“কার্তিক গিয়ে অঘ্রান আসছে। তিস্তার পারের এদিকটা একটু ফাঁকা ফাঁকা। নদীর মাঝে বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে চর জেগে রয়েছে। সেই আদিগন্ত বিস্তার করা চরে কাশ ফুটেছিল শরৎকালে। সেই কাশফুল শুকিয়ে আসছে। সবুজ পাহাড়ের গন্ধ মাখা বাতাস বইতে শুরু করেছে কিছুদিন হল।” ১নদীর ধারে ঠাণ্ডা হাওয়ায় দেখি কলেজ পড়ুয়া একটি গ্রুপকে। দুপুর থেকে ক্লাস কামাই করে তিস্তার ধারে আড্ডা দিচ্ছে আকাশ, নীল, অলিভিয়া, দিয়া ও তিথি। তাদের কথার সূত্র ধরেই জানতে পারি তিথির ‘ভ্যালেন্টাইন’ সুমন। বলে রাখা ভালো, মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের ‘বসন্তপথ’ উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা-- সুমন ও তিথি। সুমন নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাড়ি ডুয়ার্সের পাতাঝোরায়। জলপাইগুড়ির একটি মেসে থেকে কলেজে কম্পিউটার সায়েন্সে অনার্স নিয়ে পড়ত। বাবার মৃত্যুর পর উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়। প্রাইমারি স্কুল টিচারের চাকরি পেয়েও যায়। তাদের কথোপকথনে প্রথম পাই ‘বসন্তপথ’- এর উল্লেখ—
“… আদি অনন্তকাল ধরে প্রেমিক- প্রেমিকা যে পথ ধরে হেঁটে এসেছে, তুমি তাকে ডাকতে পারো বসন্তপথ বলে।” ২শুধু তাই নয়, তিথি বলে—
“গন্তব্যে পৌছানোটা বড় কথা নয় সুমন। দু’জনে একসঙ্গে হাঁটাটাই বড় কথা। কী ভালই না হত, তোমার সঙ্গে এই বসন্তপথ দিয়ে যদি অনন্তকাল ধরে হেঁটে যেতে পারতাম।” ৩চাকরি পাওয়ার পর সুমন জলপাইগুড়ির পাঠ চুকিয়ে পাতাঝোরায় চলে যায়। সুমনের সঙ্গে একমাত্র মেয়ে তিথির প্রেম মেনে নিতে পারে না উৎপলেন্দু। তিথি বন্ধু অলিভিয়ার বাড়ি গিয়ে থাকতে শুরু করে এবং সেখান থেকেই কলেজ করতে থাকে।
সুমনের স্কুলের হেড মাস্টারের চার্জে থাকা মধুসূদন রায়ের সূত্র ধরে লেখক আঞ্চলিক ইতিহাসের কথা তুলে আনেন আখ্যানে। আমরা ময়নাগুড়ির নামের উৎস হিসেবে জানতে পারি—
“অনেকের মতে মইনমাতা হলেন রানি ময়নামতী।... আসামের ঐতিহাসিক রাজমোহন নাগের ‘কোদালী রাজা’ বই আবার অন্য কথা বলে। মইনমাতা হলেন কামরূপের পালবংশের নৃপতিধর্মপালের বোন। ধর্মপালের সঙ্গে তিস্তা নদীর ধারে তাঁর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ধর্মপাল হেরে যান। ময়নাগুড়ির রেলগেট সংলগ্ন অঞ্চল আর রামশাইয়ের কাউকার গ্রামে মউনমাতা গ্রামদেবী হিসাবে পূজিত হন। এখানে মউনমাতার বাহন হল বাঘ।” ৪উত্তরবঙ্গের প্রবল শীত, কুয়াশার কথা পাই আমরা। আলুর ধসা রোগের প্রসঙ্গ, বিকল্প চাষ হিসেবে স্ট্রবেরির উল্লেখ আখ্যানকে মাটির কাছাকাছি নিয়ে আসে।
সুমন আর তিথি রেজিস্ট্রি করে ৭ জুলাই। সপ্তম মাসের সপ্তম তারিখটিকে ঘিরে জাপানে তানাবাতা উৎসব হয়। এর মূলের ‘ইন্টারেস্টিং’ গল্পটির সূত্র ধরিয়ে দেয় তিথি—
