- দেশের জন্য কাঁচুলি পরতে পারিস?
হতভম্ব হয়ে চুপ করে রইল কিশোরটি। দেশের জন্য কী করতে পারিস - এ প্রশ্নের সম্মুখীন এর আগেও বার বার হতে হয়েছে তাকে। আর প্রত্যেকবারই সে বুক চিতিয়ে জবাব দিয়েছে - পারি। প্রাণ দিতে পারি।
কিন্তু কাঁচুলি পরা?
আজকের এই প্রশ্ন শুধু অপ্রত্যাশিত নয়, অদ্ভুতও। অন্য কেউ এ প্রশ্ন করলে সে হয়তো উড়িয়েই দিত হেসে, কিম্বা অপমানিত বোধ করে ঝাঁপিয়ে পড়ত প্রশ্নকর্তার ওপর। কিন্তু এ প্রশ্ন যিনি করেছেন, তিনি ঠিক মজা করার মেজাজে আছেন বলে তো মনে হচ্ছে না!
কাঁচুলি সে চেনে, বিলক্ষণ চেনে। বাংলায় ও জিনিসটার রেওয়াজ আগে ছিল না, এখনই যা ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে; মা-ঠাকুমাদের অনেকেই এখনও শুধু শাড়িই জড়িয়ে রাখেন গায়ে, কাঁচুলি নয়। বাংলার বাইরে উত্তরখণ্ড বা পাঞ্জাব প্রদেশে গিয়ে অবশ্য মেয়েদের পরণে আকছার সে দেখেছে কাঁচুলি বা চোলি। দেখেছে সালওয়ার কামিজও।
তা বলে তা পরতে জানতে হবে, এ কেমনধারা কথা? তাও আবার দেশের জন্য?
কিশোরটি হাঁ করে তাকিয়ে থাকল আরও কিছুক্ষণ।
*****
পিছিয়ে যাওয়া যাক বছরখানেক। সেটা ১৯১১ সাল।
কলেজ স্ট্রিট আর হ্যারিসন রোডের ক্রসিং-এ তখন মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়নি ওয়াই এম সি এ বিল্ডিং। তার জায়গায় ছিল নিতান্ত দেশি মতে নির্মিত একটি ছোট্ট দোকানঘর - যার পেছনে মাথা গোঁজার মতো কয়েকটি খুপরিও করা রয়েছে।
দোকানের নাম ‘শ্রমজীবী সমবায়’। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঝড়ে যখন সমস্ত বাংলায় বিলিতিবর্জন ও স্বদেশি ব্যবহারের ধুম প্রথম ওঠে, তখনই ক্ষীরোদ গাঙ্গুলি, অমরেন্দ্রনাথ, আরও কয়েকজন ছোকরা মিলে খুলেছিল এই দোকান। বাংলার গরিব শ্রমজীবিদের উৎপাদিত দ্রব্য এখান থেকে সরাসরি খোলা বাজারে বিক্রি করে লভ্যাংশের বেশিরভাগটুকু তাদের পৌঁছে দেওয়া হবে - এমনটাই শোনা গেছিল তখন।
এখন অবশ্য দেখে মনে হয় না, দোকানটা তেমন ভালো চলে। লোকজনের আনাগোনা লেগে থাকে বটে, কিন্তু তারা যে হাত ভর্তি করে জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যাচ্ছে, এমনটি তো চোখে পড়ে না।
নদীয়া থেকে আসা দুটি ছেলে এখন দোকানে বসে, কতই বা বয়স! তারা নাকি জেঠতুতো-খুড়তুতো ভাই। দিব্যি এক্সারসাইজ করা পেটানো চেহারা - দেখেই মনে হয় ভালো ঘরের। কীসের টানে যে বাড়িঘর ছেড়ে এখানে পড়ে আছে, কে জানে! অথচ মুখে কষ্টের লেশমাত্র নেই। দিব্যি খদ্দেরদের জিনিসপত্র দেখাচ্ছে, দরকষাকষি করতে গেলে দেশের শ্রমজীবিদের দুর্দশার কাহিনী শোনাচ্ছে, আর পেছনের খুপরিগুলোতেই যা-হোক কিছু ফুটিয়ে খেয়ে রাতটুকু কাটিয়ে দিচ্ছে।
সেদিনও, একটু বেলার দিকে পসরা সাজিয়ে বসেছিল দু-ভাই, দোকানে আর কেউ নেই তখন। বুড়োটে এক খদ্দের আচমকা এ-দিক ও-দিক দেখে চট করে ঢুকে এলো দোকানে। ঘষা চশমার আড়াল থেকে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় জিগ্যেস করল, সখারাম গণেশ দেউস্করের দেশের কথা বইটা আছে?
কিশোর দুজন মুখ তুলে চাইল। বয়সে যে সামান্য ছোট, সে বলল, জানেন না, ও বই নিষিদ্ধ?
তা জানি, তবে, স্বদেশি দোকান তো…
আপনি কি ইংরেজের টিকটিকি নাকি মশায়? ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে বড়টি - কী মতলব আপনার বলুন তো?
ওরে থাম থাম! ব্যতিব্যস্ত বুড়ো ততক্ষণে চশমায় এক টান মেরে খুলে ফেলেছে, তারই সঙ্গে ধুতির খুঁটে মুছতে শুরু করেছে মুখ।
- অমরদা! একসঙ্গে বিস্ময়ে আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল দুই কিশোর।
- চুপ চুপ! কে কোথায় শুনে ফেলবে আবার… অমরেন্দ্রনাথের গলায় সতর্কতা - এমনিতেই আজকাল যা টিকটিকির বাড়বাড়ন্ত চারদিকে… ছদ্মবেশে না এলে মুশকিল।
দু-ভায়ে মিলে অমরেন্দ্রকে একরকম টেনেই নিয়ে গেল ভেতরের খুপরিতে। ছদ্মবেশ দেখেই তারা আঁচ করে নিয়েছে, কিছু একটা গুরুতর ব্যাপার আছে। নইলে অমরদা তো নিজেই এসে দোকানে বিক্রিবাটার তদারকি করে গিয়েছে কিছুদিন আগেই।
কী হয়েছে অমরদা? কোনো জরুরি খবর?
