ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ দশক—দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়; পত্রলেখা প্রকাশনা, কলকাতা-৯; ISBN: নেই
ভারতবর্ষের ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা কী?
ভারতবর্ষের সর্বকালের ইতিহাসে?
মানে, সেই প্রাচীনভারতে ‘শূন্য’-র আবিষ্কার থেকে ধাতুশিল্পের অগাধ উন্নতি (উদা. কুতুবপ্রাঙ্গনের লৌহস্তম্ভ) থেকে...।
না, মানে সমগ্র বা বিপুলসংখ্যক ভারতবাসীকে স্পর্শ করবার নিরিখে?
অষ্টম শতকে ভারতবর্ষের মাটিতে সাম্য ও সদ্ভাবনার বাণী নিয়ে ইসলামের প্রবেশ করা, না ১৯৪৭-এ ঐ ধর্মের ভিত্তিতেই ভারতভূমির বিভাজন হওয়াটা? (কেউ কেউ আবার ২০১৬-এ মোদিজীর নোটবন্দীর কথাও বলেছেন)। সত্যি কথা, পুণ্যভূমি ভারতবর্ষে যেমন আদি যুগ থেকে বুদ্ধ-শঙ্কর-নানক-ফরিদের মতো মহামানব জন্মেছেন তেমনি শক-হুনদল-পাঠান-মোগলের মতো আক্রমণকারীরাও এসেছে। এবং এসে মিলে মিশে গেছে এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে। এ’সব তো ইস্কুলে পড়া। এসে মিলে গেছে, আবার মেশেওনি হয়ত, নৈলে ১৯৪০-এর দশক থেকে কী এমন অসহ্য হতে লাগলো যে হাজার বছর ধরে পাশাপাশি থাকা হিন্দু-মুসলমান ১৯৪৭-এ এসে ধর্মের ভিত্তিতে এই প্রাচীন দেশটিকেই তেলের শিশির মতো ভেঙে টুকরো করে ফেললো, এবং করে ফেললো লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তক্ষয়ের বিনিময়ে আর ঘর ভাঙার বেদনা মিশিয়ে? এই ‘কেন এমন হলো’-কে খুঁজতে দেশবিদেশের ইতিহাসবেত্তাগণ কম কেতাব লেখেননি, কম গবেষণা হয়নি হচ্ছে না (ব্রিটেনের সরকারী প্রকাশনা ‘Transfer of Power Papers’ স্মরণ করুন)। কিন্তু, আমাদের বর্তমান লেখক তো না কোনো ইতিহাসবেত্তা না নতুন কোনো গবেষক। বরং ইনি ছিলেন এক সিনিয়র ব্যুরোক্রাট, ফিল্মক্রিটিক ও সাংবাদিক (NFDC-র চেয়ারম্যান ছিলেন এককালে), যাঁর হয়তো সেভাবে দেখলে systematic study of the discipline of History-তে কোনো স্বাভাবিক অধিকারই জন্মায় না। এবং সেইটেই হয়ে দাঁড়িয়েছে এই অতিসুখপাঠ্য বইখানির পরম সম্পদ--না কোনো পণ্ডিতি না ভড়ং না কোনো পূর্বনির্ধারিত ইজম্-এর প্রতি দায়বদ্ধতা। পরম মমতায় পরম যত্নে লেখক প্রামাণ্য গ্রন্থরাজি থেকে এই দেশভাগের ইতিহাস তুলে ধরেছেন, যা পড়তে পড়তে কখনও ক্রোধ কখনও আফশোষ আর শেষে ভাগ্যদেবীর পায়ে সমর্পিত হয়ে পড়তে হয়।
*
যেমন, কিছু ‘ইজম্’-বাদী শিক্ষা আমরা বয়সকালে পেয়েছিলুম যে ভারতভাগের দায় নেহ্রু-পটেলের ক্ষমতালোভে, ‘যুগ যুগ ধরে’ মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের অত্যাচারের কারণে, বঞ্চিত দরিদ্র মুসলিম কৃষক... ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ধনীশ্রেষ্ঠ বিলাসী ব্যারিস্টার মহম্মদ আলি জিন্নাহ্, যিনি চব্বিশ বছরের ছোট বিধর্মী বন্ধুকন্যাকে ফুসলিয়ে এনে শাদী করেন (ও শীঘ্রই অনুৎসাহী হয়ে ফেলে দেন), সেই পর্কাহারী অ-নমাযী অ-রোজেদার কী করে এই বঞ্চিতবর্গের নেতা হয়ে উঠলেন তার হদিশ মেলে না। ‘পাকিস্তান-প্রস্তাব’-কারী বাঙালীজননেতা ফজলুল হক ও সিন্ধুর জি এম সয়ীদ দু’জনেই পরে জিন্নাহ্র এই দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতা উপলব্ধি করেন, জিন্নাহ্ও নাকি করাচীতে তাঁর মৃত্যুশয্যায় ডাক্তারের সামনে আক্ষেপ করেছিলেন, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে, লক্ষ অমূল্য প্রাণ ঝরে গেছে। বর্তমান লেখক নির্ভয়ে এই জিন্নাহ্ সাহেবকে দিয়েই তাঁর গ্রন্থ শুরু করেছেন, এবং এক ফিকশনের গতিতে ক্রিপ্স মিশন থেকে ‘ভারত ছোড়ো’ থেকে নেতাজী সুভাষ থেকে গান্ধীর হাত দিয়ে ছুঁয়ে গেছেন এডুইনার স্কন্ধ! এবং কোত্থাও এতটুকু তথ্যবিচ্যুতি না ঘটিয়ে। তাই বড় সুখপাঠ্য এ’ বই, তাই এ’ সম্বন্ধে দু’কথা লিখতে ইচ্ছা করি।
*
অবিভক্ত ভারতে মুসলমানগণ কি পিছিয়ে ছিলেন? একদমই না, কক্ষনোই নয়। জিয়াউদ্দিন আহমদ সাহেবের মানের গণিতজ্ঞ, মোঃ শহীদুল্লাহ্র মত ভাষাতাত্ত্বিক থেকে মোঃ সালেহ্ আকবর হায়দারীর মত আই.সি.এস ও আদমজী/ইস্পাহানীদের মত ধনী ব্যবসায়ী অবিভক্ত-ভারতবর্ষেই জ্বলজ্বল করেছেন। মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাব কলকাতা ফুটবল লীগ জিতে জিতে রেকর্ড করেছে তো ‘ব্যাঙ্গালোর মুসলিমস’ পরপর রোভার্স কাপ জিতে। ঘৌস মহম্মদ উইম্বলডন খেলছেন। ব্রিটিশ সরে গেলেই কি এই অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যেতো? যুক্তিহীন কথা মুসলিম লীগের।
‘অলটারনেট হিস্ট্রি’ নিয়ে গপ্পকাহিনি তো হওথোর্ন থেকে ওয়েলস সাহেব অনেকেই লিখে গেছেন কিন্তু সাবেক ভারতবর্ষ বিভাজিত না হলে আজ সে যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এক জাতি হয়ে দাঁড়াতো তা নিয়ে কোনো alternate historic fiction লেখবার প্রয়োজন দেখিনা, কারণ আজ ভা-পা-বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাবলীর শুরু ঐ দেশবিভাগ থেকে আর শেষ আজকের ধর্মীয় মৌলবাদিতায় নয়... চলন্ত সমস্যা এ। কেবল আজকের সীমান্তের ফৌজী খরচ দিয়ে তিনটি দেশের শিক্ষা-স্বাস্থ্য সম্পূর্ণ ফ্রি করে দেওয়া যেত রে ভাই! ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ একটি আশ্চর্য তত্ত্ব! ভারতবর্ষে পাঠান-মোগলদের প্রায় হাজার বছরের শাসনামলে হিন্দুধর্ম ধ্বংস হয়ে যায়নি বরং সুদৃঢ়-সমৃদ্ধ হয়েছে। মোগল শাসনাবসানের পরে পরে ক্রমে ক্রমে ব্রিটিশ শক্তির উত্থান ও ১৮৫৭-র বিদ্রোহে ধাক্কা খাওয়া, যাতে নানাসাহেব-তাঁতিয়া তোপীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ দিয়ে ‘লড়াই’ আজিমুল্লাহ্ খান-আহমদ শাহ্ ফৈজাবাদীর। ইতিমধ্যে বঙ্গীয় রেনেসাঁসের আলোয় হিন্দু এগিয়ে গেছে অনেকটাইঃ নবগোপাল ঘোষের ‘হিন্দুসভা’ বা মহারাষ্ট্রে তিলকের ‘গণেশ উৎসব’ ও সুরেন্দ্রনাথের কংগ্রেসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আলিগড়ে স্যর সৈয়দ আহ্মেদ খানের মুসলিম গণচেতনা আন্দোলন, যেখান থেকেই ভারতীয় মুসলিমের স্বাভিমানের শুরুয়াৎ, যেখানেই সুদূর পাকিস্তানের বীজবপন। কোন্টা অনৈতিহাসিক? কোন্টা নিন্দনীয়? কোনোটাই নয়। এ’বইয়ের লেখক কিন্তু এক ইতিহাসবেত্তার নৈর্ব্যক্তিকতায় আল্লামা ইকবালের সেই প্রখ্যাত সঙ্গীতের পঙ্ক্তিতে এসে দাঁড়ান যেখানে ব্যারিস্টার-কবির গানে মুসলিম বিজয়বাহিনী গঙ্গাতীরে এসে উপনীত হয়েছে। ভাবি, ভারতীয় মুসলমানগণ কি তবে সত্যিই বিজয়ী-শাসক গোষ্ঠীই রয়ে গিয়েছিলেন? কিন্তু, মুসলিমপ্রধান প্রদেশগুলির মধ্যে পঞ্জাবের স্যর সিকন্দর হায়াৎ, শের-এ-বাঙলা ফজলুল হক, সিন্ধের আল্লাবক্স সুমরো (দ্রঃ গ্রন্থ-সমালোচনা, পরবাস ৬৪-সংখ্যা) ও পেশোয়ারের ‘সীমান্ত গান্ধী’ তো প্রবল জিন্নাহ্-বিরোধী ও দেশভাগবিরোধী ছিলেন! তা সত্ত্বেও ছলনাময়ী ভাগ্যদেবীর কোন্ অঙ্গুলিহেলনে দেশভাগ সম্ভব হলো... তার কারণ খুঁজতে ‘ডিরেক্ট একশন ডে’-র মতো সুরাবর্দী-পরিকল্পিত শয়তানীর সন্ধান করতে হবে, ঠিক যেখানটায় বঙ্গরাজের প্রতি এই লেখক একটু সদয় হয়ে পড়েছেন। যতই বেগম শায়েস্তা ইক্রামুল্লাহ্ (প্রিমিয়ারের মামাতো বোন ) তাঁর বইয়ে ছেচল্লিশের দাঙ্গার অন্য অন্য কারণ খুঁজে থাকুন, একাধিক প্রামাণ্য গবেষণা ও সাধারণ বুদ্ধিতে বঙ্গের প্রিমিয়ার কিন্তু তাঁর ঘৃণ্য ভূমিকা থেকে মুক্তি পান না।
আর বাকি থাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা ও গান্ধীজির ভালোমানুষী। চার্চিল ও তাঁর পেটোয়া ভারতসচিব ও লাটসাহেবরা খণ্ডিত ভারতই ছেড়ে যেতে চেয়েছিলেন; আর গান্ধী-রাজাজি যদি ১৯৪৪-এ জিন্নাহ্র বম্বে প্রাসাদে পনের দিনব্যাপী লাগাতার অসফল বৈঠক করে না আসতেন তো লীগ এতো গুরুত্বই পায় না। শেষাবধি, গান্ধীজির কথাই মানতে হবে, ‘Jinnah is fighting a case, not a cause.’ ভারতবিভাগ অবধারিত ছিল না, ব্যারিস্টার জিন্নাহ্ তাঁর পেশাদারী মুন্সিয়ানা দিয়ে পাকিস্তান জিতে এনে দিয়ে এক বছরের মধ্যে অতিরিক্ত সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে যক্ষায় চলে গেলেন। বীজ পুঁতে দিয়ে গেলেন আজকের ‘লস্কর-এ-তৈবা’-র। পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ ভাগ্য আর অন্য কোনোরকম হতে পারতো না। উৎসাহী পাঠক ‘ইহুদী গবেষক’ স্টিফেন কোহেনের Idea of Pakistan বইটি পড়ে দেখতে পারেন।
*
চমৎকার চমৎকার ছুট্কাহানি (anecdote) রয়েছে এই নন-একাডেমিক ইতিহাসগ্রন্থেঃ
১৯৪২-এ বম্বের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে ‘ভারত ছোড়ো’ ঘোষণার পরের ভোরে পুলিশ নেহ্রুজীকে গ্রেপ্তার করতে এসে দেখে তিনি ফুলকোর্স কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্টে বসে গেছেন দীর্ঘ কারাবাসের প্রস্তুতি হিসেবে, আর গোবিন্দবল্লভ পন্থজী তো রেগেই কাঁই তাঁর কাঁচা ঘুম ভাঙানোর জন্যে। আরেকটাঃ পাকিস্তান গড়ার পর বঙ্গীয় শিয়ানেতা ইস্কান্দার মির্জা দরবার করলেন জিন্নাহ্র কাছে, মুসলিম লীগ কর্মীদের জন্যে কিছু বিশেষ সুবিধা দেবার জন্যে, কারণ তারাই তো পাকিস্তানকে এনেছে! ‘মুসলিম লীগ পাকিস্তান এনেছে? মাই ফুট! পাকিস্তান এনেছি আমি আর আমার এই টাইপরাইটার আর এই স্টেনো!’ স্পষ্টবক্তা জিন্নাহ্র সোজা জবাব। এমন এমন রসগ্রহণ করতে হলে এই বইটি যে পড়ে ফেলতে হবে, পাঠক।
*
সবশেষে Partition Plan ঠিক যাঁর কলম দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল সেই only matriculate civil servant ভি পি মেননের কথা লেখক শ্রীমুখোপাধ্যায় যেভাবে চয়ন করে এনে শুনিয়েছেন তা আগে পড়া ছিল না। তবে, মুখবন্ধে লেখক ঐ যে বলেছেন যে বাঙলাভাষায় দেশভাগ নিয়ে এতো বড় কোনো কাজ আগে হয়নি--তাতে দ্বিমত পোষণ করি। সামনেই তো শঙ্কর ঘোষ মশায়ের ‘হস্তান্তর’-এর মতো বৃহৎ ও সিরিয়াস কাজ রয়েছে।
নতুন এই প্রকাশনালয়ের কাজ এমনিতে ভালো কিন্তু দ্বিতীয় মুদ্রণেও এতো বানান ভুল থাকবে কেন?
