• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৪ | মার্চ ২০১৯ | গল্প
    Share
  • নিউ ইয়র : নিবেদিতা দত্ত


    এবড়ো খেবড়ো ধান কাটা খেতের মত মুখটা একপাশে তেবড়ানো, কপাল ভর্তি ব্রণ মার্কা ছোট ছোট ফোঁড়া, কিম্বা ব্রণই হবে, পুঁজ ভরে অমন মনে হচ্ছে। আধ ময়লা টি-শার্টের বোতাম খোলা জামা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ঘাম ভরা লোমে ঢাকা একটা জিরজিরে বুক--তবে ধুকপুক করছে ঠিকই। লোক্যাল ট্রেনের গোঁত্তা খেতে খেতে প্রাণ আঁকড়ে ধরার মতই সবুজে হলুদে স্ট্রাইপ পাতাবাহারের ঘেরে বসানো ছটা জিনিয়া, দুটো গ্ল্যাডিওলি আর একটা সাদা অর্কিড ডালের ব্যুকেটা ধরে ছিল ও। ফুলের গন্ধের চেয়ে ভিড়ের ঘাম গন্ধটাই ওর বেশি স্বাভাবিক লাগছিল। শুধু একটু বসতে পেলে ভালো হত। অবশ্য না পেয়ে ভালোই হয়েছে। সেই কোন ভোরে উঠেছে--বসলেই তো ঘুম, আর ঘুমলেই সাধের ব্যুকেটা যদি মাটিতে--আর তারপরই তো মালিকের গাল, রূপেয়া কাটা--নাহ, না বসতে পেয়ে ভালোই হয়েছে।

    সকালবেলাটা ভালোই ছিল। ফুল দুকান থেকে (ও ফুল দুকানই বলে, ওসব ফ্লরিষ্ট না কি যেন ওর অত মনে থাকে না) মাল নিয়ে ছটার বস ধরে হাওড়া টিশান। মালিক ঠেকানা, ফোন নম্বর, ওউর টিকেটের টাকাভি দিছে। বসে উঠেই ও ফন্দি আঁটছিল যদি বে-টিকটে মেরে দিতে পারে টিরেনটা, তব কঠো রুপেয়া জেবে রহে যায়। একঠো পিলাটফরম কেটে উঠে পড়বে, ধরলে বলবে ‘বাবুদের হয়ে গিয়েছিল, কি করবে।’--এসবে ও চোস্ত।

    যেমন ভাবা তেমন কাজ, আর ফার্স্ট লোক্যালটাই পেয়ে গিয়েছিল। আই বাপ, পিলাটফরমে মছলি কা ক্যায়সা আঁইশা মহক! ব্যুকেটা সামলাতে সামলাতেই ভাবছিল ‘দেখা যায় লোট কর অগর অন্ডা কারি রোটি খানে কো মিল যায়,--ছে আঠঠো তো জরুর খাবেক ই।’ টিরেনে খুব ভিড় ছিল না। কিন্তু ওই এক নিউ ইয়ারকা ধামাকা। রং বিরঙ্গি ডিরেস পরা ছেলে বুড়া মেয়ে-মরদ। ওর গর্দানে কিছু একটা বিন বিন করছিল। ‘মক্ষী হো সকতা ইয়া ধীরে সে গিরতে হুয়ে পসিনা’--ও ভাবলে। ওর বোঝার উপায় ছিল না। দোনো হাঁথ ই তো ফুলের ব্যুকেটা পকড়ে আছে। ‘উঠো খরাব হোনা নহী চাহিয়ে। বহি তো জিন্দগি !’-- ও জানে।

    কোলাঘাটে দল দল নামল, পিকনিক হোবে, কে যেন ওর ডান পাটা মাড়িয়ে দিল নামার সময়। ব্রিজ যখন পেরোচ্ছিল ট্রেন, চোখে পড়েছিল ওর ওই অত দূর থেকে রক্তমাখা মুরগির পালক, কদিনের মোচ্ছবের চিহ্ন। লোকটা একবার ভাবলে ‘থোড়া চায় হো যায়, এক ছোটা পিয়ালি হি তো হ্যায়।’ কিন্তু আবার পিছিয়ে গেল, যদি তাতেও হাল্কা হতে লাগে! ‘নহি বাবা, মাল ডিলিভ্রিরি সে পহলে কুছ নহি। ব্যুকে মিট্টি পর রখনে সে অগর পিসাব কা ছিটা লগ যায়? ভুখ পেয়াস দবানে কে লিয়ে গুটখা তো হইয়ে হ্যায়।’

    খড়্গপুরে নেমে একটা ফোন করল মোবাইল নম্বরটায় (মোবাইল একটা ও রাখে কাজের জন্য)। ওধার থেকে ফোন লাগতে অতি কষ্টে বানান করে পড়ল ঠিকানা আর নামটা। নাহ ঠিকই আছে। কুছ একঠো বড়া কালেজে যাতে হোবে। রেকশা নেবে না, তা ভেবেই রেখেছিল। পায়দলেও আর দিল করছে না উতনা টেম টিরেন মেঁ খড়া রহনে কে বাদ। শেষমেষ ট্রেকারেই উঠল ও।

    যুদ্ধ প্রায় শেষ, ঠিকানা ঠিক খোঁজা গ্যাছে। এক মাইজী এসে ফুল নিলে। আবার বলে ‘ইতনা থক গিয়া, কুছ খাও’--ও বলেছে ‘জী নহি অম্মা।’ তবে কখনো যা করে না সেই গুনাহই করে বসল ও সেদিন। ব্যুকে থেকে একটা ছোট্ট ফুল ছিঁড়ে পকেটে লুকিয়ে রেখেছিল। মাল ডিলিভ্রিরি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে টিশানের একটা চা গুমটির বেঞ্চিতে বসে ফুলটা বার করে আনমনে পাপড়ি গুলো ছিঁড়ে কোরকটা নোংরা চটি দিয়ে মাটিতে পিষে দিল ও। বেশ লাগল। তারপর আধময়লা বোয়ামে রাখা তেলচিটে কেকগুলোর দিকে চোখ পড়তে একটা নিয়ে চা খেয়ে বিড়ি ধরাল ও--এবার বেশ নয়া সাল নয়া সাল লাগল ওর।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments