• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৪ | মার্চ ২০১৯ | গল্প
    Share
  • ডঃ বোস-এর শেষ রাত্রি : অতনু দে


    জ ডঃ বোস-এর জীবনের শেষ রাত্রি। ওঁর বাহাত্তর বছরের জীবনটা এবার শেষ হবে। তাও আবার ওঁর নিজের হাতেই।

    ডঃ বোস প্রচুর খেটেছেন তাঁর ডাক্তারি জীবনে। রুগীর চিকিৎসাই ছিলো ওঁর ধ্যান-জ্ঞান। একটু কড়া মেজাজের ডাক্তার ছিলেন উনি — চাঁচাছোলা, আবেগবর্জিত, কিন্তু ডাক্তারিটা যত্ন করে করতেন। বিস্তর পড়াশোনা করতেন, খুব আপ-টু-ডেট থাকতেন, ডাক্তারমহলে বেশ শ্রদ্ধার চোখেই ওঁকে দেখা হতো। বছরতিনেক আগে ডঃ বোস রিটায়ার করেন। সহকর্মীদের কথায় কান দেন নি, বলেছিলেন “এনাফ ইজ এনাফ। টাকা-পয়সা ভালোই করেছি, ছেলে প্রতিষ্ঠিত, বিবাহিত, তার একটি সন্তান আছে, ব্যাস — আর কি চাই? এবার জীবনের সেকেন্ড ইনিংস শুরু করবো। স্ত্রীকে সময় দিতে পারি নি এদ্দিন, তার সঙ্গে — আর নিজের সঙ্গেও একটু সময় কাটাবো। একটু এদিকওদিক বেড়াবো, সিনেমা-থিয়েটার দেখবো, নাতনির সঙ্গে খেলা করবো এই আর কি।"

    সেকেন্ড ইনিংস ভালোই শুরু হয়েছিলো ওঁর। হঠাৎ দু বছর আগে একটা অকস্মাৎ গাড়ির এক্সিডেন্টে ছেলে-ছেলের বৌ-নাতনি রাতারাতি চলে গেলো আকাশের ঠিকানায়। তার ঠিক ছ’মাসের মাথায় মধ্যে স্ত্রীর মৃত্যু হলো। সেকেন্ড ইনিংসটা শুরুর আগেই শেষ হয়ে গেলো।

    ভুলে থাকবেন বলে ডঃ বোস আবার ডাক্তারির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পাশের পাড়ায় “সেবা” নামক ছোট্ট সমাজসেবা সংস্থা আছে, যারা বস্তিবাসীদের স্বল্পমুল্যে চিকিৎসা করাবার চেষ্টা করে — তাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন ডাক্তার হিসেবে। যোগ দিলেন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, রামকৃষ্ণ মিশন ইত্যাদিদের ক্লিনিকেও। উদয়ান্ত অসম্ভব পরিশ্রম করতে থাকলেন তিনি। কিন্তু তবুও ঘরে ফিরে দেখতেন ঘরজুড়ে রয়েছে একরাশ অনড় শূন্যতা।

    আর সেই থেকে ডঃ বোসের প্রতিটি দিন আসলে এই শূন্যতার বিরুদ্ধে একটানা সংগ্রামের কাহিনী। যে সংগ্রামে জয়ের আনন্দ নেই, পরাজয়ের তিক্ততাও নেই — আছে শুধু এক অন্তহীন ক্লান্তি। ডঃ বোস আজ বড়ো ক্লান্ত। তাই এই চারমাস আগে যখন ওঁর প্রস্ট্রেট ক্যান্সার ধরা পড়লো, ওঁর একমাত্র অনুভূতি ছিলো মুক্তির — ভয় বা দুঃখের নয়। ডঃ বোস ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, তবে এবার স্পষ্ট এক নীরব উচ্চারণ শুনতে পেয়েছিলেন তিনি। যেন কেউ এসে বলে গেলো যে এবার যাবার বেলা।

