“We are living in a graveyard of sorts”—নতুন উপন্যাস প্রসঙ্গে অরুন্ধতী রায়ের মন্তব্যে মনে পড়ে যায় সেই কবিতা: “অন্ধকারে কাঁদিছে উর্বশী / কান পেতে শোন বন্ধু/ শ্মশান-চারিণী মৃত্যু-অভিসারিকার গান ...” (দিবারাত্রির কাব্য/মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)। Ministry of Utmost Happiness-এ যেন উপমহাদেশটি জুড়ে ছড়িয়ে থাকা “ফাটলরেখা” (fault lines)-গুলি পায়ে পায়ে মাড়িয়ে চলা, যে ফাটল আজ আর কোনও বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলে সীমিত নয়, বিশ্ব জুড়ে। এ কোন অদ্ভুত কালের যাত্রায় ভেসে চলেছি আমরা! বিংশ শতাব্দী জুড়ে যুদ্ধ, ধ্বংসের পর শান্তি আর সংহতির সমস্ত চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে নতুন শতাব্দীতে এ কোন হতশ্রী পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আজ! খাদ্য, আশ্রয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা—গণতন্ত্রের এইসব প্রাথমিক প্রতিশ্রুতিগুলি থেকে আজও কত, কত দূরে বৃহত্তর সমাজ।
সদ্য পার হয়ে আসা ২০১৭ সালটিই তো ছিল রুশ বিপ্লবের শতবার্ষিকী, ভুলভ্রান্তি নিয়েও সমাজতন্ত্রের পথে প্রথম জোরালো পদক্ষেপ। আবার সেই বছরেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর বহু আলোচিত প্রবন্ধ ‘Nationalism’। যে রচনায় কবি ঘোষণা করতে দ্বিধা করেননি যে উগ্র জাতীয়তাবোধের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সাম্রাজ্যবাদের বীজ। আর আজ এতদিন পরে বিশ্বজুড়ে নতুন করে স্বৈরাচার, হিংসা যখন গুলিয়ে দিচ্ছে সভ্য জগতের তথা ইতিহাসের সব হিসেবনিকেশ, তখন কার দ্বারস্থ হব আমরা, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া? তারই সঙ্গে প্রত্যেক দিন যেন নতুন করে বড় বেশী প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে W.E.B. Du Bois, Paulo Freire-র মতো শিক্ষাবিদদের, যাঁরা পথ দেখিয়েছিলেন কেমন করে শিক্ষা-পদ্ধতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাঠামোয় গেঁথে নিতে হয় ‘স্বৈরাচার-বিরোধী’ মন্ত্র, “কর্ণের কবচ-কুণ্ডলের মতো”—কারণ শিক্ষাই শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের প্রাণভূমি। ইতিহাসও বারবার প্রমাণ করেছে এর সত্যতা। যে কোনও সামাজিক, রাজনৈতিক বিভ্রান্তির মুহূর্তে শিক্ষাভাবনার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক চিন্তাই সাহায্য করেছে এলোমেলো হয়ে যাওয়া মানবিক মূল্যবোধগুলিকে যাচাই করে সমাজকে সঠিক কক্ষপথে পৌছে দিতে; সীমিত অর্থে হলেও গণতন্ত্র এগিয়েছে।
আসলে, যে কোনও সামাজিক চিন্তা-ভাবনার একটা নির্দিষ্ট ফল থাকেই। শিক্ষাপদ্ধতি, পাঠক্রমের ক্ষেত্রেও তা সত্য। গণতন্ত্রের সুস্থতার সঙ্গে এর সম্পর্ক বড়ই নিবিড়। তাই প্রথমেই যে প্রশ্ন মনে আসে তা হল শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যে কী, ছাত্রেরা স্কুলে গিয়ে কী শিখবে। এ প্রশ্নের সহজ উত্তর চমত্কার ভাবে ধরা পড়ে প্রচলিত ছড়ায়: “লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে”। শিক্ষা তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে মানুষের এই সহজ, স্বাভাবিক প্রত্যশাটিকে অস্বীকার করার উপায় নেই ঠিকই; কিন্তু, গোটা সমাজ, বিশেষ করে মূল শিক্ষাব্যবস্থা যখন একলব্যের প্রতিজ্ঞায় কেবল মাত্র