দ্বিতীয় যুদ্ধ পরবর্তী জার্মান কবিদের মধ্যে পাউল সেলনাকে সর্বোচ্চ স্থান দিতে চান কেউ কেউ। সমালোচক হামবার্গার বলেন আমরা যখন সেলান-এর কবিতায় মন:সংযোগ করতে যাই তখন পদে পদে কাঠিন্য আর প্যারাডক্সের মুখোমুখি হতে হয়। এদিক থেকে তিনি ফরাসী কবি মালার্মের সগোত্র, কিংবা গেয়র্গ ট্রাকল বা রেনে শার-এর সগোত্রীয়, যাঁরা সাধারণ পাঠকের কাছে cryptic, enigmatic, obscure বলে বিবেচিত হন। জর্জ স্টেইনার-ও টি.এল.এস.-এ আলোচনা করতে গিয়ে কবির মরণোত্তর কবিতা সম্পর্কে এমন কথাই বলেন। স্টেইনার-এর মতে পাঠ্যের নিহিতার্থ কোনো esoteric জ্ঞান নয়, কোনো বিশেষ দার্শনিক যুক্তি নির্ভরতা নয়। এখানে শব্দগুলো একেবারেই সোজা কিন্তু তার ব্যাখ্যান কষ্টকর। কবি কি চাইছেন না তাঁর কবিতা লোকে বুঝুক? এ যেন ভাষা নিয়ে নব্য এক বিদ্রোহ। স্টেইনার অবশ্য বলেন সেলান রিলকে অপেক্ষা বেশী অপরিহার্য। জে. এম. কোয়েটজি সেলান-অনুবাদকদের মনোভাব বিশ্লেষণ শেষে মন্তব্য করেন--সেলান বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী পর্যায়ের ইউরোপীয় কবিদের শীর্ষস্থানীয়দের অন্যতম, যিনি সময়কে না এড়িয়ে--সময় এড়ানোর কোনো বাসনা তাঁর ছিল না--acted as a lightning rod for their most terrible discharges. জার্মান ভাষা নিয়ে তাঁর অবিরাম, আপন ঘেঁষা মুষ্টিযুদ্ধ চালিয়ে গেছেন, যা তাঁর শেষ পর্যায়ের কবিতাতেও সরাসরি না হলেও অনুরণনময় হয়ে উঠেছিল। (Paul Celan and his translators--Inner Workings, Pg.131)
বাঙালির কাছে এই অল্পশ্রুত কবির জীবন-সিঁড়ির কয়েকটি কথা এখানে বলে নেওয়া যাক। সেলানের জন্ম (১৯২৩ খ্রি:) রুমানিয়ায়, ইহুদি পিতামাতার একমাত্র ছেলে, শিক্ষা শুরু ওখানেই। ১৯৩৮-এ এক বছর ঔষধ চর্চা, জেরনোওইজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রোমান্স ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন। ১৯৪২-এ তাঁর বাবা ও মাকে নির্বাসন শিবিরে নিয়ে শেষ করে ফেলা হয়, সেলান এক রুমানিয়ান শ্রমশিবিরে বেঁচে যান। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭-এ বুখারেস্ট-এ কাজ--সম্পাদক ও অনুবাদক হিসেবে। এ সময় ছদ্মনাম গ্রহণ। ১৯৪৮-এর গোড়ায় ভিয়েনাতে এবং এ-বছরের শেষটা কাটে পারি-তে। এ-সময় জার্মান সাহিত্য অধ্যয়ন, প্রথম কবিতার বই The Sand from the Urns বেরলো। বন্ধু হল বহুভাষিক পরাবাস্তববাদী কবি ইভান গল। ১৯৫০ থেকে কিছুকাল পারীর একোল নরমাল সুপেরিয়র-এ জার্মান সাহিত্যের অধ্যাপক। বিয়ে করলেন শিল্পী জিসেল চলসট্রাঁজে-কে, পিতা হলেন এক সন্তানের। পরের পনের বছর অনেকগুলি সম্মানজনক জার্মান সাহিত্য-পুরস্কার পেলেন, এ সময়টায় চোখে পড়ে তাঁর মানসিক অস্থিরতা এবং অবিশ্রাম সন্দিগ্ধতা। ১৯৬৯-এ ইজরায়েল ভ্রমণ, সেখানে