    তাছাড়া ডঃ বোস এমনিতেও খুব প্র্যাকটিক্যাল মানুষ। তিনি জানেন যেপ্রাণঘাতী রোগ থেকে সেরে ওঠার জন্যে শুধু ওষুধ-পথ্য-সেবা-অর্থই যথেষ্ট নয়। যেটা সবচেয়ে বেশী দরকার, তা হলো রুগীর বেঁচে থাকার আকাঙ্খা। একটি বারের জন্যে হলেও মাতা-স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরবার ইচ্ছে। সেটা না থাকলে শত কেমো, রেডিও বা অন্য কোনো থেরাপিতেই এ রোগ সারবে না। তাই অকারণে রোগে ভুগে এককাঁড়ি পয়সা খরচা করে কষ্ট পাবার কোন কারণ দেখেন না উনি।

    বিষয়-আশয় গুছিয়ে নিয়েছেন ডঃ বোস। উইল করে ফেলেছেন — সম্পত্তির বেশীর ভাগটাই যে সব সংস্থার সঙ্গে উনি যুক্ত, তাদেরকেই দিয়ে যাচ্ছেন। উইলটা এক্সিকিউট করতে দেওয়া আছে এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে; তাকেই বলা আছে ওঁর ডাক্তারির বইগুলো মেডিক্যাল কলেজ লাইব্রেরীতে দিয়ে দিতে। সাদার্ন এভিনিউএর ওপরে ওঁর যে ফ্ল্যাটটা, যেখানে গত ষাট বছর ধরে উনি বাস করেন, শুধু সেটা দিয়ে যাচ্ছেন ওঁর একমাত্র ভাগ্নেকে। আশা আছে সে এখানে এসে থাকবে। ওঁর রক্তের সম্পর্কের কেউ এই ফ্ল্যাটে থাকবে ভাবতে ভালো লাগবে ওঁর।

    মৃত্যুর রাতটাও ভালো বেছেছেন ডঃ বোস। বুদ্ধপূর্ণিমা — ভুবনজোড়া চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। ওঁর বাড়ির বারান্দা দিয়ে দেখা রোজকার বাসি লেকটি আজ বড় মায়ায় মাখা।

    যদিও রাত নটা বেজে গেছে, তবুও ডঃ বোস আজ বেশ আয়েস করে স্নান করলেন। পাউডার মাখলেন বেশ যত্ন করে, তারপর ধবধবে সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবী পরলেন। মন দিয়ে একমাথা সাদা চুলকে আঁচড়ালেন বেশ অনেকক্ষণ ধরে। তারপর ওঁর প্রিয় টি-হাতলওয়ালা বিলিতি লাঠিখানা নিয়ে লেকের ধারে হাঁটতে বেরোলেন। যাবার আগে একবার চেনা রাস্তায় হাঁটবেন, দু চোখ ভরে পূর্ণচাঁদের মায়া আর লেকের কালো জল দেখবেন। তারপর ফিরে এসে সোজা ওঁদের ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে। উনি নিজেই সোসাইটির সেক্রেটারি, তাই ছাদের চাবির একসেট ওঁর কাছে থাকে। তারপর পনেরো তলা থেকে একটিমাত্র দীর্ঘ পদক্ষেপে মৃত্যুর দিকে যাত্রা।

    লেকের ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় লাঠিতে ভর দিয়ে দম নিতে দাঁড়ালেন ডঃ বোস। দূরের ল্যাম্পপোস্টের একটু আলো এসে পড়েছে এখানে। এখানে রেলিঙের পাশ দিয়ে লেকের অনেকটা দেখা যায়। কালো জলে বাঁধভাঙা সাদা আলোর থইথই। এসব ছেড়ে যেতে হবে ভেবেও ডঃ বোসের বিশেষ কষ্ট হচ্ছে না। বরং বেশ নৈর্ব্যক্তিকভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলেন আশপাশটা।

    চারদিক দেখতে দেখতে একসময় চোখে পড়লো যে পাশের গাছতলায় একটা বাচ্চা মেয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। বয়েস বোধহয় সাত-আট মাস হবে। চাঁদের আলো পড়েছে তার মুখে। ভারী মিষ্টি দেখতে কিন্তু মেয়েটিকে। তার পাশে বসে আছে শতচ্ছিন্ন নোংরা জামা পরা একটি বছর পঁচিশের মেয়ে। মেয়ের মা-ই হবে বোধহয়। ওঁরই দিকে তাকিয়ে আছে মনে হলো।