এই বইয়ের শেষে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণানুক্রমিক সূচি থাকবার বড্ড প্রয়োজন ছিল।
ছায়াচরাচর—সন্মাত্রানন্দ; ধানসিড়ি প্রকাশন, কলকাতা; অক্টোবর ২০১৮; ISBN: 978-93-86612-73-1
খৃষ্টীয় ষোড়শ শতকের অগ্রভাগে বঙ্গদেশ তখন পরমপুরুষ শ্রীশ্রীচৈতন্যদেবের ভক্তিরসে ডুবুডুবু--নদে ভেসে যায়--পদ্মানদীর পূর্বতীরে (আজকের ফরিদপুর জেলায়) এক ক্ষুদ্র সামন্তরাজের সভাকবির গৃহে এক শিশু জন্মগ্রহণ করিল। বাল্যকাল হইতেই তাহার মধ্যে কবিপ্রতিভার স্ফূরণ পরিলক্ষিত হয় ও সে চাহিয়াছিল কবি হইতেই। হইলে, বঙ্গদেশে আরেক নব্য-চর্যাপদ রচিত হইত কিনা তাহা সম্ভাবনার প্রশ্ন, কিন্তু তিনি হইয়া পড়িলেন পূর্বভারতের শ্রেষ্ঠ অদ্বৈতবাদী পণ্ডিত, যাঁর ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’ গ্রন্থ এই বিষয়ের উপরে লিখিত শ্রেষ্ঠ পুস্তক। শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু-প্রবর্তিত প্রেমবিগলিত দ্বৈতবাদ (পুরুষ ও প্রকৃতি = কৃষ্ণ ও রাধা) হইতে শঙ্করপ্রণীত অদ্বৈতবাদে (‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’) তাঁর উত্তরণ, সুদীর্ঘকাল কাশীধামে অধ্যাপনা ও শাস্ত্ররচনা, উত্তরকালে নবদ্বীপে প্রত্যাবর্তন ও কৃষ্ণ-প্রেমে লীন হইয়া যাওয়া--আজ এই ইন্টারনেট ও ফেসবুকের যুগে এক তরুণ সাহিত্যিক এই মহাজীবনের উপর দীর্ঘ দ্বিশতাধিক পৃষ্ঠার এক অতি মনোজ্ঞ ও গবেষণালব্ধ দীর্ঘ উপন্যাস লিখিয়াছেন সম্পূর্ণ সাধুবঙ্গভাষায়--মস্ত বড়, হাঁ, প্রকৃতই বিশেষ উল্লেখ্য এই ঘটনা। এবং, কলিকাতার ছোট্ট এক নবীন প্রকাশনালয় পরম যত্নে সেই পুস্তক পাঠকের হস্তে তুলিয়া দিয়াছেন--সেকথা বৃহত্তর পাঠকের জ্ঞাতার্থে না আনা অন্যায়। [এখানেই উল্লেখ থাকুক যে কোনো গ্রন্থের এতো সুলিখিত ব্লার্ব বিশেষ পড়ি নাই] তাই বর্তমান গ্রন্থ-সমালোচনাটির অবতারণা।
*
কেবলমাত্র তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’-ই নহে, ‘আনন্দমন্দাকিনী’, ‘প্রস্থানভেদ’ প্রভৃতি বিংশাধিক মহাগ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন এই বাঙালী মহাত্মা, যাহাদের আলোচনা বর্তমান নিবন্ধের পরিধির বাহিরে পড়িয়া যায়, এই ক্ষুদ্র কলমকারের জ্ঞানের পরিধিরও। সে-সকলের মধ্যে না ঢুকিয়া, গ্রন্থখানির শিরোনামে দৃষ্টিনিবদ্ধ হই, খুঁজিয়া পাই ছায়া-ছায়াঘেরা নায়ককে যিনি ‘কমলনয়ন’, বা ‘পদ্মাক্ষ’, বা ‘রাজীবলোচন’, বা ‘উৎপলদৃষ্টি’ নামে ছাইয়া থাকেন উপন্যাসখানির অঙ্গে অঙ্গে। জীবনীসাহিত্যে ইহা এক অভূতপূর্ব উপস্থাপনা, অনবদ্য সংযোজন! এচ জি ওয়েলস সাহেবের ‘মেন লাইক গডস্’ বা আইজ্যাক আসিমভের ‘দ গড দেমসেলভস’-এ ‘সমান্তরাল বিশ্বের’ কথা আমরা পড়িয়াছি বটে কিন্তু সেগুলি তো নিখাদই কল্পবিজ্ঞানের গল্প। কিন্তু বর্তমান লেখক যে মুন্সিয়ানায় নায়কের জীবনের একেক সম্ভাবনাকে তাহার এক এক রূপে