এক নারীর প্রেমে পড়া। ফিরে এসে এক দুর্বোধ্য কারণে আত্মহত্যা সীন নদীর জলে। তাঁর খ্যাতি অর্জিত হয়েছিল শেকসপীয়র, র্যাঁবো, ভালেরি, ব্লক, ম্যান্ডেলস্টাম, উনগারোত্তি, ঝুল সুপেরভিই (Jules Supervielle), এসনিন আপোলিয়নের আঁরি মিশো, জ্যাঁ দাইভ, এমিলি ডি কিনসন, ম্যারিয়ান সুর এবং বুশে-র রচনা অনুবাদের জন্য। তাঁর কয়েকটি কবিতার বই পপি এবং স্মৃতি, আঙিনা থেকে আঙিনায়, ভাষার গ্রীল, না-কারো গোলা, শ্বাসচক্র, সুতোর সূর্যাবলি। অপমৃত্যুর পর বেরোয়-- আলোকচাপ, তুষার অংশ, কালের খামার। কবিতা শৈলীতে, বলা হচ্ছে সেলান মালার্মে বা ট্রাকল বা শার পন্থী, যাঁরা সবাই সাধারণ পাঠকদের কাছে সুবোধ্য নন। দার্শনিক গাদামার অবশ্য সেলান-এর দুর্বোধ্যতার সপক্ষে দাঁড়িয়ে বলেন--কোনো বুঝদার, মুক্তমনা, জার্মান সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত পাঠক এ কবিতা কোনো সাহায্য ছাড়াই বুঝতে পারবেন।
কবি হোল্ডারলিন হাইডেগার ও সেলান। এই দুজনের গঠনপর্বে প্রভাবসঞ্চারী। সেলান হাইডেগারের কবিতা বিষয়ক ধারণার, সত্যাশ্রয়িতার ব্যাপারটা পছন্দ করতেন। কবি বলেন--নিজেকে গড়েপিটে নিতে গিয়ে, কোথায় আমি ছিলাম, কোথায় আমি যেতে চাই, বাস্তবের রেখাচিত্র অঙ্কন গাদামার এর অন্বিষ্ট আমার--এ মন্তব্য পূর্বোক্ত দার্শনিকের ধারণার কাছাকাছি। হাইডেগার-এর জাতীয় সমাজতন্ত্রী অতীত এবং মৃত্যুশিবির সম্পর্কে নীরবতা সত্ত্বেও এই দার্শনিক সেলানের কবি জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৭-তে সেলান তাঁকে ডেকেছিলেন ব্ল্যাক ফরেস্টে তাঁর সাময়িক আস্তানায়। সমালোচক Lacoue-Labarthe তাঁর সেলান ও হাইডেগার বিষয়ক বইতে মন্তব্য করেন সেলান-এর কবিতা ‘in its entirety a dialogue with Heigegger’s thoughts.' (পৃ.৩৩) এই দৃষ্টিকোণ, যা ইউরোপে তৎকালে বড়ো হয়ে ওঠে, তা সেলানের কবিতাকে সাধারণ শিক্ষিত পাঠকের থেকে দূরেই রেখে দিয়েছিল। ইহুদি উত্তরাধিকার যা হাইডেগার-সন্নিবিষ্ট, তা মুছে ফেলতে সচেষ্ট আর এই পথে হাইডেগারকে উত্তর দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। হাইডেগার মনে করেন জীবন একান্তই সময়গত, এটাই মানব-মানসিকতা। প্রসঙ্গ আর আতঙ্ক মানব-ব্যক্তিত্বের নিয়ামক। স্পষ্ট দৃষ্ট বস্তুই একমাত্র সত্য এই বোধ থেকে হাইডেগার পৌঁছান বস্তুনিষ্ট আদর্শবাদে।
সেলানের ‘সময়ের চোখ’ কবিতাটির অংশ ‘এ হলো সময়ের চোখ/ ও চোখ ঠারে/ সাতরঙা ভুরুর নীচ থেকে’। জীবন হল- ‘বাধ্যতামূলক অনুবর্তনের/চলনাট্য’। (এবং নয় কোনো), কিংবা--‘যতক্ষণ আমরা জেগে থাকি/ ঘুমোলেই পার হই, চলে যাই/ করুণার ফটক অবধি’। (দুই মেরু)।
