লাশ বহনকারী বুদাইয়ের চালাঘরের কাছে অন্ধকার জঙ্গলে বাস করেও ভয় করে না আশিকের। কিছুকাল আগেও সে নানা ভয়ে ভীত ছিল। একটা সময়ে কোনো জাদুকরী ইশারায় ভয়টয় উবে যায়। বুদাই মানেই লাশ ও লাশকাটা ঘর। ভয় ও মৃত্যুর গন্ধভরা এই দুনিয়াতে বিদ্যমান অনন্ত বিস্তৃত পরপারের এক ক্ষুদ্র সংস্করণ।
একা অন্ধকার ঘরে এখন আর কোনো ভয় তার মধ্যে কাজ করে না। সুতরাং বুদাইয়ের প্রতিবেশী হয়ে সে একটা জংলি জীবন ঠেলেঠুলে নিচ্ছে।
তার ঘরের সামনে দিয়েই তো বুদাই লাশ নিয়ে যায়। পয়লা পয়লা সে কৌতূহল্ভরে তাকাত। এখন এমন হয়েছে যে, মনে হয়, বুদাই যেন গোরুর জন্য একগাদা খড় নিয়ে যাচ্ছে।
...অশুভ দানবের শরীরের মতো গাঢ় আঁধার চৌদিকে। এই অন্ধকার রাতে হ্যারিকেন ল্যান্টার্নের আলোয় সে জীবনানন্দের কবিতা পড়ে। দিনের বেলায় কবিতার বই বা কোনো বই সে পড়ে না। আগে পড়ত; এখন পড়ে না। তার অভ্যেস বদলে গেছে। নিজেকে প্রশ্ন করে এরকম উত্তরই সে পেল-স্থান, ও পরিবেশ-পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়। তবুও, তার এই জানার বাইরেও কিছু একটা রহস্য আনাগোনা করে মনের কোণে।
সে ডুব দেয় বনলতা সেন-এ। শতবার পড়েছে। তবু পড়ে যায়। বনলতা এসেছিল তার জীবনে। এসে চলেও গেল। পাশাপাশি বয়ে চলেছিল দুটি নদী-স্রোতস্বিনী নদী সহসাই গতি পরিবর্তন করল। একই মোহনায় পতিত হয়ে প্রেম সাগরে হারিয়ে যাওয়া হলো না।
পাতা উল্টাতে উল্টাতে চোখ গেল 'লাশকাটা ঘর'-এ:
'শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে ফালগুনের রাতের আঁধারে'।
চারপাশ সুনসান। নীরব-নিস্তব্ধ। এইসময় শোনা গেল বুদাইয়ের চিৎকার। তাড়ি খেয়ে পাঁড়মাতাল হয়ে রাতের এই প্রহরে চালায় বসে বুদাই চেঁচায়। এই চিৎকারে গাছে পাখিরা ডানা ঝাপ্টায়, কুকুর চিৎকার করে ওঠে। দূর জঙ্গল থেকে ভেসে আসে শেয়ালের ডাক। মাঝেমধ্যে বুদাইয়ের চিৎকার গোঙানিতে পরিণত হয়। মনে হয় গহীন পাহাড়ের কোনো গুহা থেকে ভেসে আসছে গুরুগম্ভীর হোলো-সাউন্ড। তার মনের গভীরে কী দু:খ লুকিয়ে আছে, জানা হয়নি।
সংরক্ষিত জঙ্গলের পাহারাদার সে। কয়েকজন কর্মচারি আছে: তারা সারাদিন ভেরেন্ডা ভাজে। অকর্মার ঢেঁকি সবকটা। বুদাইয়ের চালা ঘেঁষেই বন শুরু। শেষ হয়েছে দক্ষিণে নদীর তীরে গিয়ে। এই বনে কিছু মূল্যবান গাছ রয়েছে, আর আছে কয়েক প্রজাতির জীবজন্তু। গাছচোরদের কাছ থেকে জঙ্গল বাঁচাবার জন্যই তার এখানে আসা; কিন্তু গাছ চুরি হয়। জীবজন্তুও অবৈধ শিকারিদের হাতে মারা পড়ে। তবে আগের মতো তেমন জোরালো চুরি হয় না, কিংবা অবৈধভাবে বনের সীমানা দখলে চলে যায় না। কিন্তু খুনখারাপি বেড়ে গেছে।
... একসময় সুন্দরবনে তার দায়িত্ব পড়েছিল। বনদস্যুদের হাতে প্রাণ যায় যায় অবস্থা হয়েছিল। আরেকবার সে মানুষখেকো বাঘের অর্ধেক খাওয়া একটা মানুষের অর্ধেক শরীর দেখেছিল। লোকটার মাথাসহ বুক পর্যন্ত অংশ অক্ষত ছিল। লোকটার চোখ দুটো খোলা ছিল, নিষ্প্রভ আতঙ্কভরা চাহনি।