বর্ণনা করিয়াছেন--তাহা অনবদ্য। বালক কমলনয়ন যদি রাজসভায় কবিস্বীকৃতি পাইয়া যাইত তবে কি সে শ্রীচৈতন্যদেবের পদাশ্রয়ী হইবার বাসনায় নবদ্বীপ ভ্রমণ করিত? কমলনয়ন হইতে পদ্মাক্ষে উত্তীর্ণ নায়ক এই স্থলে। অতঃপর কাশীধামে আশ্রয় লইবার পরে বঙ্গীয় দ্বৈতবাদিতা হইতে ক্রমে শঙ্করীয় অদ্বৈতবাদে নায়কের উত্তরণ । এখানেই গুরু বিশ্বেশ্বর সরস্বতীর নিকট সন্ন্যাসগ্রহণ ও মধুসূদন সরস্বতী নামপ্রাপ্তি। কিন্তু মনের দোলাচলের যে তাঁর তখনও অবসান হয় নাই। আগ্রা ভ্রমণকালে বংশীধারী কৃষ্ণকিশোরলাভ ও তাঁকে ক্রোড়ে করিয়াই বারাণসীধামে প্রত্যাবর্তন করে নায়ক। অনন্তর সেই ভারতবিজয়ী মহাপণ্ডিত যখন নবদ্বীপে ফিরিয়া আসেন, দ্বৈত-অদ্বৈতের ঊর্ধে উঠিয়া তিনি তখন কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা। এখানেই নায়ক যেন ‘রাজীবলোচন’ হইয়া তাঁর আরেক সত্ত্বায় উপনীত হন! আরেক সমান্তরাল বিশ্বে আরেক সম্ভাবনার দুয়ারে লেখক তখন পাঠককে লইয়া উপনীত । এবং, সমগ্র উপন্যাসের কাহিনীর ধারা কিন্তু কোথাওই এই ঐতিহাসিক নায়কের প্রতিষ্ঠিত জীবনীর বাহিরে চলিয়া যায় না। অনবদ্য! অনবদ্য উপন্যাস এইখানি। বাঙলাসাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন!
বাঙলাভাষায় বঙ্কিম-রমেশ-শরদিন্দুর ঐতিহাসিক-উপন্যাসের ধারাটিকে সন্মাত্রানন্দ পুনরুজ্জীবিত করিলেন--বিশেষ আনন্দের বার্তা ইহা। তবে, নামখানি এঁর ছদ্মনাম না উত্তরাশ্রমের নাম--প্রাঞ্জল হইল না। যাক্, উহাতে বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। তবে, মনে হয়, পরমকরুণাময়ের বিশেষ আশীর্বাদ ব্যতিরেক এহেন গ্রন্থ কোনো সাধারণ লেখকের কলম হইতে নির্গত হয় না। বহু গবেষণায় বহু প্রয়াসে লেখক এক বিস্মৃতপ্রায় মহান বাঙালির জীবনোপন্যাস লিখিয়াছেন—ইহা বিশেষ, বিশেষ প্রশংসার্হ।
*
একটি অন্যমত, অন্যসুর না-হয় এই ধরা থাক্ঃ
প্রত্যক্ষ উল্লেখ নাই, কিন্তু মধুসূদনের জন্মসন খৃ ১৫২৫ ধরিয়াই নিশ্চয়ই অগ্রসর হইয়াছেন লেখক (নতুবা, চৈতন্যদেবের সহিত তাঁর সাক্ষাতের সম্ভাবনাই হয় না—মৃ. ১৫৩৩ খৃ.)। এই মত মানিলে মধুসূদনের জীবৎকাল অতি দীর্ঘ ছিল (১০৭ বৎ)। কিন্তু আরেক মতানুসার, মধুসূদনের জন্ম ষোড়শ শতাব্দীর চতুর্থভাগে, যে মত অধিকতর যুক্তিসঙ্গত।
*
বাঙালী মনীষার ধারা সাংখ্যদর্শনপ্রণেতা কপিলমুনি হইতে ব্রজেন্দ্র শীল-জগদীশচন্দ্র-অমর্ত্য ধরিলে আমাদের আজকের নায়ক মধুসূদন সরস্বতীর নাম অতি উচ্চ স্তরেই আসিবে। এই স্থলে উল্লেখ করিতে ইচ্ছা করি মধুসূদনের পাণ্ডিত্যের পরিধি সম্পর্কিত প্রচলিত শ্লোকটিঃ
“মধুসূদনসরস্বত্যাঃ পারং বেত্তি সরস্বতী।
পারং বেত্তি সরস্বত্যাঃ মধুসূদনসরস্বতী”
[মধুসূদনের জ্ঞানের পরিধি কেবলমাত্র মা সরস্বতীই জানেন। আর ঁমায়ের জ্ঞানের সীমা জানেন কেবল মধুসূদনই।]
কত উচ্চস্তরের পণ্ডিত হইলে তাঁহার সম্বন্ধে এ’হেন শ্লোক বিরচিত হয়!!