অমরেন্দ্র চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। যতই নির্মোহ হওয়ার শপথ নিন, যতই জানা থাকুক বলিদান ছাড়া পূজা সিদ্ধ হয় না, তবু স্নেহ তো স্নেহই। তিনি জানেন, আজ যা বলতে যাচ্ছেন, তার থেকে কোনো পশ্চাদপসরণ নেই। কোনো দ্বিতীয় বিকল্প নেই।
ধীরে ধীরে, বড়টির দিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, তোর ডাক এসেছে। যেতে হবে।
শোনামাত্র, না ভয়ে নয়, গর্বে-আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল কিশোরটির মুখ। এ গর্ব যোগ্যতার গর্ব, এ আনন্দ সেবার আনন্দ। চোখের জল মুছিয়ে দেওয়ার আনন্দ।
ছোটোটির মুখ ওদিকে কালো হয়ে এসেছে ততক্ষণে। ভাবখানা, ওর পালা কবে আসবে?
অমরেন্দ্র সে-দিকে চেয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও পারলেন না। হ্যাঁ; মা কতগুলো ছেলে পেয়েছে বটে!
*****
চন্দননগর থেকে একটি ছোট্টখাট্ট ছেলে প্রতিদিন এতটা রাস্তা উজিয়ে পড়তে যায় কলকাতা। স্কটিশ চার্চ কলেজে। সহপাঠীরাও ওকে আলাদা করে চেনে - কারণ, আর ক’টা মাস গেলেই সে-ই হবে সারা চন্দননগরের প্রথম সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট। যদিও কলেজের প্রফেসরদের ধারণা, ছোকরা থিওরির থেকে প্র্যাক্টিকাল নিয়েই মেতে থাকে বেশি - বিশেষ করে কেমিস্ট্রি। এ-কম্পাউন্ডের সাথে ও কম্পাউন্ড মেশাতে তার যে কী উৎসাহ! প্রফেসররা যত বারণ করেন, ওরে, ওভাবে একের সাথে অন্য কম্পাউন্ড হুট করে মেশাস না, হিতে বিপরীত হয়ে বিস্ফোরণ হবে, ততই যেন তার আমোদ যায় বেড়ে। চন্দননগরের ডাক্তার নগেন দত্তের বাঁধা কেমিস্ট আছে জেনেই বোধ হয় তাঁর কাছে ঘুরঘুর করে প্রায়ই; তেমনি আবার রিপন কলেজের প্রফেসর সুরেশ দত্তের পার্শিবাগানের বাড়িতেও আনাগোনা করে বলে শোনা যায়। ওর বাড়ির পেছনের জংলা জমি থেকেও প্রতিবেশীরা মাঝে মাঝে পান উৎকট আওয়াজ আর অ্যামোনিয়া কিম্বা গন্ধকের কটু গন্ধ। আন্দাজ করেন, পাগল ছেলের আর-একটা কেমিকাল এক্সপেরিমেন্ট বোধ হয় ফেল হলো।
১৯১১ সালের কালীপুজোর রাত্রে এই ছেলেটিকেই দেখা গেল, একটা চাদরমুড়ি দিয়ে বেরোচ্ছে বাড়ি থেকে, বিড়বিড় করতে করতে - টোটাল ওয়েট - ওয়ান পাউন্ড ইলেভেন আউন্স, কেস - ওয়ান আউন্স, পিকরিক অ্যাসিড পার্সেন্টেজ…
হাতে অবশ্য বই না, একটা সিগারেটের টিন।
রাস্তায় বেরিয়ে বাজি ফাটানোর বা হাউইয়ের রোশনাই দেখার ফাঁকে যে-কজন পাড়াপড়শি ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিল, তারা একটু বিস্মিতই হয়েছিল। রাস্তাতেও পড়া মুখস্থ করছে সে ভালো কথা, কিন্তু নায়েকবাড়ির এই বইমুখী ভালো ছেলেটি আবার সিগারেটের নেশা কবে ধরল?
বিস্ময়টা আরও বেড়ে গেল ছেলেটি ঘন্টাখানেক কী দেড়েক পর মুখ চুন করে ফিরে আসায়। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, কী-একটা কারণে যেন একেবারে মুষড়ে পড়েছে ও। হাতে সিগারেটের টিনটা নেই।
পরের দিন থেকেই ওই জংলা জমির পাশ দিয়ে আরও ঘন ঘন ভেসে আসতে লাগল উৎকট আওয়াজ আর অ্যামোনিয়া-সালফারের ধোঁয়া। ছেলেটির যেন রোখ চেপে গিয়েছে - এক্সপেরিমেন্টটা সফল না হলে শান্তি নেই।
*****
দুদিন পরেই শ্রমজীবী সমবায়ের সেই কিশোরটিকে দেখা গেল - না, কোনো বিপ্লবী জমায়েতে নয় - হাওড়া স্টেশনে, এক জামাইমার্কা বাঙালিবাবুর সঙ্গে। ওপরতলার সে-রকমই নির্দেশ - এই ভদ্রলোকের রাঁধুনি ঠাকুরের ভূমিকাই আপাতত ধার্য হয়েছে তার জন্য। সে-কাজ করে যে ভারতমায়ের কী লাভ হবে, তা বুঝছে না অবশ্য সে। তবে, কলেজ স্ট্রিটের খুপরিতে থাকার দৌলতে রান্নাবান্নাটা সে ভালোই শিখে গিয়েছে অ্যাদ্দিনে - এই যা ভরসা।
লোকটা ভালো, না খারাপ - তা-ও তেমন মাথায় ঢুকছে না ওর। দলের আজ্ঞা, যা বলবে লোকটা, যেন অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়। যেন বাবার চেয়েও বেশি মান্য করা হয়। কিন্তু এ-লোকটার যা সাজপোষাকের বহর আর পান খাওয়ার ঘটা দেখা যাচ্ছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে, আর যাই হোক, বিপ্লবী আন্দোলনে অংশ নেওয়া এর কম্মো নয়।
তবে এ কে? পুলিশের কোনো টিকটিকি? সেজন্যেই কি একে নজরে রাখাটা দরকারী?
