জমিদারকন্যা অমলাবালাকে বিবাহ করিয়া রসিকলাল নিতান্তই বিপাকে পড়িয়াছিল।
আপনারা যাহা ভাবিতেছেন তেমন কিছুই নহে। অমলা অতীব সুশ্রী ও গুণবতী, দেনা-পাওনা লইয়া দুই পরিবারে কোনও বিসম্বাদ হয় নাই এবং শ্বশুরালয়ে রসিকের আদরযত্নেও কোনও ত্রুটি ছিল না। সমস্যা সেসব কিছুই নহে, কিন্তু বিবাহ করিয়া রসিকলালের জীবনে আর সুখ রহিল না। কেননা তাহার কানে আসিয়াছিল, জমিদারের কন্যা শিক্ষিতা। আর বিদ্যার প্রতি রসিকের এক নৈসর্গিক অনীহা ছিল।
শুরু হইতেই বিবাহে রসিকের ঘোর আপত্তি ছিল। স্বভাবে সে স্বাধীনচেতা, আর কারো বশে থাকিবার পাত্র নহে। বিশেষত কোনও স্ত্রীলোকের। কিন্তু পিতাকে সে ভয় করিয়া চলে। তাহার পিতা সম্ভ্রান্ত কারবারী। প্রভূত জমি-জমাও আছে। তিনি অত্যন্ত রাশভারী ও খুব হাঁক-ডাক, গ্রামের সকলে সমীহ করে। তাঁহার রক্তচক্ষুর সামনে রসিকলালের সকল প্রতিরোধ খড়কুটার মত উড়িয়া গিয়াছে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই পিতার নির্বাচিত পাত্রীকে বিবাহ করিতে হইয়াছে। শুধু তাহাই নহে, জমিদার কুটুম্বের সঙ্গে মিলিত ষড়যন্ত্রে পিতা পুত্রকে তাহার শ্বশুরালয়ে নির্বাসন দিয়াছিলেন।
এখানে বলিয়া রাখা যায় যে রসিক ও অমলার বয়ঃক্রম যথাক্রমে সতের ও চৌদ্দ বৎসর। তা যে সময়ের কথা তখন কুলীনের ঘরে এ রকমই হইত। বিংশ শতাব্দীর সেই তরুণ বয়সে মানুষের জীবনযাত্রায় জটিলতা কম ছিল। বিশেষত পারিবারিক জমিদারি থাকিলে কুলীন বঙ্গসন্তানকে উপার্জনের চিন্তা করিতে হইত না। অল্প বয়সেই বিবাহ করিয়া ফেলাটা প্রায় আবশ্যিক সংস্কার হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। তৎকালে আইনত জমিদারী প্রথা নিরস্ত হইয়াছিল বটে, জমিদারবর্গ বিলুপ্ত হয় নাই।
পিতার অমানবিক চক্রান্তে রসিক নিরতিশয় ক্ষুব্ধ হইল, কিন্তু কিছুই করিতে পারিল না। বিবাহের পরে সুবোধ বালকের মত এক পুণ্যপ্রভাতে তাহাকে শ্বশুরালয়ে আসিয়া উপস্থিত হইতে হইল।
প্রাগ্বিবাহ পরিচিতির তো প্রশ্নই ছিল না। বাসর রাত্রেও শ্যালিকাবাহিনীর আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত থাকায় অমলার সহিত আলাপের বিশেষ সুযোগ পায়নি রসিক। নিজগৃহে বধূবরণ ও পাকস্পর্শের লোকাচার সমাপনান্তে অচিরেই বধূ ফিরিয়া গিয়াছিল পিতৃগৃহে। অতএব এক মাস হইল তাহাদের বিবাহ হইয়াছে, কিন্তু ইতিপূর্বে অমলার সহিত নিভৃত সাক্ষাতের সুযোগ হয় নাই রসিকের। তাই শ্বশুরালয়ে আসিয়া স্ত্রীর সহিত প্রথম পরিচয়ের নিমিত্ত সে কিছু শঙ্কিত ছিল।
আজই তাহাদের প্রকৃত ফুলশয্যা। দুরু দুরু বক্ষে পুষ্পসজ্জিত শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া বিদুষী স্ত্রীর নিকট নাকাল হইবার আশঙ্কায় রসিক প্রথমে একটু বেশী বেশী হুকুমবাজী শুরু করিয়াছিল। কিন্তু দেখা গেল অমলা বিদ্যায় রসিককে টেক্কা দিলেও স্বভাবে অত্যন্ত সুশীলা। এবং রূপলাবণ্য তাহাকে বিন্দুমাত্র অহমিকা প্রদান করে নাই। একান্ত অনুগতভাবে সে রসিকের সকল ফরমায়েস তামিল করিতে লাগিল। রসিক যখন বলিল, পা টিপে দাও, অমলা তৎক্ষণাৎ তাহাই করিল। রসিক বলিল, গান শোনাও। অমলা গান শোনাইল। রসিকের মন একটু ভিজিয়া আসিয়াছিল। এইবার বলিল, তুমি কী কী পড়ো?
অমলা ভয়ে ভয়ে বলিল, এই বাংলা, ভূগোল, ইতিহাস, অংক আর ইং—
রসিকের চক্ষু ছানাবড়া হইয়া গেল, বলিল, অ্যাঁ— সেকি? তুমি ইংরিজিও জানো?
—হ্যাঁ, একটু একটু। কেন?— রসিকের হাবভাবে ঘাবড়াইয়া গিয়া অমলা প্রশ্ন করিল।
সে কথার উত্তর না দিয়া রসিক চ্যালেঞ্জের সুরে বলিল, ইংরেজিতে বল দেখি, আমি তোমার বউ?
অমলা একটা ঢোঁক গিলিয়া বলিল, আই অ্যাম— ইয়ে— ইয়োর ওয়াইফ।
'ওয়াইফ' শব্দটি রসিকের জানা ছিল না। অনুমানে বুঝিল অমলা ভুল বলেনি। তীক্ষ্ণস্বরে ফের বলিল, হুম। এবার বল তো— পতি পরম গুরু, ইংরেজিতে কী হবে?
—হাজব্যান্ড ইজ— মানে— হাজব্যান্ড ইজ—।
বেচারি অমলা। সে কি আর জানিত স্বামীর সহিত প্রথম রাত্রে তাহাকে ইংরাজীর পরীক্ষা দিতে হইবে? সহসা 'পরম গুরু' শব্দের তর্জমা করিতে পারিল না সে। ইহাতে পরম হৃষ্ট হইল রসিক। স্বস্তির শ্বাস লইয়া বলিল, হয়েছে হয়েছে। বোঝা গেছে তোমার বিদ্যের দৌড়।
মুখে বলিল বটে, কিন্তু অন্তরে বুঝিল— অমলার বিদ্যার দৌড় তাহার চেয়ে ঢের বেশী। তাহার পুরুষকারে বিলক্ষণ আঘাত লাগিল। মনে মনেই ভাবিল, ওসব বিলাতী বুলি কপচাইয়া আমার কী লাভ শুনি? রসিক যাহা পারে তাহা পারিবে এই বালিকা? অমলা কি পারিবে ময়দার সঙ্গে কাচের গুঁড়া ও গঁদ মিশাইয়া ক্ষুরধার মাঞ্জাসুতো তৈয়ারি করিতে? সে কি জানে তুবড়ির মশলায় কী পরিমানে গন্ধক, সোরা, কাঠকয়লা আর ধাতুচূর্ণ মিশাইতে হয়? নিঃশব্দে গিয়া ক্লাসে নিদ্রাতুর পণ্ডিতমহাশয়ের শিখা চেয়ারে বাঁধিয়া দিবার কৌশল কি অমলার জানা আছ?
অবলা নারীকে এ সব শক্ত প্রশ্ন করিয়া আর বিব্রত করিল না রসিক। গম্ভীর হইয়া বলিল, শোন, ইংরেজি পার বা না পার, কথাটা কিন্তু মনে রেখ— পতি পরম গুরু। আমি তোমার স্বামী আর তুমি আমার দাসী। তাই আমি যখন যা বলব তাই করবে, বুঝলে?
অমলা সন্ত্রস্তচিত্তে তৎক্ষণাৎ গ্রীবা হেলাইয়া সম্মতি জানাইল। স্ত্রীকে যথোচিত শাসন করা গিয়াছে ভাবিয়াও কিন্তু রসিকের স্বস্তি হইল না। মনের কোনে যেন একটা কাঁটা খচখচ করিতেছিল। কী করিবে বুঝিতে না পারিয়া চিন্তিত স্বরে সে বলিল, কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি তো আমার চেয়ে অনেক বেশী পড়ে ফেলেছ! এখন কী হবে?
অমলা আতঙ্কিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কিসের কী হবে?
—বউ বরের চেয়ে বেশী লেখাপড়া জানলে কী হয় জানো তো?