অভিনন্দন ঔপন্যাসিককে। অভিনন্দন প্রকাশককে।
কিসসাওয়ালা—সৈকত মুখোপাধ্যায়; দ্য কাফে টেবল, ব্যান্ডেল, হুগলি; জানুয়ারি ২০১৮; ISBN: 978-81934239-6-7
সৈকত মুখোপাধ্যায়ের লেখা আগে পড়িনি।
সে আজকের নবীন গল্পকার ক’জনের লেখাই বা পড়েছি, ক’জনের লেখার কথাই বা বলেছি তা এই কলমের পুরনো পাতা উল্টোলেই বোঝা যাবে। কিন্তু সেটা করা উচিত। এ’পার-ও’পার বাঙলায় বেশ উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ তো হচ্ছেই, তার হদিশ না রাখলে আর যা-ই হৌক, গ্রন্থ-সমালোচক সাজা চলে না। বিশেষতঃ, যখন আজকের নতুন নতুন প্রকাশনালয়গুলি এমন উদীয়মান লেখকদের লিখনডালি এমন এমন মনোহর মোড়কে এনে উপস্থাপিত করে চলেছেন। যেমন এ’খানি। এই গল্পসংকলনের চমৎকার প্রচ্ছদ ডিঙিয়ে প্রথমেই চক্ষু আটকে যায় ‘উৎসর্গপত্রে’, যেখানে এক বরেণ্য-উন্নতশির কবির করকমল এসেছে। এঁর অনন্যসাধারণ ‘অ’ কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা আমরা পড়েছিলাম ৬৭ সংখ্যায়। শ্রদ্ধা জানালাম কিসসাওয়ালার উৎসর্গপত্রীতে।
এরপর সূচিপত্রে যে যে গল্প তাদের নামের খাতিরে চোখ আটকে নেয়ঃ ‘সেরিবান যে পথটা খুঁজেছিল’, ‘লুসিপাসের ললাটলিপি’, ‘শ্বেতযোষিৎ কল্প’, ‘স্বর্গবেশ্যার ছেলে’, ‘আগুন এবং রতিপাথর’ এবং আরও পঁয়ত্রিশটি ছোটগল্প, যাদের গড় দৈর্ঘ্য পাঁচ পৃষ্ঠার অধিক নয়। ফিকশনের গ্র.স. লেখার একটা বড় অসুবিধে আছে, আগেও বারবার বলেছি, যে গল্পটিকে না-বলে-ছুঁয়ে যেতে হয়। শঙ্কা, এই বুঝি পাঠরসটা গড়িয়ে পড়ে গিয়ে ক্রেতা/পাঠকের প্রতি অন্যায় করা হয়ে গেল; আবার, গল্পের গা না ছুঁয়ে কী করেই বা তার পরিচিতি লেখা যায়? এই অসুবিধে আরও অনেক বেশি এমন এক সংকলনের ক্ষেত্রে, কারণ গল্প ধরে ধরে চল্লিশটির আলোচনা করা অবাস্তব, ওদিকে মনেই হতে পারে ঐ গল্পটার কথা তো একটু বলা হলো না, ওটা পড়ে যে এটার চেয়েও বেশি আনন্দ পেয়েছি!