ভাবতে ভাবতেই চিন্তায় ছেদ পড়ল কিশোরের - ডাক পড়েছে আবার। গলাটাও কী বিশ্রী, জড়ানো, চিবোনো।
- বিশে, অ্যাই বিশে!
এও এক জ্বালা বটে! অমরদার সঙ্গে যখন প্রথম লোকটার বাড়ি যায়, একঝলক দেখেই লোকটা জিগ্যেস করেছিল - বাঃ, বেশ। এ-ই তা হলে আমার নতুন রান্নার ঠাকুর?
অমরদা জবাব দিয়েছিলেন - আজ্ঞে। এর নাম…
কথা শেষ হওয়ার আগেই উত্তর এসেছিল - আরে কাজ নিয়ে কথা, নাম হলেই হলো একটা কিছু। ওকে আমি নাহয় বিশে বলেই ডাকব। আর তুই আমাকে ডাকবি কর্তামশায়। কী রে ছোকরা, মনে থাকবে তো?
সেই বিশে-ই চলছে অতএব। বিরক্তি চেপে কিশোর দৌড়ে গেল কর্তামশায়ের কাছে।
তাম্বুলরঞ্জিত ওষ্ঠাধর বাঁকিয়ে কর্তা তখন এক হাতে লটপটে কোঁচা সামলাতে ব্যস্ত। অন্য হাতে রূপো বাঁধানো ছড়ির মুঠ। গায়ে গিলে করা পাঞ্জাবি আর এন্ডির চাদর ফুরফুর করে উড়ছে। পায়ের কাছে রাখা আছে কালো চামড়ার একটা ব্রিফকেস - কে জানে, কুমিরের চামড়ারই হয়তো বা। বিশে গিয়ে পৌঁছোতেই একগাদা নোট বার করে দিয়ে বললেন, যা দিকিনি, দুটো পাটনার টিকিট কেটে আন গিয়ে। সময় বেশি নেই।
বিশে দৌড়োনো শুরু করল প্রায়। আর শুনতে পেল, পিছন থেকে সেই পানের রস মাখা অননুকরণীয় জড়ানো গলায় কর্তামশায় চ্যাঁচাচ্ছেন, যদি বক্তিয়ারপুরে পাটনা মেল দাঁড়ায় তাহলে বক্তিয়ারপুরই নিস, নাহলে পাটনা-ই…
ছোটার সময় বিশে খেয়াল করল না, তাদের থেকে খানিকটা দূরে স্টেশনের থামের গায়ে ঠেসান দিয়ে মন দিয়ে দাঁত খুঁটতে থাকা দুটো লোক কেমন সক্রিয় হয়ে উঠল কর্তার চিৎকার শুনে। চোখে চোখে কথা হয়ে যাওয়ার পর তাদের একজন রয়ে গেল ওখানে, আর একজন গুটিগুটি এসে টিকিটের লাইনে দাঁড়াল, বিশের পিছনেই।
টিকিট কিনে কর্তার কাছে যখন ফিরে যাচ্ছে বিশে, তখন টিকিট কাউন্টার থেকে পাটনারই টিকিট কিনে পায়ে পায়ে পাটনা মেলের দিকে চলল লোকটা। বিশে থার্ড ক্লাসেরই টিকিট কিনেছে, দেখেছে সে। ভিড় হওয়ার আগেই থার্ড ক্লাস কামরায় একটা সিট জোগাড় করে ফেলা দরকার...