কোয়েৎজি বলেছেন ‘মৃত্যুসঙ্গীত’ বিংশশতাব্দীর অন্যতম স্মরণীয় কবিতা। যা জীবনানন্দের ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটি মনে করিয়ে দেয়। এ এক সংকট সময় যখন জার্মানি অশান্ত অস্থির অতীত ভুলতে চায় আর এক ইহুদি কবি জার্মানিকে স্মরণ করায় তার অতীত।
‘প্রত্যূষের কালো দুধ আমরা তাকে পান করি সন্ধ্যায়/ আমরা তাকে পান করি সকালে পান করি রাত্রে/ পান করি আর পান করি' এবং-- ‘বাড়ির ভেতরে বসত করে একজন সে কেউটে সাপ খেলে’ অথবা ‘আমরা তোমাকে পান করি দুপুরে মৃত্যু এক প্রভু/ জার্মানীর/.....মৃত্যু এক প্রভু জার্মানীর তার চোখ দুটো নীল', অথবা--‘সে কেউটে সাপ নিয়ে খেলে আর দিবাস্বপ্ন দেখে মৃত্যু এক প্রভু/ জার্মানীর....’।
‘কালো দুধ’ মৃত্যুযন্ত্রণার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, কেউটে সাপ দংশন উদ্যত জীবন য়ুরোপে, বিশেষত: ইহুদিদের ক্ষেত্রে। প্রতীকে কথা বলে যাচ্ছেন কবি তাঁর সমসময়ের ভয়াবহতা নিয়ে। অবশ্যই বাংলা কবিতার আবহ তার ধারে কাছেও যায় না।
একটা সময়ের জীবনানন্দ ও সেলানের কবিতা পাশাপাশি রাখা যাক।
ক) হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন/ পথের পাতার মতো তুমিও তখন / আমার বুকের পরে শুয়ে রবে? (জীবনানন্দ)
বাড়িতে বসত করে একজন তোমার সোনালি চুল মার্গারেট/ সে তার শ্বাপদগুলো ছেড়ে দেয়, আমাদের উপর সে আকাশে মঞ্জুর করে/ আমাদের জন্য কবর (সেলান)
খ) আমরা মৃত্যুর আগে কী বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা/ সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে/ ধূসর মৃত্যর মুখ (জীবনানন্দ)
মধুরতর সুরে সে ডাকে খেল্ মৃত্যু হলো প্রভু / জার্মানীর (সেলান)
বয়সের পত্রালি ধূসর, ধূসর নয় তোমার চুলগুলো (সেলান)
তুমি পিছে চাহো নাকো, তোমার অতীত নেই, স্মৃতি নেই/ বুকে নেই আকীর্ণ ধূসর (জীবনানন্দ)
পৃথিবীর সমস্ত ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখ ও সেই নক্ষত্রদের ভিতর দেখছি আমি (জীবনানন্দ)
‘হেমন্ত’ সেলান এবং জীবনানন্দ দুজনেরই লেখাতে আছে, যেমন আছে ‘মেঠো ইঁদুর’।
হাইডেগারের ‘ক্ষণস্থায়িত্ব’ জীবনানন্দে অবশ্য প্রাধান্য পায় নি। আত্মগত সত্তা, নিরন্তর মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া জীবনানন্দে অল্পকাল বজায়। Indeterminism যুদ্ধআবহে ইহুদি-জীবনে সেই পরিস্থিতি জীবনানন্দের বাংলায় ছিল না। প্রকৃতি অবশ্য জীবনানন্দ ও সেলান দুজনের লেখাতেই; শিশির, বাঁশ, গিরিমাটি, ফুল, চিনার, সেলানের কবিতায়, জীবনানন্দেও। পটভূমিকায় মৃত্যু সেলান-এ যেভাবে জীবনানন্দে তা কখনোই নয় তবে আছে। ব্রাহ্মমানসিকতা--সেটাও আর এক তফাৎ।
আগেই বলেছি পিতা ও মাতা বন্দীত্বে নিহত। সেলানের কবিতায় মায়ের জন্য আর্তি আভাসিত। যেমন--‘ঘরে ফিরতে পারবে না তো আমার মা’ (চিনার গাছ) কিম্বা--‘যার দিকে আমাকে নিয়ে গিয়ে ছিল এক মায়ের আজ্ঞা’ (একটি মোমবাতির সামনে)। ‘কফিন’ বা 'প্রভু' সম্বোধন যে অনুষঙ্গ বহন করে তা বাঙলা কবিতায় না থাকাই স্বাভাবিক।
