• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৫ | জুন ২০১৯ | গল্প
    Share
  • রকিং চেয়ার : স্বপ্না মিত্র


    আসে, সে আসে। প্রতিদিন দক্ষিণের বারান্দায়। আকাশ ভরা তারার রাতে এক ঝলক বাতাস হয়ে, ভরা বাদলের দিনে বেলফুলের সুঘ্রাণে।

    ঝিরঝিরে হাওয়ায় উইন্ড চাইমটা দুলে ওঠে, সে ফিসফিস করে কথা বলে। জলে ভেজা বাতাসের আর্দ্রতায় মনে পড়ে তার ঘামে ভেজা হাতের হিমেল স্পর্শ।

    বারান্দার গ্রিলের পাশে আধো অন্ধকারে থোকা থোকা মাধবীলতা দুলে ওঠে, সে বলে, একটা গান গাও অরু। অরুণিমা মৃদু স্বরে ধরেন, ওই মালতীলতা দোলে...

    মেঘের আড়াল থেকে পঞ্চমীর চাঁদ উঁকি দেয়, অরুণিমা গুনগুন করেন, তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখো...

    বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে দক্ষিণের বারান্দা উচ্ছল হয়ে ওঠে। চাঁদ মুখ লুকায় সামনের উঁচু ইমারতের পিছনে। অরুণিমা ওঠেন রকিং-চেয়ার থেকে। বেশি রাত করে ঘুমোনো প্রিয়তোষের পছন্দ ছিল না, খুব ভোর ভোর বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ার অভ্যাস যে অরুণিমার...

    অরুণিমার থেকেও আগে ঘুম থেকে ওঠে সুধা, এই বাড়ির বহু পুরনো কাজের লোক। অরুণিমা উঠে পড়েছে টের পেয়ে এক কাপ দার্জিলিং-চা আর দুটো বিস্কুট সুধা রেখে গেছে বেডসাইড টেবিলের ওপর। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে অরুণিমা তাকায় জানলার বাইরে। জানলার বাইরে শোয়ার ঘরের লাগোয়া দক্ষিণের বারান্দায় দুটো রকিং চেয়ার রাখা মুখোমুখি, আর একটা আউটডোর কাঠের টেবিল।

    খুব শখ করে এই রকিং চেয়ার আর টেবিল প্রিয়তোষ কিনে এনেছিলন সাহেব পাড়া থেকে। একটা চেয়ারের হাতলের স্ক্রু ঢিলে হয়ে গেছে, দুটো পায়াও নড়বড় করছে, কাঠের মিস্ত্রি ডাকতে হবে। দক্ষিণের বারান্দায় তিন চারটে ফুলের টবও রাখা থাকে, আইডিয়াটা প্রিয়তোষের, রুম ফ্রেশনারের দরকার পড়ে না, সবসময়ই ঘরে টাটকা ফুলের সৌরভ ভেসে বেড়ায়।

    সামান্য গলা উঁচু করে অরুণিমা ডাকেন, সুধা--

    সুধা এসে নিঃশব্দে দোরগোড়ায় দাঁড়ায়।

    অরুণিমা বলেন, ছাদের কোনে তিনটে বেলফুলের গাছ ভরে কুঁড়ি এসেছে, ওই গাছ তিনটে বারান্দায় রেখে বারান্দার গোলাপ গাছগুলো ছাদে রেখে এসো।

    সুধা ঘাড় হেলিয়ে বারান্দায় চলে যায়। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়েন অরুণিমা।

    নামেই ছাদের বাগান, কিন্তু আকারে বেশ বড়সড়, গুনে গুনে চল্লিশটা টব আছে এই ছাদের বাগানে। গোলাপ, রজনীগন্ধা, বেলফুল, জুঁই ছাড়াও আছে কামিনী ফুল আর বেশ কয়েকটা বোগেনভেলিয়ার গাছ। আছে গন্ধ-লেবু, পাতিলেবু, ধানিলঙ্কা, টম্যাটো, শসা, বেগুন আরও কত কী। ছাদের বাগানের প্রতিটি টবের যত্ন নিজে হাতে করেন অরুণিমা। কামিনী গাছের গোড়ায় জল দিতে দিতে অরুণিমার চোখ যায় মাধবীলতার ঝাড়ের দিকে। তিনি এগিয়ে আসেন ছাদের পাঁচিলের পাশে, ঝুঁকে তাকান নীচে--

    বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকে সামনের এক চিলতে বাঁধানো চত্বরটা ইতিমধ্যেই সুধা জল ঢেলে ধুয়ে দিয়েছে। ওই বাঁধানো চত্বরের কোনে একটা চৌকো খোপ, সেখান থেকে মাধবীলতা গাছটা সোজা উঠে এসেছে ওপরে, একতলা থেকে দোতলার বারান্দা, দোতলার বারান্দা থেকে ছাদে, ছাদে উঠে পাঁচিল বেয়ে বেয়ে এগিয়ে মস্ত ঝোপ করেছে একটা।

    মাধবীলতার ঝোপের দিকে তাকিয়ে অরুণিমার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। গাছটা পুরনো, যে মানুষটা লাগিয়েছিল সে আরও পুরনো। মানুষটা চলে গেল, গাছটা রয়ে গেছে, মানুষটার বাগান প্রীতির ইতিহাস হয়ে। জীবন বড় অদ্ভুত, তিল তিল করে সংসার তৈরি করা, সম্পর্ক গড়ে তোলা, তারপর একদিন ময়দান ছেড়ে চলে যাওয়া, একা একা।

    সত্যি, সে চলে গেল, অরুণিমাকে একা রেখে। উনসত্তর বছরের অরুণিমার ঠোঁট অভিমানে কেঁপে ওঠে। সাতসকালে খাঁ-খাঁ দিনের আলোয় খোলা ছাদে অরুণিমার চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লে একেবারে ছি-ছি কাণ্ড, বুড়ো বয়সে লোকসমক্ষে এসব কী!

    কান্নাকাটির মত অঘটন থেকে বাঁচিয়ে দেয় অনসূয়া, অরুণিমার মেয়ে, পনেরো দিনের ছুটিতে সে মেলবোর্ন থেকে কোলকাতায় এসেছে। দেড় বছর হল অনসূয়ার বাবা প্রিয়তোষ রায় বিনা নোটিশে হার্ট-অ্যাটাকে মারা গেছেন। সেই থেকে সুধাকে নিয়ে অরুণিমা একাই আছেন কোলকাতার বাড়িতে। অনসূয়া এসেছে কোলকাতার সংসারে আপাতত তালা লাগিয়ে মা-কে নিজের কাছে নিয়ে যেতে। ঘুম থেকে উঠে কখন যে অনসূয়াও ছাদে উঠে এসেছে অরুণিমা তা টের পাননি।

    অরুণিমার হাত থেকে জলের ঝাঁঝরিটা টেনে নিয়ে অনসূয়া বলে, আবার তুমি গাছে জল ঢালছ? তোমার না হাতে ব্যথা! ডাক্তার-কাকু পইপই করে বলে দিল রেস্ট নিতে, তুমি কারও কথাই শুনছো না!

    অনসূয়ার গলায় উদ্বেগের সঙ্গে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ, অরুণিমার কানে সেটা ধরা পড়ে। অরুণিমার ঠোঁটের অভিমান সরে গিয়ে এখন সেখানে আত্মাভিমান।

    অরুণিমা মৃদু হাসেন, ছাড় তো, ডাক্তাররা অমন বলেই থাকে, তাছাড়া ছাদের বাগান আর দক্ষিণের বারান্দা, এই নিয়েই তো পড়ে আছি।

    অনসূয়ার গলায় বিরক্তি, এখানে কে তোমাকে পড়ে থাকতে বলেছে মা? অভি এলো তোমাকে নিয়ে যেতে, তুমি জেদ করে গেলে না। আজ পাঁচদিন হয়ে গেল আমি এসেছি, সকাল বিকেল সাধছি তোমাকে, কিছুতেই আমার সঙ্গে মেলবোর্ন যেতে চাইছো না তুমি।