এই লক্ষ্যেই মেতে ওঠে, তখন সমাজ জুড়ে দেখা দেয় এক চূড়ান্ত ভারসাম্য-হীনতা। ঠিক যেমনটি ঘটছে আজ। যে বিশ্ব অর্থনীতির সংকটে আমরা সবাই বিচলিত তা কি এই সমস্যারই ফল নয়? অনেক গভীরে অন্ত:সলীলার মত বয়ে চলেছে যে সংকট সে সম্পর্কে জনসমাজ এখনো তেমন সচেতন নয়। বিশ্বজুড়ে শিক্ষাক্ষেত্রের এই নিদারুণ সংকটের কথা বলছেন কিছু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবিরা বেশ কিছুদিন ধরে, যা গণতান্ত্রিক কাঠামোকেই বিপন্ন করে তুলছে। সমস্ত দেশ/সমাজ মরিয়া হয়ে উঠেছে আর্থিক মুনাফার লক্ষ্যে। কেবল ব্যক্তিমানুষই নয়, গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের সামনে একটিই লক্ষ্য--জাতীয় মুনাফা। বলাই বাহুল্য সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রনীতিরও ঝোঁক জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে এমন করে গড়ে তোলা যা কেবল সেই উদ্দেশ্যকে সফল করতে উপযোগী। মানবিক দায় সম্পর্কে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত, আধুনিক অর্থনীতির নয়া উদারনৈতিক মন্ত্রে মুগ্ধ কর্পোরেট-মুখী অসাড় রাষ্ট্রনীতির চোরাবালিতে যেন তলিয়ে যাচ্ছে সব সুস্থ ভাবনা। চরম অদূরদর্শিতায় শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারী-বেসরকারী অনুদান মূলত নিয়োজিত কারিগরি প্রশিক্ষনে। ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, দর্শনচর্চা মনে করা হচ্ছে নেহাতই অপ্রয়োজনীয়। অথচ মুক্ত চিন্তা, ইতিহাসকে জানা, বোঝা, পাশের মানুষের ব্যথায় সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করা, এমন কী যে প্রযুক্তিবিদ্যা অর্জন করছি তার প্রয়োগ কিংবা অপপ্রয়োগ সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা—এ সব কিছুই শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। আর এই বোধকে ধরে রাখতে পারা না পারার ওপরই নির্ভর করছে মানবসমাজের সুস্থতা ।
রবীন্দ্রনাথ, Du Bois এবং Paulo Freire কাজ করেছেন বিভিন্ন ভৌগোলিক অবস্থানে, ভিন্ন কাল সমাজে, নিপীড়ন ব্যবস্থার আড়ালে। তাই মডেলগুলির কিছু চরিত্রগত বৈশিষ্ট থাকতে বাধ্য। বলাই বাহুল্য, তা সত্ত্বেও তাঁদের নিরীক্ষার মূল দর্শনে ছিল অনিবার্য মিল: “Education should be as broad as humanity itself.” রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রবীন্দ্র-গবেষক মার্টিন কেম্পশেন যে কথা বলেছেন তা এঁদের সকলেরই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য: এঁদের সকলেরই “প্রথম আনুগত্য মানুষের ব্যক্তিসত্তা নামক এক পরম অস্তিত্বের কাছে। কোনো রাষ্ট্রশক্তির কাছে নয়।” তাই এ বিষয়ে আলোচনা আজকের দেউলিয়া শিক্ষাভাবনার আবহাওয়ায় সামান্য সুস্থ বিতর্ক ফেরাবার তাড়া থেকে।
WEB Du Bois এবং আমেরিকান গণতান্ত্রিক শিক্ষাভাবনার ভিত্তি:
“[American Negro] would not bleach his Negro soul in a flood of white Americanism, for he knows that Negro blood has a message for the world”—W.E.B. Du Bois, ‘The Souls of Black Folk’
