বাংলা ছোটো গল্পে চল্লিশের দশকে যারা লিখতে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য্য, সমরেশ বসু ইত্যাদি বহু খ্যাতনামা কথা-সাহিত্যিকের নাম করা যায়। ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত 'পরিচয়', অরণি, 'ক্রান্তি' ইত্যাদি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যে গল্পধারার সূচনা হয়েছিল, সেগুলির একটি মূলগত স্বভাবধর্ম যদি চিহ্নিত করতে হয়, তা হল, সেই গল্পগুলির অধিকাংশই ছিল সমসাময়িক দেশ কাল সমাজনির্ভর। বলাবাহুল্য বাংলা ছোটোগল্প তার জন্মলগ্ন থেকেই সমাজ-মনস্ক থেকেছে। কিন্তু এই সময়পর্বে পরপর ঘটে যাওয়া কিছু রাষ্ট্রনৈতিক বিক্ষোভ, যেমন মন্বন্তর, দুর্ভিক্ষ, বস্ত্র সংকট, ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। সমসাময়িক সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে লেখকদের দৃষ্টির সজীব আন্তরিকতা ও তীক্ষ্ণ সমাজমনস্ক মন সেই সময়কার 'প্রগতি সাহিত্য' বা 'নতুন সাহিত্য'-র অন্তরতম সুরটিকে চিনিয়ে দিতে পেরেছিল। আমরা এই প্রবন্ধটিতে মূলত তিনজন লেখকের বস্ত্র সংকটকে নিয়ে লেখা তিনটি গল্পকে নির্বাচন করে আলোচনা করবঃ নরেন্দ্রনাথ মিত্রের 'আবরণ', নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'দু:শাসন্ এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'শিল্পী'।
'আবরণ' গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৫২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যায় 'অরণি' পত্রিকায়। গল্পের প্রধান চরিত্র দুটি। বংশী, এবং তাঁর স্ত্রী চাঁপা। বংশী দুপুর রোদে পাটক্ষেত নিড়িয়ে এসে দেখে তাঁর স্ত্রী ঘরে ঝাঁপ বন্ধ করে বসে আছে। ভেতর থেকে বন্ধ দেখে মাথায় রক্ত উঠে যায় বংশীর। দোর বন্ধ করে কী করছে তার বউ? দরজা খুলতে বললেও খুলছে না দেখে বংশী বলে 'দোর খুলবি, না বন্ধ করেই থাকবি?' চাঁপা রেগে গিয়ে বলে 'না বন্ধ করে থাকব কেন! নেংটো হয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে লোককে দেখাব সোয়ামীর আমার কেরামতি কতখানি। ভাত কাপড়ের বৌ নয় কেবল পীরিতের গোঁসাই!' স্বভাবতই জ্বলে ওঠে বংশী। দিনরাত শুধু ভাত কাপড়ের খোটা দেয় চাঁপা। ভাত কাপড় সে দেয়, না চাঁপার বাপ এসে জুগিয়ে দেয়? দোর খুলছে না দেখে লাথি মেরে দোর খোলার কথা বলতেই কাতর কন্ঠে চাঁপা স্বামীকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। চাঁপা ময়লা কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে গরমের মধ্যেও টুকরো টুকরো ছেঁড়া নেকড়া জোড়া দেবার চেষ্টা করছে। চাঁপা গলায় দড়ি দিয়ে মরার কথা বলতে বংশী বলে সে পরপুরুষ নয়। স্বামী। স্বামীর কাছে তো এত লজ্জা থাকার কথা নয়। চাঁপা ঝংকার দিয়ে ওঠে। এক বছরে একখানি কাপড় দিতে পারে না যে, তার স্বামী পরিচয় দিতে লজ্জা করে না। স্ত্রীর জন্য একখানি