১৯৬৭-তে ইজরায়েলি সৈন্যরা যখন জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করল তখন সেলান খুব আনন্দ পেয়েছিলেন।
অভিনন্দনীয় একটি কবিতা লিখলেন তিনি, যা বারংবার পড়া হত ইজরায়েলে। তার অংশ--
শুধু ভাবো একবার: তোমার১৯৬৯-এ সেবার প্রথমই সেলান গেলেন ইজরায়েল। শ্লেষ মিশ্রিত স্বরে তিনি বিস্ময় প্রকাশী উচ্চারণে বলেন--‘এতো ইহুদী মানুষ, শুধু ইহুদী আর তারা ঘেটো বন্দীত্বে নয়।’ সেলান সেখানে বক্তৃতা দেন, কবিতা পড়েন, ইজরায়েলি লেখকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন, সর্বোপরি তাঁর জেরনোউইজ দিনগুলোর পুরোনো বান্ধবীর সঙ্গে জড়িয়ে যান এক রোমান্টিক সম্পর্কায়নে। য়েহুদা আমি চাই, সেই বিখ্যাত ইজরায়েলি কবি যখন সেলানের কবিতা অনুবাদ অনুষ্ঠানে পড়েন তখন কবি সেলাই অনুবাদে কিছু কিছু সংশোধনের প্রস্তাব রাখেন।
নিজের হাত
ধরতে পেরেছে
এই বাসযোগ্য ধরিত্রীর
মাটির অংশ
যাতনা কাটিয়ে পুনর্বার
উঠে এসেছে জীবনে।
‘মৃত্যু সঙ্গীত’ সেলানের প্রথম প্রকাশিত বিখ্যাত কবিতা যা ১৯৪৪ বা ১৯৪৫-এর রচনা--পরাবাস্তব ঐতিহ্য থেকে উপকরণ প্রাপ্ত। কিছু কিছু অংশ সেলান তাঁর ঐতিহ্য থেকে পান। যেমন 'মৃত্যু হল প্রভু জার্মানীর’। কবিতাটির অভিঘাত ব্যাপক। জার্মানভাষী মহলে ব্যাপক পঠিত, সংকলন-কৃত, স্কুলে পাঠ্য, প্রোগ্রামে ব্যবহৃত। সেলানের কবিতা পাঠের আসরে এ কবিতা পাঠের অনুরোধ প্রায়ই আসত। এখানে নামোল্লেখ, নিন্দা যথেষ্ট প্রত্যক্ষ, মৃত্যু শিবিরের স্বাক্ষর সহজবোধ্য। তবে পাঠক পক্ষ থেকে এমন উচ্চারিত আগ্রহ কবির পছন্দ নয়। কোনো কোনো বিরূপ সমালোচক বলেন--কবি ইতিহাসের রক্তকক্ষের আতঙ্ক এড়াতে উঠতে চেয়েছেন প্রত্যক্ষতা রহিত শুদ্ধ কবিতা লোকে। আবার শ্রেণিকক্ষে জার্মান ছাত্রদের যখন বিশেষ অগ্রাহ্য করে ফর্মে মনোনিবেশের কথা বলা হত, বিশেষত: সাঙ্গীতিক কাঠামোয়, সেটাও কবির অপছন্দ। সমালোচকদের মতে এই কবিতাটিতে আছে জার্মানি তাঁর কালো অতীতকে ভুলে যেতে চাইছে অন্যদিকে একজন ইহুদি কবি বারংবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন জার্মানিকে তার কালো অতীত। সকাল সন্ধ্যায় কালো দুধ পান করার কথা কবিতাটির আদ্যন্ত মৃত্যু, শ্বাপদ-সংকুল জীবন ভোলার নয়, ‘আকাশ এক কবর সেখানে কেউ শুয়ে থাকে অবরোধহীন’। এক আলোচক যখন এই কবিতা-সূত্রে মন্তব্য করেন যে সেলান এড়াতে পেরেছিলেন আতঙ্কময় রক্তাক্ত ঘর দুয়ার আর সেই কারণেই এ ধরনের কবিতা ছেড়ে চলে যেতে চান শুদ্ধ কবিতার ইথার তরঙ্গে। একথা অবশ্য কবির পছন্দ হয় না। কবি তার আপাত প্রহেলিকাপূর্ণ পংক্তি-সমূহে জানান দেয়--‘আমরা ছিলাম। আমরা আছি।’ এবং ‘কিছুই হারায়নি এখনো’ এবং ‘চিৎকার করে বলো তোমার এই বিভূঁই মাতৃভূমিতে: ফেব্রুয়ারি, নো পাসারান।’ (‘নো পাসারান’এর অর্থ আর অগ্রসর নয় আসলে তাঁকে বন্দনার সমকালীন ভঙ্গিটাই ছিল তাঁর অপছন্দ।)