    অরুণিমার ঠোঁটের হাসি মুছে যায়, তার গলা গম্ভীর শোনায়, এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে আমার মন চায় না অনু, এক সময় দরকারে অদরকারে গিয়েছি তো তোমাদের কাছে।

    অনসূয়া বলে, সেটাই, সেটাই তো প্রশ্ন, আমি আর অভি দুজনেই বাইরে, বাবা চলে গেল, তবু এ বাড়ির প্রতি তোমার এত টান কেন? অত দূর থেকে তোমার দেখাশোনা আর আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছে না মা, ছ-মাস অভির কাছে ডালাসে আর ছ-মাস আমার বাড়িতে মেলবোর্নে থাকা শুরু করো, তাতে তোমার মন ভালো থাকবে, আর মন ভালো থাকলে ঘনঘন শরীরও বিগড়োবে না।

    অরুণিমার চোখ জ্বলে ওঠে, আর কোলকাতার সংসার? এই বাড়ির কী হবে?

    অনসূয়া এক মুহূর্তও দ্বিধা করে না, বেচে দাও, বেচে দাও এই বাড়ি, এত বড় বাড়ি মেইনটেইন করার কোন মানেই হয় না, আমি বা অভি কোনদিন দেশে ফিরবো না, বাড়ি বিক্রি করে যা টাকা হবে তার থেকে একটা ফ্ল্যাট কিনে বাকিটা ব্যাঙ্কে রাখো, এন্ড এনজয় দ্য ইন্টারেস্ট।

    অরুণিমার গলায় ছেলেভোলানোর সুর, আমাকে নিয়ে অত ভাবিস না অনু, আমি ঠিক আছি, আর এই বাড়ি আমার বোঝা নয় রে, বরং সঙ্গী, কত কষ্ট করে জমি কেনা, তারপর একতলা, ধীরে ধীরে দোতলা, কত স্মৃতি জড়িয়ে এই বাড়ির সঙ্গে।

    অনসূয়া আর ছোটটি নেই, সে এখন দুই মেয়ের মা, চুয়াল্লিশ বছরের অনসূয়া মায়ের কথায় ভোলে না, সে বলে, কোথায় ভালো আছ মা? আজ আরথ্রাইটিস, কাল হার্টের সমস্যা, পরশু গিজারের পাইপ লিক করছে, সমস্যা তো লেগেই আছে।

    অরুণিমা কথা ঘোরানোর চেষ্টা করেন, ওহ ভালো কথা, সেজদির এঞ্জিওগ্রাম হয়েছিল, রিপোর্ট ভালো, কোন ব্লকেজ নেই, আজ সকালে রাজা ফোন করে খবর দিল।

    রাজার ফোনের খবর শুনে অনসূয়ার মুখ মুহূর্তের জন্য কালো হয়ে যায়, তার গলা ভারি হয়ে ওঠে, আজকাল সেজমাসিকে ফোন করাই দায় হয়ে উঠেছে।

    অরুণিমার স্বর তীক্ষ্ণ হয়ে বাজে, কেন?

    অনসূয়া বলে, ফোন করলেই খালি রাজার প্রশংসা, রাজা আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল, রাজা ডাইনিং স্পেসেও এসি লাগিয়ে দিয়েছে, এইসব।

    অরুণিমা হাসেন, ছেলে নিয়ে সেজদির গর্ব আছে, তাতে কী?

    অনসূয়ার গলায় ঝাঁজ, ছেলে নিয়ে গর্ব নয়, আমি আর অভি যে বিদেশে থাকি, তোমার পাশে পাশে থাকি না, তাই নিয়ে খোঁটা দেওয়ার চেষ্টা করে।

    অরুণিমার গলায় বকুনি, ওসব তোমার মনের ভুল, সেজদিকে নিয়ে ছোট বড় কথা আর আমার সামনে বল না।

    অরুণিমার তিরস্কারে অনসূয়া চুপ করে গেলেও সন্ধেবেলা ফোনের ওপ্রান্তে অভিও সোচ্চার হয়ে ওঠে--