আমেরিকার তথা পশ্চিমী গণতন্ত্রের কাঠামোর মূল contradiction সম্পর্কে Du Bois বলেছিলেন: “Europe and America have given us the beginnings of democracy, although with strange inconsistency they have tried to hem democracy in with a colour bar.” এ কথা Du Bois লিখছেন তাঁর “Asia and Africa” রচনায়, প্রকাশিত হয়েছিল The Golden Book of Tagore-এ, রবীন্দ্রনাথের ৭০ বছরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে পাঠিয়েছিলেন রচনাটি। ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের কলমের খোঁচায় দাসপ্রথার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তিতে আফ্রিকান-আমেরিকান মানুষ রাতারাতি ‘দাস’ থেকে ‘নাগরিক’ হয়ে উঠলেন। গোটা সমাজের সামনে তখন এক মস্ত চ্যালেঞ্জ: শিক্ষা থেকে বঞ্চিত মানুষ/সমাজ তার নাগরিক অধিকার আয়ত্বের এবং দায়িত্বের দায় বহন করবে কেমন করে? Du Bois একেই চিহ্নিত করলেন “The Negro Problem” বলে, আর সেই প্রশ্নই হয়ে দাঁড়াল আমেরিকান গণতন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি। সমস্ত নৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রশ্নগুলি জড়িয়ে গিয়েছিল ওই একটি উক্তিতে। “রেস” সম্পর্কে প্রচলিত ধারণায় যে “কোপারনিকান” তোলপাড় ঘটে গেল সেই পুনর্মূল্যায়নের দাবীর মুখে মূলস্রোত “সাদা” সমাজই বা নিজেকে পুনর্গঠন করবে কেমন করে। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে দাঁড়িয়েই W.E.B. Du Bois-র কালজয়ী ঘোষণা: “[The] problem of the Twentieth Century is the problem of the color line.' আর বললেন: সদ্যোমুক্ত “কালোমানুষ”-এর বিশেষ সামাজিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত চৈতন্যই গড়ে তুলবে আমেরিকান গণতন্ত্রের ভিত—এক কথায় “কালো” মানুষের অবদান। আর “সমাজের বোঝা” নয়, বরং অনিশ্চিত দরিয়ায় সেই তখন কাণ্ডারী। সুস্থ লেনদেনের মধ্যে দিয়েই আমেরিকান সমাজ উত্তীর্ণ হবে পরিণত গণতন্ত্রে—এই বিশ্বাসই ছিল মানুষটির দীর্ঘ ৯৫ বছরের জীবনের অঙ্গীকার। বুঝেছিলেন সেই যাত্রার সার্থকতার বিজয়রথে সারথীর চাই একটিই অস্ত্র: শিক্ষা। শুরু হল চিন্তাভাবনা। কোন মন্ত্রে গাঁথা হবে সেই পুনর্গঠনের পাঠক্রম? Du Bois ঘোষণা করলেন: ফিরে যাও সেই আদি প্রশ্নে। খুঁজে বার কর জীবনের সত্যকে, তার গোপন সৌন্দর্যকে, মানব অস্তিত্বের সংকট, বিস্ময়, রহস্যকে সেই প্রাচীনতম পাঠ্যসূচীকে সামনে রেখে: “[that] was laid before the Pharaohs, that was taught in the groves by Plato, that formed the trivium and quadrivium, and today it’s laid before the ‘freedmen’s sons’… বললেন: “…the true college will ever have one goal-- not to earn meat, but to know the end and aim of that life that meat nourishes.” (Du Bois) অর্থাত্, কোনও সংক্ষিপ্ত গলিপথে পৌছন যাবে না ঈপ্সিত লক্ষ্যে। শিক্ষার ভূমিকা সম্পর্কে Du Bois-র দূরদর্শিতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁরই সমসাময়িক আরেকজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ Booker T. Washington-এর সঙ্গে বিতর্কের মধ্যে দিয়ে। গৃহযুদ্ধ পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রে তখন ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোর গোড়াপত্তন চলেছে জোর কদমে। Washington বুঝেছিলেন এই নতুন অর্থনীতিতে ‘সাদা’ সমাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলার জন্য আয়ত্ত্ব করতে হবে মূলত কারিগরি প্রশিক্ষণ যা কলকারখানায় কাজের সুযোগ এনে দেবে। Booker T. Washington-এর