অমলা চক্ষু বড় বড় করিয়া বলিল, না তো। কী হয়?
কী যে ঠিক হয় তাহা রসিকও জানে না, কিন্তু স্বামীর আত্মসম্মানে যে লাগে সেটা বিলক্ষণ অনুভব করিল। মুখে বলিল, সে খুব খারাপ হয়। এক কাজ করো। আজ থেকে রোজ রাত্তিরে তুমি যা যা পড়েছো, আমাকে সব বলবে। আমিও একটু একটু করে তোমার কাছ থেকে সব শিখে নেবো, কেমন? আর শোন, এসব কথা আর কাউক্কে বলবে না যেন।
অমলা সত্যই ভয় পাইয়াছিল। বুদ্ধিমান স্বামী সমস্যার কেমন সুন্দর সমাধান করিয়া ফেলিল দেখিয়া আশ্বস্ত হইল। মুখে হাসি ফুটাইয়া জানাইল সে কাহাকেও এসব বলিবে না।
অমলার এই বশম্বদ রূপটি রসিকের বড় ভাল লাগিল। অমলার মুখের দিকে তাকাইয়া তাহার বুকের মধ্যে কেমন যেন শিরশির করিয়া উঠিল। অতঃপর ইহাকে কী বলা যায় ভাবিতে ভাবিতে নিধুদা'র কথা মনে পড়িল রসিকের।
ছয় মাস পূর্বেই নিধুদাদার বিবাহ হইয়াছে। নববিবাহিতা বধূকে লইয়া দাদা একেবারে মাতিয়া উঠিয়াছিলেন। ভাববিহ্বলতার কোনও এক অসতর্ক মুহূর্তে পর্দার ফাঁক দিয়া তাহাদের ঘনিষ্ঠ যুগলদৃশ্যের একঝলক দেখিয়া ফেলিয়াছিল রসিক। দেখিয়াছিল নতুন বউদিদি দাদার কণ্ঠবেষ্টনপূর্বক তাঁহার মুখ লক্ষ্য করিয়া আপন অধরোষ্ঠ লইয়া আসিতেছিলেন! দাদাও চক্ষু মুদিয়া সাগ্রহে কোনও কিছুর প্রতীক্ষা করিয়া ছিলেন। ঠিক তখনই হুলোটা তাক হইতে একটা ক্যানেস্তারা ফেলিয়া হুলুস্থুল বাঁধায়। তাইতে বউদিদি আর কিছু করিতে পারেন নাই, ছুটিয়া পলাইয়া গিয়াছিলেন। দাদাও যেন আকাঙ্ক্ষিত বস্তু না পাইবার হতাশ বিরক্তিতে উদাস হইয়া গণ্ড চুলকাইতে লাগিলেন।
নবদম্পতির এমত আচরণের কারন রসিকের বোধগম্য হয় নাই। রসিকের সন্দেহ, বউদিদি নির্ঘাত দাদার অধরে কামড় দিতেন। কিন্তু নববধূ কেন স্বামীকে কামড়াইতে পারে তাহার কোনও ধারণা ছিল না রসিকের। রমণীর লজ্জারুণ মুখে সেদিন কোনও হিংস্র অভিসন্ধি ছিল বলিয়া তো মনে হয় নাই। দাদারও মধ্যে ছিল না বধূ কর্তৃক আক্রান্ত হইবার আশঙ্কা। ইহা ঠিক কী ছিল তাহা লইয়া সন্দেহের অবসান হয় নাই, কিন্তু এক অজানা রোমাঞ্চ রসসিক্ত করিয়াছিল রসিকের উদ্দাম অনাহত কিশোর মন।
আজ অমলাকে পাইয়া সে সন্দেহের অবসান করিয়া লইতে চাহিল রসিক। কণ্ঠস্বরে স্বামীসুলভ গাম্ভীর্য আরোপ করিয়া সে বলিল, এবার কাছে এস।
অমলা ভয়ে ভয়ে তাহার কাছে সরিয়া আসিল। রসিক অমলার দুই হাত নিজের স্কন্ধে স্থাপন করিয়া আজ্ঞা করিল, এবার আমার ঠোঁটে একটা কামড় দাও দিকিনি। আবার দেখো, জোরে কামড়িও না যেন।— এই বলিয়া চক্ষু মুদিল।
—এমা না—! সশঙ্ক অস্ফুটবাক্যের সঙ্গে তাহার স্কন্ধ হইতে অমলার হাত সরিয়া গেল। চক্ষুরুন্মীলন করিয়া রসিক দেখিল, পালঙ্কের এক প্রান্তে অমলা দুই হাতে মুখ ঢাকিয়াছে।
—কী হল, দাও বলছি। রসিক কড়া হইয়া বুঝাইয়া দিল স্ত্রীর অবাধ্যতায় সে অসন্তুষ্ট।
অমলা বারংবার মাথা নাড়িয়া 'না—না—' বলিতে লাগিল। রসিক রাগিয়া বলিল, কেন দেবে না? বউদের দিতে হয়। দেখ গিয়ে নিধুবৌদিদিকে।
—ওমা! সে আবার কে?
—সে আছে আমার এক বউদিদি। চান্স পেলেই দাদাকে কামড়ায়। আমি নিজে দেখেছি। মানে, প্রায় দেখে ফেলেছিলাম। খামোখা হুলোটা শব্দ করে দিল, না হলে—
মাঝপথে কথা বন্ধ করিয়া রসিক দেখে তাহার বউ এবার ফিক ফিক করিয়া হাসিতেছে। রসিক আশ্চর্য হইয়া বলে, এতে হাসবার কী হল?
—বা রে, হাসব না? তুমি যে কিছুই জানো না।— অমলা লজ্জায় অধোবদন হইয়া বলিল, ওতো চুমু। ইংরেজিতে বলে কিস।
চুমো? সে তো বড়োরা দেয় বাচ্ছাদের। ঠানদিদি কিংবা পিসিমা রসিকের চিবুক স্পর্শ করিয়া মুখে চুক্ করিয়া শব্দ করেন। কিন্তু কিস—? নাহ্, শিক্ষিতা স্ত্রী লইয়া তো মহা ফ্যাসাদ। রসিক আর সহ্য করিল না। অমলার হাত ধরিয়া সে তাহাকে কাছে টানিয়া আনিল। রাগতস্বরে বলিল, স্বামীকে নিয়ে মস্করা? দ্যাখাচ্ছি মজা।
রসিকের হাত ছাড়াইয়া অমলা বালিশে মুখ লুকাইল। তাহার অনিন্দ্যসুন্দর মুখে লজ্জার সাথে আর যে সকল ভাবের সমাগম হইতেছিল রসিক তাহা দেখিতে পাইল না। খানিক হতবুদ্ধি হইয়াও কিন্তু সে হার মানিল না, পুনরায় অমলাকে বাহুবেষ্টনে আবদ্ধ করিয়া তাহার মুখখানি নিকটে আনিয়া বলিল, শিগগির দাও বলছি।
—কী?
—কী আবার? চুমো। ঐ— ইয়ে— কিস। শিগগির দাও।
—এমা, কী যে কর তুমি— অমলা তাহার মুখখানি অন্যদিকে ফিরাইয়া যথাসাধ্য বাধা দিতেছিল। কিন্তু অবশেষে বুঝিল আর উপায় নাই। তখন হাত বাড়াইয়া ঘরের বাতিটা নিভাইয়া দিল।
২
অমলাকে পাইয়া বিবাহের প্রতি রসিকের ভীতি দূর হইয়া গেল। বিবাহ যে এত মধুর কে তাহা জানিত?
আসলে পিতার সঙ্গে বড়মা'র আচরণের স্মৃতি রসিকের বড়ই অরুচিকর ছিল। তাহার পিতার দুই সংসার। জ্যেষ্ঠা নিঃসন্তান, রসিকের মাতা কনিষ্ঠা। তা সেই বড়মা'র শাসনে তাহার প্রবলপ্রতাপ পিতাকে প্রায়শই যেরকম হেনস্থা হইতে দেখা যাইত, তাহাতে আর একটি স্ত্রীলোকের হাতে নিজেকে সঁপিয়া দিতে রসিকের মত নির্ভীকের চিত্তেও বিস্তর আপত্তি ছিল। তাই বিবাহে সে প্রবল বিরোধীতা করিয়াছে। লাভ হয় নাই, গুরুদেবের মধ্যস্থতায় তাহার পিতা পাশের গ্রামে অবস্থাপন্ন পালটি ঘর পাইয়া একপ্রকার ধরিয়া বাঁধিয়াই রসিককে কন্যাস্থ করিয়াছেন।
পুত্রের বিবাহের কোনও ত্বরা ছিল না, পিতা হয়ত আরও কিছুদিন অপেক্ষা করিতে পারিতেন। কিন্তু তাহা সম্ভব হইল না। ইহার কারণ রসিকলালের দুর্দমনীয় স্বভাব। প্রতিবেশীদের নালিশে রসিকের পিতা পূর্বেই জর্জরিত ছিলেন। উপরন্তু রসিকের স্কুলের প্রধান শিক্ষক সম্প্রতি এই দাঙ্গাবাজ ছাত্রটিকে আর স্কুলে রাখিতে অপারগতা জানাইয়া দিয়াছিলেন। কুটুম্ব হরনাথ মুখুজ্জে রায়বাহাদুর, সায়েব-সুবোদের সঙ্গে তিনি খানা-পিনা করিয়া থাকেন। আপনার প্রতিপত্তিতে তাঁহার আস্থা ছিল বলিতে হইবে। তাই সব জানিয়াও বিবাহসূত্রে তিনি এই অর্বাচীনের হস্তে আপন কন্যাকে সমর্পন করিতে সম্মত হইয়াছিলেন। বিবাহোত্তর কালে তিনি তাঁহার স্কুল হইতে নাম-কাটা জামাতাকে নিজগৃহে শিক্ষাদান পূর্বক মানুষ করিয়া লইবার অঙ্গীকারও করিয়াছিলেন।
রসিকের পিতার ইহাতে সর্বতোভাবে সুবিধা হইয়াছিল। কৃতজ্ঞতাবশত রায়বাহাদুর যখন কন্যাকে বিবাহের পর শ্বশুরগৃহে না পাঠাইয়া আরও কিছুদিন নিজের কাছেই রাখিবার প্রস্তাব করিলেন তাহাতেও রসিকের পিতা সানন্দে সম্মতি দিলেন। বধূমাতা নিতান্তই বালিকা, কিছুদিন পরে শ্বশুরবাড়ী আসিলে কোন ক্ষতি নাই। গাধাটা ইত্যবসরে বিদ্যার্জন করিয়া যদি খানিকটা মানুষ হয় তাহাই অনেক।
স্ত্রীর সহিত পরিচয় হইতে রসিক দেখিল বড়মা'র মত অমলা উঠিতে বসিতে গঞ্জনা দেয় না। অমলার ভাষায় নাই বড়মা'র কর্কশ ঝংকার। শ্বশুরালয়ে পদার্পণ করিবার দিন কয়েকের মধ্যেই রসিক তাহার বউকে ভালবাসিয়া ফেলিল।
কিন্তু অচিরেই রসিকের জীবনে মূর্তিমান খলনায়ক রূপে আবির্ভূত হইলেন তাহারই শ্বশ্রুমহাশয় রায়বাহাদুর হরনাথ মুখুজ্জে। পিতার প্রশ্রয় পাইয়া রায়বাহাদুর বড় নির্দয়রূপে জামাতাকে 'মানুষ' করিয়া লইতে বদ্ধপরিকর হইয়াছেন। রসিক অত্যন্ত অনিচ্ছার সহিত মালীর কাছে ফুলকারী, মল্লবীরের সঙ্গে ব্যায়াম ও শ্বেতাঙ্গ গৃহশিক্ষকের নিকট ইংরাজির পাঠ লইতে শুরু করিল।
ইহাতেও আপত্তি ছিল না। অমলাকে পাইবার এই মূল্য অতি সহজেই স্বীকার করিয়া লইত রসিক। কিন্তু দিনমানে অমলাকে একটু চোখের দেখা দেখিতেও রসিককে প্রচুর কাঠখড় পোড়াইতে হইত। রায়বাহাদুরের কড়া শাসনে একই বাড়ীতে থাকিয়াও রসিক ও অমলার দেখাসাক্ষাতের খুব সুবিধা ছিল না। স্ত্রীকে কাছে পাইতে রাত্রিটুকুর জন্য সারাদিন পথ চাহিয়া থাকিতে হইত তাহাকে।
বিধাতার তাহাও সহ্য হইল না। গোলযোগটি বাঁধাইলেন জমিদার মহাশয়ের গুরুদেব। আশ্রম হইতে বিনা নোটিসে তিনি হঠাৎ বিধান দিয়া পাঠাইলেন, গ্রহ-নক্ষত্রের সহাবস্থান আগামী কিছুকাল খুব শুভ নহে। এক বৎসরকাল বর-কন্যা যেন একসঙ্গে নিশিযাপন না করে।
খলনায়ক বলিয়া হিটলার ও রাবণের নাম শুনিয়াছিল রসিক। তাঁহাদের গুরুভক্তি কিরূপ ছিল জানা নাই। কিন্তু দেখা গেল রায়বাহাদুর গুরুভক্ত ব্যক্তি। সারাদিনের অধীর প্রতীক্ষার পরে যে মধুযামিনীটি রসিকের সম্বল ছিল, এইবার তাহাতেও তিনি বাদ সাধিলেন।
শ্বশুরমহাশয় এমনিতেই জামাতার প্রতি সুপ্রসন্ন ছিলেন না। বাবাজীবনের কীর্তিকাহিনী তিনি সবই শুনিয়াছিলেন। শ্বশুরালয়ে আসিয়াও সে পূজনীয় শ্বশুরমহাশয়ের স্ফীতোদর লইয়া কটাক্ষ করিয়াছে, ইহাও তাঁহার কর্ণগোচর হইয়াছে। তাহার উপর স্টিফেন সাহেব, যিনি রসিককে ইংরাজি পড়াইতেন, তিনিও অভিযোগ আনিয়াছেন ছাত্র নাকি শিক্ষায় কিছুমাত্র অগ্রগতি করিতে পারিতেছে না। পড়ার সময়ে ক্রমাগত ঢুলিতে থাকিলে শিক্ষকের কী করিবার আছে, ইত্যাদি।
পড়িবার সময়ে নিদ্রা? কী সাংঘাতিক কথা! ইহার অর্থ রাত্রি জাগরণ! রায়বাহাদুর অবিলম্বে ব্যবস্থা লইলেন। দিনের বেলা বাগান, ব্যায়াম, পড়াশোনা ইত্যাদি নানান কাজের ছুতায় তিনি রসিককে ব্যস্ত তো রাখিতেনই। গুরুবাক্যে বলীয়ান হইয়া এইবার রাত্রেও তিনি কন্যা জামাতাকে পৃথক রাখিবার নির্দেশ দিলেন।
রসিক ইহাতে নিরতিশয় ক্ষুব্ধ হইল। কিন্তু প্রকাশ্যে কিছুই করিতে পারিল না। কল্পনায় খলনায়কের কয়েকপ্রস্থ সপিণ্ডকরণ করিয়া অলক্ষ্যেই বিস্তর গজরাইল। অমলার ন্যায় কোমল বালিকার এমন অসুরসদৃশ পিতা কীভাবে হয় তাহা রসিক ভাবিয়া পাইল না। সত্য বটে, এ ভারি অন্যায়। অমলা রসিকলালের বিবাহিতা স্ত্রী। তুমি অমলার পিতা হইতে পারো, কিন্তু স্বামী-স্ত্রী কে আলাদা করিয়া রাখিবার কী অধিকার তোমার? তাহারা তো আর শিশুটি নয়।
নববধূর সাথে নিশিযাপনের সম্ভাবনা এইরূপে ধুলিস্যাৎ হইলে রসিকের রোখ বাড়িয়া গেল। সে বরাবরই ডানপিটে জেদি ছেলে। ফন্দিফিকির দ্বারা অমলাকে শালবনের পাশে নদীর ধারে ডাকিয়া আনাইয়া নিশি না সই, দিবসযাপন করিয়াই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাইবার নানান কৌশল আবিষ্কার করিয়া ফেলিল। অমলাও পূর্ণ সহযোগিতায় আজ নিকট পড়শীর বাড়ী উৎসব, কাল বকুলফুলের পুতুলের বিবাহ ইত্যাদি নানাবিধ ছুতায় মধ্যাহ্নের অলস মুহূর্তগুলি বাড়ীর বাহিরে মদনাহত কিশোর স্বামীর পরিচর্যায় সানন্দে ব্যতীত করিতে লাগিল।
ইহার অবধারিত ফলস্বরূপ রসিকের পড়াশোনা গোল্লায় গেল এবং অমলার অসময়ে বাড়ীর বাহিরে যাইবার নিমিত্ত অজুহাতের বিকল্পগুলি দ্রুতবেগে কমিয়া আসিতে লাগিল।
ছলছুতার পুনরাবৃত্তি যখন সন্দেহজনক ভাবে বাড়িয়া উঠিয়াছে, সেই সময়ে একদিন এলাহাবাদ হইতে জমিদার মহাশয়ের কনিষ্ঠ শ্যালক সপরিবারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। উদ্দেশ্য ভগিনীর বাড়ীতে কিছুদিনের অবকাশযাপন। অবশ্য শুধুমাত্র তাঁহারা আসিলে সমস্যা কিছু ছিল না। কিন্তু মাতুল পরিবারের সহিত আসিল— ব্যারন।
ব্যারন কোনও মনুষ্য নহে, সে কেতাদুরস্ত অত্যাধুনিকা মাতুলানীর পিতৃগৃহ হইতে আনীত একটি বিলাতী সারমেয়সন্তান। গুরুভার নামধারী এই পোষ্যটি কিন্তু আকৃতিতে অতি ক্ষুদ্র ও প্রকৃতিতে বড়ই মধুর। সারা দেহে লোমের বাহুল্যে তাহাকে কোন জীবিত প্রাণী অপেক্ষা একটি পশমের গোলা বলিয়া ভ্রম হইত। অমলার মাতুল ইহাকে সমীহ করিয়া চলিতেন কেননা ব্যারন ছিল মাতুলানীর বড় প্রিয়। আপন সন্তানগণের সঙ্গে তিনি ইহাকে একাসনে স্থান দিয়াছিলেন।
সারমেয়টি দেখিতে মনোহর হইলে কী হয়, নানাবিধ উৎপাত করিয়া বাড়ীর সকলকে নাস্তানাবুদ করিতে লাগিল। কিন্তু সত্য বলিতে কি অমলার ইহাতে বড় সুবিধা হইল। একদিন দ্বিপ্রহরে রসিকের সংকেত পাইয়া সে মাতুলানীর নিকট গিয়া বলিল, মামী, ব্যারনের সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গেছে। ওকে একটু নদীর ধার থেকে ঘুরিয়ে আনি?
মামী ভিতরের কথা কিছু জানিতেন না, সহজেই সম্মতি দিলেন। মায়ের সন্দেহ হইল বটে, কিন্তু ভ্রাতৃবধূর খাতিরে আর কিছু বলিলেন না। ব্যারনের গলার রেশমী দড়িটি ধরিয়া অমলা হৃষ্টচিত্তে বাহির হইয়া গেল।
রসিক কিন্তু এই কর্মনাশা সপত্নীটিকে পাইয়া আদৌ প্রীত হইল না। বলিল, একি, এই নেড়ি কুকুরটাকে আবার কোত্থেকে ধরে আনলে?
অমলা শশব্যস্ত হইয়া বলিল, ওমা! কাকে কী বলছ? ও নেড়ি? দেখছ না গলায় বকলশ? তুমি জানো, ওর নাম ব্যারন?
বকলশ পরিহিত ব্যারনের সাড়ম্বরে পরিচয় দান করিলেও অমলা বুঝিল ব্যারনের বেয়াদপি তাহাদের এই দ্বিপ্রাহরিক সুখসময়টিকে সত্যই মাটি করিবে। ইতিমধ্যেই সারমেয়নন্দন রসিকের চারিপাশে পরম আহ্লাদে প্রদক্ষিণ করিতে করিতে বেশ কয়েকবার তাহার জুতা চাটিয়া দিয়াছে। আর ক্রমাগত 'কেঁউ কেঁউ' শব্দ করিয়া নবপরিচিত জামাতার অত্যধিক আপ্যায়ন শুরু করিয়া দিয়াছে। বিরক্ত হইয়া অবশেষে রসিক বলিল, দাও দিকিনি, ব্যাটাচ্ছেলেকে থানায় জমা করে দিয়ে আসি।
অমলা আঁতকাইয়া উঠিল। রসিক তখন তাহাকে বুঝাইয়া বলিল, আরে ঘাবড়িও না। থানায় গিয়ে বলব, পেডিগ্রি কুকুর। রাস্তায় পেয়েছি। কারো বাড়ী থেকে হারিয়ে গেছে নিশ্চই। কুকুরের মালিক নিতে এলে দিয়ে দেবেন। দেখো, ওরা ঠিক আদরযত্ন করবে। তারপর ফেরার পথে তুমি গিয়ে তোমাদের কুকুর সংগ্রহ করে বাড়ী গেলেই হল।
অমলার মুখে হাসি ফুটিল। তাহা বুদ্ধিমান স্বামীর গরবে না ভারমুক্ত আসন্ন সুখসান্নিধ্যের আশ্বাসে, কে বলিতে পারে?
৩
ঘটনা কিন্তু যতটা সহজ মনে হইয়াছিল, বাস্তবে তাহা হইল না। গোল বাঁধাইলেন বিপুল দারোগা।
আশেপাশের দশটা গাঁ’য়ে সকলেই জানে বিপুল দারোগার নাম। প্রবল প্রতাপ, চোর ডাকাতে নাম শুনিলেই আসিয়া পায়ে পড়ে। শরীরের আয়তনের বিচারে তিনি সার্থকনামা। মাথাজোড়া টাক হইলে কী হয়, গোঁফের বাহারে তাক লাগিয়া যায়। সেই নধর গুম্ফে তা দিয়া মেঘমন্দ্র কন্ঠে যখন তিনি হাঁক পাড়েন, কন্সটেবল নিতাইয়ের প্যান্ট খুলিয়া যাইবার যোগাড় হয়।
নিতাই কনস্টেবল বিপুল দারোগার একনিষ্ঠ শিষ্য। সময় পাইলেই দারোগাবাবু নিতাইকে নীতি, কর্তব্যনিষ্ঠা, সত্যবাদিতা ইত্যাদির শিক্ষা দিয়া থাকেন। পাকেপ্রকারে তাহাকে ইহাই বুঝাইবার চেষ্টা করেন, তাহার পক্ষে নিয়মবহির্ভূত ধনোপার্জনের চিন্তা কতটা গর্হিত। নিতাই বয়সে, পদে ও মানে কনিষ্ঠ, তাহার এমত আচরণ মোটেই শোভা পায় না। তিনি তাহার মনিব, এইধরণের সকল সুযোগ মনিবের উদ্দেশ্যে প্রদান করাই তাহার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। কিন্তু এহেন সত্যনিষ্ঠ বিপুল দারোগার দুঃখ আর গেল না, নিতাই জমাদারকে তিনি কিছুতেই মানুষ করিতে পারিলেন না। সে অর্বাচীন এখনও সুযোগ পাইলেই ছোঁকছোঁক করিবে।
ছোট্ট গ্রামের নিরুপদ্রব থানায় দ্বিপ্রহরে বিশেষ কাজ থাকে না। বিপুল দারোগা এই সময়টিতে নাসিকায় সর্ষপতৈল যোগে একটি দিবানিদ্রা দিয়া থাকেন। নিতাইকে তিনি বুঝাইয়াছেন, ইহা একপ্রকার যোগনিদ্রা। ইহার মাধ্যমে তিনি দূরদূরান্তরের অপরাধীদের সুলুকসন্ধান করিয়া থাকেন। নিতাইকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া আছে, দারোগাবাবুর এই যোগনিদ্রায় যেন কখনও ব্যাঘাত না ঘটে।
সেদিন অপরাহ্ণে যোগনিদ্রা ভঙ্গ হইলে বিপুল দারোগা জৃম্ভণসহযোগে আড়ামোড়া ভাঙিতেছিলেন। নিতাই কন্সটেবল আসিয়া জানাইল, লক্ষীপিতিমের মত এক মা জননী এয়েচেন। বলতিছেন, আজ সকালে নাকি তাঁর বাড়ীর পোষা কুকুরটি হারিয়ে গেছে। থানায় কেউ জমা করেছে কিনা তার খোঁজ করতিছেন।
দিবাবসানের কালে এরূপ ব্যাঘাত বিপুলবাবুর মোটেই পছন্দ নয়। কিন্তু তিনি কর্তব্যে অবহেলা করেন না। সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করিলেন, খানিক আগেই এক ছোকরা একটা কুকুর জমা করে গিয়েছিল না?
—হ্যাঁ হুজুর, সেটাই। মা লক্ষীকে দেখে তার কী আহ্লাদ। আর তিনিও বললেন, এই তো সেই— কী যেন একটা মেলেচ্ছ নাম!
নিতাইকে দারোগাবাবু মোটেই বিশ্বাস করিতেন না, নারীসমীপে নিতাইয়ের চারিত্রিক শিথিলতা তাঁহার বিলক্ষণ জানা ছিল। থানার একটা নিয়ম আছে। থানায় জমা পড়া হারানো কুকুর ফেরত লইতে এক টাকা ফী জমা করিতে হয়। কুকুরের উদ্ধারকর্তাকে পুরস্কৃত করিবার জন্যই এই নিয়ম বরাদ্দ হইয়াছিল। কিন্তু নিয়ম খুব কঠোরভাবে পালিত হইত এমন নহে, এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের বিশেষ কোনও নজরদারি ছিল না। তাই থানার দারোগাবাবু ইচ্ছা করিলেই ইহার মাফ হইতে পারিত।
বিপুল দারোগা কিন্তু মাফ করিবার মানুষ নন। পরন্তু তিনি এই ফী উদ্ধারকর্তার পুরস্কারের পরিবর্তে কুকুরের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বলিয়া গ্রহণ করিতেন। তাহাতে সুবিধা এই যে, গৃহীত অর্থ সরকারী তহবিলে জমা করিবারও কোনও দায় থাকিত না। অধিকাংশ পক্ষই প্রকৃত নিয়ম অবগত নহে। প্রাপকপক্ষ সাধারণত হারানিধি ফিরিয়া পাইলে খুশী হইয়া বিনা বাক্যব্যয়েই এই মূল্য দিয়া দিত এবং প্রায় কোনও উদ্ধারকর্তাই পুরস্কার লইতে আসিত না। ফলত নিতাইকে নামমাত্র ভাগ দিয়া সহজেই বিপুল দারোগার পকেটের ভারবৃদ্ধি হইত।
নিতাইকে দিয়া কী বলিতে হয় তাহা তিনি পইপই করিয়া শিখাইয়াছিলেন। কিন্তু মুখ্যুটাকে কি ভরসা করা যায়? তাই বিপুলবাবু ধমক লাগাইলেন, তারপর? অমনি গলে গিয়ে দিয়ে দিলি?