যেমন একটি গল্প, ‘মেটাল’! অবধারিতভাবে প্রেমচন্দজীর ‘পিসনহারী কা কুঁয়া’ গল্প মনে পড়ে যায়, যেখানে কুয়ো খোঁড়ার স্থান নিয়েছে ফাদার জোসেফ টুডুর গীর্জার ঘন্টা, যার শেষটা লেখক অনায়াসে মিলিয়ে দেন ‘সীমা সুরক্ষা বাহিনী’-র রাইফেলের বুলেটে। শিহরন জাগানো একটি গল্প। আর, ‘স্বর্গবেশ্যার ছেলে’ সেই গল্পটা যেটা পড়তে পড়তেই নিবন্ধের এই শীর্ষনামটা মনে এলো। এমন গল্প লিখতে অনেক অশ্রু লাগে আর অনেক সাহস লাগে রে ভাইটি! এখানে আরও যদি দু’-তিনটি গল্প সম্পর্কে দু’-চার লাইন দু’-চার লাইন লিখি তো বাকিদের প্রতি যেন অন্যায্য করা হয়। দরকার নেই তার (তবে, ‘ম্যাডাম কিউ’ এক অনবদ্য ভয়াল-বেদনার গল্প, যেটা পড়ে ভাববেন না যেন বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা। সব ভালো লেখাই কি বিদেশী ছায়ায় হতে হবে?) এমন এক বিশ্বমানের গল্পসংকলন পাঠক দু’হাত ভরে গ্রহণ করবেন, সে বিশ্বাস গড়ে উঠলো।
*
এ’ও জানা গেল যে এই লেখক কিশোরকাহিনী, সায়েন্স ফিকশন ইত্যাদিও লেখেন এবং সেগুলিরও আলাদা আলাদা সংকলন রয়েছে। পড়বার ইচ্ছা জেগে উঠলো। তবে বর্তমান প্রকাশক ব্লার্বে এই সংকলনের গল্পগুলিকে ‘মূলধারার সামাজিক মনস্তাত্বিক কাহিনী’ বলে দেগে দিয়েছেন। এ’রকম শ্রেণীবিভাগে একটু কিন্তু কিন্তু রয়ে গেল (এ কি ‘সামাজিক যাত্রাপালা’ নাকি?)। সৈকত বিগত বারো বছর ধরে বাংলার হেন নামী-অনামী পত্রিকা নেই যাতে লেখেননি (এখানে সংকলিত)। অতএব তাঁকে ‘উদীয়মান’ সাহিত্যিক বলাটা হয়ত সঠিক হলো না, তিনি ‘উদিত’-ই।
শেষে, মুখবন্ধে বলা লেখকেরই এক অনুভূতি দিয়ে শেষ করবোঃ “গত বারো বছরে বার বার এক সরাইখানা থেকে আরেক সরাইখানায়, এক তাঁবু থেকে ভিন্ন তাঁবুতে যাত্রা করেছে এই কিসসাওয়ালা। যাযাবরী প্রকৃতি তার। ...মন তার অহরহ চেয়েছে অন্য আকাশতলায় গিয়ে দাঁড়াতে। কে জানে, পরের গ্রামে কেমন ইঁদারা, কেমন মেয়েরা জল নিতে আসে সেখানে! কেমনই বা তার শরাবখানা, সমাধিভূমি, আজান-পূজন! ভাবতে ভাবতে একদিন গভীর রাত্রে কমফর্ট জোনের চেনা চৌহদ্দি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে এই বহুপথচারী...”
চলুক, চলতে থাকুক এই পথচারী। এই পঙ্ক্তিটির চাইতে ভালোভাবে আলোচ্য গল্পসংকলনের সমালোচনা আর লিখতে পারবে না এই কলমচি। তবে অপেক্ষায় থাকব আমরা এই কিসসাওয়ালার পরের স্টেশনে পৌঁছনোর ও তার গল্প শোনবার। সে গল্প আরও অশ্রু ঝরাবে আরও বিন্ বিন্ বিন্ বিন্ করে উঠবে মাথার মধ্যে--এই আশায় বসে রইলুম।
পুঃ নিবন্ধ-শিরোনাম সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিচারে। কোনো বিতর্কের শুরুয়াৎ চাই না।
অঞ্জলিঃ ১৪২৫—Greater Binghamton Bengali Association, USA; ISSN: নেই
কোথায় পড়েছিলুম ভুলে গেছি, তবে পীট সাম্প্রাসের খেলা দেখে সম্ভবত রড লেভার বলেছিলেন যে, ‘আনন্দ নেই এমন যন্ত্রের খেলা দেখে। একটাও ভুল করে না, প্রত্যেকটা ব্যাকহ্যান্ড নিখুঁত, প্রত্যেক সার্ভিস ঠিকঠাক পড়ে....’। অর্থাৎ, ‘কমতি’ থাকা জীবনের একটা সৌন্দর্য! কম আছে বলেই না পূর্ণতা আছে, আছে ঐ ফুলে-জল-দেবার ঝারি থেকে উপছে পড়ে যাওয়া পানি... ‘শিল্প’!