মতে “The opportunity to earn a dollar in a factory just now is worth infinitely more than the opportunity to spend a dollar in an opera-house.” তাঁর মতে ‘কালো’ মানুষের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্র থেকে সরে দাঁড়ানই সমীচিন, প্রয়োজনে ‘সাদা’ আর ‘কালো’ মানুষের সামাজিক মেলামেশার প্রশ্নটিকে দূরে রেখে । ইতিহাস সাক্ষী ‘আফ্রিকান আমেরিকান’ সমাজ দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিল, আজও আঁকড়ে ধরে রয়েছে Du Bois-র নির্দেশিত পথ—কোনও খণ্ডিত লক্ষ্যকে সামনে রেখে নয়, বরং মানুষ হিসেবে পূর্ণ বিকাশের দৃঢ় আকাংখায়। তারই ফল হিসেবে আমরা পেয়েছি “হারলেম রেনেসাঁ”-র মতো সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যা কেবল ‘কালো আমেরিকা’ নয়, গোটা সমাজকে সমৃদ্ধ করেছে। ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে ষাটের দশকের সিভিল রাইটস আন্দোলন। অনেক অভিমানে, হতাশায় যে মানুষটি নিজের দেশের মাটি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সুদূর আফ্রিকায় আজ সেই মাটিতেই নতুন করে ‘যেখানে নিখিলের সাধনা’-র আয়োজন শুরু হয়েছে সেই ‘পূজালোকে’ তাঁরই জ্বালানো ‘জ্যোতি রেখা’-টুকু ধরে-- “Black Lives Matter”-এর মত গণ-জাগরণ সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবোধের প্রাচীর ভেঙে প্রসারিত ‘প্যালেস্টাইন’ পর্যন্ত।
পাওলো ফ্রেয়েরী (Paulo Freire): স্বাধীনতা মানুষের প্রাথমিক জৈবিক বাসনা, “ontological need”—এ-কথা দ্বিধাহীন ভাবে ঘোষণা করেছিলেন ব্রাজিলের বিখ্যাত শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেয়েরী। ফ্রেয়েরীর এই গভীর উপলব্ধি আজকের ব্রাজিলের সামাজিক-রাজনৈতিক আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। স্বৈরাচারের নবীনতম দূতের ব্যভিচারের বিরুদ্ধে গোটা সমাজ আজ সংগঠিত, বিশেষ করে আদিবাসী গোষ্ঠী। ‘আমাজন’ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার মরণপণ লড়াই কেবল ব্রাজিল বা ল্যাটিন আমেরিকাকেই রক্ষা করবে না, গোটা পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্যের নিশ্চিত ধ্বংসকে সাময়িক ভাবে হলেও ব্যাহত করবে। প্রগতিশীল নেতা, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভা কারাগারের অন্তরালে থেকেও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছেন, নোম চমস্কির (Noam Chomsky) মতে আজকের আন্টোনিও গ্রামশ্চী (Antonio Gramsci)। তাই আজ আচার্য ফ্রেয়েরীকে স্মরণ না করে উপায় নেই। পাওলো ফ্রেয়েরী কাজ করেছিলেন ষাটের (এবং সত্তরের দশকে), যখন ব্রাজিল পর্তুগীজ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে বৃহত্ ভূস্বামীর শাসনাধীন। চূড়ান্ত দারিদ্র, সীমাহীন হতাশায় ডুবে থাকা সমাজকে তার হারানো মর্যাদাবোধ ফিরিয়ে দেওয়ার দায় কাঁধে তুলে নিতে হয় তাঁকে। সমাজ সংস্কারের দুটি পশ্চিমী ধারা--খৃষ্টীয় এবং মার্ক্সবাদের মানবিক আবেদনে জারিত ফ্রেয়েরীর মন। বুঝেছিলেন নয়া-ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণীর দমনের রাষ্ট্রনীতি দাঁড়িয়ে আছে একটি মস্ত ‘মীথ’-এর ওপর—অজ্ঞানতা গরীব কৃষক, শ্রমিকের মজ্জাগত। আর এই ‘মীথ’-কে ভাঙার একটিই পথ। এই দলিত মানুষের অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত জ্ঞানের আলোয় তার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে যুক্তি-বুদ্ধির সাহায্যে যাচাই করে দেখার সাহসটুকু জোগানো—ফ্রেয়েরী একেই বলেছেন “conscientization”। মার্ক্সের মতই তিনিও বিশ্বাস করতেন ইতিহাসের কেন্দ্রে শ্রেণী-সংঘাত নিয়ামক হিসেবে থাকবে। আবার, এ বিশ্বাস সত্ত্বেও কখনোই মনে করেননি বুর্জুয়া শ্রেণীর বদলে শ্রমিক শ্রেণীর দমনে/শাসনেই মানুষের মুক্তি। এক্ষেত্রে ফ্রেয়েরীর ভরসা খৃষ্টীয় ‘জন্ম-পুনর্জন্ম’-বাদের নিহিত তাত্পর্যে। দলিত কৃষক-শ্রমিক তার নিষ্ক্রিয় ভূমিকা ছেড়ে বেরিয়ে এসে নিজেকে নিয়োজিত করবে স্বাধীন চিন্তায়, সৃষ্টিশীল কাজে। আর, শাসক গোষ্ঠী তার বর্ম ছেড়ে বেরিয়ে এসে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তৈরী করবে “রক্তকরবী”-র সেই ‘ধ্বজা ভাঙার’ মুহূর্ত।
শিক্ষা কোনও সমাজ-ইতিহাস নিরপেক্ষ বিষয় নয়, সামাজিক-রাজনৈতিক হাতিয়ার--এ বিষয়ে মার্ক্সের মতই পাওলোর কোনও সন্দেহ ছিল না। আর সেই অস্ত্রকে স্বৈরাচারের মুখে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার কবচ হিসেবে কেমন করে ব্যবহার করা যায় এই ছিল মানুষটির সারাজীবনের লক্ষ্য। “The materialist doctrine that men are products of circumstances and upbringing, and that, therefore, changed men are products of other circumstances and changed upbringing, forgets that it is men who change circumstances and that it is essential to educate the educator himself.” (Marx, as quoted by Fishman and McCarthy)। Marx-এর থিওরিকে শিক্ষাক্ষেত্রে সরাসরি প্রয়োগে উদ্যোগী হলেন ফ্রেয়েরী। তাঁর মতে “Education must begin with the solution of the teacher-student contradiction by reconciling the poles of the contradiction so that both are simultaneously teachers and students.”—এই ঘোষণা ইস্কুল-কলেজের গতানুগতিক শিক্ষা পদ্ধতির অচলায়তনকে আমূলে ভেঙে ফেলার আহ্বান। অর্থাত্, শিক্ষককে তাঁর ‘বেদী’ থেকে নেমে শিক্ষার্থীর সহপাঠী হিসেবে বসতে হবে। গুরু-নির্দেশিত পথকে শিরোধার্য না করে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা (dialogue), মত বিনিময়ের মধ্যে দিয়েই খুঁজতে হবে সমস্যার সমাধান। শিক্ষক আর ছাত্র তখন সহযোদ্ধা, ‘কমরেড’। শিক্ষণ পদ্ধতিতেও এনেছিলেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ফ্রেয়েরীর ছাত্রদের একটি বড় অংশ ছিল পরিণত বয়স্ক কৃষক। এঁদের সাক্ষর করতে ব্যবহার করলেন এমন ‘phonics’ বা ধ্বনি-শব্দ যা তাঁদেরই প্রত্যেকদিনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা, যেমন favela (বস্তি), trabalho (শ্রম), requeza (ধন)। শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে জুড়ে গেল বাস্তব জীবন। কোনকিছু আর আলগা রইল না। মাত্র ৪৫ দিনের মধ্যে নিরক্ষর কৃষক হয়ে উঠল সচেতন নাগরিক।