    রাত আটটা বাজে। ডিনারের দেরি আছে। অরুণিমা আর অনসূয়া ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিল। অভির ফোন এলে এ বাড়ির নিয়ম মত অনসূয়া স্পীকার অন করে দিয়েছে।

    অভি বলে, অনুদিদি ঠিক বলেছে, সেজমাসিকে ফোন করলে আমাদের কথা শুনতেই চায় না, রাজাদার প্রশস্তির পর শুরু করে তোমাকে নিয়ে, তোমার এটা সেটা অসুবিধের ফিরিস্তি দেয়, যেন তোমার সুবিধা অসুবিধার আমরা খবরই রাখি না, যেন তোমার সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ নেই।

    অরুণিমা প্রতিবাদের চেষ্টা করেন, ওসব তোদের মনের ভুল, সেজদি সরল মানুষ, আমার কষ্ট সইতে পারে না, তোরা আমার সন্তান, তাই তোদের বলে।

    অনসূয়ার গলা চড়ে যায়, অ্যাই অ্যাই, দেখলি অভি!

    ভাইকে সাক্ষী রাখার চেষ্টা করে ছ-বছরের বড় দিদি। ও প্রান্তে অভি চুপ করে থাকে, বোধহয় অনুদিদির বক্তব্য সে ঠিক ধরতে পারেনি।

    অরুণিমার গলায় অসহায়তা, কেন কী বললাম আমি, আজকাল সবতাতেই খুঁত ধরার তোর একটা বাজে স্বভাব হয়েছে অনু!

    অনসূয়া চোখ পাকায়, এই যে বললে সেজমাসি তোমার কষ্ট সইতে পারে না, আমিও তো একই কথা বলছি, তুমিই মাথা নেড়ে নিজের অসুবিধের কথা অস্বীকার করছ।

    অভি বলে, সত্যি মা, গত মাসে ছুটিতে আমরা কোলকাতা গেলাম, উমা আর আমি কত সাধলাম তোমাকে, কিছুতেই এলে না ডালাসে।

    অনসূয়ার গলায় দুশ্চিন্তা, বাবা কেমন হঠাৎ চলে গেল, তোমার শরীরও দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে মা।

    অরুণিমা জিজ্ঞাসা করেন, হ্যাঁরে অভি, উমা ফিরেছে ট্যুর থেকে?

    অভি বলে, হ্যাঁ, গতকাল রাতে।

    অনসূয়া জিজ্ঞাসা করে, ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে?

    অভি বলে, না রে, এইবার করবো।

    অরুণিমার স্বরে ব্যগ্রতা, কী ব্রেকফাস্ট করবি? উমা বানিয়ে দেবে?

    অভির গলা উষ্ণ শোনায়, আমাদের যার যার তার তার মা, কেউ কিছু করে দেয় না, প্রত্যাশা রাখাও উচিত নয়, উমাও তো চাকরি করে।

    অরুণিমা বলেন, অত কথা শোনাচ্ছিস কেন, কী খাবি সেটা বল না!

    অভি বলে, সিরিয়াল এন্ড সানিসাইড আপ।

    অরুণিমার স্বরে কৌতূহল, ঠিকঠাক পারিস, নাকি কুসুমটা ফেটে যায়?

    অভির গলা ব্যাজার, ফেটে যায়।

    এ প্রান্তে শব্দ করে অনসূয়া হেসে ওঠে, মায়ের খোকা, এখন একার সংসারে ঠ্যালা বোঝ।

    ভাই বোন মা গল্প করে, কথাগুলো উড়তে থাকে শৈশব থেকে যৌবন, প্রয়োজন থেকে প্রমোদ, অসন্তোষ থেকে আহ্লাদ, দুঃখ থেকে খুশির চারপাশে, ঘুরে ঘুরে চক্রাকারে।

    আজকের রাত বড় সুন্দর। আকাশে হাল্কা মেঘ, তবু তার মধ্যেই ঝিকমিক করছে হাজার হাজার তারা। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে থেকেই রাতের খাওয়াদাওয়ার পর দক্ষিণের বারান্দায় দু-পেয়ালা চা নিয়ে বসতো প্রিয়তোষ আর অরুণিমা।