    তাকিয়ে থাকতে থাকতে ডঃ বোস হঠাৎ দুজনকে চিনতে পারলেন। চিনতে মানে ওই যুবতীটিকে উনি দেখেছেন আরকি — পাড়ায়, বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ভিক্ষে করতে। মনে আছে এই কারণে যে বাচ্চাটাকে দেখেই ওঁর মনে হয়েছিলো বাচ্চাটা সেরিব্র্যাল প্যালসিতে ভুগছে, যার এমনিতে কোন চিকিৎসা নেই। এই পথশিশুদের তো আরোই নেই।

    “আমাদের মতন দেশে এই সব বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রাখার কোন মানেই হয় না”, আপন মনে বিড়বিড় করে বললেন ডঃ বোস। চিকিৎসা হবে না, বড়ো হয়ে আরো সমস্যা বাড়বে। তার ওপরে মেয়ে — বড়ো হলে পথের ধারের জানোয়ারেরা টেনে নিয়ে যাবে হয়তো তাদের ভোগের জন্যে। মা’টার উচিৎ বাচ্চাটা ছোট থাকতেই ওকে শেষ করে দিয়ে মুক্তি দিতে। আমাদের সমাজে এই শ্রেণীর মেয়েদের পক্ষে এটাই একমাত্র বাস্তবসম্মত রাস্তা — যতই নিষ্ঠুর শোনাক না কেন। বাচ্চাটাকে দেখতে দেখতে এসব সাতপাঁচ ভাবছিলেন ডঃ বোস।

    বাচ্চাটাকে মন দিয়ে দেখতে দেখতে চোখে পড়লো মা’টা কোথা থেকে ছেঁড়া নোংরা দুটো বালিশ জুটিয়েছে। বাচ্চাটার মাথায় একটা, অন্যটা মায়ের হাতে। বোধহয় বাচ্চাটার পাশবালিশ হিসেবে ব্যবহার হয়। আবার বাচ্চাটার পাশে তার গায়ে মুখ গুঁজে একটা বাচ্চা কুকুরও শুয়ে আছে। মনে হলো এদের পোষা, পরিবারেরই অংশ হয়ে গেছে।

    গা জ্বলে গেল ডঃ বোসের। থাকে রাস্তায়, খেতে পায় না, তার আবার বালিশ, পাশবালিশ, কুকুর। ন্যাকামো!

    চাঁদের আলোটা আজ সত্যি বড়ো মোহময়। ভাবনাগুলো সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। ওই রাস্তার ধারের নোংরা ড্রেনের পাশে শুয়ে থাকা ভিখিরির বাচ্চাও এর আলোতে দেবশিশু। আচ্ছা — এই অবস্থাতেও মানুষ তো বেঁচে থাকে? রাস্তায় থাকে, খেতে পায় না, তবুও এই আরোগ্যবিহীনরুগ্ন বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রাখে? তার মাথায় বালিশ ধরে, তার খেলার জন্যে কুকুরছানা পোষে? কেন পোষে? এদের কিসের এতো স্পর্ধা, এতো শক্তি যে নিয়তিকে চ্যালেঞ্জ জানায় এরা?

    ডঃ বোস মাথা নিচু করে ভাবনায় মিশে গেলেন। চাঁদের আলোর ম্যাজিক তখনো রাস্তায়। ওঁর হাতের টি-স্টিকের ছায়া পড়েছে ফুটপাথে। তার পাশের ব্যান্ড আর স্টিক মিলিয়ে মনে হচ্ছে একটা লাঠির গায়ে যেন সাপ জড়িয়ে আছে। সেই ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ।

    দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডঃ বোস। মরাটা আজ হয়ে উঠলো না দেখছি! পথের ধারের একটা হতচ্ছাড়া অযাত্রা ভিখিরির কাছে, তার বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রাখার অদম্য ইচ্ছের কাছে হেরে গেলেন শেষে।