রবীন্দ্রনাথ: “মরিলো, মরি সখী/আমায় বাঁশীতে ডেকেছে কে...”**— গানটির সূত্র নাকি মনের মধ্যে “বিশ্বভারতী” গড়ার ডাক। যেমন ভাবনা তেমনি কাজ—গোটা ‘বিশ্ব’-কে এক আঙিনায় হাজির করার যাবতীয় উদ্যোগে মেতে উঠলেন কবি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম দিলেন ‘বিশ্বভারতী”--“যত্র বিশ্বঙ ভবতী এক নীড়ম”—এ হেন “mission statement”-এর চেয়ে বড় anti-fascist মন্ত্র আর কীই বা থাকতে পারে! ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বিদেশী শক্তি সরে গেলেই পরতন্ত্রের হাত থেকে রেহাই মিলবে দেশবাসীর এমন কোনও আস্থা ছিল না রবীন্দ্রনাথের। স্বৈরাচার স্বদেশী মুখোশেও হানা দিতে পারে (কী নিদারুণ সেই সত্যের মুখোমুখি আজ আমরা)! তাই ক্ষমতার হাত বদলের রাজনীতি থেকে সরে স্বদেশ গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন কবি। বলাই বাহুল্য, মূলস্রোত নেতৃত্বের কাছ থেকে সাড়া মেলে নি। তাদের দাবী “আগে চাই রাষ্ট্রক্ষমতার দখল, তার প্রয়োগে দেশের উন্নতি। রবীন্দ্রনাথের বিবেচনা অন্যরকম। স্বদেশী সমাজের নির্মাণ ঐক্যবদ্ধ কর্মপ্রচেষ্টা আর স্বাবলম্বনের অনুশীলনেই সম্ভব হবে স্বাধীনতার পক্ষে অপরিহার্য জনবল ও আত্মসক্তি” (অশোক সেন, ৪৩)। স্বদেশ গঠনের নানা উদ্যোগের সঙ্গেই অবশ্যম্ভাবী ভাবে রবীন্দ্রনাথকে ভাবতে হয়েছিল শিক্ষা বিষয়ে। রবীন্দ্র-পাঠক মাত্রই জানেন যে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা/প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তাঁর গভীর উদ্বেগের শুরু একেবারে শৈশবেই। ইংরেজ আমলের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর গভীর অনাস্থা প্রকাশে কবি দ্বিধা করেন নি: “ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এই কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়, মাস্টারেরও মুখ চলিতে থাকে। চারটের সময় কারখানা বন্ধ হয়, মাস্টার-কলও তখন মুখ বন্ধ করেন, ছাত্ররা দুই-চার পাত কলে ছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তার পর পরীক্ষার সময় এই বিদ্যার যাচাই হইয়া তাহার উপরে মার্কা পড়িয়া যায়। কলের একটা সুবিধা, ঠিক মাপে ঠিক ফরমাশ-দেওয়া জিনিসটা পাওয়া যায়—এক কলের সঙ্গে আর-এক কলের উৎপন্ন সামগ্রীর বড়ো-একটা তফাত থাকে না, মার্কা দিবার সুবিধা হয়। কিন্তু এক মানুষের সঙ্গে আর-এক মানুষের অনেক তফাত। এমন-কি, একই মানুষের একদিনের সঙ্গে আর-একদিনের ইতর-বিশেষ ঘটে। তবু মানুষের কাছ হইতে মানুষ যাহা পায় কলের কাছ হইতে তাহা পাইতে পারে না। কল সম্মুখে উপস্থিত করে কিন্তু দান করে না—তাহা তেল দিতে পারে কিন্তু আলো জ্বালাইবার সাধ্য তাহার নাই।” (‘শিক্ষা সমস্যা’)। সৃজনশীলতা, মুক্ত চিন্তা আর সামাজিক দায়বোধ—এই ছিল রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা-দর্শনের মূল কথা। প্রত্যেক ব্যক্তি, বিশেষ করে শিশুর মনেই থাকে সৃজনশীল ক্ষমতার সম্ভাবনা। কবির মতে সেই সুপ্ত বীজটির পূর্ণ বিকাশের জন্য চাই উপযুক্ত পরিবেশ—প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য। শিক্ষার আরেকটি অন্যতম দিক হল স্বাধীন চিন্তার উন্মেষ। দার্শনিক মার্থা নাসবম (Martha Nussbaum) মহাত্মা গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য আলোচনায় যে ছোট্ট ঘটনাটি উল্লেখ করেন সেটি এক্ষেত্রে নেহাতই প্রাসঙ্গিক : “[when] Gandhi visited Santiniketan and wrote in the guest book a statement about the importance of sticking to one’s commitments, Tagore added a critical postscript saying that one should always keep an open mind and change if one discovers a better way. I like the idea of a democracy that retains a prominent place for critical freedom.”