সুন্দরবনে একসময় তার অবস্থানের মেয়াদ ফুরোলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে সে। তারপর এই জঙ্গলে ঠাঁই হলো তার।
বুদাই ঊনিশ বছর যাবৎ এখানে আছে। জঙ্গলের ভেতরে, উত্তর-দক্ষিণ বা পূর্ব-পশ্চিম ঘেঁষে গ্রামের বেওয়ারিশ বা বেঘোরে প্রাণ হারানো নারী-পুরুষের গলিত, অর্ধগলিত বা সদ্য অক্কাপ্রাপ্ত গরম লাশ কুড়িয়ে নিয়ে তার ভ্যানে করে এই পথ দিয়েই মাইলখানেক দূরের সদর হাসপাতালের মর্গে পৌঁছে দেয় সে। সেখানে ডোম রাঙা ভোঁতা ছুরি-কাঁচি দিয়ে লাশ কাটে। রাঙার কাছে লাশের অনেক গল্প শোনে বুদাই। গা হিম করা গল্প। সেই গল্প সে শোনায় জঙ্গলের রক্ষককে।
এখানে কথা বলার কেউ নেই। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে অনেকদূরের কুটির থেকে এক বিধবা মহিলা এসে রান্না করে দিয়ে যায়। বাজার-সদায় করে দেয় বনকর্মী লালু।
বুদাই আসে যখন তখন। বারান্দার মেঝেতে বসে গল্প করে। লাশের গল্প। বুদাই এলে সে বাংলা মদ, তাড়ি ও লাশের গন্ধ পায়। বুদাই ইনিয়েবিনিয়ে নানা গল্প করে শেষে হাত পাতে; সে টাকা দেয়-জানে বুদাই গলা অবধি গিলবে। এই দেয়া-নেয়া অনেকটা অভ্যেসে পরিণত হয়েছে দুইজনেরই।
সারাদিন বনজঙ্গল ঘুরে সন্ধ্যার পর থেকে সময়টা তার খারাপ কাটে। বনলতা সেন ভর করে। তখন সে বুদাইকে ডাকে। অনেকসময় বুদাইকে পায় না, সে হয়তো দূরের জঙ্গলে লাশ কুড়াতে গেছে। এই জঙ্গলে ডাকাতের খুব উৎপাত। হিংস্র ডাকাত তারা। জঙ্গলের ভেতরে, মহাসড়কে তারা ডাকাতি করে। প্রয়োজনে লাশ ফেলে দেয়। আশেপাশের গ্রামেও তারা ডাকাতি করে।
সন্ধ্যার পর সে খাওয়া সেরে, হারিক্যানের আলোয় বই নিয়ে বসে। দীর্ঘরাত পার করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালায়। তখন সে অনেককিছু শোনে, আবিষ্কার করে। রাতচরা পাখির ডাক, বুদাইয়ের গোঙানি ও খিস্তিখেউড় এবং দূরাগত কিছু অজানা শব্দ।
দীর্ঘ একদশক সে পাথরের ভার বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে। বনলতার হঠাৎই ব্রহ্মপুত্রের মতো গতি পরিবর্তন তাকে বিদীর্ণ করে দিয়েছিল। ভৈরব শহরের এক আলিশান বাড়িতে সে পড়াতে যেত বনলতাকে। বনলতার এসএসসি পরীক্ষার যাবতীয় প্রস্তুতি সে সম্পন্ন করে দেয়। বনলতা পাস করে কৃতিত্বের সাথে। বনলতা এবং ওর পিতামাতা তাকে যথেষ্ট খাতির করে নেমতন্ন করে খাওয়ায়, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। উপহার দেয়।
ছাত্রী পড়াবার সময়টায় মেঘনা নদীর ওপর নতুন সড়ক সেতু ও পুরোনো রেলসেতু দেখে অনেক মধুর অপরাহ্ন দুজনের কেটেছে। স্থানীয় কলেজ থেকে বিএ পাস করে সে চাকরির সন্ধানে ছিল। তার বাড়ি ভৈরবেরই কাছে কালিকাপ্রসাদ গাঁয়ে।