*****
কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সদস্য কালীকৃষ্ণ ঠাকুরের পুত্র স্বনামধন্য প্রমথনাথ ঠাকুর নেহাত শখেই একখানা বাংলো বানিয়েছিলেন দেরাদুনে। ন-মাসে ছ-মাসে ঠাকুর পরিবারের কেউ কখনো বেড়াতে আসে; তা না হলে ফাঁকাই পড়ে থাকে বিঘেখানেক আমজামের বাগান ঘেরা ছোট্ট বাড়িটি।
তারই পাশে, আউট-হাউস অর্থাৎ কেয়ারটেকারের জন্য বরাদ্দ বাসায় থাকেন কেয়ারটেকার অতুলকৃষ্ণ বসু। বাঙালির ছেলে, দিব্যি আমজাম খান আর বাকি বাগানটুকু ইজারা দিয়ে দু’পয়সা উপরি আয় করেন। কোনো ঝুট-ঝামেলা নেই, অসুবিধের মধ্যে বাংলোটা লোকালয় থেকে একটু দূরে হওয়ায় সকাল সকাল বেরিয়ে দিনের বাজার করে আনতে হয়।
এদিনও সেরকমই সকাল সকাল উঠে বাজারে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন অতুলকৃষ্ণ। হঠাৎ চোখে পড়ল, দরজার তলা দিয়ে একটা চিরকুট কে-যেন গলিয়ে দিয়ে গিয়েছে।
চিরকুটটা খুললেন তিনি। চেনা হাতের লেখায় লেখা আছেঃ পাখি বাসায় ফিরিতেছে, সঙ্গে ছানা। দানাপানির ব্যবস্থা রাখিও।
যেন একটা শিহরণ বয়ে গেল অতুলকৃষ্ণের শরীর জুড়ে।
*****
খোলা খোঁচা আর ফিনফিনে চাদর সামলে যে ওভাবে ছোটা যায়, তা যেন বিশ্বাসই হতে চাইছিল না বিশের।
নদীয়ার পোড়াগাছা গ্রামের ছেলে সে। সাঁতার কাটতে, দৌড়োতে, গাছ বাইতে তার জুড়ি নেই। উপরন্তু সমিতিতে ব্যায়াম করে করে তার শারীরিক সক্ষমতা এখন দস্তুরমতো ঈর্ষণীয়। কিন্তু সে-ও ফেল করে যাচ্ছিল কর্তার পিছু পিছু দৌড়োতে, যাঁর চেহারাটা পেটানো তো নয়ই, বরং স্থূলকায় বললেই ঠিক হয়।
বিশে টিকিট নিয়ে ফেরার সময়েই দিব্যি দেখা যাচ্ছিল, সামনেই একনম্বর প্ল্যাটফর্মে ধোঁয়া ছাড়ছে পাটনা এক্সপ্রেস - তার দিকেই ব্যস্তসমস্তভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলেন কর্তামশায়। লোকটার এই এক ভালো দিক বলতে হবে, ব্রিফকেসটা নিজের হাতেই রেখেছে - অন্তত মালপত্রটুকু বইয়ে নিচ্ছে না বিশেকে দিয়ে।
কিন্তু এ কী কাণ্ড?
কামরার এক দরজা দিয়ে উঠেই উলটো পিঠের দরজা দিয়ে সোজা পাশের লাইনের ওপর নেমে গেলেন কর্তামশায়। বিশে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে দিলেন এক ধমক - নেমে আয় না হতভাগা! অগত্যা বিশেও নেমে গেল তৎক্ষণাৎ।
তারপর? দৌড় দৌড় দৌড়। কামরার আড়াল ধরে, ট্রেনের লাইন বেয়ে দৌড়। ট্রেন শেষ হয়ে যেতে লাইন থেকেই আবার উঠে যাওয়া উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্মে। সেখান থেকে ওভারব্রিজে। সেখান থেকে কেবিনঘরের পিছনে। সেখান থেকে…
ঠিক কতগুলো জায়গা ঘুরপাক খেয়েছে মনে নেই বিশের। দৌড় থামতে দেখেছিল, পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে পৌঁছেছে তারা। এখানেও একটা ট্রেন ধোঁয়া ছাড়ছে এই মুহূর্তে - তবে এটা পাটনা নয় - দেহরাদুন এক্সপ্রেস।
তারই একটা কামরায় চট করে উঠে পড়লেন কর্তা। আর উঠেই ভ্যানিশ হয়ে গেলেন বাথরুমের মধ্যে।
এতক্ষণে একটু দম নেওয়ার, ধাতস্থ হওয়ার সময় পেল বিশে। পুরো ব্যাপারটাই ভানুমতীর খেল কিম্বা স্বপ্ন বলে মনে হতে পারত ওর - যদি না একমাত্র চাক্ষুষ সাক্ষ্য দিত কামরার বেঞ্চির ওপর পড়ে থাকা ওই কালো চামড়ার ব্রিফকেসটা।
ট্রেন চলতে শুরু করতেই বাথরুম থেকে আবার উদয় কর্তার। এবার আর দৌড়বীর নয়, ফিরে গিয়েছেন তাঁর শৌখিন বাঙালিবাবু অবতারে। দিব্যি গ্যাঁট হয়ে বসে, হাতের সুটকেসটা বাজিয়ে কামরারই এক দেহাতি বিহারির তালে তাল মিলিয়ে এমনভাবে ভোজপুরী গান গাওয়া শুরু করলেন - যেন কিচ্ছুটি হয় নি।
ঘোর তখনও কাটে নি বিশের। আর সেইজন্যেই বোধ হয় ও খেয়াল করল না, স্টেশনের থামের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই দুজনের দ্বিতীয়জন কখন যেন ছুটে এসে উঠে পড়েছে ঠিক পরের কামরাটায়।
*****
মুঘলসরাই।
এখানে গাড়ি দাঁড়ায় আধঘন্টা। কর্তা নেমে গিয়েছেন একটু আগে - দাঁড়া, পুরি কিনে আনি বলে। তা সে-ও হতে চলল অনেকক্ষণ।
বসে থাকতে থাকতে কখন যেন চোখ লেগে গিয়েছিল বিশের। কার যেন হাতের চাপে চোখ খুলল ও।
‘বাবু… এ বাবু… উতর আইয়ে…’
অনুচ্চ গলায় কামরার বাইরে থেকেই জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে যে তাকে ডাকছে, সে দশাসই চেহারার একজন শিখ। দেখেই বোঝা যায়, বড়দরের অফিসার বা ওই ধরনের কিছু। পরনে স্যুট-প্যান্ট, গালে তরিবৎ করা ঘন চাপদাড়ি। মাথার পাগড়িটার যেমন জেল্লা, তেমনই আকার।
আপনি… মানে আপ…
শেয়ালদার কাছাকাছি থাকার সুবাদে ভাঙা হিন্দি একটু-আধটু আসে বিশের। তারই একটু চালাতে যাচ্ছিল সে। কিন্তু ওরই মধ্যে কান ফাটিয়ে হুইশলের আওয়াজ এলো একটা। গাড়ি ছাড়বে।
আর ওই হুইশলের ফাঁকে ফাঁকেই দাঁতে দাঁত চাপা একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ও - নেমে আয় না হতভাগা!
