তরুণ মৃণাল সেন দেখেছিলেন অমানবিক দেশভাগে বাংলার টুকরো হয়ে যাওয়া। উপনিবেশ শাসনোত্তর এক অপদার্থ রাষ্ট্র রোধ করতে পারেনি বাংলার ভয়াবহ দাঙ্গা, আটকাতে পারেনি ক্রমশ ধ্বসে পড়া অর্থনীতি, বেকারত্ব, উদ্বাস্তু, দারিদ্র্য। এই সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে উঠে এসেছিল বাম রাজনীতি, তৈরী হয়েছিল যুক্তিহীন, আবেগতাড়িত 'আমরা-ওরার' সাদা-কালো বিভাজন। 'আমরা' অর্থাৎ শোষিত শ্রমজীবী এবং ‘ওরা’ অর্থাৎ শোষক--বড়লোক, শিল্পপতি এবং আমলার দল। এই সরলীকরণ অতি সহজপাচ্য, তাই এতেই ভেসে গিয়েছিল বাংলা, ভেসেছিলেন মৃণাল সেন। ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘কলকাতা ট্রিলজি’, ‘কোরাস’ সৃষ্টির অন্তর্নিহিত আবেগ হয়ত এটাই ছিল। এ ছবিগুলিতে মৃণাল সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন সামাজিক অদক্ষতা, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে, আঙুল তুলেছিলেন ‘ওদের’ দিকে। শীঘ্রই মৃণাল সরে আসেন আবেগতাড়িত ভাবনা থেকে। শুরু হয় তাঁর আত্মবীক্ষার পর্ব, নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখা; ‘পদাতিক’ দিয়ে যার শুরু, ‘একদিন প্রতিদিন’, তারপর ‘আকালের সন্ধানে’।
‘আকালের সন্ধানে’ একটি film-within-a-film. ছবিতে শহর থেকে এক সিনেমার দল গ্রামে আসে মন্বন্তর নিয়ে ছবির (যার নামও ‘আকালের সন্ধানে’) শুটিং করতে। তাঁরা সেলুলয়েডে ফুটিয়ে তুলতে চান সেই মন্বন্তরের কাহিনী, বৃটিশের তৈরী ১৯৪৩ সালের যে মন্বন্তরে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। প্রধান দুটি চরিত্রে দুই নারী, একটিতে অভিনয় করবেন স্মিতা পাটিল, অন্য চরিত্রে আর একজন অভিনেত্রী। শুটিং চলাকালীন ডিরেক্টরের সঙ্গে গণ্ডগোলে তিনি হঠাৎ কাউকে না জানিয়ে কলকাতায় ফিরে যান। সমাধানে এগিয়ে আসেন গ্রামের এক মধ্যবয়ষ্ক। তিনি নিজে গ্রামে যাত্রাপালা, নাটক করেছেন। তাঁর বিশ্বাস গ্রামের সকলে মন্বন্তরের কাহিনী চলচ্চিত্রায়নের সৎ প্রচেষ্টায় সাহায্য করবে। চরিত্রটি এক তরুণীর, খিদের জ্বালায় সে এখন পতিতা। গ্রামের সেই মধ্যস্থতাকারীর কথায় ঠিক হয় যে স্থানীয় একটি তরুণীকে (ঘটনাচক্রে সে উচ্চবর্ণের) শিখিয়ে কাজ চালানো হবে। সমস্যার শুরু হয় এখান থেকেই।
‘আকালের সন্ধানে’-র প্রধান সম্পদ তার চিত্রনাট্য, অভিনয় এবং সম্পাদনা। ছবির প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় তিনটি। প্রথমতঃ তিনি বলতে চেয়েছেন মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের অন্তঃসারশূন্যতা। ছবিতে যে গ্রামে শুটিংএর কথা, সে গ্রামও আকালের ভুক্তভোগী--ছবির একটি চরিত্রের কথায় “আকাল এখনো আমাদের সর্বাঙ্গে।” গ্রামের উচ্চবর্ণের তরুণীর বাবা মেয়েকে চটুল বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করতে দিতে উৎসাহী, অথচ তিনি ‘ব্রাহ্মণ পরিবারের’ মেয়েকে মন্বন্তরের শিকার এক পতিতার ভূমিকায় অভিনয় করতে দিতে ভীষণ নারাজ। আকালের তাড়নায় পতিতা হওয়া দেখানোটা তাঁর কাছে ভয়ংকর অনৈতিক ও অশ্লীল। তারপর গ্রামের সাধারণ মানুষদের সহজেই ক্ষেপিয়ে তোলা হল শহর থেকে আসা ছবি-নির্মাতাদের বিরুদ্ধে, অশ্লীলতার দোহাই দিয়ে। আমার মতে এটি মৃণালের মধ্যবিত্ত সমাজের দ্বিচারিতার মুখোশ খুলে দেওয়ার একটি অতি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এর আগে তিনি ‘একদিন প্রতিদিন’ এবং পরে ‘খারিজ’-এ এই কাজ আরো নির্মমভাবে করেছেন, পুরো চলচ্চিত্র জুড়েই।