—তাই কি হয় হুজুর? থানার নিয়ম আমি জানি না? এই দেখুন না— এক টাকা ফীজ আমি ঠিক নিয়েছি।
দারোগাবাবুর সন্দেহ যায় না, চোখ পাকাইয়া পুনরায় তিনি বলিলেন, বল দেখি ঠিক কী বলিছিলি?
—আজ্ঞে আমি বললাম, কুকুরকে নাওয়াতে খাওয়াতে তো খচ্চা লাগে। তাই এটুকু দস্তুরি দিতে হয়। সরকারী ব্যবস্থা।
বিপুল দারোগা একটি নিঃশ্বাস ফেলিয়া টাকাটি পকেটস্থ করিলেন। কিন্তু তাঁহার একটু খটকা লাগিল। আজই একজন হারানো কুকুর খুঁজিয়া পাইল আর দুই ঘন্টার মধ্যে তাহার প্রকৃত মালিকও আসিয়া পড়িল! যোগাযোগটি সন্দেহজনক। তাহার উপর একজন পুরুষ আর অপর জন স্ত্রীলোক! বিপুল দারোগা এর মধ্যে বিপুল ষড়যন্ত্রের আভাষ পাইলেন। তাঁহাকে সুখশয্যা ত্যাগ করিতে হইল।
ওদিকে নিতাইয়ের লোলুপ দৃষ্টি তাঁহার পকেটের দিকে। তাহাকে হাতের ইশারা করিয়া বলিলেন, ওসব পরে হবে। এখন চল তো দেখি।
অমলা বাহিরের কক্ষে অপেক্ষা করিতেছিল। তাহাকে দেখিয়া বিপুলবাবু বলিলেন, আরে, তুমি এখানে?... ইয়ে, তুমি হরনাথবাবুর মেয়ে না?
অতএব অমলার ব্যারনকে লইয়াই ফিরিয়া আসা হইল না। বিপুল দারোগা উপস্থিত থাকিতে জমিদারের অল্পবয়সী বিবাহিতা কন্যা একা গৃহে ফিরিয়া যাইবে, ইহা কীরূপে সম্ভব? হরনাথবাবুর কন্যার নিকট তিনি ফীজ আদায় করিয়াছেন, ইহা বিপুলবাবুর খুব স্বস্তির কারণ নহে। অথচ স্বেচ্ছাগত মালক্ষ্মীকে এত সহজে ফিরাইয়া দিতেও তাঁহার মন সরিতেছিল না। তাই অতিরিক্ত উদ্বিগ্নতা দেখাইয়া তিনি সমাদরে নিতাইয়ের পাহারায় অমলাকে গৃহে প্রত্যাবর্তন করাইলেন। প্রধান উদ্দেশ্য, পরে উচ্চঘরের মর্যাদা রক্ষার্থে তাঁহার প্রচেষ্টা সাতকাহন করিয়া জমিদারমহাশয়ের কর্ণগোচর করিলে তাঁহার প্রসন্নতা অর্জন করিবার সুবিধা হইবে।
বিপুলবাবু যে অমলাকে চিনিয়া ফেলিতে পারেন, এইটা রসিকের ফন্দিতে ধরা ছিল না।
৪
সন্ধ্যার মুখে বর্ষা নামিল। তাহার পূর্বেই অবশ্য অমলার আসিয়া যাইবার কথা। কিন্তু সে আসিল না। রসিক অধৈর্য হইতেছিল। অর্ধ ঘন্টাকাল বৃষ্টিতে ভিজিয়াও যখন অমলা ফিরিল না, তখন সে চিন্তিত হইয়া পড়িল।
পথঘাট জনশূন্য হইয়া আসিয়াছিল। গুটি গুটি পায়ে রসিক থানার নিকট আসিল। ফাটকের বাহির হইতে উঁকি মারিয়া দেখিল কিন্তু থানার অভ্যন্তরে কাহাকেও দেখা গেল না। কোথায় যাইতে পারে অমলা?
ব্যাকুলচিত্তে কী করিবে রসিক ভাবিয়া পাইতেছে না, এমন সময়ে দেখে লন্ঠন হাতে নিতাই বাহির হইতে থানায় ফিরিয়া আসিতেছে। তাহার সঙ্গে এক নারী রক্ষীও ছিল। দূর হইতে রসিক ‘মা-জননী’, ‘মুখুজ্জেবাড়ী’, ‘একলা যায় কী করে’— এইরকম কিছু কিছু বাক্যাংশ শুনিতে পাইল। ইহারা কি তবে অমলাকে গৃহে পৌঁছাইয়া আসিতেছে? সন্ত্রস্ত হইয়া বৃষ্টির মধ্যেই ভিজিতে ভিজিতে গৃহে প্রত্যাবর্তন করিল রসিক।
মুখুজ্জেবাড়ীর নিকটবর্তী হইয়া রসিক আপন সিক্তবায়স রূপে যথাসাধ্য গাম্ভীর্য অর্পণ করিয়া অগ্রসর হইল। দুয়ারে দ্বারবান বাড়ীর জামাতার দশা দেখিয়া বিস্মিত হইল, কিন্তু শশব্যস্ত হইয়া বিনা বাক্যব্যয়ে পথ ছাড়িয়া দিল। দ্রুত দেউড়ি পার করিয়া পা টিপিয়া রসিক অন্দরমহলে প্রবেশ করিতেই বিধাতা বাদ সাধিলেন। অনেকক্ষণ হইতেই নাসিকা সুড়সুড় করিতেছিল, এইবার সশব্দে রসিক দুইবার হাঁচিয়া ফেলিল।
—কে রে ওখানে? নারীকণ্ঠের আহ্বানে চকিত হইল রসিক। এলাহাবাদের মামী! শঙ্কিত হইয়া রসিক দেখিল তাহার আশেপাশে আর কেহ নাই। ভিতর হইতে দেখা দিলেন মামী। তিনি ততক্ষণে তাহাকে চিনিয়া ফেলিয়াছেন। মুখব্যাদানসহ গালে হাত রাখিয়া মামী বলিলেন, ওমা! জামাই যে!
বিপাকে পড়িলে রসিকের মাথা বেশ চলে। শীঘ্রই মুখে মাথায় দুই হাত ফিরাইয়া যেন কিছুই হয় নাই এই ভঙ্গীতে বলিল, এই যে মামী। গিয়েছিলাম একটু পায়চারি করতে। হতচ্ছাড়া বিষ্টিটা আর আসবার টাইম পেল না।—
—দেখো কান্ড! আর এদিকে বাড়ীতে যে পুলিশ এসেছিল সে কথা জানো?
রসিক আন্দাজ করিয়াছিল, সবিশেষ জানে না। পুলিশ কেন বাড়ীতে আসিয়াছিল? গাম্ভীর্য ভুলিয়া অকৃত্রিম আশঙ্কায় সেই প্রশ্নই সে মামীকে করিয়া ফেলিল।
মামী ভ্রূভঙ্গি করিয়া বলিলেন, সে আর কী বলব ভাই! আমাদের অমু ব্যারনকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল। কোথায় গিয়েছিল কে জানে, সে আর ফেরে না। এদিকে সন্ধে হয়ে এল। আমরা তো ভয়ে মরি। ভরসন্ধেবেলায় একা মেয়ে কোথায় গেল? ভাগ্যিস দারোগাবাবু অমুকে দেখতে পান। মুখুজ্জেবাড়ীর মেয়ে বলে কথা, তাই লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন।
এই ব্যাপার! যাক, অমলা ফিরিয়া আসিয়াছে। রসিক দেখিল, বিপদ কাটিয়াছে। যেন কিছুই জানে না এইভাবে প্রশ্ন করিল, কোথায় গিয়েছিল সে?
—তা জানি না ভাই। মেয়ে তো সেই থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। কিছুই বলছে না।
ইহাতে রসিক আরও নিশ্চিন্ত হইয়া মুরুব্বী চালে বলিল, বনেদী ঘরের মেয়ে এভাবে একলা কোথাও চলে যাওয়া তো ঠিক কথা নয়।
—সে আর বলতে। আচ্ছা, তুমি কি জানো না সে কোথায় গিয়েছিল?
এই কথায় রসিক কিঞ্চিৎ অসুবিধায় পড়িয়াছিল, কিন্তু অচিরেই সে দ্বিধা কাটাইয়া বলিল, আ-আমি কী করে জানব? বিকেলবেলায় একটু বেরিয়েছিলাম পায়চারি করতে। অন্দরমহলের কথা আমি কী জানি?
—ওমা! কী ডাকাত ছেলে গো! ষড় করে, বাড়ীর মেয়েকে ফুসলে বাইরে নিয়ে গিয়েও বলে কিনা— আমি তো কিছু জানি না— কপট রোষের একটি সরস মুখভঙ্গি করিয়া মামী বলিলেন, দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা। অ্যাই মেয়ে— এদিকে আয় তো—।
এই বলিয়া তিনি অমলাকে অন্তরাল হইতে টানিয়া আনিলেন। অমলা দরজার আড়ালেই ছিল, বাহির হইয়া চকিতে একবার রসিককে দেখিয়াই চক্ষু অবনত করিল। তাহার সে দৃষ্টিতে ছিল আকুল অসহায়তা। অশ্রু শুকাইয়াছে কিন্তু সে যে অনেক কাঁদিয়াছে তাহাকে দেখিলেই বুঝা যায়। অতি আয়াসে উদ্গত আবেগ অবদমিত স্বরে কোনমতে 'ওর কোনও দোষ নেই মামী'— এই ক'টি কথা উচ্চারণ করিয়া মামীর স্কন্ধে মুখ লুকাইল অমলা।
অপাপবিদ্ধ বালিকার অন্তরের ব্যথা মামীকেও স্পর্শ করিয়াছিল। তিনি গুরুজন, কিন্তু খুব প্রাচীনপন্থী নন। স্নেহসিক্ত স্বরে অমলার পিঠে হাত রাখিয়া বলিলেন, জানি রে জানি। সব দোষ তোদের এই বয়েসটার। আর দাদাভাইও যে কী জেদ নিয়ে বসে আছেন। কিচ্ছু ভাবিসনি, সব ঠিক হয়ে যাবে— যা এখন ভেতরে যা দিকিনি।
রোদনোচ্ছ্বাস দমন করিতে অঞ্চলে মুখ ঢাকিয়া অন্দরে চলিয়া গেল অমলা। রসিক বুঝিল সে মামীকে সব কথাই বলিয়াছে। তবে মামী বুদ্ধিমতী, আশা হয় তিনি সে কথা পাঁচকান করিবেন না। কিন্তু অমলা কেন এত বিচলিত হইয়াছে তাহা রসিক অনুধাবন করিতে পারিল না। অনেক দুষ্কৃতির নায়ক রসিকলাল ইতিপূর্বে বহু বিপরীত পরিস্থিতির সম্মুখীন হইয়াছে, কিন্তু এমন অসহায় কখনও বোধ করে নাই। এখন তাহার কী করা উচিত ঠিক করিতে না পারিয়া অমলার অনুবর্তী হইতে গেল সে। মামী তাহার হাত ধরিয়া রুখিলেন।
তাহার পর চোখ পাকাইয়া তিনি রসিককে বলিলেন, এই যে ছেলে, কোথায় যাচ্ছ? আমাদের মেয়েকে অনেক কাঁদিয়েছ। তার কী উপায় করবে?
হতবুদ্ধি হইয়া রসিক বলিল, ও এত কাঁদছে কেন?
—তাও জানো না? অসময়ে সবচেয়ে প্রিয় লোকটিকে কাছে না পেলে মেয়েদের মনে ভীষণ অভিমান হয়, সে খবর কি রাখো? কিছুই না ভেবে স্বচ্ছন্দে বউকে একা থানায় পাঠিয়ে দিলে? জানো, ওখানে ওর কাছ থেকে টাকা আদায় করে তবে ওরা ছেড়েছে। তুমি সঙ্গে থাকলে কি তোমার অমলার এমন অসম্মান হত?
রসিকলালের মাথার মধ্যে কেমন যেন সব গোলমাল হইয়া গেল। অমলা— তাহার অমলা—!
৫
অমলার মাতুল গৃহিণীকে সমীহ করিয়া চলিতেন। কিন্তু আদতে মানুষটি ছিলেন রসজ্ঞ। নৈশভোজের পূর্বে বেশ খানিকটা সময় মামাবাবু ছাদে বসিয়া আফিং ও তাম্বাকু সহযোগে বসন্তের বাতাস সেবন করিয়া থাকেন, সেদিনও তাহাই করিতেছিলেন। বর্ষণ শেষে আকাশে মেঘের ফাঁকে চাঁদ উঠিয়াছে। সে সময়ে আশেপাশে আর কেহ ছিল না। সুযোগ বুঝিয়া রসিক ছাদে আসিয়া গলা সাফ করিবার ছুতায় মামাবাবুর নিকট নিজের উপস্থিতি জ্ঞাপন করিল। মামাবাবু চক্ষুরুন্মীলন করিয়া সোৎসাহে বলিলেন, আরে বাবাজীবন যে, এসো এসো। তারপর, সব কুশল তো?
—আজ্ঞে,— ভণিতা করিবার অভ্যাস রসিকের কোনোকালেই নাই, তাই সরাসরি প্রসঙ্গে আসিয়া বলিল, কিন্তু একটা মুশকিলে পড়া গেছে।
রসিক সন্ধ্যার সময়ে অমলাকে সেই একবারই দেখিতে পাইয়াছিল। তাহার পর গোপন কথা জানাজানি হইবার আশঙ্কায় ও লজ্জায় মরমে মরিয়া সেই যে সে মুখ লুকাইয়াছে, আর তাহার কোনও সাড়াশব্দ নাই। অমলার সেই অভিমানক্ষুব্ধ অসহায় মুখচ্ছবি শেলের ন্যায় রসিককে বাজিয়াছে। একটা টাকা বেশী নয় কিন্তু তাহারই বুদ্ধিতে বড় ঘরের কন্যা, তাহার বিবাহিতা স্ত্রী পুলিশের হাতে নাকাল হইয়াছে, ইহাতে রসিকের বড়ই মনস্তাপ হইয়াছিল। পুলিশ না হইয়া তাহার শিক্ষক, প্রতিবেশী অথবা নিজ গ্রামের অপর কেহ হইলে রসিকের হাতে তাহার নিস্তার ছিল না। কিন্তু বিপুলবাবু দারোগা, তদুপরি বর্তমানে সে নিজে শ্বশুরালয়ের অধীন। রসিক এখন পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহের ন্যায় অসহায়।
স্বামী হইয়া স্ত্রীর এই দুরবস্থায় সে কিছুই করিতে পারিতেছে না, এই চিন্তায় রসিকলালের মস্তিস্ক উত্তপ্ত হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার অবস্থা দেখিয়া মামী মিটিমিটি হাসিয়াছিলেন। বলিলেন, হয়, অমন কখনো সখনো ভুল হয়ে যায়। অমলাকে কাছে পেলে খুব আদর করে দিও, তাহলেই হবে। বুঝেছ বীরপুরুষ?
রসিক কিছুই বুঝে নাই। তাহার মাথায় তখন প্রতিশোধের আগুন প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে। কিন্তু একাকি মস্তিষ্ক কাজ করিতেছে না। এখন থাকিত যদি তাহার প্রাণের বন্ধু ফটিক, মাখন, বীরু— একবার দেখিয়া লইত ঐ দারোগাকে। আপাতত তাহা সম্ভব হইতেছে না। অনন্যোপায় হইয়া মামীকেই সে বলিল, কী করা যায় বলুন তো মামী?