রোমাঞ্চিত হয়ে বিশে লক্ষ্য করল, শিখ ভদ্রলোকের হাতের ব্যাগটা তার খুব চেনা। কালো চামড়ার একটা ব্রিফকেস।
যখন যন্ত্রবৎ নেমে গিয়ে পাশের কামরায় উঠছে, তখন বিশের জানার কথা নয়, কলকাতা থেকে আসা সেই দ্বিতীয় অনুসরক ততক্ষণে হুইশলের শব্দ শুনে অস্থিরভাবে পায়চারি শুরু করে দিয়েছে স্টেশনের টয়লেটের সামনে। ট্রেন যে ছাড়তে যায়, কতক্ষণ ধরে আর জামাইবাবুটি ভেতরে থাকবে রে বাবা?
*****
দিনকয়েক পরের কথা।
দেহরাদুনের এক আমজামের বাগান দিয়ে ঘেরা ছোট্ট বাংলোয় ঠাঁই হয়েছে বিশের। কর্তাও এখানেই থাকেন। সকাল সকাল উঠে একইসাথে ব্যায়াম আর শারীরিক কসরত করেন দুজন। তারপর কর্তা বেরিয়ে যান। বিশের ওপর ভার থাকে রান্নাবান্নার পাশাপাশি এক-একদিন এক-একরকম ‘টাস্ক’ সম্পূর্ণ করার।
কর্তামশায়ের ওপর যদিও বিশের শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছে ট্রেনের খেল দেখার পরে, তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে এখনও ধন্দ যায় নি তার। ঠিক কী করাতে চান ভদ্রলোক তাকে দিয়ে এই টাস্কগুলো করানোর মাধ্যমে?
কখনো মনে হয়, তাকে পড়াতে চান দস্তুরমতো। থরেথরে বই এনে বিছিয়ে দ্যান - কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স। কিন্তু গোড়া থেকে না, শেষ থেকেও না। খাপছাড়া ক-টা অধ্যায়। মোশন অফ আ প্রোজেক্টাইল কিম্বা মেকিং অফ অ্যামোনিয়াম সল্ট অফ পিকরিক অ্যাসিড - কে জানে কোন ছাইয়ের কাজে লাগবে। মাঝে মাঝে চিৎকার করে ওঠেন - এসব শুধু খাতায়কলমে কষলে হবে না, মাথায় গেঁথে নে একেবারে। বাস্তবজীবনে অ্যাপ্লিকেশন করতে হলে যেন এক মুহূর্তও বাড়তি হিসেব কষতে খরচ না হয়।
আবার এই লোকটিই সন্ধেবেলা অন্য মানুষ। যখন গীতা কিম্বা বিবেকানন্দের কর্মযোগ নিয়ে বসেন, কঠিন কথাগুলো সহজ করে বুঝিয়ে দেন বিশেকে, তখন কর্তাকে দেখে মনে হয় যেন ত্রিকালজ্ঞ কোনো ঋষির পুনর্জন্ম হয়েছে।
আর সেদিন তো কাণ্ডই করে বসলেন একটা। ভরদুপুরে ফিরে এসে ওকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন বাগানের একেবারে মাঝখানে। এ-জায়গাটা এতই গাছগাছালিতে ঘেরা, যে গোলাগুলি চালালেও বাইরে থেকে শোনা যাবে না। অবাক হয়ে বিশে দেখল, সেখানেই যেন কখন গাছের ডালে বিভিন্ন দূরত্বে বেশ কয়েকটা কাঠের চাকতি আটকেছেন কর্তা। জিনিসটা ও চেনে; সমিতির আখড়ায় ওরকমই একটা ছিল, যাতে সমিতির দাদারা লুকিয়ে বন্দুকের নিশানা অভ্যেস করত। ওগুলোকে চাঁদমারি বলে।
কর্তা অবশ্য ওর হাতে বন্দুক তুলে দিলেন না, তুলে দিলেন ক’টা অদ্ভুত জিনিস। মাটি-ঠাসা সিগারেটের কেস কয়েকটা। বললেন, কই দেখা দিকি, কী রকম পড়েছিস প্রোজেক্টাইল মোশন?
কেসগুলো ছুঁড়ে একের পর এক চাঁদমারিতে লাগাতে লাগাতেও বিশে এ-হেন টাস্কের ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছিল না। শুধু দেখছিল, প্রতিটি লক্ষ্যভেদের পরে কী রকম খুশি হয়ে উঠছেন কর্তামশায়।
সবক’টা কেস ছোঁড়া হয়ে গেলে কর্তা এগিয়ে এলেন ওর দিকে। এই প্রথম অপার স্নেহের সঙ্গে ওর চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললেন, টিনগুলো কুড়িয়ে রাখ। কাল থেকে এগুলো নিয়মিত ছোঁড়াই তোর শেষ টাস্ক।
কী খেয়ালে জানে না, আউটহাউস থেকে পুরোনো দাঁড়িপাল্লাটা নিয়ে টিনগুলো পরে ওজন করে দেখেছিল ও। মাটি-শুদ্ধ প্রতিটা সিগারেট কেসের ওজন এক্কেবারে এক।
ঠিক এক পাউন্ড বারো আউন্স।
*****
১৯১২ সালের ১৩ই অক্টোবর।
পাঞ্জাবপ্রদেশের লাহোর তখন যে শুধু প্রশাসনিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ, তা নয় - শিখ-পাঠান-হিন্দু এই ত্রিধারা সম্মেলনে তার সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলও যথেষ্ট পরিণত। এ-মহল্লায় শেঠেদের ভোজ হলে ও-মহল্লায় চলে গরিবনওয়াজি, এ-মহল্লা থেকে বাইজিকণ্ঠের মাতাল-করা সুর ভেসে এলে ও-মহল্লা থেকে ভেসে আসে ভজন বা সুফিসঙ্গীত।
আগরওয়াল কা আশ্রমও লাহোরের এরকমই একটি আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠান। সাধু-সন্ন্যাসীরা এখানে এলে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় বিনামূল্যে, সসম্মানে। ভেতর দিকের অপেক্ষাকৃত ছোট কয়েকটি কুঠুরিতে সাধু ছাড়াও অন্য কয়েকজন থাকে অবশ্য।
তারাই আপাতত দপদপে লণ্ঠনের আলোয় সভা করছিল একটি কুঠুরিতে জমায়েত হয়ে।
সভা প্রায় শেষের মুখে। শুধু একটা গম্ভীর গলা সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, আরেকবার শুনে নাও সবাই। বালমুকুন্দ আর দীননাথ - তোমরা লিফলেট ছাপাবে, অ্যাকশনের পরে-পরেই যেন সে লিফলেট শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে - রাস্তায়, দেওয়ালে, ল্যাম্পপোস্টে - সে দায়িত্ব তোমাদের। ডিরেক্ট অ্যাকশন করবে আমাদের বিশে, একটু তফাতে থাকবে অবোধবিহারী। কোনো কারণে বিশে ব্যর্থ হলে অবোধ অ্যাকশনে নামবে।
- আর আপনি?