দ্বিতীয়তঃ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন অতীত ও বর্তমানের পাশাপাশি থাকার রসায়ন। অতীত যতক্ষণ ‘ইতিহাস’, আমাদের সে অতীত দেখতে অসুবিধে নেই, কিন্তু অতীত যখন বর্তমানের খুব কাছাকাছি, আমাদের সে অতীত দেখতে ভয়ঙ্কর অস্বস্তি হয়। ‘আকালের সন্ধানে’ ছবিতে সমান্তরাল ভাবে জড়িয়ে থাকে সেই গ্রামের আরেকটি দুঃস্থ মেয়ে দুর্গার (অসাধারণ অভিনয়ে শ্রীলা মজুমদার) করুণ কাহিনী। দুর্গা রোজগারের আসায় ফিল্মের দলের ফাইফরমাস খাটার জন্য এসেছিল। শুটিং-এর একটি সিকোয়েন্স-এ স্মিতা অভুক্ত স্বামী আর নিজের বাচ্চার জন্য চাল এনেছে, তার দেহের বিনিময়ে। জানতে পেরে যখন তার স্বামী যখন বাচ্চাটিকে আছাড় মারতে যায়, শুটিং দেখতে আসা দুর্গা ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। স্মিতা-অভিনীত চল্লিশ বছর আগের দুর্ভিক্ষের কবলে পড়া চরিত্রটির সঙ্গে তার সংসারের বর্তমান অবস্থার ভয়াবহ মিল। এই একটি দৃশ্যে, মৃণালের নিজের কথায়-- “Surreptitiously, the past walks into the present.” মৃণালের film-within-a-film-এর মাধ্যমে celluloid-এর মন্বন্তর আর দুর্গার বর্তমানের সাদৃশ্যের অভিঘাত আমাদের ভীত করে। ছবির শেষ দৃশ্য আমাদের নাড়িয়ে দেয়; দুর্গা series of freeze shots-এ ভবিষ্যতের অন্ধকারে হারিয়ে যায়, ফিলমের দল চলে গেলে তার রোজগার সম্পূর্ণ বন্ধ।
তৃতীয়তঃ মৃণাল এ ছবির মাধ্যমে প্রশ্ন করেছেন নাগরিক সংবেদনশীলতাকে। শুটিং করতে আসা কলাকুশলীরা সকলেই নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত, গ্রাম তাদের সম্পূর্ণ অজানা। মৃণালের কথায় “...they, in a way invade into the rural life to make a film on poverty.” খানিকটা মজার ছলে দেখান ফিলমের দলের এক সদস্যর লোকেশনের গ্রামের বাচ্চাদের ফুল প্যান্টের চেইন খুলে হাফ প্যান্ট করে ফেলার স্থূল রসিকতা। পরিচালকের “cut” গ্রামের বাচ্চাদের কাছে একটি অদ্ভুত মজার শব্দ হয়ে ওঠে। নাগরিক আগ্রাসনকে তিনি এক কথায় বুঝিয়ে দেন গ্রামবাসীর একটি অসাধারণ নির্লিপ্ত মন্তব্যে, “এরা আকাল নিয়ে ছবি করতে এসে এখানেই আকাল লাগিয়ে দিল!” ছবির কলাকুশলীদের খাবার গ্রামের বাজার থেকে দিনের পর দিন গাড়ী করে চলে যাচ্ছিল লোকেশনে, ফলে কাঁচাবাজার গ্রামের সাধারণ লোকের কাছে দুর্মূল্য হয়ে উঠছিল।
মৃণাল তাঁর ছবিতে বরাবর চেষ্টা করে গেছেন যুক্তিনির্ভর বক্তব্য খাড়া করতে, ঠিক নিটোল গল্প বলতে নয়। নিরলস চেষ্টা করে গেছেন শাসক ও মধ্যবিত্ত সমাজের কাঠামো খুলে দেখাতে। তাঁর চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো পরিমিতির অভাবে কখনো খোঁচা দিয়েছে, হয়তো অনেক সময় নান্দনিক হয়নি। তাঁর ছবিতে চিত্তবিনোদনের কোনো স্থান ছিল না, তিনি সেটা করতেও চান নি। তাঁর ‘আকালের সন্ধানের’ অভিঘাত বেশ তীব্র, যা শেষে আমাদের অনেক কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়। তুলনায় সত্যজিৎ ভালবাসেন গল্প বলতে, চেষ্টা করেন নিরপেক্ষ থাকতে, মৃণালের ছবির রুক্ষতা সত্যজিতের ছবিতে প্রায় থাকে না। সত্যজিতের ‘অশনি সংকেত’ সেই তেতাল্লিশের আকালেরই ছবি, কিন্তু দুজনের চিত্রভাবনা সম্পূর্ণ আলাদা। ‘অশনি সংকেতের’ আকাল অতীত ‘ইতিহাস’, মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে এক সাধারণ পরিবারের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের গল্প, তার সঙ্গে বর্তমানের কোনো যোগাযোগ নেই। ‘অশনি সংকেত’ আমাদের বিষন্ন করে, কিন্তু ‘আকালের সন্ধানে’ দেখতে আমরা বিব্রত বোধ করি। ‘অশনি সংকেতের’ শেষে, অনবদ্য সম্পাদনায় সত্যজিৎ কিছু সিল্যুয়েট ক্লোজ শট, কাট, লং শটের সংমিশ্রণে গরীব পরিবারটিকে মন্বন্তরের ছিন্নমূল মানুষের মিছিলে মিশিয়ে দেন। সম্পূর্ণ আবেগবর্জিতভাবে শেষ করেন শুধু এটা জানিয়ে, যে মন্বন্তরে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। তাঁর চলচ্চিত্রভাষার সংযম ও পরিমিতিবোধ শিক্ষনীয়। তুলনায়, ‘আকালের সন্ধানে’ মৃণাল নিরপেক্ষ নন। শেষের freeze shots সত্যজিতের মত কাব্যিক নয়, কিন্তু তার অভিঘাত বড় সাংঘাতিক। দুর্গার ঠিক কি হল, মৃণাল তার উত্তর না দিলেও তার “fusion of fantasy with the reality” আমাদের বিচলিত করে, ভাবতে বাধ্য করায়। সেই অর্থে ‘আকালের সন্ধানে’ ঠিক নিটোল গল্প হয়ে ওঠেনা। ‘অশনি সংকেত’ আর ‘আকালের সন্ধানে’ ভারতীয় চলচ্চিত্রের দুই সম্পদ, Berlin film festival-এ প্রথমটি ১৯৭৩ সালে Golden Bear ভূষিত হয়। ‘আকালের সন্ধানে’ তার আট বছর পর, Berlin-এ Silver Bear পায়। একই বিষয় নিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন মননের দুই কালজয়ী সৃষ্টির উদাহরণ ভারতীয় চলচ্চিত্রে আর নেই, পৃথিবীর চলচ্চিত্র ইতিহাসেও সম্ভবত বিরল।
কলকাতা ছিল মৃণালের ‘El Dorado.’ মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ--আমরা, তাঁর বড় কাছের ছিলাম। আমাদের তিনি বুঝতে চেয়েছেন; এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন “I started searching the enemy within.” চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তার এই খোঁজার প্রয়াস আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়েছে বারবার, আমাদের ভাবিয়েছে, বিপন্ন করেছে। জীবনের শেষ দুদশকে আমাদের থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। আমরাও তাঁকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছি। তাঁর ছবি হলে চলেনি, টেলিভিশনের চ্যানেলে কখনো চললেও আমরা দেখিনি। ভারতীয় চলচ্চিত্র বোর্ড তার সৃষ্টি সংরক্ষণের প্রয়োজন মনে করেনি, হলিউড তার প্রতি আগ্রহ বোধ করেনি। তাঁর নিঃশব্দে চলে যাওয়ার পর, আমাদের উন্মুক্ত করে, আয়নায় সামনে দাঁড় করিয়ে, সোজাসুজি প্রশ্ন করার সততা ও সাহস বোধহয় আর কারোর রইলো না।
ছবির সূত্রঃ
১) m.dailyhunt.in/news/nepal/english/the+wire+english-epaper-wireng/the+fasting+buddha+in+mrinal+sen+s+akaler+sandhane-newsid-114903638
২) www.youtube.com
৩) www.imdb.com/title/tt0080341/