সৃজনী-শক্তির বিকাশ, মুক্ত চিন্তার অনুশীলনের সঙ্গে আরেকটি বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তা হল জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ গণ্ডী পেরিয়ে বিশ্ব-নাগরিকত্বে উত্তরণ। যার অর্থ পারস্পরিক সহযোগিতা আর সহমর্মিতা, জাতি, ধর্ম ইত্যাদির বেড়া ভেঙে, বিশ্বের এক প্রান্তের মানুষের সঙ্গে অন্য প্রান্তের মানুষের তথা সংস্কৃতির যোগাযোগ, লেনদেনের ভিত্তিতে যে অখণ্ড মানব-সমাজ তার সম্পর্কে দায়বদ্ধতা। আর সেই কারণেই প্রাচীন ভারতের তপোবনের আদলে গড়ে উঠলেও কবির পাঠশালার মুখ প্রথম থেকেই ঘোরানো ছিল বহির্বিশ্বের দিকে। আর তারপরে সেই ছোট্ট ইস্কুলটিই ধীরে ধীরে পরিণত হল “বিশ্বভারতী” বিশ্ববিদ্যালয়ে--একাধারে ভারতীয়, প্রাচ্য এবং বিশ্ব সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে।
রবীন্দ্রনাথ, Du Bois, Paulo Frerie—তিনজনেই তাঁদের আদর্শকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এই আচার্যদের জীবন এবং কাজ যেন শেষ পর্যন্ত একটা symphony-র মত যার মূর্চ্ছনা গাঢ় তমসাকে ভেদ করে মানুষকে পৌঁছে দিতে চেয়েছে এমন এক মানব-মুক্তির লক্ষ্যে যেখানে দাঁড়িয়ে মানুষের ইতিহাসকে কেবল ‘সংঘাতের’ নিরীখে দেখা আর সম্ভব নয়।
ফিরে যাওয়া যাক অরুন্ধতী রায়ের উপন্যাসের প্রসঙ্গে, কাহিনীর শেষে, সেই কবরখানাতেই-- যেখানে হিংসা-বিধ্বস্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন কোণ থেকে পালিয়ে আসা ক্ষত জর্জরিত প্রান্তিক মানুষ এসে জড়ো হয়ে গড়ে তুলছে তাদের sanctuary—মূল প্রবক্তা অনজুম ওরফে আতাফ তৃতীয়-লিঙ্গের মানুষ, কেউ বা প্রাক্তন “কাশ্মীরি জঙ্গী”, অনাথ শিশু, ‘মুসলমান’ এমন কী কিছু পশু-পাখিও। এক কথায় “মহান ভারত” গড়ে ওঠার ‘প্রকল্প’-এ যারা ব্রাত্য। বলাই বাহুল্য, এই চরিত্রগুলিই যেন তাদের দেহে-মনে বহন করছে প্রতিরোধ স্বৈরাচারী রাষ্ট্র-শক্তির বিরুদ্ধে। তাই, আশা করতেই হবে যতই গাঢ় হোক না কেন ‘অন্ধকার’ শেষ পর্যন্ত এক প্রতীক্ষা।
যে বইগুলি এই প্রবন্ধটি রচনায় সাহায্য করেছে:
1. “Ethical Visions of Education”: Philosophies in Practice, Ed. By David D. Hansen, Teachers College Press, Columbia University, New York and London, 2007
2. “The Souls of Black Folks”: W.E.B. Du Bois, Gramercy Books, New York, 1994
3. “অনুভবে অনুধ্যানে রবীন্দ্রনাথ”: মার্টিন কেম্প্সেন, “কারিগর”, ২০১৬
4. “রাজনীতির পাঠক্রমে রবীন্দ্রনাথ”: অশোক সেন, “বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ”, ২০১৪
* প্রবন্ধটির শিরোনামের জন্যে অধ্যাপক অশোক সেন-এর কাছে আমি ঋণী।
** এই গল্পটি ফেসবুকে জানিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন প্রাক্তনী, সদ্যপ্রয়াত অধ্যাপক শিবদিত্য সেন। এটি তাঁর পিতামহ
শ্রী ক্ষিতিমোহন সেনের কাছে শোনা।