- আমি কাছাকাছিই থাকব। আমার চিন্তা কোরো না।
কুঠুরিটা আস্তে আস্তে খালি হয়ে এল। তখনও জ্বলতে থাকা লণ্ঠনটার দিকে তাকিয়ে, শুধু বসে রইলেন একজন।
কর্তামশায়।
*****
১৯১৩ সালেই ৮ নভেম্বর।
পাড়ার সকলেরই এতদিনে মোটামুটি ধারণা হয়ে গিয়েছে, নায়েকদের বাড়ির ছেলেটার নিশ্চয় মাথায় বড়সড় কোনো ছিট আছে। নইলে সারা চন্দননগরের প্রথম সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট যে, সে ইচ্ছে করলেই একটা স্কুলের মাস্টার হয়ে বসতে পারত অনায়াসে। সাহেবসুবো পাকড়ে একটু তদবির করলে, চাই কী কোনো কলেজেও অধ্যাপকের পদ পেতে পারত।
কিন্তু তা না করে দিনের পর দিন বাড়ির পেছনের সেই জংলা জমিতেই তার কেমিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে মত্ত সে। ঝাঁঝালো ধোঁয়া আর পিলে-চমকানো হঠাৎ-হঠাৎ আওয়াজে পাড়াপড়শির প্রাণ যায়-যায় অবস্থা।
এদিকে মুখ ফুটে কিছু বলাও যায় না। কেমিক্যাল নিয়ে পাগলামোটুকু বাদ দিলে মণির মতো ছেলে হয় না। পাড়ার যে-কোনো দরকারে - বর্ষার সন্ধে হোক কী শীতের রাত - মণি হাজির। এই এর ছেলের অসুখ করলে নিজে গিয়ে নগেনডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ এনে দিচ্ছে, ওই মাঝরাতে কেউ মারা গেলে মড়া ছুঁয়ে একা বসে থাকছে ভোর অব্দি। শুধু ওই কেমিক্যাল নিয়ে একবার বসে পড়লেই চিত্তির - শত ডাকেও আর সাড়া পাওয়া যায় না।
এই তো, আজই যেমন কালীপুজো। পাড়ার সবাই মিলে প্রত্যেকবারের মতোই রাস্তায় বাজি পোড়াচ্ছে বা আতসবাজির শোভা দেখছে আকাশে। বাচ্চাদের মুখে মুখে ফিরছে মণিদার নাম - ওর বানানো রংবাতিগুলো নাকি দোকান থেকে কেনা রংবাতির চেয়ে অনেক বেশিক্ষণ জ্বলছে, আলোর রোশনাইও অনেক বেশি।
তা যার নামে এত জয়ধ্বনি, সে কোথায়?
মণিকে দেখা গেল, ঠিক গত বছরের মতো একটা চাদরমুড়ি দিয়ে কোথায় যেন বেরিয়ে যাচ্ছে সে। হাতে একটা সিগারেটের টিন।
ঘন্টাদেড়েক পরে আবার যখন খালি হাতে ফিরে এলো, তখন কিন্তু সে মুষড়ে নেই একেবারেই - বরং কী-যেন অধীর আনন্দে অস্থির হয়ে উঠেছে! পাড়ায় ঢুকেই সামনে যে বাচ্চাটাকে পেলো, তাকেই কাঁধে তুলে নাচাতে নাচাতে মার দিয়া কেল্লা বলে লাফাতে লাগল সে।
বাকি বাচ্চারাও এসে তাকে ঘিরে নাচছিল বটে, কিন্তু দেওয়ালির খুশিতে খুশিয়াল বাচ্চারা জানতই না, ঠিক কোন আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছে মণীন্দ্রনাথ নায়েক!