(এই শিবের গীতের সঙ্গে পরের গ্রন্থ/পত্রিকা-সমালোচনাটির কোনো প্রত্যক্ষ যোগ নাই কিন্তু।)
*
বঙ্গভাষায় পুজোসংখ্যা/শারদ-সংখ্যা পত্রিকা কয়টি বেরোয় প্রতি বৎসর? ঝকঝকে তকতকে দামী ও নামী হাউজ থেকে বেরোনো পুজোসংখ্যা যে সর্বদাই গুণমানে শ্রেষ্ঠ হয় না তা পাঠকমাত্রেই জানেন। চিরাচরিত কালি-কাগজ মাধ্যমের পাশাপাশি ই-মাধ্যমে প্রকাশিত পত্রিকাগুলিও আজ সমভাবে পাঠকের কাছে সমাদৃত হচ্ছে (আমাদের প্রিয় ‘পরবাস’ পত্রিকা-ই তো তার প্রকৃষ্টতম উদাহরণ)। আমাদের বর্তমান আলোচ্য পত্রিকাখানি যুগপৎ ই-মাধ্যম ও কাগজে ছেপে বেরুচ্ছে আজ বছর তিনেক। তাই এ’ এক অতি নবীন পত্রিকা, যদিও পূর্বতটের Greater Binghamton Bengali Association মাতৃ-আরাধনা করছে আজ এক দশকেরও অধিক।
শারদীয়া উৎসবের সঙ্গে সঙ্গীত ও শিল্পকে জুড়ে দেবার বঙ্গীয় অভ্যাস আজ শতাব্দীপ্রাচীন হতে চললো প্রায়, ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকার ‘বিশেষ ঈদ সংখ্যা’-ও ১৯৬০-এর দশক থেকে বেরোয় বলে জানতে পাই। এই পরিপ্রেক্ষিতেই “অঞ্জলি ১৪২৫” পত্রিকাটিকে দেখি।
*
কলকাতারই অনেক পুজোকমিটি বের করেন ‘সুভেনির’-পত্রিকা, তাতে কবিতা-নিবন্ধ-শিশুবিভাগ থাকে একটু একটু। এটা নতুন কিছু নয়। ‘অঞ্জলি’ যেন এই ধারারই এক উন্নততর রূপ। কোনো সুভেনির-পত্রিকায় এই মানের লেখা পড়িনি আগে, না তারা এতো বিপুল কলেবরের হয়ে থাকে (বর্তমানেরটি সওয়া-শ’ পৃষ্ঠাব্যাপী)।
কোনো বিশেষ লেখা ধরে ধরে আলোচনার অবকাশ নেই এই নিবন্ধে, তার প্রয়োজনও নেই। বর্তমান নিবন্ধের অবতারণা শুধু এইটাই বোঝাতে যে দ্যাখো, বঙ্গদেশ থেকে সহস্রাধিক যোজন দূরের বঙ্গভাষীগণ কীভাবে দুর্গোৎসব পালনের সুযোগে বঙ্গসাহিত্যের চর্চা করে চলেছেন, তাঁদের সুরিতা দাস, অন্যা চ্যাটার্জি, রিয়া সিং-এর মত শিশুরা কী অনবদ্য ছবি আঁকছে, তাঁদের পুতুল খান, অনন্যা দাশেরা কী চমৎকার ছোটগল্প লিখে চলেছেন--তার কিছু অনুভব ‘পরবাস’-এর পাঠকদের দেওয়া। শুধু লে-আউট আর ভারি নাম দিয়ে যে একটা পত্রিকা হয় না (ঐ পীট সাম্প্রাসের ফোরহ্যান্ডের মতো), তার জন্যে প্রাণের ছোঁয়া লাগে, সেটা দেখিয়েছেন বর্ষীয়ান প্রদীপ্তা চ্যাটার্জী (সম্পাদক)। কুর্নিশ জানাই।
*
মান্য ভাষাবিজ্ঞানী উদয়নারায়ণ সিংহ মহাশয়ের লেখা আমরা বহুকাল যাবৎ-ই পড়ছি, ভালোবেসে এসেছি। পত্রিকার প্রথম নিবন্ধখানিই এঁর, তাই পত্রিকাটির উচ্চসুর বেঁধে দিলো। বিশ্বজনীনতা ও বহুমাত্রিকতা যে ভারতবর্ষের সংস্কৃতির প্রাণ, মহিষাসুরমর্দিনীর উপাসনার অবসরে তা পুনরায় স্মরণ করি তাঁর এই নিবন্ধে। বর্ষীয়ান কবি প্রণব বসুরায় তাঁর ‘নতুন ভাষায়’ মাতিয়েছেন। অঙ্কন ও অলংকরণগুলি এই পত্রিকার প্রাণ! অমৃতা ব্যানার্জির জলরঙের ছবিতে মজি, যেমন সৌরভ ঘোষের পটশিল্পে।
*
ইঙ্গ বিভাগটিও পুষ্ট যথেষ্টই। বর্ষীয়ান অমল শাস্ত্রী মহাশয়ের ঈশ্বর সন্ধানের নিবন্ধটি হয়তো স্থানসংকুলান না হওয়ার কারণে দীর্ঘতর করা যায় নি। চমৎকার শুরুয়াৎ। যেমন, শঙ্কর চন্দের আমেরিক-মেলবন্ধনের প্রবন্ধ পড়ে আনন্দ পাওয়া গেল। আবারও বলি, এ’নিবন্ধ কিন্তু নাম ধরে ধরে অমুক অমুক লেখকের তারিফ করবার তরে নয়, এক নব-উদ্যোগের পরিচয়ের হেতু এই নিবন্ধ।
বাঙলা বানান ভুল অনেক চোখে পড়েছে। সূচিপত্রটি আরও সুন্দর সাজানো হওয়া উচিত ছিল। আরও যত্নশীল হতে হবে ভবিষ্যতে।