“এ হল একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর মিলনের গল্প। তারপর আবারও দূরে চলে যাবার কাহিনি।”৫এর মধ্যে দিয়ে লেখক যেন সুমন ও তিথির ভবিষ্যৎ জীবনের আগাম ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন। তানাবাতার কাহিনির সঙ্গে নিজেদের জীবনের মিল খুঁজে পেয়েছে সুমন। তিথিকে বলছে—
“মনে হচ্ছে তুমি যেন সত্যি সত্যি সেই স্বর্গের দেবী তানাবাতা। পালকের পোশাকটা হারিয়ে ফেলেছ বলে আশ্রয় নিয়েছ এই কৃষকের বাড়িতে। এই পর্ণকুটীরে দু’দিনের অতিথি তুমি। সেই আশ্চর্য পোশাকটা খুঁজে পেলেই তুমি আবার ফিরে যাবে স্বর্গে আর একেবারে ভুলে যাবে আমাকে।” ৬এখানে একটি বিষয় বলার, বাবা-মাকে না জানিয়ে তিথির বিয়ে করার সিদ্ধান্ত পাঠক সহানুভূতির সঙ্গে মেনে নিয়েছে। লেখকের সুনিপুণ আখ্যান-কৌশলে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছে চরিত্ররা। উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে তিথির সহজ সরল জীবনের প্রতি আকর্ষণ পাঠকের মনের অন্দরে লালিত গোপন ইচ্ছেদের উসকে দেয় যেন। গ্রাম ও শহর পরস্পর পরস্পরের কাছে অপরিচিত, তিথি কি এই উপন্যাসে দুই পরিসরের মধ্যে সংযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে? মধুসূদন রায় তিথিকে ‘হাওয়ালি’ লোককথার সম্বন্ধে বলেন—
“ধরুন, মাঠের অনেকটা কাদায় খুব তাড়াতাড়ি ধানচারা তুলে বসাতে হবে কিংবা কোনও কারণে বাড়িতে তাড়াতাড়ি একটা ঘর বানাতে হবে। তখন গ্রামের সব লোক হাত মিলিয়ে সে কাজটা তুলে দেবে। একেই বলে ‘হাওয়ালি।’ টাকাপয়সার ব্যাপার নেই। যার কাজ, সে সকলকে ডাল-ভাত, মাছ-ভাত — যার যেমন সামর্থ্য, খাওয়াবে।” ৭শহরের বিচ্ছিন্ন জীবনের উল্টোদিকে গ্রামের যৌথতার চরিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেন আখ্যানকার। মধুসূদন রায়ের সংগ্রহশালায় কী কী আছে যখন জানতে চায় তিথি, সুমন বলে—
“মোষের গাড়ি, গোরুর গাড়ির চাকা, মোষের গলায় বাঁধা ঘন্টা, মাছ ধরার বাঁশের তৈরি টেপাই, জলোঙ্গা, চেকরি, কোঁচা যেমন আছে, তেমনই আছে পানীয় জলের জন্য বাড়িতে তৈরি করা কুয়োর রিং, বিত্তি, হেইতি। এ ছাড়াও আছে দশরকম প্রজাতির ধান, যা একসময় পাতাঝোরায় চাষ হত।”৮যা হারিয়ে যায় তাকে আগলে বসে থাকতে হয়, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরেই। কৃষিকেন্দ্রিক উপাদানের সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার মধ্য দিয়ে এই উপন্যাস সচেতন করতে চায় আমাদের অতীত, ঐতিহ্যের প্রতি। আউটসাইডার তিথির গ্রামকে আপন করে নেবার জন্যই ভেতর থেকে জানা প্রয়োজন। শুধু জানা নয় অনুভব করাও। কুড়ি সংখ্যক পরিচ্ছেদ শুরু হয় জলমাঙ্গা ব্রতের গানের মধ্য দিয়ে—
“হামরা জলমাঙ্গরা আইসাই গো জলাইশরী/ জল দিয়া করকেনি বিদায় গো জলাইশরী/ হাসরা জলের তানে বেড়াই বাড়ি ঘরে গে জলাইশরী/ জল দিয়া করকেলি বিদায় গে জলাইশরী।”৯মধুসূদন রায় বলে চলেন—