১৯৫৮-তে একটি পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষে সেলান বলেন--তিনি আসছেন এমন এক অঞ্চল থেকে যেখানে মানুষ ও কবিতা প্রাণবান। নিহিতার্থ যেখানে তিনি ফিরতে পারেন যদিও পরিস্থিতি তাকে ভ্রাম্যমান করে তুলেছে। আর একটা কথা-- এই এলিজি সুলভ মন্তব্যে কবি তাঁর স্বজন হারানোর ক্ষতি পুনরুদ্ধার করতে অভিলাষী। কর্পোরেট ম্যাডনেসকে পাত্তা না দিয়ে আশা প্রকাশ করেন কবিত্বময়তার। বলেন--যাবতীয় বিসর্জনের মধ্যেও অবিনশ্বর একটি উপকরণ। তা হল ভাষা। তবে তাকে অতিক্রম করতে হবে অনুত্তরত্ব, নীরবতা, সহস্র মৃত উচ্চারণের অন্ধকার। এভাবেই সেলান তাঁর ট্রমা উত্তীর্ণ হতে চান। স্মরণ করেন ব্রেখট-এর কবিত্বময় উচ্চারণ-- অন্ধকার সময়ের উচ্চতায় ব্রেখট বলেন ভবিষ্যৎ যুগ জিজ্ঞেস করবে কেন সে সময় নীরব ছিল কবিরা। তিনি কবিতার ভাষাকে করে তুলতে চান অনুত্তরত্ব এবং মারাত্মক বক্তৃতা, এই দুয়ের প্রতিস্পর্ধী। হয়ত ইঙ্গিত এখানে যে কোনো ইহুদি জার্মানীর পুনর্গঠন কালের অন্ধকার সময় ভেদ করে আসতে পারে না। যখন ভয়াবহ ও অধ:পতিত, তখন গড়ে নিতে চান এমন উচ্চারণ যা কতিপয় পাঠকের কাছেই হবে বোধ্য। কবিতা যেন বোতলে ভরা মেসেজ-প্রেরিত ভবিষ্যতে যা কেউ কোনোদিন হয়ত উদঘাটন করবে। কবিতাকে তিনি পূর্বসূরীদের (যেমন গটফ্রীড বেন) একোক্তি করতে চান না। চিন্তাবিদ মার্টিন বুবের, যার সম্পর্কে উষ্ণ উল্লেখ এ বক্তৃতায়, তাঁর মতো হতে চান সংলাপক, আবিষ্কারক, ব্যাখ্যাতা। তাঁর ওই বোতলবন্দী মেসেজের চিত্রকল্প রুশ কবি অসিপ ম্যান্ডেলস্টাম প্রাণিত, যাঁর কবিতা তিনি অনুবাদ করেছিলেন, যিনি এই বাক্যাংশ ব্যবহার করেন ১৯১৩-তে লেখা ‘সম্বোধিতের উদ্দেশে’ এই নিবন্ধে। সেলান-এর এই বক্তব্য বোঝায় ম্যান্ডেলস্টামের মতো তিনিও একদিন এমন ভাবে আদর্শ শ্রোতা খুঁজে পাবেন। এই রুশ কবিরও নীরবতার বন্দনার তীব্র ইচ্ছা ছিল। তাঁর ১৯১০-এ লেখা Silentium কবিতাটি একথার সপক্ষে যাবে। সেলান যেন কাফকার একটি প্যারাবল মনে করিয়ে দেন, যাতে বলা হচ্ছে--এখন সাইরেনে জাগছে আর এক মারাত্মক উপকরণ, তা হল নীরবতার গান। সেলান ভাষার বিরুদ্ধে নন, ভাষা ব্যবহারের পদ্ধতির কৌশলের পক্ষে। ব্রেখট একটি ছোট কবিতায় (যারা জন্ম নিচ্ছে পরে) (১৯৩৮) বলছেন--
এল এ কোন সময়সেলান উত্তর দিচ্ছেন ব্রেখটকে--
যখন গাছের কথা বলাও অপরাধ
কারণ সে কথায় থাকছে নীরবতা এতো ব্যাপক অন্যায়ের বিরুদ্ধে
একটি পাতা, গাছ নেইবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা মনে পড়ে।
ব্রেখটের জন্য
এল এক কোন সময়
যখন কথা বলা
প্রায় অপরাধ
কারণ তা ইঙ্গিতে রাখছে
এতো বিস্তর ব্যাখান?