কাপড়ের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে বংশী। কোথাও কাপড় নেই। কেউ কাপড় তো দূরের কথা একখানি গামছা পর্যন্ত দিতে অস্বীকার করেছে। সে নিজে না হয় সারাদিন গামছা পরেই থাকে কিন্তু অমন সোমত্ত বউয়ের দেহ কি গামছায় ঢাকা থাকে? সকালেও কোনোমতে একখানা শাড়ি পরে ছিল। কিন্তু ঘাটে জল আনতে গিয়ে জীর্ণপ্রায় শাড়িটি একেবারে রন্ধ্রে রন্ধ্রে খসে যায়। গোয়ালাদের বিনোদ ছিল ঘাটে। চাঁপার ইচ্ছে হচ্ছিল গলায় দড়ি দেয়। দড়ির কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে বংশী। এ-শুধু একই কথা বউয়ের মুখে। সত্যিই নাকি গ্রামে গোকুল মণ্ডলের মেয়ে গলায় দড়ি দিয়েছে। আগের বার আকালে যেমন চাল ছিল না কোথাও, এবারেও একগাছি সুতো কোথাও নেই। যাই হোক, মাঠ থেকে এসে খিদের জ্বালায় বংশী পাগল। বউকে খেতে দিতে বললে সে বলে অবুঝের মতো কেন বলছে বংশী? এ অবস্থায় ঘর থেকে বেরনো কোনমতে সম্ভব নয়। অগত্যা বেড়ে রাখা ভাত ও কলমী সেদ্ধ খেয়ে পরম তৃপ্তিতে হুঁকো টেনে যখন বউয়ের কোনো সাড়া শব্দ পায় না বংশী, তখন দোরের দড়ি কেটে ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে দেখেই পা আর এগুলো না বংশীর। সম্পূর্ণ নগ্ন নারীদেহ। এরই জন্য কি একেক রাত্রে কম খোসামোদ করেছে সে বউকে? কিন্তু আজ আর কোনো বাধা নেই। তা সত্ত্বেও চোখ মেলতে পারল না সে। ঘুমন্ত বউয়ের দেহে ছেড়া নোংরা কাঁথাটা কোনোমতে টেনে দিয়ে সে বেরিয়ে যায় কাপড়ের সন্ধানে। বলা বাহুল্য কোথাও পায় না সেই কাপড়। অবশেষে ঘটনাচক্রে শহরে এসে এক বারবণিতার দেখা পায়। সেও খদ্দের দেখে চোখের ইশারা করে বংশীকে। পরনে কমলা রঙের শাড়িখানি ভারি চমৎকার মানিয়েছে। তারপর সুখদা অর্থাৎ সেই বারবণিতার পিছু পিছু যায় তার কোঠায়। বংশী বেঁধে ফেলে তাকে। তারপর সুখদার দড়িতে ছেড়ে টাঙিয়ে রাখা শাড়িখানি বগলদাবা করে পালাতে যায়। চেঁচিয়ে ওঠে সুখদা। এখানেও সেই একই অনাবৃত নারীশরীর। শাড়ি পরার ধরনে যাকে আঠার- উনিশ বছরের যুবতী মনে হয়েছিল, তার অনাবৃত শরীরের শিথিল হয়ে যাওয়া চর্ম ও "সর্বাঙ্গে চাকা চাকা ক্ষত চিহ্ন, বুকের ওপর বিকৃত, বিস্তীর্ণ দুটি মাংসপিণ্ডের মাথায় বড় বড় দু খানা ঘা থকথক করছে"। মুহূর্তকাল হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে বংশী। তারপর শাড়িখানা সেই অনাবৃত নারীদেহে ছুঁড়ে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় সে। ততক্ষণে পদ্ম, বৃন্দা এবং পুলিশ কনস্টেবল এসে দাঁড়িয়েছে।নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখক-সত্তার বিকাশ এবং প্রতিষ্ঠা বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মন্দার এক অন্ধকারময় সময়পটে। তাঁর লেখায় সে সকল কথা আসে বটে কিন্তু তা অত্যন্ত সাবমার্জড্ টোনে। যুদ্ধ দুর্ভিক্ষের সময়কাল এসেছে বলে তাঁর লেখাকে প্রবলভাবে যুদ্ধের আবহের ভয়াবহতা-সর্বস্ব হতে হবে, এমন মনে করেন না তিনি। যেমন তিনি যখন 'হলদে বাড়ি' গল্পটি লেখেন, তখন যুদ্ধের আবহের পরিচয় পাই বটে, তবে সেটা অত্যন্তই স্বল্প ও মৃদুভাবে। 