    আজও অরুণিমার সেই অভ্যাস অব্যাহত রয়ে গেছে। বারান্দায় কাঠের টেবিলের ওপর সময়মত চায়ের সরঞ্জামের ট্রে রেখে গেছে সুধা। জানলার দিকের রকিং চেয়ারে অরুণিমা বসে, টি-পট থেকে টিকোজিটা খুলে পাশে রাখে, ফিনফিনে বোন চায়নার সাদা কাপে চা ঢালে সাবধানে, এক কাপ নয়, দু-কাপ। টি-পটের পাশেই রাখা চিনি আর দুধ। প্রথম কাপে এক চামচ আর দ্বিতীয় কাপে দু-চামচ চিনি মেশায় সে।

    প্রিয়তোষের বরাবরই চায়ে একটু বেশি চিনি পছন্দ। চিনি আর দুধ ভালো করে মিশিয়ে চায়ের কাপে তৃপ্তির চুমুক দেয় অরুণিমা। চা নিয়ে প্রিয়তোষের খুব খুঁতখুঁতুনি ছিল। চা সম্পর্কে জ্ঞানও ছিল মানুষটার। প্রিয়তোষের থেকেই তো অরুণিমা গ্রীন-টি খেতে শিখলো। শুধু গ্রীন-টি কেন, প্রিয়তোষের থেকে অরুণিমা অনেক কিছুই শিখেছে।

    প্রিয়তোষের সঙ্গে অরুণিমার বিয়ে হয়েছিল সম্বন্ধ করে, অরুণিমা তখন তেইশ আর প্রিয়তোষ তিরিশ। প্রিয়তোষের চেহারা লম্বা চওড়া, তুলনায় অরুণিমা বেঁটে, রোগা, মাঝারি গায়ের রঙ।

    শ্রাবণ ঘন তেমন তেমন দিনে সাহস সঞ্চয় করে অরুণিমা জিজ্ঞাসা করেছে, কী দেখে পছন্দ করেছিলে আমাকে, তোমার পাশে আমি তো কালো!

    প্রিয়তোষ বলেছে, কালো, তবে এমন কাজল কালো হরিণ চোখ ক-জনের আছে? আর তোমার গান? এমন মধুর গাও কী করে অরু? আমার গলা থেকে তো শুধুই ষাঁড়ের আওয়াজ বার হয়।

    হাসতে হাসতে, সুখে ভাসতে ভাসতে, অরুণিমা জড়িয়ে ধরেছে প্রিয়তোষকে, গুনগুনিয়ে উঠেছে, প্রভু আমার, প্রিয় আমার পরমধন হে...

    এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস আসে, অরুণিমা চমকে আকাশের দিক থেকে চোখ ফেরায় সামনে রাখা মুখোমুখি রকিং চেয়ারটার দিকে। হাত লেগে যায়, হয়তো পা, রকিং চেয়ারটা দুলে ওঠে মৃদু মৃদু, দ্বিতীয় কাপ থেকে খানিকটা চা চলকে পড়ে কাঠের টেবিলে...

    অরুণিমার গলায় আহ্লাদী ঢং, আহ সাবধানে, গত মাসেই একটা কাপ ভেঙেছে, জানো তো আমি ম্যাচিং টি-সেট ছাড়া রাতের চা খেতে পারিনা, একটা কাপের জন্য আবার নতুন টি-সেট কিনতে হল, শুধুমুধু কতগুলো টাকা গচ্চা!