“রায়ডাক থেকে গঙ্গা, এর মধ্যে বিচিত্র, বিস্তীর্ণ ভূভাগ, তাকেই আমরা বলি উত্তরবঙ্গ। লোকসংস্কৃতির এক অনন্ত ভাণ্ডার রয়েছে এখানে। মালদার গম্ভীরা জারি সারি, মুর্শিদা — দিনাজপুরের খন বাউল নটুয়া, দার্জিলিং পাহাড়ের পাদদেশের লাহাংকারী রাবণগান, জলপাইগুড়ির ভাওয়াইয়া, মেচেনি, তিস্তাবুড়ির আর সত্যপীরের গান, চোরচুন্নি কিংবা পালাটিয়ার পাশাপাশি গোয়ালপাড়িয়া ভাওয়াইয়া কুষাণ দেহতত্ত্ব ষাইটোন... লোকসংস্কৃতির এমন বৈচিত্র আর কোথায়!”১০মধুসূদন রায়, সুমন আর তিথির কথার মধ্য দিয়ে উঠে আসে হুদুম দ্যাওয়ের ব্রতের কথা। তোর্সা পির কিংবা তিস্তা নদীর স্বামী বুড়ো ধল্যার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে লেখক নদী আর মানুষের পারস্পরিক নির্ভরতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পুরাণ কথার মধ্য দিয়ে যে প্রকাশিত হয় মানুষেরই বেঁচে থাকার গান। তিথি বিষহরি পুজো নিয়ে জানতে চায়। মধুসূদন রায় বুঝিয়ে বলেন। তিথি সুমনকে বলে সে বিষহরি পুজো করতে চায়। ভাদ্র মাস চলছে। কদিন আগে সাপের স্বপ্ন দেখার পর থেকে তার মনে অস্বস্তি হচ্ছে।
সুমনের মায়ের সঙ্গে তিথির সুন্দর সম্পর্কের কথা পাই আমরা। যোগমায়া পূর্ববঙ্গ থেকে ছিন্নমূল হয়ে আসা পরিবারের গল্প শোনান। রাজবংশী ও ভাটিয়া— এই দুই জনগোষ্ঠীর মানুষদের কথাই লেখক তুলে ধরেন আখ্যানে—
‘অল্প দিয়ে সংসার কীভাবে চালাতে হয়, সেটা ছিন্নমূল বাঙালদের মতো ভাল আর কেউ জানে না।’ ১১মধ্যবিত্ত জীবনের গল্প ছুঁয়ে ফেলে পাঠকের মন। যত্ন করে সুখের বৃত্ত গড়ে তুলেছেন লেখক, পরবর্তীকালে ভেঙে দেবেন বলেই হয়তো। খিচুড়ি রাঁধতে তিথি যখন রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে, পায়ে সাপের কাপড়। হেল্থ সেন্টারে যাবার পথেই তার মৃত্যু হয়। সে খবর পেয়ে উৎপলেন্দু পৌঁছে যান পাতাঝোরায়। গিয়ে দেখেন—
“শান্ত মুখ- চোখ তিথির, মৃত্যু যন্ত্রণার লেশমাত্র নেই সে মুখে।”১২উপন্যাস মর্মান্তিক শোকের আবহ ঘনিয়ে তোলে। আখ্যানের শেষ অংশে দেখি উৎপলেন্দুর সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে উঠেছে সুমনের। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের অন্য সমীকরণ তৈরি হতে থাকে। উপন্যাসের শেষ হয় এইভাবে—
“এক আশ্চর্য নারী সহসা হারিয়ে গিয়েছে দু’জন অসমবয়সি পুরুষের জীবন থেকে। এই ধানখেত যেন এই দুই বিষাদগ্রস্ত পুরুষের সমব্যথী।... সেই পথ ধরে নিজের নিজের মতো করে অন্তর্যাত্রা করছে দু’জন পুরুষ। শেষ বিকেলের রজন হলুদ আলোয় স্বপ্নের মতো দেখাচ্ছে এই বসন্তপথ।”১৩ডুয়ার্সের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস হিসেবে ‘বসন্তপথ’ সার্থক। আবার এই অঞ্চলের গণ্ডিতেই টেক্সটটি আবদ্ধ থাকেনি। উপন্যাসের গতি, কাব্যিক বর্ণনা, পাঠযোগ্যতা এই উপন্যাসের শক্তি। উত্তরবঙ্গের মানুষের মানসিকতা যেভাবে উৎপলেন্দুর চোখ দিয়ে ফুটে উঠেছে তার প্রশংসা করতেই হয়—
“জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি রাস্তা মাঝে দীর্ঘ সময় ধরে খারাপ ছিল। পঞ্চাশ মিনিটের পথ দু’ঘন্টা লাগত যেতে। তবুও সাধারণ মানুষ নির্বিকার। যেন এটাই নিয়তি এভাবে মনে নিয়েছিল ব্যাপারটা। উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি বড় কোমল। তাই এদিকের মানুষের স্বভাবও বোধহয় নরম-সরম। শত অভাব-অসুবিধাতেও রা কাড়ে না কেউ। মুখ বুজে সব সহ্য করে যায়। এটা দক্ষিণবঙ্গের কোনও জেলা হলে প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠত।”১৪
‘মেঘের পরে রোদ’ আখ্যানের শুরুতেই পাই গোর্খাল্যান্ডের প্রসঙ্গ। আন্দোলনে সামিল হওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে বলপ্রয়োগ করা হচ্ছে এবং ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের ভয় তো আছেই। পৃথক গোর্খা রাজ্যের সমর্থক গ্রেগরি যখন তার বাবা ভিভিয়ানকে মিটিং-এ যেতে বলে, তখন ভিভিয়ান জানায় তার বাবা অর্থাৎ গ্রেগরির ঠাকুরদা ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণ করেছিল। যার নাম বদলে হয়েছিল ড্যানিয়েল লেপচা। পুরোনো ঋণ ভুলে যাওয়া উচিত নয়। ফলে এই আন্দোলনের সঙ্গে নাড়ীর টান অনুভব করে না সে। পিতা-পুত্রের সংলাপের মধ্য দিয়ে গোর্খাল্যান্ডের পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তিগুলিকে তুলে আনেন লেখক। ভিভিয়ানের কথা থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের মনকে চিনে নেওয়া সম্ভব—
“অতীতে কোন ভূমি কাদের ছিল, সেসব প্রশ্ন আলোচনায় উৎসাহ দিলে কিন্তু দার্জিলিঙের দেখাদেখি আলাদা করে কোচবিহার বা কামতাপুর রাজ্যেরও উৎসাহ বাড়বে। সেটা হবে আগুন নিয়ে খেলা। এর পরিণতি কী, কেউ জানে না, কোথায় গিয়ে তা শেষ হবে”১৫শান্ত অনুচ্চ স্বরে চরিত্রটি বলে চলে নিজের বিশ্বাসের সত্য। সে পথ পৃথক রাজ্যের নয়, রাজ্যের মধ্যেই কাউন্সিল গড়ে তাকে দিতে হবে আঞ্চলিক স্বশাসন। অবশ্যই দিতে হবে বাড়তি ক্ষমতা—
“... একটা কথা বুঝতে হবে লিডারদের। পৃথক রাজ্য সম্ভব নয়। সেটা কোনওভাবেই আদায়যোগ্য নয়।”১৬এই উপন্যাসে দুটি পৃথক কাহিনি চলে সমান্তরালভাবে। শেষে মিলে যায় একই সঙ্গে। ঘটনা- দুর্ঘটনায়। যাইহোক, প্রথম কাহিনির সূত্র ধরে আমরা এরপর সপ্তম পরিচ্ছেদে দেখতে পাই মিটিং-এর দিন ভিড়ে গাদাগাদি সভায় পাহাড়বাসী মানুষের বঞ্চনার কথা উঠে আসছে নেতাদের বক্তব্যে—
“...দার্জিলিংকে বলা হয় পাহাড়ের রানি। রাজা বলা হয় না। অর্থাৎ দার্জিলিং কোনও রূপবান যুবক নয়, রূপসি। সবাই যেন ধরে নেয় যে, দার্জিলিং মানে রূপবতী এক নারী। যেন ইচ্ছে করলেই তাকে লুঠ করা যাবে। বাস্তবে সেই ভোগ করা হয়ত সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। তবুও এই ভাবনাটাই কাউকে কাউকে সুখ দেয়। উচ্চারণ না করা আকাঙ্ক্ষার মতো থেকে যায় মনের মধ্যে। যারা পাহাড়ে দু’দিনের জন্য ঘুরতে আসে, তারা হোটেল থেকে ম্যাল অবধি রাস্তা চিনে ভেবে নেয়, গোটা পাহাড় বুঝি তাদের চেনা হয়ে গেল। সমতলের মানুষ কর্মসূত্রে পাহাড়ে আসে। দু’-চার বছর আলগা কাটিয়ে ভেবে ফেলে, গোটা পাহাড়টাকে বুঝি জানা হয়ে গেল। কিন্তু পাহাড়ের স্বরূপ বোঝা কি অত সহজ? পাহাড়বাসীর মন বোঝা কি অত সহজ?”