'আবরণ' গল্পে আকালের প্রসঙ্গও দুএকটি বাক্যে এমনভাবে দেন তিনি, যে মনে হয় দুর্ভিক্ষ বা যে কোনো মানবিক সামাজিক সংকটের চিত্র দেখানোটা যেন তাঁর উদ্দেশ্য নয়। বরং সেই সংকটের গহন গভীর আবর্তে আন্দোলিত নরনারীর জীবনের চকিত কিছু মুহূর্তের বিচ্ছুরণ তিনি ঘটাতে চান তাঁর গল্পে।
দু একটি বাক্য থেকে উঠে এসেছে আকাল তথা দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ। যেমন বংশীর স্ত্রী জন্য বহুদিন ধরে কাপড় খোঁজার প্রসঙ্গে বিবৃতিতে সর্বজ্ঞ কথক লেখেন--"ওবার যেমন চাল ছিল না, এবার তেমনি একগাছি সুতোও কোথাও জুটছে না।" আবার যখন কাপড় খুঁজতে গিয়ে বংশী বারবণিতা সুখদার গৃহে ঢুকে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল, তখন সুখদা হেসে বংশীকে বলে--"ধন দৌলত দেখছ বুঝি ঘরের। কিছু নেই-- ওবারের দুর্ভিক্ষ সব বেচে খেতে হয়েছে।"
জ্যৈষ্ঠ ১৩৫২ অর্থাৎ ১৯৪৫। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ১৯৪৩ এবং ১৯৪৪ বছর দুটিতে মানুষের জীবনে দু:সহ অভিজ্ঞতার ঝাঁপি উপুড় করা ছবি। আকাল, দুর্ভিক্ষ, মহামারী ইত্যাদি- সর্বাত্মক ধ্বংসের ঠিকানায় এসেছে গোটা দেশ সমাজ। বাংলা কবিতাতেও সময়কালীন চিত্র ফুটে উঠেছে। কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় যেমন বলেন তাঁর ভ্রমণ কবিতায়--
"অনেকদিন অনেক দূর রেললাইন ধরেই জীবন থেকে পালাইকথাসাহিত্যে গোপাল হালদার তাঁর 'তেরশ পঞ্চাশ' উপন্যাসে, সমর সেন তাঁর 'ক্রান্তি' নামক কবিতায় তুলে আনেন এই যন্ত্রণাকাতর সময়ের ছবি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'আজ কাল পরশুর গল্প' গ্রন্থের 'রাঘব মালাকার' গল্পে তুলে আনেন প্রত্যক্ষভাবে বস্ত্র-সংকটের ভয়াবহ চিত্র। এই গল্পে দেখা যায় রাঘব গৌতমের পা ধরে বসে থাকে কাপড়ের জন্যে। "ঘরের মেয়েগুলো সব ন্যাংটো হয়ে আছে গো। মেয়েগুলো ন্যাংটো বাবাঠকুর। মা-বুন ন্যাংটো, মেয়ে-বৌ ন্যাংটো। ন্যাংটো তো ঘরে ঘরে।" 'আবরণ' গল্পেও চলে আসে এমনই কাতর প্রার্থনা বংশীর মুখে। বংশী কাপড়ের ব্যবসায়ী সুবলের কাছে গিয়ে কাপড়ের জন্য ধরে পড়ে। সুবল বলাই বাহুল্য দেয় না। কাপড় নিতে হয় তো গভর্মেন্টের কাছে, জজ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যাক বংশী। বাড়ির "মেয়েছেলের দিকে যে চাওয়া যায় না কত্তা।" কে একজন রসিকতা করে বলে "তাহলে বাইরের মেয়েছেলের দিকে তাকাবি।" বিরক্ত হয়ে বংশী চলে যায়। কাপড় চাইতে গেলে সবাই ধমকে ওঠে। তাঁকে শুনতে হয় কত বড় ঘরের বউ-ঝিরা ন্যাংটো হয়ে আছে, তাদের চেয়ে তাঁর বউ-এর লজ্জা হল বেশি।
উনিশশো তেতাল্লিশ... উনিশশো চুয়াল্লিশ শহর থেকে শহর
বাংলাদেশে হারিয়ে যাই বাংলা দেশ ছাড়াই। ..."