মামী এই আহত শার্দূলশাবকটির মর্মব্যথা অনুভব করিলেন। তিনি ছিলেন সুরসিকা। একটি চক্ষু টিপিয়া বলিলেন, তোমার মামাবাবুর মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি বেশ খ্যালে, বুঝলে। বৃষ্টি থেমেছে, এখন তিনি খোশমেজাজে ছাদেই আছেন। তাঁকেই গিয়ে ধর না হয়।
অবশেষে মামীর কথায় যেন পথ দেখিতে পাইল রসিক। সে মামাশ্বশুরের শরণাপন্ন হইল।
আরামকেদারায় মামাবাবু ঋজু হইয়া বসিলেন। এই কিশোর জামাতাটির গুণপনা কিছু কিছু তিনি অবগত ছিলেন। কিন্তু সম্ভবত কৈশোরে তিনি নিজেও কিছুটা এমনই ছিলেন, সে কথা স্মরণ করিয়া তাহাতে বিরূপ হইতে পারিতেন না। তাঁহার সহাস্য দৃষ্টির প্রশ্রয়ে রসিক সকল ব্যাপার বলিয়া ফেলিল।
হইয়াছিল কী, অমলা থানায় গিয়া যথাসাধ্য সাহসের সহিত কোন সারমেয়শিশু জমা হইয়াছে কিনা সন্ধান করে। দারোগা সেখানে উপস্থিত না থাকায় কন্সটেবল নিতাই তাহাকে আপ্যায়ন করিয়াছিল। কেহ কিছু বলিবার পূর্বেই অবশ্য ব্যারন সোল্লাসে তাহার মালকিনের উপস্থিতিকে স্বাগত জানায়। সনাক্তকরণে সন্দেহের কোনও অবকাশই সে রাখেনি, নিতান্ত বাঁধা থাকাতে তৎক্ষণাৎ অমলার কোলে ঝাঁপাইয়া পড়িতে পারে নাই। ভাগ্যক্রমে সেদিন অমলার সঙ্গে একটি টাকাও ছিল, তাহার দ্বারা নিতাইয়ের দাবী পূরণ করিতেও কোনও অসুবিধা হয় নাই।
কিন্তু গোলযোগ বাঁধিল বিপুল দারোগা অমলাকে চিনিয়া ফেলায়। বেচারি অমলা! তাহাকে পুলিশের জিম্মায় ঘরে ফিরিতে হইল। রসিকের সঙ্গে আর তাহার দেখা হইল না। সে কোনওমতে গৃহে পৌঁছাইয়া ভয়ে, লজ্জায় ও ক্ষোভে সেই যে মুখ লুকাইল, রসিক বহু চেষ্টা করিয়াও আর তাহার দেখা পায় নাই। সেই অবধি রসিক বড় কষ্টে আছে।
সব কথা শুনিয়া মামাবাবু হাসি চাপিতে পারিলেন না। দু’টি বালক-বালিকার কোমল হৃদয়ের অবোধ অন্তর্দ্বন্দ্বও তাঁহাকে বিদ্ধ করিয়া থাকিবে। তিনি যথোচিত প্রফুল্লস্বরে রসিককে বলিলেন, এই কথা? তা এতে এত মন খারাপ করার কী আছে?... কী যেন নাম বললে, বিপুল দারোগা— না? আমাদের সঙ্গে এক হাম্বাগ বিপুল মল্লিক পড়ত, সে নয় তো? শুনেছিলাম বটে সে এখন পুলিশ হয়েছে। এই দিকেই কোথাও পোষ্টেড। এ নিশ্চই সেই হবে। দাঁড়াও একটু ভেবে নিই।
খানিক ভাবিয়া মামাবাবু বলিলেন, হয়েছে বাবাজীবন। তুমি আর এই নিয়ে কোনও চিন্তা করো না। শোন, কী করতে হবে বলে দিই।
পরদিন গুটিগুটি পায়ে রসিক থানায় গিয়া হাজির হইল। সময়টি সেই দ্বিপ্রহর, বিপুল দারোগার যোগনিদ্রা ব্যাহত হইল। অপ্রসন্নভাবে বিপুলবাবু দেখিলেন, কালকের সেই ছোকরা পুনরায় আসিয়া হাজির হইয়াছে। কী ব্যাপার?
রসিক আপন মামাশ্বশুরের পরিচয় ব্যক্ত করিয়া নিরীহভাবে বলিল, দারোগাবাবু, শুনলাম নাকি আপনি ওনার ক্লাসফ্রেন্ড?
—হ্যাঁ তা বটে। সরোজ তোমার মামাশ্বশুর? কী সংবাদ তাঁর? সন্দিগ্ধভাবে বিপুল দারোগা জিজ্ঞাসা করিলেন। কণ্ঠস্বরে সন্দেহ হয়, ছাত্রাবস্থায় বোধহয় খুব সৌহার্দের সম্পর্ক তাঁহাদের ছিল না।
—ওনার কাছে একটা খবর পেয়ে আপনার কাছে আসতে হল। মনে আছে, কাল রাস্তায় একটা কুকুর খুঁজে পেয়ে আপনার কাছে জমা করে গেছিলাম? শুনলাম তার মালিক নাকি তাকে নিয়ে গেছে। কথায় কথায় মামাবাবুর কাছে এই সব কথা হচ্ছিল। তা তিনি বললেন, হারানো কুকুর এনে দিলে পুলিশ নাকি একটাকা করে প্রাইজ দেয়। তাই পুরস্কার নিতে আবার এলাম। মামাবাবুও নিজেই আসতেন, আপনার সঙ্গে খুব দেখা করতে চাইছিলেন। কিন্তু কী একটা কাজে আটকে গেছেন। আমাকে বলে দিলেন আপনার কাছে ওনার নাম বললেই আপনি চিনবেন।
বিপুল দারোগা প্রমাদ গণিলেন। কলেজে এই সরোজ তাঁহাকে বেশ কয়েকবার নাকাল করিয়াছিল মনে পড়ে। এখন আবার সে উকিল হইয়াছে। ভাগ্নীজামাইকে সব নিয়মকানুন শিখাইয়া পাঠাইয়াছে। নিয়মানুসারে টাকাটা পুরস্কারস্বরূপ এই ছোকরাকে ফেরত দিতে হয়। না দিলে সরোজ উকিল আবার কী গোলযোগ পাকাইবে তাহার কি ঠিক আছে? নিতাইকে তখনই তাহার ভাগ দিয়া দিলে হয়ত এই আপদ ঘটিত না। অপয়া টাকাটা ফিরাইয়া দেওয়াই সমীচীন বোধ করলেন তিনি।
দারোগা জব্দ হওয়াতে রসিকের বিস্তর হর্ষলাভ হইল। অমলার করুণ মুখখানার কথা ভাবিয়া সে টাকাটাকে টং করিয়া একবার বাজাইয়া লইল। কিন্তু সরোজবাবু যে জমিদার হরনাথ মুখুজ্জের আত্মীয়, একথা তো দারোগা জানেন না। তাই প্রতিশোধ যেন সম্পূর্ণ হইল না মনে হইল রসিকের। ফিরিয়া আসিবার পূর্বে নিজের প্রকৃত পরিচয় জানাইয়া দিবার লোভ সংবরণ করিতে পারিল না সে। বলিল, সরোজবাবু জমিদারমশাইয়ের শালা হন, তা জানেন তো দারোগাবাবু?
বিপুলবাবুর চক্ষু গোলাকার হইল, বিস্মিত হইয়া বলিলেন, তাই নাকি? তা তুমি জানলে কী করে হে?
—আরে তিনি যে আমার মামাশ্বশুর, আমি জানবো না?— রসিক এইটুকুই বলিয়া প্রস্থানোদ্যত হইল।
বিপুল মল্লিক সকলই বুঝিয়া লইলেন। এই ছোকরা হরনাথবাবুর জামাতা, অর্থাৎ নিশ্চয়ই অমলার স্বামী। দিবা দ্বিপ্রহরে স্ত্রীর সহিত অভিসারে আসিয়াছিল, ইহাও বুঝিতে তাঁহার বিলম্ব হইল না। গুরুজনদিগের অলক্ষ্যে ও অজ্ঞাতসারে, সন্দেহ নাই।
এমন একটি সরস সংবাদ অবগত হইয়া দারোগার সুপুষ্ট গুম্ফের আড়ালে একটুকরো হাসির আভাষ দেখা দিল।
৬
—আপনার অনুমতি না নিয়েই অন্যায় কাজটা করে ফেলেছি, মামাবাবু।— পরদিন সকালে সমস্ত ঘটনা মামাশ্বশুরের নিকট ব্যক্ত করিবার পর কুণ্ঠিত ভাবে বলিল রসিক।
এই বালক জামাতাটি তাঁহারই পরামর্শে নিজের স্ত্রীর অসম্মানের বদলা লইতে পারিয়াছে দেখিয়া মামাবাবু অতীব প্রীতিলাভ করিয়াছিলেন। রসিক চপলস্বভাব, দস্যিপনা করে ও পড়াশোনা করে না ঠিকই কিন্তু অন্তঃকরণ তাহার মলিনতাহীন। মামাবাবু ইহা অনুভব করিতেন। কোন গর্হিত কাজ যে রসিক করিবে না, এ ভরসা তাঁহার ছিল। তদুপরি তিনি দেখিলেন, রসিক সত্যই অমলাকে ভালোবাসিয়াছে। বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে চপলতা কাটিয়া যাইবে, তাঁহার স্নেহের ভাগিনেয়ী রসিকের সহিত বিলক্ষণ সুখী হইবে ইহাতে মামাবাবুর কোন সন্দেহ ছিল না। উৎসুকভাবে তিনি রসিকের পানে চাহিলেন।
ঝোঁকের মাথায় পুলিশের নিকট নিজের পরিচয় দিয়াই রসিক বুঝিয়াছিল, কাজটা বোধহয় ভালো হইল না। দারোগাবাবুর অপ্রসন্ন মুখমন্ডলে ক্রূর হাস্যাভাস দেখিয়া তাহার সন্দেহ হয় লোকটা পরে কোন গন্ডগোল পাকাইবে না তো? অবশ্য এসব পরিস্থিতি রসিক ভালোই সামলাইতে পারে। ফিরিয়া আসিতে গিয়াও তাই সে আর একবার দাঁড়াইয়া পড়িল। অত্যধিক বিনীতভাবে বলিল, দারোগাবাবু, এই পুরস্কারের কথাটা দয়া করে আমার শ্বশুরবাড়ীতে বলবেন না যেন। বুঝতেই তো পারছেন, জমিদারের জামাই একটা টাকার জন্যে আপনার কাছে হাত পেতেছি একথা পাঁচকান হলে কি মান থাকে?