১৭বলাবাহুল্য লেখক এখানে অভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরেছেন অন্য বাস্তবতা। দার্জিলিং কে পাহাড়ের রানি মনে করবার মধ্য দিয়ে উপনিবেশবাদের নতুন ভাষ্য তৈরি হচ্ছে কি? সমতল আর পাহাড়ের সম্পর্কের মধ্যেও কি লুকিয়ে আছে অজানা অন্ধকার? পাহাড়ের স্বরূপকে বুঝতে হলে যে চোখ প্রয়োজন, তার সূত্র ধরেই আমাদের মনে পড়তে পারে পরিমল ভট্টাচার্যের লেখা ‘দার্জিলিং: স্মৃতি সমাজ ইতিহাস’ বইটির কথা। ভারতে শৈলশহরগুলির নির্মাণের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন—
জনমানবহীন দার্জিলিঙের কুমারী পাহাড় ব্রিটিশদের একটি ‘আবিষ্কার’ — এইভাবে দেখার পেছনে কাজ করছে ঔপনিবেশিক মানসিকতা। এই মানসিকতার থেকেই জন্ম নিচ্ছে ভিনদেশি প্রকৃতির মাঝে মাতৃভূমির নস্টালজিয়া নির্মাণের এক অত্যাশ্চর্য কর্মযজ্ঞ।১৮স্বাধীনতা-উত্তরকালে দার্জিলিং-কে কেন্দ্র করে বাঙালির ভাবাবেগ যত বেড়েছে, শৈলরানিকে তার মতো করে বোঝার চেষ্টা দেখা যায়নি। দর্শনীয় স্থানের আড়ালে প্রতিদিনের জীবন ছড়িয়ে দিয়েছে দীর্ঘশ্বাসের ডালপালা। আত্মপরিচয়ের সন্ধান করতে গিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদের সমস্যাকে বোধহয় আরো সহমর্মিতার সঙ্গে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। দার্জিলিং- এর আদি অধিবাসী লেপচারাই কিন্তু গোর্খাদের দাবিকে উপেক্ষা করা ঠিক নয়। যাইহোক, আখ্যানে এরপর দেখি নেতাদের বক্তব্যে উত্তেজিত হয়ে উঠছে জনতা। স্লোগানে গলা মেলায় গ্রেগরি আর ভিভিয়ান—
“উই ওয়ান্ট গোর্খাল্যান্ড... গোর্খাল্যান্ড দিনু পড়ছ!”১৯ভিড়ের হৃদয় স্পর্শ করেই বুঝি লেখক ভিভিয়ানকে দিয়ে শ্লোগানে গলা মেলান। এরপর দ্রুত পরিস্থিতি যায় বদলে। রণক্ষেত্রে হয়ে ওঠে সভাস্থল। চলে গুলি। গ্রেগরির চোখের সামনে তার বাবা ভিভিয়ানের সোয়েটারের উপর ফুটে উঠতে থাকে ছোপ ছোপ রক্তের কাটাকুটি। গ্রেগরি এরপর থেকেই ভুগতে থাকে মানসিক অস্থিরতায়, ওয়ার্কিং কর্পস সিনড্রোমে। অবশ্য সে রোগ ধরা পড়ে রঘুবীরের ডাক্তারের সহায়তায়। এই আখ্যানের আরেকটি কাহিনির কথা বলেছিলাম, তার নায়ক। বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে সে ডাক্তারি করে অসম আর ভুটান সীমান্তে এক গ্রামীণ হাসপাতালে। লেহ-লাদাখ ঘুরতে গিয়ে তুষারধসে স্ত্রী ও পুত্রকে হারিয়ে ফেলার পর অতলান্ত বিষাদ ও একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি পেতে ঘটনাচক্রে হাজির হয় দাওয়াপানিতে— সেই হোম স্টে চালায় গ্রেগরির ত্রী রজনীগন্ধা। রঘুবীরের সহায়তায় শেষপর্যন্ত গ্রেগরি মানসিক রোগ থেকে মুক্তি পায়। উপন্যাস শেষ হয় রজনীগন্ধার শ্রদ্ধাবনত চিত্তের অপূর্ব আত্মসমর্পণে। রজনীগন্ধার সঙ্গে রঘুবীরের কথার মধ্যেও উঠে এসেছিল জাতিভিত্তিক স্বাতন্ত্র্যের প্রসঙ্গ। রঘুবীরের কথার মধ্য দিয়েই যেন প্রতিফলিত হয় লেখকের অভিপ্রায়—