ব্যাখ্যান সেলান-এর অপছন্দ। তাঁর বহুবার সংকলিত ‘মৃত্যু গীত’ কবিতাটি সম্পর্কে বলেন--এখানে বহু ব্যাখ্যান।
সেলান ব্যাখ্যানের বিরুদ্ধে, অনহিতের পক্ষে, খুঁজে নেন রহস্যময়তা। এই রহস্যময়তাই গড়ে তুলবে ভাষীর বোধ্যতা। সেখানে অভিপ্সীত এক সংলাপ-বিনিময় যা আউসউইৎস-পূর্ব জার্মান কবিতায় ছিল না। এ পদ্ধতি রচনায় তিনি মালার্মেকেও অতিক্রম করে যান। তাঁর কবিতায় এভাবে মৃত্যু শিবিরে বিনষ্টদের বেদনা বিকীর্ণ হয়।
সেলান পরে তাঁর প্রথম দুটি কবিতার বই খারিজ করে দেন, তৃতীয় বইটি পরাবাস্তব মতবাদ প্রভাবিত অর্থাৎ চিত্রকল্পে মুক্তি। পরাবাস্তবের বিভ্রম সৃষ্টিকারী স্বপ্নের কথা, প্রশংসা সেলান তাঁর প্রথম যুগের একটি গদ্য প্রবন্ধেও বলেন। প্রথম দুটি বইয়ের প্রকল্প কবিতায় তিনি অস্ত্যর্থকতা ব্যক্ত করেন, একটা টান টান ভঙ্গিমা। মালার্মের ধাঁচ কোথাও কোথাও এলেও মালার্মে যদি ৭০টি কবিতা লেখেন, সেলানের কবিতা সেখানে সাতশ। ‘ভাষার গ্রীল’ বইতে এল তাঁর নব্য প্রকরণ-- আধা ইমেজ আধা আড়াল। একটা উদাহরণ-- ‘ঘরে ফেরা’ --
তুষারপাত, গাঢ়তর এবং গাঢ়তর
গতকালের মতোই কপোত ধূসর
তুষারপাত, যেন এখনো তুমি ঘুমিয়ে আছো।
।। মুখে যদি রক্ত ওঠে।।
মুখে যদি রক্ত ওঠে/ সেকথা এখন বলা পাপ।/ এখন চার দিকে শত্রু, মন্ত্রীদের চোখে ঘুম নেই। এ সময়ে রক্তবমি করা পাপ: যন্ত্রণায় ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া পাপ: নিজের বুকের রক্তে স্থির হয়ে শুয়ে থাকা পাপ।
সাদা, দূরে স্তূপে সাজানো।(প্রথম ৬ পংক্তি)
তার উপরে, অন্তহীন
হারানো মানুষের শ্লেজগাড়ির দাগ।
‘না কারো গোলাপ’ (১৯৬৪) অতি কঠিন বিশেষত: যারা ইহুদী নন তাদের কাছে। ধর্মীয় গোঁড়ামিতে ফেরার অভিঘাত তুলতে চান। উদাহরণ--
।। প্রার্থনা গান ।।[শেষ ১২ পংক্তি]আমারা ছিলাম
কিছুই না, নই কিছুই
সেই অনস্তিত্ব.....। সেই
না-কারো গোলাপ।নিয়ে আমাদের
আত্মা-উজ্জ্বল গর্ভাশয়
নিয়ে আমাদের স্বর্গপীড়িত পুংকেশর
নিয়ে আমাদের রক্তবর্ণ দলমণ্ডল
নিয়ে সেই লাল শব্দ যা গেয়েছি আমরা
কাঁটার উপর, হায়
কাঁটার উপর।
প্রেমের কবিতা লিখেছেন, ইহুদিধর্ম ও খৃষ্টীয় গূঢ়তত্ত্ব নিয়ে কবিতা লিখেছেন, ঈশ্বর ও মানব সম্পর্ক নিয়ে ঈশ্বরের জবানীতে কবিতা লিখেছেন, আর কবি যখন পরিত্রাণহীন ভাষাশ্রয়ী অনুভবের কারিগর, তাই তাকে এপথে ওপথে বিপথে যেতেই হয়। এ আর এক ধরনের পথ পরিক্রমা। কখনও জেগে ওঠে এক রহস্যময় তুমি, প্রেমিকা হতে পারে, আত্মসত্তার অন্য অংশ হতে পারে। যেমন--ওর আলোক-অনুভব দিয়ে তুমি আমাকে অনুমান করো। (ভাষার জাল)।
বা, তোমার চোখ, পাথরের মতো অন্ধ (ফুল)
বা, যাও, তোমার প্রহর
ভগ্নিহীন, তুমি -
বাড়িতে।
ক্রমশ: পরিণত কাব্যবীক্ষায় কবি ওই বোতল বন্দী মেসেজ নিক্ষেপ করছেন সমুদ্রে, ভবিষ্যের তরঙ্গমালায় যার পাঠোদ্ধার, ভাষাবাহিত এক দ্যুতি। কিছু উদাহরণ জড়ো করা যাক--
ঐ শব্দটি শুইয়ে দাও মুর্দার চোখের পাতায় (পল এলুয়ার স্মরণে )
বা,
একশৃঙ্গী হরিণ:
তুমি জানো পাথরদের কথা (শিবোলেথ)
বা,
নীরবতা, স্বর্ণের মতো রান্না করা
অঙ্গারীভূত, অঙ্গারীকৃত
হাত (আলকেমীয়)
বা,
কিছু-নার ভেতরে....কি থাকে সেখানে? রাজা (ম্যানডোর লা)
বা, তুমি, গানবোট, নাম খার বাওবাব (সার্কাস এবং দুর্গের সাথে অপরাহ্ন)
বা,
হাড়-হিব্রু
বীর্যে গুঁড়িয়ে মেশানো
ছুটে গেলো সূর্যঘড়ির মধ্য দিয়ে (প্রাগে )
বা,
তিনটি বালুকা- কন্ঠস্বর, তিনটি
বৃশ্চিক (ঈশ্বরের ধোঁয়া)
বা,
ঈশ্বর রুটিটি ভাঙলেন
রুটিটি ঈশ্বরকে ভাঙল। (শিশির)
বা,
তেমাথায় নিজ মনে উচ্চারণ করো....
গিরিমাটি, গিরিমাটি.....
তিনবার, নয়বার। (গিরিমাটি)
কয়েকটি উদাহরণ তুলে দিলাম। কবিতার পাঠককে তো জানতে হবে মুর্দার চোখের পাতায় শব্দ শুইয়ে দেওয়ার মানে, একশৃঙ্গী হরিণ বা পাথর রহস্য (অনেকবার ‘পাথর’ ব্যবহৃত), নীরবতার রান্না স্বর্ণের মতো-- কি তার অর্থ, রাজা কে, কিছু-না কি দার্শনিক তত্ত্ব, গানবোট বা বাওবাব বলতে কবি কী বোঝান, হাড়-হিব্রু বীর্য কি ইহুদি কোনো পুরাণকথা, সূর্যঘড়ি-- সেটা কি, বালুকা-কন্ঠস্বর কি অর্থে ব্যবহৃত, ঈশ্বর ও রুটির কথা বোধকরি ইহুদি পুরাণ কথা, তেমাথায় তিন বা নয়বার উচ্চারণ সে তো লোকসংস্কার। এসব অর্থ জেনে ফিরে যেতে হবে কবিতা-শরীরে, কবিজীবনে, ঐতিহ্যের পুঞ্জে। তবেই কবিতা সান্নিধ্য।
এখানে উঠে আসে, মাঝে মধ্যেই বিশ্ব কবিতার এলাকায় উঠে আসে, একটা সমস্যা। কবি ও পাঠকের মধ্যে যে সম্পর্ক তা কি সেতুরচনা? যদি কোনো কবি সেই সেতু রচনা করতে প্রথমত আগ্রহী না হন, অথচ তার বলার কথা থাকে তাহলে তো আশ্রয় নিতেই হয় সাংকেতিকতায়, তাহলে পাঠককেও নামতে হয় পরিশ্রমে। কবি যদি পাঠকের সঙ্গে সাম্প্রতিক যোগ বিমুখ হন, তাহলে দুয়ের সম্পর্ক আলগা হয়ে যায়। সেলানের কবিতা সম্পর্কে সমালোচকরা যে cryptic, enigmatic, obscure, hermetic ইত্যাদি মন্তব্য করেন তার সংকট এখানে। কোয়েৎজি বলেন--আধুনিকতার আন্তর্জাতিকতার বিচারে ১৯৬৩ পর্যন্ত সেলানের কবিতা আয়ত্তযোগ্য। কিন্তু পরের কবিতা নজরে পড়ার মতো কঠিন, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে obscure. এই কথা বলতে গিয়ে অবসকিওর কবিতা হিসেবে একটি কবিতা তুলে দেন। সেটা এরকম--
তুমি শুয়ে আছো ব্যাপক শ্রুতির মধ্যে
ঝোপে ঢাকা, স্তূপ হয়ে যাওয়া
যাও মাতলামিতে, হাভেনে,
যাও মাংস ঝুলন কাঁটায়
লাল আপেল গোঁজে ধাঁধাঁ
সুইডেনের--এই যে আসে দানসামগ্রীর টেবল
এটা ঘোরে ফেরে ইডেনের চারদিকমানুষটা হয়ে পড়ে চালানি, বৌকে
দিতে হত সাঁতার, কুঁড়েও লোভী
নিজের তরে, আর কারো নয়, আবার সবার তরে
ল্যাভওয়ের খালটা কোনো ধ্বনি তুলবে না
এ কবিতার বিষয় কি? যদি না কিছু তথ্য দেওয়া যায়। কবি নিজে আলচক পিটার জোন্ডিকে বলেছিলেন যে লোকটা চালানি সে হল কার্ল লিয়েবনেট, সাঁতার-রত বৌটা হল রোজা লুক্সেমবুর্গ, ‘ইডেন’ হল একটা বাড়ির চত্বর যেখানে দুজন সক্রিয় সংগ্রামীকে গুলি করে মারা হয় ১৯১৯-এ আর মাংস ঝোলানোর হুক হল হাভেল নদীর ধারে প্লটজেনসিতে সেই জায়গা যেখানে হিটলার হত্যার চেষ্টা করা আততায়ীদের ফাঁসি দেওয়া হয় ১৯৪৪-এ। এ-ভাবেই জার্মান দক্ষিণপন্থীদের আক্রমণে হত্যাপর্ব চলে, জার্মানদের নীরবতা এই প্রসঙ্গে তুলনীয় শঙ্খ ঘোষের ‘কবিতার মুহূর্ত্ত’--যেমন ব্যাঘ্যাত কবিতাগুলি বুঝতে সহায়ক হয়।