দারোগাবাবু ঘূর্ণিতচক্ষে একটা মোক্ষম জবাব খুঁজিতেছিলেন। তিনি কিছু বলিবার পূর্বেই রসিক পুনরায় বলিল, মামাবাবু বলছিলেন কত দারোগা নাকি এই পুরস্কারের টাকা মেরে দেয়। ওনার সাথে আবার লাটসাহেবের বড় ভাব। ক্লাবে, পার্টিতে প্রায়ই মোলাকাত হয়। লাটসাহেবের কানে তুলে তিনি অনেকবার সেই সব দারোগাদের নাকি ভিনদেশে বদলি করে দিয়েছেন। দু’এক জনের আবার চাকরিও গেছে।
দারোগাবাবু যাহা বলিতে চাইছিলেন, তাহা আর বলা হইল না। কেননা ততক্ষণে তাঁহার চিবুকখানি বিসদৃশ ভাবে ঝুলিয়া পড়িয়াছিল। রসিক উৎফুল্লস্বরে বলিয়া চলিল, কিন্তু দেখতে যেমনই হোন আপনি কিন্তু মোটেই সেইরকম দারোগা নন, তাই না? এই তো কেমন আমার প্রাপ্য টাকা আমি পেয়ে গেলাম। আমি মামাবাবুকে আপনার কথা বলব। উনিও লাটসায়েবকে জানিয়ে দেবেন’খন।
সরোজবাবু লাটসাহেবকে কী জানাইবেন সে কথা উহ্যই রাখিয়াছিল রসিক। দারোগা বিপুল মল্লিকের কিন্তু বুঝিয়া লইতে অসুবিধা হয় নাই। তাঁহার চক্ষের দ্যুতি নিভিয়া গিয়াছিল, মুখ দেখিয়া মনে হইতেছিল নিমপাতা ভক্ষণ করিতেছেন।
নিতান্ত ম্রিয়মাণ স্বরে তিনি বলিলেন, না না, লাটসাহেবকে আবার এই সামান্য ব্যাপার জানাবার কী দরকার। আমি তো যা কর্তব্য তাই করেছি।
রসিক থানার বাহিরে আসিয়া একটা সলম্ফ ডিগবাজি খাইল। বিপুল দারোগা আর যাহাই করুন, এই সারমেয়পর্বজনিত প্রসঙ্গ লইয়া মুখুজ্জেবাড়ীতে তাঁহার আর আগমণ হইবে বলিয়া তো বোধ হয় না।
সকল বিষয় অবগত হইয়া মামাবাবু হো হো করিয়া উচ্চহাস্যে বিগলিত হইলেন। সে হাসির বেগ অন্দরমহলেও পৌঁছাইয়াছিল। অমলার মাতা আসিয়া ব্যস্তভাবে বলিলেন, ওমা সরোজ, অমন করে হাসিস কেন?
পাশের কক্ষ হইতে হরনাথবাবুর রাশভারী কণ্ঠস্বরও পাওয়া গেল, ব্যাপার কী হে সরোজবাবু, এত হাসির কী হল?
—কাল আমার ছোটমা’র কাছে সব শুনে নিও দিদি, আমি জামাইদা-র কাছে চললাম।— বলিয়া হাসিতে হাসিতেই মামাবাবু কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। মামা তাঁহার কনিষ্ঠা ভাগিনেয়ী অমলাকে ছোটমা সম্বোধন করিতেন।
রসিকলালের লজ্জাসংকোচের তেমন বালাই ছিল না, কিন্তু এখন কেমন যেন বোধ হইল এস্থান ত্যাগ করাই বাঞ্ছনীয়। মামাবাবু মারফৎ সব কথা শ্বশুরমহাশয় অবগত হইবেন, এই ব্যাপারটায় ঠিক শঙ্কা নয়— কিন্তু কিছু অস্বস্তি বোধ হইতে লাগিল। সেই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে কী করা যায়, বোধহয় তাহাই স্থির করিতে রসিক ধীরে ধীরে বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল।
মামাবাবু উচ্চ-নীচ স্বরে ভগ্নীপতিকে কী বুঝাইলেন তাহা জানা গেল না, কিন্তু তাহার ফলে থাকিয়া থাকিয়া হরনাথবাবুর কণ্ঠ হইতে যে ধ্বনি নির্গত হইতে লাগিল, তাহাকে অবদমিত হাস্য বলিয়া মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে। বেশীক্ষণ অবদমিত না থাকায় অবশ্য আর সন্দেহের অবকাশ রহিল না। উদ্গত হাস্যের ক্রমবর্ধমান উচ্ছ্বাসের ফাঁকে ফাঁকে তাঁহাকে বলিতে শোনা গেল, আমি একটি গাধা... আমি এক মূর্খ... আমার মতিচ্ছন্ন হয়েছিল...। ইত্যাদি।
রায়বাহাদুর আপন বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে এমন সত্যভাষণ কখনও করেন না। রসিকের স্বকর্ণে অবিশ্বাস আসিতেছিল। অঙ্গুলিযোগে কর্ণমার্জনা করিয়া শুনিল হরনাথবাবু সহধর্মিণীকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, কই গো বড়গিন্নী এখানে আছো নাকি? হা হা হা... আমার ভীমরতি হয়েছিল, এতদিনে বুঝলাম। হা হা হা...যাক, আজকেই নীচের ঘরখানা খালি করে ফেলতে হবে। জামাই বাবাজীর সব জিনিষপত্র ওপরে অমুর ঘরে পাঠিয়ে দিও। গ্রহদোষ কেটে গেছে। নীচের ঘরে আর বাবাজীবনের শোওয়ার প্রয়োজন নেই। হা হা হা...
অনেকদিন পরে গভীর রাত্রে রসিককে একান্তে পাইয়া অমলা কাঁদিয়া ফেলিল। রসিক নানা অতিরঞ্জন সহকারে তাহার দারোগাদমন কাহিনী স্ত্রীর নিকট বলিতে শুরু করিয়াছিল। অমলা বামহাতে তাহার মুখ চাপা দিয়া অশ্রুদমন করিতে তাহার বক্ষে মুখ লুকাইল।
রসিক প্রথমটা কিঞ্চিৎ হতভম্ব হইয়া গেল। স্ত্রীলোকের মনের গহনে কী কথা লুকাইয়া থাকে সে কখনও জানিতে চাহে নাই। বেচারা ব্যস্ত হইয়া অমলার মাথায় ও পিঠে হাত বুলাইয়া তাহাকে শান্ত করিবার যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে লাগিল।
তাহার পর কখন অমলার কান্না বন্ধ হইল, কত রাত্রে তাহারা নিদ্রা গেল অথবা আদৌ গেল কিনা তাহা বলা যায় না। শুধু এইটুকু জানি, সে রাত্রির আকাশ পূর্ণচন্দ্রের জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হইয়াছিল ও মলয়ানিলে মাধবীলতার সুবাস বহুদূর পর্যন্ত ভাসিয়া আসিতেছিল। এমন মদির রাত্রে দীর্ঘবিরহিত দুই কিশোরকিশোরীর হৃদয়ের অনুচ্চার ভাষা সর্বসমক্ষে বর্ণনা করিয়া শিষ্টতার উল্লঙ্ঘন করিব না। তাহাদের একান্তে রাখিয়া এইখানেই পুনর্মিলনবাসরের দুয়ার টানিয়া দিলাম।
অত্যুৎসাহী পাঠককে বলি, আর ঔৎসুক্য কেন? আপনাদের কী অন্যত্র কোনও কাজ নাই?
এ কাহিনীর বিষয় আলাদা, কিন্তু গত শতাব্দীর এক সুখ্যাত গল্পকারের একটি গল্পের প্রেক্ষাপট ও কিছু চরিত্র এতে ব্যবহার করা হয়েছে— সে ঋণ স্বীকার করা রইল মুখ্য পাত্র-পাত্রীর অপরিবর্তিত নামকরণে। আশা করি সহজেই ধরা যাবে সে গল্পের নাম। বাড়তি সংকেত হিসেবে গত সত্তর দশকের গোড়ায় ওই গল্প অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রভাবটিও সচেতনভাবে উপস্থাপনায় রাখা হয়েছে।