বস্ত্র সংকটকে নিয়ে লেখা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'দু:শাসন' গল্পটি শুরু হয় এই কাতর প্রার্থনা দিয়ে। প্রথম লাইনেই তাই বলা হয়--"অনেকক্ষণ ধরে তীর্থের কাকের মতো বসে আছে লোকটা। সুতরাং অভিনয় পর্বটা তাড়াতাড়ি শেষ করাই ভালো।" লোকটি হাউ হাউ করে কেঁদে পড়ে। সজল চোখে বলে--"আর তো মান ইজ্জত থাকে না বাবু। একটা ব্যবস্থা না করলে--'' ব্যবস্থা! ব্যবস্থা! খানিকটা অন্যমনস্কের মতো দেবীদাস বাইরে তাঁকিয়ে থাকে। এখানে পরোক্ষ ইঙ্গিতধর্মিতার মাধ্যমে চিনিয়ে দেওয়া হয় গল্পের মূল সমস্যাপটটিকে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেবীদাস দেখে--''ছোট নদীর খেয়া পার হয়েই ধুলোয় ভরা পথটা হারিয়ে গেছে ধূ ধূ করা দিকচিহ্নহীন মাঠের ভেতর, প্রখর সূর্যের আলোয় নিজেকে মেলে দিয়েছে নগ্ন অনাবৃত পৃথিবী। এক সারি বন ঝাউএর গাছ হাওয়ায় যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে।" বাইরের রিক্ত পাণ্ডুর নিরুদ্দেশ পথের হারিয়ে যাওয়া, কোথাও যেন বর্তমান দেশ কাল সমাজের মানুষের দুর্গতির দ্যোতক। পৃথিবীর প্রখর সূর্যের আলোয় নিজেকে নগ্ন অনাবৃত করে মেলে ধরাও, মানুষের আবরণহীনতাকে মনে করায়। পৃথিবীর দুটি বিশেষণ এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। 'নগ্ন' এবং 'অনাবৃত'। বারে বারেই প্রকৃতির রুক্ষ, পাণ্ডুরতার প্রসঙ্গ এসেছে গল্পে। একই ছবি যখন একাধিকবার গল্পে আসে, তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না কোথাও লেখকের মোটিফকে। "দেবীদাস খোলা জানলার পথে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল। রিক্তশ্রী পাণ্ডুর পৃথিবী, বৈশাখে রোদ যেন শ্যামলতার শেষ চিহ্নটুকু মুছে নিয়ে গেছে। জ্বলন্ত আকাশটার তলা দিয়ে উড়ে চলেছে 'সমকাল' পাখির ঝাঁক--পিপাসায় কাতর হয়ে কোনো সুদূর বিল কিংবা জলার সন্ধানেই চলেছে হয়তো...কোনখানে একটি মানুষ নেই--যেন শ্মশান।"
দেবীদাস ছোট গাঁয়ের বন্দরে কাপড়ের আড়তদার। খুচরো পাইকারী সবই চলে, আশপাশের আট দশখানা হাট তারই কৃপার ওপর নির্ভর করে থাকে; কিন্তু এবার সে অনুগ্রহের মুষ্টি দৃঢ়বদ্ধ করতে হয়েছে দেবীদাসকে। চালান নেই। যে মাল জোগাড় করা যায়, সরকারী দরে বিক্রি করতে গেলে পড়তায় পোষাবে না। তার চেয়ে গুদামে ডবল তালা দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকাটা বেশি লাভজনক। থানার লাল বাড়িটি দেবীদাসের বাড়ি থেকে বেশ দেখা যায়। ওটাকে রুক্ষ্ম মাটির বুক চেরা রক্তজবার মতো মনে হয় তার। থানার যাত্রাপালা হবে-- দু:শাসনের রক্তপান। সেই উপলক্ষ্যে দেবীদাসের কাছে থানার এল.সি কানাই দে পঞ্চাশ টাকা নিয়ে যায়। দেবীদাস অবাক হওয়ায় সে বলে-- "আলবৎ। সমুদ্র থেকে এক আঁজলা। দারোগা শচীকান্ত বলে দিয়েছেন।" পঞ্চাশ টাকার মায়া ভুলতে পারে না সে। এদিকে থানাকে চটালেও চলবে না। নইলে ব্যবসা টিঁকবে না। অগত্যা যেতে হয় দেবীদাসকে। ভাইপো গৌরদাসকে সঙ্গে নিয়ে। রাত জেগে মুচিপাড়ার ভেতর দিয়ে ফিরতে গিয়ে আধা আলো অন্ধকার তারা দেখে ঘাটের দিক থেকে একটি ষোড়শী মেয়ে জল নিয়ে আসছে। মানুষের গলা পেয়েই বিদ্যুৎগতিতে কোথায় মিলিয়ে গেল। সম্পূর্ণ উলঙ্গ নগ্ন মেয়েটি। "যুগের দু:শাসন নির্লজ্জ পাশব হাতে বস্ত্র হরণ করছে তার, তার সমস্ত লজ্জা, সমস্ত মর্যাদাকে নিষ্ঠুর উপহাসে মেলে দিয়েছে লোলুপ পৃথিবীর সামনে।" গৌরদাস ভাবে--"যে দু:শাসন বাংলাকে বিবস্ত্র করেছে তারও কি প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে এক দিন? তাকেও কি রক্ত দিতে হবে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে?"