“... দার্জিলিং কসমোপলিটন শহর। কোনও ট্রাইবাল অঞ্চল নয়। এই শহরের রেস্তরাঁ, বইয়ের দোকান, ফোটো স্টুডিয়ো — সব কিছুই ইতিহাস ছুঁয়ে আছে। অথচ সেই হেরিটেজ নিয়ে কেউ ভাবছে না। এখানকার ইন্টেলেকচুয়াল লাইফের কথা সমতলের মানুষের পৌঁছায় না। এখানকার সাংস্কৃতিক স্বর নিয়েও সমতল সেভাবে ওয়াকিবহাল নয়। কিন্তু তা কেন হবে? আসল সংহতি হল মননে। ভূগোল বইয়ে নয়।”২০মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের আখ্যানভুবনে উত্তরবঙ্গের উপস্থিতি মনে রাখবার মতো। ‘জয়ঢাক’ ওয়েব ম্যাগাজিনে ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘রংঝুরি রহস্য’ কিশোর উপন্যাসেও উত্তরবঙ্গের পটভূমিকে ব্যবহার করা হয়েছে। এই উপন্যাসে ডুক্পা জনজাতির মানুষদের জীবনাচরণ, বৌদ্ধদের ধর্মবিশ্বাসের পরিচয় পাই আমরা। সবুজ সংঘের ক্রিকেট খেলার গল্প ও রংঝুরিতে কঙ্কাল কাণ্ডের গোপন রহস্যের উন্মোচন— একইসঙ্গে অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় পরিবেশন করেন লেখক। রুদ্ধশ্বাস ক্রিকেট টুর্নামেন্ট জেতার আনন্দ পাঠককে মুগ্ধ করে। কথক চপলের চরিত্র থেকে লেখককে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না আমাদের। কেননা আমরা জানি মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য দীর্ঘদিন জেলাস্তরে ক্রিকেট খেলেছেন এবং জেলার বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছেন। খেলা ও লেখা — শব্দদুটি আমাদের আরেকবার সাহিত্যের সৃজনরহস্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। ‘সূর্যাস্তের নদীর তীরে’ অলৌকিক অপেক্ষা করতে থাকে গল্পের চরিত্রেরা, পাঠক বুঝতে পারে জেগে থাকা জীবন আসলে অনিঃশেষ উপন্যাস...
সূত্রনির্দেশঃ
১. মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য, বসন্তপথ, এখন ডুয়ার্স, প্রথম সংস্করণ, নভেম্বর ২০১৬, পৃ: ৭।
২. পূর্বোক্ত, পৃ: ৩৬।
৩. পূর্বোক্ত, পৃ: ৩৬।
৪. পূর্বোক্ত, পৃ: ৪৪।
৫. পূর্বোক্ত, পৃ: ৫৫।
৬. পূর্বোক্ত, পৃ: ৫৮।
৭. পূর্বোক্ত, পৃ: ৫৯।
৮. পূর্বোক্ত, পৃ: ৬১।
৯. পূর্বোক্ত, পৃ: ৮৬।
১০. তদেব।
১১. পূর্বোক্ত, পৃ: ১০০।
১২. পূর্বোক্ত, পৃ: ১১২।
১৩. পূর্বোক্ত, পৃ: ১৬০।
১৪. পূর্বোক্ত, পৃ: ১১০।
১৫. মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য, মেঘের পরে রোদ, এখন ডুয়ার্স, জলপাইগুড়ি, প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি ২০১৮, পৃ: ৩৬।
১৬. পূর্বোক্ত, পৃঃ ৩৬।
১৭. পূর্বোক্ত, পৃ: ৪৪।
১৮. পরিমল ভট্টাচার্য, সালামান্ডারল্যান্ড, দার্জিলিং: স্মৃতি সমাজ ইতিহাস, অবভাস, কলকাতা, পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ, জানুয়ারি ২০১৫, পৃঃ ৩৬।
১৯. মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য, মেঘের পরে রোদ, পূর্বোক্ত, পৃ: ৪৬।
২০. পূর্বোক্ত, পৃ: ৯২।