    এইবার কোলকাতায় অনসূয়া এসেছিল শুধুমাত্র অরুণিমার জন্যই। কোলকাতার সংসারে আপাতত তালা লাগিয়ে অরুণিমাকে নিয়ে মেলবোর্ন ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার। তবে কোলকাতার বাড়ি একা সুধার দায়িত্বে রেখে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠলেই সেখান থেকে সরে গেছেন অরুণিমা।

    অনসূয়া আকাশপাতাল ভেবেছে, মা-র সমস্যাটা ঠিক কী, মা কি জামাই বাড়িতে যেতে চায় না? কিন্তু অনসূয়া তো চাকরি করে। আর মা ভালো করেই জানে যে অনসূয়ার মাস মাইনে জামাই শোভিতের থেকে বেশি। হ্যাঁ, শোভিত ইউপি-র ছেলে বলে এই বিয়েতে মা-বাবার খুব আপত্তি ছিল। তবে সে তো বহু পুরনো গল্প, সতেরো বছর আগেকার কথা। তারপর কতবার ঘটা করে মা জামাইষষ্ঠী করলো!

    অনসূয়ার দুই মেয়ে, নায়রা আর ইরা, নায়রা চোদ্দ আর ইরা বারো, দুজনেরই জন্ম বিদেশে। পিঠোপিঠি দুই সন্তানকে মা-বাবার সাহায্য ছাড়া চাকুরিরতা অনসূয়ার পক্ষে সামলানো অসম্ভব ছিল। সেসময় মাসের পর মাস অরুণিমা এসে থেকেছেন মেয়ের বাড়িতে। এবং সেই কারণেই নায়রা আর ইরার খুব কাছের মানুষ দাদু আর দিদা। শুধু সেসময় কেন, নায়রার ছ-বছর বয়স অবধি মা-বাবা নিয়মিত এসেছেন তাদের বাড়িতে। তারপর বাবার শরীরে নানা রোগের উপসর্গ দেখা দিল, মা-র বাতের ব্যথাও দিনে দিনে বেড়ে উঠলো। তাছাড়া জমানো টাকা থেকে বছর বছর বিদেশ ভ্রমণের টিকিট কাটাও মুশকিল হয়ে পড়ছিল। তবে অরুণিমাকে না জানিয়েই অরুণিমার জন্য একটা টিকিট বুক করে রেখেছে অনসূয়া, শেষমেশ যদি মা মেলবোর্ন যেতে রাজি হয়ে যায়!

    তা দেখতে দেখতে অনসূয়ার ছুটির বারো দিন কেটে গেছে, কোলকাতায় এলে সময় যেন হুড়হুড় করে চলে যায়।

    প্রথম দু-চারদিন ছেড়ে বাকি দিনগুলোতে অনসূয়া উঠে পড়ে বাড়ির কাজ সেরেছে। মা-র সঙ্গে ব্যাঙ্কে গেছে, হাউসফিজিশিয়ান ডাক্তার-কাকুর সঙ্গে দেখা করেছে, অরুণিমাকে হার্ট স্পেশালিষ্ট দেখিয়ে এনেছে, নতুন চশমা করে দিয়েছে, আর দু-দিন কষে গড়িয়াহাট থেকে মার্কেটিং করেছে।

    আর তিনদিন পর সে ফিরে যাবে নিজের আস্তানায়। মনে মনে মা-র জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে, আবার মা-র ওপর বিরক্তিও আসছে, অদ্ভুত জেদ ধরেছেন মহিলা, কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না।

    সেবার এরকমই, দু-সপ্তাহের ছুটিতে তারা চারজনই এসেছিল ইন্ডিয়ায়, নায়রা আর ইরার সঙ্গে বাবা খুব হইহই করেছিলেন। ফিরে যাওয়ার পর এক মাসও যায়নি, সকাল এগারোটার সময় বাবার চলে যাওয়ার খবর এসেছিল অফিসে। অফিস কলিগদের সামনেই অনসূয়া হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল। সে দুঃখ ভোলার নয়।

    ডিনারে সুধা বিরিয়ানি করেছিল। বিরিয়ানি খেয়ে পেট গরম হওয়ার কারণে নাকি মা-কে নিয়ে চাপা দুশ্চিন্তার জন্য, কে জানে কেন কিছুতেই ঘুম আসছিল না অনসূয়ার। ঘুমের আরাধনায় কিছুক্ষণ কাটিয়ে সে উঠে বসে বিছানায়। ধুর, মা-র ড্রয়ারে তো ঘুমের ওষুধ থাকে, ডাক্তারকাকুই দিয়েছেন, প্রয়োজন হলে মাঝেমধ্যে মা ঘুমের ওষুধ নেয়, সেখান থেকে দুটো ট্যাবলেট খেয়ে নিলেই আজকের রাতের মত ল্যাটা চোকে!