এরপর অদ্ভুত একটি চিত্র দেখতে পায় দেবীদাস। ফসলহীন রিক্ত মাঠের ওপর দিয়ে একদল কাজ করতে চলেছে--"তাদের ধারালো হেঁসোগুলোতে সূর্যের আলো ঝিকিয়ে উঠছে। অকারণে--অত্যন্ত অকারণে বড় বেশি ভয় করতে লাগল গৌরদাসের। অমন ঝকঝকে করে কেন হেঁসোতে শান দেয় ওরা?" গৌরদাসেদের মতো দু:শাসনদের বিরুদ্ধে কোনো সম্মিলিত প্রতিরোধের আগুন এখনও জ্বলে ওঠে নি। কিন্তু যে কোনো সময় জ্বলে উঠতে পারে, এমনই একটি অকারণ, অনাবশ্যক ভয় নয়, বরং অত্যন্ত সংগত একটি ভীতি কাজ করে গৌরদাসের মনে। বিদ্রোহের একটি সম্ভাবনার সূত্রকে জাগিয়ে রেখে গল্পটি শেষ হয়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'শিল্পী' বস্ত্র-সংকট নিয়ে লেখা গল্পগুলির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের পর কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে তিনি খোলামেলা ভাবে যুক্ত হন। ফলে এই পর্যায়ের গল্পগুলির মধ্যে নিম্নবর্গের মানুষের জীবন, বেঁচে থাকার লড়াই এবং সংঘবদ্ধ শ্রেণিসংগ্রামের চিত্রটি তিনি দেখিয়েছেন শিল্পকুশলতার সঙ্গে।
তাঁতিপাড়ায় আজ সাতদিন হল টানা উপোস। তাঁত বন্ধ। তাঁতিরা সরাসরি সুতো কিনতে পারছে না। সুতোর অভাব? না মধ্যস্বত্ত্বভোগী মহাজনের কারসাজি? মিহিরবাবু মহাজন। ভুবন মিহিরবাবুর হয়ে তাঁতিপাড়ায় ঘুরঘুর করে। তাঁতিদের সম্মিলিত প্রতিরোধ ভেঙে দেবার জন্য। মদন তাঁতি হল প্রকৃত শিল্পী। পেট চালানোর জন্য সস্তার ধুতি শাড়ি গামছা সে নিজেও বোনে না। অন্যদের কথা দেয় বুনবে না। কথাটার মানে সে প্রথম বোঝে নি। পরে বুঝেছে--মদন যেদিন গামছা বুনবে আর সূর্য যেদিন পশ্চিমে উঠবে কোথাও সমার্থক। রাত দুপুরে ঘটাঘট তাঁত চালাবার শব্দ শুনে চমকে ওঠে সকলে। মদন কি শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল ভুবনের করে দেওয়া বন্দোবস্তে? ঘরে উপবাস, বউটি পোয়াতি এসব কি শেষ পর্যন্ত টলিয়ে দিল তাঁকে? পরদিন সকলে উপস্থিত হয় মদনের ঘরের সামনে। বুড়ো ভোলা শুধোয়--ভুবনের কাছে সুতো নিয়ে তাঁত চালিয়েছে নাকি মদন চুপিচুপি? মদন সকলকে এসে দেখায়--খালি তাঁত। তাঁত না চালিয়ে খিঁচ ধরেছিল পায়ে হাতে। তাই খালি তাঁত চালিয়েছে মদন। "বেইমানি করব তোমাদের সাথে কথা দিয়ে? মদন তাঁতী যেদিন কথার খেলাপ করবে--মদন হঠাৎ থেমে যায়।"
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বস্ত্র সংকট নিয়ে লেখা গল্পগুলির মধ্যে যার আলোচনা না করলে মনে হয় কোথাও অসম্পূর্ণতা থেকে যাবে, তা হল তাঁর 'আজ কাল পরশু' গল্প সংকলনের অন্তর্গত 'দু:শাসনীয়' গল্পটি। গল্পটিতে লেখক স্পষ্টতই শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের গ্রামবাংলা সম্পর্কে সচেতনতাকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। শহুরে শিক্ষিত কিছু মানুষ যাদের ড্রইং রুমে বসে দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার কথা ভেবে ভেবে চিন্তায় কপাল ছিঁড়ে যাচ্ছে, তাদের কোথাও তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ করেছেন। হাতিপুর গ্রামের দুর্ভিক্ষের চিত্র আঁকতে গিয়ে কিছু পরিস্থিতিকে এমন অকপট বাস্তবতার সঙ্গে তুলে আনেন লেখক, যে তা হয়ে ওঠে সমকালীন গ্রামবাংলার বিশ্বস্ত দলিল। সেখানে বস্ত্র সংকটের বাস্তব প্রেক্ষিত ফুটে উঠেছে। ভোলা নন্দী, তার কোমরের ঘুনসীর সঙ্গে দু আঙুল চওড়া পট্টি বেঁধে তার পাঁচ হাত ধুতি মেয়েদের দান করেছে। একটি মাত্র কাপড় একবার পরে একে একে বাইরে যায়। "কাপড়খানা যে কোনো গতরের স্ত্রী লোকের কোমরে একপাক ঘুরে বুকে ঢেকে কাঁধ পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে। কাঁধে সর্বক্ষণ অবশ্য ধরে রাখতে হয় হাত দিয়ে, নইলে বিপদ।" আর কতকাল মেয়েরা উলঙ্গ হয়ে ঘরে কয়েদ হয়ে থাকবে? মাথা খোঁটে তারা। হু হু করে কেঁদে ওঠে।
ভুতির ছেলে কানুর বয়স বারো। ভুতির স্বামী গদাধর কাজ আর কাপড়ের খোঁজে বেরিয়েছে আজ এগারো দিন। খিদেয় কাতর কানু ভুতির কয়েদ খানার বাইরে থেকে ভাত চায়। ছেলের সামনে উলঙ্গ হয়ে বেরোবে কি করে ভুতি? শিকেতে পান্তা ঝোলানা রয়েছে। ছেলে তাতে হাত পায় না। অগত্যা ছেঁড়া মাদুরটা চোখে পড়ে ভুতির, সেটিকে একহাতে জড়িয়ে অন্যহাত দিয়ে আগল খুলে বাইরে বেরিয়ে শিকে থেকে হাঁড়িটা এক হাতে নামাতে গিয়ে মাটিতে পড়ে ভাত সমেত মাটির হাঁড়ি চুরমার হয়ে যায়। মেঝেতে ছড়ানো ভাতের মাঝেই থপ করে বসে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
রাবেয়া তাঁর স্বামী আনোয়ারকে বলে দিয়েছে--আজই শেষ, আজ যদি তাঁর স্বামী কাপড় না আনে তবে পুকুরে ডুবে মরবে। বলাবাহুল্য আনোয়ার আনতে পারে না কাপড় তার জন্য। দিন কয়েক ধরেই রাবেয়ার বিবর্ণ মুখ, রুক্ষ চুল ও উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি দেখে আনোয়ারের বুক কেঁপে উঠেছিল। দুর্ভিক্ষের দিনে খেতে দিতে না পারার দোষও গ্রাহ্য করেনি। শাকপাতা তুলে খেয়েছে। কিন্তু পরতে দিতে না পারার দোষ সইতে সে নারাজ। দিনের পর দিন ফুঁসেছে, গঞ্জনা দিয়েছে। কিন্তু আনোয়ার শেষ পর্যন্ত কাপড় আনতে পারে নি, সেই দু:সংবাদটি দেয়। আগেই জেনেছে রাবেয়া। অদ্ভুত নির্লিপ্তি আসে রাবেয়ার। শান্ত হয়ে আনোয়ারের সঙ্গে কথা বলে। পায়খানার ছেঁড়া চটের পর্দাটা গা থেকে খুলে ছুড়ে দেয় উঠোনে। গা ঘিন ঘিন করে বড্ড। আনোয়ারের ভয় হয়। শেষ বাক্যটিতে এক তীব্র শ্লেষ এর মধ্য দিয়ে গল্পটির সমাপ্তি টানেন লেখক।--
"কাপড় যে দিতে পারে না এমন মরদের পাশে শোবে না বলে রাবেয়া একটা বস্তায় কতকগুলি পাথর ভরে মাথাটা ভেতরে ঢুকিয়ে গলায় মুখটা দড়ি জড়িয়ে এঁটে বেঁধে পুকুরের জলের নীচে, পাঁকে গিয়ে শুয়ে রইল"।