ব্রিজের গোড়ায় মেঘনার পাথুরে পাড়ে আছড়ে পড়ছিল ঢেউ। কনক অপলক চেয়ে ছিল ঢেউয়ের দিকে। বাতাসে চুল উড়ছিল। কনক সেই পাথুরে পাড়ে বসে ওর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়েছিল। আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ ছাপিয়ে সে নিজের হৃৎপিন্ডের ধুকপুকানি শুনতে পাচ্ছিল। তার থরথরিয়ে কেঁপে ওঠাটা নজর এড়ায়নি কনকের। শ্লেষের কন্ঠে বলেছিল, 'ভীরু কাপুরুষ। কালিকাপ্রসাদের গ্রামেই আপনাকে মানায়। সেখানে গিয়ে হালচাষ করুন'।
সে বলেছিল, 'বনলতা, এটা কাপুরুষের ভয় নয়: তোমাকে না পাওয়ার ভয়'।
কনক খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, 'বনলতা আবার কী!'
'তোমার নাম, আমার কল্পরাজ্যের রাজকুমারীর নাম। তুমি জীবনানন্দের বনলতা সেন হয়ে আমাকে কোথায় যেন নিয়ে গেছো'।
'কবিতাটা বলুন তো'।
'বলবো। তবে আপনি-আপনি করে বললে বলবো না'।
'বলো এবার'।
সে বলেছিল.....।
ওপারের আশুগঞ্জের সারকারখানার ঝাঁকেঝাঁকে আলো ঠিকরে পড়ছিল কনকের চোখেমুখে। ওর আয়তচোখ, টিকোলো নাক, আর বাতাসে ভেসে আসা ওর এলোকেশের মিষ্টি গন্ধে সে কোনো স্বপ্নের জগতে চলে গিয়েছিল।
'উঠতে হবে জনাব। রাত হয়ে গেছে'। কনকের তীক্ষ্ণকন্ঠে তার চটকা ভেঙেছিল।
সেইরাতে কোনো এক ঘোরের মধ্যে সে বাড়িতে পৌঁছেছিল। কিছুদিন সে স্বপ্নাবিষ্ট ছিল। তারপর একদিন সে আবার হাজির হয় পাথুরে স্থানটায়। কনক আসতে বলেছিল ওকে। কিন্তু আসেনি কনক।
কখনও আসেনি আর....।
সে জানতেও পারেনি অনেকদিন যে, কনকের বিয়ে হয়েছে ঢাকা শহরের এক ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের সাথে। কনকের বাবা ভৈরবের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের একজন, একথাটা সে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। ভুলে গিয়েছিল সে নিজে বিএ পাস করা বেকার ও চাষার পুত্র।
চাকরির বয়সের প্রান্তসীমায় এসে সে অবশেষে বনবিভাগের একটা প্রজেক্টের অধীনে বিট কর্মকর্তার চাকরি পেয়ে যায়। সুন্দরবনে পোস্টিং হয়। ততদিনে সে বনলতা ও কয়েকটি কবিতার বই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল বুড়িগোয়ালিনী নদীর ঘোলা জলে।
একটা দশক কেটে যায়। চুলদাড়িতে পাক ধরে। মৌয়াল, বাওয়ালি ও জেলেদের সাথে মিশে সে তাদের মতোই কাদামাখা ও ধূলিমলিন হয়ে গেল। এইসব চাকরিতে নিজস্বতা বলতে কিছু নেই। একদিন সে জঙ্গলের গহীনে সন্দেহজনক কয়েকজন লোককে বসে থাকতে দেখে চ্যালেঞ্জ করে। তারা ওকে ধরে রামধোলাই ছিল। এরা ছিল ডাকাতদল। সর্দার বলল, 'এরপর এদিকে তোকে দেখা গেলে জানে মেরে ফেলব'। ডাকাত বন্দুকের বাঁট দিয়ে তার পায়ে জুতসই আঘাত করে। সাতক্ষীরা হাসপাতালে ছিল সে কয়েকদিন। তারপর হাসপাতাল থেকে ফেরে খোঁড়া হয়ে। বাম পা তার প্রায় পঙ্গুত্বের পর্যায়ে চলে যায়।