*****
১৯১৩ সালের ৭ ডিসেম্বর
এই হচ্ছে ক্লক টাওয়ার - ওই হচ্ছে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক… এই হচ্ছে বড়রাস্তা। আর এইদিক দিয়ে আসছে…
নিশাচর শহর হিসেবে দিল্লির তেমন সুনাম নেই কোনোদিনই। ডিসেম্বরের শীতে তো আরোই না। তাই দুজন আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা মানুষ ল্যাম্পপোস্টের তলায় একটা বড় ম্যাপ বার করে নিচুস্বরে যে কী আলোচনা করছিল, তা শোনার জন্য তৃতীয় ব্যক্তি ছিল না কেউ। কিছুদূরে একজন ঘুমন্ত টাঙ্গাওয়ালা ছিল যদিও - আর ছিল ক’টা কুণ্ডলীপাকানো কুকুর। ব্যাস।
ওই দুজন অবশ্য তা-ও থেকে থেকে সতর্ক চোখে চারদিক জরিপ করে নিচ্ছিল এক-একবার। সাবধানের মার নেই।
সবদিক দেখা হয়ে গেলে আবার নিখুঁত হিসেবে ফিরে যাচ্ছিল একজন - এই থাম থেকে ওই দোকানটা পঁয়ত্রিশ ফুট। এই ল্যাম্পপোস্টটা বারান্দা থেকে পঁচিশ ফুট। এই…
অপরজন মন দিয়ে শুনছিল এই কথাগুলো। শুনছিল না বলে গিলে নিচ্ছিল বলাই ঠিক। এই হিসেবের ওপরই নির্ভর করছে তাদের সাফল্য।
সবকিছু বলা আর শোনা শেষ হয়ে গেলে ঘুমন্ত টাঙ্গাওয়ালার ঘুম ভাঙিয়ে টাঙ্গায় চড়ে বসল একজন। আর একজন কিন্তু দূরত্ব বজায় রেখে পায়ে হেঁটেই মিলিয়ে গেল কুয়াশায়। শুধু সাবধানতা অবলম্বন নয়, আশেপাশের গলিঘুঁজিগুলোও চিনে রাখা দরকার।
*****
১৯১২ সালের তেইশে ডিসেম্বর।
হাত-পা টাটিয়ে উঠছিল হুকুম সিং-এর। ঠায় ঘন্টা পাঁচেক ধরে একই জায়গায় পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা কি সোজা কথা? এমনকি প্রস্রাবের বেগটুকু অব্দি চাপার উপায় নেই। অথচ মুহূর্তেও জন্যও এক পা নড়ে, কি কাজে ঢিল দ্যায় - কার ঘাড়ে কটা মাথা? বিশ ফুট দূরত্বে দূরত্বে তাই হুকুম সিং, একলাখ, রামভরোসা, নেয়ামৎ, হরজিত, সবাই সার বেঁধে দাঁড়িয়ে। আরও কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে, কে জানে?
এদিকে সামনে-পিছনে জমতে থাকা ভিড় ক্রমাগত যে শুধু তাদের গায়ের ওপর এক-একবার ঢলে পড়ছে তা-ই নয়, রাস্তায় লোক আটকানোর জন্য যে কাছিটা দেওয়া হয়েছে তা-ও টপকানোর উপক্রম করছে থেকে থেকে। অবশ্য ঘোড়ায় চড়া সাহিব সার্জেন্ট এসে পড়লেই তারা আবার চোঁ-চাঁ দৌড় দিচ্ছে উল্টোদিকে।
এতকিছুর মধ্যে হুকুম সিং-এর বিনোদন বলতে শুধু রংবেরঙের লোকজন দেখা। লাটসাহেবের এই জুলুস দেখতে শুধু দিল্লি নয়, কঁহা কঁহা মুলুক থেকে লোকজন এসেছে। এই তো একটু আগেই হুকুম সিংকে এসে পথ করে দেওয়ার জন্য কী ঝুলোঝুলি করছিল একজন পার্সি আদমি তার জনানাকে নিয়ে। মাথায় কাজ-করা কালো ভেলভেটের টুপি, গায়ে দামী ফতুয়া। তাকে কোনোমতে বিদয় করার পরই আবার এসে হাজির এক সস্ত্রীক শিখ। তারা অবশ্য রাস্তায় উঠতে চায় না, রাস্তার উল্টোদিকের বাড়িটায় যেতে চায় শুধু। আধবুড়ো শিখের যেমন তর্জনগর্জন, সুন্দরী স্ত্রীর মুখে তেমনই করুণ আর্তি।
কিছুটা গাঁইগুঁইয়ের পর, সার্জেন্ট আসছে না দেখে অবশেষে পথ ছেড়ে দিল হুকুম সিং, কাছিটাও উঁচু করে তুলে ধরল। উল্টোদিকের বাড়িটা প্রীতমদাসজির - অভিজাত এই শিখের নাম দিল্লির এ-মহল্লার বাচ্চা-বুড়ো সবাই জানে। তাদেরই রিস্তেদারের সাথে বদতমিজি হলে পরে না আবার তার চাকরি নিয়ে টানাটানি হয়!
সর্দারও দিব্যি বউয়ের কোমরে হাত দিয়ে চলে গেল চুপচাপ। সেদিকে তাকিয়ে হাসিই পেয়ে গেছিল হুকুমের। সর্দারের ভারী চেহারা, পাকা দাড়ির পাশাপাশি রোগা, ফর্সা, লম্বা বিনুনি-চোখে সুর্মার জরুটি যে কোনোমতেই ষোলো-সতেরোর বেশি হতে পারে না, তা বেশ বুঝতে পারছিল ও।
অ্যাটেনশন!