আমরা যে তিনজন লেখকের তিনটি গল্প নিয়ে আলোচনা করলাম, তাতে বিষয়গত মিল থাকলেও লেখকদের নিজস্ব জীবনদৃষ্টি এবং প্রকাশভঙ্গি ফুটে উঠেছে। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের 'আবরণ' গল্পে সংকটের কারুণ্য প্রকাশ পেয়েছে। হতাশা দুর্দশাও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সেই সমস্যাপট থেকে উত্তরণের কোনো আভাস পাই না, যেমনটি পাই আমরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'শিল্পী' গল্পে। 'দু:শাসনীয়' গল্পেও রাবেয়ার প্রতিবাদ তীব্রতা পেয়েছে। সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের আভাস ফুটে উঠেছে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে, যেমন শোষিতের প্রাণের ভেতর লুকিয়ে থাকা পাপবোধ জনিত ভয় গল্পের শেষ লাইনে প্রকাশ পেয়েছে ('এমন ঝকঝকে করে হেঁসোতে শান দেয় কেন ওরা?')।
কেন এমন হয়েছে? বলাই বাহুল্য কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ফলে মানিক যেভাবে প্রতিরোধের কথা শোনাবেন, নরেন্দ্রনাথ বা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সে ভাবে শোনাবেন না।
লেখকের কাল তাঁর লেখার মধ্যে 'গোচরে অগোচরে' ক্রিয়া করে চলে। বর্তমানের কোনো সামাজিক রাষ্ট্রনৈতিক আলোড়ন সমকালীন সংবেদনশীল স্রষ্টারা অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটি বড় প্রশ্ন থেকে যায়, যে সমসাময়িক ঘটনা-প্রবাহ যখন কালের নিয়মে মিলিয়ে যায়, তখন সেই সমস্ত ঘটনাপটে রচিত সাহিত্য কি আধুনিক পাঠক মনে সেই সংবেদন জাগিয়ে তুলতে পারে? নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কিছু লেখা, যেগুলিকে 'যুগ সাহিত্য' বলে উল্লেখ করেছেন জগদীশ ভট্টাচার্য, যেমন 'দু:শাসন', 'ভাঙা চশমা' ইত্যাদি, সেগুলি সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। বলেছেন--"সমসাময়িক ঘটনারাজি পাঠক সাধারণের মনে যে উদ্দীপন বিভাব রচনা করে চলে, ভবিষ্যৎ কালের পাঠকের কাছে যখন তার কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকবে না, তখন বিভাব, অনুভাব স্থায়ীভাবের মিশ্রণে যে শিল্প রসায়ন তাতে কোনো উপাদানের অভাব হবে নাত? তাছাড়া প্রত্যেক যুগেই কতকগুলো সঞ্চারীভাবের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। যুগোত্তীর্ণ পাঠকের মনে তাদের আবেদন শিথিল হওয়াই স্বাভাবিক।" আমাদের আলোচ্য তিনটি গল্পেরই মূল সমস্যাপট বস্ত্র সংকট। আজকের পাঠকের কাছে সেই যুগ সেই সময় ইতিহাস। তবুও 'আবরণ' গল্পের বংশীর বারবণিতার কাপড় ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা এবং উলঙ্গ নারীদেহের ক্ষতবিক্ষত বিকৃত বীভৎসতা সেই কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়ার মধ্যে কোথাও তার অসহায়তা জীবনের আন্প্রেডিকটিবিলিটিকেই চিহ্নিত করে। এই অনিশ্চয়তার চেতনা তো চিরকালীন। তা যে কোনো কারণেই হোক। রাবেয়ার পুকুরের পাঁকে গিয়ে শুয়ে থাকার অভিমান, কিংবা মদনের নিশুতি রাতে তাঁত চালানোর মধ্যে মানুষের জীবনযাপনের সংগ্রামই দ্যোতিত হয়। রাবেয়া সেই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারে নি। জীবনযুদ্ধে হার মেনেছে। আর মদন? সে আর বলতে? 'মদন যেদিন গামছা বুনবে।'