একদিন সে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পায় ঢাকা থেকে আগত বিশেষ অতিথিদলের তদারক করার। সেই অতিথিদলের মধ্যে সে কনককে দেখতে পেল। প্রমোদতরীতে সবচেয়ে উৎফুল্ল ও হাসিখুশি দেখাচ্ছিল কনককে। তার সঙ্গী সুপুরুষ লোকটাকে দেখে সে বুঝতে পারল তিনি কনকের প্রকৌশলী স্বামী। আর সঙ্গের ফুটফুটে বাচ্চা দুটি এই দম্পতির ছেলে ও মেয়ে।
তাকে কয়েকবার সামনাসামনি দেখেও কনক চিনতে পারেনি: চেনার কথাও না বোধহয়। প্রকৌশলী ইশারায় তাকে ডাকলেন। সে এগিয়ে গেলে বললেন, 'আমার স্ত্রীর শখ হয়েছে লঞ্চ থেকে নেমে নৌকায় চড়ে ওই গাছগুলোর ভেতর দিয়ে জঙ্গলে ঢোকার'।
'স্যার, এখন জোয়ারের সময়। তাছাড়া এদিকের এই বাইনগাছের বনে এক বাঘিনী আস্তানা গেড়েছে। বিপদ হতে পারে'।
পাশে দাঁড়ানো কনক ছাইরঙা আকাশ, দুইপাশের সবুজবন ও নদীর দ্রুতগামী হলুদ জল দেখছিল। তার কন্ঠ শুনে চমকে তাকাল। বলল, 'আপনাকে কেমন চেনা লাগছে'।
সে প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসল। কনক বলল, 'চিনেছি, আপনি এমন হয়ে গেছেন কেন? আর খুঁড়িয়ে হাঁটেন কেন?'
নৌকায় চড়া যাবে না বুঝে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব দুই ছেলেমেয়ের হাত ধরে রেলিং ঘেঁষে অন্যদিকে চলে গেলেন ভিন্নমাত্রার কোনো দৃশ্য আবিষ্কারে।
'বিয়ে করেননি?'
'না'।
'এখানে আপনি কী করেন?'
'এটা আমার চাকরি। জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই। অতিথিদের খেদমত করি'।
'কী অবস্থা হয়েছে আপনার! আয়নায় নিজেকে দেখেন?'
'না' টলটলে চোখে কনকের দিকে তাকিয়ে সে বলল, 'মনের আয়নায় নিজেকে দেখি। তাতেই বুঝি আমি কেমন আছি। এই বুড়িগোয়ালিনী নদীতে ফেলে দিয়েছি কবিতার বইগুলো'।
কনক করুণ চোখে তাকাল তার দিকে। সে বলল, 'কনক, তুমি প্রতারক'।
কিছু বলার জন্য কনকের মুখ হাঁ হলো। সে দাঁড়াল না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অন্যদিকে চলে গেল।
কনকের সাথে কাকতলীয় দেখা হবার কদিন পরই তার বদলি হয় গজারিবনে। বাঘের চেয়েও ভয়ঙ্কর এখানকার মানুষ--তারা নানা কায়দায় বনভূমির জায়গা গ্রাস করে। ডাকাতেরা খুন করে। আর নোংরা রাজনীতির শিকার মৃত মানুষগুলোকে এখানে ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা।
এসব মানসিক অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে একদিন সে শহরে গিয়ে কয়েকটি কবিতার বই কিনে আনে। বইগুলোর অবয়ব যেন কনকের মতো। রাতের নিরালায় বইগুলো কথা বলে তার সাথে। তার চোখে ভাসে পাথুরে পাড়, ঝকঝকে আলো, ঢেউয়ের ওপর সাপের মতো মোচড় খাওয়া লাল নীল সবুজ আলো, আর নাকে এসে লাগে সুবাসিত চুলের গন্ধ।
বিস্মিত হয়ে সে ভাবে- এখনও সে ভুলতে পারেনি কনককে। প্রতারিত হওয়ার ক্ষতের চেয়েও না পাওয়ার ব্যথাটাই বুকে বড়ো বাজে।
সকালবেলা তার ঘুম ভাঙে বুদাইয়ের চেঁচামেচিতে। 'কী হলো বুদাই, চিৎকার করছো কেন!'
'কাইল রাইতে বহুত ডর খাইছি'। বুদাইয়ের শরীর কাঁপছে, 'এহনও ডর লাগতাছে'।
'কেন? কী হয়েছে'।
'সাব, কাইল সন্ধ্যায় একটা মেয়েলোক খুন হইছে জঙ্গলের পশ্চিমের শেষ সীমানায়। খানকি মেয়েলোক। খদ্দেরের লগে পয়সা লইয়া কথা কাটাকাটি হয়। খদ্দেররা ডাকাইত ধনু মিয়ার চ্যালা। তারা টাকা দেয় নাই। খানকিও জবর ডাকাইত, সে-ও ছাড়ব না। কোমর থেকা ছুরি বাইর কইরা একজনের পিঠে বসাইয়া দেয়। তারপর চ্যালা চারজন ছুরি বহাইয়া দেয় মেয়েলোকটার পেটে আর পিঠে। খবর পাইয়া পুলিস আসে। একজন পুলিস দুপুর রাইতে আমারে আইসা বইলা গেল লাশকাটা ঘরে দিয়া আসতে। আমি ভ্যানে লাশ উঠাইয়া নিয়া আসতাছি হঠাৎ মেয়েলোকটা কইল, 'আমারে বাঁচান বুদাই ভাই'। আমি ফাল দিয়া ভ্যান থেকে পইড়া দিলাম দৌড়।
'লাশ কথা বলল! তারপর?'
'কথা কইল সাব, নড়ল-চড়ল। আমি তারপর একদৌড়ে আইসা চালায় উঠি। এখন আপনার কাছে আইলাম'।
'লাশ কই এখন?'
'জানি না। ওইহানেই আছে বোধহয়'।
'তোমার ভ্যান?'
'ওইহানেই'।
পোড়খাওয়া বিট কর্মকর্তা, একসময়ের বনলতার প্রেমিক আশিকুর রহমান আশিকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সে বুদাইকে পছন্দ করে, তার মতো একাকী একটা মানুষ। আর তার নিত্যদিনের সঙ্গী। সে বলল, 'চলো তো গিয়ে দেখি'।
আধমাইল হেঁটে তারা দুজন লাশের কাছে এলো। আশিক লাশের একদম কাছে চলে এলো। সে চিনতে পারল মেয়েলোকটাকে। নাম পারুল। স্বামীতাড়িত মা-বাপ মরা এই মেয়েটা নিশীথিনীর মতো ঘুরে বেড়াত এই জঙ্গলে। একরাতে সে আশিকের দরজায় টোকা দেয়।
'কী চাই?'
'স্যার, আমার নাম পারুল'। মেয়েটি কান্নাভেজা কন্ঠে বলল, 'দুইদিন পেটে দানাপানি পড়ে নাই। খদ্দের জোটে নাই। আপনে তো একলা মানুষ। আপনের একটু সেবা করতে দেন। আমার পেটটাও ভরুক'।
'পেটে দানাপানি না পড়লে আমার ঘরে খাবার আছে খাও। কোনো সেবাটেবা আমার লাগবে না'।
'আচ্ছা স্যার, দেন একটু ভাত'।
মেয়েটি গোগ্রাসে গিলছিল দেখে আশিকের মনে হলো একবিন্দু মিথ্যে বলেনি মেয়েটা। খেতে খেতে শাড়ির আঁচল দিয়ে সে নাকমুখের জল মুছছিল। আশিক আদ্যোপান্ত প্রশ্ন করে মেয়েটির সবকিছু জানল। কেন সে দেহপসারিনী আর কেনই বা ক্ষুধার্ত। খাওয়া শেষ হলে সে মেয়েটির হাতে কিছু টাকা তুলে দিল। একটুকরো শুকনো হাসি দিয়ে পারুল বলেছিল, 'ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করবেন'।
সেই পারুল। আশিক কী যেন ভাবল। তারপর আরও এগিয়ে গিয়ে মেয়েটির গলায় বাম হাত রেখে বিড়বিড় করে বলল- 'বেশিক্ষণ হয়নি মারা গেছে। শরীর এখনও গরম'।
বুদাইয়ের দুই হাঁটু কাঁপছে। সেদিকে তাকিয়ে আশিক বলল, 'কাল গলা পর্যন্ত খেয়েছিলে, না? তুমি খুব বিপদের মধ্যে আছো, বুদাই'।
একথায় বুদাই ঘোলাটে চোখে তাকাল।
আশিক আবার বলল, 'তুমি দুইটা খারাপ কাজ করেছো। মেয়েটি যখন বলল, আমাকে বাঁচান। তুমি দৌড়ে না পালিয়ে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলে মেয়েটি বেঁচে যেত। তা না করে তুমি ভয় পেয়ে পালালে। সুরতাহলে তারা পারুলকে নিশ্চল দেখে ভেবেছিল মরে গেছে। আর তাকে কথা বলতে দেখে তুমি ভাবলে কোনো পিশাচিনী সে। তোমার বিপদটা হলো এই যে, কাল মাঝরাতের লাশ এখন এই বেলা দশটায়ও তুমি মর্গে পৌঁছাও নাই। তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। ফেঁসে যেতে পারো'।
বুদাই হাউমাউ করে কেঁদে আশিকের পায়ে লুটিয়ে পড়ল। বিকৃত কন্ঠে বলল, 'সাব, আমারে বাঁচান'।
আশিক বলল, 'তুমি লাশ নিয়ে রাঙার কাছে যাও। আমি আসছি'।
বুদাই এক দৌড়ে ভ্যানের দিকে ছুটে গিয়ে ভ্যান ও লাশ নিয়ে হারিয়ে গেল জঙ্গলের বাঁকে।
সাড়ে এগারোটায় আশিক উঁকি দিল লাশকাটা ঘরে। শরীর গুলিয়ে উঠল। পারুলের দেহটা একটা লম্বাটে টেবিলে রেখে একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে ছিল রাঙা। মুখে রুমাল চাপা দিয়ে আশিক বলল, 'রাঙাদা, আপনার সাথে দেখা করতে এলাম'।
খেঁকিয়ে উঠল রাঙা। বলল, 'সবাই রাঙা ডোমরে দেখলে দৌড়াইয়া পলায়। আর আপনে আইছেন আমার লগে দেখা করতে। ক্যাডা আপনে?'
'আমার নাম আশিকুর রহমান। বিট অফিসার'।
'আপনার নাম শুনছি বুদাইয়ের কাছে। আপনে ভালো মানুষ। তা কী করতে পারি আপনার জন্য?'
'আমি তো ভালোমানুষ। বুদাই কেমন মানুষ?'
'সে ও ভালোমানুষ। আর আমার দোস্ত'। একটুকরো হাসি খেলে গেল রাঙার মুখে।
রাঙাকে একপাশে ডেকে নিয়ে সব খুলে বলল আশিক। একগাল হাসল রাঙা। বলল, 'কোনো চিন্তা করবেন না সাহেব। লাশ ধরেন গিয়া আমি রাইতেই পাইছি। আরও তিনডা লাশ আছে। পারুলের লাশ কাটতে দেরি অইতেই পারে'।
আশিকও হাসল, পকেট থেকে একতাড়া নোট বের করে রাঙার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, 'তোমাদের তো আবার কতকিছু লাগে-বাংলা, হাঁড়িয়া, তাড়ি। এমনি আরও কতকিছু'।
মাঝবয়সী রাঙার ভাঙাচুরা মুখ ঝলমলিয়ে উঠল প্রাপ্তিযোগে। বুদাই দৌড়ে এসে ফের আশিকের পায়ে পড়তে গেল। আশিক দ্রুত সরে গিয়ে মড়ার গন্ধভরা ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলো।
পারুলের জন্য একটা চিনচিনে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল দেহজুড়ে। খানিকবাদেই পুরোনো-ভোঁতা ছুরিতে খন্ডিত হবে মেয়েটা।
বাংলোতে ফিরতে ফিরতে মনের মধ্যে ভেসে উঠল প্রমোদতরীর সেই নারীকে। নিজের অজান্তেই মাথা ঝাড়ল সে-না, না। এই মুখ সে দেখতে চায় না।
সে দেখতে চায় আরও আগের একটা মুখ, আয়ত দুইচোখ মেলে চেয়ে আছে তার দিকে। বাতাসে তার চুলের মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগছে...।
এমনি একটা মুখ চিরভাস্বর হয়ে থাকুক মনের কোঠায়।