কবি ও পাঠকদের সেতুবন্ধন, কবিতায় যে প্রতিফলন তা মানুষ-হৃদয়ে রেখাপাত করবে কি করবে না, কবি কতোদূর সংকেতময়, প্রহেলিকাপূর্ণ হবেন, কবি মাত্রেরই কি প্রহেলিকা-পূর্ণ হওয়া আবশ্যিক এসব একগুচ্ছ কথা উঠে আসে। অতিবিস্তার কবিতার পক্ষে কতোটা ক্ষতিসাধক, অতি প্রহেলিকা যোগাযোগ রচনার প্রতিবন্ধক। মাথার ওপর যদি ঘন আঁধারের কুঠার উদ্যত হয়--তাহলে? এ সব নিয়ে যুগে যুগে সংকটে সংকটে ভাবুকতা চলছেই। চলতেই থাকবে বলে মনে হয়।
আত্মহনন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এক প্রহেলিকা। মায়াকভস্কি বা এসেনিন অথবা প্রিমো লেভির আত্মহনন 'আটবছর আগের একদিন’ কবিতা নিঃসৃত প্রহেলিকার উদাহরণ। পূর্বেই বলেছি ১৯৭০-এ পারীতে সিন নদীর জলে এই কবি আত্মহত্যা করেন। ইজরায়েল প্রত্যাগত কবির এই আকস্মিক অপমৃত্যু রহস্যময়। ইতিহাসকার এরিক কাহলার (যার সঙ্গে কবি সেলানের চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল) একটা ব্যাখ্যা দেন। জার্মান কবিতার এক বড়োত্বে স্থাপন আর অন্যদিকে এক তরুণ কেন্দ্রীয় ইউরোপীয় যুবকের কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্পের ছায়ায় বেড়ে ওঠা, এই দুয়ের দ্বন্দ্ব বোঝা ছিল কবি মানসিকতার পক্ষে ব্যাপক। বৃহত্তর অর্থে এটাই হতে পারে তাঁর আত্মহননের ব্যাখ্যা। আর একটা ব্যাখ্যা আছে। বন্ধু গল-এর স্ত্রী অভিযোগ করেছিল সেলান গলের কবিতা চুরি করেছেন, ফলে সেলানের এক মানসিক বিপর্যয় ঘটে, ডাক্তার দেখাতে হয়। সেলানের-ও বেশ কিছু বলার ছিল। সেটা বলা হয় নি। জীবিতকালেই সেলান-এর কবিতা নিয়ে জার্মানীতে ব্যবসা শুরু হয়, পণ্ডিতরা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। যেমন কাফকাকে নিয়ে তেমনি সেলানকে নিয়ে ব্যবসা শুরু হয় জোর কদমে। সোচ্চার স্বরবিরোধী সেলানের এসব ভালো লাগে নি। অনুবাদক, ক্রিটিক, পাঠক যে যে কারণে হৈচৈ শুরু করে তা কবির পছন্দ হয় নি।
মনে করো:আপাতত: ‘সেই সব বালুকার কাফনের কোট’ এই কবির জন্য। আমরা নিজের মতো করে পাঠ করা শুরু করি আর স্মৃতির সরাইখানায় তাঁর নামটা খোদাই করে রাখি।চক্ষুহীন কেউ, আকৃতিহীন
তোমাকে পথ দেখিয়ে নিচ্ছে হট্টগোলের মধ্য দিয়ে
তুমি হচ্ছ শক্তিমান এবং
আরো শক্তিমান।(মনে করো)
[পাউল সেলানের কবিতা--খোন্দকার আশরাফ হোসেন, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৭ বইটি থেকে বিস্তর সাহায্য নিয়েছি।]