    অরুণিমার ঘরের দরজা ভেজানো ছিল, অনসূয়া সন্তর্পণে দরজা ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢোকে।

    আজ পূর্ণিমা, চারপাশ ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। জোছনার আলো এসে পড়েছে অরুণিমার বিছানাতেও। অনসূয়া অবাক হয়ে দেখে, মা বিছানায় নেই। সে অ্যাটাচড বাথরুমের দিকে তাকায়, সেখানেও আলো জ্বলছে না। অনসূয়ার বুক ছ্যাঁত করে ওঠে, তার চোখ যায় শোয়ার ঘরের জানলার বাইরে দক্ষিণের বারান্দায়।

    ওই তো, বারান্দায় রকিং চেয়ারে মা বসে। পূর্ণিমার আলো এসে পড়েছে অরুণিমার মুখে। সেই এক চিলতে আলোতেও অরুণিমার মুখের ভাব দেখে অনসূয়া চমকে ওঠে, তার মনে ঝলসে ওঠে স্কুলের দিনগুলো, মা-র যুবতী বয়সের আহ্লাদী মুখের ছবি। মন্ত্রমুগ্ধের মত অনসূয়া এগিয়ে যায় জানলার দিকে--

    দক্ষিণের বারান্দা ভেসে যাচ্ছে অনাবিল জ্যোৎস্নায়। অরুণিমা বসে আছেন। অরুণিমার মুখোমুখি একটা খালি রকিং চেয়ার। পূর্ণিমার আলোয় বারান্দার একপাশে সাদা বেলফুলেরা মুখ উঁচিয়ে হাসছে, হাওয়ায় ভাসছে ফুলের সৌরভ। খালি রকিং চেয়ারটা দুলছে মৃদু মৃদু, সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছে অরুণিমা। স্মৃতির পরপারে দাঁড়ানো অরুণিমার হাত লেগে যায় চা ভর্তি কাপে। খানিকটা চা চলকে পড়ে কাঠের টেবিলে, মেঝেতে...

    প্রিয়তোষের সঙ্গে কথা বলার ভঙ্গীতে অরুণিমা বলে ওঠে, আহ আস্তে, অত হাত-পা নেড়ো না, চায়ের কাপ উল্টে যাবে।

    জানলার পাশে দাঁড়িয়ে অনসূয়া চেয়ে চেয়ে সব দেখে, তার চোখের বিস্ময় গলে গলে জল হয়ে ঝরে পড়ে। অনসূয়া যেমন ঢুকেছিল তেমনই নিঃশব্দে ফিরে আসে নিজের ঘরে, টেবিল ল্যাম্প জ্বালায়, বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার খুলে বার করে অরুণিমার মেলবোর্ন যাওয়ার টিকিট। পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় নিজের ঘরের জানলার পাশে...

    দৈব অরুণিমার থেকে প্রিয়তোষকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আজও মায়ায়, ভালোবাসায়, স্মৃতিতে প্রিয়তোষ আছে অরুণিমার সমগ্র চৈতন্য জুড়ে। এই প্রিয়তোষকে অরুণিমার থেকে আলাদা করে সাধ্য কার।

    না, এই বাড়িতে মা একা নেই তো! পদে পদে বাবার স্মৃতি মা-র সঙ্গী।

    অরুণিমার টিকিটটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে জানলার বাইরে হাত বাড়িয়ে অনসূয়া উড়িয়ে দেয় তারা ভরা আকাশের দিকে। এক রাশ সাদা কাগজের টুকরো ভালোবাসার ফুল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মাধবীলতা গাছটার গোড়ার কাছে। হাওয়ায় দুলে ওঠে মাধবীলতার ডাল। থোকা থোকা মাধবীলতা ফুলের গায়ে হেসে ওঠে জোছনার আলো।




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)