চিৎকার করে উঠল সাহিব সার্জেন্ট। হুইশল বেজে উঠল পর পর বেশ কয়েকটা। মহামহিম এসেই পড়েছেন প্রায়! আর মিনিট দশেকের মধ্যেই এসে পড়বেন।
খটাস করে হিল ঠুকে দাঁড়িয়ে পড়ল হুকুম-সমেত ওরা সবাই।
এরই মধ্যে লোকজন আবার ঠেলাঠেলি শুরু করেছে। সবাই সামনে থেকে দেখতে চায় তাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাকে। সেই পঞ্জাবি জেনানাটিকেও এক ঝলক দেখতে পেল হুকুমজি - প্রীতমদাসজির বাড়ির দোতলার বারান্দায় অন্য আর পাঁচজন জেনানার সাথে সে-ও লাট দেখবে বলে হুড়োহুড়ি লাগিয়েছে।
এখনও মিনিট পাঁচেক। ইতিমধ্যেই দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ধুলোর জাল। হুকুম জানে, ও ধুলো আভাঁ-গার্দে - অ্যাডভান্স গার্ডদের ঘোড়ার খুরের। পঞ্চাশজন অশ্বারোহী সশস্ত্র সৈনিক থাকছে লাটসাহেবের মিছিলের পুরোভাগে।
এবার চোখ তুলে অবশ্য বাকিদের ভিড়ে জেনানাটিকে আর দেখতে পেল না সে।
ততক্ষণে পঞ্চাশজন সৈনিক এসে পড়েছে, দুলকিচালে কুচ-কাওয়াজ করে যাচ্ছে তারা। তাদেরই পিছনে আসছে হাতির সার। হ্যাঁ, হাতি - প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হাতি। যেমন তাদের দাঁতের বাহার, তেমনি তাদের হাওদার ঘটা। হাওদাগুলো নির্ঘাত রূপোর, আর হাতির মাথাগুলো কি সোনা দিয়ে বাঁধানো? মনে মনেই বুঝতে চেষ্টা করছিল হুকুম সিং।
আর ঠিক এই সময়, ওর সামনেই প্রীতমদাসজির বাড়ির দরওয়াজা আবার ধীরগতিতে খুলে গেল। বেরিয়ে এল একটি বাচ্চা ছেলে। হাতে একটা সিগারেটের টিন।
হুকুম সিং চেনে না ছেলেটিকে। কিন্তু কোথায় যেন দেখেছে। কোথায়? সেটাই মনে করতে পারছিল না ও।
ততক্ষণে প্রথম হাতিতে চড়ে প্রজাদের দিকে হাত নাড়তে নাড়তে এগিয়ে আসছেন সারা হিন্দোস্তাঁর মাইবাপ, ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। পোষাক থেকে সোনা ঠিকরোচ্ছে। পাশে বসা লেডি হার্ডিঞ্জের সারা গায়ে যে কত গয়না, তার সীমাসংখ্যা নেই।
তাঁদের মাথার ওপর রূপোর রাজছত্র ধরে আছে বলরামপুর এস্টেটের রাজকর্মচারী মহাবীর সিং। ছাতা এবং আকর্ণবিস্তৃত হাসি - দুয়েরই ভারসাম্য সযত্নে রক্ষা করছে সে। আর সেই ছাতার ওপরে উড়ছে মহিমান্বিত ইউনিয়ন জ্যাক।
ভিড় এবার যেন উত্তাল হয়ে উঠল আরও। আর এই ভিড় সামলাতে সামলাতেই হুকুমের চোখে পড়ল, উল্টোদিকের গোটা ভিড়ে মাত্র দুটো চেহারা স্থির।
সিগারেটের টিন হাতে ওই বাচ্চা ছেলেটি, আর তার ফুটদশেক দূরত্বে সেই জেনানার স্বামী, পাকা দাড়ির অধিকারী সেই পাঞ্জাবিটি। তারও হাতে বাচ্চাটির মতোই একটা সিগারেটের টিন।
আর তক্ষুণি হুকুমের মনে পড়ে গেল, এই বাচ্চাটির মুখে যেন ওই জেনানাটির মুখ একেবারে কেটে বসানো।
কিন্তু কী হচ্ছে না হচ্ছে, ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই বাচ্চাটির হাত একটা নিখুঁত বৃত্তচাপ আঁকল আকাশে - আর বড়লাট হার্ডিঞ্জের হাতির হাওদায় নির্ভুল নিশানায় আছড়ে পড়ল একটা সিগারেটের টিন - যার ওজন ঠিক এক পাউন্ড বারো আউন্স।
মোশন অফ আ প্রোজেকটাইল!
তারপরের ব্যাপারটা খুবই আবছা মনে আছে হুকুমের। চিৎকার, দৌড়োদৌড়ি, মহাবীর সিং-এর রক্তাক্ত নিষ্প্রাণ দেহটা ঢলে পড়া, হাওদা আর পতাকায় আগুন লেগে যাওয়া, উন্মত্ত হাতির তাণ্ডব, ভাইসরয়ের স্ত্রী-র কান্না…
এসবের মধ্যে শান্তভাবে সরে গিয়েছে শুধু দুটো চেহারা।
এক, পাঞ্জাবি হরবন্সলাল ওরফে কর্তামশায় ওরফে চূচেন্দ্রনাথ ওরফে আমিরচাঁদ ওরফে… নাঃ, পিতৃদত্ত নামটা তাঁর জানত না প্রায় কেউই। রাসবিহারী, রাসবিহারী বসু।
অন্যজন, যে কিছুক্ষণ থমকে ছিল কর্তামশায়ের একটা প্রশ্নে -
দেশের জন্য কাঁচুলি পরতে পারিস?
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর হয়তো নদীয়ার সেই দুর্দম কিশোরের উত্তর ছিল বঙ্কিমের ভাষায় -
“জীবন তুচ্ছ; সকলেই ত্যাগ করিতে পারে।
আর কি আছে? আর কি দিব?
তখন উত্তর হইল, ভক্তি।”
সে-ই নিখুঁত পাঞ্জাবী যুবতীর সাজে ভাইসরয়ের মিছিলের মধ্যে পথ করে নেওয়া বিশে ওরফে বসন্ত বিশ্বাস। শহীদ বসন্ত বিশ্বাস।
সেই এক ২৩শে ডিসেম্বরে, অনেকক্ষণ ধরে ভারতের রাজধানীর রাস্তায় ধুলোমাখা হয়ে, দাউ দাউ করে পুড়ছিল ভাইসরয়ের মাথার ওপর থেকে খসে যাওয়া একটা ইউনিয়ন জ্যাক। অনেক, অনেকক্ষণ ধরে।