    লাঠিটায় ভর দিয়ে এগিয়ে চললেন ডঃ বোস। সেরিব্র্যাল প্যালসিতে কি কিছুই করার নেই? জার্নালগুলো ঘেঁটে দেখা যাক তো। একবার মেডিক্যাল কলেজেই নাহয় চলে যাবেন ব্যাপারটা নিয়ে। নিয়তিকে একটা চ্যালেঞ্জ দিয়েই দেখি, বিড়বিড় করে বললেন ডঃ বোস।


    ****


    উজ্জ্বলার চোখ দিয়ে খালি জল পড়ছে। মেয়েটার মুখ দেখছে যতবার, ততবার নতুন করে চোখে জল পড়ছে। কিন্তু মন শক্ত করে ফেলেছে ও — ওর মেয়ের ছোট্ট জীবনের আজ শেষ রাত্রি। ডাক্তাররা বলেছে এর কোন চিকিৎসা নেই, সারাজীবন ভুগবে এ। নিজেও ভুগবে, উজ্জ্বলাকেও শেষ করে যাবে। তার চেয়ে এই ভালো। একটু রাত হলে বালিশটা ওর মুখে খুব জোরে চেপে ধরবে উজ্জ্বলা। কষ্ট হবে একটু, কিন্তু শান্তি পাবে সুন্দরী। আহা, বড়ো সাধ করে ওর নাম রেখেছিলো ‘সুন্দরী’।

    উজ্জ্বলা চোখ বুঁজে এক মনে ঠাকুরকে ডাকছে। ও ঠাকুর — আমার দোষ ধরো না গো। তোমার কোলে দিলাম ঠাকুর, তুমিই ওকে দেখো। মনে মনে বারবার এই একই কথা একঘেয়ে ভাবে বলে চলেছে উজ্জ্বলা।

    একসময় চোখ খুললো উজ্জ্বলা। রাতের শূন্যতায়, লেকের এই নির্জন রাস্তায় উজ্জ্বলা স্পষ্ট দেখলো এক তুষারশুভ্র দেবদূত এসেছেন ওর সুন্দরীকে নিয়ে যেতে। চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে তাঁর সাদা চুলে ভরা মাথা, তাঁর সাদা পোশাক। উজ্জ্বলার বুক আশায় ভরে গেলো।

    “ঠাকুর, তুমি নিজের হাতে ওকে নিতে এলে? ঠাকুর, তুমি আমাকে মাপ করলে তো?” আপন মনে বলে উঠলো উজ্জ্বলা মৃদুস্বরে। দেবদূত উত্তর দিলেন না। শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ, তারপর মাথা নিচু করে থেকে একসময় কিছু না বলে লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে চলে গেলেন। একবার হাসলেনও না।

    উজ্জ্বলা তাকিয়ে রইলো সেই দিকে। তবে কি ঠাকুর রাগ করলেন? সুন্দরীকে মারতে বারণ করলেন? নাকি সুন্দরীকে আশীর্বাদ করতে এসেছিলেন? তাহলে কি সুন্দরী ভালো হয়ে উঠবে এবার?

    উজ্জ্বলার চোখ দিয়ে আবার জল পড়তে লাগলো। ঠাকুর, আমি ওকে কাল সকালেই নিয়ে যাবো অন্য ডাক্তারের কাছে। ওই পাশের পাড়ায় “সেবা” বলে যে ফ্রি ডাক্তারখানাটা আছে, সেখানে। ও ঠিক ভালো হয়ে উঠবে, তাই না?

    উজ্জ্বলা মেয়ের মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে একটা চুমু খেলো। তাতে মেয়েটা নড়ে উঠে ঘুমের মধ্যে কি যেন অ্যালব্যাল বলে উঠলো। আর তাই শুনে বাচ্চা ভুলু কুকুরটা মুখ তুলে দুবার ভুকভুক করে তার মানবভগিনীর কোলে পুনরায় মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়লো।

    ***


    (এই সংখ্যায় অতনু দে-র আরো একটি গল্পঃ 'উত্তরাধিকার')




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ সোনালী ব্যানার্জী
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments