঙ্গে ঢোল আর হাততালি বাজিয়ে গান। দরোজায় ঝন ঝন বেল দুপুরটাকে চমকে দিয়ে। আড়চোখ একবার চকিতে ঘুরে আসে দলটাকে মেপে। ক্রমশঃ মুখচেনা, আলগা পরিচয়। বুল্টি, গুল্টি, পাকু, ছানা আগে অটোটা দেখলেই ভৌ ভৌ করে তেড়ে যেত। এখন লেজ নাড়ে। পাশ দিয়ে যাবার সময়ে ওরাও কখনো বিস্কুটের ছোট প্যাকেট। আমাকে দেখে টুকরো হাসি, হাতনাড়া। ইনকাম ভালো হলে খাপছাড়া কথা সামান্য।

    -- কাউকে খোঁজ দিদি? আমাদের মতো? কে লাগে? ভাই?

    -- বন্ধু। ভাইএর-ই মতো। বলবো কোনদিন, আজ থাক।

    -- এই বাড়িটার গল্প জান?

    -- সামান্য। স্পষ্ট নয় ছবিটা।

    -- আসি দিদি। বেশি কথা বল যদি আমাদের সঙ্গে তো পড়োশিরা বদনাম রটাবে। কোনদিন বলবো এই মকানের গল্প। খুদা জানে, আমরা যার তালাশ করি, তুমিও হয়তো খোঁজ তাকেই।

    ।। ৫ ।।

    এই এক জীবন। স্কুল, বাড়ি, নাকু পাকুদের খাওয়া, ওষুধ-পথ্য, দুঃখ, কান্না, অবিরাম সন্ধান তারই যা পাওয়া যায়না কখনও একবার হারিয়ে ফেললে। এরই মাঝে জারি থাকে টুকরো টুকরো ছবি, রঙ, ক্যানভাস। ছবি দেখে লুকোন দরোজা খুঁজে পাবেনা কেউ। শুধু আমি চিহ্ন দিয়ে রাখি। চাবির ফুটোর অবস্থান জানি শুধু আমি। যাওয়া আসা চলতেই থাকে। যাওয়া আসা করতেই হয়। পুরোন ছবি বদলে বদলে যায়। কখনও সময়ের নিয়মে, কখনো আমার কারসাজিতে। সময় নিয়ে খেলা করি। কখনও একদম আটকে রেখে দিই, কখনো বয়ে যেতে দিই। ঠাম্মুর চশমার ফ্রেমটা একটু বদলে দিই। সাদা শাড়ি আজকাল আর কে পরে? হাল্কা বুটি তুলি সাদা খোলে সরু ব্রাশটা দিয়ে। মহাভারতের মলাটটায় নতুন রঙ দিই এক পোঁচ। সিংহের থাবা দেওয়া উঁচু খাটে ঠাম্মুকে বসিয়ে সামনে চেয়ার টেনে আমি। আমার চুলে হাল্কা সাদা লাইন টানি দুটো চারটে। তক্তার ওপর বালিশে ঠেস দিয়ে বাবা সটান সোজা। পুরোন রান্নাঘরে নতুন তেল রঙ। পুরোন উনুন মুছে গ্যাসের আগুন। তোলা উনুনের আংরাপোড়া গনগনে লালের বদলে বেগনে-ঘেঁষা নীল।

    স্কুল বাড়িটা আঁকতে ভালো লাগেনা। যতবার আঁকতে গেছি অপমান আর তীব্র বিষাদের রঙটা আনতে পারিনি ঠিকঠাক। আর রঙ না মিললে ছবি তো মেকি গল্প। ও আমি পারিনা। তাই এখন বিরাট সবুজ মাঠ শুধু। বাড়িটা ভাঙাচোরা। টানা বারান্দায় দড়িতে ঝোলে হলুদ কামিজ, কমলা শাড়ি কি নীল সবুজ ঘাগরা চোলি। ঘোরে ফেরে কটা মানুষ। আলাদা মুখ চোখ নাক নেই। ঝাপসা অবয়ব। শরীরটা ঝাপসা কিন্তু তীব্র ইন্দ্রিয়। কি জোরে জোরে কথা বলে ওরা, আগুন জ্বালিয়ে ধেই ধেই নাচে ঢোল বাজিয়ে, হাততালি দিয়ে। দুঃখ হলে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদে।

    লাল বাড়িটা, ভাঙা বারান্দা, নাকু ছিল যেখানে, সে বাড়ি ভাঙা পড়েছে। দাঁড়াও, ঐ ছবিটা বার করি। রোল খুলে এই পাতি। দ্যাখো বাড়ি ভাঙা পড়েছে। নাকুকে রাখবেনা আর। বিষ মেশানো বিরিয়ানি ছড়িয়ে দিয়েছে। কি কালো লোকগুলো। দ্যাখো দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিচ্ছে ওকে কে যেন, আলুথালু পোশাক, যেন পাগলি একটা। অ্যাম্বুলেন্স, সাদা অ্যাম্বুলেন্স, লাল আলো, সাদা হাসপাতাল। শেষ হয়নি এখনও ছবি ... আমাদের ছোট মফস্বলী বাড়ির ছবিটায় যেতে হবে। ঠাম্মুর ঘরে মেঝেতে আমি, আমার কোলে নাকু। মহাভারত পড়ছে ঠাম্মু। শুনছি সবাই।

    গর্চা ফার্স্ট লেনের দোতলা বাড়ির রংটা ফিকে করতে হল একটু। পাশের খোলামাঠে চারতলা ফ্ল্যাট। আলো আটকে গেছে। কালো রঙটা হাল্কা গুলে এক কোট। পর্দা পাল্টে দিই কখনো। বিছানার চাদর, কুশন কাভার। এমনকি চুপি চুপি অমিতের চেহারা অব্দি। এমন করে বদলাই যেন অমিতই নয়। সন্ধের আলো আঁধারিতে বারান্দায় দুটো চেয়ার। রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলো ঢাকা পড়েছে ঝাঁকড়া আমগাছে। আমি আর আমার উল্টো দিকে যে তার মুখে ছায়া। সে অমিত না স্বপ্ন ভেঙে উঠে আসা আর কেউ।

    যেই হোক, সেই হোক। কি এসে যায়। সব টুকরোগুলো জুড়ে দিয়েছি। এখান থেকে ওখানে ইচ্ছেমতো। তুলিতে রঙ ছিটিয়ে চলছি তো চলছি, হাসি রঙ বৃষ্টির মতো।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)